রহস্যের কুয়াশা☠️ #পর্ব–৩,০৪

0
208

#রহস্যের কুয়াশা☠️
#পর্ব–৩,০৪
#হাফসা ইরিন রাথি
০৩

মিলি মাথা নেড়ে সায় দিল যে এই নাম করো সামনে আর বলবে না।মিলি ছোটবেলা থেকেই নিজের প্রতিটি মুহূর্তে,কাজে আশেপাশে ইহানকে এমনভাবে পেয়েছে যে এখন সবচেয়ে আপন বলতে ওকেই মনে হয়,মনে হয় নিজের অস্তিত্বের অংশ।খেলার সাথী,হাঁটার সাথী,ঘুরার সাথী,বিপদের সাথী এমনকি মিলিকে ঘুমও ইহানই পাড়িয়ে দেয়।
মিলিকে পরদিন ওর মা বাবা নিয়ে গেলো সেই হুজুরের কাছে।ভাগ্যবশত বাড়িতেই পায় উনাকে।হুজুরের কাছে সব খুলে বলেন উনারা।তিনি সব শুনে আসরে বসার সিদ্ধান্ত নেন জ্বীন হাজিরের জন্য।প্রয়োজনীয় যা যা দরকার তা নিয়ে পরেরদিন আসার কথা বলেন উনাদেরকে।মিলির বাবা মা ফিরে যায় বাসায়।



–কেনো গিয়েছিলে তুমি ঐখানে??
মিলি ইহানের এমন কান্না কান্না গলা শুনে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো।দেখলো ইহান চুপ করে চেয়ারে বসে আছে মাথা নিচু করে।মিলি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
–কোথায় ইহান??

–হুজুরের বাসায়।

–ঐটা তো ভালো জায়গা,ওখানে গেলে কি হবে ইহান??

–না কিছু হবে না।তবে যদি আমি হারিয়ে যাই!
মিলির মুখটায় অন্ধকার নেমে এলো ইহানের চলে যাওয়ার কথা শুনে।ছোটো হলেও এই কথাটায় ওর বুক কেপে উঠলো যেনো প্রিয়তমকে হারানোর আশঙ্কা!
মিলির নিষ্পাপ মুখটার দিকে তাকিয়ে ইহানের ভীষণ মায়া হলো।এসব নিয়ে ওকে কষ্ট না দিয়ে নিজেই যা করার করবে বলে ঠিক করলো। ইহান কথা পাল্টানোর প্রসঙ্গে বললো,
–চলো আমরা ঘুরতে যাই।

–কোথায়??(উৎফুল্লোভাবে)

–কোনো শিশু পার্কে??

–ইহান?

–কি হলো??(চিন্তিত হয়ে)

–তুমি শিশু পার্কে যাওয়ার কথা কেনো বললে??

–এমা তুমি তো সেই জায়গাটাই বেশি পছন্দ করো।আর বাচ্চারা তো সবাই সেখানেই যায়।কতো ধরনের খেলার জিনিস।

–ইহান আমি এখন আর বাচ্চাটি নেই যে আমি শিশু পার্কে গিয়ে খেলনা গাড়িতে চড়বো!!!
ইহান চোখ বড় বড় করে বললো,
–তুমি বুঝি বড় হয়ে গেছো?৪.৫ বছর বুঝি বড়??

–আমি ছোট হলে তুমিও ছোট।

–এক্সকিউজ মি,আমি তোমার চেয়ে অনেকটা বড়,মেপে দেখো হুহ

–বড়োজোর ২ বছর বড় হতে পারো।

–২০০ বছর!!!

–কিছু বললে??

– না বলিনি।চলো ঘুরতে যাই।আজ আমি একটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাবো তোমায়।
চোখ বন্ধ করো।

–কেনো??

–সারপ্রাইজ!

–ওকে
মিলি চোখ বন্ধ করলে ইহান ওর হাতটা ধরলো এরপর মিলির কাছে কেমন সব অন্যরকম লাগতে লাগলো।মিলি চোখ খুলে দেখে অনেকগুলো বাচ্চারা সাঁতার শিখছে একটা সুইমিং পুলে।
–এখানে কেনো এনেছো ইহান??

–এটা কেমন কথা হলো??এখানে তোমায় সাঁতার শিখাতে আনলাম।সাঁতার জিনিসটা জেনে রাখা খুব দরকার বুঝলে।নিজের প্রটেক্টর হয় এটা অনেক ক্ষেত্রে।

–আমার জানার দরকার নেই।

–কেনো??

–আমার তো তুমি আছো।তুমি সবসময় আমায় বাঁচিয়ে রাখবে সবকিছু থেকে।
একগাল হেসে মিলি কথাটা বললো। ইহান হতাশ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।মাঝে মাঝে মিলি এমন বড়দের মতো করে কথা বলে যে ইহানের সব বাঁধ ভেঙ্গে যায়,ওকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে কিন্তু তা যে সম্ভব না।
ইহান মিলির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিজেকে সামলে নিল।
–চলো নামো তোমায় সাঁতার শিখাবো।

–তোমাকে কেউ দেখছে না??

–হুম দেখছে।

–বাহ্ ইহান,তুমি তো খুব ভালো ম্যাজিক জানো।আমায় শিখাবে প্লিজ?

–আচ্ছা সে পরে দেখা যাবে এখন আমার হাত ধরে নামো তো।

–না আগে বলো শিখাবে।

–ওকে শিখাবো,এইবার তো আসো।
মিলিকে অনেকক্ষন সাঁতার শিখালো ইহান।ওর আজ মতলব হচ্ছে মিলিকে আজ বাসায় কিছুতেই যেতে দিবে না।বাসায় গেলে ওই আলেম হুজুর যদি কোনোভাবে ওকে তাড়িয়ে দেয়!!কিভাবে বাঁচবে ও ওর রিদকে ছাড়া!
|||••••|||||||
– হহেলো জজারিফ…

–তোমার গলা এমন শুনাচ্ছে কেনো??কোনো সমস্যা?(শঙ্কিত কণ্ঠে)
মালিহা বেগম কাদতে কাদতে বললেন,
–মিলিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আবার।

–কি বলছো কি?এতদিন তো কোনো সমস্যা হয় নি তাহলে হঠাৎ কি হলো!!!তুমি বাড়ির চারপাশ খুঁজে দেখছো তো ভালো করে??

–হ্যাঁ আমি ছাদে, গেটের সামনে,সারা বাসায় খুঁজেছি।সবার ফ্ল্যাটে গিয়েও জিজ্ঞেস করছি কিন্তু কেউ নাকি ওকে দেখেই নি।
জারিফ আমার মনে হয় আমরা হুজুরের কাছে যাওয়ায় জ্বীনটা এমন করছে।প্লিজ জারিফ আর ওখানে যাওয়ার দরকার নেই,প্লিজ।আমি শুধু আমার মেয়েকে সুস্থ দেখতে চাই,নিজের কাছে রাখতে চাই।
কাদতে কাদতে মালিহা বেগমের হিচকি উঠে গেছে।ফোনের ওপারে জারিফ সাহেব খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন।এর একটা পার্মানেন্ট সলিউশন চাই কিন্তু নিজের স্ত্রীর এমন অবস্থা দেখে কি বলবেন/ করবেন বুঝতে পারছেন না।
–মালিহা তুমি দুশ্চিন্তা করো না আমি এখনি আসছি বসকে বলে।

–প্লিজ তুমি তাড়াতাড়ি আসো।যেভাবেই পারো যেখান থেকে পারো আমার মেয়েকে এনে দাও প্লিজ জারিফ।
জারিফ সাহেব চিন্তিত হয়ে “হুম” বলে কলটা কেটে দিলো।কি করবেন বুঝতে পারছেন না তাই তাড়াতাড়ি বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলেন।
বাসায় এসে দেখলো রাত তখন ৮ টা বেজে গেছে।বিকেল ৪ টা থেকেই নিখোঁজ মিলি।মালিহা বেগম তখন রান্নার কাজে ব্যাস্ত ছিলেন আর আগের মতো এই হারিয়ে যাওয়ার সমস্যাটা মিলির হচ্ছে না দেখে তিনিও অনেকটা অবহেলা করেছিলেন সেই ব্যাপারটাকে,ভেবেছিলেন আর হবে না কিন্তু সারা বাসা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পায় নি।
জারিফ সাহেব প্রতিবারের মতো এইবারও মালিহা বেগমকে নিয়ে পুলিশ স্টেশনে গেলো মিসিং রিপোর্ট করার জন্য।সকালে হুজুরের কাছ যাবে বলে ঠিক করেছে।মালিহা বেগম প্রথমে রাজি হয় নি হুজুরের কাছে যাওয়ার জন্য কিন্তু অনেক বলে কয়ে রাজি করিয়েছে জারিফ সাহেব।
•••••|||||||||||||•••••••••
–ইহান,সন্ধ্যা হয়ে গেলো আর কতো সাঁতার কাটবো??বাসায় যাবে না??
ইহান চিন্তিত হয়ে গেলো মিলির কথা শুনে কারণ আগে মিলি ছোট্ট বাচ্চাটি ছিল বলে কখনো কোনো প্রশ্ন করতো না এসব নিয়ে কিন্তু অনেকদিন হলো মিলিকে কোথাও নিয়ে যায়না তাই আগের সব ভুলেও গেছে মিলি যে আগে ১ মাসও ও বাড়ির বাহিরে কাটিয়েছে ইহানের সাথে।
–আজকে তোমায় অনেক কিছু ঘুরিয়ে দেখাবো।আগে উপরে উঠো তোমায় নতুন কাপড় এনে দেই,ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার।

–না ইহান আমি আর ঘুরবো না।বাসায় যাই চলো।

–আচ্ছা আগে তো উঠো।
মিলি উঠলো ইহাণের হাত ধরে। ইহান মিলিকে নিয়ে একটা গাছের আড়ালে চলে গেলো।তারপর বললো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে।মিলি ১ মিনিট অপেক্ষা করতে না করতেই ইহান হাতে একটা সুন্দর সাদা গাউন নিয়ে এসে হাজির হলো। গাউনটা এতটাই ঝকমকে আর উজ্জ্বল ছিল যে মিলির চোখ দাধিয়ে গেলো।মিলি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো সেটার দিকে।মিলির এমন মুখের ভাব লক্ষ্য করে ইহান হেসে বললো,
–পছন্দ হয়েছে??
মিলি ইহানের হাত থেকে গাউনটা নিয়ে একপ্রকার লাফানো শুরু করে দিলো।মিলির পাগলামি দেখে ইহান খুব হাসছে।
–ইহান আমার এই ড্রেসটা অনেক অনেক অনেক পছন্দ হয়েছে।আমি এতো সুন্দর ড্রেস কখনো দেখিনি।

–আমি তোমায় ড্রেস দিয়েছি তাহলে এখন আমার সাথে যাবে তো ঘুরতে?তোমায় সমুদ্র দেখাবো,ওই যে বইয়ে দেখছিলা ঐটা।

–সত্যি!!!!!!(এক্সসাইটেড হয়ে)

–হুম যাবা??
মিলি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।আসলে মিলির কোনো আকর্ষণ নেই বাড়িতে যাওয়ার কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে আসায় কেনো জানি বাড়িতে যাওয়ার কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।আসলে আমাদের সমাজের মানুষেরা/মা বাবা ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের বিশেষ করে মেয়েদের মনে “সন্ধ্যার পর বাহিরে থাকা যাবেনা,রাতে তো কোথাও যাওয়া যাবেই না+ব্লা ব্লা ব্লা (etc)” এই কথাগুলো গেঁথে এমনভাবে গেঁথে দেয় যে তারা সেটায় অভ্যস্ত হয়ে যায়।আর মস্তিষ্ক সেটাই করার কথা চিন্তা করে।যাইহোক এতক্ষণ যদি মিলি বাসায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ছিল এখন সে ঘুরতে যেতে কতো সহজেই রাজি হয়ে গেলো। ইহান জানে মিলি সমুদ্র খুব পছন্দ করে।কারণ বইয়ের এই জিনিসটার ছবিই মিলি অনেক নিরীক্ষণ করে দেখে।
ইহান খুশি মনে মিলির হাত ধরে ওকে চোখ বন্ধ করতে বললো।মিলি চোখ খুলে নিজেকে একটা বাথরুমে আবিষ্কার করলো।
–তুমি চেঞ্জ করে নাও,আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি।
মিলি চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বললো,
–তুমিও থাকো না প্লিজ।এখানে আমার ভীষন ভয় লাগছে।
মিলি কথাটা বলে চারপাশ কেমন ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে দেখলো।অচেনা জায়গা বলেই হয়ত এমন হচ্ছে।কিন্তু মিলির কথা শুনে ইহানের তো চোখ কপালে। রিদ বলে কি!!আমি ওর সাথে থাকবো চেঞ্জ করার সময়!!পরমুহূর্তেই ভাবলো রিদ তো এখন ছোট তাই হয়ত বুঝতে পারছে না।
–আচ্ছা ঠিক আছে আমি এখানেই আছি।
ইহান অন্য দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে।এটা একটা শপিং মলের চেঞ্জিং রুম।
–হয়ে গেছে আমার।
ইহান তাকিয়ে দেখলো এ যেনো কোনো রূপকথার গল্পের পরী দাড়িয়ে আছে ওর সামনে।সাদা জ্বীন রাজ্যের পোশাকে সত্যি তাই মনে হচ্ছে,যে কারো কাছেও হয়ত তাই মনে হবে এমনটাই লাগছে ইহানের কাছে। ইহান মনে মনে ভাবছে রিদের সৌন্দর্য সেই আগের মতোই আছে,একটুও মলিন হয় এ!শুধু ছোটো হয়ে গেছে এই একটাই তফাৎ!
ইহান মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে মিলির হাতটা ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে এনে চোখ বন্ধ করতে বললো।মিলিও হেসে চোখ বন্ধ করলো।চোখ খুলে দেখলো সামনে শুধু বিশাল জলরাশি ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না।আনন্দে লাফাতে শুরু করেছে মিলি।বইয়ের দেখা সেই দৃশ্যটা থেকেও হাজার গুনে সুন্দর আর জীবন্ত লাগছে এখন সমুদ্রটাকে! হ্যাঁ এটাই সেন্ট মার্টিন!যদিও রাতে পানিগুলো নীল রঙের লাগছে না কিন্তু চাঁদের আলোয় পানিতে নীল রং আর চাঁদের রঙে মিলে একটা অসম্ভব সুন্দর চমক সৃষ্টি করেছে যা সত্যি দেখার মতো দৃশ্য।
–তোমার পছন্দ হয়েছে রিদ??
মিলি একগাল হাসি নিয়ে ইহানের হাত ধরে লাফাতে লাফাতে বললো,
–খুব খুব খুব পছন্দ হয়েছে ইহান!আমি একটু পানি ছুয়ে দেখি??
ইহান চোখ মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো।মিলি চাঁদের আলো পড়া পানিতে নিজের ছায়াটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।পানিতে কোনো ধরনের নড়াচড়া নেই যেনো পানি নয়,একটা সুবিশাল আয়না!মিলির কাছে সব স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।মিলি হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতে পানি ছড়াছড়ি করতে লাগলো।ভীষণ ভালো লাগছে ওর। ইহান মিলিকে নিয়ে একটা দ্বীপে আছে এখন।মাথার উপরেই চাঁদটা আলো ছড়াচ্ছে ওদের উপর।চারপাশটা যেনো ভেসে যাচ্ছে আলোয় আলোয়।কিন্তু আশপাশে কেউ নেই ওরা দুজন বাদে।যদিও সন্ধ্যা কিন্তু তবুও এখানে কেউ আসেনা বিশেষ করে রাতে।

চলবে কি??

#রহস্যের কুয়াশা☠️
#পর্ব–৪
#হাফসা ইরিন রাথি
মিলি আর ইহান পানি নিয়ে অনেকক্ষন খেলা করে এখন ওরা দ্বীপে বালি নিয়ে দুজনে আকাবুকি করছে আর খেলছে।মিলি বালি দিয়ে একটা দুর্গের বা বিল্ডিংএর মতো তৈরি করছে। ইহানও একটা কি একটা মসজিদ বানাচ্ছে। ইহান একটু পানি নিলো সমুদ্র থেকে বালি ভিজিয়ে নিতে যাতে করে বানাতে সুবিধা হয়।কিন্তু পানি ভুলক্রমে পড়ে গেলো মিলির তৈরি করতে থাকা বিল্ডিংটার গায়ে,আর যা হবার তাই হলো!বালির বিল্ডিং ধ্বসে গেলো!!
মিলি ক্রুর দৃষ্টিতে ইহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
–আমার এতো সুন্দর বিল্ডিংটা তুমি ভেঙ্গে দিলা??

–না আসলে……আমি তো ইচ্ছে করে….

–এ্যা……

–রিদ আমি ঠিক করে দিচ্ছি। তুমি এতো কান্নাকাটি করো কেনো সবসময়??
কিন্তু মিলি ইহানের কোনো কোথায় কর্ণপাত না করে কেদেই চলেছে। ইহান একটা মৃদু ধমক দিলো।
–চুপ,একদম কান্না করবা না।মাইর দিবো কিন্তু।
মিলি চুপ করে বসে আছে গাল ফুলিয়ে।আর ইহান মিলির তৈরি করা বিল্ডিংটা আবারো আগের মতো করে বানানোর চেষ্টা করছে।বানানো শেষ হতেই খুশি মনে মিলির দিকে তাকালো।কিন্তু একি!মাত্র একটু সময়ের ব্যবধানে ইহান মিলির দিকে তাকাতেই দেখলো মিলি ঘুমে ঢুলছে মাথাটা আরেকটু হলেই পড়ে যাবে বালিতে। ইহাণ নিজের হাতটা তরীগডি করে মিলির মাথার নিচে ধরলো যাতে ও পড়ে না যায়।সারাদিন এতো ধকলের পর একটা ৪.৫ বছরের বাচ্চা যে ৯/১০ টায় ঘুমিয়ে যাবে এটা আর আজব কি তাছাড়া প্রকৃতিটা এতটাই শান্ত আর মনোরম যে,যেকেউ ঘুমে তলিয়ে যেতে বাধ্য!
ইহান নিজের সব চিন্তার ইতি টেনে মিলিকে বুকে জড়িয়ে নিলো।কিন্তু এখন এইখানে তো আর সারারাত মিলিকে রেখে কষ্ট দিতে পারেনা।কোথায় যাওয়া যায় চিন্তা করতে করতে অবশেষে ঠিক করলো একটা রিসোর্টে বা হোটেলে নিয়ে গেলেই হয়।মিলিকে একটা হোটেলের রুমে নিয়ে গেলো ইহান।এই রুমটা এখনো ভাড়া হয় নি তাই চিন্তার কোনো কারণ নেই।বাহিরে থেকে বন্ধ আছে রুমটা। ইহান মিলিকে কোলে তুলে নিয়ে এসেছে,মিলির অবশ্য সেসবে খেয়াল নেই,ও আছে ঘুমের রাজ্যে।
মিলিকে একটা বালিশে শুইয়ে দিয়ে নিজেও ওর পাশে শুয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো ইহান।ও নিজের ঘুমন্ত রীদকে দেখছে আর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে এর চেয়ে শান্তির কোনো মুহূর্ত হতেই পারে হয়ত!যদিও প্রতিদিনই মিলিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ইহান নিজেই কিন্তু আজ একটু অন্যরকম লাগছে।লাগবে নাই বা কেনো?কতদিন পর আবার ঘুরতে বেরোলো নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে, তাও আবার এই পরীর মতো বেশে!আগে মিলির ছোট থাকা অবস্থায় ওকে ইহান নিয়ে যেতো ঠিকই কিন্তু তখন তো মিলি কিছুই বুঝতে না শুধুই হাসতো আর হাসতো খিলখিল করে।ওর ফুকলা দাঁতের হাসি অবশ্য দেখার মতোই ছিল কিন্তু এখন আরো বেশি ভালো হয়েছে ও কথা বলতে পারায়।মিলি একা কান্না করতো যখন রাতে তখন ওকে নিয়ে কতো জায়গায়ই না ঘুরেছে ইহান ওর কান্না থামানোর জন্য!
মিলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ওর ছোটবেলার কথাগুলো ভাবছে আর হাসি পাচ্ছে ইহানের।
••••••••••|||||||||••••••••••••
–”তোমার মেয়ের যদি ভালো চাও তাহলে আর হুজুরের স্মরনাপন্ন হইয়ো না।আর হ্যাঁ নামাজ,নামাজ কখনো বস দিও না।তোমার মেয়ে যেখানেই আছে ভালো আছে,কিন্তু খবরদার হুজুরের কাছে নিও না।নিজের মনকে মানাও যে ওকে নিয়ে আর ঐখানে যাবে না তাহলেই ওকে ফিরে পাবে।”

–দাড়ান দাড়ান যাবেন না।আমার মেয়ে!মিলি!
মালিহা বেগম ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলো।এটা কি দেখলো উনি?মিলিকে নিয়ে এই পর্যন্ত যত স্বপ্ন দেখেছে সব সত্যি হয়েছে তাই এটাও যে একটা সতর্কবার্তা তা খুব ভালোই বুঝতে পারলেন উনি।মাঝরাতে স্ত্রীর কান্নার শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেলো জারিফ সাহেবের।
–কি হলো মালিহা??তুমি কাদছো কেনো?

–জজারিফ, আআমার মেয়ে!

–প্লিজ শান্ত হও আমরা কাল সকালেই হুজুরের কাছে যাবো।সব…

–না না কিছুতেই না।কিছুতেই যাবো না আমি হুজুরের কাছে।আমার মেয়ের ক্ষতি হবে।প্লিজ জারিফ যাবো না,প্লিজ আমাকে একটু শান্তিতে বাঁচতে দাও আমার মেয়েদের নিয়ে।

–কি হইছে তোমার মালিহা?প্লিজ এমন করিও না।কি হইছে আমায় খুলে না বললে আমি কিভাবে বুঝবো।

–আ্ আমি আবারো সেরকম স্বপ্ন দেখেছি জারিফ।একটা লোকের কোলে আমার মেয়ে ছিল।লোকটার চেহারা আমি এইবারও দেখতে পারিনি।লোকটা বলছিলো যাতে করে আমি হুজুরের কাছে না যাই,গেলে আমার মেয়ের ক্ষতি হয়ে যাবে।আর নামাজের কথাও বলেছে।যদি ওর কথা মানি তাহলে নাকি আমাদের মেয়ে ফিরে আসবে খুব শীগ্রই।
জারিফ যা লাগে করো তবুও আমার মেয়েকে আমার কাছে এনে দাও।
কাদতে কাদতে কথাগুলো বললেন মালিহা বেগম। জারিফ সাহেব উনাকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন কিন্তু উনার চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।কি হচ্ছে,কি করণীয় তার কিছুই বুঝতে পারছেন না।স্ত্রীকে শান্ত করতে বললেন,
–তুমি কেদো না,আমরা যাবো না ঐখানে।চিন্তা করিও না।সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু আপন মনে ভাবলেন কিভাবে হবে ঠিক???
•••••••||||||||||••••••••
সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাড়িতে যাবে বলে বলে বায়না ধরেছে মিলি। ইহান বুঝে না মিলি কেনো এতটা পাল্টে যায়।কখনো বাড়িতে যেতে চায় না তো কখনো যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যায়।মন খারাপ করে ভাবলো,
–”নিশ্চয়ই আমার রীদকে মানুষ রোগে পেয়েছে!!!”

–ইহান চলো না বাসায় যাই।আমি বাসায় যাবো। এ্যাঁ……

–রীদ কি শুরু করলে বলোতো??তোমার কি খেলনা লাগবে বলো,আমি এনে দিবো।অনেকগুলো এনে দিবো।প্লিজ কান্না করিও না।

–আমরা একবার বাসায় যাই চলো।আমি তুমি আর মিতু মিলে খেলা করবো।চলো না।
ইহান মনে মনে ভাবলো হয়ত ওর বাবা মা ওকে নিয়ে আর যাবে না হুজুরের কাছে,তাছাড়া রীদের কান্না দেখতে ওর ভালোও লাগছে না খুব কষ্ট হচ্ছে তাই বাসায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলো।বাসায় যাবার পর কোনো সমস্যা হলে সেটা পরে দেখা যাবে।
–আচ্ছা আর কাদিও না।চলো তোমায় বাসায় দিয়ে আসি।আমি আর কখনো খেলবো না তোমার সাথে।তুমি আর মিতুই খেলিও।
চলো।
মিলি একগাল হেসে বললো,
–আমি জানি তুমি খেলবে আমার সাথে।

–কচু জানো।
নিজেই নিজের কাছে বিরক্ত হলো ইহান।সত্যিই তো প্রতিবারই রাগ করে বলে আসবে না,খেলবে না,চলে যাবে কিন্তু আবার ঠিকই চলে আসে।মাঝে মাঝেই মনে হয়,
–আচ্ছা রিদ কিভাবে পারে এমনভাবে ভুলে যেতে??
মিলি আর কিছু না বলে হাসছে ইহানের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে। ইহান মিলিকে চোখ বন্ধ করতে বললো মন খারাপ করে।মিলি জানে একটু পরেই ওর মন ভালো হয়ে যাবে,আবারো খেলবে,হাসবে তাই মন খারাপটাকে পাত্তা না দিয়েই চোখ বন্ধ করে ইহানের হাতটা ধরলো।চোখ খুলে দেখলো নিজের বিছানায় শুয়ে আছে মিতুর পাশে!বাবা মা গেলো কই??উকিঝুকি মেরে বেড রুম থেকে বের হতেই দেখলো ডাইনিং রুমে সোফায় মা বাবা চিন্তিত হয়ে বসে আছে।মিলি দৌড়ে ওদের কাছে গেলো হাসি মুখে।ওকে দেখে উনারা দুজনেই খুব খুশি আর অবাক হলেন কারণ আগেও এমন হয়েছে কিন্তু বাসায় নিজে থেকে এভাবে কখনো ফিরে আসেনি মিলি,যদিও তখন ছোট ছিল।
মালিহা বেগম মিলিকে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বললেন,
–কোথায় ছিলি মা তুই?কেনো এমনটা করিস বল?
মিলি ভাবলো কেমন করি আমি?? হাসি মুখে বললো,
–আমি তো ঘুরতে গিয়েছিলাম মা। ইহান আমায় অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গায় ঘুরিয়েছে,সাঁতার শিখিয়েছে।অনেক অনেক মজা হয়েছে।
ইহান নামটা আরো অনেক শুনেছেন উনারা দুজনেই তাই আর অবাক হলো না।উনারা ভেবে পায় না যে কে এই ইহান?আর কেনোই বা মিলিকে নিয়ে যায় কিন্তু কোনো ক্ষতি করে না উল্টে ওর সাথে খেলা করে,ওকে খুশি রাখে!!!
–চলো এখনই আমরা হুজুরের কাছে যাবো।এর একটা বিহিত করতেই হবে।
মালিহা বেগম চমকে গিয়ে আতঙ্কিত গলায় বললেন,
–না না না কিছুতেই না।কিছুতেই আমরা আর ঐখানে যাবো না।ঐখানে গেলে আমার মেয়ের ক্ষতি হবে।

–কিন্তু এভাবে আর কতদিন মালিহা??
তার চেয়ে আমাদের একবার হুজুরের….
উনাকে কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়েই মিলিকে কোলে তুলে নিয়ে বেড রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন মালিহা বেগম।জারিফ সাহেব অনেক ডাকাডাকি করেও লাভ না হওয়ায় তিনি হতাশা আর বিরক্তি নিয়ে আগেই অফিসের পথে পাড়ি জমালেন।উনি বুঝতে পারছেন না মালিহা কি করতে চাইছে।
মিলি আসা অব্দি এখনো ইহানকে দেখেনি। ইহান ওকে এখানে রেখেই চলে গেছে।মিলির উপর খুব রাগ হওয়ায়।মিলিকে নিয়ে মালিহা বেগম বিছানায় নিজের সামনে বসালেন।পাশেই ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট মিতু।মিলি আশেপাশে তাকিয়ে ইহানকে খুঁজছে।
–মিলি….
হঠাৎ এভাবে ডাক পড়ায় চমকে উঠলো মিলি।সামনে ওর মা বসে আছে অথচ ওর খেয়ালই নেই।মিলির মা এতক্ষণ ও কি করছিলো তা ভালো করে নিরীক্ষণ করছিলো।
–তুমি খুজছো মিলি??

–ইহান, ইহানকে খুঁজছি মা।

–কে এই ইহান??তোমার মনের ভুল সব, ইহান বলতে কেউ নেই মিলি।এই বাড়িতে আমি,তুমি,মিতু আর তোমার বাবা ছাড়া কেউ থাকেনা।

–না মা তুমি জানো না। ইহান আছে। ইহান খুব ভালো।ও আমার সাথে খেলে।

–কেমন দেখতে সে??

–ইহান খুব মিষ্টি দেখতে।জানো মা ইহান আমার চেয়ে একটু বড় হবে,কিন্তু সে এটা মানতেই চায় না।হা হা হা।
এইবার আবার আরেক চিন্তায় পড়লেন মালিহা বেগম।কারণ এতদিন ভাবতো এই ইহান হয়ত বড় কেউ যাকে উনি স্বপ্নে দেখেন কিন্তু মিলির ভাষ্যমতে ইহান ওর সমবয়শী!!
–মিলি তুমি আর কখনো ইহানের সাথে কোথাও যাবে না।মা বাবাকে ছেড়ে কেনো যাও বলোতো??আমাদের বুঝি কষ্ট হয় না?
মিলি চুপ করে মায়ের বাহুতে আটকে রইলো,ছাড়ানোর কোনো চেষ্টাই করলো না। ইহানকে ছাড়া যে ওর দিন কাটেনা, ইহানকে ছাড়া যে খেলা জমে না, ইহান যে ওর জন্মসূত্রে পাওয়া একজন সেটা কিভাবে অস্বীকার করবে?কিভাবে মাকে বুঝাবে?ও ছোটো বলেই হয়ত বুঝাতে পারছে না,কিন্তু চিন্তাগুলো মাথায় কিভাবে আসছে সেটাও বুঝা যাচ্ছ না।জন্মের পর থেকেই প্রতিটি কাজে এমনভাবে ইহান জড়িয়ে গেছে যে ওকে ছাড়া সব ফাঁকা,শূন্য,অসম্ভব হয়ে পড়ে।ওর সাহায্য ছাড়া কোনো কাজই সম্পূন্ন হয় না!!!

চলবে কি?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here