রঙ তুলির প্রেয়সী,পর্ব ৭,৮

0
1245

রঙ তুলির প্রেয়সী,পর্ব ৭,৮
ফারজানা আহমেদ
০৭

‘উফ, মা। হয়েছে কী বলোতো? সাত-সকালে এতো চিৎকার চেচামেচি কীসের?’ চোখ কচলাতে কচলাতে ডাইনিং টেবিলের সামনে আসতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল আদিয়ার। জাওয়াদের সাথে বসে চা খাচ্ছেন হেলাল আহমেদ। আদিয়াকে দেখেই একগাল হেসে বললেন, ‘আটটা বাজে। এই উঠলি তুই? আয় এদিকে আয়।’ বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন উনি। আদিয়া এখনও হতভম্ব। আস্তে আস্তে হেঁটে গেল সে। হেলাল আহমেদ মেয়েকে নিজের কোলে বসালেন। তারপর বললেন, ‘ব্রাশ করেছিস?’

না সূচক মাথা নাড়লো আদিয়া। জাওয়াদ বললো, ‘কতোদিন বলেছি ঘুম থেকে উঠেই ব্রাশ না করে রুম থেকে বেরোবিনা।’

হেলাল আহমেদ জাওয়াদকে থামিয়ে আদিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। যা ব্রাশ করে আয়। তোর মা আলুর পরটা বানাচ্ছেন। একসাথে খাবো। রিয়াদ উঠেছে?’

আদিয়া আবারও না সূচক মাথা নাড়লো। জাওয়াদ বললো, আমি ডেকে আনছি।’ তারপর চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে গেল। আদিয়া রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো মুনতাহা আলুর পরটা ভাঁজছেন। টুনি পেঁয়াজ কাটছে। সে এগিয়ে গিয়ে মুনতাহার পাশে দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমিতো ভুত দেখার মতো কেঁপে উঠেছিলাম। হঠাৎ করে বাবা এসে গেল যে? কোনো সমস্যা হয়েছে মা?’

‘আরে না। সারপ্রাইজ দিবে নাকি। এভাবে কেউ আসে বল? রান্নাবান্না কিছুর ঠিকঠাক নেই এইযে সকাল সকাল এলো আগে বললে তো কিছু আইটেম রেঁধে রাখতাম।’

‘যাকগে। আমি অনেক মিস করছিলাম বাবাকে। ফ্রেশ হয়ে আসি বাবার হাতে খাবো।’ বলে হাসি দিয়ে চলে গেল আদিয়া। মুনতাহা টুনির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীরে হয়েছে? একটু দেখতো আমার বাথরুমের কল ছাড়া কিনা। ভুলে গেছি।’

‘হইয়া গেছে আর একটু।’ বললো টুনি।
_______________

প্রায় পাঁচ মিনিট থেকে রিয়াদের দরজায় দাঁড়িয়ে ডেকেই যাচ্ছে জাওয়াদ। রিয়াদের কোনো সাড়াশব্দ নেই। রিয়াদ থাকে দোতলার একেবারে শেষ প্রান্তের ঘরটায়। তিথি ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে একটু মাথা নেড়ে চারপাশে দেখছিলো। হঠাৎ খেয়াল করলো ডান’দিকে একেবারে শেষ প্রান্তে একটা ঘরের সামনে কোমরে দু’হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে জাওয়াদ। কৌতূহল নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল তিথি।

‘রিয়াদ ভাইয়ার দরজার সামনে চোরের মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’

তিথির কথা শুনে চট করে ফিরে তাকালো জাওয়াদ। চোখে মুখে তার চরম বিরক্ত। জাওয়াদ এভাবে হুট করে পেছন ফিরে তাকানোর কারণে তিথি খানিকটা পিছিয়ে গেল। তারপর দু-হাত উপরে তুলে সারেন্ডার করার ভঙ্গিতে বললো, ‘উউউ! এভাবে তাকাতে হয়না। কুচ কুচ হয়।’

‘হোয়াট!’ চোখ বড় বড় করে বললো জাওয়াদ।

‘কিছুনা। এভাবে তাকালে তো ভয়ে মরা একটা তেলাপোকাও জীবিত হয়ে উড়তে শুরু করবে, আর আমিতো…যাকগে। কী করেন এখানে?’

জাওয়াদ মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে বললো, ‘রিডিকিউলাস!’ তারপর আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে দুটো টোকা দিলো রিয়াদের দরজায়। তিথি একটা ভেংচি দিলো। মনেমনে বললো, ‘ভালো করে কথা বল ব্যাটা, আমি তো সুন্দর করেই কথা বলতেছি। এহ! ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি যেন মরেই যাচ্ছি!’ মনের কথা মনেই চেপে রেখে মুখে বললো, ‘বুঝলাম। রিয়াদ ভাইয়াকে ডাকা হচ্ছে। তবে মাথার ধূসর কোষগুলোতে হালকা কমন সেন্স থাকলে আমার মনেহয় ভালো হতো।’

এবার জাওয়াদ ঘুরে আগুন চোখে তাকিয়ে বললো, ‘পটরপটর করতে কেউ বলেছে? আর হোয়াট ডু ইউ মিন বাই কমন সেন্স হে? কী বলতে চাইছো?’

জাওয়াদের দৃষ্টিতে খানিকটা চুপসালো তিথি। তারপর আমতাআমতা করে বললো, ‘ন-না মানে, বলছিলাম যে… এ-একটা কল করলেই তো হয়। এতোক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছেন নিশ্চয়ই পায়ে ব্যাথা করছে? আমি মানবতার খাতিরে বললাম। আচ্ছা আমি যাই হে।’ বলেই আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে চলে গেল তিথি হনহন করে। জাওয়াদ কয়েক মুহূর্ত তাকালো তিথির গমনপথে। তারপর হেসে দিলো হুট করে। তিথির চুপসানো মুখটা মনে করে ভারী মজা পেলো জাওয়াদ। তারপর হাসতে হাসতেই মোবাইল বের করে কল করলো রিয়াদকে।

সিঁড়ির কাছে এসে একবার পেছন ফিরে তাকালো তিথি। দেখলো জাওয়াদ ছাদে যাচ্ছে। তখনই তার মনে পড়লো আসার পর থেকে ছাদে যাওয়া হয়নি। একবার যেতে হবে।
___________________

‘আসসালামুয়ালাইকুম আঙ্কেল।’ হাসি হাসি মুখ করে হেলাল আহমেদের পেছনে এসে দাঁড়ায় তিথি।

‘আরে আরে তিথি মা যে। কতো বড় হয়ে গেছো তুমি! আসো আসো বসো।’ বলে নিজের ডানদিকের চেয়ারটা টেনে দিলেন তিনি। তিথি দেখলো ওপাশের চেয়ারে আদিয়া বসে আছে। আর হেলাল আহমেদ তাকে আলুর পরটা মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন। তিথি হেসে এসে বসলো উনার পাশে। মুনতাহা বললেন, ‘তোকে ডাকতে পাঠিয়েছিলাম। মনেহয় বাথরুমে ছিলি, টুনি গিয়ে পায়নি। নে এবার খাবারটা খেয়ে নে। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে তোর।’

তিথি হেসে বললো, ‘সে খাবো ক্ষণ। কিন্তু আঙ্কেল আসবেন বললেনা কেন কেউ? আমিও রিসিভ করতে যেতাম।’

মুনতাহা বললেন, ‘জানলে তো বলবো? হুট করে না বলে চলে এলেন।’

‘তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য হয়তো। মিস করছিলে তো খুব, আসার পর থেকে মনমরা দেখেছি। তাইনা আঙ্কেল?’ তিথি হেসে তাকালো হেলাল আহমেদের দিকে। হেলাল আহমেদ হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘এইতো, আমার এখানকার সবাই হচ্ছে বুদ্ধু। আর এই আমার তিথি মা হচ্ছে বুদ্ধিমতী।’

‘আর কূটনী বুড়িও।’ ফোঁড়ন কাটলো আদিয়া।

‘আমি কোনো কূটনামি করিনি।’ ঠোঁট ফুলিয়ে বললো তিথি। হাসলেন হেলাল আহমেদ। মুনতাহা বললেন, ‘হয়েছে এবার খা। আর এই দুধের গ্লাসটা শেষ করবি। আজ কোনো কথা শুনবোনা, পুরোটা খাবি।’

‘মামণি, প্লিজ একটু কমাও।’ কাতর স্বরে বলে তিথি। হেলাল আহমেদ বললেন, ‘এমন করতে হয়না। বড়দের কথা শুনতে হয়।’

তিথি আর কিছু বললোনা। ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে থাকলো দুধের গ্লাসটার দিকে। আচ্ছা, এসব খাওয়াদাওয়া কে বের করলো?

‘তোমার এক ছেলেকে ডাকতে আরেক ছেলে গেল। গিয়ে দুজনেই কোথায় গায়েব হলো? খাবারদাবার তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমার একটু ঘুমোতে হবে। তার আগে রিয়াদের সাথে একটু দেখা করবো।’ আদিয়াকে খাওয়ানো শেষ করে বললেন হেলাল আহমেদ।

‘কিজানি। এদের মতিগতি আমি বুঝিনা। দুটোতে এক হলে খবর থাকেনা। কী করছে কে জানে।’ বললেন মুনতানা। আদিয়া পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো, ‘বড় ভাইয়া তো ছোট ভাইয়াকে ডাকতে গেল। ডাকতে গিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়লো নাকি?’

তিথি এবার চোখ তুলে তাকালো। তার মনে পড়লো সে দেখেছে জাওয়াদকে ছাদে যেতে। সে বললো, ‘উনাকে তো দেখলাম ছাদে যাচ্ছেন।’

‘বড় ভাইয়া?’ জিজ্ঞেস করলো আদিয়া।

‘হুম।’

মুনতাহা আদিয়াকে বললেন, ‘খাওয়া তো শেষ। যা তো দেখ কী করে ওরা। ডেকে নিয়ে আয়।’

‘এক মিনিট আমারও শেষ। আমিও যাবো।’ উঠে দাঁড়িয়ে বললো তিথি।
____________________

জাওয়াদ ছাদে এসে দেখলো রিয়াদ বুকডন দিচ্ছে। হেসে দিলো সে। এ ছেলের কোনোকিছুরই কোনো টাইম টেবিল নেই। রিয়াদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। তারপর বললো, ‘সকাল ন’টায় এক্সারসাইজ? ওয়াও ব্রো! ওয়াও!’

‘তবুও তো তোর মতো বডি বানাতে পারিনা। বেড লাক! আজ কয়টা দিলি?’

‘একটাও না। সময়ই পাইনি। আর তাছাড়া, এক্সারসাইজ করতে হয় ভোরবেলা।’ বলে হাসলো জাওয়াদ।

উঠে বসলো রিয়াদ। তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘সময় পাসনি মানে? ভোরবেলা কী কাজ ছিলো?’

‘বাবাকে রিসিভ করা।’

‘মানে? বুঝলাম না।’

‘মানে বাবা চলে এসেছেন। ডাকছেন তোকে। চল।’

‘কী বলিস! হঠাৎ? কোনো সমস্যা হলো নাকি?’ রিয়াদ খানিক চিন্তিত হয়ে বললো।’

‘সারপ্রাইজ, মায়ের জন্য।’ বলে হাসলো জাওয়াদ। হাসলো রিয়াদও। হেসে বললো, ‘স্টিল হি ইজ সো রোম্যান্টিক।’

‘হুম। চল এবার।’

‘দাঁড়া। বুকডন হয়ে যাক একবার? আজতো দিলিনা।’

জাওয়াদ চোখ ছোট করে ভাবার মতো করে বললো, ‘উম, নট অ্যা বেড আইডিয়া। দিয়েই যাই চল।’ বলেই টি-শার্ট এক টানে খুলে ফেললো জাওয়াদ। রিয়াদ ভ্রু উঁচিয়ে বললো, ‘ওয়াও ম্যান! দিনদিন তো হট হচ্ছিস। আমি ভাবছি আমার বিয়েতে সবাই আমাকে না তোকে দেখবে।’

হাসলো জাওয়াদ। দুজনেই ছাদে উপুড় হয়ে বুকডন দিতে লাগলো।

আদিয়া আর তিথি ততক্ষণে এসে ছাদের দরজায় দাঁড়িয়েছে। আদিয়া এগিয়ে গিয়েই বলতে লাগলো, ‘বাহ বাহ, বাবা ওদিকে অপেক্ষা করে আর এদিকে উনারা বডি বানাচ্ছেন। বাবা বসে আছেন তো।’

থামলো জাওয়াদ। উঠে দাঁড়ালো। রিয়াদ ছাদেই শুয়ে টি-শার্ট পরে নিলো। জাওয়াদ হেসে বললো, ‘এজন্যেই আমার সাথে দিতে মানা করি। আমি দিলাম এইটুক সময়ে ষোল। আর তুই সাত।’ বলে পাশে রাখা ছোট পানির বোতল থেকে পানি খেয়ে নিজের খালি গায়েও পানি ঢাললো সে বোতল থেকে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হা হয়ে তাকিয়ে আছে তিথি জাওয়াদের দিকে। জাওয়াদের বুকের পশমগুলো লেপ্টে আছে বুকের ওপর। বিন্দু বিন্দু জল বেয়ে পড়ছে বুক, পেট বেয়ে। কপালে, নাকে জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শরীরে প্রতিটি ভাঁজ… না না, এবস, নিশ্বাসের সাথে ওঠানামা করছে। হাসছে জাওয়াদ, সেই হাসিটা দেখতে কেমন যেন অদ্ভুত ভালো লাগছে তিথির। তিথির কেমন মাথা ঘুরছে, পা টলছে। ঘেমে যাচ্ছে তিথি। ঢোঁক গিললো সে। আবার তাকালো। বিড়বিড় করে বললো, ‘এমন লাগছে কেন? কেন দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে বারবার?’ তিথি আরো একবার তাকালো। নাহ, মাথাটা ভনভন করছে ওর। তাড়াতাড়ি করে নেমে গেল সে। এখানে থাকলে নিশ্চিত অজ্ঞান হবে।
__________________

তিথি বসে আছে নিজের রুমের বারান্দায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আনমনে। পেছনে আদিয়া এসে দাঁড়িয়েছে সেটা খেয়ালই করেনি সে। ঘোর কাটে আদিয়ার ডাকে। আদিয়া বলে, ‘কীরে? ওভাবে না বলে চলে এলি যে। বললি ছাদে ঘুরবি।’

তিথি কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। খানিক দোনামোনা করে হেসে বললো, ‘বাথরুম পেয়েছিলো। এখন ছাদে বসে তো করতে পারবোনা…’

হো হো করে হাসলো আদিয়া। তিথি একটা নিশ্বাস নিলো। আদিয়া বললো, ‘তুই ঠিক আছিস? কেমন লাগছে।’

‘না, মানে মাথাটা একটু ধরেছে।’

‘রেস্ট নে। একটু শুয়ে পড়। পরে আবার ছাদে যাবো।’

‘আচ্ছা।’

হেসে বেরিয়ে গেল আদিয়া। তিথি দরজা লাগিয়ে আলমারি থেকে জাওয়াদের ডায়েরিটা বের করলো। তারপর বিছানায় এসে বসলো ওটা নিয়ে। কেমন যেন বুক কাঁপছে তিথির। সাহস হচ্ছেনা খুলে দেখার। আচ্ছা, ডায়েরিটা কী রেখে দিয়ে আসবে? এভাবে পড়া ঠিক হবে? পরক্ষণেই আবার নিজেকে শুধালো। এনেছে যখন পড়েই নিক। তিথি গভীর চোখে তাকালো ডায়েরিটার দিকে। খুব একটা বড় না ডায়েরিটা। পাতলা। বেশিক্ষণ লাগবেনা শেষ করতে। তিথি একটা ঢোঁক গিললো। আস্তে আস্তে ডায়েরির প্রথম পাতা উল্টালো। সাথেসাথে দেখতে পেলো একটা ছবি লাগিয়ে রাখা। দুজন মানুষ একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসছে। দুটো মানুষের চেহারাই তার পরিচিত। কৌতূহল নিয়ে আরেক পাতা উল্টায় তিথি। দেখতে পেলো লেখা আছে অনেক কিছু। পড়তে শুরু করলো তিথি…….
_________

চলবে……..
@ফারজানা আহমেদ

রঙ তুলির প্রেয়সী
৮.

ঠাস করে ডায়েরিটা বন্ধ করলো তিথি। অস্থির লাগছে ওর। খুব অস্থির লাগছে। চোখ জ্বলছে। নিশ্বাস পড়ছে থেকে থেকে। কান্নারা যেন বাঁধ মানছেই না। হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তিথি। অনেকক্ষণ কাঁদার পরে জোরে জোরে বার কয়েক নিশ্বাস নিলো সে। তারপর উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখগুলো ফুলে গেছে কান্না করার কারণে। চোখ মুখ ভালো করে মুছে নিলো সে। নিজেকে খুঁতিয়ে দেখতে লাগলো তিথি। হালকা-পাতলা গড়ন, হ্যাঁ, তার গায়ের রঙ ও ফরসা। তিথি কয়েকবার চোখের পলক ফেললো, এইতো তার চোখের পাপড়িও ঘন। আরেকটু এগিয়ে গেল তিথি আয়নার দিকে। হাত বুলালো ঠোঁটের নিচের ডানদিকের তিল টার ওপর। খুলে দিলো নিজের চুলগুলোর খোঁপা। পিঠময় ছড়িয়ে পড়েছে তিথির চুলগুলো। কোমর ছাড়িয়ে হাঁটুর খানিকটা উপরে। এইতো, তার চুলও কোমরের নিচে… হাসলো তিথি। লজ্জারাঙা হয়ে গেল তার মুখটা। চোখে একটা অদ্ভুত খুশির জোয়ার। বুকে যেন প্রশান্তির ঢেউ। তিথি বিড়বিড় করলো, ‘সে কি একবারও আমাকে ঠিকমতো দেখেছে?’

বাইরে কারো চিৎকারে ঘোর কাটে তিথির। কিছু মুহূর্ত নীরব থেকে বোঝার চেষ্টা করলো কে চিৎকার করছে। তার কানে এলো জাওয়াদ চিৎকার করে বলছে, ‘আমার আলমারিতে কে হাত দিয়েছে? কে আমার ঘরে গিয়েছে?’

কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন নিশ্বাস বুকে আঁটকে গেল তিথির। ঢোঁক গিলতে চেয়েও গিলতে পারছেনা, গলায় আঁটকে আছে। এবার কী হবে! এবার… ভয়ে আত্মা কাঁপতে লাগলো তিথির। সে দৌড়ে গিয়ে ডায়েরিটা হাতে নিলো। তারপর উপরের দিকে মাথা তুলে বললো, ‘আল্লাহ! পাঁচটা মিনিট সময় দিলানা? এক্ষুণি নিয়ে রেখে দিতাম। এবার আমি কী করবো?’

ভয়ে ভয়ে দরজাটা হালকা ফাঁক করলো তিথি। মাথা বের করে দেখলো জাওয়াদ কোথায়। দেখতে পেলো জাওয়াদ নিচে নামছে। তাড়াতাড়ি করে তিথি সাবধানে জাওয়াদের ঘরে গেল। দরজাটা খোলাই ছিলো, ঘরের অবস্থা করুণ। আলমারি খোলা, কাপড়চোপড় সব এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে। তিথি একবার তাকালো ডায়েরিটার দিকে। এভাবে খুঁজছিলো! তিথি ডায়েরিটা আলমারিতে রাখার জন্য এগোলো। পরক্ষণেই চিন্তা করলো – নাহ, আলমারিতে রাখা যাবেনা। ওখানে খোঁজা শেষ। এদিক সেদিক তাকিয়ে হঠাৎ খাটের দিকে চোখ পড়তেই তিথির মাথায় বুদ্ধি এলো। সে ডায়েরিটা খাটের নিচে ছুঁড়ে দিলো। তারপর এক মুহূর্তও ওখানে না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল।
___________________

‘আদিয়া, আদিয়া…’ নিচে গিয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো জাওয়াদ আদিয়াকে। হুড়মুড় করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো আদিয়া। মুনতাহাও বেরিয়ে এলেন। হেলাল আহমেদ এর ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনিও চোখ কচলে বেরিয়ে এলেন। মুনতাহা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে? এমন করছিস কেন?’

‘আমার রুমে কে গিয়েছে?’

‘কে যাবে? কেউই তো না।’

‘কেউ একজন গিয়েছিলো। আমার আলমারিতে কে হাত দিয়েছে?’

‘কীসব বলছিস জাওয়াদ? তোর আলমারি কে নাড়তে যাবে?’

হেলাল আহমেদ বললেন, ‘কী হয়েছে সেটা বলোতো?’

জাওয়াদ চিৎকার করে বললো, ‘মাহির ডায়েরি খুঁজে পাচ্ছিনা আমি। কোথায়?’

হেলাল আহমেদ বললেন, ‘ঘরেই কোথাও আছে হয়তো। খুঁজে দেখো ভালো করে।’

‘দেখেছি। নেই।’ বলেই দু’হাতে চুল খামচে ধরে সোফায় বসে পড়লো জাওয়াদ। মুনতাহা তাড়াতাড়ি গিয়ে ওর পাশে বসে বললেন, ‘শান্ত হ। কোথায় যাবে? ঘরেই আছে।’

‘আমি খুঁজছি।’ বলে জাওয়াদের ঘরের দিকে গেল আদিয়া। হেলাল আহমেদ বললেন, ‘জাওয়াদ। রুমেই আছে। আরেকদিন একইভাবে রুমে রেখেই তুমি এমন করেছো।’

‘আমি বলছি আমি খুঁ…’ মাথা তুলে কিছু বলতে গিয়ে জাওয়াদ দেখলো সোফার কাছে জড়োসড়ো হয়ে তিথি দাঁড়িয়ে আছে। জাওয়াদের মনে পড়লো সকালে তিথি তার আলমারি নেড়েছে। মাথায় রক্ত উঠে গেল জাওয়াদের। সে ফোঁস ফোঁস করতে করতে তিথির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হঠাৎ এভাবে জাওয়াদ এসে দাঁড়ানোতে তিথির অস্বস্তি লাগলো। চোখ তুলে জাওয়াদের চোখের দিকে তাকাতেই যেন আত্মা কেঁপে ওঠে তার। আগুন ঝরছে চোখ দিয়ে। জাওয়াদ দাঁতে দাঁত ঘষে তিথির চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ইউ! তুমি! ডায়েরি কোথায়?’

‘আ-আম-আমি জা-জা-জানিনা…’ বলেই কেঁদে দেয় তিথি। মুনতাহা উঠে গিয়ে তিথিকে জড়িয়ে ধরে জাওয়াদকে ধমকে উঠলেন, ‘কী করছিস? পাগল হয়ে গেছিস?’

‘এসব কী হচ্ছে জাওয়াদ? ও কীভাবে জানবে?’ হেলাল আহমেদও ধমকালেন।

জাওয়াদ জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে বললো, ‘ও-ই জানে। ও-ই সকালে…’

‘বড় ভাইজান, আফামণি আপনেরে ডাকে। আপনের জিনিস আপনের খাটের তলায় পাওয়া গেছে।’ জাওয়াদের কথার মাঝখানে এসে ভয়েভয়ে কথাটা বললো টুনি। মুহূর্তেই যেন জাওয়াদের মাথা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সে একবার তাকালো তিথির দিকে। তারপর বাবা মার দিকে। হেলাল আহমেদ বললেন, ‘দেখলে তো!’

জাওয়াদ তিথির দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে ‘দুঃখিত’ বলেই চলে গেল হনহন করে। তিথি নাক টানতে লাগলো। মুনতাহা তিথিকে নিয়ে সোফায় বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে টুনিকে বললেন, ‘যা তো, এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়।’

‘আইচ্ছা।’ বলে চলে গেল টুনি পানি আনতে।

হেলাল আহমেদ এসে তিথির পাশে বসে বললেন, ‘কিছু মনে করো না তিথি মা। ছেলেটা এমনই।’

তিথি চোখ মুছলো। লম্বা একটা শ্বাস নিলো। তারপর ভাবতে লাগলো… এই ছেলে এমন থাকবেনা আর।
_____________________

বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বসে বই পড়ছিলো জাওয়াদ। হঠাৎ দরজার দিকে চোখ পড়তেই খানিকটা চমকে গেল। তিথি দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। জাওয়াদ বইটা রেখে সোজা হয়ে বসলো। পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তিথির ওপর। কেমন অস্বস্তি লাগলো তার। মনে পড়ে গেল কেমন দুর্ব্যবহার করেছিলো। লজ্জিত বোধ করলো সে।

‘আসতে পারি?’ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো তিথি।

‘হুম। এসো।’ আস্তে করে বললো জাওয়াদ। তিথি ভেতরে এসেই জাওয়াদের পায়ের কাছে বিছানায় বসে গেল। জাওয়াদের পা লম্বা করে রাখা ছিলো, তিথি এভাবে হুট করে এসে বসায় খানিকটা লেগে গিয়েছিলো তিথির হাতে জাওয়াদের পা। তাড়াতাড়ি করে পা সরিয়ে নিলো জাওয়াদ। এমনভাবে সরালো যে তিথির ভ্রু কুঁচকে গেল। মনেমনে বললো, ‘আমার শরীরে কী ইলেক্ট্রিসিটি আছে নাকি? শক লাগছে?’ মুখে বললো, ‘ব্যাথা টেথা পেলেন নাকি? কাঁটা খোঁচা দিলো? আহ দেখি দেখি…’ বলে মাথা এদিক সেদিক নাড়িয়ে জাওয়াদের পায়ের দিকে তাকালো তিথি। হেসে দিলো জাওয়াদ তিথির অবস্থায়। জাওয়াদের হাসি দেখে হাসলো তিথিও।

‘স্যরি পিচ্চি। আসলে তখন, মাথাটা ঠিক ছিলোনা তো…’ একটু অস্বস্তি নিয়ে বললো জাওয়াদ।

‘ইটস ওকে, বাট আমার বয়স আঠারো বছর দুই মাস। দেখতেও মোটামুটি বিয়ের লায়েক, আর বয়সেও। কোনদিক দিয়ে পিচ্চি লাগে আমাকে?’ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো তিথি।

তিথির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসলো জাওয়াদ। মেয়েটা কী চটাং চটাং কথা বলে রে! সব কথার উত্তর ঝপাঝপ দিয়ে দেয় মাটিতে পড়ার আগেই।

তিথির আবার মাথা ঘুরতে লাগলো একটু একটু করে। এ কী হচ্ছে তার! এমন হওয়ার কথা ছিলোনা… এই হাসি দেখে কেমন যেন মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে। বুক করছে ধুকপুক। ঘোরে চলে যাচ্ছে সে।

‘যতোই হোক, আমার তুলনায় অনেক পিচ্চি। নয় বছরের ছোট। আদিয়ার বয়সি মানেই আমার কাছে পিচ্চি।’ হাসি বজায় রেখেই বললো জাওয়াদ।

‘তার মানে আপনার বয়স সাতাশ। এতেই আমি পিচ্চি হয়ে গেলাম? এমন ভাব করছেন যেন মনে হচ্ছে বয়স সাতাশ না আপনার, সাতাশি।’

‘তুমি কি সবসময়ই ঝগড়া মুডে থাকো নাকি?’ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো জাওয়াদ।

‘আমি কই ঝগড়া করলাম রে বাবা! যুক্তিতে পারলেন না এখন হয়ে গেলাম আমি ঝগড়াটে? বাহ বাহ।’

জাওয়াদ হালকা শব্দ করে হাসলো। এই হাসি দেখে আবারও মাথা ঘুরালো তিথির। দুরুদুরু বুক নিয়ে তিথি তাকিয়ে থাকলো। জাওয়াদ বললো, ‘আমি পারবোনা, সত্যিই কথায় তোমার সাথে পারবোনা।’

তিথি হেসে বললো, ‘দুই দিনের দুনিয়া। এতো ঝগড়াঝাঁটি করে কী ফায়দা? যতদিন বেঁচে আছি মিলেমিশেই থাকি। ডায়েরিটাতে কী এমন ছিলো?’

জাওয়াদ একটু থমকালো। তারপর মুচকি হেসে আস্তে করে বললো, ‘আমার বেঁচে থাকার কারণ।’

কথাটা কেমন যেন বুকে গিয়ে লাগলো তিথির। মুচড়ে উঠলো যেন হৃদয়টা। সে আস্তে করে বললো, ‘ও।’

‘তিথি, স্যার এসেছেন। পড়তে বসবি না?’ আদিয়া এসে রুমে ঢুকেই স্বাভাবিকভাবেই তিথিকে বললো কথাটা। কিন্তু আদিয়ার আগমনে জাওয়াদ আর তিথি দুজনেই কেমন অস্বস্তি বোধ করলো। জাওয়াদ আদিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘নাহিদকে বলিস পড়ানো শেষ করে থাকতে।’

‘আচ্ছা।’ বললো আদিয়া। তারপর তিথির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘গল্প পরে করিস। চল চল।’ বলে সে চলে গেল।

জাওয়াদ তিথির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘যাও। মন দিয়ে পড়াশোনা করো।’

তিথি কোনো কথা না বলে উঠে গেল সেখান থেকে। মনেমনে আদিয়ার টিচারের গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলো। আর আসার সময় পেলো না!
_____________

চলবে……
ফারজানা আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here