#রক্তিম_চন্দ্র
#পর্ব_৩
#তুষার_আব্দুল্লাহ_রিজভী
কিছুদিন পর…
সেদিন সেই কলটার পর পল ঘাবড়ে গিয়েছিল কিছুটা। তবে নতুন একটা কেসের দায়িত্ব পেয়েছিল সে। কেসটা সে গুছিয়ে উঠেছে এখন। সমাধানও করে ফেলেছে৷ মার্ডার কেস ছিল একটা। একটা ছোট্ট মেয়েকে হত্যার পর লাশ টুকরো করে বস্তাবন্ধী করা হয়। এই কাজটা মেয়ের নিজের বাবাই করেছিল। পল এটা খুঁজে বের করার পর নিজেই চমকে উঠেছিল। এরপর মেয়ের বাবার স্বীকারোক্তি নিয়ে কেসটা কোর্টের উপর ছেড়ে দিয়েছে। সরকার যা শাস্তি দিতে চায় দিবে। তবে, লোকটা প্রচুর ঘৃণা করে পে।
বর্তমানে পল তার বড় বোন হিলারি ও ভাগ্নে রিপকে নিয়ে চলে এসেছে তার নিজের বাড়িতে। সকলে এখন পোলেনের ড্রইংরুমে। কিছুক্ষণ আগেই বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করেছে তারা।
হিলারি ড্রইংরুমের চারপাশে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিল বেশ কয়েকবার। হিলারির অগোছালো বাড়ি-ঘর পছন্দ করে না। এখানে ড্রইংরুমের পরিবেশ দেখে তার মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার অবস্থা। ড্রইংরুমের তেমন কিছু নেই। থাকার মধ্যে টিভি, সোফা সেট, একটা মাঝারি আকারের টেবিল ছাড়া তেমন কিছু নেই। সোফার উপরে কিছু জামা কাপড় ছড়িয়ে আছে। টেবিলের চারপাশে খাবারের নোংরাগুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
এসব দেখে হিলারি একটু উঁচু গলায় বলে উঠল, “ড্রইংরুমটার একি অবস্থা করে রেখেছো, ভাই!” জোরে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। সোফার কাছে গিয়ে জামাগুলো হাতে নিতে নিতে বলল, “সব কিছু চারদিকে এমন ছড়ানো ছিটানো কেন?”
পোলেন লজ্জায় মাথা নিচু করল৷ পরক্ষণেই হিলারির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি একা থাকি আর এসব তো মেয়েদের কাজ তাই না। একা যতটুকু পারি করি। আর সারাদিন থাকতে হয় পুলিশ স্টেশনে। এত কিছুর খেয়াল রাখা যায় নাকি বলো, বোন?”
কিছু একটা ভেবে হিলারি বলল, “ও, ভালো কথা মনে পড়ল আমার। তোমার স্ত্রী কোথায়? নাকি এখনো বিয়েই করোনি।”
“বিয়ে তো করে ছিলাম,” থেমে গেলো পল। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না।
“কী হলো থামলে কেন? পুরো কথা বলো,” আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল হিলারি।
“তেমন কিছু না। আমি করি পুলিশের চাকরি আর এ কাজে জানোই তো বেশী সময় হয় না পরিবারের সাথে থাকার জন্য। আমি ওকে সময়ও দিতে পারতাম না তেমন। তাই চলে গেছে দূরে ডিভোর্স দিয়ে,” কন্ঠে ক্লান্তি চলে আসল পলের।
“ওরে, আমার ভাইটারে,” আদর মাখা কন্ঠে বলল হিলারি। “তোমাকে আর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। একটা গেছে তো কী হয়েছে আরো একটা বিয়ে করাবো আমার ভাইটাকে। সুন্দর একটা ফুটফুটে বউ আনব তোমার জন্য।”
“দেখো বোন, তুমি যা মন চায় করো আমি কিছুতেই নিষেধ করবো না, কিন্তু প্লিজ আমাকে কখনো বিয়ের কথা বলবে না,” জোর গলায় বলল পল। মনটা বিষণ্ণতায় ভরে উঠল।
“কেন, তুমি কী বিয়ে করবে না নাকি? তোমার জীবনটাকে গোছাতে হবে তাই না?”
“না, হবে না,” রাগান্বিত কন্ঠে বলল পল। “তুমি আর রিপ এখন থেকে আমার জীবন। চাকরির পাশাপাশি যতটুকু সময় পাই তোমাদের সাথে কাটাতে চাই আর কিছু লাগবে না আমার। প্লিজ, এসব বিয়ের কথা আর কখনো তুলো না।”
পল কথাটা বলেই তার নিজের বেডরুমের দিকে চলে গেল রিপকে কোলে নিয়ে।
হিলারিও আর কিছু না বলে ড্রইংরুম গোছানো শুরু করে দিল। হিলারির খারাপ লাগতে শুরু করলো হয়তো তার কথায় পল রাগ করেছে এই ভেবে। সে ড্রইংরুম গুছিয়ে পলের বেড রুমের দিকে গেল। ভাইটাকে “সরি” বলে মনটাকে ভালো করার জন্য।
পল বেডরুমে আসা মাত্রই রিপের ঘুম ভেঙ্গে যায়। পল খেয়াল করলো ঘুম ভাঙ্গার পর রিপ কাঁদলো না, উল্টো তার কোলে থাকা অবস্থায় ধরার চেষ্টা করছে দু’হাত বাড়িয়ে। রিপকে বিছানায় রেখে পল মেঝে তে হাটু গেড়ে বসে তার হাত আঙ্গুল বাড়িয়ে দিল রিপের দিকে৷ রিপ সেটা ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে আঙ্গুল ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পলের আঙ্গুল রিপ যেই ধরছে ওমনি আঙ্গুল সরিয়ে ফেলছে সে, আবার আঙ্গুল বাড়িয়ে দিচ্ছে। রিপ হেসে উঠছে বারবার এরকম করাতে। রিপ এটা করতে খুব মজা পাচ্ছে।
হিলারি পলের বেডরুমে প্রবেশ করল। পুরোপুরি ঢুকল না। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ৷ হিলারি দেখল দুই মামা ভাগ্নে মিলে খেলা করছে। একটু দূর থেকে দেখে হিলারি বুঝলো তার সন্তান রিপ ও তার নতুন ভাইয়ের মধ্যে দারুন মিলবন্ধন হয়ে উঠেছে।
হিলারির চোখ বেডসাইড টেবিলটার কাছে গিয়ে ঠেকল। একটা মেয়ের ছবি সেখানে। দেখে মেয়েটাকে তার পরিচিত মনে হলো। একটা ইচ্ছাকৃত কাশি দিয়ে বেডরুমে ঢুকে গেল সে।
“ভালোই তো খেলা করছো তোমরা,” বলে উঠল হিলারি।
“তুমি এখানে কখন আসলে, বোন?” জিজ্ঞেস করল পল।
“এই তো কিছু সময়।” হেসে উঠল হিলারি। “তোমাদের বিশেষ করে আমার ভাইটার বাচ্চামো স্বভাবটা দেখছিলাম।”
“কী যে বলো বোন,” লজ্জা পেল পল। “তাছাড়া আমি বড় হলামই বা কবে?” হো হো করে হাসতে লাগল সে।
“হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না।” মুচকি হাসল হিলারি। “সরি, ভাই।” কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল সে।
“সরি কেন?”
“তখনকার বিষয়টার জন্য।”
“বোন এখন কিন্তু রাগ করবো আমি।”
“কেন ভাই?”
“তুমিই তো বলবে, তাই না?”একটু থেমে গেল আবার বলল পল, “তখন আমিই একটু ওভার রিয়েক্ট করে ছিলাম। সরি তো আমার বলা উচিত।”
“আচ্ছা হয়েছে বাদ দাও এই বিষয়,” হিলারি বেডসাইড টেবিলের কাছে গিয়ে ছবিটা হাতে নিয়ে দেখেতে লাগল ভালো করে। এতক্ষণ বেশ কয়েকবার তাকিয়ে দেখছিল ছবিটা। সে পলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, এই ছবিটা কার ছবি?”
“আমার স্ত্রী এলেক্সার ছবি,” উত্তর দিল রিপের দিকে তাকিয়ে থেকেই পল।
“এলেক্সা!” নামটা শুনে কিছুটা বিস্ময় হলো হিলারি। “একে তো আমি দেখেছি.”
“কী, বলছো বোন?” উঠে দাঁড়ালো পল। হিলারির পাশে গিয়ে দাড়িয়ে বলল, “এটা হয়তো তোমার মনের ভুল হবে। এলেক্সা থাকে এই শহরেই। এলেক্সা কে দেখবে কী করে? তোমার মনের ভুল ছাড়া আর কিছু না।”
“আরে না, ভাই। মনের ভুল হবে কেন? আমি এলেক্সাকে দেখেছি সামনা-সামনি।” আত্মবিশ্বাসের সাথে জোর দিয়ে বলল হিলারি।
“এটা কী করে সম্ভব? এলেক্সা থাকে এই শহরে। ডা. ভেলি হচ্ছে গিনিয়ানার। এখন থেকে ওতদূর গিয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না আর সেখানে এমন কোনো কাজও এলেক্সার থাকার কথা না। তাহলে?” জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে তাকালো হিলারির দিকে।
“আচ্ছা বলছি শোনো,” বলতে শুরু করলো হিলারি। “গত ৩-৪ মাস আগে একটা প্রেস কনফারেন্স ছিল গিনিয়ানায়। আমার স্বামীর আর সেখানে এই মেয়েটি মানে এলেক্সাও ছিল। সে আমার স্বামীর সাথে ছবিও তুলেছিল। সেই সময় আমি এলেক্সাকে দেখি।” আরো কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল হিলারি।
“তাই!” অবাক হলো পল। বলল, “এলেক্সার ব্যপারে আমি খোঁজ রাখি সবসময়। ৩-৪ মাস আগে ও এই ফ্রেইজা ছেড়ে কোথাও গিয়েছে বলে মনে হয় না।”
“হয়তো তুমি খোঁজ নিতে ভুলে গিয়েছিলে হয়তো তখন।”
“হ্যাঁ, হতেই পারে। কোনো প্রয়োজনে গিয়েছিল নাকি?”
“সেটা বলতে পারবো না।” কিছু লুকিয়ে গেল হিলারি। সব বলা ঠিক হবে না বলে মনে করল হিলারি, “বাদ দাও তো এসব এখন।”
“কিন্তু…”
“কোনো কিন্তু নয়।” এ ব্যাপারে কিছু বলার আগে থামিয়ে দিল পলকে। “আগে বলো, তোমাকে যে ডায়েরিটার খোঁজ-খবর নিতে বলেছিলাম, খোঁজ নিয়ে ছিলে?”
“হ্যাঁ, বোন। আমি বলে দিয়েছি থানায়। ওরা খোঁজার কাজে ব্যস্ত আছে।”
“ওই ডায়েরিটা যেভাবে হোক এনে দিতে হবে আমাকে, ভাই।” হিলারি নরম কন্ঠে বলল, “আমার স্বামীর শেষ সম্ভল ছিল ওই ডায়েরিটা।”
“আচ্ছা, বোন। তুমি চিন্তা করো না।” চিন্তা মুক্ত করার জন্য পল বলল। “আমি ওটা তোমাকে এনে দেবো যেভাবেই হোক।”
এটা বলেই পল চলে গেল তার ভাগ্নের কাছে। রিপ ভালোই খেলা করছে তার মামার সাথে। রিপের কাছে থাকবে আজ সারাদিন। পল থানায় ফোন করে বলে দিয়েছে, সে আজ আর থানায় যাবে না। কারণ আজ সে তার বোন আর ভাগ্নের সাথে ব্যস্ত থাকবে। পল আজ বহুদিন পর থানা থেকে ছুটি নিয়েছে। তার নতুন পরিবার হয়ে উঠেছে। এখন থেকে সে তার জীবনে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আনার চেষ্টায় থাকবে।
চলবে?…
(অবশ্যই সবাই মন্তব্য করবেন)