রঙ তুলির প্রেয়সী,০৪,০৫

0
1265

রঙ তুলির প্রেয়সী,০৪,০৫
ফারজানা আহমেদ
৪.

‘শপিং টপিং তো শেষ। এবার?’ ড্রাইভ করতে করতে লুকিং গ্লাসে চোখ রেখে বললো রিয়াদ। পেছনে আদিয়া ও তিথি গল্পে মশগুল। রিয়াদের কথাটা ওদের কানেই গেলনা। হাসলো রিয়াদ। তারপর গাড়ি সাইড করে থামালো। গাড়ি থামাতেই হুঁশ হলো আদিয়া ও তিথির। আদিয়া জিজ্ঞেস করলো, ‘গাড়ি থামালে কেন?’

‘আমি কী জিজ্ঞেস করেছি শুনেছিস?’

‘ওহ না। কী?’

‘ফিরে যাবো?’

‘তো আর তো কিছু করার নাই।’ বলে হাই তুললো আদিয়া। সাথেসাথে তিথি লাফ দিয়ে বললো, ‘একদম না। ফুচকা খাবো ফুচকা। রিয়াদ ভাইয়া ফুচকা খাবো।’

আদিয়াও উৎসাহ দেখিয়ে বললো, ‘জোশ হবে। অনেকদিন খাইনা। ছোট ভাইয়া চলো। “হোয়াট দ্য ফুচকা” তে যাই।’

তিথি আদিয়ার দিকে তাকিয়ে ঝামটি মেরে বললো, ‘হোয়াট দ্য ফুচকা মানে? ফুচকা চিনিস না? এলিয়েন নাকি রে? মেয়েদের ইজ্জত মেরে দিলি।’

হো হো করে হেসে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো রিয়াদ। আদিয়া হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো তিথির দিকে। তিথি আবার বললো, ‘এভাবে তাকাচ্ছিস কেন?’

‘আমি এই “হোয়াট দ্য ফুচকা’ ছাড়াও যে আরো দু’তিন লাইন কথা বলেছি সেগুলো কি তোর কানে গেছে নাকি খালি এটাই শুনেছিস?’

তিথি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো তখনই রিয়াদ লুকিং গ্লাসে তিথির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হোয়াট দ্য ফুচকা হচ্ছে এখানকার একটা রেস্টুরেন্টের নাম, তিথি।’

‘অ্যাঁ?’ ভারি অবাক হলো তিথি। সে তাকালো আদিয়ার দিকে। তারপর মিনমিনে গলায় বললো, ‘স্যরি।’ আদিয়া ভেংচি কেটে বললো, ‘মন দিয়ে পুরো কথা না শুনে লাফালাফি করিস না।’

তিথি খুব সুন্দর করে বললো, ‘আচ্ছা।’
____________________________

‘আমি সুমেলিকে নিজের বোনের চোখে দেখি। ওর প্রতি আমি খুবই কৃতজ্ঞ। একমাত্র ওর কারণেই আমি তোমাকে নিজের করে পেয়েছি। আজ ওর মেয়ে আমার এখানে এসেছে, ওর মেয়ের জন্য কিছু করতে পারলে আমি সত্যিই অনেক শান্তি পাবো। আদিয়া আর তিথির মধ্যে কোনো ফারাক রাখবোনা।’ বললেন হেলাল খান।

মুনতাহা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন। তারপর বললেন, ‘মেয়েটা খুবই মিষ্টি। ওকে সারাজীবনের জন্য যদি নিজের ঘরে রেখে দেয়া যেতো!’

‘সেই সুযোগ আর কই? রিয়াদের তো সব ঠিকঠাক। আর জাওয়াদ…’

‘আচ্ছা ওসব বাদ দাও। তুমি আসবে কবে? শেষ হয়না কেন তোমার কাম কাজ এতোদিন থেকে?’ প্রসংগ পাল্টাতে কথা বদলালেন মুনতাহা। স্বামীকে এই মুহূর্তে মন খারাপ করতে দিতে চান না উনি।

‘এলামই তো মাত্র দু’দিন হলো। মাসখানেক তো লাগবেই।’

‘ও…’

মুনতাহা ভিডিও কলে কথা বলছিলেন স্বামী হেলাল আহমেদের সাথে। কথা বলার এক পর্যায়ে হেলাল আহমেদ বললেন, ‘রাতে ঘুমাও না? চোখের নিচে কালো কেন?’

‘ওমা! সবসময় টাইম টু টাইম বেড এ আসি।’

‘তাহলে চোখের নিচ কালো কেন? আর ব্রণও দেখছি।’

‘কীসব আজেবাজে বকছো? ব্রণ আসবে কোত্থেকে? এসব বয়সের ছাপ। বুড়ো হয়েছি, নাতি-নাতনী পাবার বয়স হয়েছে। চোখের নিচে কালী থাকবে নাতো কি সোনা থাকবে?’

‘কে বললো তুমি বুড়ো? এখনও সুচিত্রা সেনকে হার মানানোর মতো রূপ তোমার। আর আমাকে পাগল বানানোর মতোও।’

কথাটা শুনে ভারি লজ্জা পেলেন মুনতাহা। পেছন থেকে খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পেলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন টুনি দাঁড়িয়ে আছে। মুনতাহা তাকাতেই টুনি বললো, ‘মাগো মা! খালুজান এখনও কত্তো রুমান্টি গো!’

‘কী বললি? রুমান্টি কী?’ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন মুনতাহা। টুনি বিজ্ঞের মতো হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললো, ‘আরে ঐযে, রুমান্টি গো… ফিলিমে নায়ক নাইকারা রুমান্টি থাকে যে ঐডা।’

মুনতাহা বুঝলেন টুনি রোম্যান্টিক কে রুমান্টি বলছে। প্রচণ্ড হাসি পেলো তার। তিনি হাসি চেপে মুখে কঠোর ভাব এনে বললেন, ‘দেবো একটা কানের নিচে। যা রান্নাঘরে যা আমি আসছি।’ টুনি ধমক খেয়ে মুখ ভার করে চলে গেল। এতোক্ষণ এসব কথা শুনে নিঃশব্দে হাসছিলেন হেলাল আহমেদ। তিনি বললেন, ‘এজন্যেই বলি, ইয়ারফোন দিয়ে কথা বলো ভিডিও কল এর সময়। নাহলে আবার আমাদের এই বুড়ো বয়সে “রুমান্টি” কথাবার্তা বাচ্চারা শুনলে লজ্জার ব্যাপার না?’ বলেই হো হো করে হাসলেন হেলাল। মুনতাহা মুখে কঠোর ভাবটা বজায় রাখতে চেয়েও পারলেন না। হেসে দিলেন।
________________________________

রেস্টুরেন্টে কর্ণারের দিকে একটা টেবিলে বসলো ওরা তিনজন। রিয়াদ দু’প্লেট ফুচকার অর্ডার করলো। তিথি জিজ্ঞেস করলো, ‘সেকি দু’প্লেট কেন ভাইয়া? তুমি খাবেনা?’

‘ভালো জিনিস ওরা খায়না।’ রিয়াদ কিছু বলার আগেই আদিয়া বললো কথাটা। তিথি হাসলো ফিক করে। রিয়াদ বললো, ‘হ্যাঁ খুব ভালো জিনিস। এই ভালো জিনিসটা খেয়ে যদি পরে বুকে ব্যথা পেটে ব্যথা বলে চিল্লাইছিস তাহলে বুঝবি।’

ভেংচি দিলো আদিয়া। ওয়েটার দু’প্লেট ফুচকা নিয়ে এলো। খাওয়া শুরু করলো তিথি আর আদিয়া। রিয়াদ পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফেইসবুকে স্ক্রল করছিলো। হঠাৎ আদিয়া চাপা স্বরে উচ্ছাস করে উঠলো, ‘ছোট ভাইয়া!’

রিয়াদ মাথা তুলে তাকিয়ে বললো, ‘কী?’

আদিয়া রিয়াদের পেছনে তাকিয়ে হাসছে। তিথি আদিয়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে রিয়াদের পেছনে তাকালো। দেখলো রিয়াদের পেছনের টেবিলটায় তিনটা মেয়ে আর দুটো ছেলে বসে আছে। সেদিকে তাকিয়ে এতো উচ্ছাস করার কী আছে এটা মাথায় ঢুকলোনা তিথির। সে আদিয়ার দিকে তাকালো। আদিয়া তখনও তাকিয়ে আছে রিয়াদের পেছনে। রিয়াদ আদিয়াকে তার পেছনে ওভাবে তাকিয়ে হাসতে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতে যাবে তখনই আদিয়া বলে উঠলো, ‘আরে তাকাইওনা ওদিকে, মারা খাবা।’ বলে সে যথাসম্ভব নিজেকে ওদের থেকে আড়াল করতে চাইলো। তিথি কিছুই বুঝতে পারছেনা, শুধু তাকিয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে। রিয়াদ আদিয়ার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আদিয়া মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে বললো, ‘স্বপ্না।’

‘লা-হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আ’লিউল আযিম!’ বলে মাথায় হাত দিয়ে দিলো রিয়াদ। তিথি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হলো? তোমরা এমন করছো কেন?’

আদিয়া হেসে আস্তে আস্তে বললো, ‘ঐযে সবুজ ড্রেস পরা সুন্দরি মেয়েটা দেখছিস? ঐটা ছোট ভাইয়ার এক্স।’

‘ওমা তাই নাকি?’ চোখ বড় বড় করে বললো তিথি। তারপর আবার বললো, ‘এক্স যখন তাহলে এতো লুকানোর কী আছে?’

‘আরে ব্যাক আসতে চায়। আমাকেও জ্বালিয়ে খাচ্ছে খালি “তোমার ভাইয়ের সাথে কথা বলিয়ে দাও” এটা বলে বলে। আজকেই গিয়ে ব্লক করবো ওকে।’

‘আহারে। মেয়েটা মনে হয় ট্রু লাভ করে।’ আক্ষেপের স্বরে বললো তিথি। তিথির এক্সপ্রেশন দেখে হেসে দিলো আদিয়া ও রিয়াদ। রিয়াদ বললো, ‘আর ট্রু! ওটা কী ছিলো আমি নিজেও জানিনা। বাই দ্য ওয়ে, বেরোবো কীভাবে? আমি মোটেও ওর সামনে পড়তে চাইনা।’

এমন সময় আদিয়া আর তিথি দেখলো স্বপ্না মেয়েটা কানে ফোন চেপে বাইরে বেরিয়ে গেল। ওর সাথের সবাই জায়গায়ই আছে। আদিয়া বললো, ‘ছোট ভাইয়া ও বেরিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ফোন এসেছে। চলো বেরোই আসার আগেই।’

রিয়াদ নিজের ওয়ালেট টা তিথির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘তুমি বিল দিয়ে আসো, আমরা গাড়িতে আছি।’ বলেই বেরিয়ে গেল ওরা। তিথি শুধু বিষ্ময়কর চাহনি নিয়ে ওদের বেরিয়ে যাওয়া দেখলো।
______________________________

গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলোতে চোখ বুলিয়ে সেগুলো ম্যানেজারের হাতে তুলে দিয়ে বললো জাওয়াদ, ‘ঠিক আছে সব। কাজ শুরু করে দিন যতো দ্রুত সম্ভব। আমি বাবাকে বলবো সব। চিন্তা করবেন না।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ বলে বেরিয়ে গেলেন ম্যানেজার। কফির কাপে চুমুক দিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রাখলো জাওয়াদ। টেবিলের ওপর রাখা জাওয়াদের ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। কে কল করেছে নাম না দেখেই রিসিভ করে ফোনটা কানে চেপে ধরলো জাওয়াদ। ওপাশ থেকে একটা নারীকণ্ঠ ভেসে এলো,

‘হৃদয়ে জমছে মেঘ, নয়নে বর্ষণ…
অপরিষ্ফুটিত মোর আঁখি,
খোঁজে তোমারই দর্শন।’

মুহূর্তেই মেজাজ খিঁচে গেল জাওয়াদের। ইচ্ছা করলো কড়া কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে। রাগে দপদপ করে লাফাচ্ছে কপালের রগ। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সহ্য করে চুপ করে রইলো জাওয়াদ। ওপাশ থেকে নারীকণ্ঠ আবার বললো, ‘কথা বলবি না?’

‘নির্লজ্জতার একটা লিমিট আছে।’ কথাটা বলেই খট করে কেটে দিলো কলটা জাওয়াদ। টেবিলের ওপর থেকে একটা কাগজ নিয়ে সেটাকে দুমড়ে মুচড়ে মুষ্টিবদ্ধ করে রাখলো। তারপর ছুঁড়ে ফেললো। বার কয়েক জোরে জোরে নিশ্বাস নিলো। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে বেরিয়ে গেল।
__________________________________

বাড়ি ফিরে লাঞ্চ সেরে ঘুমিয়ে পড়েছিলো তিথি। ঘুম ভাঙলো বিকেল পাঁচটায়। কিছুক্ষণ ওভাবেই শুয়ে থাকলো সে। তারপর উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস দিচ্ছে। অদূরে ছোট ছোট টিলা দেখা যাচ্ছে। টিলার ওপাশে সূর্যটা আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে। হাই তুললো তিথি। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পাশের বারান্দায়। দেখলো বারান্দায় রিয়াদ আর জাওয়াদ বসে আছে দুটো চেয়ারে। মাঝখানে একটা টেবিল। মনে হচ্ছে কিছু একটা খেলছে। তিথি গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমরা কী করছো?’

রিয়াদ ঘুরে তাকালো। তারপর হেসে বললো, ‘ঘুম শেষ? কেমন লাগছে এখন?’

‘ভালো লাগছে। ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছে।’ বলে জাওয়াদের দিকে তাকালো তিথি। অদ্ভুত! একবারও মাথা তুলে তাকাচ্ছেনা ছেলেটা। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে টেবিলের ওপর।

‘দাবা খেলছি। পারো? খেললে আসো।’ বলে নিজের চালটা দিলো রিয়াদ। সাথেসাথে জাওয়াদ নিজের চাল দিয়ে বলে উঠলো, ‘চেক, এন্ড মেট!’ বলেই হেসে পাশের বারান্দায় তিথির দিকে এক ঝলক তাকালো সে। তারপর আবার রিয়াদের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

রিয়াদ এক হাতের তালুতে আরেক হাতে কিল বসিয়ে বললো, ‘শিট!’ তারপর তিথির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘জীবনেও পারিনা ওকে হারাতে।’

তিথি খুব অহংকার নিয়েই বললো, ‘আরে আমার পক্ষে এসব বাম হাতের খেল! বুড়িমা তো তার কলেজে দাবার চ্যাম্পিয়ন ছিলো। আর আমি উনাকেই হারাতাম। ইনি আর এমন কী!’

জাওয়াদ হেসে দিলো কথাটা শুনে। রিয়াদের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললো, ‘সো সিলি!’

‘বাচ্চা তো।’ আস্তে করে বললো রিয়াদ। তারপর তিথির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বাব্বাহ! তাই নাকি? তাহলে আসো। এক ম্যাচ হোক!’

দাবার বোর্ডে গুটি সাজাতে সাজাতে জাওয়াদ জোর গলায় বললো, ‘বুঝলি রিয়াদ? বাচ্চাদের মন ভোলাতে মাঝেমাঝে ইচ্ছা করেই হার মেনে নিতে হয়। সেটাকে এতো লাইটলি দেখার কিছু নেই।’ তারপর মুখে একটা দুষ্টু হাসি নিয়ে এদিক ওদিক চোখ বুলাতে লাগলো। ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো রিয়াদ।

জাওয়াদের কথায় তিথির চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। এটা কী বললো? ওকে মিন করেছে নাকি?

‘এ-এই এই কী বললেন? কী?’ কোমরে দু’হাত রেখে বললো তিথি।

প্রত্যুত্তরে জাওয়াদ রিয়াদের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললো, ‘কে যেন আমাকে হারাবে?’

‘ধুর!’ বলে হেসে দিলো রিয়াদ। হাসতে লাগলো জাওয়াদ ও। হাসি দেখে গা জ্বলে যাচ্ছিলো তিথির। একে তো এভাবে ড্যাম কেয়ার ভাব দেখাচ্ছে। সরাসরি তিথিকে না বলে রিয়াদকে বলছে। দেখে মেজাজ খিঁচে যাচ্ছে। কেন তিথির সাথে কথা বলা যায়না? এহ, না বলুক। না বললে মরে যাবে না তিথি। হেসে কী প্রমাণ করতে চাইছে? তিথি দাবা খেলা পারেনা? আরে ব্যাটা দেখ কীভাবে গো হারান হারাই। ভাবতে ভাবতে তিথি জোরে জোরে বললো, ‘এতো হাসার কিছু নেই। ঢাকায় আমাকে লুডুতেও কেউ হারাতে পারতোনা। এক্ষুণি আসছি।’

‘লুডু!’ বলে হাসলো জাওয়াদ।
___________________

চলবে…….
ফারজানা আহমেদ

রঙ তুলির প্রেয়সী
৫.

রুম থেকে বেরিয়েই আদিয়ার মুখোমুখি হলো তিথি। আদিয়া বললো, ‘কীরে? ঘুম হইছে? আস্তে আস্তে তৈরি হ, আজকে থেকে তো পড়তে বসবি আমার সাথে।’

‘আরে রাখ তোর পড়া। আমি এখন অনেক বড় মিশনে যাচ্ছি।’

‘মিশন? কিসের?’

‘তোদের মোগ্যাম্বো আমারে চ্যালেঞ্জ করছে। আমি নাকি ওকে দাবাতে হারাতে পারবোনা।’ দু’হাতে কোমর ধরে বললো তিথি।

আদিয়া হাঁটা থামিয়ে প্রথমে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলো, ‘মোগ্যাম্বো?’

‘আরে তোদের বড়টা রে। হাঁটা থামালি কেন চল। পরে বলবে ভয় পেয়ে যাচ্ছিনা।’

হো হো করে হেসে উঠলো আদিয়া। হেসে হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা কেমন নাম দিলি?’

‘তোর ভাইরে দেখার পরে এরথেকে ভালো নাম আমার ডিকশনারিতে পাই নি।’

‘শুধুশুধু চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্ট করেছিস। হারবিই তুই।’ বলে হাঁটা শুরু করে আদিয়া। তিথি একটা মুখ ভেংচি দিয়ে বললো, ‘দেখা যাবে।’

জাওয়াদের রুমে ঢুকেই কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেল তিথি। আদিয়াও গেল পেছন পেছন। তিথিকে দেখেই রিয়াদ বললো, ‘এতোক্ষণে এলে?’

জাওয়াদ বললো, ‘আমিতো ভাবলাম দাবার ট্রেনিং নিতে গেলে নাকি আমাকে হারাবে বলে।’ কথাটা একদম তিথির চোখের দিকে তাকিয়ে বললো জাওয়াদ। এই প্রথম জাওয়াদ তিথির চোখে চোখ রেখে কথা বললো। তিথির যেন কেমন একটা করে উঠলো বুকের ভেতর। সে তড়িৎ চোখ সরিয়ে বললো, ‘আসার সময় এই আদিয়া গল্প জুড়ে দিয়েছিলো তাই একটু দেরি হয়েছে।’

‘এবার খেলা শুরু হোক। আই অ্যাম সো এক্সাইটেড!’ উৎসাহ নিয়ে বললো আদিয়া। রিয়াদ বললো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। এইযে তিথি বসো এখানে তুমি। আমি আদিয়ার পাশে যাই।’ বলে আদিয়ার পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলো সে।

খেলা শুরু হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই একে একে তিথির সব সৈনিক মারতে লাগলো জাওয়াদ। তিথির চোখে হেরে যাওয়ার আতঙ্ক। জাওয়াদের ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। একসময় ঠোঁটে মুচকি হাসি নিয়ে শেষ চাল চেলে বলে উঠলো জাওয়াদ, ‘উপ্স! চেক মেট!’

‘না হবেনা। আমি মানিনা!’ উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে দু’হাত রাখলো তিথি। কপাল কুঁচকে তাকালো জাওয়াদ। আদিয়া আর রিয়াদ অবাক হলো। রিয়াদ বললো, ‘কী হলো তিথি?’

তিথি কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘উনি সবসময় কি সাদা গুটিই নেয়?’

‘হ-হ্যাঁ, কিন্তু কেন বলোতো?’

‘এইতো! আগেই বুঝেছি। যতো জিতাজিতি সব এই গুটির জন্য। আমি সাদা গুটি নিবো। আরেক ম্যাচ হবে। এবার দেখবো!’ চেয়ারে বসে বললো তিথি। অবাক চোখে তাকালো জাওয়াদ। কিছুই বুঝতে পারছেনা সে। রিয়াদের দিকে তাকালো। রিয়াদ ইশারায় কিছু একটা বললো। তারপর তিথির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে তুমি সাদা গুটিই নাও।’

আবার খেলা শুরু হলো। এবার তিথি প্রথমেই জাওয়াদের একটা সৈনিক মেরে দিলো। তারপর খুশিতে বাক-বাকুম হয়ে রিয়াদ আর আদিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ইয়েস!’ হাসলো ওরা দুজনে। জাওয়াদ শুধু একটা অদ্ভুত চাহনি দিলো, কিছু বললোনা। আদিয়া হাসছে, খুব হাসছে। তবে সেটা অন্য কারণে। তার মাথায় ঘুরছে অনেক চিন্তা। সে তাকিয়ে আছে তিথির দিকে।

একইভাবে আগের মতোই হারিয়ে দিলো জাওয়াদ তিথিকে। তারপর মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে বললো, ‘এটা লুডু না। এটা দাবা।’

তিথি কথাটা কানে না নিয়ে দাবার বোর্ডটা হাতে তুলে এটার চারিদিকে কপাল কুঁচকে দেখতে লাগলো কিছু একটা। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আদিয়া বললো, ‘কী করছিস এগুলো?’

তিথি বোর্ডটা নাড়তে নাড়তে বললো, ‘দেখছি, তাবিজ টাবিজ কিছু লাগানো আছে নাকি। তাবিজ তো নেই, আমি শিওর পানি পড়া ছিঁটিয়ে রেখেছে।’

‘মানে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো জাওয়াদ।

তিথি বললো, ‘মানে সবাইকে এভাবে বারবার হারাচ্ছেন। নিজে একবারও হারছেন না। ডালমে কুচতো কালা হে। নিশ্চয়ই তাবিজ টাবিজ বা পানি পড়া ছিঁটিয়েছেন বোর্ডে তাই এমন।’

বিষ্ময়ে বাকরূদ্ধ হয়ে গেল জাওয়াদ। কিছুই বলতে পারছেনা সে। মানে, সিরিয়াসলি? সামান্য দাবার জন্য সে তাবিজ করবে? পানি পড়া… চোয়াল শক্ত হয়ে এলো জাওয়াদের। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো রিয়াদ আর আদিয়ার দিকে। দেখলো ওরা দুজন মুখ চেপে হাসছে। এতো হাসি হাসছে যে ওদের শরীর কাঁপছে। জাওয়াদের রাগ বেড়ে গেল। সে একটা আগুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তিথির দিকে। তারপর সেখান থেকে উঠে চলে গেল। তিথি মুখ ভেংচি দিয়ে বিড়বিড় করলো, ‘নামটা একেবারে পারফেক্ট! মোগ্যাম্বো!’

জাওয়াদ চলে যাওয়ার পর রিয়াদ আর আদিয়া মুখ থেকে হাত সরিয়ে জোরে জোরে হাসতে লাগলো। রিয়াদ হাসতে হাসতে হাসতে বললো, ‘আমি কিন্তু তোমার ফ্যান হয়ে যাচ্ছি তিথি।’

তিথি কিছু বললোনা। হাসলো। আদিয়া বললো, ‘জানো ছোট ভাইয়া, তিথি বড় ভাইয়ার নাম কি দিয়েছে? মোগ্যাম্বো!’ বলে আরেক দফা হাসতে লাগলো আদিয়া। হাসতে লাগলো রিয়াদ আর তিথি ও। এমন সময় রিয়াদের কাছে একটা কল এলো। কথা শেষ করে আদিয়াকে রিয়াদ বললো, ‘নাহিদ আসবেনা আজ।’

আদিয়া জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন?’

‘কী একটা জরুরি কাজ।’

‘ও।’ আদিয়ার মুখটা কেমন ছোট হয়ে গেল। তিথি জিজ্ঞেস করলো, ‘নাহিদ কে?’

‘তোমাদের টিচার।’ বলে হেসে সেখান থেকে উঠে গেল রিয়াদ। আদিয়া তিথিকে বললো, ‘চল নিচে যাই।’

জাওয়াদের ঘর থেকে বেরোনোর সময় দেয়ালে একটা ছবি দেখে তিথি আদিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা কার ছবি রে?’

‘কাজিন।’ বলে মুচকি হাসলো আদিয়া।

‘এখানে টানানো কেন? মনে হচ্ছে তো রঙ তুলির আঁকা।’

‘ঠিকই ধরেছিস। চল চল তাড়াতাড়ি।’ বলে যতো দ্রুত সম্ভব সেখান থেকে বেরিয়ে গেল আদিয়া। তিথি একবার ভালোকরে দেখলো ছবিটা। তারপর সেও বেরিয়ে গেল।
__________________________

ফোঁস ফোঁস করতে করতে রান্নাঘরে এসে ফ্রিজ খুলে ঢকঢক করে ঠাণ্ডা পানি গিলতে লাগলো জাওয়াদ। কপালের রগ দপদপ করছে। রিয়াদ একপাশে দাঁড়িয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। মুনতাহা জাওয়াদকে এমন করতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’

‘তোমার ছেলে সবসময় জিতবে বলে দাবার বোর্ডে পানি পড়া ছিঁটিয়ে রেখেছে মা।’ বলে হাসতে লাগলো রিয়াদ। কটমট করে তাকালো জাওয়াদ। বললো, ‘রিডিকিউলাস!’

‘ওহ স্যরি।’ বলে হাসি আটকানোর ব্যার্থ চেষ্টা করে রিয়াদ। মুনতাহা বললেন, ‘কীসব পাগলের মতো কথা বলিস?’

‘আমি বলি নি। তিথি বলেছে। জাওয়াদ এর কাছে হেরে গিয়ে।’

মুনতাহা একবার জাওয়াদের দিকে তাকালেন। উনার হাসি পাচ্ছে খুব। তবুও হাসি চেপে জাওয়াদের পাশে গিয়ে বললেন, ‘ও ছোট। আদিয়ার বয়েসি। মা বাবা কেউ নেই। পরিবারের সবাই তাড়িয়ে দিয়েছে দূরদূর করে। মেয়েটা খুব চঞ্চল আর প্রাণবন্ত। এমন একটা ফুলের মতো মেয়ের জীবনে এতো কষ্ট। ওর মা জানে ওর কোথাও জায়গা হবেনা। তাই আমাকে চিঠি লিখে গেছে। আর ওর মা অনেক কিছু করেছে আমার জন্য, যার ঋণ শোধ করার মতো না। ওর সাথে মিলেমিশে থাকতে পারবিনা?’

‘একদম। তিথি খুবই ইন্টারেস্টিং মেয়ে। তুই একটু ইজিলি ওর সবগুলো কথা নিস। এভাবে রাগিস না। রাগিস দেখেই রাগায়। বাচ্চা তো! ওর সাথে রাগারাগি তোকে মানায়?’ বললো রিয়াদ।

জাওয়াদ একটা বড় নিঃশ্বাস নিলো। তারপর হেসে বললো, ‘আচ্ছা ওকে ঠিক আছে। আমি এখনথেকে ইজিলি নেবো।’

স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন মুনতাহা। হাসলো রিয়াদ।
______________________

হাতে একটা টাইগারের বোতল নিয়ে সেটাতে চুমুক দিতে দিতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছিলো জাওয়াদ। দেখলো তিথি দাঁড়িয়ে আছে নিজের রুমের সামনে। হাতে একটা কলম। সেটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করছে। আরকটু কাছে যেতেই শুনতে পেলো তিথি গান গাইছে, ‘মেরি পাতলি কামার মেরি…’ জাওয়াদকে দেখেই গান বন্ধ করে দিলো তিথি। সরু চোখে তাকালো ওর দিকে। জাওয়াদ এর কেন যেন হাসি পেলো। সে হেসে তিথিকে পার করে নিজের রুমের সামনে গেল। পরক্ষণেই আবার মাথায় দুষ্টুমি চাপলো জাওয়াদের। পেছন ফিরে তাকালো। দেখলো তিথি তাকিয়ে আছে তার দিকে। জাওয়াদ টাইগারের বোতলে একটা চুমুক দিলো। তারপর মাথা কাত করে তিথির পা থেকে মাথা অবধি তাকালো। তিথির কেমন অস্বস্তি লাগলো। সে একবার নিজের পরনের টপসটা টেনে ঠিক করে নিলো। জাওয়াদ একইভাবে মাথা কাত করে তিথির কোমরের দিকে তাকালো। তারপর মাথা নাড়িয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে নিজের রুমে চলে গেল। তিথি যেন একটা চারশো চল্লিশ ভোল্টের শক খেলো। মোগ্যাম্বোটা এভাবে ওর কোমরের দিকে তাকিয়ে হেসে কী বোঝাতে চাইলো? মজা করলো? এতো জঘন্য মজা? মানে কী বোঝালো তিথি মোটা? রাগ চড়ে গেল তিথির। সে চিৎকার করে বললো, ‘এইযে এই শুনুন আপনি হাসলেন কেন?’ বলতে বলতে জাওয়াদের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই জাওয়াদ তিথির মুখের ওপর ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিলো। হা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তিথি। তারপর জাওয়াদের রুমের দরজায় একটা লাথি দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেল সেখান থেকে।

বিছানায় বসে হাসতে লাগলো জাওয়াদ। হাসতে হাসতে নিজে নিজেই বললো, ‘মেয়েটা বড্ড পাগল আছে!’ তারপর একটু থামলো। তারপর আবার বললো, ‘বাচ্চা!’
_______________

চলবে……..
ফারজানা আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here