রক্তিম_চন্দ্র #সূচনা_পর্ব

0
1318

#রক্তিম_চন্দ্র
#সূচনা_পর্ব
#তুষার_আব্দুল্লাহ_রিজভী

সদ্য মা হতে চলেছে একজন মহিলা। ব্যথায় রাস্তার এক পাশে পড়ে আছে। সন্তান প্রসবের বেদনা উঠেছে। কিন্তু আশেপাশে ধরা বা দেখার মতো কেউ নেই। এমন একটা রাত যে রাতে শহরের পুরো রাস্তা ফাঁকা। বৃষ্টির ফোঁটা মহিলার উপর আঘাত করে যেন সেই মহিলার ব্যথার আর্তনাদকে শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আশে পাশে কোনো মানুষের চিহ্নও নেই। মহিলাটা মুখ বুঝে সব কষ্ট সহ্য করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে চলল।
বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেছে। মহিলা বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে পুরোপুরি। বিদ্যুৎ চমকালে তার চেহারা আর দেহাবয়বের কিছুটা অংশ দেখা যায়। কিন্তু দেখার মতে কেউ নেই। প্রসবের ব্যথায় কর্দমাক্ত মাটিতে রীতিমতো গড়াগড়ি খাচ্ছে তো খাচ্ছেই।

***

ওদিকে পুলিশ অফিসার পল তার অফিসের সকল কাজ গুছিয়ে রেইন কোর্ট গায়ে জড়িয়ে নিলো। পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে পার্কিং লটে থাকা তার বাইকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাড়ির উদ্দেশ্যে। আজকে তাকে অনেকগুলো কেসের ফাইল সামলাতে হয়েছে। সে সব দেখতে দেখতে কখন যে মাথা ব্যথার শিকার হয়েছে খেয়াল নেই। মাথা ব্যথা করলেও তার কাজকে সবার আগে প্রাধান্য দেয় সে। কাজ শেষ করে একটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে, আজকে বাড়িতে গিয়ে একটা সেই রকম ঘুম দিতে হবে। পরিশ্রমের পাশাপাশি ঘুমটাও জরুরী একটা বিষয়। এই ঘুমের মাধ্যমে রিফ্রেশ করে নিবে নিজেকে। নতুন দিন নতুন উদ্যোমে কাজে লেগে পড়বে সে।
বাইক চালানোর সময় পল তার আশেপাশে খেয়াল করতে করতে যায়। যাতে কেউ অসুবিধেতে পড়লে তার নজরে আসে আর সে সাহায্য করতে পারে। আজকেও বাইকা চালাচ্ছে আর আশেপাশে নজর রাখছে।
তার বাবাও একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। তার বাবার আদর্শে সে বড় হয়েছে। সৎ ভাবে সে তার সকল কাজ সম্পূর্ণ করে। পোল তার শহরের মানুষের যেকোনো সাহায্যে আগে এগিয়ে আসে। এজন্যই হয়তো তার শহরে ইদানীং কোনো আসামি ধরতে হচ্ছে না৷ বড় বড় দাগী আসামিরাও তাকে দেখলে একবার স্যালুট তো দিবে-ই।
পলের হাত ধরে বহু আসামি এ শহরে নতুনভাবে সৎ রাস্তায় বেঁচে থাকতে পারছে। পলের বাবা পলকে ছোটো বেলায় কিছু কথা বলতেন, “দেখ পল, পুলিশ হয়েছি বলেই যে সকল আসামি ধরে সাথে সাথে জেলে ভরে দিতে হবে, কোর্টে চালান করে তার উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে বিষয়টা কিন্তু এমন নয়! একজন পুলিশের দায়িত্ব মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া, সেবা করা। সেক্ষেত্রে আসামিরাও তো মানুষই। তাদের জীবনের পিছনে একটা অন্ধকার জীবন থাকে। কেউ ইচ্ছে করে কোনো খারাপ কাজে জরায় না। তাদেরকে যদি আলোর পথে এনে সুস্থ একটা জীবন দেওয়া যায় তাহলেই তারা সারাজীবন আলোর পথে চলতে পারে৷ তারা যদি ভালো পথে চলে তাহলে শহরে আর খারাপ কোনো কাজও হবে না। সাধারণ মানুষের জীবনও নিরাপদ থাকবে। তাই আসামিদের আলোর পথ দেখিয়ে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। এটাই পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য আমি মনে করি। এভাবে একটা সুন্দর জগৎ সাজানো যায়।”
পল সেই আদর্শে বড় হয়েছে। বাবার কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আসছে আজ বহু বছর যাবৎ। যে কারণে তার দায়িত্বে থাকা শহরে এখন খারাপ কাজের পরিমাণ কমে গেছে।
বাইক চালানোর সময় হঠাৎ বাইকের সামনের হেডলাইটের আলোতে কিছু একটা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো৷ দূর থেকে কিছুটা বোঝা যাচ্ছে সেটা নড়ছে বারবার। বাইক নিয়ে সেটার কাছে যেতেই দেখলো সেখানে একজন গর্ভবতী মহিলা। রাস্তার পাশে কর্দমাক্ত মাটিতে পড়ে আছে। ব্যথায় ছটফট করছে, খুব যন্ত্রনার মধ্যে আছে মহিলাটা। পল দ্রুত বাইকটাকে রাস্তায় পাশে দাঁড় করিয়ে মহিলার কাছে গেল। মহিলাকে ধরাধরি করে উঠিয়ে নিয়ে বাইকের সামনে কোনো রকমে বসিয়ে বাইক চালতে লাগল।
এই শহরের প্রতিটা গলি পলের চেনা। সে জানে সামনে কাছে কোথায় হাসপাতাল আছে। ডেলফোর্ট হাসপাতালটা একেবারে কাছেই ছিল। এখান থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। সেটার উদ্দেশ্যেই যেতে লাগল। জলদি, যত দ্রুত সম্ভব তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এই চিন্তাটা তার মাথায় বারবার টোকা দিচ্ছে আর সেই চিন্তার ভাজে পড়ে গিয়েই দ্রুত বাইক ছোটাচ্ছে।
হাসপাতালের সামনে গিয়ে বাইক থামিয়ে মহিলাটাকে কোলে তুলে নিলো পল৷ হাসপাতালের ভিতরে প্রবেশ করেই সেখানে থাকা ডাক্তার আর নার্সদের ডেকে তাদের কাছে হস্তান্তর করে দিল মহিলাটাকে। পোলের খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল মহিলাটাকে নিয়ে। কেনোই বা চিন্তা করবে না। দেখেই বোঝা যায় সদ্য মা হতে যাওয়া একজন মহিলা। সে রাস্তায় এভাবে পড়ে আছে। খুব বড় বিপদে না পরলে তো এমন হওয়ার কথাও না। কিন্তু তার পরিবার কোথায়?
চিন্তা করতে করতে পলের কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়তে লাগল। ঠোঁটের উপর বিন্দু বিন্দু ঘামের আবির্ভাব হলো। সে রেইনকোর্ট পড়ে থাকার কথা এতক্ষণে খেয়াল করেছে। হাসপাতালের ওয়াশরুমে গিয়ে সেটা খুলে ফেলল সে আর চোখে মুখে পানিয়ে দিয়ে নিল।
মহিলার মুখ ভালোভাবে দেখহাসপাতালে প্রবেশের পর। দেখে যতটুকু বুঝেছে সে এখানকার নয়। এখানকার মানুষেরা সাদা বর্ণের আর কালো বর্ণের। কিন্তু মহিলা শ্যামলা বর্ণের ছিল।
শ্যামলা বর্ণের একজন মহিলা কিন্তু এখানে কীভাবে আসলো? ঘুরতে নাকি অন্য কোনো কারণে? কেনোই বা পড়ে ছিল এভাবে? তার সাথে কী আর কেউ ছিল না? এরকম অনেক প্রশ্ন পোলের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। এত ভাবনার মাঝেও সে তার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে নিল এই বলে, “এই মহিলা যেনো সম্পূর্ণ সুস্থ থাকে আর তার বাচ্চাটাও। না হলে এদের কোনো ক্ষতি হলে সম্পূর্ণ দায়ভার আমাকে বহন করতে হবে। হে ঈশ্বর, তাদের সুস্থ রেখো।”
প্রায় আধা ঘন্টার পর একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ পেল পল। সে অপারেশন থিয়েটারের সামনে অপেক্ষা করছিল এতক্ষণ। একজন নার্স বাহিরে এসে পোলেনকে জানিয়ে দিল, “সেই মহিলার ছেলে সন্তান হয়েছে।” এটা শুনে সে খুব আনন্দিত বোধ করলো। কারণ আজ একটা নবজাতকের প্রাণ বাঁচাতে পেরেছে পল। এটা হয়তো তার গডের কাছ থেকে একটা উপহার পেল সে। আজ সে না থাকলে হয়তো আরো কোনো বড় বিপদ হতে পারতো। গড-ই হয়তো তাকে ওখানে নিয়ে তার মাধ্যমে একটা নবজাতকের প্রাণ বাঁচালো। সে মনে মনে তার ঈশ্বরকে আবার অনেক ধন্যবাদ দিয়ে আরো অনেক প্রশংসা করতে লাগল কিছুক্ষণ।
পলকে ভিতরে ডেকে নেওয়া হলো কিছু সময় পর। ডাক্তার নবজাতককে পলের কোলে তুলে দিলো। নবজাতকটা দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছে। তার মার মুখ আর তার মুখ মিলে যাচ্ছে। ঠিক তার মায়ের মতোই হয়েছে নবজাতকটা।
নবজাতক কান্না করছিলও এতক্ষণ। পলের কোলে আসতেই তাকে দেখে হাত নাড়িয়ে হাসতে শুরু করলো। সাধারণ কোনো নবজাতকের তো এমন করার কোনো কথাও না। এই বিষয়টাকে আশ্চর্য একটা বিষয়ও বলা যায়। তবে পল গড-এর তরফ থেকে ভালো একটা উপহার ভেবে বিষয়টাকে এড়িয়ে গেল সে। কারণ সে এখন মহাখুশি, মহা আনন্দিত। সবই গড-এর খেল।
সন্তান প্রসবের পর নবজাতকের মা জ্ঞান হারায়। কিছুক্ষণ পর নবজাতকের মা’র জ্ঞান ফিরলে পল নিজে তাকে জানায়, তার একটা ছেলে সন্তান হয়েছে। পল মহিলাটাকে বিশ্রাম নিতে বলে আর পরেরদিন দেখা করতে আসবে বলে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বাইকটাতে চড়ে বসে। বৃষ্টি থেমে গেছে ততক্ষণে। চাঁদের আলোয় চকচক করছে বৃষ্টি ভেজা গাছের পাতাগুলো। মাটির সোদা গন্ধ সে পাচ্ছে। তার মনের খুশিকে বাড়িয়ে তুলতেই যেন আজকেই এই পরিবেশ। হয়তো, নবজাতকের জন্মের খুশিতে আজকের এরূপ পরিবেশের আবির্ভাব।
আকাশের দিকে তাকাল সে। চাঁদটার দিকে লক্ষ্য করল। চাঁদটা যেন হাসছে মনে হলো তার কাছে। এবার বাইকের দিকে তাকালো সে। বাইকে চাবি দিয়ে স্টার্ট করল সে। মনের আনন্দে বেরিয়ে গেল সে সেখান থেকে।
একটা ভালো কাজ পলের মনকে উচ্ছ্বসিত করে তুলে বারবার। এটাই তার প্রাপ্তি। হঠাৎ অনেক অনেক শব্দ করে আবার একটা বজ্রপাত হলো যেন ঠিক পলের মাথার উপরে।

চলবে?….

(সকলের মন্তব্য আশা করছি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here