#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_৫,৬
#নবনী_নীলা
৫
আদিল ব্যাস্ত হয়ে চোখ রাঙিয়ে বললো,” আস্তে!” তারপর শীতল কণ্ঠে বললো,” সবকিছুতেই রাগ দেখাতে হয় নাকি?” স্নিগ্ধা দাতে দাঁত চিপে নিজের রাগ সামলে নিয়ে তাকালো, তাকে চোখ রাঙিয়ে কথা বলছে। স্নিগ্ধার তীক্ষ্ণ চাওনিতে আদিল মৃদু হেসে বললো,” সামান্য,লেহেঙ্গা সামলাতে পারছো না, আমাকে কি করে সামলাবে?”
স্নিগ্ধা কড়া চোখে তাকিয়ে রইলো তারপর ওড়নাটা হাতে নিয়ে আদিলের থেকে সরে দাঁড়ালো। আদিলের প্রতিটা কথায় তার রাগ লাগছে। সারাজীবন তার এই লোকটার সাথে কাটাতে হবে ভেবেই মাথা যন্ত্রণা করছে। স্নিগ্ধা রূমের কোথাও নিজের লাগেজ দেখতে পাচ্ছে না।
একপাশের টেবিলে কয়েকটা ড্রেস বক্সে ভাজ করে রাখা। স্নিগ্ধা বক্স খুলে হতভম্ব এইসব কি ড্রেস ! স্নিগ্ধা রিতিমত ঘামছে। স্নিগ্ধার চোখ মুখের অবস্থা দেখে এগিয়ে এসে ড্রেস গুলো দেখলো।
এইসব মোটেও সে করেনি কিন্তু স্নিগ্ধার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে সব দোষ তার। যারা এই পুরো আয়োজনটা করেছে তাদের পাকনামো এগুলো। স্নিগ্ধা মূর্তির মতন একপাশে দাড়িয়ে আছে। আদিল বেছে একটা ড্রেস আলাদা করে রেখে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বললো,” তুমি আপাদত এইটা চেঞ্জ করে নিতে পারো। আমি দেখছি।”
স্নিগ্ধা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। আদিল যেনো সে চোখের ভাষা বুঝতে পারছে। এই ড্রেস সে পড়বে না। তার লাগেজ এক্ষুনি লাগবে।
আদিল তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,” আচ্ছা, বললাম তো আমি দেখছি। কিন্তু আমার মনে হয় না তোমার লাগেজ এসেছে। তুমি এই ড্রেসটা ট্রাই করতে পারো।”
স্নিগ্ধা চোখের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ করলো। আদিল পকেট থেকে ফোন বের করে কল করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
স্নিগ্ধা আড় চোখে তার পাশে থাকা ড্রেসের দিকে তাকালো। তারপর হাত বাড়িয়ে ড্রেসটা ধরে দেখলো। ড্রেসটা অতোটা খারাপ না। আর এমনিতেও তার পক্ষে এই ভারী জামা পরে থাকা অসম্ভব ব্যাপার।
স্নিগ্ধা ড্রেসটা পরে বেরিয়ে এলো। সব ঠিকই আছে তবে গলাটা বেশি বড় বড় লাগছে তার কাছে। তবুও স্নিগ্ধা প্রশান্তির নিশ্বাস ফেললো। এতোক্ষণে সে দম নিতে পারছে।
আদিল রুমে ঢুকেই স্নিগ্ধাকে দেখে অপলকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এগিয়ে আসতে লাগলো। তারপর ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বললো,” তোমাকে সুন্দর লাগছে।”
স্নিগ্ধা ড্রেসিং টেবিলের সাথে একদম মিশে গিয়ে বললো,” আপনি এগিয়ে আসছেন কেনো?”
আদিল ঠোঁটের কোনের সূক্ষ্ম হাসি বজায় রেখে এগিয়ে এসে দুপাশে হাত রেখে বলল,” কি করবো বলো? তোমার থেকে দূরে থাকতে ইচ্ছে করে না।”
স্নিগ্ধা জড়সর হয়ে দাড়িয়ে আছে। আদিল স্নিগ্ধার দুই বাহু ধরতেই নাক মুখ কুঁচকে বন্ধ করে ফেললো সে। আদিল মৃদু হেসে স্নিগ্ধাকে আয়নার দিকে মুখ করে দাড় করাতেই স্নিগ্ধা হতভম্ব হয়ে চোখ খুললো। তারপর আয়নায় আদিলের ঠোঁটের কোনের মৃদু হাসি দেখে বুকের ধুক ধুক বেড়ে গেছে তার। আদিল হাত দিয়ে স্নিগ্ধার চুল গুলো একপাশে এনে স্থির দৃষ্টি আয়নার দিয়ে তাকিয়ে রইলো। সেই দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার সারা শরীরে এক শিহরণ অনুভব করছে।
আদিল পকেট থেকে একটা লকেট বের করে স্নিগ্ধার গলায় সেটা পরিয়ে দিতেই স্নিগ্ধা হতভম্ব হয়ে তাকালো। লকেটটা পরিয়ে দিয়ে আদিল শীতল কণ্ঠে বললো,” এটা আমার ভালোবাসার প্রথম উপহার। এই লকেটটা আমার জন্যে খুব স্পেশাল, ঠিক তোমার মতন।”
স্নিগ্ধা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে। এর মাঝেই অভ্রর ডাক কানে আসতেই স্নিগ্ধার হুশ ফিরলো। সে সঙ্গে সঙ্গে সরে দাড়ালো।
আদিল এগিয়ে গিয়ে অভ্রকে কোলে তুলে নিলো। অভ্র রুমটা দেখে অবাক হয়ে বললো,” কি সুন্দর! তোমার রুম সাজিয়েছে কেনো?”
আদিল মাথা নেড়ে ভেবে বললো,” কারণ আজকে একটা স্পেশাল দিন।”
অভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,” আজকে কেনো স্পেশাল দিন?”
” কারণ আজকে এই মেয়েটি আমাদের বাড়িতে এসেছে। আর এখন থেকে সে আমাদের সাথে থাকবে।”, বলেই স্নিগ্ধার দিকে ঈশারা করলো। অভ্র ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে স্নিগ্ধাকে দেখে খুশি হয়ে গেলো তারপর আবার মুখ ফুলিয়ে আদিলকে বললো,” আমার ঘর কেনো এইভাবে সাজায় নি। ওদের তুমি বকে দিবে।”
আদিল মাথা নেড়ে বললো,” আচ্ছা বকে দিবো।”
অভ্র গাল ফুলিয়ে রেখে বললো,” এক্ষুনি বকে দাও।”
আদিল ঝুকে এসে অভ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,” এক্ষুনি বকতে হবে? পরে বকে দিলে হবে না?”
অভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে না সূচক মাথা নাড়লো। আদিল হেসে উঠে অভ্রকে কোলে করে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,” আচ্ছা চলো। বকে দিয়ে আসি।”
স্নিগ্ধার এদের দেখে নিজে থেকেই হাসলো। তারপর গলার লকেটটা হাত দিয়ে ধরে দেখলো। তারপর কি ভেবে আস্তে করে সেটা খুলে তুলে রাখলো।
⭐ স্নিগ্ধার খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। আজ সে দেরিতে উঠেছে নাকি সকাল সকাল বুঝতে পারছে না। কেমন একটা ধুমধাম শব্দে তার ঘুম ভাঙলো। সে চটপট উঠে পাশে তাকাতেই দেখলো আদিল নেই। কাল রাতে কি লোকটা এই ঘরে আর আসে নি? স্নিগ্ধার ভীষন ঘুম পেয়েছিলো যার কারণে মাঝে একটা বালিশ দিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
স্নিগ্ধা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ঘড়ির কাঁটা বলছে এখন আটটা দশ। এই মশাই এতো সকালে উঠে? স্নিগ্ধা ফ্রশ হয়ে রূমের বাইরে এলো। ধুপধাপ আওয়াজটা এখনো বিদ্যমান। মনে হচ্ছে মাথার উপর কে যেনো লাফাচ্ছে।
স্নিগ্ধা নিচে নেমে এলো। নিচে নেমেই বাহিরে কয়েকজন গার্ডকে দেখতে পেলো। এরা কি রাতে ঘুমায় না? নাকি সারারাত এইভাবে দাড়িয়ে থাকে। হয়তো বেছে বেছে ইনসোমনিয়ায় আক্রান্ত বডিগার্ড খুঁজে বের করেছে এই লোকটা।
স্নিগ্ধার সকালে উঠে চা খাওয়া একটা অভ্যাস। তাই সে কিচেনে এলো। কিচেনে একজন সেফ ব্রেকফাস্ট বানাতে ব্যাস্ত। স্নিগ্ধাকে কিচেনে ঢুকতে দেখে তারা ভুত দেখার মতন করে তাকালো। তারপর একজন এগিয়ে এসে বলল,” ম্যাডাম আপনার কি লাগবে আমাদের বলুন?”
স্নিগ্ধা সরল ভঙ্গিতে হেসে বললো,” আমার কিছু লাগবে না। আমি চা বানাবো। তাই আপনারা এখন কিচেনে থাকতে পারবেন না।”
একজন এগিয়ে এসে বললো,” আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, আমি করে দিচ্ছে।”
স্নিগ্ধা এগিয়ে এসে চায়ের পানি বসিয়ে বলল,” আমাকেই কষ্ট করতে হবে। কারণ দিনের শুরুটা আমি নিজের হাতের চা দিয়ে করি। এইটা আমার অভ্যাস।”
শেফ দুজনেই স্তম্ভিত দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার চা বানানো দেখছে, আর কেনো বিপদ যেনো না হয় সেদিকে খেয়াল রাখছে। স্নিগ্ধার কেমন জানি লাগছে। তার মনে হচ্ছে এরা তার চা বানানো থেকে কোনো ভুল ধরে সেটা নিয়ে মনে মনে হাসছে। সে চলে গেলে আড়ালে বলবে। এমনটা তার সবসময় সব ক্ষেত্রেই মনে হয়।
স্নিগ্ধা প্রতিদিন সকালের মতোই অভ্যাসগত কারণে তিন কাপ চা বানিয়ে ফেলেছে। আগে নিজের সাথে সাথে মা বাবাকেও সে চা দিতো। আজকে মা বাবা ফরিদার হাতের চা খাবে? ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার।
স্নিগ্ধা তিনটি কাপেই চা ঢাললো। একটি ট্রে করে দু কাপ চা নিয়ে অন্য কাপটি ঢেকে এক পাশে রেখে দিয়ে
বাইরে এলো। আনোয়ার সাহেব সকালের মিষ্টি রোদে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। স্নিগ্ধা অন্য কাপ চা আনোয়ার সাহেবের সামনে রেখে পাশের চেয়ারটিতে বসতেই আনোয়ার সাহেব খবরের কাগজটা ভাজ করে রেখে হেসে উঠে বললেন,” বাহ্, এতো সকালে উঠে পড়েছ?”
স্নিগ্ধা চিন্তিত মুখে বললো,” আপনি চায়ে কেমন চিনি খান? আমি অল্প দিয়েছি। বাবা মাকে যতটুকু দেই।”
আনোয়ার সাহেব হাত বাড়িয়ে চা নিয়ে এক চুমুক দিয়ে আয়েশ করে বললেন,” মারাত্মক হয়েছে। এখন থেকে তাহলে রোজ সকালে তোমার হাতের চা দিয়ে শুরু করবো।”
স্নিগ্ধা সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে হাসলো। এতক্ষণ ভীষন নার্ভাস লাগছিলো তার। তারপর নিজের চা হাতে নিতেই আনোয়ার সাহেব নানা গল্প শুরু করলেন। সেসব গল্প শুনতে তার ভালোই লাগছে। চা খাওয়া শেষে স্নিগ্ধা কিচেনে এসে অন্য কাপ চায়ের দিকে তাকালো। তারপর কাপটা হাতে নিয়ে দেখলো এখনো গরম আছে। কি করবে সে এখন। ফেলে দেওয়াটা তার বিবেকে সায় দিবে না। আচ্ছা জনাব আবিএফ কোথায়?
আদিল উপরে নিজের ওয়ার্কআউট করতে ব্যাস্ত। হাটু পর্যন্ত কালো রঙের শর্ট প্যান্ট আর একটা হুডি পড়ে ওয়ার্ক আউট করছে সে। জিম একপাশে দাড়িয়ে আজকের দরকারি কাজগুলোর বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে। আদিল পুশ আপ করছিলো এর মাঝেই জিম নোটপ্যাড দেখে দেখে বলছে,
” স্যার, ম্যাগাজিনের লোকেরা আজকে আপনার সাক্ষাৎকার চাইছেন। আপাদত তাদের আমি নেক্সট উইকে একটা ডেট দিয়েছি। অফিসের কাজ গুলো ম্যানেজার সাহেব সামলে নিচ্ছেন। সব আপডেট গুলো আমি ফাইল করে রেখেছি,,,”
আদিল তখন থেকে জিমকে চুপ করতে বলছে কিন্তু এই ছেলে রেডিওর মতন তার কানের কাছে বাজছে। আদিল পুশ আপ শেষ করে উঠে নিজের তোয়ালে নিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে তীব্র বিরক্তি নিয়ে জিমের দিক তাকালো। ভেজা চুলগুলো তার কপালে এসে পড়েছে।আদিল হাত দিয়ে সেগুলো এলোমেলো করে দিয়ে আপাদত জিমের কথা শুনছে।
জিমের দৃষ্টি নোট প্যাডেই রয়েছে। যেনো এই কথাগুলো বলতে না পারলে জিমের বিশাল কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে!
স্নিগ্ধা চা নিয়ে উপরে উঠে জিমের এমন দীর্ঘ বক্তৃতা শুনে থ মেরে বাইরে দাড়িয়ে রইলো। জিমের কথা শেষ হতেই স্নিগ্ধা হাতের চা আদিলকে না দিয়ে জিমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,” নিন।” জিম কিছু না বুঝে সবে হাত বাড়িয়েছে চায়ের কাপের দিকে তার আগেই আদিল চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক দিয়ে মুগ্ধ হয়ে বললো,” বাহ্, অসাধারণ।”
স্নিগ্ধা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। এমন কিছু সে চিন্তাও করেনি। সে চা জিমের দিকে এগিয়ে দিয়েছিলো কারণ তার মনে হয়েছে এতো কিছু বলতে বলতে নিশ্চই লোকটার তৃষ্ণা পেয়ে গেছে। এই দিকে যে এমন একটা নিষ্ঠুর লোক দাড়িয়ে আছে সেটা তো সে ভুলে গেছিলো।
জিম হটাৎ স্নিগ্ধাকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। তারপর অনেকটা দূরে সরে গিয়ে বলে,” ম্যাডাম, আপনি?”
আদিলের এমন কাজে আদিল লজ্জিত কিনা স্নিগ্ধা জানে না কিন্তু স্নিগ্ধা লজ্জিত। তারপর ভ্রু কুঁচকে আদিলের দিকে তাকিয়ে বললো,” আপনি এইটা কি করলেন?”
আদিল চায়ের চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা একপাশে রেখে এগিয়ে এসে মৃদু হেসে বললো,” সকাল সকাল বউয়ের হাতের চা খেলাম।”
স্নিগ্ধার ভীষন রাগ লাগছে। রেগে চলে যেতেই আদিল এগিয়ে এসে স্নিগ্ধার এক হাত ধরে অন্য হাতে কোমড় জড়িয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো। আদিলের এমন আচরণে স্নিগ্ধা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো।
জিম হুড়মুড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তার নিশ্বাস যায় যায় অবস্থা।
আদিল মৃদু হেসে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধার রাগান্বিত চোখ গুলোর দিকে। পরক্ষনেই তার দৃষ্টিতে ধরা পড়লো স্নিগ্ধা লকেটা পড়ে নি। আদিলের মুখের হাসি আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো। তারপর স্নিগ্ধাকে আরো কাছে এনে সিরিয়াস হয়ে বললো,” লকেটা পরোনি কেনো?”
স্নিগ্ধা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ছটফট করছিল কিন্তু প্রশ্নটি শোনা মাত্র থেমে গেলো। তারপর শান্ত দৃষ্টিতে আদিলের দিকে তাকিয়ে বললো,” ভালোবাসার প্রথম উপহার, ভালো না বেসে কি করে পড়ি? যেদিন ভালোবাসতে পারবো সেদিনই পড়বো।”
স্নিগ্ধার এই উত্তরে আদিল ব্যাথিত দৃষ্টিতে তাকালো চোয়াল শক্ত করে পরক্ষনেই স্নিগ্ধার কোমর জড়িয়ে রাখা নিজের হাতের বাধন সহজ করলো। তারপর মৃদু হেসে হাতটা ছেড়ে দিলো। স্নিগ্ধা এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে বেরিয়ে এলো।
#চলবে…
#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_৬
#নবনী_নীলা
হুট করেই স্নিগ্ধার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভাঙতেই সে পাশে তাকালো। অভ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। স্নিগ্ধা ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো,রাত একটা পনেরো, অথচ আদিল এখনো বাড়ি ফেরেনি। এতো কিসের ব্যস্ততা তার? স্নিগ্ধা বেশ সাবধানে অভ্রের পাশ থেকে উঠে পড়ল। গল্প শুনতে শুনতে অভ্র এই ঘরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। স্নিগ্ধা কোনো শব্দ না করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
এই বাড়িটা তার কাছে ধীরে ধীরে রহস্যময় হয়ে উঠেছে। এই বাড়িতে কোনো ফ্যামিলি ফটো নেই। কিন্তু কেনো? এমন কি অভ্রর ঘরে অভ্রর মায়ের ছবি পর্যন্ত নেই। এইটা কি অন্যায় না? এই বাচ্চাটির কি অধিকার নেই তার মাকে দেখার?
স্নিগ্ধার সন্দেহ আরো গাঢ় হয়েছে যখন সে দোতলার শেষ রুমটি তালাবদ্ধ দেখেছে। রোজ একবার একজন স্টাফ রুমটা পরিষ্কার করে আবার তালা দিয়ে রাখে। বিষয়টা স্নিগ্ধার কাছে খুবই অদ্ভূত লেগেছে। এমন কি আছে ঐ রুমে যে এত যত্ন করে রাখা হয় আর সবার থেকে আড়াল?
স্নিগ্ধা সকাল থেকেই আদিলের জন্যে অপেক্ষা করছিলো। একটা কারণে সে ভীষন রেগে আছে। আজ সে নিজের মা বাবার সাথে দেখা করবে ভেবে বের হতে যাচ্ছিল। সেই সময় গার্ডরা তাকে বের হতে দেয় নি।
আদিল নাকি তাদের বলে রেখেছে তার অনুমতি ছাড়া যেনো স্নিগ্ধাকে বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া না হয়। কিন্তু কেনো? সবকিছুতে ওই লোকটার পারমিশন নিতে হবে কেনো? এমন একটা বাড়িতে তাকে থাকতে হচ্ছে, যেখানে কথা বলার কেউ নেই।কেমন নিস্তব্দ একটি বাড়ি। মনে হয় কতগুলো রবোমানবের মাঝে সে একটি মাত্র মানুষ।
অভ্রর মতন একটা ছোট্ট শিশুকে নাকি জন্মের পর থেকে এই চার দেওয়ালের ভিতরেই থাকতে হচ্ছে। তাহলে কি তার সাথেও তাই হবে। কখনই না, সে এইসব মেনে নিবে না।
অভ্রর ব্যাপারটা জানার পর থেকে স্নিগ্ধার মাথায় রীতিমত রক্ত উঠে গেছে। একটা বাচ্চাকে এইভাবে কষ্ট দেওয়ার কি কোনো মানে হয়?
স্নিগ্ধা সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখলো জিম একপাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে হাই তুলছে। স্নিগ্ধা এগিয়ে গেলো তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো,” কোথায় আপনার স্যার?”
স্নিগ্ধাকে দেখে জিম বেশ অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো তারপর বললো,” উনি তো আনোয়ার সাহেবের ঘরে ছিলেন।”
জিম ভেবেছিলো এ কথা শুনার সঙ্গে সঙ্গে স্নিগ্ধা উপরের রূমে চলে যাবে কিন্তু না স্নিগ্ধা আরো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পাক্কা গিন্নির মতোন বলল,” এতো রাত হলো কেনো?”
জিম কয়েকবার চোখের পলক ফেলে বললো,” একটা কাজে স্যার আটকে গেছিলো। ”
স্নিগ্ধা বিশ্বাস করেছে বলে মনে হলো না জিমের। মিথ্যে কথাটা ধরতে পেরে সে বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে রুমে চলে গেলো। স্নিগ্ধা রুমে ঢুকেই দেখলো আদিল ঘুমন্ত অভ্রর কপালে চুমু একে দিচ্ছে।
আদিলকে দেখে খুব টায়ার্ড মনে হচ্ছে ঠিকই কিন্তু স্নিগ্ধার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো তার হাতে বাঁধা সাদা রুমালটি। যার উল্টা পিঠে বিন্দু বিন্দু রক্তের দাগ ভাসছে। লোকটা কি কাউকে মেরেছে? নাকি নিজেকে নিজে আঘাত করেছে।
স্নিগ্ধাকে এইভাবে দরজার পাশে স্তম্ভিত অবস্থায় দাড়িয়ে থাকতে থেকে আদিল এগিয়ে এলো নিজের ঘড়ি খুলতে খুলতে বললো,” হটাৎ এতো রাত জাগার কি প্রয়োজন পড়লো তোমার? তুমি নিশ্চয়ই আমার জন্যে জেগে নেই?”
স্নিগ্ধা উত্তরে কিছু বললো না। বললে কি বলবে? হ্যা আপনার জন্য জেগে আছি। হ্যা তারপর মহাজন উল্টা পাল্টা কথা শুরু করবে। তাই নিরবতাকেই নিজের হাতিয়ার বানালো সে। আদিল ঘড়িটা একপাশে রেখে মৃদু হেসে মাথা কাত করে জিজ্ঞেস করলো,” তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলে?”
স্নিগ্ধা আদিলের কথায় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো। তারপর নিজেকে এই অবস্থা থেকে বের করে আনতে সোজা প্রস্ন করে বসলো,” আপনার হাতে কি হয়েছে?”
আদিল ভ্রু কুঁচকে নিজের হাতের দিকে তাকালো। স্নিগ্ধার এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো আদিল হাতের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে রেগে গিয়েছিলো। কিন্তু পরক্ষনেই নিজের রাগ চাপা দিয়ে একটা ভ্রু তুলে বললো,” কেনো তোমার কি আমার জন্যে চিন্তা হচ্ছে?”
স্নিগ্ধার ভীষন রাগ হচ্ছে, আদিল এতো কৌশলে কথাগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে যে এই কয়দিনের পরিচয়ে তার পক্ষে অধিকার খাটিয়ে প্রশ্নের জবাব চাওয়া সম্ভব না।
স্নিগ্ধাকে এমন অপ্রস্তুত হতে দেখে আদিল বেশ মজা পাচ্ছে। নিজেকে সংযত রাখতে গিয়ে স্নিগ্ধা রাগটাও দেখাতে পারছে না। আদিল নিশ্চুপে স্নিগ্ধার কাছাকাছি এগিয়ে আসতে লাগলো। স্নিগ্ধা আগে থেকেই দেওয়ালের সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লো।
আদিল কাছে এসে দুপাশে হাত রেখে দাড়াতেই স্নিগ্ধা অস্থির হয়ে উঠলো। বিচলিত চোখে তাকালো। তার বুকের ভেতরে ধুক ধুক বাড়তে লাগলো। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না।
স্নিগ্ধা এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” কি করছেন কি আপনি?”
আদিল ঘোর লাগা কণ্ঠে বললো,” যা করতে চাইছি সেটা কি করে দেখবো?,” তারপর একটু থেমে স্নিগ্ধার অগোছালো দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে গভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,” হুম্?”
স্নিগ্ধা রাগী চোখে তাকানোর চেষ্টা করলো কিন্তু সে চোখের হালকা লাজুক দৃষ্টিতে আদিল মৃদু হেসে বললো,” তুমি এত ঝাঁঝালো কেনো?”
স্নিগ্ধা এবার ভুত দেখার মতোন করে তাকালো।তারপর রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,” ঝাঁঝালো মানে? দেখুন অনেক আজে বাজে বকেছেন। আমার একটাও প্রশ্নের উত্তর তো দিলেন না কায়দা করে এড়িয়ে গেলেন। এখন আমাকে আবার আমাকে ঝাঁঝালো বলছেন। আমি ঝাঁঝালো তো বিয়ে করেছেন কেনো? আমি কি আপনাকে নেমন্তন দিয়ে বলেছিলাম যে আসুন, এসে আমাকে বিয়ে করুন।”
আদিল ঝুকে এসে স্নিগ্ধার কানের কাছে মুখ আনতেই স্নিগ্ধা শিউরে উঠলো। শক্ত করে শাড়ির আঁচল খামচে ধরে চোখ বুঝতেই আদিল ফিচেল গলায় বললো,” কারণ, তোমাকে দেখার পর থেকে ঝাল জিনিস আমার একটু বেশিই ভালো লাগে।”
স্নিগ্ধা আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো। পাশ ফিরতে আদিলের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে ফেললো সে। তারপর নিজেকে শান্ত করে প্রসঙ্গ ঘুরাতে গম্ভীর গলায় বললো,” দেখুন, আজে বাজে কথা বন্ধ করুন। আপনার সাথে আমার কিছু কথা বলার প্রয়োজন ছিলো। তাই আমি এতক্ষন জেগে ছিলাম।”
আদিল স্নিগ্ধার কানের কাছে মুখ রেখেই বললো,” হুম্, বলো। আমি তো তোমার কাছেই আছি। নাকি আরেকটু কাছে আসতে হবে।” কথাটা বলে স্নিগ্ধার দিকে তাকাতেই দেখলো স্নিগ্ধা চোখ ছানবড়া করে তাকিয়ে আছে।
আদিল মনে মনে হাসলো তারপর স্নিগ্ধাকে আরো ভয় দেখতে একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতেই। স্নিগ্ধা আদিলের হাতের নিচ বেড়িয়ে এলো। তারপর জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। হার্ট বিট যেনো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে তার।
আদিল মাথা নিচু করে হেসে ফেললো। তারপর দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুরে দাড়ালো।বুকের কাছে হাত ভাজ করে স্নিগ্ধার দিকে অপলকে তাকিয়ে রইলো। স্নিগ্ধা আড় চোখে একবার আদিলের দিকে তাকিয়ে বিছানায় গিয়ে অভ্রর পাশে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। জেগে থেকে যে এমন বিপদে পড়তে হবে কে জানতো। কি সাংঘাতিক লোক রে বাবা! স্নিগ্ধা চাদর টেনে গলা পর্যন্ত দেখে চোখ বন্ধ করে রইলো। যা প্রশ্ন সেগুলো সকাল বেলা করতে হবে।
আদিল ফোঁস করে হেসে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। কিন্তু সে জানে স্নিগ্ধার এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি তাকে আবার হতে হবে। কিন্তু স্নিগ্ধাকে সবটা বললে সে কি তাকে বুঝবে? যদি ভুল বুঝে ছেড়ে চলে যায়! তখন কি সে আটকাতে পারবে?
⭐ ভোরের আলো চোখে পড়তেই স্নিগ্ধার ঘুমটা ভেঙে গেলো। কিন্তু সে গাঢ় ঘুমের কারণে চোখ খুলতে পারলো না। তারপর হাত বাড়িয়ে অভ্রকে জড়িয়ে ধরতেই তার মনে হলো সে শক্তপেশির কাউকে জরিয়ে ধরেছে। স্নিগ্ধা গাঢ় ঘুমের রেশ কাটিয়ে আস্তে আস্তে চোখ মেললো। তারপর সামনে তাকাতেই চোখ কপালে উঠে গেলো স্নিগ্ধার, ঘুমের ঘোরে এতক্ষণ তাহলে সে আদিলকে জড়িয়ে রেখেছে? স্নিগ্ধা দুঃস্বপ্ন দেখার মতোন লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়লো।
সকাল সকাল মারাত্মক একটা শক খেয়ে ঘুম ভেঙেছে তার। হৃদ কম্পন বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক ভাবে। স্নিগ্ধা ভ্যাবাচেকা খেয়ে আড় চোখে ঘুমন্ত আদিলের দিকে তাকালো। আসলেই কি ঘুমিয়ে আছে? জেগে থাকলে তো ভীষন বিপদ। কিন্তু সে আদিলের এতটা কাছাকাছি কি করে গেলো? মাঝে তো অভ্র ছিলো। স্নিগ্ধা মাঝে তাকিয়ে দেখে অভ্র নেই। কোথায় গেলো? ভেবেই চমকে আশে পাশে তাকিয়ে সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।
তারপর অনায়াসে তার মুখে হাসি ফুটে গেলো। এ কেমন সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী সে? আদিলের বুকের সাথে একদম মিশে আদিলকে জড়িয়ে ধরে ঘুমে অচেতন হয়ে আছে অভ্র। আদিল তার এক বলিষ্ঠ হাতে আগলে রেখেছে তাকে। দেখেই কেমন মায়ায় পড়ে গেলো সে।
পরক্ষনেই এই মহূর্তটাকে ক্যামেরা বন্দি করতে পা টিপে টিপে উঠে পড়লো সে। নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে ছবি তুলতেই ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইট গিয়ে পড়লো আদিলের চোখে। স্নিগ্ধা একদম খেয়ালই করে নি যে লাইটটা অন করা ছিলো। ছবি তোলার পর দেখলো, আদিল ঘুম ঘুম চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা ফট করে ফোনটা লুকিয়ে ফেলে কিছু না হওয়ার ভান করতে লাগলো। কোনো লাভ হচ্ছে কিনা সে জানে না। আদিল তো তাকে ফোন হাতে দেখে নিয়েছে। এইবার আবার কি উল্টা পাল্টা কথা শুনতে হয় তাকে?
[ #চলবে ]