রঙ তুলির প্রেয়সী-৯,১০
ফারজানা আহমেদ
০৯
চুল খাড়া, গায়ের রঙ মোটামুটি ফর্সা মানে যাকে বলে উজ্জ্বল শ্যামলা। কালো রঙের টি-শার্ট পরে এসেছে। দেখতে হ্যান্ডসাম মাইরি। আদিয়ার মতো সুন্দরী আর জোয়ান একটা মেয়েকে এরকম হ্যান্ডসাম ছেলের কাছে কীভাবে পড়তে দেয়া হলো এটাই ভেবে পাচ্ছেনা তিথি। এই বাড়ির মানুষ কি জানেনা? আগুন আর ঘি পাশাপাশি রাখতে নেই? একটু পরপর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে আদিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে ছেলেটা। আদিয়া তাকালেই আবার সে নিচের দিকে চোখ নামিয়ে নেয়। আদিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো আদিয়া একমনে অংক ঠিকই করে যাচ্ছে কিন্তু গালে তার লালচে আভা স্পষ্ট। বিষয়টা খটকা ঠেকলো তিথির কাছে। সে হাতে কলম ঘুরাতে ঘুরাতে পর্যবেক্ষণ করছিলো আদিয়া আর নাহিদকে। নাহিদ খেয়াল করলো তিথি তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে সাবধান হয়ে গেল। এক গাল হেসে বললো, ‘তোমার হয়েছে?’
‘সেটা দেখার আর সময় কই আপনার স্যার?’ একইভাবে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বললো তিথি।
চট করে ফিরে তাকালো আদিয়া। নাহিদ যেন খানিক ঘাবড়ালো। তারপর আবার হেসে বললো, ‘এই স্যার ডেকোনা প্লিজ। ভাইয়া বলেই ডাকো। আদিয়াও স্যার ডাকেনা।’
‘তাই নাকি? আদিয়া কী ডাকে?’
‘আমিও ভাইয়াই ডা…’ বলতে গিয়ে আঁটকে গেল আদিয়া। নাহিদের দিকে তাকালো। নাহিদও তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তিথির এই মুহূর্তে খুব মজা লাগছে। সে ভালোকরেই বুঝতে পারছে হয় এদের দুজনের মধ্যে কিছু আছে আর নাহয় খুব তাড়াতাড়ি হওয়ার সম্ভাবনা।
ওদের আর বিভ্রান্তিতে ফেলতে চাইলোনা তিথি তাই হেসে বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি স্যার ডাকবোনা। ভাইয়া ডাকবো।’
‘গুড। আচ্ছা দেখি দাওতো কতোটা হলো।’ বলে পড়ানোতে মন দিলো নাহিদ। আদিয়া আর তিথিও পড়ায় মন দিলো। তিথি মনে মনে ভেবে নিলো যে কাহিনীটা আদিয়ার মুখ থেকেই উগড়াবে।
_____________________
জাওয়াদ বারান্দায় বসে সিগারেট খাচ্ছিলো। তার হাতে তার মোবাইল বাজছে অনবরত। স্ক্রিনের নামটা যতোবারই দেখছে ততবারই দপদপ করে উঠছে কপালের রগ। রাগ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে রিসিভ করে ফোন কানে লাগালো জাওয়াদ। ওপাশ থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে এলো, ‘কেন এমন করছিস? আর কতো ক্ষমা চাইবো আমি?’
‘তুই সারাজীবন ক্ষমা চাইলেও আমি তোরে ক্ষমা করবোনা।’ খুব শীতল কণ্ঠে বললো জাওয়াদ। ওপাশের মেয়েটা কেঁদে দিলো এবার। জাওয়াদ বিরক্ত হয়ে বললো, ‘এই বন্ধ করতো! আমার কাছে এসে এমন কাঁদবিনা। তোর কান্না আমার কানে বিষাক্ত লাগে কোনো অনুভূতি হয়না।’
কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিলো মেয়েটা। জাওয়াদ হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে হিসহিসিয়ে বললো, ‘ছ্যাঁচড়ামির লিমিট আছে। আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ কর তুই। নাহলে হঠাৎ একদিন দেখবি তোকে আমি বিভৎসভাবে খুন করে জ্বালা মিটিয়েছি।’
‘জাওয়াদ প্লিজ। একটাবার ক্ষমা করে আমাকে সুযোগ দে… প্লিজ… আমি তোর জীবন আবার গুছিয়ে দেবো। প্লিজ জাওয়াদ…’ কাঁদতে কাঁদতে বললো মেয়েটা।
রাগে দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো জাওয়াদের দু’চোখে। সে নিজেকে প্রাণপণে সামলানোর চেষ্টা করছে। ডান হাতে নিজের চুল খামচে ধরে জোরে জোরে বার কয়েক নিশ্বাস নিলো। ওপাশের মেয়েটা তখনও কেঁদে যাচ্ছে। জাওয়াদ বললো, ‘গুছিয়ে দিবি? তুই গুছিয়ে দিবি? তোরে সুযোগ দেবো? কীসের সুযোগ চাস তুই?’
‘জাওয়াদ আমি তোকে ভা…’
মেয়েটা কথা শেষ করার আগেই জাওয়াদ খুব শান্ত স্বরে বললো, ‘মুখ সেলাই করে দেবো তোর আমি। দ্বিতীয়বার এই কথা বলার সাহস করবি তো আমি খুন করে ফেলবো তোকে। আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ কর।’
‘তুই যা বলবি আমি সব করবো শুধু আমাকে ক্ষমা করে দে।’
‘তাই নাকি? সব করবি? যা তাইলে তোর বাপ চাচাদের গিয়ে বল কী কুকর্ম করেছিলি তুই। যা।’
‘জাওয়াদ প্লিজ এমন করিসনা।’ বলে কাঁদতে থাকলো মেয়েটা। জাওয়াদ আর সহ্য করতে পারলোনা। কল কেটেই ফোন অফ করে দিলো। তারপর বসে বসে নিশ্বাস নিতে লাগলো জোরে জোরে।
_____________________
হেলাল আহমেদকে যাওয়ার আগে কিছু দরকারি জিনিসের কথা বলে দিয়েছিলেন মুনতাহা, সেগুলো মুনতাহার কাছে দিচ্ছিলেন উনি। মুনতাহা বললেন, ‘যাক, তোমার দেখি সবই মনে আছে যা যা বলেছিলাম।’
হেলাল আহমেদ বললেন, ‘হ্যাঁ। তিথি আর আদিয়াকে একটু ডাকো। দুজনের জন্যেই মোবাইল এনেছি। আদিয়ার মোবাইলটাও তো পুরনো অনেক।’
এমন সময় তিথি আর আদিয়া রুমে এলো। মুনতাহা বললেন, ‘ডাকা লাগেনি। এসেই গেছে। তোদের পড়া শেষ এতো তাড়াতাড়ি? নাহিদ তো কমপক্ষে দুই ঘণ্টা পড়ায়। আজ এতো কম?’
তিথি সরু চোখে তাকালো আদিয়ার দিকে। আদিয়া একটা ঢোঁক গিললো। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তিন বন্ধু আজ আড্ডা দিবে শুনলাম। তাই।’
‘ও আচ্ছা।’
হেলাল আহমেদ বললেন, ‘অনেকদিন পরে শুনলাম ওদের আড্ডা হবে। গানবাজনা হবে নাকি? ছেলেটার গান শুনিনা অনেকদিন।’
আদিয়া বললো, ‘দেখলাম তো স্পিকার আর গিটার টেনে নিচ্ছে ছাদে।’
চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনছিলো তিথি। গান? কার গানের কথা বলছে ওরা? জাওয়াদ নাকি রিয়াদ?
____________________
আদিয়ার একটা এক্সট্রা সিমকার্ড ছিলো, তিথি সেটাই তার নতুন মোবাইলে এক্টিভেট করলো। আদিয়া বললো, ‘আজকে তো কেউ বেরোবেনা। আব্দুল ভাইও চলে গেছে। কালকে লোড করায়ে দিবো সিমে।’
‘সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এতোক্ষণ থেকে তো তোর মোবাইলটা বাজছে। রিসিভ কর?’
আদিয়া চমকে গেল। তিথি কীভাবে দেখলো? সে তো মোবাইলটা উল্টে রেখেছে। আর সাইলেন্টও আছে। ভাবতে ভাবতে বিছানার ওপর নিজের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে হা হয়ে গেল। উল্টে রাখেনি! আদিয়া হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা হাতে নেয়ার আগেই চট করে তিথি নিজের হাতে নিয়ে রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিলো। ওপাশ থেকে নাহিদের গলা ভেসে এলো, ‘মাই গড! আদিয়া, তোমার বোনটা এক চিজ কিন্তু। ভয় পেয়ে গেছিলাম আমি। এই কিছু বুঝেছে?’
আদিয়ার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে ফ্যাকাসে মুখে তাকালো তিথির দিকে। তিথি খিলখিল করে হেসে দিলো। আদিয়া তিথির কাছ থেকে মোবাইলটা কেড়ে এনে কলটা কেটে দিলো। তিথি এবার বিছানায় শুয়ে হাসতে লাগলো। আদিয়া ও হেসে দিলো তিথির সাথে। কিছুক্ষণ দুজনেই হাসার পরে তিথি বললো, ‘আগেই বুঝেছি।’
‘হয়েছে এবার চুপ আমার লজ্জা লাগছে।’ আদিয়া দুহাতে মুখ ঢেকে বললো।
তিথি হেসে দিলো আবার। বললো, ‘যা আর লজ্জা দিবোনা। আচ্ছা ছাদে যাবি?’
আদিয়া বললো, ‘পাগল? এখন ওরা হুইস্কি টুইস্কি খাবে আড্ডা দেবে। আমরা মেয়েরা ওদের মাঝে যাবো৷ কেন?’
‘হুইস্কি খায়?’ চোখ বড় বড় করে বললো তিথি।
‘হ্যাঁ। ছাদে সফট আলোর লাইট জ্বালিয়ে গিটার দিয়ে গানও গায়। আর আমরা নিচ থেকে শুনি।’
‘প্লিজ প্লিজ আদিয়া চলনা। জাস্ট পরিবেশটা দেখবো দেখেই চলে আসবো।’ আকুতি করে বললো তিথি।
‘এই না বড় ভাইয়া দেখলে মেরে ফেলবে। আমি কোনোদিনই এভাবে যাইনি।’
তিথি গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। আদিয়া বললো, ‘থাক আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসি।’ বলে উঠে গেল আদিয়া।
____________________
‘আচ্ছা তো প্লান কী জাওয়াদ? সুযোগ দিবি নাকি একটা?’ বলে চোখ টিপ দিয়ে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিলো নাহিদ। জাওয়াদ ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। রিয়াদ হেসে দিলো শব্দ করে। তারপর বললো, ‘তোর পিঠ কী মার টানছে নাহিদ?’
নাহিদ অবাক হয়ে বললো, ‘আরে আমি খারাপ কী বললাম? দেখ ভুল মানুষের হতেই পারে। তাই বলে এমন করতে হবে? মেয়েটা কম ক্ষমা চায়নি।’
‘এটাকে তোর কাছে ভুল মনে হয় নাহিদ?’ জাওয়াদ বললো খুব ঠাণ্ডা গলায়। হুট করে যেন পুরো পরিবেশ শান্ত হয়ে গেল। নাহিদ ভড়কে গেল। ঢোঁক গিলে কিছু একটা বলতে চাইলো আর তখনই টপিক পাল্টানোর জন্য রিয়াদ বললো, ‘আরে ধুর এসব ফাউল টপিক বাদ দে। জাওয়াদ গান ধর। অনেকদিন শুনিনা।’
‘কালকেই দেখলাম হেডফোন লাগিয়ে ছাদে ঘুরছিস আর নাচছিস।’ হেসে বললো জাওয়াদ।
‘আরে তোর গান। নাহিদ একটু গিটারটা এগিয়ে দে আর স্পিকারটা ঠিক কর।’
‘হ্যাঁ।’ বলে জাওয়াদের হাতে গিটার দিয়ে স্পিকার ঠিক করে এসে বসলো নাহিদ।
জাওয়াদ গিটারে সুর তুলতে খানিকটা সময় টুংটাং করলো। ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য মুগ্ধ নয়নে দেখছিলো তিথি। আদিয়া ওয়াশরুমে যাওয়ার পরে অনেক দোনা মোনা করে ছাদে ছলে এসেছে সে। নিজেকে যথেষ্ট লুকিয়ে রেখেছে যাতে ওরা কেউ না দেখে। হলুদাভ লাইটের আলোয় কপালে এলোমেলো ভাবে লেপ্টে থাকা চুলে জাওয়াদকে দেখতে কতোটা নেশাময় লেখছিলো! তিথির বুক কাঁপতে লাগলো। ছাদের দরজায় শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। জাওয়াদ গান ধরলো,
“I used to believe
We were burnin’ on the edge of somethin’ beautiful
Somethin’ beautiful
Selling a dream
Smoke and mirrors keep us waitin’ on a miracle
On a miracle
Say, go through the darkest of days
Heaven’s a heartbreak away
Never let you go, never let me down
Oh, it’s been a hell of a ride
Driving the edge of a knife
Never let you go, never let me down
Don’t you give up, nah-nah-nah
I won’t give up, nah-nah-nah
Let me love you
Let me love you
Don’t you give up, nah-nah-nah
I won’t give up, nah-nah-nah
Let me love you
Let me love you”
একটা দমকা হাওয়া এসে যেনো সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল। চারিপাশে যেন উড়তে লাগলো ভালোবাসার রঙের এক একটা প্রজাপতি। গানের প্রতিটি লাইন যেনো বুকের ভেতরটাকে ধুকপুক করে কাঁপিয়ে তুলছিলো তিথির। যেনো এই গানটা জাওয়াদ তার জন্যে গাইছিলো। যতোই জাওয়াদকে এই হালকা আলোয় দেখছিলো তিথি, ততোই যেনো তার বুকের ভেতরটা অস্থিরতায় ভরে যাচ্ছিলো। তিথির পা টলতে লাগলো। সে কি এখন বেহুঁশ হয়ে যাবে? নাহ নাহ, এখানে থাকলে সেটাই হয়ে যাবে। এখানে আর থাকা যাবেনা। তিথি এলোমেলো পা ফেলে নিচে নেমে গেল। নামতে নামতে ভাবলো, ‘উনার সামনে গেলে আমার এমন কেন হয়?’
_______________
চলবে……….
@ফারজানা আহমেদ
*
রঙ তুলির প্রেয়সী
১০.
আজ সকাল থেকেই কেমন আবহাওয়া মেঘলা মেঘলা। সবাই একসাথে বসে আছেন মুনতাহাদের ঘরে শুধু জাওয়াদ ছাড়া। হেলাল আহমেদ এর ইচ্ছে হলো এই মেঘলা আবহাওয়াতে পাকোড়া খেতে খেতে জাওয়াদের সাথে দাবা খেলবেন। তিনি রিয়াদকে বললেন, ‘জাওয়াদ কোথায় রে? ঘরে আছে? এক ম্যাচ হয়ে যেতো তবে। এই মুনতাহা যাও পাকোড়া বানাও। অনেকদিন হলো খাইনা।’
‘আছে দেখলাম। কী বই পড়ছে বসে বসে।’ রিয়াদ বললো। আদিয়া পাশ থেকে হেসে বললো, ‘কৌতুকের বই পড়তে দেখলাম।’
‘এতো সিরিয়াস হয়ে কেউ কৌতুকের বই পড়ে!’ তিথি অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো। তিথির কথার ধরণে হেসে দিলো সবাই। তিথি আবার বললো, ‘মামণি সত্যি, তোমার এই ছেলে কী? মানে, আদিয়া আর রিয়াদ ভাইয়াকে দেখো সব কথায় হাসে। কিন্তু উনার মুখে হাসি খুব রেয়ার! উনাকে পালার জন্য এনেছো নাকি?’
তিথির কথায় আবারও হাসলো সবাই। মুনতাহা বললেন, ‘হয়েছে যাই আমি পাকোড়া বানাই। আর কেউ কিছু খাবে?’
‘সিঙ্গাড়া খেতে ইচ্ছে হচ্ছে মা।’ বললো রিয়াদ। আদিয়াও রিয়াদের সাথে হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলালো। মুনতাহা উঠে গেলেন। হেলাল আহমেদ বললেন, ‘যা তো রিয়াদ। জাওয়াদকে বল দাবার বোর্ড নিয়ে চলে আসতে। এখানেই খেলবো।’
কেউ কিছু বলার আগেই তিথি বললো,’আরে আঙ্কেল! লুডু খেলি চলেন। অনেক তো দাবা খেলেছেন। এসব দাবা দুজন ছাড়া খেলা যায়না। চলুন চারজনে লুডু খেলি।’
‘সেটাও খারাপ না। দাঁড়াও তাহলে আমি লুডুটা ইনস্টোল করে নেই মোবাইলে।’ বলে নিজের মোবাইল খুঁজতে লাগলেন হেলাল আহমেদ। তিথি খিলখিল করে হেসে বললো, ‘কীসব যে করেন না আপনারা! আরে রিয়েল লুডুর কথা বলেছি। এটাতে মজা আছে নাকি?’
‘রিয়েল লুডু এখন পাবো কই? মনেহয় গত দু’বছরেও খেলিনি।’ আদিয়া বললো।
‘কেন আমি সেবার এসে না খেললাম?’
‘ঐতো, দু’বছর। আচ্ছা চল খুঁজে দেখি পাই কি না।’ বলে আদিয়া উঠে দাঁড়ালো। হেলাল আহমেদ বললেন, ‘জাওয়াদকে আসতে বলিস।’
‘আচ্ছা।’ বলে তিথিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল আদিয়া।
___________________
তিথি আদিয়াকে বলে নিজের রুমে খুঁজতে এলো টুনিকে নিয়ে। দু’একমিনিট খুঁজে সে টুনিকে বললো, ‘শোনো, তুমি এইখানে দেখো ভালো করে। আমি অন্য রুমে যাই।’
‘আর কই পাইবেন আফা? বড় ভাইজানের রুম আর ছোট ভাইজানের রুম ছাড়াতো এহানে আর কোনো রুম নাই।’
‘ঐ রুমগুলোতেই দেখবো।’
‘ছোট ভাইজানের রুমে হয়তো পারবেন। কিন্তু বড় ভাইজানের রুমে খুঁইজা হুদ্দাই সময় নষ্ট। উনি এইগুলান রাখেন নাকি। উনিতো চিস খেলায়।’
তিথি কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী খেলায়?’
টুনি বিজ্ঞের মতো হাত নাড়িয়ে বললো, ‘আরে আফা চিস চিস। মানে ইংরিজি কইলাম, দাবার।’
তিথি ফিক করে হেসে দিলো। চেস কে চিস বলছে টুনি। তিথি আর কথা না বাড়িয়ে বললো, ‘আচ্ছা না পেলে না পেলাম। খুঁজতে তো সমস্যা নেই। তুমি ভালো করে দেখো।’ বলে বেরিয়ে গেল তিথি।
জাওয়াদের রুমের সামনে এসে দেখলো তিথি যে জাওয়াদের রুমের দরজাটা খোলা। ভেতরে উকি দিলো, কেউ নেই। খানিকটা অবাক হলো তিথি। বিড়বিড় করে বললো, ‘গেল কই!’ বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে বারান্দার দিকে এগোলো। জাওয়াদ একটু বাইরে গিয়েছিলো। রুমে এসে দেখে তিথি বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে বাইরে। আস্তে আস্তে গিয়ে তিথির একেবারে পেছনে দাঁড়ায় জাওয়াদ। তারপর বলে, ‘কী ব্যাপার?’
হুট করে এভাবে পেছন থেকে কেউ কথা বলায় ভয় পেয়ে পেছন ফিরতে গিয়ে স্লিপ খেয়ে পড়ে যেতে নেয় তিথি। জাওয়াদ তিথির ডান হাত ধরে হ্যাচকা টান দেয়। তিথি উড়ে এসে পড়ে জাওয়াদের বুকে। আকস্মিক ঘটনায় স্তব্ধ তিথি কথা বলতেই ভুলে গেল। জাওয়াদ কড়া ভাবে তিথির চোখে চোখ রেখে বললো, ‘এতোটা কেয়ারলেস কেন? এক্ষুনি তো পড়ে ঠ্যাং ভেঙ্গে ফেলতে।’
তিথি কিছু বলতে চেয়েও পারছেনা। গলায় শব্দ আঁটকে যাচ্ছে। নিশ্বাসও আসছে আঁটকে আঁটকে। তিথি এমন এক ধ্যানে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে জাওয়াদের টনক নড়ে। তিথিকে ছেড়ে সরে দাঁড়ায় সে। তারপর বলে, ‘এখানে কী?’
তিথি কাঁপছে। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। এখনও ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারছেনা। মনে হচ্ছে যেন তার দুনিয়া ঘুরছে। সে আমতাআমতা করে কিছু বলতে যাবে তখনই টুনির গলা শুনলো, ‘আফা খালুজান ডাকতেছেন আপনেগো।’
জাওয়াদ মাথা ঘুরিয়ে বললো, ‘আমাকেও?’
টুনি নিচের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হ। খালাম্মা পাকোড়া বানাইছেন, খাইতে ডাকে।’
তিথি জাওয়াদকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। টুনিও চলে গেল। জাওয়াদ ব্যস্ত হয়ে এসে নিজের বিছানায় বসলো। তার বুক ধড়ফড় করছে। গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে এক নিশ্বাসে গিলে ফেললো। তারপর জোরে জোরে নিশ্বাস নিলো। ঢোঁক গিলে বিড়বিড় করলো, ‘ওরও… ঠোঁটের নিচে… তিল!’
__________________
আদিয়ার রুমেই পাওয়া গেল লুডু। হইহই করে লুডু খেলা হচ্ছে। আদিয়া আর তিথি এক টিম। রিয়াদ আর হেলাল আহমেদ এক টিম। যেহেতু চারজনেই খেলতে হয় সেহেতু জাওয়াদ চুপচাপ বসে বসে পাকোড়া খাচ্ছে আর খেলা দেখছে। খেলা দেখছে বললে ভুল হবে, সে তিথিকে দেখছে। এই প্রথম, মন দিয়ে দেখছে সে তিথিকে। যতোই দেখছে ততোই বুকের কাঁপন বেড়ে যাচ্ছে তার। বারবার একটা পরিচিত মুখ ভেসে উঠছে ওর চোখের সামনে। অস্থির লাগতে লাগলো জাওয়াদের। তিথির ঠোঁট, ঠোঁটের নিচের তিল, ঘন পাপড়ির চোখ… সবকিছু… সবকিছু আজ মন দিয়ে দেখছে জাওয়াদ। সবকিছু তাকে বারবার একটা মুখই মনে করিয়ে দিচ্ছে। চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করতে চাইলো জাওয়াদ। নাহ, পারছেনা। উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরলো। হাঁটতে হাঁটতে শুনলো পেছনে তিথি বলছে, ‘রিয়াদ ভাইয়া এসব ঠিকনা কিন্তু তুমি খালি ঠকাচ্ছো। এই টুনি তুমিই বলো আমার ছক্কা এসেছে না? আমি খেয়েছি রিয়াদ ভাইয়ার গুটিটা।’
অস্থির বুকে হাসলো জাওয়াদ। পেছন ফিরে তাকালো একবার, তারপর নিজের রুমে চলে গেল।
________________
গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে পৃথিবীর বুকে। সন্ধ্যা নামার আগেই পৃথিবী যেন অন্ধকার। নিজের বারান্দার দরজার সামনে বিষন্ন মনে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে জাওয়াদ। আজ ভালো লাগছেনা কিছু। পুরোনো স্মৃতিরা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বুকের ভেতর একটা চাপা কষ্ট বারবার উঁকি দিচ্ছে। মাথা ঝাড়া দিয়ে বা’দিকে তাকাতেই যেন একটা ধাক্কা খেলো জাওয়াদ। ধক করে উঠলো তার বুক। সে চট করে নিজেকে আড়াল করে নিলো। তারপর দেখতে লাগলো। হাঁটুর একটু উপর সমান খোলা চুল নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে তিথি। তারপর রেলিংএ পিঠ ঠেকিয়ে মাথাটা পেছনদিক দিয়ে হেলিয়ে দিলো। হাত দু’টি মেলে ধরলো দু’দিকে একটা পাখির মতো। মাথা হেলিয়ে দেয়ায় চুলগুলো পিঠ বেয়ে কেমন ঝুলে আছে রেলিংএর বাইরে। বাতাসে নড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে যেন একটা হার্টবিট মিস করলো জাওয়াদ। বুকের বা পাশে হাত চলে গেল আপনআপনি। অস্ফুট স্বরে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘ওহ মাই গড!’ জাওয়াদের চোখে পড়লো, তিথি পেছনদিকে হেলে থাকার কারণে তার টপস টা খানিক উপরে উঠে নাভি বেরিয়ে এসেছে। চোখ বন্ধ করে ফেললো জাওয়াদ, সাথেসাথে আরেকটা দৃশ্য ভেসে ওঠে তার চোখের সামনে। জাওয়াদ আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। ভেতরে চলে এলো। বিছানায় বসে হাসফাস করতে লাগলো। ধুপ করে চিত হয়ে শুয়ে পড়লো সে বিছানায়। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো চোখে দু’বছর আগের সেই মধুর সময়টা। শেষ বারের মতো নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে সে কাছে পেয়েছিলো। ছুঁতে পেরেছিলো, আদর করতে পেরেছিলো…
সেদিন জাওয়াদের বড় মামার ফ্যামিলি বেড়াতে এসেছিলো তাদের বাড়ি। পরদিনই জাওয়াদের ফ্লাইট ছিলো। বন্ধুদের সাথে তিন’মাসের ট্রিপ সিঙ্গাপুরএ। বড় মামার দুই মেয়ে, মাহি এবং ফাহি। মাহি জাওয়াদের সমবয়সী। ফাহি দু’বছরের ছোট। আর এই মাহির সাথে জাওয়াদ তার জীবনের সুন্দর মুহূর্ত গুলো কাটানোর স্বপ্ন দেখে। দুজনে মিলে টুনা টুনির সংসার পাতানোর স্বপ্ন দেখে। দুই পরিবারের ও সম্মতি আছে এই সম্পর্কে। কোনো বাধা না থাকায় দিন দুনিয়া ভুলে ভালোবাসায় মত্ত থাকতো দুজনে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইজেলে রঙ তুলিতে ছবি আঁকছিলো জাওয়াদ। এমন সময় মাহি এসে দাঁড়ায় দরজায়। মাহির উপস্থিতি টের পায় জাওয়াদ, কিন্তু ভাব ধরে যেন বুঝতে পারেনি। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে মাহি, ‘আসতে পারি?’
জাওয়াদ ছবি আঁকতে আঁকতেই বলে, ‘এসেই তো গেলি। আর আসবি কী?’
‘তাহলে চলে যাবো?’
এবার তাকায় মাহির দিকে জাওয়াদ। একটা লাল রঙের এক কালার সেলোয়ার-কামিজ পরেছে মাহি। কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো সিথি করে খুলে সামনে এনে রেখেছে। জাওয়াদ নিচের দিকে তাকিয়ে একবার হাসে। তারপর মাহির দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে, ‘তুই বড্ড জ্বালাচ্ছিস। অ্যালকোহল আমি নেইনা। তুই নিজেই আস্ত একটা অ্যালকোহল হয়ে ভর করছিস আমার ওপর।’
মাহি হেসে ফেলে। বলে, ‘হয়েছে হয়েছে। কী আঁকছিস?’
‘যা-ই আঁকি। দেখাবোনা।’
‘দেখাইওনা। তোর জন্য এনেছিলাম একটা জিনিস।’ বলে পেছনে রাখা দু’হাত সামনে আনে মাহি। জাওয়াদের প্রাণখোলা হাসিমুখের একটা ছবি। রঙ তুলিতে এঁকেছে মাহি। ছোটবেলায় দু’জনেই একসাথে ছবি আঁকা শিখেছে। মাহির আঁকা সেই ছবিটা এখনও ঝুলছে জাওয়াদের ঘরের দেয়ালে।
____________
চলবে…….
ফারজানা আহমেদ