রাকা(১৭)

0
632

রাকা(১৭)
ফারজানা রহমান তৃনা

দরজার সামনের এই দৃশ্য আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন মহিলা। যে সম্পর্কে আমার বড় বোন হয়।
কিন্তু সমস্যা হলো তাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে না সে আমার বোন হয়। এটা কি সত্যিই আমার সেই স্টাইলিশ, ফ্যাশনদুরস্ত বোন, তানিশা?
না অন্য কেউ!
তার হাতে একটা বড় ব্যাগ।
সেই ব্যাগে কিছু আছে বলে মনে হয়না।
শুধু শুধুই এই এত বড় ব্যাগ বহন করে নিয়ে আসার অর্থ ও বেমালুম।

স্বাভাবিকভাবে,আমার তাকে দেখেই কেঁদে দেওয়ার কথা। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে মরা কান্না জুড়ে দিবো-এমনটাই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু আমার শুধু শরীরের কম্পন ব্যতীত আর কোনো উপদ্রব দেখা গেলো না।
যেন এটাই স্বাভাবিক।
আমি করুন কন্ঠে বললাম,
– আপু, ভালো আছিস?
সে টান টান চোখে উত্তর দিলো,
– ভালো আছি। তুই? ভেতরে ঢুকতে দিবি তো নাকি?
– ও হ্যাঁ হ্যাঁ আসো!
তানিশা আপু তার হাতের এই বস্তা টাইপ ব্যাগটা আগে ভেতরে রাখলো।
আপু ভেতরে ব্যাগ রাখছিলো তখন আমি দরজা আটকাতে গেলাম। দরজা আটকানোর সময় অত খেয়াল ছিলো না কিছুরই।

আচমকা আপু চেঁচিয়ে উঠে বললো,
– ওমা! রাকা, কী করছিস!
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম,
– কী করছি! দরজা আটকাচ্ছি!
সে ব্যস্ত হয়ে আমার সামনে এসে বিরক্তি নিয়ে বললো,
– তোর চোখে কি ছানি পড়ছে? তুই বাইরে দেখোস না তোর দুলাভাই দাঁড়ায়ে আছে? একটাবার তো ভালোর খবর ও নিলি না,তার উপর ওর মুখের উপর দরজা দিয়ে দিচ্ছিস!
আমি তাজ্জব বনে গেলাম। আমার দুলাভাই নাকি বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। কই আমি তো আমার দুলাভাইয়ের মত কাউকে দেখছি না। অদ্ভুত তো!

জিজ্ঞেস করলাম,
– কই আপু? আমি তো দেখতেছি না। কোথায় উনি? তুই বিয়ে করেছিস? কবে?
আপু রাগে গিজগিজ করতে করতে বললেন,
– আজব। তুই বোকাই থাকবি আজীবন।
এই তুমি ওখানে দাঁড়ায়ে আছো ক্যান? আমার বোন তো তোমাকে দেখতেছে না। এদিকে আসো!

দুলাভাই সাহেব টগবগ করতে করতে চলে এলো আমার সামনে।
হাতে বিড়ি। গলায় নকল রুপার চেইন।
চুলের মাঝখানে ঠেঁসে ঝুটি বাঁধা।
এটাতো সেই ছেলেটা!
যার ছবি একদিন আমাকে দেখিয়ে আপু
জিজ্ঞেস করছিলো, ছেলেটা দেখতে কেমন।
আমি বোধ হয় বলেছিলাম, জঘণ্য।

তোঁতলাতে তোঁতলাতে জিজ্ঞেস করলাম,
– আপু, এ_এ_এইটা আমার দুলাভাই?
– হুম। ওকে নিয়ে ভেতরে আয়। আমি রান্না চাপিয়েই গোসলে যাবো। বুঝলি?

আপু ভেতরে চলে গেলো।
দুলাভাই বিড়ি টানতে টানতে ভেতরে ঢুকলো। আমি দরজা আটকে আমার রুমের দিকে রওনা হলাম।
দুলাভাই পিছন থেকে বললো,
– নাম কী তোমার? রা_ক্কা? উফ, কি নাম রে ভাই! একজনের নাম তান-ঈশা,আরেকজনের নাম রা_ক্কা!
যত্তসব ফালতু নাম রাখছে শ্বশুর আব্বা।

আমি চোখ ঘুরিয়ে একবার তাকিয়ে আবার ফিরিয়ে নিলাম।
সে এবার আমার সামনে এসে ধুঁয়া ছাড়লো, একদম আমার মুখের উপর।
তারপর বললো,
– রাকা, শালিকা আমার! যাও! টেবিলে তাড়াতাড়ি খাওন দেও। খুব ক্ষিধা লাগছে।

আমি জবাব না দিয়ে জোর পায়ে হেঁটে চলে এলাম।
ভাবতেই অবাক লাগছে, এরকম একজন অসভ্য, রুচিহীন,বাজে লোককে আমার তানিশা আপু বিয়ে করেছে!
বাসায় কোনোপ্রকার রান্না নেই।
ডিম ভাজা দিয়েই পার করছি কিছুদিন,কারণ রিমা খালা আসছে না ইদানিং।
ছুটা বুয়ার ও খবর নেই।

তানিশা আপু নিজে ফ্রিজ থেকে মাছ,মাংস নামিয়ে এনে রান্না চাপিয়ে দিলো। ওদিকে দুলাভাই সাহেব ড্রয়িংরুমে বসে ফুল স্পিডে পাখা ছেড়ে,হাই ভলিয়্যুম দিয়ে হিন্দি গান দেখছে। পেট,পিঠ দেখানো কি বিশ্রী নাচ! এসব বিনা দ্বিধায় সে আমাদের সামনেই দেখছে।
আপু কিছুই বললো না।
সে আপন মনে কাটাকুটি করে যাচ্ছে।
তাকে দেখতে দেখতেই আমি ব্যস্ত।
কি পরিবর্তন হয়েছে তানিশা আপুর!
মোটা হয়ে গেছে অনেক!
একদম আমাদের মা-খালার মত গড়ন হয়েছে।
চুলে এলোমেলো করে খোপা করা।
মাথাভর্তি তেল। বিদঘুটে গন্ধ সেই তেলের।
কে জানে হয়তো কেরোসিন হবে ওটা!

আমি আমার ড্রয়ার থেকে কয়েকটা শ্যাম্পু নিয়ে আপুর কাছে গেলাম।
জিজ্ঞেস করলাম,
– আপু, গোসলে যা তুই। আমি দেখি এগুলো।
তানিশা আপু নাড়ানো বন্ধ করে দিলো সাথে সাথে। তারপর বললো,
– কেন রে? আমার গায়ে দুর্গন্ধ খুব,তাইনা? সহ্য হচ্ছে না তোর?
– ওমা! এসব কি বলিস! তুই_ই তো বললি রান্না চাপিয়ে গোসলে যাবি। তাই বললাম।
– ওহ্। তো আব্বু কেমন আছে রে?
– ভালোই।
– কখন আসবে?
– ঠিক নাই। বিকেলেই আসতে পারে। দেরীও হতে পারে।
সে তীক্ষ্ণাগ্র কন্ঠে বললো,
– তোর দুলাভাইকে তোর পছন্দ হয়নাই, আমি জানি। কিন্তু কিছু বলিস না। যেমনই হোক, ও এখন আমার হাজবেন্ড। আর এটাই আমার কপাল। তাই ওর ব্যাপারে আমাকে আর কিছুই বলবিনা। ঠিক আছে?
– ঠিক আছে।

আপু আমার দিকে ফিরে কথা বলছে দেখে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, সে আসলেই মাত্রাতিরিক্ত মোটায়ে গেছে। চোখ ফুলে গেছে।
কাজের বুয়া,খালাদের মত তেলমাখা চুলের মাঝখানে সিঁতা করে খোপা করা।
আমি রীতিমত অবাক হচ্ছি তাকে দেখে।
এক ফাঁকে বলেই দিলাম,
– আপু, তুই খুব চেইঞ্জ হয়ে গেছিস! এত মোটা হয়ে গেলি কিভাবে?
আপু হেসে উড়িয়ে দিলো কথাটা।
বললো,
– বিয়ে হয়ে গেলে সবাই ই মোটা হয়ে যায়! হিহ্ হি!
– কেন কেন? বিয়ে হলেই কেন মোটা হয়? আমি ও তো মাঝারি সাইজের মোটা। আমার তো বিয়ে হয়নাই। তাহলে? আমি বললাম।
– ধুর তুই এখনো খুব অবুঝ। এগুলা এখন বুঝবি না! এগুলা বুঝতে হলে অনেক জানতে হবে।
আরো বড় হতে হবে। বিয়ে করতে হবে।

আপু আমার ৩/৪ বছরের বড় হবে।
অথচ তার ভাষ্যমতে, আমি একজন কচি খুকি আর সে একজন মধ্যবয়স্কা।
এমন সময় ড্রয়িংরুম থেকে চেঁচিয়ে উঠলো দুলাভাই।
– তানিশা, ঐ বেয়াদবের বাচ্চা, আর কহন খানা দিবি তুই? পেটের আতুড়ি সব শুকাই গেলে দিবি? হারামজাদি কোথাকার!
আমি আচমকা এসব গালিগালাজ শুনে হকচকিয়ে গেলাম!
এসব কি বলছে লোকটা!
আপু কোনোমতে তার মুখের লাগাম ধামাচাপা দিতে দৌঁড়ে চলে গেলো তার কাছে। গিয়ে কিসব যেন বললো, তারপর লোকটা চুপ করলো।
আপু আবার আমার কাছে ফিরে এসে বললো,
– রাকা, তুই শুধু নাড়া। লবণ হইছে কিনা দেখিস। না হলে এক চামচ দিয়ে দিস। আর ভাত ফুটলে ঢাকনা সরিয়ে আঁচ কমিয়ে দিস। আমি ১০মিনিটের মধ্যে গোসল সেরে আসতেছি। তুই কষ্ট করে দেখ একটু।
বলেই সে দৌঁড়ে বাথরুমে চলে গেলো।

যে তানিশার গোসল সারতে ঘন্টা দুয়েকেও পোষায় না, সে এখন ১০মিনিটের মধ্যে গোসল সেরে আসবে বলছে। যাকে কেউ সাধারণ কিসিমের ১টা কথা ছোঁয়ালেও সে ১০টা শুনায়ে দেয়, সে আজ বিনা কারণে তার স্বামীর কাছ থেকে একগাদা গালিগালাজ শুনেও কিছু না বলে নিচু গলায় কি কি যেন বলে,বুঝিয়ে ফিরে আসলো!
এসব কিভাবে সম্ভব, আমার জানা নেই।

আব্বুকে ফোন দিতে যাবো, তখনই দেখি দুলাভাই সাহেব আমাদের ড্রয়িংরুমের ফ্রিজের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন করছেন। উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম কি করে। সে ফ্রিজ খুলে অবলিলায় যা পাচ্ছে,তাই খাচ্ছে। এমনভাবে খাচ্ছে যেন তার বাবার জন্মে ও সে এত খাবার চোখে দেখেনি।

সে খাওয়া শেষ করে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো সোফায়। ততক্ষনে তানিশা আপু বেরিয়ে রান্নার কাজে লেগে পড়েছে।
সে বিদ্যুৎের গতিতে কাজ করছে আর মাত্রাতিরিক্ত হাঁপাচ্ছে।
এত হাঁপাচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না।
আমি গিয়ে হাতে হাত লাগাতে চাইলাম।
সে মানা করে দিলো। বললো,
– তুই যা। তোর দুলাভাইয়ের সাথে বস গিয়ে। আমি এগুলা একাই করতে পারবো। আর বেশিক্ষন লাগবে না। এটা ওটা বলে ১৫ মিনিট ভুলায়ে রাখ। ওর আবার একটু রাগ বেশি তো! আমি সব রেডি করছি। আর একটু!

আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম,
– কী দরকার? তার এখন পেট ঠান্ডা। মাথাও ঠান্ডা।
– মানে?
– সে নিজেই ফ্রিজ খুলে যা যা খাওয়ার সব খেয়ে নিছে। তুমি এখন আস্তে আস্তে নিশ্চিন্তে কাজ করো। চিন্তা করোনা। ফ্রিজে অনেক খাবারই ছিলো। সে অনেকক্ষন লাগায়েই খাইছে। আমি দেখছি।

আমার কথা শুনে তানিশা আপু সামান্য লজ্জ্বা পেয়ে গেলো।
সে তরকারির আয়োজন এমনভাবে করছে যেন এসব তার আর তার স্বামীর আগে থেকেই প্ল্যান করা। একদম প্ল্যান মোতাবেক সব চলছে।
আপু একা হাতেই সবটা সামলাচ্ছে।
আমাকেও কাছে-ধারে ঘেষতে দিচ্ছেনা।
সে কিছুক্ষন পর পরই বুক ফুলিয়ে, জোরে জোরে শ্বাস নেয়। চোখ যেন বেরিয়ে যায় তখন। আর মাঝেমধ্যে তলপেটে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলছে। হয়তো কোনো কিছুর তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করছে। মনে হচ্ছে,কিছু তরকারির ঝাঁজ আর গন্ধ সে সহ্যই করতে পারছে না। আঁচল দিয়ে নাক চেপে ধরে তরকারি নাড়াচ্ছে। আপু খুব অসুস্থ, বোধ করছি।

আমি কয়েকবারই টুকটাক করতে গেলাম।
কিন্তু ও কি ভেবে যেন আমাকে কিছুই করতে দিলো না।
জোরাজোরি করায় বললো,
– আহ্ হা রে! তুই গিয়ে ওর সাথে একটু বস না। আম্মু নাই, বাসায় কি খাইছোস না খাইছোস তোরা, তা কি আমি বুঝিনা? শান্তিমত একটু কিছু খাওয়াতে দে, খেতে দে। আমি নিজেও যে খাইয়্যা ভাসায়ে ফেলছি এমন না। একটু নিজের মত করে রাঁধতে দে। আজ আসুদা পুরাইয়া খাবো রে।

আমি ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম।
এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপুর কষ্ট দেখাই ঢের ভালো,দুলাভাইয়ের কাছে গিয়ে তার নোংরামি আর তার গায়ের অমন বিশ্রী,পাঁঠার মত বোটকা গন্ধ সহ্য করার চেয়ে।

এমন সময় দুলাভাই আসলেন হনহনিয়ে।
এসেই রক্তচক্ষু নিয়ে তানিশা আপুর ঘা ঘেষে দাঁড়ালেন।
– আর কতক্ষন লাগাবি তোর রান্ধন শেষ কইরতে? খাইতে না দেওয়ার ফন্দি, না?
আপু তার দিকে ফিরে পিটপিট করে তাকিয়ে,কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
– তুমি একটু বসো! এইতো শেষ! অনেক আইটেম তো, তাই দেরী হচ্ছে! এইতো ভাতের মাড় গালবো এরপর শুধু মুরগীটা ভাজবো। অল্প কিছুক্ষন আর।

কথাটা শেষ না করতেই দুলাভাই আমার সামনেই অকথ্য ভাষায় কিছু গালিগালাজ করলো তানিশা আপুকে। সেসব লিখলাম না আর।
এই অশ্লীল গালিগুলো আমরা সবসময়ই কোনো না কোনোভাবে শুনি।
কিন্তু লেখক তার গল্পে লিপিবদ্ধ করলে কিছু পাঠক বলবে,লেখক কি অশ্লীল!
এই লেখকের গল্প আর পড়া যাবেনা!


দুলাভাইয়ের কান্ডকির্তী আমার জন্য একেবারেই নতুন। এরকম কিছু আমি জীবনেও দেখিনি।
তাই তাজ্জব বনে শুধু দেখেই যাচ্ছি।
আপুর লজ্জ্বায়, কষ্টে চোখ ভিজে গেলো।
সে মিনমিনিয়ে শুধু বলছে,
– একটু দাঁড়ান না। শেষ তো, এইতো।
বলে সে ভাতের মাড় গালতে যাবে তখনই দুলাভাই চুল ধরে টান দিলো।
ব্যস, ভাতের মাড় পড়ে গেলো তার হাত বেয়ে পেট অব্দি। তানিশা আপু চিৎকার করলো না।
শুধু চোখের জলের পরিমাণ বেড়ে গেলো।
এরকম অবস্থায় তার জোরে চিৎকার-চেঁচামেচি করে বাসা উঠিয়ে ফেলার কথা ছিলো।
কারণ আপু সবসময়ই একটু বেশি আধিখ্যেতা, ঢং টাইপ স্বভাবের।

সেখানে সে চিৎকার চেঁচামেচি কিছুই করলো না। বেশ শান্তভঙ্গিতেই মাড় ফেললো। তারপর উঠে মগভর্তি পানিতে হাত ভিজিয়ে রাখলো। পেটে বেশি পড়েনি। তবুও ভেজা কাপড় দিয়ে ধরে রাখলো কিছুক্ষন। আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
কি করবো না করবো বুঝতেছি না।
দুলাভাই আমার দিকে তাকিয়ে তারপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলে যেতে যেতে বললেন,
– তানিশা তাড়াতাড়ি খানা দে কইলাম। আমার রাগ উঠাইস না।
দুলাভাই যাওয়ার পর আমি আপুর কাছে ঘেষবো তখনই সে আবার কাজে লেগে পড়লো। আমি আপুকে বললাম, সরে যাও, তুমি রেস্ট নাও।
কিন্তু সে আমার কোনো কথাই কানে তুললো না।
কি অদ্ভুত!
আমার এত ছোট বোনটাও আজ কত বড় হয়ে গেছে!
তাকে দেখে আমার সন্দেহ হলো।
নিশ্চয় তার কোনো বড় অসুখ হয়েছে।
কেমন কেমন যেন করছে।
আব্বুকে বিষয়টা জানাতে হবে।

আমাদের খাওয়ার পর্ব শেষ হলো।
তানিশা আপু এত কষ্ট করে রাঁধলো কিন্তু সে তৃপ্তি করে কিছুই খেতে পারলো না। শুধু ছোট মাছের টক নিলো একটু,আর শেষ পাতে নিলো কচুর লতি দিয়ে রাঁধা চিংড়ি। ওর রাঁধার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিলো আজ বুঝি সব ও একাই খেয়ে নিবে। অথচ তার খাওয়ার এই বেহাল দশা দেখে আমি চুপসে গেলাম।
কিন্তু তার জামাই কব্জি ডুবিয়েই খেয়েছে।
সব খাবারের তিন চতুর্থাংশই তার পেটে বাঁধা পড়েছে। সে চিকনাচাকনা হলেও একজন প্রথম শ্রেণীর পেটুক। বলা সমীচীন।

খাওয়া শেষে তানিশা আপুরা দরজা বন্ধ করে দিলো। আমি প্রস্তুতি নিয়ে বসেছিলাম, আজ আপুর সাথে গল্পসল্প করবো। কিন্তু তা আর হলোনা। আব্বুকে ফোন দিলাম। তাকে ফোনে পাওয়া গেলো না।
এখন বাসায় একটা ভালো ফোন আছে।
ওটা আমার জন্যই আনা হয়েছে।
আমি চুপ করে বসে আছি।
হাতে কমিক্সের বই। অমন সময় দেখলাম ফোন বাজছে।

নাম্বার অজানা, তবুও চেনা।
কারণ ঐ নাম্বার যে আমার মুখস্ত!
অনু চৌধুরীর ফোন!
আজ সব অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে।
তানিশা আপু হুট করে এসে হাজির হয়েছে।
এখন আবার অনু চৌধুরীর ফোন! এতদিন পর তার আমার কথা মনে পড়লো?
অনিচ্ছাসত্ত্বে ও ফোন রিসিভ করলাম।
– হ্যালো।
– হ্যাঁ মা, আমি তোর আম্মু। কেমন আছিস মা?
– জানি। ভালো।
– কী করছিস? খাওয়া-দাওয়া হইছে?
– হুম।
– বাসায় কেউ গেছে?
– জানোই যখন তখন জিজ্ঞেস করো কেন?
– আমার সাথে তুই সবসময় এইভাবে কথা বলিস ক্যান রাকা? কারা গেছে বল।
– তানিশা আপুরা আসছে।
– ও.. তানিশারা কখন গেছে?(না জানার ভান)
– সকালের দিকেই।
– এখন কী করে?
– জানিনা।
– কেন? তুই তানিশার কাছে যাস নাই? এতদিন পরে নিজের বোনটারে কাছে পাইলি!
– গেছি। ওরা এখন দরজা বন্ধ করে রেস্ট নিচ্ছে।
– ও। তোর শরীর ভালো আছে? সব ঠিকঠাক?
– হুম।
– তোর যে আরেকটা বোন হইছে জানিস?
– না।
– কয়ডা নাম ক দেহি। ওর নাম রাখবো তোর পছন্দে।
– আমার তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করতেছেনা। রাখি।

– আচ্ছা শুন, তুই তানিশার জামাইয়ের কাছাকাছি কম ঘেষবি। না পারতে কথা বলবি। ঠিক আছে?
– কেন?
– আমি বলছি তাই।
– আর রাতে দরজা লাগায়ে ঘুমাবি। তোর আব্বু আসবে কখন?
– জানিনা।
– আচ্ছা,তোর আব্বুর তো ঘুমের সমস্যা আছে। জানিস?
– না।
– তুই উনাকে রাতের খাবারের পরে ঘুমের ঔষধ খেয়ে শুতে বলবি। তাহলে দেখবি, সুস্থ হয়ে যাবে অল্পদিনেই।
– আচ্ছা। তোমার এত চিন্তা কেন? তুমি তোমার নতুন মেয়ে নিয়ে ভালো থাকো না। আমি রাখলাম।
– শুন, রাকা..

আমি আর সুযোগ দিলাম না।
রেখে দিলাম।
আব্বুর যে রাতে ঘুমের সমস্যা হয় সেটা আমি জানি। কিন্তু আব্বু এই সমস্যার জন্য ঘুমের ঔষধ খায় কিনা তা আমার জানা নেই।
আজ আসলেই বলবো।
এতদিনে অনু চৌধুরী একটা ভালো কাজ করেছে!
বলতেই হয়!

আপুর দরজার সামনে গিয়ে আস্তে আস্তে ধাক্কা দিলাম।
– আপু, এই আপু, বাইরে আয় না।
ভেতর থেকে কড়া গলায় পুরুষালি আওয়াজ এলো,
– ঐ ঘুমানোর টাইমে প্যাঁচাল পাড়িস ক্যান? যা এইখান থেকে।
কিছুক্ষন ধস্তাধস্তির আওয়াজ ও পাওয়া গেলো। তারপর আপু বেরিয়ে এলো।

আমরা সুখ-দু:খের গল্প করলাম কিছুক্ষন। আপুর গড়নে পরিবর্তন আসলেও কথার ধরণে সেই আগের আঁচই রয়ে গেছে।

কথার এক ফাঁকে মুচকি হেসে বললো,
– রাকা জানিস,আম্মুর যে আবার একটা মেয়ে হইছে?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, হুম আজকেই জানছি।
সে আরো লজ্জ্বিত হয়ে কণ্ঠস্বর নরম করে বললো,
– কি সুন্দর দেখ! আমরা মা মেয়ে দুজন একসাথেই বাচ্চার মা হচ্ছি! হিহ্ হি!
আমি হকচকিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– মানে? বুঝলাম না।
সে চোখ-মুখে উত্তেজনা আর হাসি চেপে বললো,
– আরে বোকা,তুই খালামণি হবি কিছুদিনের মধ্যেই! হাহ্ হা হা!

আমি হাসার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু পারলাম না। বরং অবাক হলাম।
সবাই কত বিয়েসাদিতেই না যায়।
কত অনুষ্ঠান, কত আনন্দ-ফুর্তি হয় সেখানে।
তারপর গিয়ে তাদের বাচ্চাকাচ্চা হয়!
অথচ আমার ফ্যামিলিতে দু দুটো বাচ্চা চলে আসছে অথচ একটা বিয়েও সাধারণ বিয়ের মত হলো না!
আমি তো তাদের বিয়ে হতেই দেখলাম না।
রিমা খালার ও তো বিয়ে হলোনা,বাচ্চাও আর হলোনা। এই বিষয়গুলো আব্বুকে জানাতে হবে। কিছু প্রসেস কিভাবে হয় কিছুই বুঝিনা।
গুগল ক্রোমেও উত্তর মিলেনা। আব্বুই তো আমাকে সব বোঝায়। তাই সেই আমার একমাত্র ভরসা। আসুক সে,আজকেই বলবো।

বিকেলের দিকে আব্বু ফোন দিলো।
– হ্যালো রাকা। কী করো মা?
– শুয়ে আছি। গেইম খেলছিলাম এতক্ষন।
আব্বু তুমি আজকে কখন আসবা?
– মা, আজকে তো মনে হয় রাতে ফিরতে পারবো না। তোমার রাহেলা আন্টিকে ফোন দিয়ে বলবো,আজ যেন তোমার সাথে থাকে।
– তার আর দরকার নেই।
– কেন?
– তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় আসো আব্বু! প্লিজ!
– বললাম তো,চাপে আছি আজ।
– রাখো তো তোমার কাজ! তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে! প্লিজ আব্বু,তাড়াতাড়ি আসো।
– সারপ্রাইজ পরে দিবা। এখন রাখি। আজ ফিরবো না। আগামীকাল সকালে দেখা করে যাবো। আল্লাহ হাফেজ।
– আব্বু! শুনো, তানিশা আপু বাসায় আসছে আজকে। তুমি আসবানা?
আব্বুর মুখ দিয়ে আর কোনো কথাই বের হলো না।
আমি কিছুক্ষন হ্যালো হ্যালো করলাম।
কোনো সাড়া শব্দ নেই।
ফোন কেটে গেলো।

কিছুক্ষন বসে থেকে চেষ্টা করলাম বার বার।
আব্বু আর ফোনই তোলেনা। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই লক্ষ্য করলাম, তানিশা আপু আর দুলাভাই আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
আপু কঠিন চোখে জিজ্ঞেস করলো,
– কিরে? আব্বুকে বলে দিয়েছিস আমি যে আসছি? আসতেছে নাকি এখনি?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
– হ্যাঁ। তবে এখন আসছে কিনা জানিনা।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here