#রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ,০৬,০৭
[০৬]
তাড়াতাড়ি নিজের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে আরাভ। আরাভের আজ অনেক তাড়া। কলেজে আসার ইচ্ছে তার ছিলো না। ফাস্ট ইয়ারের একটা ইম্পরট্যান্ট ক্লাস থাকায় কলেজে আসতে হয়েছে তাকে। প্রথমে ভেবেছিল ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসটা করেই চলে যাবে।প্রিন্সিপ্যালের কাছে ছুটি চাই সে না করে দেয়। দুদিন পর পর হঠাৎ করে এমন ছুটি তিনি আর দিবেন না। এদিকে আরাভের ফোনে একের পর এক কল এসেই চলেছে। অফিসে বসে নিজের কাজ করছিলো আরাভ। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ডিপার্টমেন্ট এর হেড স্যার মনিরুল ইসলাম বসে আরাভের পাশে। আরাভ মনিরুল স্যারের দিকে তাকিয়ে সৌজন্য মূলক হাসি হাসলো। তারপর নিজের কাজে মন দেয়। মনিরুল ইসলাম কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বললেন,
” আপনি কি ব্যাস্ত?”
” হ্যাঁ, এখন একটু ব্যাস্ত আছি।”
মনিরুল ইসলাম ইতস্তত করে উঠতে চেয়েও উঠলেন না। কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে বললেন,
” আজ ডিনারটা আমাদের সাথে-ই করবেন।”
” ডিনার!”
” আমরা কয়েকজন স্যার মিলে ডিনারের ব্যবস্থা করছি।সেখানে আপনাকেও উপস্থিত থাকতে হবে।”
” চেষ্টা করবো। বাট কথা দিতে পারছি না।”
” আমরা অপেক্ষা করবো।!
উঠে দাঁড়ায় মনিরুল ইসলাম। আরাভের দিকে একপলক তাকিয়ে মৃদু হাসে তারপর প্রস্থান করে। মনিরুল ইসলাম চলে যেতেই আরাভ তার চলে যাওয়ার দিকে তাকায়। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ডিপার্টমেন্টের হেড এই তরুন স্যারকে তার বেশ লাগে। কেমন মুহূর্তে এই স্যার সবাইকে আপন করে নিতে পারে। এই সম্পর্কে বেশী কিছু জানে না সে। গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করে শহরে এসেছে। এর থেকে বেশী কেউ জানে না। লম্বাশ্বাস নিয়ে নিজের কাজে মন দিলো আরাভ।
ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ির কাছে যায় আরাভ। গাড়ির দরজা খুলে যেইনা গাড়িতে উঠতে যাবে অমনি ভূমির আগমন। ভ্রুদ্বয়ে সমান্য ভাজ পরে আরাভের। আরাভ কিছু বলবে, হাতে মোবাইল থাকায় থেমে গেলো। ” আই উইল কল ইউ লেটার” বলে কল কেটে দেয় আরাভ। ভূমি সেদিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায়। এতক্ষণ তো ঠিক কথা বলল। যে না ও এসেছে আর ওমনি কল কেটে দিলো। কে কল করেছিল? ওর সামনে কথা বললে কি হতো? আচ্ছা স্যারে জিবনে কি কোন মেয়ে আছে? এমন হ্যান্ডসাম ছেলে তার কোন গার্লফ্রেন্ড থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বিষন্নতায় ছেয়েগেল ভূমির মুখ। মাথা নিচু করে নিলো সে। চোখ জ্বালা করছে। ভিষন জ্বালা করছে। কার্নিশে পানিও জমেছে। আরাভ ভুমির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে। যখন এলো তখন তো হাসি মুখের ছিলো। এখন আবার হলোটা কি এই মেয়ের। আরাভের কপালের ভাজ আরো গাঢ় হলো। তারপর প্রশ্ন করলো,
” কি হয়েছে? এতক্ষণ তো ঠিক ছিলে? হঠাৎ করে কি হলো?”
মাথা তুলে তাকালো না ভূমি। আর কোন জবাবও দিলো না। আবারও জিগ্যেস করলো আরাভ,
” মুখটা অমন শুকনো লাগছে কেন? শরীর খারাপ?
এবারও ভূমির থেকে কোন জবাব পেল না। বিরক্তবোদ করলো আরাভ। বিরক্তিতে চ” উচ্চারণ করে। আশপাশ তাকালো। মনিরুল ইসলাম আর প্রিন্সিপ্যাল স্যার এদিকে আসছে। আরাভ ভূমির দিকে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল,
” গাড়িতে বসো।”
ভূমি দ্বিরুক্তি করলো না। গাড়িতে বসলো। আরাভ ও গাড়িতে বসে সিটবেল্ট বাধতে বাধতে জিগ্যেস করলো,
” কেন এসেছিলে?
এবার মাথাতুলে তাকালো ভূমি। ভূমির ছলছল কোমল দৃষ্টি দেখে আরাভের বুকের ভিতরটায় চিনচিন ব্যাথা করে উঠলো। আটকে উঠলো সে। চেয়ে রইলো সেই নরম কোমল দৃষ্টির দিকে। চোখ নামিয়ে নিলো ভূমি। আরাভ সিটবেল্ট রেখে ভূমির এসে আসলো। ভূমির চিবুক ধরে নরম শীতল কন্ঠে জিগ্যেস করলো,
” কাঁদছ কেন ভূমি? কেউ কিছু বলেছে?
এবার মুখ খুলল ভূমি। আরাভের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
” আপনি তখন কার সাথে কথা বলছিলেন।”
হেসে ফেলল আরাভ। মুখ ঘুড়িয়ে ঠোট চেপে হাসলো। তারপর ভূমির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” এই জন্যে ম্যাডামের মন খারাপ। সন্দেহ করছো আমায়?”
“না সন্দেহ না। আপনি আমায় দেখে কল কেটে দিলেন কেন? কে ছিলো?” শেষ প্রশ্নটা মাথা নিচু করে করলো।
আরাভ ভূমির মুখটা দু-হাতে উচু করে ধরে বলল,
” মব খারাপ করার কিছু নেই। রেদওয়ানের সাথে কথা বলছিলাম।”
মূহুর্তেই ভূমির মনের সব বিষন্নতা কাটিয়ে একটু হাসির রেখে ফুটে উঠলো। আরাভ এবার সেন স্বস্তি পেলো। লম্বা এক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভূমির সিল্টবেল লাগিয়ে সোজা হয়ে বসলো। নিজের সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে প্রশ্ন করলো,
” এখানে কি করতে এসেছিলে?”
” কফিশপে যাব।”
” এখন।”
” হুম।
আরাভ পড়লো এবার মহামুশকিলে। ভূমিকে এখনি কপিশপে যেতে হবে। এদিকে রেদওয়ান কল দিয়ে তাড়া দিচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরাভ। ভুমিকে মুখের উপর না করতেও পারছে না। কয়েকদিন পর দেখা তার মেয়েটার সাথে। কাজ আর মানুষিক চাপের কারনে মেয়েটাকে সময়ই দেওয়া হয়না। পরে যা হবার হবে, এবার ভূমির ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দিবে আরাভ সিদ্ধান্ত নিলো। ভূমির দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
______________________
দিগন্ত ঢাকায় ফিরেছে দু-দিন হলো। দুদিন আর অফিসে যায়নি সে। গতকাল রাতে রফিক মির্জা কল করেছিলে। আজ তাকে অফিসে যেতে হবে। সিলেটের কেইসের হিসট্রি জানতে চান তিনি। তারপর হয়তো দিগন্তের হাতে নতুন কোন কেইস তুলে দিবেন। রাতভর গভীর ঘুমে নিমজ্জিত থাকায় সকালে ঘুম থেকে উঠতে লেট হয় দিগন্তের। ফ্রেশ হয়ে অনলাইনে খাবার অর্ডার অফিসে যাওয়ার জন্যে তৈরী হয়ে নেয়। ততক্ষণে খাবার এসে যায়। দিগন্ত নাস্তা করছে এমন সময় দিগন্তের সেলফোন বেজে উঠে। স্কিনে “মা” নামটা দেখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে দিগন্তের চোখমুখে। কল রিসিভ করে বলে,
” মা, মা বল কেমন আছো তুমি?”
ওপাশ থেকে ভরাট কন্ঠ। কন্ঠে অভীমানের সুর। চাপা কষ্ট। আদরের ছেলে দিগন্ত। যাকে নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন দিগন্তের মা সৈয়দা লাভলী। সবসময় ছেলেকে আগলে রেখেছেন। কখনো কষ্ট কি বুঝতে দেননি। আজ সেই ছেলে শহরে একা থাকে। ঠিকমতো খেতে পারে কি না জানেনা। কষ্টে, যন্ত্রণায় ছটফট করেন সৈয়দা লাভলী। অভীমানি কন্ঠে বললেন,
” আমার খবর নেওয়ার সময় কি তোর আছে। সারাক্ষণ তো ওই কাজ কাজ কাজ। হ্যারে খোকা। তোর শরীর ভালো আছে তো? ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করিস তো?”
” মা,,, মা,, এত চিন্তা করোনা। আমি ঠিক আছি। আমি কিন্তু এখন আর ছোট্ট্ নেই। অনেক বড় হয়েছি।”
” তা তো দেখাতেই পাচ্ছি। তোকে কিছু বলার ছিলো?”
” হ্যাঁ মা বলো কি বলবে?”
” রুমিকে তো চিনিস। তোর বাবা বলছিলো রুমির সাথে তোর বি,,,য়ে,,,,
” মা প্লিজ। তুমি তো সবটা তাহলে কেন এসব কথা বলছো।”
” যে হাড়িয়ে গেছে তাকে কি খুঁজে পাবি বল। এভাবে নিজের জিবনটা নষ্ট করিস না খোকা।”
” তার ঠিকানা আমি পেয়ে গেছি মা। এবার খুব তাড়াতাড়ি তোমার বৌমাকে ঘরে তুলবো।”
” হ্যারে সত্যি বলছিস তো খোকা।”
” হুম। সত্যি বলছি। এবার রাখছি বুঝলে মা। আমাকে অফিসে যেতে হবে।”
” হুম রাখ। আর শোন সাবধানে থাকবি, নিজের খেয়াল রাখবি। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করবি। আর একদম রাত জাগবি না।”
” ঠিক আছে এবার রাখি।”
” হুম রাখ।
কল কেটে স্মিত হাসলো দিগন্ত। ওর মা-টা না কি যে ভাবে। দিগন্তকে এখনো সেই ছোট্টটি ভাবে। আসলে ছেলেমেয়েরা যতই বড় হোকনা কেন? বাবা মায়ের কাছে তারা সবসময় ছোটই থাকে। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে খাবার খেতে শুরু করে দিগন্ত।
রফিক মির্জার সাথে আলোচনা শেষ করে বিকালের দিকে অফিস থেকে বের হয় দিগন্ত। গন্তব্য এখন তার প্রিয় মানুষটার ঠিকানায়। একটা রিক্সা ডেকে সেটায় উঠে বসে। রিক্সা চলছে তার নিদিষ্ট গতিতে। দিগন্তের চোখ রাস্তার চারিপাশে বিচরণ করছে। মনে মনে নানা কল্পনা আটছে তার প্রিয় মানুষটাকে ঘিরে। কেমন দেখতে হবে তার প্রিয় মানুষটা। তার সাথে প্রথমে কি ভাবে কথা বলবে? দিগন্ত খেয়াল করলো ওর গলা কাপছে। হার্ট দ্রুত বিট করছে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই ছোট্ট পুতুল। দিগন্তের এখনো মনে আছে প্রথম যেদিন তার ছোট্ট পুতুলের সাথে দেখা হয়েছিলো তখন দিগন্ত সবে ফোরে পড়ে। ছোট্ট ভাই মা বাবা আর দাদুকে গিয়ে এসেছিলো তাদের ছোট্ট গ্রামে। যেটা এখন শহর হিসাবে গড়ে উঠেছে। লাল ফ্রক পড়া ছোট্ট সেই মেয়েটির মাথায় ঋুটি করা ছিলো। যেটা দেখে দিগন্ত প্রথম যেটা বলেছিলো সেটা হলো, পুতুলের মাথায় তালগাছ গজিয়েছে। মাথায় তালগাছ গজিয়েছে বলে পুতুল অনেক কাঁদছিল যার কারনে দিগন্তকে মার খেয়ে হয়েছিল ওর মায়ের হাতে।
হেসে ফেলল দিগন্ত। ছোট বেলার সেই মধুর স্মৃতি আজো ওর বুকে ধারন করে রেখেছে। এই স্মৃতিগুলো নিয়েই তো বেচে আছে সে। একদিন সে তার পুতুলকে কাছে পাবে তাকে আপন করে পাবে এই স্বপ্নই তো সে দেখেছে।
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে রোজিনা হোসাইন দরজা খুলে দেন। দরজার ওপাশে লম্বা সুশীল এক যুবককে দেখে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকান। রোজিনা হোসাইনকে দেখেই যুবকটার মুখে চোওড়া হাসি ফুটে উঠলো। রোজিনা হোসাইন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ড্রয়িংরুম বসে মোবাইলে লুডু লেখছে ভূমি আর তন্ময়। রোজিনা হোসাইনকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভুমি প্রশ্ন করলো,
” কে এসেছে, মা?”
কন্ঠটা শুনে বুকটা ছেদ করে উঠলো যুবকটার। বুকের ভিতরটা উঠানামা করছে। সে দ্রুত শ্বাস নিতে থাকলো। এই কন্ঠটা, হ্যা এই কন্ঠটাই তো সে শুনতে চেয়েছে এতদিন।
চলবে,,,,,,,,
Mahfuza Afrin Shikha
#রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ।
[০৭]
এতগুলো বছর পর দিগন্তকে দেখতে পেয়ে আবেগপ্রবণ রোজিনা হোসাইন। সেই ছোট্ট দিগন্তকে যখন ছেড়ে এসেছিলেন তখন ভুলেই গিয়েছিলেন দিগন্তের কথা। দিগন্তের সাথে তাদের আর কোনদিন দেখা হবে এটা কখনো ভাবেন নি। তবে ভূমি কিংবা তন্ময় কেও চিনতে পারেনি দিগন্তকে। দিগন্তের পরিচয় দেওয়ার পর ভূমি ওকে চিনতে পারে। ছোটবেলায় কিছু স্মৃতি তারও মনে পরে। তবে সেগুলো শুধু ছোটবেলার স্মৃতি হিসাবেই। দিগন্তের মতো সেগুলো আগলে রাখেনি। ইউনুস হোসাইন বাড়ি ফিরে দিগন্তকে দেখে বুকে জড়িয়ে নেয়। রোজিনা হোসাইনের কড়া নির্দেশ আজ দিগন্তকে তাদের সাথে থাকতে হবে। দিগন্ত তার প্রিয় বন্ধুর কাছাকাছি থাকতে পারবে।রোজিনা হোসাইনের কথায় রাজি হয়ে যায় সে। সেদিন রাতভর গল্পকরে কাটায় দিগন্ত রোজিনা হোসাইন আর ইউনুস হোসাইন। দিগন্তের মন বলছিল ভূমি আসবে। তাদের গল্পের আসরে ভূমি আসবে। শেষ পর্যন্ত ভূমি কিংবা তন্ময় কেউ আসেনি গল্পের আসরে।
পরেরদিন সকালে রোজিনা হোসাইনের বাপের বাড়ি থেকে কল আসে। তার একমাত্র ভাইঝি শিমলার বিয়ে। বিয়েটা আরো দুমাস পরে হওয়ার কথা ছিলো। কিন্ত সপ্তাহ খানেক আগে শিমলার হবু শ্বশুরমশাই স্ট্রোক করেন। তাই তিনি তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দিতে চান। আগামি পরশু শিমলার গায়ে হলুদ তারপর বিয়ে।
পরেরদিন সবাই মিলে রওনা দেয় ময়মনসিংহে উদ্দেশ্যে।
সঙ্গে দিগন্তও আছে। রোজিনা হোসাইনের জোরাজুরির কারনে অফিস থেকে চার দিনের ছুটি নিয়েছে দিগন্ত। দিগন্তের হাতে যেহেতু নতুন কোন কেইস নেই তাই ছুটি পেতে সহজ হয়েছে। তবে রফিক মির্জা শর্ত দিয়েছেন। নতুন কেইস হাতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে দিগন্তকে জয়েন করতে হবে। দিগন্ত তাতেই রাজি হয়েছে। ক্রিমিয়ার ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর রফিক মির্জা নিজ সন্তানের মতো স্নেহ করেন দিগন্তকে। সব বিপদ থেকে আগলে রাখেন। ছেলের বয়সি দিগন্তের মাঝে তিনি নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। তরুন বয়সে এমনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, ও প্রখর মেধার অধীকারি ছিলেন তিনি। দিগন্তের প্রতিটা কাজে মুগ্ধ তিনি।
গাড়িতে ব্যাগপত্র তুলছে দিগন্ত আর তন্ময়। ইউনুস হোসাইন ড্রাইভারের সাথে কথা বলছেন। ভূমি রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে দিয়ার সাথে কথা বলছে। রোজিনা হোসাইন রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছু একটা মনে পরতেই রোজিনা হোসাইন ভূমিকে ডাক দিলেন। ভূমি তার মায়ের দিকে তাকাতেই তিনি বললেন,
” আরাভ কখন যাবে?”
” আমাকে কিছু বলেনি।”
” কিছু বলেনি মানে? ওকি যাবে না!”
” আমার সাথে কথা হয়নি।”
” আরাভকে একটা কল দে। দেখ কখন যাবে।”
” আমি কেন? তুমি দাও।”
” তুই দিবি না তো কে দিবে। এখুনি কল দে।”
দিগন্তের ব্যাগপত্র গাড়িতে তুলা শেষ। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে রোজিনা হোসাইন আর ভূমির কথা শুনছিলো সে। রোজিনা হোসাইনের শেষ কথা শুনে দিগন্তের মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কে এই আরাভ? ভূমি আরাভের নাম্বারে দুইবার কল দেওয়ার পরেও কল রিসিভ হচ্ছে না। তৃতীয়বার করে দিয়ে বিড়বিড়াল ভূমি,” এবার যদি রিসিভ নাকরে আর কল দিব না”। তৃতীয়বারও কল রিসিভ হলো না। বিরক্তিতে “চ” উচ্চারণ করলো ভূমি। তারপর রোজিনা হোসাইনের কাছে গিয়ে বলল, “স্যার কল রিসিভ করছে না।”
ভূমির মুখের অঙ্গভঙ্গি লক্ষ করে দিগন্ত তন্ময়কে জিগ্যেস করলো,
” আচ্ছা, এই আরাভটা আবার কে?”
” তুমি চেনো না ভাইয়াকে?”
” তোমার আরো কোন ভাই আছে?” মাথা চুলকে লাজুক হাসি দিয়ে বলল দিগন্ত।
” আমার আপন ভাই নয়। আরাভ ভাইয়া আমার দুলাভাই হয়। আপুর হবু বর।” মৃদু হেসে বলল তন্ময়।
তন্ময়ের কথা শুনে দিগন্তের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। আকস্মিক দুপা পিছিয়ে যায়। মাথাটা কেমন ঘুরতে থাকে। চারিদিকে অন্ধকার দেখতে পায়। স্তব্ধ, বিমূঢ় দিগন্ত যেন স্থান কাল পাত্র সব ভুলে গেল। বুকের ভিতরে চাপা কষ্ট অনুভব করছে সে। চোখদুটো ভিষন জ্বালা করছে। এ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। দিগন্তের চোখের কোনে জমাট বাধলো অশ্রু। আড় চোখে তাকালো ভূমির হাস্যউজ্জল মুখের দিকে। মুহূর্তেই যেন নিজের কষ্ট উপশমের ওষুদ পেল সে। ভূমির হাসি মাখা মুখটা দেখেই নিজের সব দুঃখ কষ্ট অনায়াসে ভুলে থাকতে পারবে। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো দিগন্ত। চোখ বন্ধকরে দীর্ঘশ্বাস নিলো। যতই সে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিকনা কেন? মন ভাঙার কষ্টটা সে উপলব্ধি করছে। বুকের ভিতরের চাপা কষ্টটা তাকে ঠিক থাকতে দিচ্ছে কই। নিজেকে আরো বেশী দূর্বল লাগছে। না দিগন্ত পারবে না, ভূমির সামনে থাকতে। ভূমিকে যতবার দেখবে তাতবারই মনে হবে, তার ভূমি, তার প্রিয় মানুষটা অন্যকারো। এটা সহ্য করতে পারবে না দিগন্ত। তারচেয়ে ভালো সে দূরে চলে যাক। দিগন্ত রোজিনা হোসাইনের কাছে গেল।
” কাকিমনি, আমার না গেলে চলবে না?”
” সে কি কথা। যাবে না কেন? তোমাকে যেতেই হবে।”
” আমার জরুলি একটা কাজ পড়েগেছে আমাকে যেতে হবে কাকিমনি।”
” তুমি না ছুটি নিয়েছো?”
” ডিটেকটিভদের আবার ছুটি। আমাকে এখন যেতে হবে বুঝলে কাকিমনি।”
” যেতেই হবে।”
” হুম। আমি নাহয় বিয়ের দিন আসবো। এখন আসি হুম।
রোজিনা হোসাইন সম্মতি দিয়ে দিগন্তের মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় দিলেন। যাওয়ার আগে দিগন্ত ভূমির দিকে একপলক তাকিয়ে মনে মনে বলল,
” আমি তোমাকে ভালোবাসি আর ভালোবাসবো।দূর থেকেই ভালোবাসবো তোমায়। ঠিক আগের মতো। দূরে গেলে কি ভালোবাসা কমে যায়। না। কমে না। দূরে গেলে ভালোবাসা আরো গাঢ় হয়। আরো গভীর ভাবে ভালোবাসবো তোমায়। তুমি সেটা জানতেও পারবে না। তোমার জন্য কেউ একজন ভিতরে ভিতরে নিঃশেষ
হয়ে যাচ্ছে। না তুমি জানলে, না তুমি শুনলে, না তুমি দেখলে। অথচ মানুষটা কি ভয়ংকর ভাবে তোমার শূন্যতা অনুভব করে যাচ্ছে। নিজেকে হারাতে বসেছে এক ঘোর অনিশ্চয়তায়। সেই খবর তুমি জানো না, হয়ত জানবেও না কোনদিন। ভালো থেকো। নিজের একান্ত প্রিয় মানুষটার সাথে ভালো থেকো।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তন্ময় আর ইউনুস হোসাইনের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় দিগন্ত।
______________________
আরাভের কল এলো রাতের এগারোটার পরে। ভূমি তখন মাত্র ঘুমিয়েছে। নাম্বার না দেখেই কল রিসিভ করে বলে,
” হ্যালো, কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ এলো না। ভূমি পরপর কয়েকবার জিগ্যেস করার পরেও কোন সাড়া পেল না। নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে ভূমি বলে উঠে,
” কথা বলবেন না তাহলে কল করছেন কেন? যত্তসব আজাইরা পাবলিক। রাতবিরাতে মেয়েদের ডিস্টার্ব করাই এদের কাজ। আর একবারও যদি কল করছেন তাহলে আপনার নামে থানায় ইভটিজিং এর ডাইরি করবো।”
কল কটে মোবাইল সুইচ অফ করে ঘুমিয়ে পরে ভূমি। সকালের মিষ্টি রোদ এসে মুখে পরতেই আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠে ভূমি। চাদর সড়িয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ঝলমলে চিকচিক আকাশের দিকে তাকাতেই মৃদু হেসে ফেলে সে। মনে হচ্ছে রাতের দিকে বৃষ্টি হচ্ছে সকালে কেমন ঝলমলে মিষ্টি রোদ। দু হাতে প্রসারিত করে প্রাণভরে শ্বাস নেয় ভূমি। শহরে এই সুন্দর সতেজ সকালটার অভাববোদ করে। এরকম প্রানভরে শ্বাস নিতে পারে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়ায়,
” আজকের সকালটা একটু বেশীই সুন্দর।”
আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো একমনে। মনে মনে সাজালো এক নতুন জগৎ। সাদা মেঘের ভেলা, তার উপর বসে আছে ভূমি আর আরাভ। আরাভের বুকে মাথা রেখে মেঘের উপর ভেসে যাচ্ছে ভূমি আর আরাভ দুহাতে তার প্রিয় রমনীকে আগলে রেখেছে। মাঝে মাঝে অধোর স্পর্শ করছে ভুমির মাথায়। কি সুন্দর, মনোমুগ্ধকর দৃষ্টি। হেসে ফেলল ভূমি।
চুলের টান পেয়ে আহ্ শব্দকরে নিজের ভাবনার জগৎত থেকে বেড়িয়ে আসে ভূমি। বাস্তব অবস্থান বুঝতে আরো কয়েক সেকেন্ড সময় নেয়। যখন বুঝতে পারে তখন রাগে কটমট করে তাকায় সামনে থাকা তন্ময়ের দিকে। তন্ময় তার দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলে,
” মোবাইল কোথায় তোর? ভাইয়া সকাল থেকে কতবার কল করেছে তোর ধারনা আছে?”
” ভাইয়া।” ভ্রু কুঁচকে ফেলে ভূমি। পরক্ষনে স্বরনে আসতেই জিহ্বা কামড়ে ধরে। তন্ময় ভূমির মাথায় চাটি মেরে বলে,
” তোর ঘুম জিবনেও শেষ হবে না। মোবাইল অন করে ভাইয়ার সাথে কথা বলে নি।”
তন্ময় চলে যাবে তখনি ওর পিঠে দুমকরে একটা কিল পরে। তন্মর রাগী চোখ করে ভূমির দিকে তাকাতেই ভূমি ডোন্ট কেয়ার ভাবনিয়ে বিছানায় এসে নিজের মোবাইল হাতে নেয়। মোবাইল অন করতেই কয়েকটা একটা মেসেজ আসে। ভূমির মেসেজ সিন করে পড়তে থাকে।
” কন্ঠে কি আফিম মিশিয়েছ শুনি। যা আমার সর্বশক্তি গ্রাস করে নিয়েছে। আর তুমি আমার নামে ইভটিজিং এর মামলা করবে। মামলা তো তোমার নামে করা উচিৎ।”
প্রথম অংশে পড়ার সময় লাজুক হাসলেও পরের অংশ পড়ে সেই হাসি, সেই লাজুকলতা সব উবে গেল। মনে পরল কাল রাতের কথা। তখন স্যার কল করেছিলো। তাড়াতাড়ি নাম্বার চেক করলো ভূমি। উহঃ শিট। দু আঙ্গুল দিয়ে কপালে স্লাইড করে ভূমি। নাম্বার না দেখে বড্ড ভুল করেছে। স্যার কি এজন্যৈ ওর নামে থানায় মামলা করবে। চিন্তায় ভূমির কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পরলো। না স্যারের কছে ক্ষমা চাইতে হবে। আরাভের নাম্বারে কল করবে ভূমি ওমনি তন্মর ভূমির হাত থেকে মোবাইল নিয়ে দেয় দৌড়। পিছনের দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
” আমাকে মারার শাস্তি এটা। আজ সারাদিন তুই মোবাইল পাবি না।”
ভূমি তন্ময়ের পিছনের ছুটে বলে,
” ভাই আমার মোবাইলটা দে। তোকে আর মারবো না। এই দেখ কান ধরছি আর মারবো না। আমার মোবাইলটা দে।”
চলবে,,,,,,,,