রঙ তুলির প্রেয়সী,০২,০৩

0
1595

রঙ তুলির প্রেয়সী,০২,০৩
ফারজানা আহমেদ
পর্ব ২

‘বলছিলাম যে, তিথি তো চলে এসেছে আজ।’ জাওয়াদের প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে বললেন মুনতাহা।

‘তিথি কে?’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় জাওয়াদ।

‘ওমা! এরই মধ্যে ভুলে গেলি? বলেছিলাম না তোকে? সুমেলির মেয়ে। ও মারা যাওয়ার আগে আমাকে চিঠি লিখে গিয়েছিলো। তিথিতো দু’বছর আগে আরেকবার এসেছিলো তখন তুই ছিলিনা। আদিয়ার বয়সেরই। ভারি মিষ্টি…’

‘আচ্ছা। বুঝেছি।’ বলে খাবারে মন দিলো জাওয়াদ।

‘আজ দেরি করলি যে?’

‘দরকার ছিলো আজ অফিসে। বাবার সাথে স্কাইপে একটা মিটিং ছিলো।’

‘ও আচ্ছা।’ বলে উশখুশ করতে লাগলেন মুনতাহা। বিষয়টা নজরে এলো জাওয়াদের। সে বললো, ‘কিছু বলবে মা?’

‘হ-হ্যাঁ…’

‘কী?’ কপাল কুঁচকে তাকালো জাওয়াদ।

‘তিথিকে তোর পাশের ঘরটায় থাকতে দিয়েছি…’ নিচের দিকে তাকিয়ে বললেন মুনতাহা। একমুহূর্তের জন্য জাওয়াদের হাত থেমে গেল। সে চোখ তুলে তাকালো। মুনতাহা আবার বললেন, ‘তো-তোর জিনিসগুলো আমি তোর আলমারিতে…’

‘ঐ আলমারির ভেতর যা যা ছিলো সব বের করেছিলে?’ জাওয়াদের শীতল কণ্ঠ।

‘হ্যাঁ তা করেছি…’

‘কাজটা করার আগে আমাকে অন্তত বলা উচিত ছিলো।’ কথাটা বলে উঠে দাঁড়ায় জাওয়াদ। তারপর হাত ধুয়ে চলে যায় সেখান থেকে। নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ সেদিকে মুনতাহা। তারপর হাঁক ছাড়লেন, ‘এই টুনি… এগুলো গুছিয়ে রাখ তো। আর ঢেকে রাখিস ভালো করে।’
________________________________________________

আদিয়ার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছিলেন মুনতাহা। পাশেই উনার ঘাড়ে মাথা রেখে দুনিয়ার তাবত গল্প করেই যাচ্ছে তিথি। আদিয়ার মাথায় তেল দেয়া শেষ করে তিথিকে বললেন মুনতাহা, ‘উঠ তো, উঠে এখানে এসে বোস। তেল দিয়ে দেই। মাথা ঠাণ্ডা হবে, ঘুম ভালো হবে।’

‘যা বলেছো। একটা লম্বা ঘুম দরকার আছে আজ।’ বলতে বলতে ফ্লোরে বসে পড়লো তিথি। মুনতাহা তেল দিতে লাগলেন ওর মাথায়। এমন সময় টুনি এসে ঢুকে ঘরে।

‘খালাম্মা, বড় ভাইজানের কালা কফিডা এখন বানামু?’

‘কালা কফি?’ কপাল কুঁচকে আদিয়ার দিকে তাকায় তিথি। আদিয়া ফিক করে হাসে। টুনি বলে, ‘আরে আফা ঐযে কালা রঙের কফি আছেনা? আরে দুধ ছাড়া বানায় যেটা। ঐটা।’

‘ওহ ইউ মিন ব্ল্যাক কফি?’

‘হ হ বেলেক কফি। আপনেরে দিমু? বড় ভাইজান তো চিনি ছাড়া খায়। আপনেরে চিনি দিয়া দিমু?’

‘হাও সুইট! বাই দ্য ওয়ে আমি বেলেক কফি খাইনা।’ বলে খিলখিল করে হাসে তিথি। মুনতাহাও হাসেন। আদিয়া টুনির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুই যা, আমি দিয়ে আসছি।’

‘আইচ্ছা।’ বলে বেরিয়ে গেল টুনি।

তেল দেয়া শেষ করে তিথির চুল শক্ত করে বেণি করে দিলেন মুনতাহা। তারপর বললেন, ‘যা এবার রুমে গিয়ে ঘুমা।’
________________________________________________

তন্নতন্ন করে আলমারির ভেতর খুঁজতে লাগলো জাওয়াদ। নাহ, নেই, কোথাও নেই। ‘কোথায় গেল? কোথায় গেল?’ বিড়বিড় করতে করতে আরেক দফা উল্টাপাল্টা করে ফেললো আলমারির ভেতর। দু’হাতে চুল টেনে ধরে ধুপ করে বসে পড়লো সে বিছানার ওপর। ওটা কি রয়ে গেল ওঘরে? আগপিছ চিন্তা না করে হনহন করে হেটে বেরিয়ে গেল নিজের রুম থেকে জাওয়াদ।

গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে লাগেজের কাপড়গুলো ভাঁজ করে আলমারিতে গুছিয়ে রাখছিলো তিথি। দরজাটা খোলাই রেখেছিলো, ঘুমানোর আগে বন্ধ করবে বলে। হাতের কাপড়টা আলমারিতে তুলে রাখার জন্য পেছন ঘুরতেই আঁতকে ওঠে তিথি। পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলে নিলো সে। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার। আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে মাত্র তার ভাঁজ করে রাখা কাপড়গুলো ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলছে। দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ধমকে উঠে বললো তিথি, ‘আরে কে আপনি? এসব কী? এভাবে ফেলছেন কেন আমার কাপড়? আরে এ.. আরে এস.. এই! কী হচ্ছে এসব?’

পাত্তাই দিচ্ছেনা জাওয়াদ। পাগলের মতো কিছু একটা খুঁজে যাচ্ছে সে। খুঁজতে গিয়ে পুরো আলমারি এলোমেলো করে দিচ্ছে। তিথি আবার বললো, ‘বিগত এক ঘণ্টা ধরে আমি এই কাপড়গুলো ভাঁজ করছি। এভাবে ছানাছানি করছেন কেন? পরে আবার কে এসব ভাঁজ করবে? আপনি?’

জাওয়াদের যেন কানেই যাচ্ছেনা কোনো কথা। সে এমন ভাব করছে যেন এই ঘরে তার নিজের ছাড়া আর কারো অস্তিত্বই নেই। পাগলের মতো এই ড্রয়ারে খুঁজছে তো আবার ঐ কাপড় ফেলছে। তিথির রাগ এবার তুঙ্গে। সে চেচিয়ে উঠলো, ‘কারো ঘরে আসার আগে নক করে আসতে হয়। এটা কেমন অভদ্রতা? আপনার সাহস তো কম না দেখছি! আর এভাবে… মামণি…’

‘ডোন্ট শাউট ড্যাম ইট!’ বলেই একটা শাড়ি পেছনের দিকে ছুঁড়ে ফেলে জাওয়াদ। সেটা গিয়ে পড়লো তিথির মুখের ওপর। শাড়িটি হাতে নিয়ে আর্তনাদ করে বললো তিথি, ‘পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে এই শাড়িটি ভাঁজ করেছি। এখন আবার কে করবে!’

‘উফ!’ বলে ফ্লোরে একটা লাথি দিলো জাওয়াদ। তারপর আবার আলমারির ভেতর হাতড়াতে লাগলো। হঠাৎ তার হাত থেমে গেল। ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। তার কাঙ্ক্ষিত জিনিসগুলো দেখতে পেলো সে। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো জাওয়াদ। জিনিসগুলো হাতে নিয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেল সে রুম থেকে। একবার পেছন ফিরে তাকিয়েও দেখলোনা। হতভম্ব তিথি হা হয়ে তাকিয়ে থাকলো জাওয়াদের গমনপথে। কেউ একজন এসে এভাবে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিলো, তারপর আবার এমন ড্যাম কেয়ার ভাব দেখিয়ে চলেও গেল। ব্যাপারটা হজম হলোনা তার। নিজে নিজেই বললো, ‘এ কে রে! কত বড় খবিশ ছেলে!’ খানিকক্ষণ ফোঁস ফোঁস করলো তিথি। তারপর আবার বললো, ‘একবার স্যরিও বললোনা। এভাবে সবকিছু… দাঁড়া ব্যাটা!’ তারপর ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড়গুলোর ওপর একবার চোখ বুলালো তিথি। ‘মামণি…’ বলে চেচাতে চেচাতে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
__________________________________________________

আদিয়া কফি নিয়ে এসে দেখলো জাওয়াদ রুমে নেই। সে কফির কাপটা টেবিলের ওপর রেখে পেছন ঘুরলো বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। তখনই বারান্দা থেকে জাওয়াদের গলা কানে এলো, ‘কে?’

‘আমি, বড় ভাইয়া। তোমার কফি এনেছি।’ বলে বারান্দায় যেতে নিলেই দেখলো জাওয়াদ চলে এসেছে ভেতরে। আদিয়ার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ‘কী খবর তোর পড়ালেখার? কেমন আগালি?’

‘ভালোই। তোমার কফিটা।’ বলে টেবিল থেকে কফির কাপটা নিয়ে জাওয়াদের হাতে তুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো আদিয়া। বিছানায় বসে জাওয়াদ আনমনে চুমুক দিচ্ছিলো কফিতে। আদিয়া রুমের এদিক ওদিক চোখ বুলাচ্ছিলো। হঠাৎ দেয়ালে টানানো ছবি দুটোয় চোখ আঁটকে গেল। চাপা দির্ঘশ্বাস ফেললো আদিয়া। সময় কত নিষ্ঠুর! কী নিষ্ঠুরভাবে বদলে দিলো সবকিছু! কফি শেষ করে আদিয়ার দিকে কাপটা বাড়িয়ে দিলো জাওয়াদ। আদিয়ার সেদিকে খেয়াল নেই। সে তাকিয়ে আছে ছবি দুটোর দিকে। আদিয়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে জাওয়াদও তাকালো ওদিকে। তারপর আবার আদিয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ দিয়ে শিস দিলো। নড়েচড়ে দাঁড়ালো আদিয়া। জাওয়াদ জিজ্ঞেস করলো, ‘কী এতো চিন্তা করিস?’

‘ন-না ম-মানে, ভাবছিলাম… ভাবছিলাম এটা খাও কীভাবে!’ কাপটা হাতে নিতে নিতে আমতাআমতা করে বললো আদিয়া।

‘কোনটা?’ হেসে বললো জাওয়াদ।

‘এইযে এটা। চিনি ছাড়া, একদম তেতো!’ মুখ বিকৃত করে বললো আদিয়া।

‘খেয়ে দেখ একদিন। তুইও পারবি।’ বলে হাসলো জাওয়াদ।

‘আল্লাহ মাফ করুন। ছয় মাসের জন্য আমার জিহবা খাবারের মজা ভুলে যাবে। এতো তেতো বাবারে বাবা! অ্যাট লিস্ট চিনি দিয়ে তো খাওয়া যায়!’ বলতে বলতে বেরিয়ে গেলো আদিয়া। হাসতে লাগলো জাওয়াদ। তারপর পেছন ঘুরে তাকালো দেয়ালে টানানো ছবিগুলোর দিকে। হেটে ওগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর একটা ছবির ওপর পরম আদরে হাত বুলিয়ে হেসে হেসে বলতে লাগলো, ‘দেখলি? এমন কফি খাওয়ানো শিখিয়ে গেলি যে লোকে আমাকে কথা শোনাচ্ছে। ভালো কিছু শেখাতে পারলিনা?’

হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকলো জাওয়াদ ছবিগুলোর সামনে। ইশ, বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথাটা আবার হচ্ছে। চট করে ঘুরে দাঁড়ায় সে। তারপর টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে চলে যায় বারান্দায়। কষ্টগুলোকে ধোঁয়ায় রূপ দিতে!
________________________

চলবে….

রঙ তুলির প্রেয়সী
পর্ব ৩

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বসে আছে নিজের রুমে তিথি। একটু আগে আদিয়া ডেকে গেছে, ব্রেকফাস্ট করার জন্য। ঘড়িতে সকাল আটটা বাজে। এমনিতে ফজরের নামায পড়ে আরেক দফা ঘুমিয়ে দশটার আগে ওঠেনা সে। কিন্তু এখানে তো পরের বাড়ি, এতো বেলা করে ঘুমানো টা ভালো দেখায় না। হাই দিতে দিতে বেরিয়ে গেল সে রুম থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় হঠাৎ ডাইনিং টেবিলে একজনকে দেখে থমকে গেল সে। খুব চেনা চেনা লাগছে… ভ্রু কুঁচকে ভালোভাবে তাকালো তিথি। আরে হ্যাঁ, এটাতো কালকের সেই মোগ্যাম্বোটা যে ওর রুমে ঢুকে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিলো। যদিও কালকে মুখ দেখেনি, কিন্তু এই লাল রঙের টি-শার্ট টাই পরা ছিল। এহ, খাচ্ছে দেখোনা! এত আস্তে আস্তে কেউ খায়? একটু খেয়ে আবার ছয় ঘণ্টা পরে আরেকটু খাচ্ছে! উফ, স্টাইল দেখে বাঁচা যায়না! এতো প্রানবন্ত রিয়াদ ভাইয়া আর আদিয়া। এদের ভাই কী করে এতো মোগ্যাম্বো হলো ভেবে পায়না তিথি। মনেমনে ভেংচি দিলো সে। গতকাল রাতে নালিশ নিয়ে গিয়েছিলো সে মুনতাহার কাছে। সব শুনে মুনতাহা বলেছিলেন, ‘আসলে ঐ ঘরটায় ওর কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রাখা ছিল রে মা। মনেহয় বেশিই গুরুত্বপূর্ণ কিছু যা রুমে খুঁজে না পেয়ে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো। তাই এমন… তুই মন খারাপ করিসনা। আমি টুনিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, সে সব গুছিয়ে দিবে।’ তিথি মুনতাহাকে আর কিছু বলেনি। কিন্তু মনেমনে ঠিকই ঐ মগেম্বোটার গুষ্টি উদ্ধার করছিলো। মানে, এভাবে করতে হবে? অদ্ভুত! তাও কী ভাব বাবারে! পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলোও না এখানে কোনো মানুষ আছে কি না! মনেমনে আবার ভেংচি দিলো তিথি। তারপর সেখানে দাঁড়িয়েই মাথা এদিক সেদিক নাড়িয়ে জাওয়াদের মুখটা দেখার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু ও শুধু মুখের বাম সাইড দেখতে পাচ্ছে।

‘এই তিথি, দাঁড়িয়ে আছিস কী রে? আয় আয় নাস্তা করবি আয়।’ সিঁড়িতে তিথিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকলেন মুনতাহা। আদিয়া আর রিয়াদও মুনতাহার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো তিথির দিকে। দুজনেই হাসলো।

‘হ-হ্যাঁ…’ বলে নিচে নেমে যেতে লাগলো তিথি। অদ্ভুত তো! মামণি ডাকার সাথেসাথে বাকিরা আমার দিকে ফিরে তাকালো। কিন্তু এ ব্যাটা খাবারের দিক থেকে মাথাই তুললোনা! জন্ম জন্মান্তরের ভুক্কা নাকি রে? এসব ভাবতে ভাবতে নিচে টেবিলে গিয়ে বসলো তিথি।

‘গুড মর্নিং তিথি। কী অবস্থা? ঘুম কেমন হলো?’ রিয়াদ জিজ্ঞেস করলো হেসে।

‘ভালোই।’ হাসলো তিথি।

‘এই তিথি, আজ একটু বেরোবো আমরা। ঠিক আছে? এগারোটার দিকে রেডি থাকবি।’ খেতে খেতে বললো আদিয়া।

‘কোথায়?’ জিজ্ঞেস করলো তিথি।

‘আর বলোনা, মেকাপ টেকাপ কিনবে আরকি। ওর আর কী? আর তোমার জন্য বই কিনবো। সেজন্যেই মূলত যাওয়া।’ বললো রিয়াদ।

‘ও!’ মনটাই খারাপ হয়ে গেল। খালি পড়া পড়া আর পড়া। পৃথিবীতে এটা ছাড়া আর কিছু নাই?

‘কিছু কাপড়চোপড় ও কিনিস মেয়েটার জন্য। এখানে এসেছে, এখনও কিছু দিতে পারিনি ওকে।’ বললেন মুনতাহা।

‘আরে আমার আছেতো মামণি…’ বলে তাকালো তিথি মুনতাহার দিকে। মুনতাহা একবার চোখ বড় করে তাকালেন ওর দিকে, চুপ হয়ে গেল তিথি। মুনতাহা আবার বললেন, ‘খাসনা কেন? এতোক্ষণ থেকে হাত গুটিয়ে বসে আছিস কেন?’

‘খাচ্ছি তো।’ বলে খেতে লাগলো তিথি।

কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর রিয়াদ বললো, ‘এই তিথি, আমাদের বড় সাহেবের সাথে পরিচিত হয়েছো? তুমিতো আগে দেখোনি ওকে। তুমি যখন এসেছিলে সে দেশে ছিলোনা। এইযে, আমাদের বড় সাহেব। জাওয়াদ!’ হাত তুলে জাওয়াদের দিকে ইশারা করলো রিয়াদ। এতোক্ষণে চোখ তুলে তাকালো জাওয়াদ। তারপর তিথির দিকে তাকিয়ে হেসে ভ্রু উঁচিয়ে বললো, ‘ভালো আছো?’

উইসসালা! এ তো হাসতেও জানে! এমন ভাব যেন মনে হচ্ছে এই প্রথম তিথির সামনাসামনি হলো। অবশ্য সামনাসামনি এই প্রথমই, কাল তো পিছ দিয়ে ছিল।

‘ভালো, ভাইয়া৷ আপনি?’ বলে পরখ করতে লাগলো তিথি জাওয়াদকে। ফর্সা, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, চুলগুলো খাড়া খাড়া। রিয়াদ এর চেহারার সাথে অদ্ভুত মিল আছে। রিয়াদ শুধু একটু শুকনো, আর ওর রিয়াদ এর থেকে একটু হালকা মাংস বেশি, এই যা।

‘হুম।’ বলে আবার খাবারে মনোযোগ দিলো জাওয়াদ। মুনতাহা বললেন, ‘তোর তো দেখা হয়েছে তিথির সাথে।’

‘কখন?’ ভারি অবাক হলো জাওয়াদ।

‘কখন মানে? কাল তো ওর ঘরে গিয়ে সব এলোমেলো করে দিয়ে আসলি।’

হঠাৎ জাওয়াদের মনে পড়ে গেল গত রাতের কথা। তারপর হেসে বললো, ‘ওহ, খেয়াল নেই। বাট ওকে আমি দেখিনি।’ বলে পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে সেটা নামিয়ে টেবিলের ওপর ধরে রাখলো।

ব্যস? খেয়াল নেই? বললেই হলো? আরে ব্যাটা স্যরি তো বলবি নাকি? তোর জন্য আমার ঘুমের দুই ঘণ্টা লেইট হইছে। দেখো দেখো, ভাব দেখো, তাকাচ্ছেই না! এসব ভাবতে ভাবতে হাতের চামচটা প্লেটের ওপর নাড়াচ্ছিলো তিথি। হঠাৎ অসাবধানতায় সিদ্ধ ডিমের ওপর চামচটা এমনভাবে লাগলো যে সেটা উড়ে গিয়ে জাওয়াদের হাতের ওপর পড়লো, সে হাতে সে গ্লাসটা ধরে ছিল। আদিয়া, রিয়াদ ও মুনতাহা খাওয়া থামিয়ে ভয়ার্ত চোখে জাওয়াদকে দেখলেন। কেঁপে ওঠে হাত সরিয়ে বিরক্তি নিয়ে তাকায় জাওয়াদ। জাওয়াদকে তার দিকে তাকাতে দেখে তিথি ফোঁস করে বলে উঠলো, ‘এভাবে তাকানোর কী আছে? মুরগীর ডিমই তো পড়েছে। বিষ্ঠা তো আর পড়েনি!’

‘হোয়াট!’ বলে অবাক চোখে তাকালো জাওয়াদ। তার মুখে খেলা করছে অস্বস্তি, অপমান। সবাই নীরব। আদিয়া করুণ চোখে তাকালো মুনতাহার দিকে। মুনতাহার দৃষ্টি খাবারের প্লেটে নিবদ্ধ। তিথি আবার বললো, ‘বাংলা বোঝেন না?’

জাওয়াদ যেনো আরো অবাক হলো। এভাবে মুখেমুখে ওর সাথে কেউ কথা বলেনি একজন ছাড়া। এই মেয়ে কে? রাগ হতে লাগলো জাওয়াদের। সে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো রিয়াদের দিকে। সাথেসাথে হো হো করে হেসে উঠলো রিয়াদ। আদিয়া ও হেসে দিলো। মুনতাহাও নিজেকে আঁটকাতে পারলেন না, হেসে দিলেন। রান্নাঘরের দরজায় টুনি দাঁড়িয়ে ছিলো। ফিক করে হেসে দিলো সেও। সাথেসাথে জাওয়াদ ঘুরে তাকালো সেদিকে। হাসি আঁটকে প্রাণ হাতে নিয়ে রান্নাঘরের ভেতরে চলে গেল টুনি। অবাক চোখে জাওয়াদ তাকালো মুনতাহার দিকে। মুনতাহা প্লেট হাতে উঠে গেলেন সেখান থেকে। জাওয়াদ চোখ কটমট করে তাকালো আদিয়ার দিকে, আদিয়া হাসি বন্ধ করে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর তিথির দিকে তাকালো জাওয়াদ, তিথি তাকিয়ে আছে তার চোখের দিকে। কী নির্লজ্জ মেয়ে! ভাবতেই রাগ যেনো বাড়তে লাগলো জাওয়াদের। রিয়াদ তখনও হেসেই চলেছে। ভীষণ বিরক্ত নিয়ে রিয়াদের দিকে তাকায় জাওয়াদ।

‘স্যরি ব্রো, স্যরি স্যরি।’ বলে হাসি আঁটনোর চেষ্টা করলো রিয়াদ। রাগ এবার তুঙ্গে জাওয়াদের। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে হনহন করে চলে গেল।

‘হেই জাওয়াদ, হেই দাঁড়া, আরে স্যরি…’ বলতে বলতে পেছন পেছন গেল রিয়াদ। ভেংচি দিয়ে খেতে লাগলো তিথি। আদিয়া এবার নিজের হাসি উগড়ে দিলো। হাসতে হাসতে বললো, ‘তুই কী রে? এতো সাহস পাস কই?’

‘এখানে এতো সাহসের কী?’

‘আমি বলেছিলাম, আমরা বড় ভাইয়াকে রাগাই না।’

‘তো? রাগালে কী হয়?’

‘বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চায়।’

‘তারপর? যায়না?’

‘না। ছোট ভাইয়া আঁটকায় সবসময়।’

‘এ আবার কেমন রাগ? আরে এসব হচ্ছে ভং বুঝলি? যাবে টাবে না। যাওয়ার হলে এমনিই যেতো। রিয়াদ ভাইয়া আঁটকাতে পারতোনা।’

‘উহু, ওরা ভাই কম, ফ্রেন্ডস বেশি।’

তিথির হঠাৎ মনে হলো এমন ভাব করে বললো, ‘হ্যারে, রিয়াদ ভাইয়া নাম ধরে ডাকে কেন? উনার বড় না?’

‘তোকে কে বললো বড়?’ হাসলো আদিয়া।

‘তুই-ই তো ছোট বড় বলে ডাকিস।’

‘ওরা টুইন। ছয় সেকেন্ডের ব্যবধান দুজনের জন্মে। আমার তো ডাকতেই হয় এভাবে।’

‘ওহ! এজন্যেই চেহারায় দুজনের মিল!’ বলে একবার দোতলার দিকে চোখ বুলালো তিথি। ছেলেটা যেনো কেমন!
____________________________________________________

একটু পর বেরোবে রিয়াদ আর আদিয়ার সাথে তিথি। তাই শাওয়ার করে নিবে চিন্তা করলো। কিন্তু তোয়ালে টা খুঁজে পাচ্ছেনা কেন? কোথায় রাখলো? এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ মনে পড়লো, বারান্দায় মেলে দিয়েছিলো সকালে। নিজের কপালে নিজেই একটা চাপড় মেরে সেদিকে পা বাড়ালো সে। দরজার কাছে যেতেই পাশের বারান্দায় চোখ পড়তেই থমকে গেল তিথি। নিজেকে যথাসম্ভব দরজার আড়ালে রেখে দেখতে লাগলো সে। পাশের বারান্দায় মাত্র শাওয়ার করে এসে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে নিজের মাথা মুছছিলো জাওয়াদ। খালি গা, শুধু ট্রাউজার পরে আছে। শরীরে বিন্দু বিন্দু জল দেখা যাচ্ছিলো। বুকের ওপর লম্বা লোমগুলো লেপ্টে ছিলো। সুঠাম দেহের অধিকারী জাওয়াদকে দেখে চোখ কপালে উঠে গেল তিথির। সে ঢোঁক গিলে বিড়বিড় করে বললো, ‘মোগ্যাম্বো তোহ হট আছে মামা!’

জাওয়াদ তোয়ালে মেলে দিয়ে চলে গেল সেখান থেকে রুমে। তিথি সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। ভুলেই গেল, সে যে নিজের তোয়ালে নিতে এসেছিলো।
___________________________________

চলবে……
ফারজানা আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here