রক্তিম_চন্দ্র #পর্ব_০৪,০৫,০৬

0
395

#রক্তিম_চন্দ্র
#পর্ব_০৪,০৫,০৬
#তুষার_আব্দুল্লাহ_রিজভী
০৪

রাত হয়ে এসেছে। সবাই খাওয়া দাওয়া করে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ পলের বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠলো। হিলারি পলকে বলল দরজাটা খুলতে। পল গিয়ে দরজা খুলে দেখল তার সহকর্মী হেনরি এসেছে। হেনরির হাতে একটা ব্যাগ।
হেনরি ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি বের করে পলের হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, দেখুন তো এই ডায়েরিটা কি আপনার, যেটার খোঁজ করতে বলে ছিলেন?”
ডায়েরিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিয়ে বলল, “ভিতরে এসো, হেনরি।”
হেনরি ভিতরে প্রবেশ করল। পল সোফা দেখিয়ে বলল, “বসো ওখানে।”
হেনরি চুপচাপ বসে পড়ল। পল তার বোনকে ডাকল। কিছু সময়ের মধ্যে তার বোন এসে উপস্থিত হলো ডাইনিং রুমে পল সামনে। পল ডায়েরিটা বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল হিলারিকে, “বোন, এটা কি তোমার ওই ডায়েরিটা নাকি দেখোতো?”
ডায়েরিটা হাতে নিয়ে দেখা মাত্রই চিনতে পারল হিলারি। তার ডায়েরি দেখতে কিছুটা ভিন্নধর্মী৷ ডায়েরির উপরের কভার কালো রঙের। ঠিক মাঝখানে গোলাকৃতির কাচ দেওয়া পাশাপাশি ডায়েরির চারপাশেও কাচ দিয়ে ডিজাইন করা। হিলারি দেখা ডায়েরিটাতে সামান্য চোখ বুলিয়ে বলে উঠল, “হ্যাঁ, এটাই আমার ডায়েরি।”
হেনরি চুপচাপ বসে আছে সোফায়। হিলারির কথাটা শুনে হেনরি হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কারণ এটা অনেক কষ্টে খুঁজে বের করতে হয়েছে তাকে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সে পায় ডায়েরিটা।
হেনরি উঠে দাঁড়িয়ে হাসি মাখা মুখে বলল, “স্যার, তাহলে এখন যাই। আপনার ডায়েরি তো পেয়েই গেছেন।”
“কিছু খেয়ে যাও, হেনরি,” বলল পল।
“আজকে না, স্যার। অন্য কোনোদিন,” হাসি লেগে আছে হেনরির মুখে। “বাড়িতে যেতে হবে, না হলে তো বুঝেনি বউ এর কী জ্বালা!”
“হ্যাঁ, বুঝি। আচ্ছা, তাহলে যাও তুমি।”
হেনরি দরজার ওপাশে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্রই পল এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। হেনরির দিকে তাকিয়ে পল বলল, “ধন্যবাদ, হেনরি।”
হাসিমাখা মুখে হেনরি বলল, “স্যার, ধন্যবাদ দিয়েন না। শুধু শুধু লজ্জিত করছেন। এটা আমার দায়িত্ব ছিল।”
কথাটা বলা মাত্রই হেনরি চলে গেল সেখান থেকে।
ডায়েরিটা নিয়ে হিলারি তার ঘরে চলে গেছে। ডায়েরিটাকে তার ঘরে থাকা আলমারির মধ্যে রেখে দিয়েছে সে। হিলারির বেডের পাশে একটা দোলনায় রিপকে রাখা হয়েছে। ঘুমিয়ে আছে রিপ।
হিলারি দোলনার কাছে গিয়ে দেখতে লাগলো রিপের মায়াবী মুখখানা।
এদিকে পলের চোখেও প্রচুর ঘুম আসছে। পোলেন হেনরিকে বিদায় করে দিয়ে তার বোনের ঘরে ঢুকলো। দেখলো তার বোন দোলনার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পোলেন বোনের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রিপকে দেখতে দেখতে বলল, “রিপের মুখটা কত মায়াবী, তাই না বোন?”
“হ্যাঁ। দেখতে হবে না তার কার ছেলে,” মুচকি হাসল হিলারি।
“তাই তো। আমার বোনের ছেলে,” পলও হাসিতে যোগ দিল বোনের সাথে। “তোমার ডায়েরিটা ঠিকঠাক আছে তো?”
“হ্যাঁ। উপর দিয়ে সব ঠিকঠাকই আছে।”
“আর ভিতরে?”
“কালকে খুলে দেখবো। ভিতরে অবশ্য পানি যাওয়ার কথা না।”
“আমি একটা বিষয় খেয়াল করলাম ডায়েরিটাতে,” আস্তে করে বলল পল
“কী?”
“ডায়েরিটার ডিজাইনটা অদ্ভুত!”
“ওয়াটারপ্রুফ ও তাই ভিজেও নি।”
“সেটাও খেয়াল করেছি।”
“আচ্ছা, বোন এখন ঘুমাতে যাই,” হাই তুলতে তুলতে বলল পল।
“আমারও ঘুম পাচ্ছে।” হিলারি তাকালো পলের দিকে। “যাও গিয়ে ঘুমাও এখন।”
“আচ্ছা বোন, যাচ্ছি।” হিলারির দিকে তাকালো পল। “শুভরাত্রি, বোন।”
“শুভরাত্রি, ভাই।”
পল হিলারির বেডরুম থেকে বের হয়ে গেল। পল তার ঘরে গিয়ে দেখলো তার বেড গোছানো। মুচকি হাসলো সে। কারণ এটা তার বোনের কাজ। এসেই পুরো বাড়িটাকে গুছিয়ে ফেলেছে। তার বোনের হাতে জাদু আছে বলতে হবে। বহুদিন পর নিজেকে শুভরাত্রী বলে নয়, তার বোনকে শুভরাত্রি বলে ঘুমাতে যাচ্ছে পল। এই আনন্দটাও ব্যপক দোলা দিচ্ছে পলের মনে।

৫.

আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন লাগছে। আজও বৃষ্টি হবে। ঘুম ভাঙ্গা মাত্রই পল কিছুক্ষণ উপরে ফ্যানে দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়। তারপর বিছানা থেকে উঠে জ্বালানার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে গতকালকের কথাগুলো আর আজকের পরিবেশটা অনুভব করতে থাকে মুক্ত বাতাসে।
কিছুক্ষণ পর কান্নার শব্দ পেল পল। কান্নাটা রিপের। ঘুম ভেঙ্গে গেছে রিপের তাই কাঁদছে হয়তো, এই ভেবে তার সকল ভাবনা চিন্তা ফেলে রেখে পল চলে গেল রিপের কাছে। রিপ দোলনায় শুয়ে আছে। রিপকে কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামাল পল আর দুলাতে লাগল এদিক ওদিক করে।
পল লক্ষ করলো রিপের মা বেডরুমে নেই। রিপকে কোলে নিয়ে রান্না ঘরের দিকে গেল সে। সেখানেও নেই রিপের মা। সারা বাড়িতে খুঁজে দেখলো তবুও রিপের মাকে কোথাও পেল না সে। রিপকে কোলে নিয়ে বাড়ির আশে পাশে ঘুরতে ঘুরতে “বোন,বোন,” করে ডাকতে থাকলো পল। তবুও তার বোনের কোনো খবর নেই। পলের চিন্তার ভাজ আবার খুলতে লাগল। কোথায় গেল তার বোন?
এদিকে পলের অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। থানায় যেতে হবে, কত কাজ জমে আছে কে জানে? তার উপর গতকালকে যায়নি সে।
পল খুব চিন্তায় পড়ে গেল। চিন্তার পরিমাণ বাড়তে থাকল। এই অজানা শহরে কোথায় যেতে পারে হিলারি আর যাবেই বা কেন? তেমন তো কোনো কাজ নেই এই শহরে আর যাওয়ার জায়গাও নেই তার বোনের। ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে আছে আর ভাবছে তার বোনের কথা।
হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। পল রিপকে সোফায় নামিয়ে শুইয়ে দিয়ে উঠে গেল পল। দরজা খুলে দিয়ে দেখতে পেল, হিলারি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে কিছু জিনিসপত্র প্যাকেট করা।
“বোন, এতো সকালে কোথায় গিয়ে ছিলে আমার ভাগ্নেটাকে একা রেখে?” জানতে চাইল পল।
“সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ফ্রিজে কোনো কিছুই নেই খাওয়ার মতো। তাই গিয়ে ছিলাম খাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে।” ভিতরে ঢুকলো হিলারি। “আর ‘হ্যা’ রিপকে আমি একা কোথায় রেখে গেলাম তার জন্য তো আমার ভাইটা আছে?”
“কতটা চিন্তা হচ্ছিলো আমার জানো? সারা বাড়িতে খুঁজে দেখি তুমি নেই। তখন অনেক চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।” দরজা আটকে সোফার কাছে এসে ভাগ্নেকে কোলে তুলে নিল পল। “এসব কেনার জন্য টাকা কে দিলো? আমি দিয়েছি বলে তো মনে হয় না?”
“পল, তুমিও না অন্যরকম। আশ্চর্য একটা প্রশ্ন করে ফেললে।” হাসলো হিলারি। সোফার সামনে টেবিলের উপর সব জিনিসপত্র রেখে পলের দিকে তাকালো সে। “সকালে বাড়িতে তেমন কিছু নাই দেখে তোমার কাছেই গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছ। তখন দেখলাম বেডসাইড টেবিলে তোমার মানি ব্যাগ। সেখান থেকে কিছু নিয়ে গিয়ে ছিলাম।”
“ওওও, আচ্ছা, ভালোই করেছো।”
“এবার এসো আমাকে হেল্প করো। অনেক ক্লান্ত লাগছে।”
“হ্যাঁ, অবশ্যই।”
“প্যাকেট গুলো নিয়ে ফ্রিজে রাখো। আমি সকালের খাবারের জন্য জিনিস গুলো নিয়ে যাচ্ছি,” বলেই হিলারি কিছু জিনিস নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল। ঢুকেই সে আগে পলের জন্য খাবার প্রস্তুত করতে লাগল।
পল বাকী সব প্যাকেট ফ্রিজে তুলে রাখলো। পল খেয়াল করলো রিপ ঘুমিয়ে গেছে। পল গিয়ে রিপকে দোলনায় শুইয়ে রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বোনের তৈরি খাবার খেয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার আগে রিপের কাছে গিয়ে রিপকে দেখল আর একটা চুম্বন একে দিলো রিপের কপালে।

***

থানায় পৌঁছে পল তার অফিস রুমে গিয়ে বসে বসে এলেক্সার কথা ভাবছে। এলেক্সা মেয়েটা রহস্যময়ী। এলেক্সাকে কখনো সে চিনতেই পারেনি। কারণ সে কোনোদিন জানাতে চায় নি সে কে বা কী চায়? তাকে নিয়ে হ্যাপি আছে কীনা? এরকম হাজারো প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে এখন।
এলেক্সা তাকে নিয়ে হ্যাপি ছিল শুরুতে। তাকে বুঝতো। তার কাজকে সবসময় আগে রাখতো। সবসময় হাসিখুশি থাকা মেয়েটা কেনো হঠাৎ করে চেঞ্জ হয়ে গিয়েছিলো? সেই প্রশ্ন এলেক্সাকে করেনি। মেয়েটার হঠাৎ পরিবর্তন তার চোখে পড়েনি। কারণ সেই সময় ও ঠিক ছিল। সব স্বাভাবিক ছিল।
হঠাৎ একদিন এলেক্সা তার কাছে ডিভোর্স চেয়ে বসে। পলকে ভাবতেও সময় দেয়নি। সব রেডি করেই পল জানায় ডিভোর্সের কথা। এলেক্সার সেদিনের কথাগুলোর জন্যই ডিভোর্স দিয়ে দেয়।
এলেক্সা এতে ভালো থাকলে তার আপত্তি থাকার কথাও না। পল এলেক্সাকে ভালোবাসে আর ভালোবাসার মানুষটাকে ভালো থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়াই উচিত। হঠাৎ কেন এই সিদ্ধান্ত? হয়তো সরি বলে সব আগের মতো গুছিয়ে নেওয়া যেতো। কিন্তু পল তা করেনি। সেদিন এলেক্সার ডিসিশনকে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলো পোলেন। সেটাই হয়তো বড় ভুল ছিল তার। সে কখনো এলেক্সাকে বুঝতে পারেনি। সব ভুল যে পলের তা সে মেনে নিয়েছে অনেক আগেই।
এলেক্সার ভাবনা তাকে ভিতর থেকে তিলে তিলে যন্ত্রণা দিচ্ছে। যার ফলে থানার কোনো কাজ-ই তার মাথায় ঢুকছে না এখন। কোনো কাজেই তার মাথায় বসাতে পারছে না অথচ তার ডেস্কে অনেক গুলো ফাইল পড়ে আছে। যেগুলোর এখনো কোনো সমাধান হয়নি। পোলেন এলেক্সাকে খুব মিস করছে। কোনো উপায় নেই। এলেক্সাকে কাছে আনার সকল রাস্তা বন্ধ।
বেশ কিছুদিন আগে সেই একই জায়গায় বসে ছিল। ভাবনার দুনিয়ায় ঘোরাঘুরি করছিল। সেদিন হেনরি এসে পলকে তাড়া দেয়। শহরে একটা খুন হয়েছে। তাদের সেখানে জেতে হবে এক্ষুনি!
পল হেনরির কথা শুনে চলে থানা থেকে বেড় হয়ে গিয়ে ছিল যেখানে খুন হয়েছে সেই জায়গায়। সেই জায়গাটাকে দেখেই চিনে ফেলে ছিল সে। কারণ সেখানে এলেক্সা থাকতো। সে বাড়ির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবছিল তাহলে কী এলেক্সা… না, তা হবে কেন? এলেক্সার সাথে তো কারো এরকম শত্রুতা নেই যে কারণে কেনই বা… এসব!
হেনরি তখন তার ভাবনার মধ্যে ব্যঘাত ঘটিয়ে দেয়। দু’জনে সেই বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। ডেড বডির পরে থাকা স্থানে গিয়ে পল দেখে এলেক্সার খুন হওয়া বডিটা মাটিতে পড়ে আছে। এটা দেখার পর সে নিজেকে কন্ট্রোল কীভাবে করেছে, সে নিজেই জানে না। ভালোবাসার মানুষটার ডেড বডি! সে অনেক কষ্ট করে হলেও নিজেকে কন্ট্রোল করে। চোখের পানি ঝরতে দেয়নি। কিন্তু সেদিন রাতে বাসায় ফিরে কাদতে কাদতে রাত পার করেছিল সে।
পোলেন নিজেকে কোনোরকমে সামলিয়ে নিয়ে হেনরিকে বডিটা পোস্টমর্টেম এ পাঠাতে বলে। হেনরি তখন নতুন এসেছে এই ডিপার্টমেন্টে। ডেড বডিটা যে স্যারের প্রাক্তন স্ত্রী সে জানতো না তখনো। অবশ্য তদন্তের পর জানতে পারে।
এলেক্সার বডিটা উঠানোর সময় পল লক্ষ করে তার হাতের তালুতে কী যেনো লেখা আছে। পোলেন সামনে গিয়ে এলেক্সার হাতে দেখে, রক্ত দিয়ে লেখা আছে ছোট্ট করে (d-6)। পল বুঝতে পারছিল না এর মানে। খুন হলো কেন এক রহস্য ছিল সেদিন আর (d-6) এর মানে খুঁজা আরেকটা রহস্য ছিল। এজন্য এলেক্সাকে পল সবসময় রহস্যময়ী নারী বলে।
সেদিন বাড়িটাকে সিল মেরে চলে আসে থানায়। গার্ড রেখে আসে বাড়িতে যাতে কেউ ঢুকতে না পারে। তার পরের দিন পল এলেক্সার বাড়িতে যায়। সারা বাড়ি খুঁজতে থাকে। বিশেষ করে এলেক্সার বেডরুম যেখানে তার বডি পরে ছিল সেখান থেকেই খোঁজাখুঁজি শুরু করে।
বেডরুম এলোমেলো পড়ে আছে দেখে একটা সম্ভাবনা খুঁজে বের করলো পল, কেউ এসে ছিল কিছু খুঁজতে এখানে। এমন কিছু ছিল যার কারণে এলেক্সাকে খুন হতে হয়েছে। এলেক্সা না দেওয়ায় হয়তো খুন করতে বাধ্য হয় খুনি। কে আসতে পারে আর কী-ই বা খুঁজতে এসেছিল? এরকম হাজারো প্রশ্ন ঘুরতে থাকে পলের মাথায়। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ সে লক্ষ করে বেডরুমে থাকা টেবিলের পাশে পড়ে আছে একটা বই আর বইয়ের উপর লাল কালি দিয়ে লেখা আছে (d-6)। পোলেন সেটা উঠিয়ে নিয়ে নিজের কাছে রেখে দেয়। সেদিন বাসায় গিয়ে পল বইটা ঘাটাঘাটি করে। সে ভেবে ছিল হয়তো এর মধ্যেই আছে সকল রহস্য। কিন্তু সে ব্যর্থ হয়। সে কোনো ক্লু খুঁজে না পেয়ে বইটা আলমারিতে তুলে রাখে। সে প্রতিদিনই খুঁজে বেড়ায় বইটাতে। কোনো লাভ হয় না। সে তেমন কিছুই খুঁজে পায় না।
কিছুদিন এই কেসটা নিয়ে অনেক তদন্ত হলেও একটা সময় পর এটা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ তারা তদন্ত করে খুনির কাছে না পারছিল পৌঁছাতে, না পারছিল কোনো ক্লু বেড় করে একটা সমাধানে আসার। ক্লু বলতে (d-6) লেখাটাই তার কাছে ছিল। যেটার মানে সে কখনো খুঁজে বের করতে পারেনি। কেসটা অন্য কেসগুলোর নিচে চাপা পড়ে যায়। কিন্তু পল কখনো তার এক্স স্ত্রীর এলেক্সার এভাবে চলে যাওয়া মানতে পারেনি আজও।
পোলেন তার সদ্য সম্পর্ক তৈরি হওয়া বোনকে বলেই নি যে, এলেক্সা খুন হয়েছিল তার এই শহরে। আর সে বলতেও চায় না কখনো।

৬.

দিন গড়িয়ে যেতে থাকে। সময়ের ঘড়ি বাড়তে থাকে। রিপ বড় হতে থাকে। রিপকে সবসময় তার পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেয় তার মা ও মামা।
রিপের যখন থেকে বোঝার বয়স হয়েছে, তখন থেকেই সে ভ্রমণ করতে ভালোবাসে। সে সবসময় ঘুরতে ভালোবাসে। বিভিন্ন নতুন নতুন জায়গায় ভ্রমণ করাটা নেশা হয়ে ওঠে তার কাছে। এক জায়গায় দু’বার ভ্রমণ করতেও ভালো লাগে না রিপের। একটা জায়গাতে বেশিক্ষণ তার মন টিকাতে পারে না।
রিপ সবসময় নতুন স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ অবধি ছুটির যে দিনগুলো পেতো, সেই দিনগুলোতে ভ্রমণ করার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যেতো। বন্ধু-বান্ধব সঙ্গে গেলে মজা করতে পারতো, ভ্রমণটাতে বেশ স্বাচ্ছল্য বোধ করতো কিন্তু তাদের কেউ সঙ্গে না থাকলে একাই চলে যেতো তার ভ্রমণে। উপভোগ করতো ঠিক মতোই।
রিপের মা প্রায় লক্ষ করতো রিপ যতোই বড় হতে থাকে তার ভ্রমনের নেশাটা বাড়তে থাকে। রিপের বাবাও ছিল ভ্রমণ পিপাসুদের একজন। ভ্রমণ করতে না পারলে আর নতুন কিছুর সন্ধান না পেলে তখন যেনো নাজেহাল অবস্থা হয়ে যেতো। নতুন কিছুর সন্ধান করার উদ্দেশ্যে ভ্রমণ তো করতেই হতো।
রিপের মা হারাতে চায় না রিপকে। ভ্রমণের জন্যই রিপের বাবাকে হারিয়েছে সে। রিপের এই ভ্রমণের এই নেশাটা দূর করার জন্য অনেক কিছু করেছে কিন্তু কাজ হয়নি। বাড়িতেও আটকে রাখতে পারেনি রিপকে। কারণ রিপের প্রতি ভালোবাসাটা অনেক বেশিই। ছেলেকে বাড়িতে আটকে রাখলে বেশি কষ্টটা তার-ই হয়। তাই রিপকে বাড়ির মধ্যে আটকে রাখাটাও সম্ভব হয়নি।
সবসময় ছেলের জন্য চিন্তা হয় তার। কখন যে কী হয়! দুশ্চিন্তায় থাকতে হতো রিপের মাকে। যেখানেই যেতো রিপ, সবসময় তার মা খোঁজ খবর রাখার চেষ্টা করতো। তবুও বহু জায়গা আছে যেখান থেকে যোগাযোগ সম্ভব হয়না। তখন রিপের মা ছেলের জন্য দুশ্চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া সব ভুলে যেতো।
রিপের মা রিপের আরো একটি বিষয় লক্ষ্য করতো। রিপ আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়। তার ভাবনাগুলো অন্য রকম। সে ভাবতো সবসময় একটু বেশিই। যে কোনো কাজে রিপের ব্রেন অনেক বেশি-ই কাজ করে। রিপ যেকোনো বিষয় খুব সহজেই সমাধান করে ফেলে। ভ্রমণের পাশাপাশি বিভিন্ন রহস্য সমাধানেও নিজেকে দক্ষ করে তুলতে থাকে। ছোটো বড় কোনো রহস্যের গন্ধ পেলেই সেখানে ছুটে যায়। মাঝে মাঝে রিপ তার মামার বিভিন্ন কেসেও সাহায্য করতে থাকে।
তার মামা পুলিশ অফিসার পল রিপকে ডিটেকটিভ হতে বললে রিপ সরাসরি তার মামাকে না বলে দেয়। কারণ ডিটেকটিভ হওয়ায় তার কোনো ইচ্ছে নেই। সে শুধু তার জীবনকে উপভোগ করতে চায়।

এভাবে কেটে যায় ২২ বছর…

রিপের মা হিলারি এখন বেঁচে নেই। দু’বছর আগে রিপের মা মারা যায়। রিপের মা রিপকে তার ডায়েরিটা দিয়ে গিয়ে ছিল। ডায়েরিটা লক করা অবস্থায় ছিল। খোলার মতো চাবি ছিল না রিপের কাছে। তার মার কাছেও ছিল না তাই হয়তো দিয়ে যেতে পারেনি। শুধু বলে গিয়েছিল, প্রয়োজনে পড়লে খোলার উপায় এমনিতেই জেনে যাবে সে। রিপেরও সেই ডায়েরির প্রয়োজন কখনো পড়ে না। ডায়েরিটা মায়ের শেষ স্মৃতি মনে করে সবসময় রিপের কাছে রেখে দেয়। কখনো হাতের বাইরে রাখেনি। নিজের কাছেই রাখতো। মাঝে মাঝে মায়ের কথা বেশি মনে পড়লে ডায়েরিটা ছুঁয়ে দেখতো। তখন তার মনে হতো, তার মা একদম কাছেই আছে তার।
রিপের সম্পূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়ে রিপের মামা পলের উপর। মামা তো মামাই হয়। পল কখনো তার ভাগ্নের সাথে উঁচু গলায় কথাও বলে না। পল রিপকে রিপের ইচ্ছে মতো সব দিতে থাকে। রিপের যখন যা দরকার, বলতে দেরি হলেও রিপের চাহিদা পুরণ করতে দেরি হয় না। একমাত্র ভাগ্নেকে রাজপুত্র করে রেখেছে পল।
দ্বীপে ঘুরতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো রিপের। সমুদ্রে ভ্রমন করতো বেশি তার বাবার মতো। নতুন কোনো দ্বীপ খুঁজে বের করে সেটা সম্পর্কে জানাও তার জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরী কাজ। রিপ শুধু ভ্রমনই নয়, ভ্রমনে যদি ভয়ানক কিংবা বিপদজনক কিছু না থাকে তাহলে রিপের ভালো লাগে না। যেখানে খুব মারাত্মক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেখানে ভ্রমন করতে চাইতো রিপ। কিন্তু কখনো এরকম জায়গায় ভ্রমণ করা হয়ে উঠেনি। রিপ অনেক জায়গায় ভ্রমণ করেছে কিন্তু আজও মারাত্মক বা ভয়ানক কোনো ঘটনা ঘটেনি তার সাথে।
রিপ গত সপ্তাহে সমুদ্রপথে একটা দ্বীপে ঘুরতে গিয়েছিল। সেটাও আর পাঁচটা দ্বীপের মতো ছিল। ঘুরতে গিয়ে বোরিং অনুভব করেছে বেশি। নতুনত্ব না পাওয়ায় ফিরে আসতে হয়েছে বাধ্য হয়ে।
রিপ বাড়িতে ফিরে এসেছে। রিপ আসার পর থেকেই মনমরা হয়ে আছে। রিপকে দেখে তার মামা খুশি না হয়ে উল্টো চিন্তায় পরে গেল। খেয়াল করলো রিপের চোখে মুখে কোনো রসকষ নেই, মনমরা থাকছে বেশি সময়। রিপকে অনেকবার জিজ্ঞেস করে তার মামা কী হয়েছে তার? কোনো উত্তরই দেয় না রিপ।
পোলেন আরো দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় ভাগ্নের জন্য। কিছু হয়নি তো আবার রিপের। ভ্রমণের আগে তো খুব ভালোই হাসিখুশি ছিল কিন্তু আসার পর এমন কি হলো রিপের?

কিছুদিন এভাবেই কেটে যায়।

রিপ আর পল দু’জনে রাতে খাওয়া দাওয়া করে এক সাথে বসে টিভি দেখছে। রাত হলে দুই মামা ভাগ্নের টিভি দেখার অভ্যাস পুরোনো। রাতে খাওয়া দাওয়া করেই টিভি না দেখলে ঘুম আসে না তাদের।
হঠাৎ খবরের একটা চ্যানেলে চোখ পড়ে গেল রিপের। সে খবরে দেখতে পেল সমুদ্রের মাঝখানের কোনো একটা জায়গায় জাহাজ গেলে সেখান থেকে আর ফিরে আসতে পারে না। কারণ সেখান থেকে বিশাল বড় বড় জাহাজ গায়েব হয়ে যায়। কেন হয় তা কেউ জানে না। রহস্যে ঘেরা সেই জায়গা। সেটাকে ঘিরে অনেক রহস্য তৈরি হয়েছে।
রিপ খবরটা মনোযোগ দিয়ে দেখে তার মামার দিকে তাকাল। রিপের মামার বুঝতে বাকি রইলো না রিপ কী চাচ্ছে। রিপের মনে ইচ্ছেটা কী?
রিপ কিছু বুঝার আগেই রিপের মামা বলে উঠল, “রিপ তুমি কী বুঝাতে চাইছো বুঝেছি, কিন্তু যাওয়াটা ঠিক হবে না। এমন আবদার করো না, ভাগ্নে।”
রিপ কথা শুনেই মন খারাপের স্বরে বললো, “কেন মামা?”
“কারণ, সেখানে জীবনের একটা ঝুঁকি আছে,” শক্ত গলায় বললো পল। “তোমার রহস্য ভালো লাগে। তুমি ঘুরতে পছন্দ করো। তোমার এডভেঞ্চারকেও আমি সবসময় সমর্থন করি। তাই বলে জীবনের ঝুঁকি আর না ফেরার ভয়ে আমি তোমাকে পাঠাতে পারিনা ওখানে। তাছাড়া তোমার মা আমাকে তোমার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। জেনে শুনে তো তোমাকে ওই জায়গায় যেতে দিতে পারি না আমি। দায়িত্বের অবহেলা করতে চাই না। তোমার কোনো ক্ষতি হলে এর দায়ভার তো আমাকেই নিতে হবে। কষ্টটা তো কম হবে না।
“মামা, প্লিজ আমাকে যেতে দাও,” অনুরোধ করল রিপ। তাকিয়ে রইলো তার মামার দিকে।
পলও তাকিয়ে রইলো ভাগ্নের চোখের দিকে। রিপের চোখের মায়া সে বুঝতে পারছে। কী চাইছে রিপ সেটাও সে বুঝতে পেরেছে কিন্তু ভাগ্নের অন্যায় আবদার এটা৷ সে সবসময় তার ভাগ্নের খেয়াল রাখে। যেখানে যায় রিপ তাকে দূর থেকে তার খবরাখবর রাখার জন্য লোক লাগিয়ে রাখে। যাতে করে রিপ যখনি কোনো বিপদে পড়বে তাকে যেন সাহায্য করা যায়। রিপের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে অনেক খেয়াল রাখতে হয়। রিপ ছাড়া পলের এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। ভাগ্নেকে ঘিরে তার জীবন।
ভাগ্নের কষ্টটাও সহ্য করতে পারবে না পল। সেটা সে ভালো করেই জানে। পল চোখের সামনে রিপের মন খারাপ করে থাকাটা সে দেখতে পারবে না। সে আর বাঁধা দিতে চাইলো না রিপকে।
কিছু সময়ের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল তাদের মাঝে। নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে পল বলল, “আচ্ছা, যেও। সামনের সপ্তাহে ব্যবস্থা করে দেবো। তবে ওখানে গিয়ে যদি সবার মতো…”
“কিচ্ছু হবে না, মামা,” পলকে থামিয়ে দিয়ে রিপ বলে উঠল। “সবসময় কী একই রকম হয় নাকি! আমি যাচ্ছি ওই জায়গাটার খোঁজে। দেখতে চাই কী এমন আছে?”
“আচ্ছা, ঠিকাছে। তোমাকে বাঁধা দিলে শুনেছো কবে,” নিচু স্বরে বলল পল।
পলের অনুমতি পেয়ে রিপ অনেক খুশি হয়েছে। খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে তার। ঠিক তখন কী যেনো মনে করে রিপের মন ভারী হয়ে গেল।
পল ভাগ্নের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল মন খারাপ হয়েছে কিছু ভেবে। পোলেন রিপকে জিজ্ঞেস করল, “তোর আবার কী হলো? এইতো খুশি ছিলি আবার এখনই মন খারাপ হয়ে গেল। কিছু লাগবে নাকি?”
“মামা, এবার আর তা করতে পারবে কিন্তু,” রিপ আবেগি কন্ঠে বলল।
“কী করতে পারবো না বলবি তো?” চিন্তার ভাজ পড়লো পলের মনে।
“এবার আর কোনো লোক লাগাতে পারবে না আমার খোঁজ খবর রাখার জন্য। আমি একা এডভেঞ্চার করতে চাই৷ তোমার এই স্বভাবের কারণে এডভেঞ্চারে শান্তি আসে না।”
রিপের কথায় দাগ কেটে গেল পলের মাঝে। তার মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরছে রীপ বুঝলো কীভাবে এই বিষয়টা। এটা তো সে কাউকে জানায়নি।
রিপ বলে উঠল, “কী ভাবছো মামা? জানলাম কীভাবে? আমাকে এত কাঁচা ভেবো না। তুমি ভালো করেই জানো আমি কী আর কেমন?”
পল ভালো করেই জানে রিপ কেমন। তার কাছে লোক লাগানো থাকে আর সেই বিষয়টা ধরতে পারা খুব কঠিন কোনো বিষয় না।
পল কোনো উপায় না পেয়ে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আাছে। তোর যা ইচ্ছে।”
এটা শুনে রিপের মন আবারো খুশিতে ভরে উঠল।

চলবে?…

(সবাই অবশ্যই মন্তব্য করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here