রঙিন_রোদ,পর্ব_৮,৯

0
1307

#রঙিন_রোদ,পর্ব_৮,৯
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৮

এখন মৃত্তিকা পুরোপুরি সুস্থ তবে ওই ঘটনাটা এখনো তাকে খুরে খুরে খায়। তবুও সেটা সে মাথা থেকে ঝেড়ে পড়াশোনায় মন দিতে চায়। এতদিন সে মা-রিনিদের জোরাজুরিতে বাসায় ছিল। প্রতিদিন সিয়া এসে বা মোবাইলের মাধ্যমে নোট পাঠিয়ে দিতো। কিন্তু মৃত্তিকা আজ আর মানবে না। তার হোস্টেলে ফিরে যেতে হবে। অনেক পড়া এখনো বাকি। এমনিও ঈশান ভাইয়ের কথার অনেক অমান্য করে ফেলেছে, এখন থেকে আর করবে না। যথারীতি ব্যাগ গুছিয়ে বের হওয়ার আগে রিনির সাথে ড্রয়ইং-রুমে খেতে বসতেই দেখলো আরশি রুম থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেকদিনের জন্য কোথাও যাচ্ছে। আরশির পেছন পেছন তার মা-বাবা বের হচ্ছে। তার মা আঁচলে মুখ ঢেকে চোখের পানি নিয়ে মেয়েকে বিদায় দিচ্ছে।
মৃত্তিকা আর রিনি কিছুই বুঝলো না। হঠাৎ কোথায় যাচ্ছে আরশি! আরশির পরিবার ঈশান ভাইয়ের বিয়ে ভাঙার পর থেকে বাসার কারো সাথে তেমন কথা বলে না যার ফলে আজ সে কোথায় যাচ্ছে সেটা মৃত্তিকা-রিনি ধরতে পারছে না।

আরশি দেশের বাইরে পড়াশোনা করে। তার বিয়ে উপলক্ষে খুশিতে দেশে এসেছিল। সে আগে থেকেই ঈশানকে পছন্দ করতো। ভেবেছিল, বিয়ের পর আর দেশের বাইরে যাবে না। এখানেই বাকি পড়াশোনাগুলো শেষ করে ফেলবে কিন্তু তা তো হলো না।

আরশি দরজার সামনে গিয়ে রিনির দিকে এগিয়ে এলো।

-‘আমি যায় রিনি। ভালো থাকিস।’

-‘কই যাচ্ছ আরশি আপু?’ রিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আরশি ছলছল চোখে মলিন হাসলো। আরশির এই মলিন হাসি দেখে মৃত্তিকার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে জানে, এই হাসির পেছনে কতটা বেদনা লুকিয়ে আছে। মৃত্তিকার আরশির জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে কিন্তু মৃত্তিকার কিছুই যে করার ছিল না তখন। ছোটকাল থেকেই আরশি রিনি-মৃত্তিকাকে বড়ো বোনের মতো আগলে রাখতো। ভিনদেশে যাওয়ার পরেও রিনি-মৃত্তিকার প্রতি আরশির ভালোবাসা একটুও কমেনি। আরশি অনেক আগে থেকেই ঈশানকে পছন্দ করতো কিন্তু কোনোদিন মুখ ফুটে লজ্জায় বলতে পারেনি।

-‘আগে যেখানে ছিলাম এখন আবার সেখানেই পাড়ি জমাচ্ছি।’ আরশি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।

-‘ইংল্যান্ড?’ রিনির চেহারায় বিস্ময় সাথে মৃত্তিকাও অবাক দৃষ্টিতে আরশির দিকে তাকিয়ে রইল।

-‘হ্যাঁ, রে।’

-‘তুমি তো আর যাবে না বলছিলে ওখানে!’

-‘যার জন্য আসলাম তাকেই পেলাম না। এখানে থেকে আর লাভ কী বল! চেষ্টা করবো আর না আসার এখানে। আমি যে এতো তাড়াতাড়ি অনুভূতিটা ভুলতে পারবো না। চোখের সামনে এগুলো সহ্য করতে পারবো না। অনেক আগে থেকে সেখানে একেবারের জন্য থেকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ভেবেছিলাম এই বিয়ের পর এখানেই থেকে যাব। পাপা, মাম্মাও কয়েকমাসের মধ্যে আমার এখানে চলে আসবে একেবারের জন্য। আশা করি, সমস্যা হবে না। দোয়া করিস আমার জন্য।’ আরশি মৃত্তিকার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রিনির উদ্দেশ্যে জবাব দিল। এরপর চলে যেতে নিলে মৃত্তিকা কী বুঝে আরশিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল।

-‘আরশি আপু। তুমি আমাকে বড়ো বোনের মতো সবসময় আগলে রেখেছিলে। তুমি আমার সাথে কথা না বললে আমি থাকতে পারবো না। তোমার চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারছি না। বিশ্বাস করো, তোমার চোখের পানি দেখে আমার বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে। সেদিন আমার কোনো দোষ ছিল না আপু। আমাকে দরকার হলে ছোটবেলার মতো মেরে-কেটে শাসন করো তবুও আমার সাথে কথা না বলে থেকো না আপু প্লিজ।’

আরশি মৃত্তিকার দিকে ফিরে মাথায় হাত বুলিয়ে মলিন হাসলো।

-‘এই পাগলী! বড়ো বোনে কোনোদিন ছোট বোনের কথায় রাগ করে থাকতে পারে! এখানে তো তোর দোষ নেই। সেদিন আমি রাগের মাথায় সবার সাথে সাথে তোকে দোষারোপ করেছি কিন্তু কয়েকদিন যেতেই বুঝেছি সেখানে তোর কোনো দোষ ছিল না। সব আমার নিয়তি। ঈশান হয়ত আমার কপালে ছিল না ;তাই তো এতো আয়োজনের পরেও তাকে আমি পেলাম না।’

-‘আপু, আমাদের ছেড়ে আবার চলে যাচ্ছ যে!’

-‘আমার যে যেতেই হবে। তোরা নিজেদের খেয়াল রাখিস, ভালো থাকিস বোন। তোদের উপর আমার কোনো রাগ নেই। আমি যায় রে।’ বলেই আরশি রিনি-মৃত্তিকাকে দুই’হাতে জড়িয়ে ধরে এরপর একে একে সবার সাথে আলাপ শেষ করে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে।

মৃত্তিকা আরশির যাওয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এমন বোন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। মৃত্তিকা না চাইতেও অনেক বড়ো কষ্ট দিয়ে ফেলেছে বোধহয় আরশিকে।

আরশি যেতেই রিনি মৃত্তিকার কাঁধে হাত রেখে খাবারের দিকে ইশারা করলো। মৃত্তিকা চুপচাপ খাওয়া শেষ করলো।

এরপর রুমে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো হোস্টেলে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ব্যাগ নিয়ে মা’কে আর বাসার বাকি সবাইকে বলে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। রিনি সাথে আসতে চেয়েছিল কিন্তু মৃত্তিকা যেতে পারবে বলে চলে এসেছিল। রিনি আবার এতো পথ কষ্ট করে আসবে- যাবে ;সেটা মৃত্তিকা চায়নি।
.
.
কেটে গেল আরো কয়েকটা দিন। সময় চলে যাচ্ছে আপন-গতিতে। মৃত্তিকা নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত এখন। আদিবের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে পড়াশোনায় মন দিয়েছে। আর কোনো অঘটন সে চায় না। ঈশানের আদেশ মেনে চলার চেষ্টা করছে। এখন সে ঈশানের অর্ধাঙ্গিনী। না চাইলেও ঈশান তার স্বামী। স্বামীর কথা মেনে চলা উচিত।

আজ ক্লাস আছে। তাই মৃত্তিকা সকাল সকাল উঠে কিছু বানিয়ে খেয়ে নিল। আর বাকি কিছু সিয়ার জন্য রেখে দিল। সিয়া তার গ্রামের বাড়ি গিয়েছে কিছুদিনের জন্য। গ্রামে তার চাচাতো বোনের বিয়ে। মৃত্তিকাকে কাল রাতের দিকে বলেছিল, সে হোস্টেলে ফিরে আসার উদ্দেশ্যে রাত দশটার বাসে উঠেছে। মৃত্তিকা তৈরী হয়ে ক্লাসে যাওয়ার আগে সিয়া’কে কল করার উদ্দেশ্যে মোবাইল হাতে নিতেই স্ক্রিনে সিয়ার নাম ভেসে উঠলো। তা দেখে মৃত্তিকা মুচকি হাসলো। মেয়েটাকে মাত্রই কল করতে মোবাইল নিয়েছিল। মৃত্তিকা ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে রুমের দরজা আটকাতে আটকাতে সিয়ার কল রিসিভ করল।

-‘হ্যাঁ রে, সিয়া! কই তুই? ঢাকা এসে গে…’

-‘মৃত্তি…তো…তো…কে…’
সিয়া মৃত্তিকাকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই হাপাতে হাপাতে উত্তেজিত কণ্ঠে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু বেশি উত্তেজনার কারণে কথা সম্পূর্ণ করতে পারছে না।

মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে সিয়ার কথা বোঝার চেষ্টা করছে কিন্তু পুরোপুরি বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে। মেয়েটার আজ কী হয়েছে।

-‘সিয়া। কী হয়েছে! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না তোর কথা। কী বলতে চাচ্ছিস?’

-‘ আ… আমার… তো… তোকে গুরুত্বপূর্ণ ক…’ সিয়া হাপাতে লাগলো।

-‘আচ্ছা, তুই এসে রিলেক্স হয়ে বলিস। এতো কষ্ট করে বলতে হবে না। আমি ক্লাসে যাচ্ছি, তোর মুখ থেকে এসে সব শুনবো। সাবধানে আ…’ মৃত্তিকার কথার মাঝখানে’ই অপরপাশ থেকে কল কেটে গেল। দ্বিতীয়বার কল লাগাতেই মোবাইল বন্ধ শুনালো। মৃত্তিকা তা দেখে মাথা নেড়ে আপনমনেই ‘পাগলী’ বলে বিড়বিড় করে উঠলো। মেয়েটাও বাসা থেকে এতো দূরে আসতেছে অথচ মোবাইলটা ঠিকমত চার্জ দিয়ে আনতে পারল না। কথার মাঝখানে সিয়া’র মোবাইল বন্ধ হয়ে যাওয়া-আজকের নতুন ব্যাপার নয়। যখন থেকেই সিয়ার সাথে পরিচয় মৃত্তিকার তখন থেকেই এমন। মেয়েটা কোনসময় মোবাইলে পুরোপুরি চার্জ দিয়ে রাখতো না। প্রথম প্রথম মৃত্তিকার বিরক্ত লাগলেও সময়ের সাথে সাথে সয়ে গেছে। সে আর কিছু না ভেবে মোবাইলটা ব্যাগে রেখে রুম লক করে ক্লাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
.
.
ক্লাস শেষ করে মৃত্তিকা রুমে এসে ফ্রেস হয়ে রান্নাঘরে কিছু খাওয়ার উদ্দেশ্যে গেল। সকালে সিয়ার জন্য যা খাবার বানিয়ে রেখে গিয়েছিল সেসব আগের মতো আছে দেখতেই মৃত্তিকার টনক নড়লো। সিয়া কী এখনো আসেনি! সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়ালো কিন্তু মেয়েটার আসার নাম-গন্ধ নেই। এতক্ষন তো লাগার কথা নয়! সিয়ার গ্রামের বাড়ি ঢাকার বাইরে অন্য জেলাতে হওয়াতে বাসে করে যেতে হয়। সর্বোচ্চ ৭ ঘন্টা লাগে স্টেশনে পৌঁছাতে। এরপর স্টেশন থেকে হোস্টেলে ফিরতে আধ-ঘন্টা মতো লাগে। আজ এখনো এলো না কেন ভাবতে পারছে না মৃত্তিকা! সে তাড়াতাড়ি সিয়াকে কল করার উদ্দেশ্যে মোবাইল হাতে নিতেই দেখলো ঠিক সেসময়ে সিয়ার নাম ভেসে উঠেছে। মৃত্তিকা মোবাইল রিসিভ করে কড়া ভাষায় কিছু বলতে নিতেই অচেনা কারো কণ্ঠস্বর শুনে থমকে গেল। মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে কান থেকে মোবাইল নামিয়ে দেখলো। না, এটা সিয়ারই নাম্বার। কিন্তু অচেনা মানুষের কণ্ঠ কেন! মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে মোবাইল কানে ধরতেই ওইপাশ থেকে কিছু একটা বলতেই মৃত্তিকা স্তব্ধ হয়ে গেল।

#চলবে ইনশাআল্লাহ।

#রঙিন_রোদ
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৯

-‘হ্যালো! শুনতে পাচ্ছেন! আপনি কী মৃত্তিকা? মানে এই মোবাইলের মালিকের বেস্ট ফ্রেন্ড? এই মোবাইলের মালিক অনেক বড়ো একসিডেন্ট করেছেন। উনার এখন অনেক ক্রিটিকাল অবস্থা। মোবাইলটা এতক্ষনে একটু চার্জ হওয়াতে কললিস্টে আপনার নাম্বার আগে পেয়ে কল দিয়েছি।’

মৃত্তিকার কান দিয়ে এতকিছু ঢুকছে না। সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল,

-‘ক… কোন… হা… হাসপাতালে আছে!’

-‘জি, আমি অ্যাড্রেস মেসেজ করছি। আপনি উনার পরিবারকে খবরটা দিয়ে দিয়েন। উনার অবস্থা অনেক ক্রিটি…’

মৃত্তিকা আর কিছু শোনার প্রয়োজনবোধ করলো না। সে মোবাইল নিয়ে কোনোমতেই তড়িঘড়ি করে ঐভাবেই বেরিয়ে পড়লো।

হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছেই মৃত্তিকা সিয়ার ওখানে দৌড়ে গেল। মৃত্তিকা যেতেই ডাক্তাররা মৃত্তিকার সাইন নিয়ে সিয়াকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়ে ফেলল। অবশ্য, ডাক্তাররা আগে পরিবারকে খুজেছিল কিন্তু অবস্থা বেশি ক্রিটিকাল হওয়ায় মৃত্তিকা ডাক্তারদের বেশি জোর করাতে ওরা অপারেশনের ব্যবস্থা করলো। বাইরের থেকে থিয়েটারের কাঁচ দিয়ে ভেতরে তাকাতেই সিয়াকে এরূপ রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ডাক্তাররা তড়িঘড়ি করে ভেতরের পর্দাটা টেনে দিতেই মৃত্তিকা থিয়েটারের বাইরে মেঝেতে বসে পড়লো। চঞ্চল সিয়াকে এমন শান্ত অবস্থায় মৃত্তিকা সহ্য করতে পারছে না।
হঠাৎ খেয়াল হলো সিয়ার পরিবারকে বলা হয়নি। মৃত্তিকা তাড়াতাড়ি করে সিয়ার পরিবারকে কল দিয়ে সব জানিয়ে রিনিকে কল করে জানাল। কাঁদতে কাঁদতে মৃত্তিকার চোখ-মুখ ফুলে গেছে। সে কাঁদতে কাঁদতে ক্রান্ত হয়ে মেঝেতে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুসময় পর থিয়েটারের দরজা খোলার আওয়াজে মৃত্তিকা চোখ খুলেই দেখতে পেল একজন ডাক্তার তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসছে। সে কোনোমতে উঠে ডাক্তারের কাছে যেতেই ডাক্তার জানাল – রোগীর জন্য আর্জেন্ট রক্ত লাগবে কারণ অনেক রক্ত কমে গিয়েছে।
মৃত্তিকার হঠাৎ মনে পড়লো তার আর সিয়ার রক্তের গ্রুপ মিল। তারা সবসময় সেটা নিয়ে গর্ব করে বলতো,সবাইকে বলতো ওরা দুইবোন যার ফলে সবকিছুর সাথে সাথে রক্তের গ্রুপও মিল। মৃত্তিকা উত্তেজিত কণ্ঠে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

-‘আমি দিব রক্ত।’

-‘কিন্তু আপনাকে তো দেখতে অনেক দুর্বল লাগছে। পারবেন?’

-‘হ্যাঁ, পারবো।’

মৃত্তিকার জবাব পেতেই ডাক্তার তাড়াতাড়ি করে একটা নার্সকে ডাক দিল। নার্স আসতেই ডাক্তার আবার থিয়েটারে ঢুকে গেল। নার্স মৃত্তিকাকে একটি ক্যাবিনে নিয়ে রক্ত নিতেই মৃত্তিকাকে দুর্বলতা গ্রাস করে যার ফলে নার্স একটি ঘুমের ওষুধ দেয় যাতে মৃত্তিকা ঘুম থেকে উঠেই একটু সুস্থতা অনুভব করে। এরপর নার্স রক্ত নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

নার্স মৃত্তিকার ক্যাবিন থেকে বের হতেই কেউ একজন আড়াল থেকে দেখে সেই ক্যাবিনের দিকে এগিয়ে গেল।
আগন্তুকটি আস্তে আস্তে গিয়ে মৃত্তিকার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মলিন শ্বাস ফেলে এক দৃষ্টিতে মৃত্তিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

-‘কতদিন পরে এই চেহারাটা দেখছি। আজকের ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত মৃত্তি। ক্ষমা করে দিও আমায়। আমি না চাইতেও এটা করতেই হলো। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি মৃত্তি। চাইলেও কাছে আসতে পারি না। জানো, ভীষণ কষ্ট হয় তোমার দূরে থাকতে। আচ্ছা, ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেন হয় মৃত্তি! বড্ড মিস করি তোমায়! আজকে তোমার সবচে কাছের বোন সমান বান্ধবীর এরূপ অবস্থার জন্য আমি দায়ী। না চাইলেও করতে হয়েছে আমায়। ক্ষমা করে দিও আমায় মৃত্তি। আমি যে তোমায় বড্ড ভালোবাসি।’ আস্তে আস্তে কথাগুলো বলতে বলতেই আগন্তুকটার চোখ বেয়ে অশ্রু নির্গত হলো। আগন্তুকটা মৃত্তিকার দিকে ঝুঁকে থাকায় তার চোখের পানি মৃত্তিকার কপালে পড়লো।

কপালের উপর তরল জাতীয় কিছু পড়ায় মৃত্তিকা ঘুমের মাঝেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। তার মনে হচ্ছে, কেউ যেন খুব গভীর-ভাবে তার মুখের দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। আগন্তুকটার নিঃশ্বাস মৃত্তিকার মুখের উপর আঁচড়ে পড়ছে কিন্তু মৃত্তিকা চাইলেও তার চোখ খুলতে পারছে না। বারবার চাইতেও আবারো গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেল।

মৃত্তিকার নড়াচড়া দেখে আগন্তুকটা চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। শেষবারের মতো মৃত্তিকার মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে ক্যাবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

——-

মৃত্তিকা চোখ খুলেই রিনিকে তার পাশে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তার নিজের আবার কী হলো! সে শোয়া অবস্থায় ক্যান! আস্তে আস্তে সবকিছু মনে পড়তেই সে তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসল।

-‘রিনি, সি… সিয়া কই?’

সিয়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই রিনি মুখ পাংশুটে করে ফেলল।

-‘শোন মৃত্তি। সিয়ার বেশি ক্রিটিকাল অবস্থা ছিল যার ফলে ডাক্তাররা চেয়েও তার অবস্থা ভালো করতে পারেনি। তবে চেষ্টায় আছে।’

-‘সোজাসুজি বল রিনি।’

মৃত্তিকার কথা শুনে রিনি মাথা নিচু করে ফেলল।
-‘সিয়ার এক্সিডেন্ট বেশি ভয়ঙ্কর’ভাবে হয়েছে – ডাক্তাররা এমন কল্পনা করতেছেন। শরীরের অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। একসিডেন্টের মাঝে সিয়ার পেতে ছুরির আঘাত কোথ থেকে এলো কেউ ভাবতে পারছে না। আপাতত এখানেই তার চিকিৎসা চালাতে হবে। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছে।’ এরপর রিনি মাথা নিচু করে আবারও বলে উঠল,’আল্লাহ যদি চান তাহলে সিয়া আবারো আমাদের মাঝে ফিরে আস…’

রিনির কথা শুনে মৃত্তিকা যেন থমকে গেল। তার চোখ দিয়ে অঝোরে ধারায় অশ্রু নির্গত হতে লাগলো। তার কানে একটা মাত্রই কথা বাজছে যে ‘ডাক্তাররা সিয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে ‘ মৃত্তিকা রিনির আর বাকি কথাগুলো না শুনে দৌড়ে ক্যাবিন ছেড়ে বেরিয়ে সিয়াকে আলাদা করে রাখার ক্যাবিনটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। পেছন পেছন রিনি এগিয়ে এলো। মৃত্তিকা আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে ক্যাবিনে ঢুকে সিয়ার পাশে দাঁড়াল। সিয়ার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। মাথায় ব্যান্ডেজ। শরীরের নানা জায়গায় ব্যান্ডেজ। আজ সিয়া কী শান্তভাবে শুয়ে আছে!

-‘স… সি… সিয়া! এই সিয়া। উঠ না বোন আমার। আমরা গুলশানে যাবো। আড্ডা দিবো অনেক।’

সিয়ার কোনো নড়াচড়া না দেখে মৃত্তিকা রিনির দিকে ফিরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল,

-‘ র… রি… রিনি..এই রিনি! আমার সিয়া আবারো আগের মতো আমার সাথে হেসে খেলে কথা বলবে। সে মজা করছে তাই না? তোরা দুইজনে মিলে প্রতিবারের মতো আবারও আমাকে বোকা বানাতে চাচ্ছিস তাই না? আমি কিন্তু এবার আর বোকা হবো না। তোদের চালাকি ধরে ফেলেছি। সিয়া উঠ।’

মৃত্তিকার কথা শুনে পেছনে রিনি ফুফিয়ে উঠলো। মৃত্তিকা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আস্তে আস্তে সিয়ার শরীরে হাত রেখে ধাক্কা দিয়ে জাগাতে চেষ্টা করলো কিন্তু আজ আর সিয়া চোখ খুললো না।

হঠাৎ ক্যাবিনের দরজা খুলে সিয়ার মা দৌড়ে এসে মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়তেই মৃত্তিকাও ফুফিয়ে কেঁদে উঠল। তার সিয়া আজ আর তার সাথে মজা করতে আসছে না।

অদূরেই সিয়ার বাবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সিয়ার মায়ের বেশি কান্না দেখে তিনি তার স্ত্রীর দিকে এগিয়ে স্ত্রীকে থামানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। সিয়ার মা কিছুক্ষন আগেও বেহুঁশ হয়ে ছিল অন্য ক্যাবিনে। হুশ ফিরতেই আবারও মেয়ের কাছে পাগলের মতো ছুটে এসেছে।

একজন নার্স তাদের ডাক দিতে দিতে ক্যাবিনের দরজা খুলে দৌড়ে এসে তাদের উপর বকা-ঝকা করতেই সবাই কন্দনরত চোখে সিয়াকে আরেকবার দেখে ক্যাবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল । সিয়ার মা কাঁদতে কাঁদতে আবারো বেহুঁশের ন্যায় হয়ে পড়লো।

মৃত্তিকা নিজেও তার আগের অবস্থায় নেই। তার বারেবারে মনে হচ্ছে, এইতো সিয়া এখনই শোয়া থেকে উঠে অক্সিজেন মাস্ক ছুঁড়ে ফেলে হেসে বলে উঠবে,’দেখেছো? তোমাদের কীভাবে অতি সহজে বোকা বানিয়ে ফেলেছি!’
তখন মৃত্তিকা দৌড়ে সিয়ার দিকে রাগী দৃষ্টিতে এগিয়ে গিয়ে দুইটা থাপ্পড় লাগাতেই সিয়া মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে তার রাগ কমানোর চেষ্টা করবে। এক পর্যায়ে সফলও হবে। মৃত্তিকার রাগ কমে গিয়ে হেসে দিবে।

মৃত্তিকা বারবার সিয়ার ক্যাবিনের দরজার কাঁচ দিয়ে সিয়ার দিকে তাকাচ্ছে। এই বুঝি সিয়া উঠে যাবে কিন্তু আজ আর মৃত্তিকার ইচ্ছে সফল হলো না। সিয়া উঠলো না। নিশ্চুপভাবে শুয়ে আছে আজ। আজ আর মৃত্তিকার মন খারাপ অবস্থায় হাসাতে চেষ্টা করতে এলো না সিয়া।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here