#রঙিন_রোদ,পর্ব_২
#নাজমুন_বৃষ্টি
সোফার এক কোনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে মৃত্তিকা। কাজী তোড়জোড় করছে কবুল বলার জন্য। ঈশান ভাই কবুল বলেই উঠে চলে গেল।
মৃত্তিকা ঈশানের যাওয়ার দিকে এক ফলক মলিন চোখে তাকালো। সে ভাবেনি এতকিছু হয়ে যাবে।
চোখের পানি পড়তে পড়তে শুকিয়ে গিয়েছে। পাশেই রিনি মৃত্তিকার হাত ধরে বসে আছে। মৃত্তিকা জানে না, মেডিকেলে কী জবাব দিবে। তার চেয়ে বড়ো কথা ঈশান ভাই মৃত্তিকারই মেডিকেলে ক্লাস নেয়। আদিবকে কী জবাব দিবে তা মৃত্তিকা ভেবে পাচ্ছে না, ছেলেটা যদি জানতে পারে মৃত্তিকার বিয়ে হয়ে গিয়েছে তাহলে কী করবে! ছেলেটা মৃত্তিকাকে ছেড়ে থাকতে পারবে তো? না কি কোনো কিছু করে ফেলবে না তো? সবকিছুর মূল ঈশান ভাই। তিনি কেন করলো এমন! তিনি যদি কাল মৃত্তিকার রুমে না আসতো তাহলে আজ কী সুন্দর মৃত্তিকা আগের মতোই থাকতে পারতো!
তখন লুৎফর আহমেদ অনেক্ষন মাথা নিচু করে বসে ছিল। মৃত্তিকার বাবা মারা যাওয়ার পর এই বাড়িতে একমাত্র লুৎফর আহমেদই বোন আর বোনের মেয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সবার মুখোশ মৃত্তিকার বাবা মারা যাওয়ার দুইদিনের ভেতর বেরিয়ে এসেছিল। সমাজে একা একটি মা-মেয়ে চলার পথে যে কত বাধা আসে তা তখনোই টের পেয়েছিল মৃত্তিকারা। সে সময়ই মৃত্তিকার বড়ো মামা লুৎফর আহমেদ গিয়ে বোনকে নিজের কাছে রাখে। সে থেকে মা-মেয়ে দুইজনকে পরম মমতায় আগলে রেখেছিল লুৎফর আহমেদ। মৃত্তিকার বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী মৃত্তিকাকে তাদেরই মেডিকেলে পড়াচ্ছে লুৎফর আহমেদ। মৃত্তিকাও তার বড়ো মামার কথা সবসময় মেনে চলতো তাই তিনি সবার চেয়ে মৃত্তিকাকেই একটু বেশি ভালোবাসতেন। শুধু তাই নয়, লুৎফর আহমেদ মৃত্তিকাকে বিশ্বাস আর ভরসা দুটোই করতেন। কিন্তু আজ! আজ কী তিনি আর বিশ্বাস করবেন মৃত্তিকাকে!
এই বাড়িতে সবার আগে লুৎফর আহমেদের কথা অনুযায়ী চলে। তখন তিনিও হয়ত মৃত্তিকাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। সবাই যখন একেক কথা বলছিলো লুৎফর আহমেদ তখনও চুপ ছিল। হঠাৎ করে মাথা তুলে বলে উঠল,’ কাজী ডাকো। ওদের বিয়ে পড়ানো হবে।’
তার এক কথায় সবাই চুপ হয়ে গিয়েছিলো আর পালনও করেছিল।
মৃত্তিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে বসা লুৎফর আহমেদের দিকে এক ফলক তাকালো। লুৎফর আহমেদ তখনও মাথা নিচু করে ছিলেন। হয়ত বেশি কষ্টই পেয়েছে। মৃত্তিকা কী তার মামাকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে! কী থেকে কী হয়ে গেল তা মৃত্তিকা এখনো ভেবে উঠতে পারছে না।
লুৎফর আহমেদ হঠাৎ মাথা তুলে মৃত্তিকার দিকে এক ফলক তাকিয়ে রিনিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
-‘রিনি মা। মৃত্তিকাকে ঈশানের রুমে নিয়ে যা। কিছু খাইয়ে দেয়। কাল সকালে ওর ক্লাস আছে।’
মৃত্তিকা চমকে লুৎফর আহমেদের দিকে তাকালো। সে ভাবেনি এতো কিছুর মাঝে এভাবে তার মামা তার খেয়াল রাখবে! তার উপর কালকের ইম্পরট্যান্ট ক্লাসটার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে গিয়েছিল কিন্তু লুৎফর আহমেদ ঠিকই মনে রেখেছে। ড্রয়ইং রুমে থাকা বাকিরাও চমকে তাকিয়ে রইল লুৎফর আহমেদের দিকে। সবাই মনে করেছিল, হয়ত লুৎফর আহমেদও রাগের মাথায় এদের বিয়ের আদেশ দিয়েছিলো। বেশিরভাগ মানুষই খুশি হয়ে হয়ত মনে মনে মৃত্তিকা আর ওর মায়ের উপর ভেংচি কেটেছিল যে এবার মা-মেয়ে যায় কোথায় দেখে নিবে। কিন্তু উল্টো লুৎফর আহমেদ এতকিছুর মাঝেও মৃত্তিকার খবর ঠিকই নিচ্ছে। মৃত্তিকা মনে মনে স্বস্তি ফেলো। তার মানে তার মামা তাকে বিশ্বাস করেছে যে অন্তত মৃত্তিকা এমন কাজ করতে পারে না!
রিনি মৃত্তিকাকে নিয়ে রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সোফা ছেড়ে উঠতেই লুৎফর আহমেদ পেছন থেকে ডাক দিয়ে নিজে মৃত্তিকার সামনে এগিয়ে এলো।
-‘আমি জানি মা। এখন তোর উপর কতটা ভয়ানক প্রেসার পড়ছে। সবাই অন্তত তোদের উপর এমন কিছু চাপিয়ে দিতে চাইলেও আমি জানি তোরা এমন কিছু ভুলেও করবি না। যাক, এসব এখন মাথা থেকে ঝেড়ে নিজের জীবনের দিকে ফোকাস দেয় তোরা। আমি আশা রাখি, তোদের সামনে এগিয়ে যেতে গেলে আর কোনো বাধা আসবে না, নিশ্চিন্তে থাক মা। এখন মনে প্রাণে আমার দুই ছেলে মেয়ে আর আমার বৌমার জন্য দোয়া করি। এখন গিয়ে কিছু খেয়ে শুয়ে পড়। কালকে তোদের ক্লাস আছে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়।’
মৃত্তিকা ‘হ্যাঁ’বোধক মাথা নাড়লো। রিনি মৃত্তিকাকে ঈশানের রুমে নিয়ে এলো। ঈশান বোধহয় কোথাও বেরিয়ে গিয়েছে। মৃত্তিকা বুঝতে পারলো না। মানুষটা কী মৃত্তিকার উপর রেগে আছে!
রিনি একটা প্লেট আনতেই মৃত্তিকা কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। তার এতো কিছুর মাঝে আর আদিবের খেয়াল ছিল না।
গভীর রাতে ঈশান রুমে ঢুকতেই তার বিছানায় কেউ একজনকে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলো। সে এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিল আজ মৃত্তিকার সাথে তার জীবন আবদ্ধ হয়েছে। সে মুচকি হেসে মৃত্তিকার দিকে এগিয়ে গেলো। এরপর মন ভরে তাকে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে মৃত্তিকার গায়ে লেপ টেনে দিয়ে নিজেও আরেকপাশে ঘুমিয়ে পড়লো।
.
.
সকালে মৃত্তিকা ঘুমু ঘুমু চোখে হাতড়িয়ে মোবাইল নিয়ে সময় দেখতেই তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসতেই পাশে চোখ যেতেই থমকে বসে রইল সে। পাশের সিঙ্গেল সোফাটাতে ঈশান ভাই বসে ফোন গুতাচ্ছে। মৃত্তিকা এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিল কাল এতো বড়ো ঘটনাটা। মৃত্তিকা উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানির ঝাপ্টা দিয়ে বেরিয়ে আসলো। ঈশান ভাই এখনো ফোনের দিকেই দৃষ্টি দিয়ে আছে। মৃত্তিকা সংকোচ ঠেলে বিষাদ-ভরা কণ্ঠে বলে উঠল,
-‘কী হবে এরপর!’
ঈশানের কাছ থেকে কোনো জবাব না আসাতে অপমানে মাথা নিচু করে ফেলল মৃত্তিকা। শুধু শুধু কেন বলতে গেল এমন কথা! এভাবেও যে সবকিছু আর আগানো সম্ভব নয় মৃত্তিকার পক্ষে। তার চেয়ে বড়ো কথা, এই মানুষটার সাথে তার সংসার ভাবা মোটেও আশাযোগ্য নই। মৃত্তিকা হতাশ হলো ঈশানের কোনো উত্তর না পেয়ে। এরপর তৈরী হয়ে ক্লাসের উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হতে নিতেই পেছন থেকে ঈশানের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে থেমে গেল।
-‘আমাদের এই বিয়ে হয়ে যাওয়াটা অনাকাংক্ষিত। আমিও ভাবিনি এভাবে বিয়েটা হয়ে যাবে আর তুইও হয়ত ভাবিসনি। আমাদের নিজেদের মধ্যে সময় নেওয়া দরকার। তুই আগের মতোই থাক। পারলে হোস্টেলে থাকতে পারিস আগের মতোই। এগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়ায় মনোনিবেশ কর। সামনে আমারো বাইরে যেতে হবে। এটা একটা এক্সিডেন্ট। আর তার চেয়ে বড়ো কথা, কাল এই আরশির সাথে আমার বিয়েটা হতো না। আমার ক্যারিয়ার এখনো পড়ে আছে আর তোর পড়াশোনা। আমি বাইরে চলে যাব এই কয়েকদিনের ভেতর। তোর এই বাসায় থাকার প্রয়োজন নেই, তুই হোস্টেলেই থাকিস।’ বলে ঈশান ভাই ফোন পকেটে পুরে উঠে দাঁড়ালো।
মৃত্তিকা কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতেই ঈশান আবারো ফিরে বলে উঠল,’ মেডিকেলে তোর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। ইতিমধ্যে অনেকেই হয়ত জেনে গেছে। সেদিকেরটা আমি ম্যানেজ করে নিব। তুই তোর পড়াশোনার দিকে ফোকাস কর।’ বলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল ঈশান ভাই।
ঈশান ভাই বেরিয়ে যেতেই মৃত্তিকা ধপ করে বসে পড়লো সোফাতে। এরপর পরই রিনি ঢুকলো। রিনি মৃত্তিকার পাশে বসলো।
-‘চিন্তা করিস না। তুই প্যাকিং করে নেয়। ভাই তোরে আজই চলে যেতে বলেছে হোস্টেলে। এই বাসায় থাকা তোর জন্য ভয়ঙ্কর আর তার চেয়ে বড়ো কথা ভাই তোকে এতো সাধনার পর পেয়েছে, হারাতে…’ রিনির কথার মাঝেই মৃত্তিকা তার দিকে তাকাতেই সে থেমে গেল। মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে রিনির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-‘মানে!’
-‘ওহ কিছু নাহ। তুই প্যাকিং করে নেয়। ভাই মনে হয় কাল-পরশুর মধ্যে দেশের বাইরে চলে যাবে।’
মৃত্তিকা ‘হ্যাঁ’বোধক মাথা নেড়ে সব প্যাকিং করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দুইদিন আগেও সে একই ব্যাগ নিয়ে হোস্টেল থেকে এসেছিলো ঈশান ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে অথচ আজ কত তফাৎ। আজ সে বিবাহিত! মানতে না চাইলেও এটাই নিয়তি। আজ থেকে সে ঈশান ভাইয়ের অর্ধাঙ্গিনী।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।