রঙ তুলির প্রেয়সী-১৯,২০
ফারজানা_আহমেদ
১৯
রাত বিরেতে পুকুরপাড়ে এসে বসে আছে টুনি। কিছুক্ষণ পরপর কিছু একটা বিড়বিড় করছে আর আপন মনেই মুখ ভেংচি দিচ্ছে। সিঁড়িতে এসে বসার আগে পুকুরপাড়ের লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে এসেছিলো টুনি। চাঁদের আলোয় পুকুরের পানিগুলো চিকচিক করছে। আর সেদিকে তাকিয়ে আছে সে এক দৃষ্টিতে, তাই এখনও টের পায়নি তার পাশেই আব্দুল সেই কখন থেকে এসে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর টুনি একটু নড়েচড়ে বসতে গিয়ে ডান পাশে তাকিয়ে ভয়ে আঁতকে উঠলো। পরক্ষণেই আবার মুখ ভেংচি দিয়ে সামনে তাকালো। আব্দুল বললো, ‘রাইত বিরাইতে এনে বইসা আছোস ক্যান?’
‘ভালা করছি। যাও এন থিকা।’, মুখ ঝামটি মেরে বললো টুনি। আব্দুল হেসে দিলো। টুনিকে ডাকলো দু’একবার নাম ধরে, কিন্তু টুনি পাত্তা দিলোনা। আব্দুল তখন হুট করেই সেই গানটা গাইতে লাগলো, যেই গান একটু আগে টুনি গেয়েছিলো খেলায়। গান শেষ হওয়ার আগেই খিলখিল করে হেসে উঠলো টুনি। হাসতে হাসতে বললো, ‘আর গাইওনা, কানের আঠারোটা বাইজা যাইবো।’
আব্দুল মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো, ‘হাসোস ক্যান ছ্যামড়ি? আমি গাড়ি চালাই। গানের ইশকুল চালাই নাকি?’
‘তাইলে আমিও তো ঘরের কাম করি। হারমুনি বাজাই নাকি যে রুনা লায়লার মতো গান গামু?’
টুনির বলার ধরনে আব্দুল হেসে দিলো। তারপরে বললো, ‘এনে আইসা বসলি যে, কেউ যদি খুঁজে তোরে তাইলে কী করবি?’
টুনি হাত নেড়ে বললো, ‘না খুঁজবোনা। আমি খালাম্মারে কইয়া আসছি যে ওজু করতে যামু। মটর নষ্ট না? পানিতো নাই হেগো উশরুমে।’
‘উশরুম কী? নয়া কিছু আছে নাকি এনে এই নামে?’, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো আব্দুল।
‘আরে! এরলিগাই কই কিছু ইংরিজি বই পড়ো। উশরুম গোসলখানারে কয় ইংরিজিতে।’, বিজ্ঞের মতো বললো টুনি।
‘মুক্কুসুক্কু মানুষ আমি। তুই ইকটু শিখাই দিলেই পারিস।’
‘আইচ্ছা এহন থিকা শিখাই দিমু।’
‘যা এলা ঘরে যা। এনে রাইতে বিরাতে বই থাহিসনা। যা।’, তাগদা দিলো আব্দুল।
‘আইচ্ছা। ইট্টু পরে খাওন রেডি হইবো। ঘরেই থাইকো।’, বলে টুনি একটা হাসি দিয়ে ওজু করে চলে গেল।
___________
তিথির মাথা কিছুক্ষণ নিজের বুকে চেপে ধরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো জাওয়াদ। তারপর দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নিয়ে বলতে লাগলো, ‘আমি, রিয়াদ, মাহি, অন্তু, নুহা… আমরা সবাই একসাথে লেখাপড়া করেছি। সমবয়সী আমরা। গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করার পরেও আমাদের বন্ধুত্ব আগের মতোই ছিলো। আড্ডা, হ্যাংআউট সব চলতো আগের মতোই। অন্তু মাহিকে পছন্দ করতো। কিন্তু আমার কারণে ভয় পেতো সে। তখন আমি আমার চারুকলার কিছু বন্ধুদের সাথে একটা উদ্দেশ্যে আউট ওব কান্ট্রি ছিলাম। একদিন হুট করে আমার ফোনে নুহার ম্যাসেজ আসে…’
এইটুকু বলে থামলো জাওয়াদ। গলাটা খানিক কেঁপে উঠলো শেষের কথাটা বলতে গিয়ে। ঢোঁক গিললো সে। তার বুক কাঁপছে মৃদুভাবে। হৃদপিণ্ডের কম্পন শুনতে পাচ্ছে তিথি। বুকটা কেমন হুহু করে উঠলো তিথির। সে আরো নিবিড়ভাবে মাথা চেপে ধরলো জাওয়াদের বুকে। আর তারপর… এতোক্ষণ যে কাজটা করতে সংকোচ বোধ করছিলো সেটা করে ফেললো। দু’হাত জাওয়াদের পেছনে নিয়ে পিঠের ওপর রাখলো। খুব সন্তর্পণে। জাওয়াদ হাসলো নিঃশব্দে। তারপর আবার বলতে লাগলো, ‘সেই ম্যাসেজে একটা ছবি ছিলো। সেই ছবিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো, অন্তু মাহিকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে। আর জায়গাটা… জায়গাটা ছিলো অন্তুর বেডরুম।’
আবারও থামলো জাওয়াদ। এবার তিথি মাথা তুলে তাকালো ওর দিকে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলো তিথি, জাওয়াদের চোখে মুক্তর মতো চিকচিক করছে জল। ইশ! কতো কষ্ট হয়েছিলো তখন জাওয়াদের? আর এখনই বা কতো কষ্ট হচ্ছে? কান্না পেয়ে গেলো তিথির। সে নিজের চোখের পানি লুকানোর জন্য আবার জাওয়াদের বুকে মাথা রাখলো। জাওয়াদ নিশ্বাস নিলো লম্বা করে। তারপর বললো, ‘হুটহাট রেগে যাই আমি। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। সেদিন কল করে মাহিকে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলেছি। স্ল্যাং ইউজ করেছি। কিন্তু মাহি আমাকে কিচ্ছু বলেনি, একটা টু শব্দও করেনি। তাতে আমার রাগ আরো বেড়ে যায়। আমি আমার মোবাইলটা ভেঙ্গে ফেলি। ব্যস, আর মাহির সাথে কথা বলাও বন্ধ করে দেই। বন্ধুর ফোন থেকে শুধু পরিবারের সাথে কথা বলতাম। কিন্তু ওদিকে বেদনায় কাতরাচ্ছিলো আমার মাহি। আমি বুঝতে পারিনি সে বেদনা। নিজের রাগ আর জেদ নিয়ে বসে ছিলাম।’
এটুকু বলে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো জাওয়াদ। বুকটা ব্যথায় চিনচিন করছে। ঢোঁক গিলে আবার বললো, ‘অথচ, আমার মাহি যে এমন করতেই পারেনা কোনোদিন সেটা একবারের জন্যও আমার মাথায় আসেনি। আমি ক্রোধে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। দেশে আসার পরে জানতে পারলাম… জোর করে ওসব করেছে অন্তু মাহির সাথে। নুহাও জড়িত ছিলো। যে করেই হোক আমাদের আলাদা করতে চেয়েছে ওরা। কারণ? নুহা আমাকে পছন্দ করতো।’
তিথি মাথা তুলে তাকালো। জাওয়াদ হাসছে! হালকা শব্দ করে হাসছে। তিথির চোখের দিকে তাকিয়ে জাওয়াদ বললো, ‘জানো? অন্তুকে বেধম পিটিয়েছিলো রিয়াদ। আমাকে বলেনি, কিন্তু আমি জানি। তারপর থেকে আমি হয়ে গেলাম মুডি জাওয়াদ। কারো সাথে মিশিনা খুব একটা। সবসময় একা একা থাকতে ভালো লাগতো। মাহি যাওয়ার পরে আর কারো প্রতি আমি মনোযোগ দিতে পারি নি।’
থমলো জাওয়াদ। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিথি জাওয়াদের দিকে। জাওয়াদ দু’হাতে তিথির মুখটা ধরে উঁচু করলো। তারপর আচমকা ঠোঁট ছোঁয়ায় তিথির কপালে। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো তিথি। দু’গালে লাল রঙের আভা ছড়িয়ে পড়লো। হৃদপিণ্ডের চারপাশে ভালোবাসার পাখিরা কিচিরমিচির করতে লাগলো। নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত। জাওয়াদ বললো প্রায় ফিসফিস করে, ‘তারপর একদিন এক এলোকেশীকে দেখলাম বৃষ্টি বিলাস করতে। তার মাঝে আমি আমার অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম। সেদিনই হুট করে অনুভব করলাম, আরো একবারের জন্য আমার হৃদয় বেসামাল হয়ে পড়েছে। হৃদয় ধুকপুক করে জানান দিচ্ছিলো, প্রাণনাশী ভালোবাসার জানান দিচ্ছিলো। তুমি আমাকে ভালোবাসার বানে মেরেই ফেলেছো তিথি… আরো একবার…’
তিথি চোখ খুললো। বুকের ভেতর ঝড় উঠেছে যেন। কান থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। এসব সত্যি? জাওয়াদ এসব কী বললো? ভালোবাসা! টুপ করে তিথির গাল বেয়ে এক ফোটা জল গড়ালো। তিথি কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু আশ্চর্য! গলায় সব কথা আটকে আছে। তিথি নিজেকে ছাড়ানোর জন্য জাওয়াদের হাত দুটো একটু ঠেলে দিতেই জাওয়াদ তিথির কপালের সাথে নিজের কপাল লাগালো। তিথির নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। ঠোঁট কামড়ে ধরেছে সে নিজের। জাওয়াদ এবার আস্তে আস্তে বললো,
‘আমার শুধু “তুমি” চাই।
”তোমার” চোখের দিকে তাকিয়ে-
বিভোর হয়ে,
”তোমাকে” নিয়ে শত শত কবিতা লিখে ফেলতে চাই।
হ্যাঁ, আমি ”তোমাকেই” চাই।’
তিথি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে চোখ বন্ধ অবস্থায়ই বললো, ‘আমি, আ-আমি এক্ষুণি অজ্ঞান হয়ে যাবো… আমার সবকিছু স্বপ্ন লাগছে!’
তিথির কোমর ধরে তিথিকে উঁচু করে নিজের মুখোমুখি করলো জাওয়াদ। তিথি চোখ খুলে তাকালো। চাঁদের আলোয় ঐ চোখে তাকিয়ে জাওয়াদ অনুভব করলো, এই চোখে তাকিয়েই সে শান্তিতে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। সে হাসলো। তারপর বললো, ‘আমার রঙ তুলির প্রেয়সী হবে তিথি? কথা দিচ্ছি, হারিয়ে যেতে দেবো না। হৃদয়ে তো রাণী হয়ে বসেই আছো, চলো তোমাকে আমার জীবনের রাণী বানাবো।’
কান্নারা অনেক যুদ্ধ করছে তিথির সাথে, বেরিয়ে আসবে বলে। কিন্তু তিথি নাছোড়বান্দা, চোখ দিয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ার পরেও কান্নাদের আসতে বাধা দিচ্ছে। ঢোঁক গিলে কাঁদো কাঁদো গলায় সে বললো, ‘এভাবে কথা বলে আমাকে কাঁদানোর মানে কী, হ্যাঁ? আমার যে এখন মাথা ঘুরছে… মনে হচ্ছে এক্ষুণি অজ্ঞান হয়ে যাবো। আচ্ছা, অজ্ঞান হলে কি আপনি আমাকে কোলে তুলে নেবেন?’
জাওয়াদ হেসে দিলো। তিথিকে আবার বুকে জড়িয়ে ধরে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো, ‘পাগলি!’
____________
চলবে…….
#ফারজানা_আহমেদ
রঙ তুলির প্রেয়সী
২০.
সময় বইতে থাকে তার গতিতে। চোখের পলকে কেটে গেল অনেকদিন। আদিয়া আর তিথি সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলো। ঢাকায় ওরা দুজনের মধ্যে কেউই পরীক্ষা দেয়নি। কারণ তারা সিলেটেই থাকতে চায়। আল্লাহর রহমতে দুজনেই চান্স পেয়ে গেল। আদিয়া গণিত বিভাগে আর তিথি ইংরেজি বিভাগে। তিথির জীবন চলতে লাগলো সুন্দরভাবে। রেগুলার ক্লাস, বাসায় প্রাইভেট। যেদিন ক্লাস থাকেনা সেদিন আদিয়ার সাথে মিলে দুজনে একসাথে রান্না করে। ফ্রি টাইমে সবাই একসাথে বসে লুডু খেলে। আর রাত হলে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তখন প্রিয়তমর হাতে হাত রেখে রাত জাগা। বুকে মাথা রেখে চাঁদের আলোয় মুগ্ধ হওয়া। গুজুরগুজুর করে গল্প করা। বসে বসে ভাবছে তিথি, তার জীবনে এতো সুখ আসবে সে কি কোনোদিনও ভেবেছিলো? নাহ, ভাবেনি। কোনোদিন আশাও করেনি। বারান্দায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে এসব ভাবছিলো তিথি। তখনই কোথা থেকে আদিয়া এসে হইহই করে বললো, ‘তিথি, মা বলেছে রেডি হতে। শপিংএ যাবো। সময়তো হাতে নেই আর, একসপ্তাহ আছে।’
চোখ খুলে তাকালো তিথি। বলা ভালো, রিয়াদের বিয়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। আর এক সপ্তাহ পরেই ফাহির সাথে ওর বিয়ে। যেহেতু আত্মীয়র মধ্যেই বিয়ে হচ্ছে, সেহেতু দু’পক্ষেরই ইচ্ছে এক বাড়িতেই একসাথে মিলেমিশে বিয়েটা সম্পন্ন করার। তাই, দু’দিন ধরে খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। শপিং এখনও সারা হয়নি। তাই মুনতাহা আজই শপিংএ যাবেন ঠিক করেছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তিথির কোথাও যেতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। সে ক্লান্ত কণ্ঠে বললো, ‘আদিয়া, আমার না ইচ্ছে করছেনা। আমি মামণিকে যেয়ে বলি আমি যাবোনা।’
আদিয়া চোখ রাঙিয়ে বললো, ‘ঢং পাইছো? ঢং? আমি একা যাবো? তাড়াতাড়ি রেডি হ তো। তাছাড়া গায়েহলুদে কী শাড়ি পরবি নিজে পছন্দ করে আনবি। তোকে কোন শাড়িতে বেশি সুন্দর লাগবে সেটা তুই না গেলে বোঝা যাবে না।’
‘শাড়ি’ শব্দটা শুনতেই তিথির চোখেমুখে একটা খুশির চিলিক দিলো। সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আচ্ছা যা। পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে আসছি।
আদিয়া খানিক অবাক হলো তিথির ভাব দেখে। সে কিছু না বলে বেরিয়ে গেল। তিথি কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
______________
চোখ বন্ধ করে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে নুহা। দু’বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে ভাবছে সে। চোখ বন্ধ করতেই দৃশ্যটা ভেসে উঠলো স্বচ্ছ আয়নার মতো। সেদিন মাহি বাড়িতেই ছিলো। নুহা মাহির কাছে গিয়ে বললো, ‘মাহি, আজ আমার সাথে একটু বেরোবি?’
মাহি একটা রুমাল সেলাই করছিলো। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই বললো, ‘কোথায়?’
‘অন্তুর বাসায়। আমার খুব ইমপোর্টেন্ট একটা কাজ আছে ওর সাথে। ওকেই আসতে বলতাম, কিন্তু ছেলেটার শরীর ভালো না।’
‘শরীর ভালো না? কী হয়েছে?’ চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলো মাহি।
‘ঐ একটু জ্বর আরকি। গেলে আমার কাজটাও হয়ে যাবে, আর ওরে দেখেও আসলাম।’
‘হুম আচ্ছা। আমিও যাই, দেখে আসি কী অবস্থা।’
হাসলো নুহা। মাহি রাজি হয়ে গেছে। প্লান মাফিক হলো সব। অন্তুকেও কষ্টে রাজি করিয়েছে এটা বলে যে, এমন করলে জাওয়াদ আর মাহির সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হবে। জাওয়াদ মাহিকে কোনোদিনও আপন করবেনা। এতে করে অন্তু সহজেই মাহিকে পাবে।
অন্তুর বেডরুমে বসে গল্প করছে ওরা তিনজন। বাসায় অন্তু একাই থাকে। ওর পরিবারের সবাই থাকে অন্য জায়গায়। সে নিজের কাজের জন্য এখানে আছে বছরখানেক হলো। কথা বলার এক পর্যায়ে নুহা বললো, ‘কীরে কিছু খাওয়াবিনা? এতো অভদ্র কেন বে তুই? বাসায় মেহমান আসলে কিছু খাওয়াতে হয়।’
অন্তু হেসে বললো, ‘আমি অসুস্থ মানুষ। কই তোরা আমার জন্য খাবার আনবি, তা না করে খুঁজছিস আমার কাছে!’
মাহি হেসে বললো, ‘আচ্ছা ঝগড়া ছাড়। আমিই যাচ্ছি কিছু করে আনি।’ বলে উঠতে যাবে আর তখনই নুহা তাড়াতাড়ি করে বললো, ‘ন-না না। আমি যাই। পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। পানিও খাবো আর কিছু বানিয়ে নিয়ে আসবো। বোস তোরা।’ বলে আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেল নুহা। হাসলো মাহি।
‘তো প্রেম কেমন চলছে, মাহি?’ ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করলো অন্তু।
‘একেবারে রসে টইটুম্বুর।’ হেসে বললো মাহি।
‘তাই? জাওয়াদ লাকি। নাহলে এভাবে আমাকে ঘোল খাওয়ানোর সাধ্য কারোর নেই।’ বলে হাসলো অন্তু।
মাহির অস্বস্তি লাগলো। যখনই অন্তু এ ব্যাপারে কিছু বলে তখনই অস্বস্তি এসে ভর করে মাহির ওপর। সে বললো, ‘আচ্ছা বোস তুই। আমি দেখি নুহা একা একা কী করছে।’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়ালো মাহি। খপ করে মাহির হাতটা ধরলো অন্তু। তারপর দাঁড়িয়ে বললো, ‘নুহা রাধুনি ভালো। যেতে হবেনা তোর।’
‘হাতটা ছাড়। দৈত্যের মতো ধরেছিস, আমার লাগছে।’
‘স্যরি স্যরি।’ বলে হেসে হাতের বাঁধন শিথিল করলো অন্তু, কিন্তু ছাড়লোনা। আবার বললো, ‘মাহি, চোখ বন্ধ কর। একটা জম্পেশ সারপ্রাইজ আছে তোর জন্য।’
‘তাই নাকি? কী সারপ্রাইজ?’ মাহির চোখে কৌতূহল।
‘সেটা চোখ বন্ধ করলেই তো ফিল করতে পারবি।’ শীতল কিন্তু কুচক্রী গলায় বললো অন্তু। বোকা মাহি বুঝলোনা, এই চোখ বন্ধ করলে যে তার জীবনের সবথেকে বড় দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবে। সে চোখ বন্ধ করলো। তারপর… হুট করে নিজের হাতে হ্যাঁচকা টান অনুভব করলো। মুহূর্তেই ভয়ার্ত মাহি চোখ খুলে দেখলো সে অন্তুর বাহুডোরে বন্দি। তার দুহাত তার পেছনে মুচড়ে ধরেছে অন্তু। নড়তে পারছেনা। কিছু একটা বলার জন্য ঠোঁট নাড়াতে নিলো আর তখনই তার নিজের ঠোঁট দুটো বেদখল হয়ে গেল। ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তখন মাহির। চোখের সামনে জাওয়াদের মুখ ভাসছিলো। কিন্তু অসহায় ছিলো সে, অন্তুর অসুর শক্তির সাথে সে পেরে উঠেনি। অন্তু যখন মাহিকে ছেড়েছিলো, রাগে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে থাপ্পড় মেরেছিলো মাহি অন্তুকে। তারপর বেরিয়ে গিয়েছিলো সেখান থেকে। সেই দৃশ্যের ছবি তখন লুকিয়ে নিজের ফোনে ক্যামেরাবন্দী করেছিলো নুহা। তারপর সেটা জাওয়াদকে পাঠিয়েছিলো।
জাওয়াদকে পাওয়ার জন্য এসব করেছে নুহা। এতোটা নিচে নেমেছে। আর এখন ঐ মেয়ে… ঐ মেয়ে হুট করে এসে জাওয়াদকে তার থেকে ছিনিয়ে নেবে? নুহা এটা কোনোদিনও হতে দেবে না। যে জাওয়াদকে পাওয়ার জন্য এতোকিছু করেছে, সে জাওয়াদকে সে অন্য কাউকে ছিনিয়ে নিতে দেবে না। চোখ খুলে তাকালো নুহা, চোখ ভিজে উঠেছে তার। চোখ মুছলো সে। তারপর বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
নুহার মা মনিরা বেগম নিজের রুমে বসে কাপড় গুছাচ্ছিলেন। এমন সময় নুহাকে নিজের রুমে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীরে? কোনো দরকার?’
‘হ্যাঁ। মা, আমি খালামণির বাসায় যাবো। রিয়াদের বিয়েতে আমি সবার আগে যেতে চাই।’
‘তো যাবি। কাল সকালেই যাবি। তোর বাবা আসুক, আমি কথা বলে কালকেই তোকে পাঠিয়ে দেবো।’
‘মা, আমি আজই যাবো।’
অবাক হলেন মনিরা। বললেন, ‘আজই? এখন তো আর একটু পরেই মাগরিবের আজান হয়ে যাবে। আর আজ তো মনেহয় ওরা এখনও শপিংএ।’
‘হোক। বাসায় টুনিতো থাকবে তাইনা। আমি আজই যাবো। তুমি বাবাকে বলবে। এখনই বলবে।’ জেদি গলায় বললো নুহা।
‘আ-আচ্ছা ঠিক আছে। যা রেডি হ। বলছি তোর বাবাকে।’ মনিরা বেগম আর কথা বাড়ালেন না। তার মেয়ে জেদি, তিনি জানেন। এই পরিমাণ জেদি যে এতোদিনে বিয়ের জন্যেও রাজি করাতে পারেন নি। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। একমাত্র মেয়েকে উনারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই চোখে হারান। নুহার পরে আরেকটা বাচ্চার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহর হুকুম ছিলো না, তাই আর কোনো সন্তান পাননি উনারা। তাই নুহাই উনাদের চোখের মনি। ভাবতে ভাবতে স্বামী নাজিম হোসেন কে কল করলেন মনিরা।
__________
হুট করেই একটা দরকারি কাজ পড়ে যাওয়ায় রিয়াদ আর হেলাল আহমেদ সিলেটের বাইরে যাবেন। তাই মুনতাহাকে কল করে বললেন আব্দুলকে পাঠিয়ে দিতে। গাড়ি করেই যেতে চাইছেন। আব্দুল চলে যাওয়ার পরে জাওয়াদ অফিস থেকে সোজা শপিংমলে চলে এলো মুনতাহাদের নিতে। তখন রাত প্রায় ১০ টা বাজতে চললো। গাড়িতে উঠে বসতেই জাওয়াদের চোখে চোখ পড়ে তিথির। তিথি চোখ নামিয়ে নিলো। লজ্জা পাচ্ছে সে। তিথি একটা সবুজ জামদানী কিনেছে। রিয়াদের গায়েহলুদের দিন এটা পরবে। চুল খুলে ছড়িয়ে দেবে পিঠময়। মুখে কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করবেনা। শুধু টকটকে লাল লিপস্টিকের ছোঁয়া দিবে ঠোঁটে। আচ্ছা, জাওয়াদ কি তখন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে ওর দিকে? ভাবতেই লজ্জা পেলো আবার তিথি। মাথা ঘুরিয়ে জানালার বাইরে তাকালো। জাওয়াদ গাড়ি স্টার্ট দিয়েই মুনতাহাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘মা, চলো আজ আর্কেডিয়াতে ডিনার করি।’
মুনতাহা কিছু বলার আগেই আদিয়া বললো, ‘মন্দ হবেনা। চলোনা বড় ভাইয়া, আমার পাস্তা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব।’
মুনতাহা হেসে তিথিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই কী খাবি?’
তিথি চমকে উঠে তাকালো। তারপর আমতাআমতা করে বললো, ‘সবাই যা খাবে তাই।’
জাওয়াদ হেসে উঠলো এটা শুনে। তিথি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। জাওয়াদ লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে বললো, ‘ বুঝলে মা, তিথি হচ্ছে সর্বভুক। সবাই যা খাবে সেও তাই খাবে। মানে আমরা তিনজন আলাদা আলাদা আইটেম খাবো, সেই তিনটা আইটেমই সে একা খাবে। ভাবতে পারো?’ বলে আবার হাসলো জাওয়াদ হো হো করে। তিথি গাল ফুলিয়ে জানালার দিকে মাথা ঘুরালো। মুনতাহা আর আদিয়া ভারি অবাক হলেন। জাওয়াদ ইদানীং খুব রসিকতা করে সবার সাথে। যেন সেই আগের জাওয়াদ। খুশিতে মুনতাহার চোখে পানি চলে আসতে চাইলো। আদিয়া হয়তো বুঝলো, তাই একহাতে মায়ের একটা হাত চেপে ধরলো সে। মুনতাহা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
রেস্টুরেন্টে মুনতাহা আর আদিয়া পাশাপাশি বসলেন। আর তিথি বসতেই জাওয়াদ তিথির পাশে বসে গেল। খাবার আনার পর সবাই খাওয়া শুরু করলো আর এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে লাগলো। তিথি চুপচাপ খাচ্ছিলো আর তাদের আলোচনা শুনছিলো মন দিয়ে। হঠাৎ অনুভব করলো তার ডান পায়ে কারো পায়ের ছোঁয়া। মুখে সবেমাত্র একটু খাবার নিয়েছিলো। সেগুলো আর গিলতে পারলোনা। সে ভালোই বুঝতে পারছে এগুলো জাওয়াদের কাজ। সে ডানদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখলো জাওয়াদ মন দিয়ে খাচ্ছে আর কথা বলছে মুনতাহার সাথে। যেন সে এসব কিছুই করছেনা। তিথি যখন জাওয়াদের দিকে তাকালো তখন অনুভব করলো পা টা তার পায়ের ঘণ্টা ছাড়িয়ে উপরে উঠছে। তিথির সারা শরীরে একটা কাঁপন দিলো। হাত নামিয়ে জাওয়াদের কোমরে একটা চিমটি বসালো তিথি। সাথেসাথে পা সরে গেল। হাফ ছেড়ে বাঁচলো তিথি। খাওয়া শেষে যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলো ওরা তখন এক ফাঁকে জাওয়াদ তিথির কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘চিমটির যন্ত্রণা টা আদর দিয়েই মেটাতে হবে আজ তোমায়।’
তিথি কিছু বললোনা। একটা ভেংচি দিলো শুধু।
_________
বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামালো জাওয়াদ। সবাই নেমে যাওয়ার পরে জাওয়াদ মুনতাহাকে বললো, ‘মা, অফিসে একটা ফাইল রেখে এসেছি। ওটা নিয়ে আসতে হবে। ইমপোর্টেন্ট। তোমরা যাও। আসছি আমি।’
বলে জাওয়াদ চলে গেল গাড়ি স্টার্ট দিয়ে। সবাই ভেতরে গেল। আদিয়া ক্লান্ত স্বরে বললো, ‘আমিতো এখন ধপাস করে বিছানায় শুবো আর সকালে উঠবো। আর কে পায় আমায়।’
ভেতরে গিয়েই মুনতাহা কণ্ঠে বিস্ময় ঝরিয়ে বললেন, ‘কীরে! কখন এলি তুই? বললিনা আসার আগে একবারও। খেয়েছিস তুই? হায় মাবুদ! আমাকে বলবিনা আসবি যে?’
আদিয়া গিয়ে নুহাকে জড়িয়ে ধরলো। নুহা বললো, ‘খেয়েছি। আর এসে চমকে দিতে চেয়েছি তাই বলিনি আগে।’ বলে একবার হাসলো নুহা। তারপর একটা ঠাণ্ডা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তিথির দিকে। তারপর একটা বাঁকা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভালো আছো, তিথি?’
তিথি চমকে উঠলো। গলা শুকিয়ে গেল তার। এই প্রথমবার তার ভেতর কোনো একটা ভয় এসে জেঁকে বসলো। কিসের ভয় সেটা? তিথি ঢোঁক গিললো। আস্তে করে বললো, ‘ভালো।’
__________
চলবে……