রক্ষিতা,পর্ব-১৫
আশুথিনী_হাওলাদার (ছদ্মনাম)
ভার্সিটির এক্সামের খাতা দেখছিল অর্ঘমা। “অহনিফা” এসে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে কোলে শুয়ে পরে। ভ্রু কুচকায় অর্ঘমা। চোখের চশমা ঠিক করে তাকে প্রশ্ন করে,,
__“কিছু বলবে নিফা?
__‘আম্মু তোমাকে স্কুলে ডেকেছে স্যার।
অহনিফার দিকে এক পলক তাকায় অর্ঘমা। হাতের কাগজ রেখে তাকে টেনে তুলে সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করে,,,
__‘আজ আবার কি করেছো?
ঢোক গিলে অহনিফা। হাসার চেষ্টা করে বলে,
__“কিছু না। ক্ককি করবো?
পর্দার আড়াল থেকে “অর্নিফ” এসে বলে,,,
__“আম্মু নিফা আজকেও মারামারি করেছে।
তেরে ওঠে “অহনিফা” বলে,,
__‘তো! তোর মতো মার খেয়ে বাড়িতে আসবো। আর নিফা কি আপু বল। বড় বোন আমি তোর সম্মান দে। (ভাব নিয়ে বলে)
“অর্নিফ” ভেংচি দিয়ে বলে,,
__“এহ আসছে বড় বোন। শোন তুই মাত্র চার মিনিটের বড় আমার থেকে। ”
__“চার মিনিটের বড় হলেও বড় সো সম্মান দিবি। ”
“অর্ঘমা টেবিলের উপর হাতের ভর দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে দু’জনের দিকে তাকায়। এরা একবার লাগলে থামে না। তাই এক পলক তাদের দিকে তাঁকিয়ে মৃদু হেসে নিজের কাজে মন দেয়। সন্তান দু’টির মুখের দিকে তাঁকিয়েই ১৫টি বছর কাটিয়ে দিয়েছে সে। বর্তমানে বান্দরবান বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হিসেবে কর্মরত আছে। সেদিন নিফানের বাড়ি তগেকে বেরিয়ে সোজা বান্দরবান চলে আসে। এখানে তাদের একটা বাংলো ছিল মোটামুটি ধরনের। তার মায়ের খুব পছন্দের ছিল। বিবাহবার্ষিকীতে তার বাবা গিফট করেছিল তার মা কে গিফট করেছিল। কিছুদিন যাওয়ার পর দেখা হয় ছোটোবেলার বন্ধু রোহানের সাথে। ক্লাস টেন অব্দি একসাথে ছিল তারা। এরপরে আলাদা কলেজ আলাদা ভার্সিটি আস্তে আস্তে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন । এখানে এসে’ই দু’জনের আবার দেখা। এরপর রোহান’ই সব দায়িত্ব নেয়। নিজ দায়িত্বে লোক লাগিয়ে অর্ঘমাদের বাড়ির ভাড়া তুলে অর্ঘমা অব্দি পৌছানো। অবশ্য সবটাই নিফানের অগোচরে। “অহনিফা- অর্নিফ” হওয়ার পর বেশ কয়েক জায়গায় ইন্টারভিউ দেয় জবের জন্য। তারপর হয়ে যায় ভার্সিটিতে জব। এরপর থেকে দশ ধরে ভার্সিটির প্রফেসর হিসেবে আছে অর্ঘমা। অতীত ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্ঘমা। একটা খুব খুব সুখের সংসার চেয়েছিল সে। স্বামী- সন্তান নিয়ে ভালবাসার সংসার। তবে সবার সব ইচ্ছে পূরন হয় না। এটা মেনে নিয়েই সামনে আগাচ্ছে সে। চোখের চশমাটা খুলে টেবিলের উপরে রেখে রুম লাগাওয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ায় অর্ঘমা। সে নিজের কথা রেখেছে। ১৫ বছরে সে কখনো নিফানের ছায়াও মারায়নি। চায়ও না নিফানের সাথে কখনো তার দেখা হোক। সব পারা যায় কিন্তু অসম্মান, মিথ্যে, আর ভালবাসা ছাড়া, ঠকানো নিয়ে আর যাইহোক একসাথে বাঁচা যায় না। এসব সত্যি জেনে মেনে নিয়ে সে কখনো নিফানের সাথে থাকতে পারতো না। সেখানে ভালোবাসার বদলে তিক্ততাটা বেশি থাকত।
প্যাকেটের শেষ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফেলে দেয় নিফান। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব মনেহচ্ছে। এখন সে বুঝতে পারছে। রাগ জিনিসটা ঠিক কতটা ভয়ংকর। সাথে অভিমান শব্দটাও কত তুখোড়। অর্ঘমার তুখোড় অভিমানে সে ১৫ বছর ধরে জ্বলছে। তাচ্ছিল্য হাসে সে। ১৫ বছর হয়ে গেছে কোথায় না খুজেছে সে অর্ঘমাকে। কিন্তু অর্ঘমার দেখা মিলেনি। মাথার চুল খামছে ধরে চেয়ারর গা হেলিয়ে শোয়। তার সন্তান কেমন দেখতে হয়েছে? তার মতো নাকি অর্ঘমার মতো? না তার মতো হওয়ার দরকার নেই। সে চায় তার সন্তান যেন কখনো তার মতো না হয়। সে যেন তার মায়ের মতো ভালো মানুষ হয়। কতটা হতভাগ্য হলে নিজের স্ত্রী সন্তান থেকেও সে নিঃস্ব। হোহো করে হেসে উঠে নিফান। সে এটাও জানে না। তার ছেলে আছে নাকি মেয়ে। কিন্তু তার একটা ১৪ বছর বয়সি সন্তান আছে।
সেদিন অর্ঘমা অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর । ভেংগে পরে নিফান। অর্ঘমা সব জেনে গেছে। তাকে হয়তো সে কখনো ক্ষমা করবে না। কি করবে সে কি করে মানাবে তাকে। মাথা কাজ করে না নিফানের। আরাফ তাকে সামলিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। অর্ঘমাকে সব খুলে বলবে। বুঝাবে সে যা শুনেছে সব সত্যি হলেও নিফান তাকে’ই ভালোবাসে। সব কিছুর মধ্যে এটা পিউর সত্যি। কিন্ত্য বাড়িতে ফিরে সদর দরজা খোলা দেখে বুকে কামড়ে উঠে নিফানের। তড়িঘড়ি করে রুমে চলে যায় সে। না অর্ঘমা নেই। সারাবাড়ি খুজেও অর্ঘমার দেখা মিলেনি। তবে বেড রুমের বিছানার উপর তিন’টে কাগজ মিলে। একটা ডিভোর্স পেপার যা নিফান পাঁচ বছর আগে অর্ঘমাকে দিয়ে চলে গিয়েছিলো। সেটায় অর্ঘমার সাইন করা। একটা মেডিকেল রিপোর্ট যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা “অর্ঘমা প্রেগন্যান্ট”। শেষের কাগজে ২ লাইনের শব্দ লেখা।
“যেখানে ভালোবাসাই ছিল না। সেখানে মিথ্যে মরিচীকার পিছনে থেকে কি লাভ?”
এই দুই লাইন’ই যথেষ্ট ছিল তাকে জ্বলে পুড়ে নিঃস্ব করে দেয়ার জন্য। এরপর নিফান সারা শহর তন্নতন্ন করে খুজেও অর্ঘমার দেখা পায়নি। ১৫ টি বছর ধরে শুধু খুজে চলেছে তাকে। কিন্তু ১৫ বছরেও অর্ঘমার নাগাল সে পায়নি শুধু একটাই ইচ্ছে মৃত্যুর আগে অর্ঘমাকে দেখা। নিজ সন্তান কে দেখা। জানে না কখনো পূরন হবে কিনা সে ইচ্ছে। হাতে অর্ঘমার লিখে যাওয়া সেই কাগজটি। তাতে চোখ বুলায় নিফান। ভাবছে, অর্ঘমা কেমন আছে? কি রকম দেখতে হয়েছে? সেই আগের মতো বাচ্চা অর্ঘমা আছে? হাসে নিফান। যেখানে তার সন্তানের বয়স ১৪। সেখানে অর্ঘমা কি এখনো আগের মতো আছে? ৪২ বছর বয়স হয়েছে তার। আচ্ছা অর্ঘমার চুল পেঁকেছে? আবার হাসে নিফান। কল্পনায় অর্ঘমাকে দেখার চেষ্টা করে। ৪২ বছর বয়সি অর্ঘমা কেমন দেখতে হয়েছে। চেয়ার থেকে উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নিফান। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বর দিকে তাঁকায় সে। চেহারায় বয়সের ছাপ এখনো ততোটা না পরলেও দু’একটা চুলে পাক ধরেছে। অবশ্য কম তো বয়স হলো না ৪৭ বছর বয়স হয়ে গিয়েছে। ছোটো শ্বাস ফেলে নিফান। ড্রেসিংটেবিল থেকে চশমা তুলে পরে নেয়। ভাবে নিফান, অর্ঘমাও কি চশমা পরে। হাসে নিফান। হেসে চশমা পরা অর্ঘমাকে কল্পনায় আঁকাড় চেষ্টা করে।
“টিচার্স রুমে বসে আছে অর্ঘমা তার দু’পাশে অহনিফা-অর্নিফ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাব্বির যে ‘অহনিফার’ মার খেয়েছে।
সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় হেডমাস্টার মুনিরুজ্জামান। অর্ঘমা কে উদ্দেশ্য করে বলে,,
__‘ম্যাম এই নিয়ে ৩ বার বিচার আসলো অহনিফা আর অর্নিফের বিরুদ্ধে। ওরা লেখাপড়া খেলাধুলা, কথা বার্তা সব কিছুতে ভালো হলেও। মারামারিটা খুব খারাপ। দেখুন সাব্বির কে মেরে কি করেছে। ওর প্যারেন্টস আমাদের কাছে কমপ্লেন করলে তখন ব্যাপারটা কেমন হবে বলুন তো। আপনি মান্নিগুন্নি মানুষ। ভার্সিটির প্রফেসর তাই আমি আপনাকে পার্সনাল্লি জানাচ্ছি।
অর্ঘমা মাথা ঘুরিয়ে শক্ত চোখে দু’জনকে দেখে বলে,,
__‘ওরা দ্বিতীয় বার এমন করলে আমাকে জানাবেন না। অন্য বাচ্চাদের যে শাস্তি দেয়া হয়। ওদেরও তাই’ই দিবেন। আমি কখনো এর কারন জানতে আপনার কাছে আসবো না।
চলবে?