#রঙিন_রোদ,পর্ব_৬,৭
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৬
মৃত্তিকা জানে না, এখানে কতদিন তাকে এভাবে আটকে রাখবে! আস্তে আস্তে তার দেহ’র ভার ছেড়ে দিচ্ছে, দুর্বলতা গ্রাস করছে। আজ কয়েকদিন ধরে সে এভাবেই বদ্ধ রুমে কাটাচ্ছে। কোনো আলোর হদিস পাচ্ছে না এখানে। শুধু খাওয়ার সময়ে একজন এসে খাবার দিয়ে যায়, তখন দরজা দিয়ে একটু আলো ঢুকে। সেই আলোতেই মৃত্তিকার খাবার শেষ করতে হয়। প্রথম কয়েকদিন পালানোর চেষ্টা করেও পালাতে পারেনি। হাত-পা সবসময় বেঁধে রাখে। এখন আর পালানোর মতো ক্ষমতা তার নেই। সে এই কয়েকদিনে বুঝতে পেরেছে, এখান থেকে পালানো অনেক কঠিন। সে জানে না, এভাবে তাকে এখানে আটকে রেখে তাদের কী এমন কার্যসাধন হবে! এই কয়েকদিনে এখানকার কোনো মানুষকেই সে দেখেনি। শুধু খাবারের সময় একজনই আসতো, সেও মাস্ক পরিহিত। মৃত্তিকা এখন বুঝতে পারছে, ঢাকার বাইরে এই অচেনা জায়গায় কাউকে না বলে আসাটা তার সবচেয়ে বোকামি। এখন আর কিছুই তার হাতে নেই। মৃত্তিকা আস্তে আস্তে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। সে এখন তার জীবনের আশা ছেড়ে দিছে।আদিবের কাছ থেকে হয়ত আর ক্ষমা চাওয়া হবে না। তার একমাত্র মা হয়ত মৃত্তিকাকে না পেয়ে পাগলপ্রায়। তিনি তো এমনিই নরম মনের, এর উপর তার মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ শুনলে কী করে থাকবে! তা ভাবতেই মৃত্তিকার খারাপ লাগছে। অন্তত মা’কে বলে আসা উচিত ছিল। রিনিকে শুধু বলছিল, মৃত্তিকা একটি কাজে ঢাকার বাইরে যাচ্ছে -পরে এসে সব বলবে। মৃত্তিকা চোখ বন্ধ করতেই ঈশানের চেহারাটা তার চোখের উপর ভাসতে লাগলো। মৃত্তিকা বিড়বিড় করে উঠল,’ঈশান ভাই।’ ঈশান ভাইয়ের কথা ভাবতে গিয়েই তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে তার ঈশান ভাইয়ের কথা অমান্য করেছে। তিনি মৃত্তিকাকে প্রয়োজন ছাড়া কোনো কাজে হোস্টেল থেকে বের হতে বারণ করেছিল। ঈশান ভাই কী জানে! মৃত্তিকার নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে! তিনি কী মৃত্তিকাকে খোঁজতে আসবে!
হঠাৎ বাইরে থেকে কয়েকজনের আওয়াজ আসতেই মৃত্তিকা বুঝতে পারলো তাকে আটকে রাখা এই রুমটিতেই বোধহয় আসছে। তাহলে এতদিনে মৃত্তিকা তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে হয়ত জানতে পারবে। মানুষগুলো রুমে ঢোকার আগেই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পড়লো। একজন আগে আগে ঢুকে মৃত্তিকার চোখ বেঁধে দিল। এরপর পর বাকি মানুষগুলো ঢুকলো। মৃত্তিকা পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলো এখানে অনেকজন। ভয়ে তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। এই লোকগুলো এখন মৃত্তিকার সাথে কিছু করতে আসলেও মৃত্তিকা পেরে উঠবে না। মৃত্তিকা দুর্বলভাবে তাদের কথোপকথন শুনতে লাগল।
-‘এইটাকে কী করা যায়।’
-‘ঈশানের বউ নাহ? এটাকেই তো খুজছিলাম। সে ধোঁকা দিছিলো আমাদের।’
-‘কী করা যায়!’
-‘অন্য মেয়েগুলোকে যেমন করা হয় , এটার সাথেও সেটাই হবে। এটাকে একটু স্পেশালভাবে পাঠানো হবে।’
এরপর পরই সবাই হেসে উঠল। মৃত্তিকা কিছুই করতে পারলো না, চুপচাপ শোনা ছাড়া। সেখান থেকে সেদিনের বাসে মৃত্তিকার পাশে বসা ছেলেটারও আওয়াজ শুনতেই মৃত্তিকা যা বুঝার বুঝে ফেলল।
-‘তবে তাই হোক।’
-‘এইটাকে শেষবারের মতো এখানে ভালোমতো খাইয়ে দেয়। এরপর এতো ভালো খাবার নাও পেতে পারে।’
-‘বস, মেয়েটা কয়দিন ধরে তেমন কিছু খাচ্ছে না। শুধু পানি ছাড়া।’
-‘আজকের রাতে ওর ফ্লাইট। না খেলেও জোর করে খাইয়ে দিবি। বসের টার্গেট বলে কথা। এইটা আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান সম্পদ। এটার যেন কোনো ক্ষয়-ক্ষতি না হয়। এরপর ৩২নাম্বার রুমের মেয়েগুলোকে খাইয়ে দিবি। খাওয়ার পর স্পেশাল পানীয় খাইয়ে দিবি।’
-‘আচ্ছা ভাই।’
এরপর পর রুমটা আগের মতোই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। হয়ত লোকগুলো চলে গিয়েছে। এই লোকগুলোর কথোপকথন শুনে মৃত্তিকা বুঝতে পারলো – সে খুব বিশ্রী ভাবে ফেঁসে গিয়েছে। হয়ত এই ফাঁদ থেকে আর বেরও হতে পারবে না। ৩২নাম্বার রুমে আরো মেয়ে আছে তার মানে নারী পাচার! মৃত্তিকার গা রাগে রিরি করে উঠল। আরো অনেক অসহায় মেয়ে এখানে আটকে আছে। ওদের মনের অবস্থা হয়ত আরো করুণ। মৃত্তিকার নিজের চিন্তা হচ্ছে না কিন্তু মেয়েগুলোর জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা,ওরা ঈশান ভাইয়ের কথা কেন বললো! ঈশান ভাই কী ওদের চেনা-পরিচিত! তাহলে ঈশান ভাই কী জানতে পারবে মৃত্তিকা এখানে আটকে পড়েছে! ঈশান ভাই কী মৃত্তিকাকে বাঁচাতে আসবে! না, উনি কীভাবে আসবে! উনি তো এই দেশে নেই! তাহলে কী মৃত্তিকা শেষবারের মতো আর কাওকেই দেখতে পারবে না! মৃত্তিকা ডুকরে কেঁদে উঠলো। তার মা, বড়ো মামা, ঈশান ভাই, রিনি-আদিব সবার কথা ভীষণ করে মনে পড়ছে।
দরজা খোলার আওয়াজে মৃত্তিকার কান খাড়া হয়ে গেল। বুঝতে পারলো কেউ একজন তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। মৃত্তিকা ভেবেছিলো খাবার নিয়ে আসা লোকটাকে সুযোগ বুঝে মেরে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করবে, বাকিটা কপালে যা লেখা থাকে তাই হবে। লোকটা এসে মৃত্তিকার চোখ খুলে দিতেই মৃত্তিকা নিরাশ হলো। আজ লোক একসাথে দুইটা আসছে। হয়ত আজকে শেষদিন বিধায় একটু বেশিই সিকিউরিটি রাখছে। মৃত্তিকা খেতে না চাইলে একটা লোক এসে তার গাল টিপে ধরলো। বাইরের পরপুরুষ মৃত্তিকার গায়ে হাত দেওয়ায় মৃত্তিকা আটকা অবস্থায় গা দিয়ে লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে লোকটার মুখের উপর থুথু দিল। এতে লোকটা রেগে গর্জন করে মৃত্তিকার দিকে এগিয়ে আসতেই অন্যজন লোকটাকে আটকে ফিসফিস করে কিছু একটা বলতেই লোকটা শান্ত হয়ে গেল কিন্তু মৃত্তিকা লোকটার চোখ দেখে বুঝলো ওর চাপা রাগ তবুও কমেনি।
মৃত্তিকা নিজেই খাবারের প্লেট এগিয়ে নিয়ে খেতে লাগলো। সে বুঝতে পারলো, এখন খেতে না চাইলে লোকগুলো তার গায়ে হাত দিতে চাইবে কিন্তু মৃত্তিকার জীবন থাকতে এমন কিছু সে মোটেও হতে দিবে না। সে ঈশানের অর্ধাঙ্গিনী। একমাত্র ঈশানই ছুঁতে পারবে মৃত্তিকাকে।
মৃত্তিকা খাওয়া শেষ করতেই অন্য একটা লোক তাকে একটি গ্লাস এগিয়ে দিল। মৃত্তিকা বুঝতে পারলো, এই পানীয় জাতীয় এটাতেই সব ভেজাল। কিছুক্ষন আগে ওই লোকগুলোর মুখ থেকে শুনেছিল, খাওয়ার পর স্পেশাল পানীয় খাওয়াতে। হয়ত এই পানি খেয়েই সবাই জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। যাতে রাতে তাদের মেয়েগুলোকে পাচার করতে কোনো অসুবিধা না হয়। মৃত্তিকা কোনোমতেই খাবে না এই পানি। কিন্তু লোকগুলো বারেবারে তার দিকে এগিয়ে আসছে। যেন সুযোগ পেলেই মৃত্তিকার শরীরে হাত দিতে চাচ্ছে। মৃত্তিকা তার আটকানো চেয়ার দিয়ে একজনকে ধাক্কা দিতেই অন্যজন এসে তার মুখ আটকে ধরতেই আরেকজন পানিগুলো তার মুখে ঢেলে দিল এতে মৃত্তিকা না চাইতেও খেতে হলো। লোকগুলো মৃত্তিকাকে আগের মতো আটকে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
মৃত্তিকা আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ছে। চোখগুলো বারেবারে খুলে রাখতে চাইলেও ব্যর্থ হচ্ছে। তার চোখ গড়িয়ে অঝোরে ধারায় পানি পড়ছে। তার বুঝি শেষবারের মতো পরিবারকে আর দেখা হলো না! সে বুঝি হেরে যাচ্ছে! মৃত্তিকাকে বাঁচাতে ঈশান ভাই কী আসবে না!
চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে মৃত্তিকার নাকে একটি সুগন্ধ আসতেই সে তাড়াতাড়ি চোখ খুলে উত্তেজিত হয়ে উঠল। মৃত্তিকা আপনমনেই বিড়বিড় করে অস্থির দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো।
-‘ঈশান ভাই।’ বলে বিড়বিড় করে আশেপাশে কিছু খুঁজতে লাগলো। চারদিকে তাকিয়ে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু তার আশা এখানে ঈশান ভাই আছে। এই পারফিউমের সুগন্ধটা একমাত্র ঈশান ভাইয়ের কাছ থেকেই আসে। মৃত্তিকা যেন আশার আলো খুঁজে পেলো। তার ঠোঁটে আপনা-আপনি হাসি ফুটে উঠলো। তার মন বলছে, এখানে আশেপাশে কোথাও ঈশান ভাই আছে। কিন্তু অনেকক্ষন হয়ে যাওয়ার পরেও যখন মৃত্তিকাকে কেউ নিতে আসলো না তখন সে হতাশ হয়ে পড়লো। হয়ত একই পারফিউম এখানের মধ্যে কেউ একজন ব্যবহার করে। আর তার চেয়ে বড়ো কথা, ঈশান ভাই এদেশেই নেই। এসব ভাবতেই মৃত্তিকার আশার আলো নিভে গেল। দুর্বলতা তাকে আরো বেশি গ্রাসঃ করে নিলো। পানীয় জাতীয় ওষুধটার হয়ত কাজ হয়ে যাচ্ছে।
মৃত্তিকার চোখ বন্ধ হয়ে পড়ে যাওয়ার সময় ঝাঁপসা চোখে দেখল তার রুমটার দরজা দিয়ে আলো ঢুকছে। হয়ত কেউ একজন এসেছে। আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ হয়ে গেল ওর। তাহলে কী হার মেনে নিলো সে!
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
#রঙিন_রোদ
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৭
মৃত্তিকা আধো আধো চোখ খুলতেই দেখলো রিনি তার এক হাত ধরে মাথার পাশে বসে আছে আর একটু দূরেই চিন্তিত-মুখে সিয়া দাঁড়িয়ে আছে। মৃত্তিকা চারদিকে তাকিয়ে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বসতে নিতেই হাতের ব্যথায় ছটফট করে উঠল।
-‘আরে আস্তে। এভাবে তাড়াহুড়ো করছিস ক্যান!’
-‘আমি এখানে কীভাবে এলাম! আমি তো একটা অন্ধকার বদ্ধ রুমে ছিলাম! কে আনলো আমায়?’উত্তেজিত কণ্ঠে একনাগাড়ে বলে উঠল মৃত্তিকা।
-‘বদ্ধ রুম! মানে! তুই তো ঢাকার বাস স্টেশনে বেহুঁশ হয়ে পড়ে ছিলি। পরে কেউ একজন তোর ব্যাগ থেকে মোবাইল নিয়ে সিয়াকে কল দেয়াতে সে গিয়েছিল ওখানে। পরে আমি আর সিয়া মিলে তোকে এখানে এনেছি। বাবা- ফুফিকে বলেছি, তুই অসুস্থ তাই হোস্টেল থেকে নিয়ে এসেছি। আগে বল, তুই বাস স্টেশনে কী করতে গিয়েছিলি? আমাকে এর কয়েকদিন আগে মেসেজ দিয়েছিলি সেটা আমি খেয়াল করিনি।’
মৃত্তিকা স্তব্ধ হয়ে রিনির দিকে তাকিয়ে রইল। এসব কী বলছে ওরা! মৃত্তিকা তো একটা রুমে আটকা ছিল। ওখানে সব কথা ও স্পষ্ট শুনেছিল যে তাকে সেদিন রাতে ফ্লাইটে বাইরের দেশে পাচার করবে। কিন্তু এরা কী বলছে এসব!
-‘কী বলছিস এসব?’ মৃত্তিকা কাঁপা কাঁপা স্বরে জানতে চাইলো।
-‘হ্যাঁ রে।’ সিয়া এগিয়ে এসে মৃত্তিকার কথার জবাব দিল।
-‘তোদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমাকে একটা রুমে আটকে রাখা হয়েছিল।’
-‘শোন, তোর মাথায় অতিরিক্ত প্রেসার পড়ায় আজেবাজে বকছিস। লাইট অফ করে কিছুক্ষন ঘুমা। তাহলে দেখবি ভালো লাগবে। মাঝরাতে এসব আজেবাজে বকিস না।’ রিনি মৃত্তিকার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠল। রিনির সাথে তাল মিলিয়ে সিয়াও একই কথা বলে উঠতেই মৃত্তিকা ঝাটকা মেরে রিনির হাত সরিয়ে চিৎকার করে উঠল।
-‘তোরা কী মনে করছিস? আমি পাগলামি করছি?’ বলতে বলতে মৃত্তিকা ফুফিয়ে কেঁদে উঠল। তার কথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইছে না।
-‘আমরা কেউই বলছি না যে তুই পাগলামি করতেছিস। আমরা বলছি, তোর মাথায় বেশি প্রেসার পড়ার কারণে মাঝরাতে এমন আজেবাজে বকছিস। একটু ঘুমা। সকালে উঠে ভালো লাগবে। আমরা ফুফিকে অনেক কষ্টে রাতে রুমে পাঠিয়েছি ঘুমানোর জন্য। তিনি তোর চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তুই এসবের কিছুই ফুফি, বাবাকে বলিস না। নাহলে ওরা আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। এখন একটু ঘুমা। দেখবি, সকালে ভালো লাগবে। চল সিয়া।’ বলেই রিনি আর সিয়া লাইট অফ করে রুমের দরজা আটকে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
মৃত্তিকা স্তব্ধ হয়ে অন্ধকারে বসে রইল। কেউ ওর কথা বিশ্বাস করছে না। আচ্ছা, সেদিন কী হয়েছিল মৃত্তিকার সাথে! সে তো ওই বদ্ধ রুম থেকে চেয়েও পালাতে পারেনি। সেদিন রাতে মৃত্তিকার ফ্লাইট ছিল। আর ওই ৩২নাম্বার রুমের মেয়েগুলোর কী অবস্থা! ওরা কী পালাতে পেরেছিল না-কি পরিবারের মায়া ত্যাগ করে মানুষের পণ্য বস্তু হিসেবে অন্যদেশে পাড়ি জমিয়েছে! মৃত্তিকার হুট্ করে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো মেয়েগুলোর জন্য! মৃত্তিকা তো বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। মেয়েগুলোও তো কোনো পরিবারের আদরের মেয়ে হতো! তাদের এই অবস্থা! আচ্ছা, মৃত্তিকাকে কে বাঁচিয়েছে! সে বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার আগে কেউ একজনকে সেই রুমে ঢুকতে দেখেছিল। সে সময় মৃত্তিকা তো ধরেই নিয়েছিল তার বোধহয় দিন শেষ। তাকে কেউ একজন তাদের কথা অনুসারে নিতে এসেছিল। এরপর চোখ গুলো আর চেয়েও খুলে রাখতে পারলো না। তাদের তীব্র নেশার ফলে মৃত্তিকার চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল। এরপর! এরপর আর কিছু মনে ছিল না মৃত্তিকার। কিন্তু কীভাবে মৃত্তিকা স্টেশনে গিয়েছিল? উফফ! মৃত্তিকা আর ভাবতে পারছে না। মাথাটা চেপে ধরে সে বসে রইল। আস্তে আস্তে মাথার তীব্র যন্ত্রনায় মৃত্তিকা শুয়ে পড়লো।
——-
সকাল বেলায় রুমি আহমেদ ঘুম থেকে উঠে আগে মৃত্তিকার রুমে গেল।
রুমে ঢুকতেই বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতে দেখলো মৃত্তিকাকে। তিনি মৃত্তিকার বিছানার দিকে এগিয়ে মেয়ের মাথার পাশে বসলো। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তাকিয়ে রইল। শফিকের এই একটামাত্র অস্তিত্বকে সে সবসময় আগলে রাখার চেষ্টা করে। আজ যদি শফিক বেঁচে থাকতো তাহলে এই মেয়ের অসুস্থতায় বোধহয় প্রাণ টাই দিয়ে দিতো। ছোট বেলায় মৃত্তিকার ছোট্ট ছোট্ট হাতগুলো ধরে সবসময় আদর-মাখা কণ্ঠে রুমি আহমেদকে ইশারা করে বলতো,
-‘হ্যাঁ রে রুমু! কখন যে আমার এই মেয়েটা বড়ো হবে। আমাকে আধো আধো কণ্ঠে ‘বাবা’ বলে ডাকবে!’
রুমি আহমেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আফসোস! শফি ‘বাবা’ ডাকটা শোনার আগেই পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। শফি থাকলে কী যে খুশি হতো! একদম বাচ্চা-পনা স্বভাব ছিল শফিক আহমেদের। অথচ আজ সে আকাশের তারা। কে যেন তার ভালোবাসাকে চিরতরে রুমি আহমেদের কাছ থেকে কেড়ে নিল। এখনো ভুলতে পারেনি রুমি আহমেদ। রুমি আহমেদও একা পথ চলা শিখে গিয়েছে। তার চলতে আজ আর কারো প্রয়োজন পড়ে না।
.
.
মৃত্তিকা চোখ খুলতেই দেখলো তার মা জানালার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি ঝাঁপসা। মৃত্তিকা একটা মলিন শ্বাস ফেলল। তার মা’কে সে প্রায় সময় এরকম অবস্থায় আবিষ্কার করে। মৃত্তিকা জানে, এখন তার মা বাবা’র স্মৃতিস্মরণ করছে। যতবারই মৃত্তিকা অসুস্থ হয়ে পড়বে ঠিক ততবারই রুমি আহমেদ মৃত্তিকার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কোথায় জানি হারিয়ে যায়। প্রথম প্রথম মৃত্তিকা বুঝতে না পারলেও সময়ের সাথে সাথে এখন বুঝতে শিখেছে। তার মা এখনো বাবা’কে ভুলতে পারেনি। পারবেও বা কীভাবে! তাদের যে প্রেমের বিয়ে ছিল। বিয়ের তিনবছরের মাথায় মৃত্তিকার এক বছর বয়সেই একদিন তার বড়ো ভাই লুৎফর আহমেদ খবর আনলো শফিক আহমেদ মারা গিয়েছে। কে বা কারা যেন মৃত্তিকার বাবাকে হত্যা করে লাশ গায়েব করে ফেলেছে। বাবার কোনো স্মৃতিই মৃত্তিকার মনে নেই। মনে থাকবেও বা কীভাবে! তখন যে মৃত্তিকা অনেক ছোট ছিল। বাবার আদর কী জিনিস মৃত্তিকা কোনোদিন জানতে পারেনি কিন্তু তার বড়ো মামা ঈশান ভাইয়ের বাবা সবসময় মৃত্তিকাকে আগলে রাখতো ;তিনি অনেক আদর-যত্ন করতেন মৃত্তিকাকে। বাবা’র জায়গা নিতে না পারলেও যথেষ্ট খেয়াল রাখতেন মৃত্তিকার। তাই বাবা’কে তেমন একটা মনে পড়েনি মৃত্তিকার কিন্তু মাঝে মাঝে মা’য়ের এমন খামখেয়ালি স্বভাবের জন্য বাবাকে ভীষণ করে মনে পড়ে। মৃত্তিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের দিকে তাকালো।
-‘মা ‘
রুমি আহমেদের হঠাৎ হুশ ফিরতেই তিনি মৃত্তিকার দিকে তাকাল।
-‘হ্যাঁ রে মা । কেমন লাগছে এখন তোর?’
-‘ভালো, মা।’
-‘ শরীরের খেয়াল রাখবি না? হোস্টেলে তো আমি দেখিই না কী খাস না খাস! না খেয়ে এই অবস্থা করছিস শরীরের। কয়েকদিন পড়াশোনা বাসায় বসে কর। ভালো লাগলে হোস্টেলে যাস। এখন আমি কিছু নিয়ে আসি, খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিবি চুপচাপ।’ বলেই রুমি আহমেদ তড়িঘড়ি করে উঠতে নিতেই মৃত্তিকা হাত ধরে ফেলল।
-‘মা, আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ। তুমি এতো প্রেসার নিও না তো।’
-‘একদম চুপ। হোস্টেলেও এমন করে রোগ বাধিয়েছিস। ভাগ্যিস, সিয়া ছিল। নাহলে এভাবেই পড়ে থাকলেও তো আমি জানতে পারতাম না।’ বলেই তিনি বেরিয়ে যেতে নিলে দরজা দিয়ে রিনিকে খাবার নিয়ে ঢুকতে দেখে থেমে গেল।
-‘ফুফি, তুমি মৃত্তিকাকে নিয়ে এতো ভেবো না। ওর জন্য আমি আছি। তুমি গিয়ে কিছু খেয়ে ওষুধ খেয়ে নাও। সকাল থেকে তো এখানেই পড়ে আছো।’
রিনি জোর করে রুমি আহমেদকে খেতে পাঠিয়ে দিল।
রুমি আহমেদ যেতেই রিনি খাবারের প্লেট নিয়ে মৃত্তিকার দিকে এগিয়ে গেল।
-‘আমি খেতে পারবো। আমাকে দেয়।’ মৃত্তিকা রিনির থেকে প্লেট এগিয়ে নিতে চাইলে রিনি না দিয়ে নিজে খাবার খাইয়ে দিতে লাগল মৃত্তিকাকে।
-‘তুই আগে পুরোপুরি সুস্থ হ। তারপর খাইস।’ রিনি রুটি ছিঁড়ে মৃত্তিকার মুখে পুরে দিতে দিতে বলল।
-‘তোর কী মনে হয়? আমি অসুস্থ?’
-‘তাই নয় তো কী! নাহলে স্টেশনে গিয়ে এভাবে কেউ বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে না-কি?’
-‘তোরা আমার কথা কেউ বিশ্বাস করছিস না। আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল আর আমাকে ওরা সেদিন রাতে বাইর দেশে পাচার করে দিতে চেয়েছিল। এরপর কী হয়েছিল আমি আর জানি না।’
-‘আচ্ছা যা বিশ্বাস করলাম কিন্তু ওরা তোকে কিডন্যাপ করে পাচার না করে স্টেশনে কেন রেখে গেল? সিয়া কয়েকদিনের জন্য তার বাড়ি গিয়েছিল। আসার পথে কল আসাতে সে স্টেশনে গিয়ে তোকে পেল।’
মৃত্তিকা আবারো কিছু বলতে নিতেই সিয়া তৈরী হয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠল,
-‘শোন মৃত্তিকা। তুই ইদানিং সারাদিন পড়াশোনা বেশি করছিস তাই মাথায় অতিরিক্ত প্রেসার পড়ার ফলে এমন করছিস। এসব ভুলে যা। কয়েকদিন বাসায় থাক। আমি তোকে নোট দিয়ে যাবো। পরে সুস্থ হলে হোস্টেল যাইস। আমি যায়, ক্লাস আছে। তুই নিজের খেয়াল রাখিস।’ বলেই সিয়া রিনির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-‘রিনি, ওর খেয়াল রাখিস।’ বলেই মৃত্তিকাকে কিছু বলতে না দিয়ে সিয়া তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল।
মৃত্তিকা একটা মলিন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার কথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইছে না। কাউকে সে বোঝাতে পারছে না। সে এখনো বুঝে উঠতে পারছে না। কেন তারা মৃত্তিকাকে আগের জায়গায় রেখে গেল!
#চলবে ইন শা আল্লাহ।