রহস্যের কুয়াশা☠️,পর্ব-০১,০২

0
540

#রহস্যের কুয়াশা☠️,পর্ব-০১,০২
#হাফসা ইরিন রাথি
#সূচনা পর্ব

সকালে ১১ দিন বয়সী মিলিকে সবাই বাশগাছের উপর আবিষ্কার করলো!!তাও আবার যে সে বাঁশ নয়,এলাকার সবচেয়ে ভয়ানক আর ভুতুড়ে বাঁশঝাড়ের সবচেয়ে উচু বাশটার সাথে বাচ্চাদের ছোট দুলনায় ঝুলন্ত অবস্থায়।সবাই খুব অবাক আর ভয় ও পেলো।কিন্তু কি আশ্চর্য এই টুকু মেয়ে যার বয়স কিনা সবে ১১ দিনে পা রাখলো সে এখানে উঠলো কিভাবে??আর ও তো নিজের মায়ের বুকে ঘুমাচ্ছিল, এমন দোলনাও নেই ওদের বাসায়,তাহলে এটাই বা এলো কোত্থেকে!!
এলাকার লোকজন অনেক কষ্ট বাঁশের উপর থেকে ওকে নামাতে সক্ষম হলো।কিন্তু মিলির চোখে কান্নার কোনো চিহ্নই নেই,যেনো খুব ভালোই ছিল এখানে!!এইটুকু বাচ্চা মেয়ে তো মাকে ছাড়া কেদে হিচকী উঠে যাওয়ার কথা কিন্তু এই বাচ্চা কিনা দিব্যি খেলছিল উপরে!
মিলির বাবা মা ওর জন্মের পর থেকেই ওকে নিয়ে শঙ্কায় আছে কারণটা হলো ওকে এমন হঠাৎ করেই পাওয়া যায় না।তারপর অনেক খোঁজাখুঁজির পর এমন কোথাও পাওয়া যায় না কিন্তু শেষে আবার সেই ঘরেই পাওয়া যায় ওকে কিন্তু এবারের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন ঘটলো বলে দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেছে সবার।
মিলি কাল রাত খুব কান্না করছিলো ওর মা ঘুমের মাঝেই শুনতে পাচ্ছিলো যে ও কাদছে কিন্তু উনার এত্তো বেশি ঘুম পাচ্ছিলো যে চোখের পাতা খুলতেই পারছিলেন না।হঠাৎ ২ মিনিটের মধ্যেই কান্না থেমে একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো পরিবেশটা যেনো কোনো বাচ্চার অস্তিত্বই নেই।মিলির বাবা মা দুজনেরই ঘুম ভেঙে যায় কিন্তু বিছানায় খুঁজে পায় না মিলিকে।সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও না পেয়ে শেষে এলাকার মানুষজন নিয়ে বাহিরেও খুজাখুজি করে।কিন্তু কোথাও পায় না মিলিকে।ওর জন্মের পর এমন হয়েই চলেছে।এই ১১ দিনের মধ্যেই ৩ বার নিখোঁজ হয় মিলি কিন্তু প্রতিবারই আবার ঘরেই খুঁজে পেয়েছে তাই এইবারও অপেক্ষা করতে লাগলো কখন ঘরে পাওয়া যাবে।ওর মা তো কাদতে কাদতে শেষ। মিলিই উনার প্রথম সন্তান।রাতে ৩ টার দিকে কাদতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল উনার খেয়ালই ছিল না। স্বপ্নে তিনি দেখলেন মিলি একটা দোলনায় দোল খাচ্ছে আর ওর মাকে ডাকছে।তাকে অবাক করে দিয়ে কথা বলে উঠলো মিলি।বললো,
–মা তুমি একদম দুশ্চিন্তা করো না।আমায় সকালে এলাকার বড় বাশবাগানের সবচেয়ে উচু বাসটার উপর পাবে।আমি একদম খুশি আছি।আমি অনেক খেলেছি।
তারপর হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গেলো মিলির মায়ের।উঠে দেখলেন ফজরের আজান হচ্ছে। স্বপ্নের কথা মনে আসতেই তিনি পাশে ঘুমিয়ে থাকা তার হাজবেন্ডকে ডেকে তুললেন বেস্তসমস্ত হয়ে।
উনার স্বামীকে জাগিয়ে তুলে সব খুলে বললেন স্বপ্নে দেখা কথাগুলো।তিনি প্রথমে নেহাত স্বপ্ন বলেই এড়িয়ে গেলেন কিন্তু স্ত্রীর পীড়াপিড়িতে একবার তার সন্দেহ দূর করার জন্যই এলাকার সবাইকে নিয়ে এখানে এসে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হোন।
আস্তে আস্তে যতই বড় হচ্ছে মিলির সমস্যাগুলো ততই বাড়তে থাকলো।সে একা একা খেলা করে উপরের দিকে তাকিয়ে যেনো কেউ ওকে খুব মজা দিচ্ছে।ওর মা রান্না করার সময় ও একাই থাকে কিন্তু কখনো ওর মা ওকে কাদতে দেখেনি,যদিওবা কেদেছে তবে সেটা ৩০ সেকেন্ডের বেশি বলে উনার মনে পড়ে না।উনি রান্নাঘর থেকে উঠে আসতে আসতেই কান্না হাওয়া,উনি এসে দেখতেন মিলি হাসছে আর খেলছে।আর রাতে মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যেতে থাকে ঘর থেকে।যখনই কান্না করতো তার পর আর ওকে পাওয়া যেতো না ঘরে বা ঘরের আনাচে কানাচে কোথাও।তারপর আবার আগের মতোই স্বপ্নে ওর মা দেখতে পেতো ওকে, স্বপ্নে মাকে বলে দিতো ও কোথায় আছে আর সকালে আশ্চর্যজনকভাবে সেখানেই পাওয়া যেত।ব্যাপারটা আস্তে আস্তে এলাকার সবাই জেনে যায় আর সবাই ওকে ভুতুড়ে মেয়ে বলতে থাকায় ওর বাবা নিজের চাকরির বদলি করিয়ে শহরে চলে আসে ৬ মাসের মিলি এর ওর মাকে নিয়ে।কিন্তু শহরে আসার পর ঘটতে থাকে আরেক ঝামেলার ঘটনা।মিলিকে এমন পাওয়া যেতো না তারপর ওর মা স্বপ্নে দেখতো ও কোনো একটা শিশু পার্কে আছে,খুব মজা করছে,খেলছে,দৌড়াদৌড়ি করছে অথচ মিলি কিন্তু ঠিকমতো বসতেও পারে না।
ওর বাবা মা অনেক কবিরাজও দেখিয়েছেন কিন্তু কোনো লাভ হয় নি।কোনো তাবিজ মিলির হাতে কয়েক ঘণ্টার বেশি থাকতো না।তারপর সেই তাবিজ যে কোথায় হারাতো তা হদিস পাওয়া যেতো না।আর কবিরাজরাও বলেছেন এই কাজ তাদের দ্বারা সম্ভব না যদি বাড়াবাড়ি করে তাহলে মিলির বা উনাদের পরিবারের ক্ষতি হতে পারে।অনেক চেষ্টার পরও যখন এসব হয়েই চলছিল তখন উনারা ভাবলেন যেহেতু মিলির কোনো ক্ষতি হচ্ছে না তাই এসব নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করাই ভালো।
দিনদিন যেনো উৎপাত বেড়েই চলছে।মালিহা বেগম আর জারিফ খান উনাদের প্রথম সন্তানটা নিয়ে এতই চিন্তিত ছিলেন যে আর বাচ্চা নেবার কথা তারা ভাবেন নি।কিন্তু মেয়েকে কাছে পেতেন খুবই সামান্য।সারাদিন মেয়ে তাদের একা একাই খেলতো আর ঘরময় ঘুরে বেড়াতো আর বাহিরে ঘুরা তো আছেই ২/৩ দিন পর পর রাতে!১ বছরের বাচ্চাকে সাধারণত হাত ধরে হাঁটা শিখাতে হলো কিন্তু মিলির ব্যাপারে উনারা বাবা মা হিসেবে সেক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখার সুযোগ পান নি,কে যেনো মিলিকে হাত ধরে হাঁটতো তা উনারা স্পষ্ট টের পেতেন।কারণ মিলি পড়ে যাওয়া ধরেও আবার নিজে নিজেই কিভাবে যেনো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যেতো যেনো কেউ ওকে ধরে ফেললো মালিহা বেগম আর জারিফ খানের এসব চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না কারণ উনারা ধরলেই খুব কান্না জুড়ে দিতো মিলি,এমন সে কান্না যা থামানোই যেতো না।এমনি একদিন মিলি একা একা হাসছিল আর হাঁটছিলো আবার পড়ে যেতে নিয়েও উঠে দাড়াচ্চিল।মালিহা বেগমের খুবই কষ্ট লাগতো নিজের মেয়েকে আদর করতে না পারার কারণে তাই তিনি আজ ওকে কোলে তুলেই নিলেন কিন্তু প্রতিদিনের মতো মিলির কান্না সত্বেও ওকে ছাড়ছিলেন না।মিলির একসময় কাদতে কাদতে হীচকি উঠে গেলো।জারিফ খান এসে জোর করে উনার হাত থেকে মিলিকে ছাড়িয়ে আগের মতোই ছেড়ে দিলেন।আর সাথে সাথে মিলির কান্না হাওয়া।উনারা খুবই হতাশ হচ্ছিলেন এসব দেখে দেখে।সেদিন রাতে ঘুমের মাঝে মালিহা বেগম স্বপ্নে দেখলেন খুব ঘন কালো অন্ধকার একটা রুম থেকে একটা গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসছে,কন্ঠটা কি বলছে তা কিছুই মালিহা বেগমের বোধগম্য হচ্ছে না তবে আরবীতে কথা বলছে তা তিনি স্পষ্টই টের পাচ্ছেন।তারপর হঠাৎ খাটি বাংলায় বলতে লাগলো,
–মিলিকে জোর করে ভালো করিস নি,আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।১ মাস আগে তোরা ওকে আর পাবি না।
আর ইবাদতে কখনো ফাঁকি দিস না।
কণ্ঠটায় স্পষ্ট রাগ ফুটে উঠছে।হঠাৎ সেই আওয়াজটা বিলীন হয়ে গেলো আর সাথে সাথে ধরফড়িয়ে উঠলো মালিহা বেগম।কিন্তু পাশ ফিরে দেখলো মিলি নেই!!
সেই রাতে অনেক খুঁজলেন কিন্তু কোথাও পাওয়া গেলো না মিলিকে।উনি বুঝে গেলেন যে সত্যিই ১ মাস আগে মিলিকে আর পাওয়া যাবে না।শোকে শোকে পাগল প্রায় হয়ে গেলেন তিনি।ওই রাত থেকে উনারা কখনো নামাজ রোজা বা কোনো ধরনের ইবাদতে অবহেলা করতেন না।
মিলির হারিয়ে যাওয়ার ১৫ দিন পেরিয়ে গেলেও আর খুঁজে পাওয়া যায় নি।কবিরাজ,পুলিশ কোনো কিছুই বাদ রাখেন নি উনারা।শেষে আরেকটা বাচ্চা নেবার সিদ্ধান্ত নেন।ঠিক ৩০ দিনের দিন রাতেই আবার স্বপ্নে মিলিকে দেখতে পান মালিহা বেগম।
–”মা আমার বোনটা ভালো আছে তো??তুমি ওর খেয়াল রাখো তো?আমি কাল চলে আসছি আর তোমার কোনো টেনশন নেই বোনকে নিয়ে।
আমায় কাল সাফারি পার্ক থেকে এসে নিয়ে যাইও মা।”
স্বপ্ন দেখার পর প্রতিবারের মতো এইবারেও ঘুম ভেঙে যায় মালিহার।তিনি ঘুম থেকে উঠেই ক্যালেন্ডার দেখতে ছুটলেন।যদিও ৩০ দিন পার হবার অপেক্ষাতেই দিন গুনছিলেন তবুও ক্যালেন্ডার দেখে সিউর হতে চাইলেন। হ্যাঁ,একদম পাক্কা ৩০ দিন।মিলি হারিয়েছিল ২৫ আগস্ট আর আজ ২৫ সেপ্টেম্বর!!আর আরেকটা বিষয় খুবই অবাক হলেন সেটা হলো উনি যে প্রেগনেন্ট তা উনি নিজেই জানেন না অথচ স্বপ্নে মিলি বলে দিলো বোন কেমন আছে!!!
পরদিন উনারা সাফারি পার্কে গিয়ে ১৪ মাসের মিলিকে আবিষ্কার করে পার্কে একটা গাড়িতে বসে থাকা অবস্থায়।উনাদের দেখেই বড়োদের মতো হেসে উঠলো মিলি।উনারা সিকিউরিটি গার্ডদের জিজ্ঞেস করেও এই বাচ্চাকে কে রেখে গেছে তার কোনো হদিস পেলো না।
মিলিকে বাসায় নিয়ে এলো জারিফ খান আর মালিহা বেগম।কিন্তু এইবার মিলির মাঝে কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিলো আর সেটা হলো ও নিজের বাবা মায়ের সাথে খুব ভালো মিশতে থাকে,একটা স্বাভাবিক বাচ্চার চাইতেও বেশি বন্ধুত্বপূর্ন ভাবে।কিন্তু ১৪ মাস হয়ে যাওয়ার পরও ও এখনো বাবা,মা,নানা,দাদা বা অন্যান্য শব্দগুলো যেগুলো স্বাভাবিক বাচ্চারা উচ্চারণ করে সেগুলোর কিছুই বলে না।তবে একটা জিনিস বলে শুধু একটা নাম আর সেটা হলো “ইহান”।
কি আশ্চর্যের বিষয় একটা বাচ্চা নিজের বাবা মা নানা দাদা দাদু নানু এসব কিছুই না বলে বলে কিনা একটা ছেলের নাম! ইহান!!!
এর কিছুদিন বাদেই মালিহা বেগম আর জারিফ খান ডাক্তারের স্মরনাপন্ন হন আর আশ্চর্যজনকভাবে আলট্রাসোগ্রাম করে জানা যায় মালিহা বেগম মা আর চলেছেন,২ মাসের অন্তঃসত্ত্বা!!এখন শুধু আর কয়েকটা মাসের অপেক্ষা এটা দেখার জন্য যে তিনি সত্যিই কি কন্যাসন্তানের মা হতে যাচ্ছেন কি না!
মালিহা বেগম হঠাৎ তার কোলে থাকা মিলির দিকে তাকিয়ে লক্ষ করলেন মিলি উনার দিকে তাকিয়ে হাসছে,যেনো অভিনন্দন জানাচ্ছে!এই হাসি মোটেও কোনো ১৫ মাসের বাচ্চা মেয়ের হাসির মতো মনে হচ্ছে না,মনে হচ্ছে একটা প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে যেনো!
মিলি এখন বাসায় ওর মা বাবার সাথে খেলাধুলা করে কিন্তু যখনই একা থাকে তখন যেনো অন্য একজনের সাথে তার খুনসুটি, ঝগড়া,দুষ্টুমি,খেলা এসব চলতেই থাকে এটা স্পষ্ট খেয়াল করেন মালিহা বেগম।কিন্তু এখন আসা অব্দি আর হারিয়ে যায় নি ও।

চলবে কি?

#রহস্যের কুয়াশা☠️
#পর্ব–২
#হাফসা ইরিন রাথি
মিলির বাবা মা ঈদের ছুটিতে ওকে নিয়ে ওর নানুর বাসায় গেলো লক্ষ্মীপুরে। মিলি একদিন উঠোনে হাঁটছিলো আর বরাবরের মতোই ও হাত উচু করে হাঁটছিলো যেনো কেউ হাতটা ধরে রেখেছে।হঠাৎ একটা কুকুর কথা থেকে এসে ঘেউ ঘেউ করে পুরো মাথায় তুলতে লাগলো মিলির দিকে তাকিয়ে।মিলি কুকুরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খিল খিল করে হাসছে।ওর মা দরজার সামনে বসে বসে সব দেখছিলেন।তিনি খেয়াল করলেন কুকুরটা মিলির চারপাশ ঘুরছে কিন্তু ঠিক অনেকটা দূরত্ব রেখে একটা চক্রের মতো করে।কুকুরের আওয়াজ আর চেঁচামেচি শুনে বাসার সবাই চলে এসেছে।মিলির মা মালিহা বেগম কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে তার মেয়েকে বাঁচানোর জন্য কুকুরের হাত থেকে,বাসার সবাইও কুকুর তাড়াতে ব্যাস্ত কিন্তু যার জন্য এতোসব সে খিল খিল করে হেসেই চলেছে যেনো খুব মজা পাচ্ছে।
সবাই বুঝতে পরে যে মিলির সাথে কিছু অস্বাভাবিক জিনিস আছে,ভূত বা জ্বীন জাতীয় কিছু।ওর নানু ওকে একটা কবিরাজের কাছে নিয়ে গেলেন কিন্তু তখন ও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেলো।কবিরাজ কিছুই করতে পারলো না বলে একটা হুজুরের কাছে নিয়ে গেলো।হুজুর অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললেন যে মিলির সাথে একটা ছেলে জ্বীন থাকে।তিনি জ্বীন হাজির করার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করলেন। হঠাৎ দেড় বছরের মিলি সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে খুব সুন্দর মিষ্টি গলায় সালাম দিয়ে উঠলো।
–আসসালামুয়ালাইকুম

–তুমি কে এখানে কেনো এসেছো??
হুজুর সালমার জবাব না দেওয়ায় আবারো সালাম দিলো মিলির মধ্য থেকে সেই আওয়াজটা।
–আস সালামু আলাইকুম

–ওয়া আলাই কুম আস সালাম।

–আমি একটা জ্বীন আর আমি ওর(মিলি) জন্য এসেছি এখানে।যতদিন ও আছে,আমিও থাকবো।আমাকে তাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করবেন না।আমি তো কারো কোনো ক্ষতি করছি না।
হঠাৎ ঘরের জ্বালানো সবগুলো মোমবাতি এক ঝটকায় নিবে গেলো।আর ঘরের চারপাশে যেনো তাণ্ডব চলতে লাগলো।হুজুর বুঝতে পারলেন এই জ্বীন খুবই শক্তিশালী তাই তিনি এই কাজ করতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিলেন।
–আপনারা এই জ্বীনকে তাড়ানোর চেষ্টা না করলেই ভালো করবেন।আমার এই ব্যাপারটা অন্যান্য ব্যাপার থেকে আলাদা মনে হচ্ছে।এখানে কোনো একটা রহস্য আছে আমি তার স্পষ্ট গন্ধ পাচ্ছি কিন্তু আমি নিজের শক্তিতে তা জিজ্ঞেস করার আগেই সে চলে গেল।ও খুবই শক্তিশালী কিন্তু সেই সাথে অনেক আদব কায়দা সম্মন্ধিত একটা জ্বীন।তবে ওর কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করলে কারো ক্ষতি করতে পিছ পা হবে না।
তবে আপনাদের একটা বড় আলেম হুজুরের ঠিকানা দিচ্ছি,ওখানে গিয়ে চেষ্টা করতে পারেন।
হুজুর আলেমের ঠিকানা দিলেন।মিলির বাবা মা নানু ওকে নিয়ে সেই ঠিকানায় গেলো পরেরদিন কিন্তু সবাই জানালো হুজুর এখন দেশে নেই উনি একসপ্তাহ আগে সৌদি আরব উনার ছেলের কাছে গেছেন। মক্কা,মদিনা দর্শন আর সেখানে কিছু সমস্যা সমাধানে করে আসেতে বছর খানেক সময় তো লাগবেই।উনারা আশাহত হয়ে ফিরে এলেন।
মিলির বাবা মা ওকে নিয়ে কোথাও যেতো না তেমন,বাসায়টেই থাকতো উনার মেয়ের এমন সব সমস্যা হয় বলে।এভাবে কেটে গেলো আরো ৮ টা মাস।এরই মধ্যে মালিহা বেগমের আরেকটা মেয়ে জন্ম নিলো।উনি আর উনার স্বামী খুবই আশ্চর্য হলেন এই ভেবে যে স্বপ্নের কথাটা সত্যিই হলো!!কিন্তু এই মেয়ে হবার পর থেকে মিলি আগে ওর বাবা মার সাথে যতটা মিশতো এখন আর ততটা মিশে না যেনো অভাব পূরণ করার জন্য আরেকটা মানুষ আসতেই ও নিজেকে গুটিয়ে নিল।এখন মিলির বয়স ২ বছরের উপরে।মিলির মা ওর ছোট বোনকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকে বলে মিলিকে আগের মতো চোখে চোখেও রাখতে পারে না।মিলির কিন্তু কোনো সমস্যা নেই সে দিব্যি একা একাই খেলে,হাসে কথা বলে।মালিহা বেগমের ছোট মেয়ে মিতু হবার সময় উনার দেখবালের জন্য জারিফ খানের মা মানে মিলির দিদুন এসেছিলেন গ্রামের বাড়ি থেকে।কিন্তু ১ মাস না যেতেই উনি চলে যান কারণ মিলির দাদু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন।
একদিন মালিহা বেগম শুয়ে শুয়ে মিতুকে ঘুম পারাচ্ছিলেন তখন উনি ভুলে নিজের ওষুধ না খেয়েই ঘুমিয়ে যাচ্ছিলেন।কে যেনো উনাকে টানছে মনে হওয়ায় কাচা ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো।তাকিয়ে দেখেন মিলি ওষুধ আর একটা গ্লাসে পানি নিয়ে দাড়িয়ে আছে!একটা আড়াই বছরের বাচ্চা মেয়ে কিভাবে একটা গ্লাস আর ওষুধ নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে পারে সেটা মালিহা বেগমের মাথায় কাজ করছিল না।যে কিনা ঠিক মতো দাড়াতেই পারে না সে ওষুধ হাতে পানি হাতে দাড়িয়ে আছে উনাকে খাওয়াবে বলে!!!!
উনি তাড়াতাড়ি করে মিলির হাত থেকে ওষুধটা নিয়ে চেক করলেন।কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ওষুধটাও একদম ঠিক সেইটাই যেটা ডক্টর উনাকে খেতে বলেছেন,প্রেসক্রিপশনে লিখে দিয়েছেন।উনি অবাক চোখে মিলির দিকে তাকিয়ে দেখলেন মিলি উনার দিকে তাকিয়ে বাকা হাসছে!উনার শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো এসব প্রত্যক্ষ করে।
–মা,খা……(ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে)
মিলির মুখে এই প্রথম মা ডাক শুনতে পেলেন মালিহা বেগম। মা ডাকটা শুনে উনার সব ভয় চলে গেলো। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন।মিলি হাসি মুখে সব আদর মাথা পেতে নিলো।
মিলি আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে।ওই হুজুরের কথা উনাদের কারো আর খেয়াল ছিল না কারণ তেমন কোনো খারাপ ঘটেনি।মিলি যতই বড় হচ্ছে ততই অসম্ভব ধরনের সুন্দর একটা বাচ্চায় পরিণত হচ্ছে।যে একবার ওকে দেখবে কোলে নিতে/চুমু খেতে চাইবেই চাইবে।
মিলির বয়স যখন ৪ এ পড়লো তখন নিকটস্থ একটা স্কুলে ওকে ভর্তি করতে নিয়ে গেলো।
–তোমার নাম কি মামুনি??

–খাদিজাতুল রিদ!
স্যার বাচ্চা মেয়ের গলার আওয়াজ এতটা প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো শুনানোয় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে।মিলির বাবা মাও ওর কথা শুনে অবাক। স্যার তাড়াতাড়ি ফর্মটার চেক করলেন।কিন্তু সেখানে দেখতে পেলেন “মিলি জারিফ”।মিলির বাবা মাও একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে।
–মা তোমার নাম বলো টিচারকে।এটা কার নাম বলছো।

মিলি যেনো হঠাৎ কেমন মনমরা হয়ে গেলো।তারপর আবার স্বাভাবিকভাবে বাচ্চাদের মতো করেই বললো,
–মিলি জারিফ।

–আচ্ছা মিলি মামুনি,বলোতো আমাদের জাতীয় ফল কি?

–খেজুর।
আবারো সেই কণ্ঠস্বর শুনলো সবাই।হেডটিচার মিলির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন কিন্তু উনার কাছে হঠাৎ একটা ছেলে আসায় কথাটা চাপা পড়ে যায়।
–হ্যাঁ বলো রাজিব,কি সমস্যা??

–বাবা এই কয়টা প্রশ্নের আনসার পারতেছি না,প্লিজ হেল্প করো।

–প্রশ্ন গুলো বলো।

–বাংলাদেশে জাতীয় দিবস পালিত হয় কবে??

–৭ই মার্চ।২০২১ সালেই প্রথমবারের মতো ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ-কে জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়।

–পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্কতম পাখি কোনটি??

–উইজডম(এটা কোনো পাখির প্রজাতির নাম না,একটা পাখির নাম)।এই পাখিটির বয়স বর্তমানে ৭০ বছরেরও বেশি।এই পাখিটি মূলত একটি এলব্রাটস।এদের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো_এরা আজীবনের জন্য একটাই সঙ্গী বেঁচে নেয়।তবে সঙ্গীটি মারা গেলে আবার নতুন সঙ্গীর সন্ধান করে,আর বেঁচে থাকলে সারাজীবন তার সাথেই থাকে।(ব্যাপারটা আমার খুব স্পেশাল মনে হইছে)এরা কয়েক বছর পরপর মাত্র একটি করে ডিম পাড়ে।
আর সবচেয়ে বয়স্কতম আলব্রাটস মানে উইজডমের আগের সঙ্গীটি মারা যায় কিন্তু সে নতুন আরেকটা সঙ্গী খুঁজে পেয়েছে,বর্তমান সঙ্গীটির নাম একিয়াকামি।
প্রধান শিক্ষক অবাক হয়ে গেছেন এসব দেখে যে একটা ৪ বছরের বাচ্চা মেয়ে কিভাবে ভার্সিটি লাইনের পড়াগুলো ফটাফট বলে দিচ্ছে,যেনো তার চোখের সামনে সবটা দেখেছে শুধু মনে করে বলছে!!!!
রাজিব প্রধান শিক্ষকের ছেলে।ও ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রশ্নব্যাংক সলভ করছিলো। স্যার ওকে সাথে করে নিয়ে এসেছেন স্কুলে আর একটা রুমে পড়তে দিয়েছিলেন।বেচারা না পারলে বাবাকে না বলে উপায় নেই কারণ মোবাইলটাও নিয়ে নিয়েছে ওর বাবা।সব বাবা মায়ের হয়ত একই কথা পড়াশুনায় ছাড় নেই,মনোযোগ দিয়ে পর নাহলে রিক্সা কিনে দিমু!(?)
যাইহোক প্রধান শিক্ষক রাজিবের হাত থেকে নোটটা নিয়ে নিজেই আগ্রহের সাথে মিলিকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।
–বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণতম ব্যাক্তির নাম কি??

–১১৮ বছর বয়সি জাপানি নারী,নাম কানে তানাকা।তিনি ইতিমধ্যে ২ বার ক্যান্সারকে পরাস্ত করেছেন।

–Discovery আর Invention-এর মাঝে পার্থক্য কি??

–এই দুটো শব্দের অর্থই আবিষ্কার তবে অর্থগত পার্থক্য আছে।Discovery হলো এমন কোনো ধারণার আবিষ্কার করা যা পৃথিবীতে আগেই ছিল শুধু মানুষ খুঁজে বের করেছে।যেমন:কোনো প্রজাতি খুঁজে পাওয়া।কিন্তু…Invention হলো সেই আবিষ্কার যা মানুষ নিজের চিন্তাশ্রম দিয়ে তৈরি করে।যেমন:কম্পিউটার।
প্রধান শিক্ষক এইবার এমন পর্যায়ে চলে গেছেন যেনো মিলিকে হারানো উনার চ্যালেঞ্জ!তিনি একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন আর মিলি ঠান্ডা মাথায় নির্দ্বিধায় উত্তর দিয়েই যাচ্ছে।একসময় ক্লান্ত হয়ে প্রধান শিক্ষক মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।এটাকে উনি কিভাবে বিচার করবেন তার কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না।শুধু একটা কথাই বললেন মিলির বাবা মাকে।
–আপনাদের মেয়ে মনে হয় অনেক সাধারণ জ্ঞানের বই শেষ করেছে এই বয়সেই। সি ইজ এ সুপার ট্যালেন্টেড চাইল্ড!!
মিলির বাবা মা আর কথা বাড়ালেন না এই ব্যাপারটা নিয়ে।মিলিকে ক্লাসে দিয়ে বাসায় ফিরে এলেন উনারা।একই সাথে একটু হলেও ভিন্ন কণ্ঠস্বর শুনে উনারা চিন্তিত হয়ে গেলেন।তাই সেই হুজুরের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
মিলি বসে ছিল একা একটি বেঞ্চে।একটা ছেলে হয়ত ওর ১/২ ক্লাস বড় হবে,ওকে দেখছিল অনেকক্ষন যাবৎ।তারপর ওর সাথে একটু গল্প করার জন্য কাছে আসতেই ধপাস করে পড়ে গেলো নিচে!ছেলেটা পায়ে প্রচন্ড রকমের চোট পেলো।
(সেইদিন রাতে)
মিলির মা রান্না ঘরে রান্না করছেন,বাবা অফিস থেকে ফিরেন নি এখনো।মিলিকে মালিহা বেগম মিতুর কাছে বসিয়ে রেখে গেছিলো যাতে ওকে একটু সামলে রাখে।মিতু ঘুমিয়ে পড়ায় মিলি ওর পাশেই শুয়ে পড়লো।হঠাৎ ইহানকে দেখলো ওর পাশেই শুয়ে আছে।
–ইহান,আজকে তুমি ঐ ছেলেটাকে মারলে কেনো??

–তোমার কাছে আসছিল,তোমার সাথে ও খেলা শুরু করে দিতো তখন আমার সাথে তুমি খেলা আর খেলতে না।তাই মেরেছিলাম।

–আচ্ছা ইহান তোমায় মা,বাবা, বোন কেউ কেনো দেখতে পায়না??

–পায় তো।তোমার বোন দেখতে পায় আমায়।
আচ্ছা রিদ,তুমি কি আমায় ভালোবাসো??

–ভালোবাসা??সেটা কি ইহান??
ইহান মিষ্টি করে একটু হেসে বললো,
–বড় হলেই বুঝতে পারবে।

–তুমি আমায় রিদ নামে কেনো ডাকো??

–খাদিজাতুল রিদ!!
একটা মানুষের অনেক নাম হয় বুঝলে।আমি তোমার এই নাম দিলাম।তুমি এই নাম আর কারো সামনে বলো না,কেমন??
চলবে কি??
(মিলির সাথে কি সম্পর্ক ইহানের??খাদিজাতুল রিদ কে? মিলি কে কি এই অবস্থা থেকে স্বাভাবিক মানুষ করতে পারবে ওর বাবা মা??ভাবুন,ভেবে উত্তরটা দিয়ে দিন। রাথি অপেক্ষা করছে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here