রক্ষিতা,পর্ব-১২

0
888

রক্ষিতা,পর্ব-১২
আশুথিনী_হাওলাদার (ছদ্মনাম)

খাটের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে৷ আছে অর্ঘমা। কষ্ট হচ্ছে বুকে পিড়া হচ্ছে তবে কান্না আসছে না। যে মেয়ে ছোটো খাটো জিনিস নিয়ে হলেও কেঁদে কেটে বাড়ি মাথায় তুলতো আজ তার চোখে কোনো পানি নেই। জীবন তাকে এভাবে হারিয়ে দেবে ভাবেনি কখনো। দুঃখ কষ্ট কি সেটাও জানতো না। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তার মতো কষ্ট, দুঃখ পৃথিবীতে কারো নেই। নিফানের সাথে চুক্তি শেষ হতে মাত্র চার মাস বাকি তারপর সে আর নিফান আলাদা। বুকের ভিতির জ্বলছে তার। এটুকু বুঝে গেছে সে নিফান কখনো তাকে চুক্তির শেষে রাখবে না। কই যাবে সে? নিফান কে ছাড়া দ্বিতীয় বার কি করে বাঁচবে?

এক সপ্তাহ পরে দেশে ফিরে নিফান। বিজনেসের কাজে তাকে এক সপ্তাহ জন্য USA যেতে হয়েছিল। আজ তার মন ভালো। অনেক দিন পর সে অর্ঘমাকে দেখতে পাবে। মন তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসে ফোন অন করে। তার অ্যাসিস্ট্যান্টকে কল করে। গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করে,
__‘তোমার ম্যাডামের পরিবারের খোজ পেয়েছো মোহন?
মোহন নিফানের গম্ভির কন্ঠে ঘাবরায়। গত চার বছর ধরে সে নিফানের সাথে আছে কিন্তু কখনো তাকে হাসতে দেখেনি। নিফানের মুখের হাসি মোহনের কাছে দুর্লভ বস্তু যা চাইলে পাওয়া যায় মা।
শুকনো ঢোক গিলে উত্তর দেয়,
__‘খোজ পাওয়া গেছে স্যার তবে, ম্যাডামের পরিবারের কেউ বেঁচে নেই।
কথাটা শোনা মাত্র নিফানের বুকে বুকে চিন করে ওঠে। নিজেজে শান্ত করতে জোড়ে জোরে শ্বাস নেয় নিফান। কাপা স্বরে জানতে চায়,
__‘কখন?
রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে মোহন। এবার যা বলবে তাতে নিফানের রিয়াকশন ঠিক কি হবে একটু হলেও আন্দাজ করতে পারছে সে। মিনমিন করে সে উত্তর দেয়,
__‘বছর চারেক আগে স্যার”
নিফানের মাথার রগ ফোলে উঠে। চোখ বন্ধ করে নেয়। শুকনো ঢোক গিলে সে। গল্টা শুকিয়ে যাচ্ছে। শক্ত রাগী কন্ঠে প্রশ্ন করে,
__“তুমি সেটা আমায় আগে জানাওনি কেন? “মোহনলাল”।
“বিরক্ত হয় মোহন সাথে ভয় পায়। তার পুরু নাম সে একদম পছন্দ করেনা। স্যার যখন রেগে থাকেন তাখন তাকে পুরু নামে ডাকে।
মোহন ওপাশ থেকে হাসফাস করে উত্তর দেয়,
__“স্যার আমি আপনাকে অনেক আগেই “মেইল” পাঠিয়েছি। আপনি বলার পর আমি গত চার বছর ধরে ম্যাডামের সব খবর রেখেছি। আপনি ম্যাডামের নাম শুনতে পারতেন না তাই “মেইল” পাঠাতাম। ” (কথা শেষ করে জোরে শ্বাস ফেলে মোহন। ভয়ে হাত-পা কাপাঁকাঁপি করছিল তআর। এই বুজি চাকরিটা গেল সাথে প্রান।)
“স্তব্ধ হয় নিফান। কল কেটে দেয়। অর্ঘমার ভাইয়ের প্রতি সব রাগ অর্ঘমার উপর গিয়ে পরে। তিক্ততার পরিমান এত বেড়ে গিয়েছিল যে মোহনলাল কে অর্ঘমার খবর রাখতে বললেও নিজে কখনো জানতে চায়নি। চোখ বন্ধ করে সীটে গা হেলিয়ে দেয় নিফান। মাথাটা বেশ ধরেছে।

ফোনের দিকে তাঁকিয়ে হাসফাস করছে মোহনলাল। কথা তো শেষ হয়নি। শেষ করার আগে নিফান কল কেটে দিয়েছে। এখনো বলা হয়নি অর্ঘমার পরিবারের মৃত্যুর পর তার পরবর্তী জীবনের কথা। সাথে অর্ঘমার দাদির মৃত্যুর খবরও জানানো হয়নি নিফানকে। ভয়ে নিজে থেকে কল ব্যাক করতে পারছে না সে। মন-মেজাজ তেতো হয়ে যায় মোহনলালের। এ কোন ফ্যাসাদে পরলো?

“বাড়িতে কেমন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। সব কেমন চুপচাপ বুকে ধক করে উঠে নিফানের। তারাহুরো করে রুমে যায় সে। অর্ঘমাকে ঘুমতে দেখে শান্ত হয় সে। একপলক তাকে দেখে। কাবার্ট থেকে জামা_কাপড় নিয়ে ফ্রেস হতে চলে যায়।
ফ্রেস হয়ে এসে অর্ঘমার পাশে বসে। মেয়েটার চোখ-মুখ ফ্যাকাসে লাগছে। ঠিক করে খায়না নাকি! নিফান কিচেনে চলে যায়। কিচেনে গিয়ে দেখে কোনো খাবার নেই। ভ্রু কুচকে যায় নিফানের। ধপ করে মাথায় রাগ উঠে যায়। অর্ঘমা কি সারাদিন না খেয়ে থেকেছে? রাগ উঠলেও নিজেকে শান্ত করে নেয়। একটু হলেও অর্ঘমার কষ্ট বুঝতে পারে। পরিবার হারা মেয়েটা। কেউ বেঁচে নেই। সেও তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। একা একটা মেয়ে চার বছর ধরে থেকেছে। দাদি ছিল সেও এখন অসুস্থ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিফান। তবে সব কিছুর মধ্যে সামন্য ভালোলাগাও কাজ করছে অভ্রের এই পরিনতি তে। কথায় আছে পাপ বাপ কেও ছাড়ে না। অর্ঘমার জন্য খারাপও লাগছে। কিছু খাবার রান্না করে নিয়ে যায় অর্ঘমার জন্য। খাবারের ট্রে টেবিলে রেখে। তাকে টেনে তুলে। অর্ঘমা চোখ পিটপিট করে তাঁকায়। নিফান কে দেখে মলিন হেসে শুতে যায়। নিফান টেনে তুলে বসিয়ে দেয়। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে নিফানের দিকে তাঁকায় অর্ঘমা। নিফান তাকে পাত্তা না দিয়ে তার সামনে সুপের বাটি রাখে। অর্ঘমা বিরক্তি নিয়ে বলে,
__‘আমি কি অসুস্থ বাবু যে আমাকে সুপ খেতে হবে? বিরক্তিকর সরুন তো ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাবো।
নিফান কে পাত্তা না দিয়ে শুয়ে পরে অর্ঘমা। রাগ হয় নিফানের। রাগকে শান্ত করে। আবার টেনে তুলে অর্ঘমাকে। নিজের কোলে বসিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে মুখে সুপ তুলে দেয়। রাগে ‘চ’ করে শব্দ করে অর্ঘমা খাবার ফেলে দিতে গেলে। নিফানের রাগী চোখ দেখে। মুখ কাচুমাচু করে গিলে নেয় খাবার।
গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে অর্ঘমা। নিফাব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তাকে। বাঁচ্চা অর্ঘমার সাথে বড্ড অমিল। বাচ্চা অর্ঘমা জিন্স আর শার্ট পরে ঘুরতো। ছোটো ছোটো চুল গুলো জুটি করে রাখতো। কিন্তু ছাব্বিশ বছর বয়সের অর্ঘমা এক পুরুদস্তর মহিলা। সে জিন্স, শার্ট ছেড়ে শাড়ি পরতে শিখে গেছে। ছোটো ছোটো চুল গুলো এখন হাটু ছুই ছুই। রান্নায় পাকা হয়েছে। তার সংসার সামলাচ্ছে। মুচকি হাসে নিফান। ঝুঁকে অর্ঘমা ললাটে ছোটো করে ঠোঁট ছোয়ায়। তাদের বিয়ের প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর হয়ে গেল। সময় কত তাড়াতাড়ি যায়। সব ঠিক থাকলে তাদের হয়তো বেবি থাকত। বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় যায় নিফান। বাসা থেকে একটু দূরে পার্কে ছোটো ছোটো বাচ্চারা খেলা করছে। তাদেরও তো এমন ছোটো ছোটো বেবি থাকতে পারতো। আচ্ছা! আচ্ছা তার নাম কি হতো? ছেলে হতো নাকি মেয়ে ? অবশ্যই মেয়ে হতো। অর্ঘমার মতো বাচ্চা গুলোমুলু বেবি হতো তাদের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিফান।

“হঠাৎ একদিন ফোনে কল আসে। তার বোন নবনীতা নাকি অসুস্থ তাকে হস্পিটালাইজ করা হয়েছে। অবস্থা খুব খারাপ তাকে ঢাকায় ফিরতে হবে। নিফান অর্ঘমাকে জানানোর সুযোগ পায়নি। তারাহুরু করে চলে যায় ঢাকা। গিয়ে বোন কে নয় বোনের লাশ দেখতে পেয়েছিল সে। জমজ ছিল দু’জন এক সাথে মায়ের পেটে ভাগাভাগি করে থেকেছে। এক সাথে জন্ম। আপু অবশ্য তার থেকে ৩ মিনিটের বড় ছিল। সে আপুর লাশ দেখে সে। ভেংগে পরে সে। তখন বন্ধু হিসেবে একমাত্র পাশে ছিল আরফ। নিফান খুজে বের করার চেষ্টা তার নবনীতা কেন সুইসাইড করেছে৷ পেয়েও যায় নবনীতার মৃত্যুর দু’দিন পর সে আসল কারন জানতে পারে। নবনীতা বলে ছিল সে এক ছেলে কে খুব ভালবাসে এমনকি তার সাথে মিটও করে নিফান। সে ছেলেই ছিল তার বোনের মৃত্যুর কারন। অভ্র তার বোনকে ঠকিয়ে অন্য কারো সাথে রিলিশনে গেছে। এটা জানতে পেরেই তার বোন সুইসাইড করে। পাগল হয়ে যায় নিফান। অভ্র কে সামলে পেলে সে মেরে ফেলত৷ নিফান হঠাৎ একদিন নবনীতার ফোন ঘাটতে গিয়ে অর্ঘমার ফটো দেখতে পায়। নবনীতার ফোনে অর্ঘমার ফটো দেখে বেশ অবাক হয় সে। পরে খোজ নিয়ে জানতে পারে অর্ঘমা আর কেউ না অভ্রর আদরের বোন। ঠিক তখন’ই প্রতিশোধের নেশা চেপে ধরে নিফান কে। এক নিমিষে সে নিজের ভালোবাসার কথা ভুলে গিয়ে প্রতিশোধ প্রনয়ণ হয়ে উঠে। চট্টগ্রাম ফিরে সে প্রথমে অর্ঘমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সে জানত, অর্ঘমা তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে এবং সে সুযোগটা সে কাজে লাগায়। এবং অর্ঘমা রাজি হয়। তারপর বিয়ে। বিয়ের পর দু’জনের সাত মাসের সংসার সংসার খেলা। এরপর হঠাৎ করে সে উধাও হয়ে যায়। একটা ডিভোর্স পেপার রেখে। প্রতিশোধ সে নেয়। অর্ঘমাকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়ে নিফান USA. চলে যায়। ফিরে আসে তিন বছর পর। ফেরার দিন একটা কাজে ঢাকা মেডিকেলে যেতে হয় তাকে। সেখানে গিয়ে আবার দেখা অর্ঘমার সাথে। অর্ঘমাকে দেখে যেমন আবেগে আপ্লূত হয় তেমনি পুরুনো রাগটা আবার ধপ করে জ্বলে উঠে তার মাথায়। সে রাগের বশবর্তি হয়ে অর্ঘমাকে তার “রক্ষিতা” হতে হয়।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here