রাকা (১০)
ফারজানা রহমান তৃনা
আজমল উদ্দীনের উস্কানিতে অনু চৌধুরী আরো এক ধাপে রেগে গেলেন। তিনি আমার রুমে তড়িঘড়ি করে আসলেন। তারপর আমার দিকে হিংস্র জন্তুর ন্যায় তেড়ে এসে ঐ লেহেঙ্গার প্যাকেট গায়ের উপর ছুঁড়ে দিলেন।
– এইটা পরে আয় এখনি। এখন মানে এখন ই।
আমি মুখের উপর বলে দিলাম, না।
রাগের উত্তালতায় কর্কশ গলায় কান ফাঁটিয়ে অনু চৌধুরী বলে উঠলো,
– তুই পরবি, তোর বাপ ও পরবে। কুত্তার বাচ্চা। খুব মেজাজ হইছে তোর, না? তুই এখনি এইটা পরবি। না পরলে এখনি তোকে ঘর থেকে বাইর কইর্যা দিমু। তোর ঘরে জায়গা নাই।
আমি নির্বিকার চিত্তে জবাব দিলাম,
– ঘরটা কার? বাসাটা কার? তোমার? আব্বুর বাসা থেকে তুমি তাড়াবা কেন?
এইটা কি তোমার বাসা নাকি?
– ঐ কুত্তারবাচ্চা,হারামজাদী,তুই আমার মুখে মুখে তর্ক করিস? এইটা আমার বাসা। এই সবকিছু আমার। তোরটা তোর শ্বশুরবাড়িতে। তোর বাপের সবই আমার। তুই আমাকে বলিস আমি তাড়ানোর কে?
আমি আর কথা বললাম না।
শুধু প্যাকেটটা গা থেকে একটু সাইডে সরিয়ে দিয়ে তাকে পিছ দিয়ে বসলাম। কারণ আমি তার এই ধরণের অশ্লীল গালাগাল আর শুনতে চাচ্ছিনা।
কিন্তু সে আমার এইভাবে পিছ ফিরে বসাটাকে তার প্রতি বিরুদ্ধাচরণ মনে করলো।
তাই আবারো তেড়ে আসলো বিছানার ঝাড়ু হাতে নিয়ে।
শলাটা এবারেই এনেছিলো।
সেবার নানু বাড়ি থেকে সে শুধু এটা নিয়েই এসেছিলো।
তখন আমি এটা দেখিয়ে আব্বুকে বলেছিলাম,
নতুন ঝাড়ু ফ্রম নানু বাড়ি।
সেই ঝাড়ু দিয়ে গায়ে, পিঠে, হাতে যেখানে পারছে সেখানেই শরীরের সব শক্তি দিয়ে মারলো। যেখানেই পড়ছে সেখানেই যেন আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিংবা গরম খুন্তি দিয়ে যেন আঁকাবুঁকি চলছে আমার পিঠে।
সুইঁ দিয়ে কি সেলাই করছে নাকি আমার শরীর! আমি কাঁদলাম না। একটুও চিৎকার করিনি। জ্বর থেকে উঠে বসতে না বসতেই এই মারের প্রকোপ।
খুব শান্তিতে আছি!
কান্না এসে যায় যায় করে আবার থেমে যাচ্ছে।
কিন্তু আমি কাঁদবো না।
চোখ-মুখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে এই অসহ্য যন্ত্রণা সয়ে যাচ্ছি আর বলছি,
না! আমি কাঁদবো না! কিছুতেই কাঁদবো না আমি।
কিন্তু সে থামছে না। অনবরত মারছে।
মারুক, আমিও আর কাঁদবো না।
আমি দুর্বল নই।
তখনই আজমল উদ্দীন ছুটে এসে অনু চৌধুরীকে আটকালেন।
– অনু, কী করছো তুমি! এত বড় মেয়েকে মারছো! কী হইছে?
অনু চৌধুরী এবার থামলেন।
– মারতে হয় একটু – আধটু। তোমার হলে তুমিও বুঝবা আজমল। নইলে এগুলা বেয়াদব তৈরী হবে এক একটা।
আজমল উদ্দীন টুপ করে এসে আমার সামনে চলে আসলেন।
সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
– তোমার ড্রেসটা পছন্দ হয়নি মামণি? আচ্ছা যাও,আজকে সব ক্যান্সেল। আজকে আমি শুধু তোমাকে নিয়ে শপিংমলে যাবো। তোমার যতটা ইচ্ছা,ততটা নিবা। যেটা ভাল্লাগবে সেটাই কিনে দিবো। চলো। এখনি যাবো। যাবা তো?
আমি দম মুখ খিঁচে বসে আছি।
ইচ্ছা করছে, যে যে জায়গায় ঝাড়ুর মার পড়েছে সেই জায়গাগুলোয় হাত দিয়ে একটু ঘষা দেই। জ্বলে যাচ্ছে।
কিন্তু অপ্রতিভ রাগের তাড়নায় চুপচাপ বসে আছি। জ্বললে জ্বলুক।
জ্বলে জ্বলেই ঠিক হয়ে যাক।
আমার মত মেয়েদের এইসব সামান্য ব্যাথার দিকে ঝুঁকতে হয়না।
আমাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন আজমল উদ্দীন,
– কী মামণি? যাবা না?
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
– না। যাবো না আমি।
তারপর অনু চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললাম,
– আমি যাবো না।
বলে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
অনু চৌধুরী আজমল উদ্দীনের কাঁধ চেপে ধরে বললেন,
– আজমল, চলো, এখনি চলো। আমরা এখনি রওনা হবো। এই বেয়াদব এখানে একাই থাকবে আজ। দেখি ও কিভাবে থাকে।
আজমল উদ্দীন আর কিছু বললেন না।
উঠার আগে আমার দুই উরুতে হাত রেখে চেপে ধরে বললেন,
– কেন এমন করো রাকা? আমি তোমাকে কী করছি বলো? হুম? বলে ঠোঁটের কোণের সামান্য হাসি লুকালেন। আমার চোখ তা এড়ায়নি।
আমি তো অনু চৌধুরী না। আমি রাকা।
লোকটা উঠলেন স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও বেশি সময় নিয়ে। ততক্ষন এইভাবেই চেপে ধরে রাখলেন।
সে আর অনু চৌধুরী আমার রুম ত্যাগ করতেই আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম।
দরজা বন্ধ করার সময় ঐ প্যাকেটটা দরজার বাইরে রেখে দিলাম। ওটা আমি পরবো না। ঐ জঘণ্য লোকের জামা আমি কিছুতেই পরবো না। তাই।
তারপর জামা তুলে দেখলাম উরু লাল হয়ে আছে। আর একটু হলে হয়তো ছিলেই যেত।
তারপর সারা গায়ে একবার এলোমেলোভাবে হাত দিয়ে ঘষলাম। ভালোই মারছে আজ।
টেবিলের উপর বসে পড়ে এবার নিজের অজান্তেই শব্দ করে কেঁদে দিলাম।
খুব জ্বলছে। এত কষ্ট আগে কখনো লাগেনি।
কিন্তু আমার চোখের এই নোনা পানির অর্থ কি কেউ আদৌ বুঝবে?
ওদিকে বাইরে থেকে অনু চৌধুরী বলছে,
– তানিশা খাবার তো বেশি নেই। যা আছে তাও খাওয়ার অযোগ্য। তাও তুই সব ফ্রিজে ঢুকিয়ে ফ্রিজ লক করে ফেল। দেখি মহারাণী কতক্ষন না খেয়ে থাকতে পারে। আমরা ওখানের বেস্ট রেস্টুরেন্ট থেকে আজ খেয়ে আসবো। বুঝলি?
কথাগুলো বললো জোরে জোরে।
খাবারের লোভে পড়ে হলেও যেন আমি অন্তত রাজি হই, তাদের সাথে যাওয়ার জন্য,তাই।
কিন্তু আমি বের হইনি।
তারা বের হওয়ার পর তানিশা আপু বলে গেলো, – – রাকা, এই রাকা! বাইরের দরজা বন্ধ করে দে। আমি চলে যাচ্ছি। উনারা চলে গেছে।
আমি কিছুক্ষন পরই দরজা খুলে বের হলাম। বের হতেই চমকে গেলাম।
তারা সবাই আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
কেউ যায়নি।
অনু চৌধুরীর হাতে আজমল সাহেবের আনা সেই লেহেঙ্গাটা।
আমি বের হতেই অনু চৌধুরী চোখ রাঙিয়ে বললো,
– কী? কথায় কথায় দরজা আটকানো কোন ধরণের স্বভাব? খুব বড় হয়ে গেছোস?
আমি একবার তানিশা আপুর দিকে তাকালাম। আপুও আমার সাথে এমন করলো!
ওকে তো আমি সব খুলে পর্যন্ত বলেছিলাম!
তাহলে কেন?
আমার কথা কেউ বিশ্বাস করেনা কেন?
অনু চৌধুরী আমার কপালে হাত দিলেন।
তারপর তৃপ্তিদায়ক ভঙ্গিমায় বললেন,
– না জ্বর নাই। আয়, এদিকে আয়, আমার সাথে একটু আয় তো।
বলে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন।
আমিও তার সাথে গেলাম।
না গিয়েও উপায় নেই।
এখানে কেউই তো আমার কোনো কথা বা রাগই আমলে নিবেনা।
অনু চৌধুরী পেছনে ফিরে আজমল উদ্দীনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– ১০মিনিট জাস্ট!
আজমল উদ্দীন বললেন,
– ওকে ডার্লিং।
আমি এখন আম্মুর রুমে।
আমাকে কখনোই সে নিজ হাতে আদর করে সাজায়নি। ছোট্টবেলায় হয়তো আদর করে কখনো কখনো কপালের এক পাশে কালো টিপ লাগিয়ে দিতো। কারণ সবাই_ই দেয়। না দিলে ঘোর অনর্থ!
হয়তো সেও দিয়েছে। ওটা দেয় কেন? যেন নজর না লাগে! কিন্তু আমার মা জননী আমাকে সাজাবেন অন্য উদ্দেশ্যে, যেন নজর লাগে।
যদিও সে এসব জানেনা।
জানার চেষ্টাও করেনা।
কারণ সে তো অন্ধ।
এজন্যই হয়তো গানের কথায় আছে,
“চোখ থাকিতেও অন্ধ।”
সে আমাকে জোর করে ঐ লেহেঙ্গাটা পরিয়ে দিলো।
পরানোর আগে যখন জামা খুলে দেখলো তার মারের দাগগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে লম্বা-লম্বা, লাল-লাল দাগের মাধ্যমে; তখন সে একটু ছুঁয়ে দেখলো। অস্ফুটস্বরে একবার বলে উঠলো, ইশ!
তারপর কিছু একটা লাগালো ঐ জায়গাগুলোয়। কি লাগালো জানিনা তবে খুব শান্তি পেলাম। হয়তো তার হাতের শীতল স্পর্শটুকুই ছিলো আমার সেই শান্তির খোরাক।
বলছিলো,
– কেন এমন করিস বলতো? আমার কি তোকে মারতে ভাল্লাগে,বল? তুই এইভাবে মুখে মুখে তর্ক করিস কেন? আগে তো এমন ছিলি না।
কেন এমন তৈরী হচ্ছিস দিনকে দিন?
আমি কোনো কথারই কোনো উত্তর দেইনি।
কিছু কিছু সময় চুপ থাকাই শ্রেয়।
উপভোগ করতে হয়। সবার জন্য তো আর তার মায়ের আদর দীর্ঘস্থায়ী,সহজলভ্য হয়না।
তাই যখন সময় আসে তখন চুপ থাকাই উত্তম লক্ষণ।
সে তার কাজ শুরু করলো।
কপালে একটা ছোট পুতির টিপ, চোখে কাজল আর কানে দুল। ঠোঁটেও লাল লিপস্টিক এঁটে দিলো। হাত খালি। তাই নিজের একটা কি যেন ব্রেসলেটের মত, ওটা চেপে ছোট করে হাতে পরিয়ে দিলো।
তারপর সে নিজেই কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। হয়তো সে বুঝতেই পারছে না, তার এই কালো মেয়েটাও এত সুন্দর!
হয়তো ততটা না সুন্দর না।
কিন্তু একটা অন্য রকমের মায়া মায়া ভাব আছে।
যার চোখ-মুখের অসীম মায়ায় গ্রাস হতে পারে শত শত নর-নারী। সে জানতোই না,তার ছোট মেয়ে এত মায়া নিয়ে জন্মেছে!
কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আমাকে কাছে টেনে এনে বললো,
– তোকে খুব সুন্দর লাগছে এখন,রাকা। কেন যে এমন করিস তুই… কত সুন্দর লাগছে জানিস? এখন চল।
বলে আজমল উদ্দীনের সামনে নিয়ে গেলো। তারপর হাসিমুখে বললো,
– দেখছো আজমল,আমার এই মেয়েও কিন্তু কম সুন্দর না। একটু দুষ্ট আর জেদি স্বভাবের কিন্তু রুপে-গুণে একদম পাক্কা। একটু জেদি আরকি। কী বলো?
আজমল উদ্দীন হেসে বললেন,
– হ্যাঁ। তোমার মেয়ে দুইটাই তোমার মত সুন্দর। রাকা আরো সুন্দর হতো,কিন্তু তোমার বর কালো তো তাই এই মেয়ের উপর এফেক্ট পড়ছে একটু। এনিওয়েজ,রাকা, দারুন দেখাচ্ছে কিন্তু!
আর কি, আমাকেও যেতে হলো।
আমি যতক্ষন পারছি ততক্ষন অনু চৌধুরীর হাত চেপে ধরেছিলাম।
তার পিছু পিছু, তার গা ঘেঁষে ঘেঁষেই হাঁটার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তার বোধ হয় আমার এই গা ঘেঁষাঘেঁষির বিষয়টা পছন্দ হচ্ছেনা।
সে আমাকে একবার বলেই ফেললো,
– রাকা, কী করছিস? একটু দূরে দূরে হাঁট! গায়ে পড়ে যাবি নাকি! শাড়িটা নষ্ট করে ফেলবি তো!
তারপর তানিশা আপুর হাত ধরলাম।
কিন্তু সেই হাত ও মিনিট পাঁচেকের বেশি ধরতে পারলাম না। তানিশা আপু ও ব্যস্ত।
সেল্ফি আর ভিডিও করা নিয়ে সে তুমুল ব্যস্ত।
জায়গাটা সুন্দর।
আমরা জাদুঘর থেকে এখন চিড়িয়াখানায় এসেছি। পথিমধ্যে ঘোড়ার গাড়িতে উঠতে হলো দুজন দুজন করে।
অনু চৌধুরী আর আজমল উদ্দীন প্রথমে উঠলেন। তারপর তানিশা আপু আর আমি। আমাকে তুলে দিলেন আজমল উদ্দীন। সেই একই কাজ।
সে কোলে তোলার বদৌলতে পেট ছুঁয়ে দিলো আচমকা। শিউরে উঠতেই গাড়ি চলা আরম্ভ করলো।
এরপর যখন চিড়িয়াখানায় আসলাম, সেখানেও আমি মা আর বোনদের সাথে সাথে থাকার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু কেউই আমাকে সময় দিচ্ছেনা। যে যার কাজে ব্যস্ত। অনু চৌধুরী আজমল উদ্দীনের এক হাত জড়িয়ে ধরে হাঁটছে।কিন্তু আমার হাত ধরলো না।
আমাকে দেখার সময়ই নেই কারোর।
এদিকে বল ছুটে আসছে, ওদিকে ঢিল ছুটে আসছে, সবাই এটা ওটা করে এভাবেই দুষ্টামি করছে।
আমারও ওদের সাথে যোগ দিতে ইচ্ছা করছে।
কিন্তু আমি এখন ওদের সাথে যোগ দিতে পারবো না। আমার যা ড্রেস! কিভাবে কি খেলবো!
তাই বড়দের মতই চুপচাপ, সংযত হয়ে হাঁটতে লাগলাম।
এক সময় আবার অনু চৌধুরীর হাত চেপে ধরলাম।
সে বিরক্ত হয়ে আজমল উদ্দীনকে বললো,
– এই তুমি ওকে ধরো তো। ওর এক হাত ধরে হাঁটো। আমার শাড়ি ঠিক করতে হয় তো। দুজনকে কিভাবে ধরবো! মেয়েটা তখন থেকে এরকম করতেছে। বোধ হয় ভালো লাগতেছে না ওর।
আজমল উদ্দীন যেন এই অপেক্ষাতেই এতক্ষন সময় পার করছিলেন। শোনা মাত্রই কাজ সারা যাকে বলে তাই হলো।
সাথে সাথেই আমাকে কোলে তুলে নিলো।
আমি বাঁধা দেওয়ার সুযোগটুকুও পেলাম না।
তারপর অনু চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
– নাও! এবার তুমি তোমার শাড়ি ইচ্ছামত সামলাও। আমরা দুজন ঝামেলাই এখন এক হয়ে গেলাম। হাহ্ হা।
অনু চৌধুরীও হাসিতে যোগ দিলেন।
আজমল উদ্দীনের এত এত আদর তার মেয়েদের প্রতি, দেখলেই তার খুশিতে মরে যেতে ইচ্ছা করে। মানুষটা খুব ভালো। এরকম কাউকেই তো দরকার জীবনে। ভাবছে অনু চৌধুরী। আর আমি!
আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। ক্লাস সিক্সে তখন।
আমার ভীষণ অস্বস্তি লাগছিলো।
এদিক দিয়ে টান দিয়ে ধরি তো ঐ দিক দিয়ে উঠে যায়। কি একটা অবস্থা..
সে কি আর বুঝে অনু চৌধুরী?
কিছুক্ষন যেতে না যেতেই সে আবার শুরু করলো। তার হাত নিচের দিকে বার বার নাড়াচাড়া করতে শুরু করলো।
একসময় একটা হাত ভেতরেই ঢুকিয়ে দিলো।
অন্য হাত দিয়ে ঝাপ্টে ধরে আছে। তার অবাধ্য চলমান হাত পা টপকিয়ে আস্তে আস্তে উরুর দিকে ধাবিত হতেই আমি তার ভেতরে ঢুকানো হাতটা চিমটি দিয়ে সরিয়ে দিলাম। কিন্তু ওটা সরিয়ে দিতে না দিতেই আবার সেটা ছুটে আসলো বুকের উপর।
পিছন থেকে ধরেছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই সেটা জায়গামত চলে আসবে বলে ঠাওর করা যায়।
আমি জোরে বলে উঠলাম,
– আপনি আমাকে নামিয়ে দিন আংকেল। নামান। প্লিজ!
আজমল উদ্দীন বললো,
– কেন? ভালো লাগতেছেনা? নেমে কী করবা?
– নামান আমাকে। প্লিজ।
অনু চৌধুরী আর তানিশা আপু তখন একসাথে ছবি তুলছে।
সেই সুযোগে আজমল উদ্দীন একটু দূরে চলে গেলেন জোরে হেঁটে।
তারপর ফিসফিস করে বললেন,
– কী সমস্যা তোমার রাকা? সবার সামনে এরকম আচরণ কেন করো?
তুমি এরকম আচরণ করলেও কোনো লাভ হয়না। দেখলেই তো। তাহলে কেন করো? আমি তোমাকে কী করি বলোতো? মারি? বকি? আদর করি তো!
তখনই তার কোল থেকে টপকে পড়ে গেলাম।
রাগান্বিত স্বরে বললাম,
– আপনি আমাকে বিরক্ত করেন। আমার আপনাকে অসহ্য লাগে। আর এইভাবে হাত দিয়ে এমন করেন কেন? আমি আব্বুর কাছে বলে দিবো সব।
লোকটা শব্দ কর হেসে দিলো এবার।
বললো,
– সত্যি! বাব্বা, খুব ভয় পাইছি তো আমি! তো, কী বলবা?
– আপনি যা যা করেন, সব। সব বলে দিবো।
– আচ্ছা! তাই বুঝি? ওকে,বলেই দিবা যখন, তখন আরো বেশি বেশি করে করবো। কী বলো? যদি না বলো তাহলে আর কিছুই করবো না। ধরা যখন খাবোই তখন কিছু করেই খাইনা! হাহ্ হা হা।
আমি তোমাকে কিছুই করিনা, বুঝলা?
বি পজিটিভ। বড় হবা কবে মাই ডিয়ার বেবি গার্ল!
আমি তার থেকে সরে চলে আসলাম।
আপন স্যারকে বলা হলো না আমরা কোথায় কোথায় যাবো। বললে হয়তো সে ছুটে আসতো আর আমাকে বাঁচাতো এই অসভ্য লোকটার হাত থেকে।
আপুর অনুরোধে সিনেমাহলেও যাওয়া হলো অবশেষে। ওখানে আমাদের দুই বোনকে তার দুই সাইডে বসতে হলো। তার রিকুয়েস্ট রক্ষার্থে। যদিও অনু চৌধুরীর তার সব বাড়াবাড়ি ভালো লাগেনা। তবুও মেনে নেয় মেয়েদের প্রতি তার উপচে পড়া ভালোবাসা দেখে।
তাই অনু চৌধুরীকে বসতে হলো আমাদের সামনের সিটে।
সেখানে বসে বসে পপকর্ণ খাওয়ার পাশাপাশি একটা সিনেমা দেখা হচ্ছে।
ওখানে ও একই কান্ড।
লোকটা দুই হাত দু পাশে প্রশস্ত করে আমাদের দুই বোনকেই ধরেছে।
তানিশা আপু কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাচ্ছেনা।
তার সাথে ও যে এমন কিছু হচ্ছে কিনা, কে জানে?
হলেও মনে হয়না কিছু বলবে বলে।
কিন্তু আমি তার হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিতেই সে আবার সেটা আমার গায়ে তুলে দিলো। আমার দিকেই হেলে সে আবার তার চাহিদা মেটালো। চুপচাপ সয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার রইলো না। জ্বর, তার উপর দিয়ে মার আর তার সাথে সাথে ফ্রিতে সহ্য করতে হচ্ছিলো তার এই অসভ্যতামিগুলো।
বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হলো।
এসেই আমি ফ্রেশ হয়ে ভাঙা ফোনটা জোড়া দেওয়ার কাজে লেগে গেলাম। অনেক কষ্টে,অনেক সময় নষ্ট করে তারপর ওটাকে সচল করা গেলো।
আব্বুকে ফোন দিতে হবে। আপন স্যারকে আজকের বিষয়টা জানাতে হবে।
আমি সমানে ফোন করতে লাগলাম দুজনকে। কেউই ফোন তুলছে না।
আব্বুর ফোন বেজে যাচ্ছে, সে রিসিভ করছে না। আর আপন স্যারের নাম্বার বিজি। তাই আমি বাধ্য হয়ে প্রথমেই আব্বুকে একটা মেসেজ দিলাম,
যতটুকু পারি সিলেবল ভাগ করে করে লিখতে ততটুকুই লিখলাম,
” আব্বু, তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় আসো। নইলে আমি মরে যাবো। তখন তুমি অনেক অনেক কাঁদলেও আর আসবো না। প্রমিস! বলে দিলাম কিন্তু। ”
তারপর আপন স্যারকে একটা লিখলাম,
” স্যার কালকে পানির ট্যাংকির ওখানে
থাকবেন তো? আমি আপনার সাথে কথা বলবো একটু। ”
এরপর ঘুমিয়ে গেলাম।
সকালে উঠে দেখি দাদি আমাদের বাসায় এসেছে। দাদিকে বাসায় দেখে আমি খুশিতে হতবিহ্বল। অনেকদিন পর দাদির মুখ দেখলাম। দাদি অবশ্য আমাকে ততটা আদর করেনা। কারণ সে মনে করে আমি তার বউয়ের রক্ত, জাত। যদিও সে জানে, আমি তার বউয়ের কোনো গুণ বা রুপই পাইনি।
যা রপ্ত করেছি সবটাই তার ছেলের।
সেক্ষেত্রে সামান্য হলেও আদর পাই।
কিছুক্ষন পর দেখলাম, কাকা,ফুফু-ফুফারাও এসেছেন।
আজ সবাই কেন দল বেঁধে আসছে জানিনা।
আমি আমার জন্মের পর থেকে কাউকে কখনো আমাদের বাসায় এক রাত ও থাকতে দেখিনি। আসলেও আসে বছরে একবার। সারাদিন বা ঘন্টাখানেক থেকে আবার ঐদিনই চলে যায়।
আর দাদি তো একসময় আমাদের সাথেই থাকতো।
কিন্তু এখন আর থাকে না।
আমাদের সাথে তার না থাকার বয়স আজ অনেক বছর। সে আমাদের সাথে না থাকার মূল কারণ হলো, তার সাথে অনু চৌধুরীর বনিবনা হয়না। আর দাদু অনু চৌধুরীকে প্রথম থেকেই পছন্দ করতেন না। একবার সামান্য একটা কারণে ঝগড়ার প্রকোপ এমন পর্যায়ে গেছিলো যে পরে দাদি বাধ্য হয়েই একা একা ছোট ছেলের বাসায়,আমার কাকার বাসায়, চলে গেছিলেন। আব্বুকে বার বার বলতো,
“এই বউ ছাড়, তোর জীবন ছার-খার করে তবেই এই মেয়ে শান্ত হবে। আমি বললাম। তুই আমার কথা মিলায়ে নিস বাপ।”
কিন্তু আব্বু বড্ড বেশিই ভালোবাসে অনু চৌধুরীকে। মায়ের কথা ভেবে অনেকবার ছুটে গেছিলো, আমাদের ও সাথে করে নিয়ে গেছিলো। বার বার মাফ চেয়েছিলো। তবে অনু চৌধুরীকে কখনোই কোনোভাবে নিতে পারেনি সাথে।
তার মাও এক কথার মানুষ,
– এই মেয়েকে বিদায় করলে আমি তোর বাড়িতে পা রাখবো। নতুবা আমি মরে গেলেও না। গেলে আমার লাশ যাবে।
অনু চৌধুরী প্রথম যখন বিয়ের পর এই বাড়িতে আসে, তখন সে শুধু আব্বুরই নয়, আমার দাদির ও নয়নের মণি ছিলো। বড় ছেলের বউ।
তাকে মূলত তাড়াতাড়ি আনানোর কারণ একটাই, দাদির দেখাশোনা। কিন্তু সে প্রতিদিন বেলা ১০/১১টায় উঠতো। আব্বু তো সকালেই চলে যায় কাজে। সে এসব জানতোও না।
প্রথম প্রথম দাদি সব ছাড় দিয়ে একা হাতে নিজেই সবটা করতেন। অনু চৌধুরী উঠতে উঠতে তার বাসার সব কাজ শেষ ও হয়ে যেত।
সে উঠে কোনোমতে তার খাওয়া খেয়ে, সেই যে ফোন নিয়ে বসতো… আর উঠার নামগন্ধ নেই। গোসলের বেলা ফেরিয়ে যায়, ফেরিয়ে যায় নামাজের বেলা…. না, তার কথা শেষই হয়না। বছর যেতেই এই ফোনে কথা বলার হার ক্রমশ বাড়তে থাকে।
দাদি সন্দেহ করতো কারণ সে বেশিরভাগ সময়ই ছাদে গিয়ে কথা বলতো।
আর বাসায় থাকলে বলতো দরজা বন্ধ করে।
এত কিসের কথা বা কার সাথে এত কথা – সেসব একদিন সে নিজ কানেই শুনে নেয়। দরজা খোলা ছিলো সেদিন। দরজা লক করলেও অমনোযোগের কারণে সেটা লক হয়নি ঠিক করে।
দাদি তার কিছু বেফাঁস কথা শুনে চিৎকার দিয়ে যখন বলে,
– বউ, কি কও, কার লগে এগুলা কও!
অনু চৌধুরী চমকে উঠে আমতা আমতা করে বলে,
– কে_কে_ন মা! আপনার ছেলের সাথে!
– ও মা! আমার ছেলেতো কাজে গেছে। তার তো কাস্টমারের সাথে,লোকজনের সাথে কথা কওনের ই সময় হয় না। আর সেই ছেলে তো বইস্যা বইস্যা এত কথা কইবো না তোমার লগে! আর যদি এত কতা কওনের দরকার ই পড়ে তয় সে বাসায় থাইক্যা যাউক না! কাজে যাইতে কয় কে? আমি তো তারে কইলাম বাসায় থাকতে কয়দিন! হে নিজেই তো মানা করলো।
– ও…
– দাঁড়াও আমি তারে এহনি আবার কমু।
– কেন মা? আপনার আমার কথা বিশ্বাস হয়না?
– না মা। তারে খালি বলমু এহনি যেন চইল্যা আসে। আর সপ্তাহ খানেকের জন্য যেন ছুটিও আনে। তুমি তো এইভাবে অসুস্থ হইয়্যা যাইবা মা। নাওয়া-খাওয়া সব তো তোমার লাটে উঠছে।
তখনই সে তার ছেলেকে ফোন করে জানতে পারে, তার ছেলে এখন মহা ব্যস্ত।
সে এখন মিটিং এ আছে। আজ তার নিশ্বাস ফেলার ও সুযোগ নেই।
দাদির আর বুঝতে বাকি রইলো না কিছুই।
দাদি কটমট করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– ও বউ! আমার পোলা তো কাজে ব্যস্ত। তুমি তাইলে কার লগে ব্যস্ত থাহো?
অনু চৌধুরী চোখ রাঙিয়ে বলে,
– আপনার মাথার লগে। বুড়ি বয়সে বেশি
বাড়াবাড়ি কইর্যেন না। ভাগাইয়া দিমু কইলাম। ঝামেলা একটা।
– তুমি আমারে ভাগাইবা? ও বউ কি কও?
এইডা আমার পোলার বাড়ি না?
আমার পেডের পোলা!
– তয় এইডা আমার ও স্বামীর বাড়ি। আম্নে আমার নামে যেন তেন অভিযোগ আনবেন , আর আমি চুপ থাউম নাকি?
তারপর আব্বু আসার পর আব্বুকে দাদি বোঝালো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাচ্চা নাও।
নয়তো,এই বউ মনে হয় না টিকবো।
আব্বু পর পর দুটো বাচ্চা নিলো।
দাদির তো খুশির কোনো অন্ত নেই।
সে একাই সব কাজ করে গেছে, সব সয়ে গেছে এতদিন। একটা মাত্র বউ। সে না দেখলে কে দেখবে, এই ভেবে।
কিন্তু বাচ্চাদের জন্ম হওয়ার পর ও সে তার এই অভ্যাস ছাড়েনি। সে তখন ও তার একই নিয়ম ধরে রাখলো।
দাদির কষ্ট একটাই,
“বউ আনছি শখ কইর্যা নিজের কামের পাল্লা কমার লাগি। হেই বউ যদি পায়ের উপর পা তুইল্যা বইয়্যা থাইক্যা আমারে দিয়াই সব করায়ে উসুল করে, তাও মানা যায়। কিন্তু এই বউ তো দেহি দুশ্চরিত্রা। ”
মাঝেমধ্যেই দাদি শোনার চেষ্টা করতো তাদের আলাপন।
এরপর এমন এমন করে একদিন সে গৃহত্যাগ করে।
আব্বুর হাজার অনুরোধ, মিনতিও আর কাজে লাগেনি। আস্তে আস্তে ফুফুরাও সব জেনে যায়।
তারাও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।
একমাত্র কাকা,সেও তাই করে।
আব্বু সব সহ্য করে যায়।
কারণ অনু চৌধুরী তার প্রাণ।
সে ভাবতো, একদিন ঠিক হয়ে যাবে সব।
সে বোঝাতো। আর ভাবতো, মেয়েরা বড় হলে আপনা-আপনিই ঠিক হয়ে যাবে একদিন।
কিন্তু না! মেয়েরা বড় হওয়ার পর আরো বেড়েছে বৈ কমেনি।
(চলবে)