রাকা-১১,১২

0
612

রাকা-১১,১২
ফারজানা রহমান তৃনা
পার্ট-১১

দাদির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– দাদি, কী হইছে? তোমরা সবাই আজকে আমাদের বাসায় আসছো যে!
দাদি কিছুই বলছেনা শুধু নাক টেনে কাঁদছে।
তার মুখের বিষাদের ছাপ স্পষ্ট। সবার মুখই কালো হয়ে আছে। খারাপ কিছু কি হয়েছে?
ছোট ফুফির কাছে গিয়েই তার সাথে চেপে বসে জিজ্ঞেস করলাম,
– ও ফুফি,কী হইছে? কারো কিছু হয়েছে? দাদি কাঁদে কেন?
ছোট ফুফি কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
– তোর বাবা অসুস্থ হইয়্যা পড়ছে রে রাকা,তোর বাবার খুব খারাপ অবস্থা..
কথাটা শুনেই আমি ফুফির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
– কী হইছে আমার আব্বুর? বলো না ফুফি,ও ফুফি..
ফুফি কান্না জড়ানো গলায় বললো,
– এক্সিডেন্ট করছে তোর বাপে। এক্সিডেন্ট।
কথাটা শুনেই বুকটা যেন ধক করে উঠলো সাথে সাথে।
আর কথা বলতে পারলাম না।
ফুফিরা জোরে জোরেই বিলাপ করতে লাগলেন,
– ভাইয়ের কি এমন দুশ্চিন্তা, কি এমন সমস্যা যে ভাই আমার এতটা অমনোযোগী হয়.. ক্যান আমার ভাইডার এমন হইলো। আমার ভাইয়ের তো কোনোদিন ও এত চিন্তা ছিলোনা। তাইলে এহন ক্যান এমন হইলো? আমরা কি কিছু বুঝিনা?

তারপর তাদের কথার শোরগোলে বুঝে নেই,
গতকাল রাতেই আব্বু এক্সিডেন্ট করেছিলো।
মাত্রাতিরিক্ত উদ্বিগ্নতায় তার বুকের ব্যাথা আর মাথাব্যাথা বেড়ে গেছিলো। তাই আর সহ্য করতে না পেরে ঔষধ আনার জন্য নিজেই বের হইছিলো। পথিমধ্যে আচমকা তার মাথা ঘুরে যায় আর একটা বাসের সামনে পড়ে যায়। এক পা আর এক হাত পুরোই থেতলে গেছে। মাথায় ও আঘাত পেয়েছে। অনেক রক্তপাত হয়ে গেছিলো কারণ ঐ রাস্তায় অত রাতে লোকজনের আনাগোনা কম ছিলো। একজন এসে দেখেছে তাও অনেক দেরীতে। আর বাসওয়ালা তখনই পালিয়েছিলো। ততক্ষনে প্রচুর ব্লাড খরচ হয়ে যায়। ডাক্তারখানায় নিতে নিতে আরো বেশি। আব্বুর অবস্থা এখন ভালো না। পায়ের হাড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে।

তার মানসিক চিন্তা,দুশ্চিন্তার দরুন
ব্রেইনে খুব এফেক্ট ফেলছে।
এই প্রভাব এক দুদিনের না, বহুদিনের পোষা রোগ। যার ফলে মাথা ঘুরে গেছিলো।
এরকম আবার হতে পারে। হয় তার সব সমস্যা সমাধা করতে হবে নতুবা তাকে রিল্যাক্সেশনে রাখতে হবে। একদম চিন্তামুক্ত পরিবেশ চাই তার জন্য। হাসপাতালে সারা রাত সে ব্যাথায় কুঁকড়ে গেছিলো। সারা রাত শুধু রাকা রাকা, আমার কী হবে ইত্যাদি সব কথাবার্তা বলে বিড়বিড় করে যাচ্ছিলো।

অনু চৌধুরীকে হাজারবার ফোন করার চেষ্টা করা হয়েছিলো,আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে ফোন রিসিভ করেছে, এইতো সকালেই।
ধরেই যখন জানতে পারে এই খবর, তাড়াতাড়ি আজমল উদ্দীনকে উঠিয়ে তাকে বের করে দেয় ঘর থেকে।
তাই আজ ও কেউই জানতে পারলো না আজমল উদ্দীনের ব্যাপারটা।
অনু চৌধুরীকে দাদি,ফুফুসহ সবাই মিলে খুব বকলো। এত উদাসীন কিভাবে থাকে সে, ফোন তোলেনি কেন, আব্বুর উপর কেন চাপ দিচ্ছে, কিসের এত দুশ্চিন্তা এসব অনু চৌধুরী জানেনা কেন ইত্যাদি ইত্যাদি বলে…

সেবার আব্বুর এই এক্সিডেন্টই আটকিয়ে রেখেছিলো অনু চৌধুরীকে।
নচেৎ সেবারই হয়তো সে পালাতো।
আব্বুর সেবাযত্নের জন্য দাদি বাধ্য হয়েই থেকে গেলো কয়েক মাস। তার ধারণা,বউয়ের অযত্ন,উদাসীনতা, বদ-অভ্যাসই ছেলের এই অসুখের কারণ।

ফুফুরাও আসা যাওয়া করতো তখন।
সেজন্য এক হিসেবে আমাদের জন্য সুবিধাই হচ্ছিলো।
নির্বিঘ্নে চলছিলাম। ভালোই চলছিলো সব।
মাসখানেকের মধ্যেই যখন আব্বু সুস্থ হয়ে যায় তখন দাদি আবার চলে যায় আমাদের বাসা থেকে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেতে হয়েছে বলা বাহুল্য।
এ ক’দিন থেকেই তার দফারফা এক হয়ে গেছে অনু চৌধুরীর অনিয়ম, অত্যাচারে।

কিন্তু সমস্যার শুরু হলো দাদি চলে যাওয়ার পর। আব্বু তখন ঘরে বসেই সব সামলায়।
অনু চৌধুরী একদিন নিজে যেঁচে এসে বলে,
– শুনো না, তুমি তো অনেকদিন ব্যবসায় যেতে পারো না। আমি মাঝেমধ্যে গিয়ে দেখে আসি সব? তুমি আমাকে বুঝায়ে দিলা সব, আমি সব তেমনভাবেই দেইখ্যা আসবোনে। সব ঠিক আছে কিনা,তারা আসলেই কাজ করে কিনা ভালো কইর‍্যা… এইভাবে আর কয়দিন কও?
নিজের ব্যবসা এইভাবে অন্যদের উপর বিশ্বাস কইর‍্যা চালানো যায়? দুনিয়ায় কাউরে বিশ্বাস করা যায় নাকি?

আব্বু প্রথমে রাজি হয়নি। পরে একসময় অনু চৌধুরীর জোরাজোরিতেই রাজি হয়ে গেলেন। আমি আজমল উদ্দীনের ব্যাপারটা অনেকবার শেয়ার করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আব্বুর মানসিক চিন্তার কথা,অসুখের কথা শুনে আর কিছুই বলিনি। তাছাড়া অনু চৌধুরীর তুমুল নিষেধাজ্ঞা, যদি কিছু বলছোস ওর নামে তাহলে ঐদিনই তোরে, তোরে বাপরে মাইর‍্যা এরপর আমি নিজেও মরমু।
তোদের সুখের সংসার জ্বালায়ে দিমু।

অনু চৌধুরী এই বাহানা দিয়ে (ব্যবসা দেখার) হরহামেশাই চলে যেতেন আজমল উদ্দীনের কাছে। কিন্তু সেটা রেজা চৌধুরী ওরফে আব্বু জানতেন না।
কয়েকবারই অবশ্য লোকজনের কাছ থেকে খবর আসছিলো যে অনু চৌধুরীকে একজন মধ্যবয়সী লোকের সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে হাঁটতে,চলতে দেখা গেছে অমুক-তমুক জায়গায়।
সে দোকানপাটে ও তার বেশি সময় ব্যয় করেনা। তাহলে থাকেটা কোথায় ঘন্টার পর ঘন্টা?
আব্বুর সমস্যা হচ্ছে অন্ধ-বিশ্বাস।
সে শক্ত হাতে ধরতে গিয়েও ধরেনি।
সে যখন বিষয়টা ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে যায়, তখন আবার অনু চৌধুরী সাবধান হয়ে যেতেন।

গড়িমাসি করে এভাবেই চললো কয়েকমাস। মাঝেমধ্যেই দেখতাম সে তেঁতুল,চাটনী এটা ওটা খুব বেশি খেতো।
এত বেশি খেত যেন সে মরিয়া হয়ে যায় এগুলোর জন্য।

আব্বু এসব লক্ষ্য করার মত সময়ই পেতেন না। তবে সে তার ইচ্ছা আর ভালোবাসার বশীভূত হয়ে কয়েকবারই অন্তরঙ্গ মুহূর্তে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গিয়েও কোনো লাভ হয়নি। অনিচ্ছাসত্ত্বে ফিরে আসতে হয়েছে বার বার। অনু চৌধুরীর সারা মাসই পিরিয়ড চলে। কিন্তু রেজা চৌধুরী বুঝতো না, ওটা পিরিয়ড না। বাচ্চা মিসকারেজের জন্য, বাচ্চা স্বেচ্ছায় নষ্ট করার ফলাফল। সে তার সবকিছু বিলীন করতো আজমলের জন্য,রেজা চৌধুরীর জন্য নয়। রেজা চৌধুরী ছিলো অনু চৌধুরীর দেখানো, নামমাত্র স্বামী। কিন্তু ততদিনে সে মনে প্রাণে ভালোবাসে আজমল সাহেবকে।

আজমলের অসাবধানতার জন্যই বাচ্চা মিসকারেজের কিছু ঝামেলা পোহাতে হতো তাকে।
সে এরকম কয়েবারই কন্সিভ করেছে আবার নষ্ট ও করে ফেলেছে। তার শারীরিক অবস্থা বেশ ভালো। তাই এতবার মিস্কারেজ করেও সে দিব্যি সুস্থ ছিলো।
মিস্কারেজ করতো কারণ তখনো সে তার কার্যসিদ্ধি করতে পারেনি।
বিষয়টা নিয়ে একদিন রেজা চৌধুরী চিন্তা করে। ভাবলো, অনুর কোনো বড় অসুখ হয়নি তো?

ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার পর সে(মহিলা ডাক্তার) অনু চৌধুরীকে আলাদা করে জিজ্ঞেস করেন,
– কী ব্যাপার ম্যাডাম? হাজবেন্ডকে জানান না এসব? এখন বাচ্চা কয়টা আপনার? আর নিতে চান না??
অনু চৌধুরী সেই ধাপ ও ছলে বলে কৌশলে অতিক্রম করে আসে।

আজমল উদ্দীনের সাথে একদিন সামনাসামনি দেখাও হয়ে যায় রেজা চৌধুরীর।
অনু চৌধুরী ও তখন সাথেই ছিলো।
অনু চৌধুরী আজমল উদ্দীনের পরিচয় দেন, জেঠাতো ভাই। রেজা চৌধুরী বাইরে দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গি দেখালেও ভিতরে ভিতরে সন্দেহ করছিলেন। জেঠাতো ভাই হলে তো একে চেনার কথা,কিন্তু তিনি কিছুই চিনতে পারলেন না।
বাসায় এসে জিজ্ঞেস করলেন,
– অনু, তোমার ঐ জেঠাতো ভাই আমাদের বিয়েতে আসেনি? কই আমার সাথে তো কেউ তাকে পরিচয় করায়নি।
– কিভাবে আসবে বলেন? ও তো দেশে ছিলো না।
দেশের বাইরে থাকে ও। এইবারই তো আসছে।
এইভাবে হাজারো মিথ্যার আশ্রয়েই ধামাচাপা পড়ে যায় তার পাপ-কর্ম।

আমার ক্লাস সিক্সের শেষের দিকে রেজা চৌধুরীর সাথে ঝগড়া বেঁধে যায় অনু চৌধুরীর।
আমিও এর পিছনে দায়ী।
যখন দেখলাম, তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে “আজমল উদ্দীন আসলে কে?”- এই বিষয় নিয়ে তখন খুব ইচ্ছা করতো আব্বুকে সব বলে দেই।
ফ্যামিলির এইসব অস্বাভাবিক কার্যকলাপ নিজের চোখে দেখতে দেখতে,এসবের মুখোমুখি হতে হতে আমি বয়সের চেয়েও দ্বিগুন বড় হয়ে গেছিলাম। আমিও সবটাই বুঝতাম ততদিনে।

একদিন অতি সন্তপর্ণে আব্বুর কানে কথাটা তুলে দেই। ইনি আজমল উদ্দীন,এনার সাথেই আম্মুর মেলামেশা, ইনি আমাদের বাসায় ও এসেছিলেন, ইনি আসলে অনু চৌধুরীর জেঠাতো ভাই না, ইত্যাদি সব…
কিন্তু আজমল উদ্দীনের আমার সাথে করা ব্যবহারগুলোর কথা লজ্জ্বার কারণে আর বলতে পারিনি।
এই নিয়ে একদিন তুমুল ঝগড়া বাঁধে।
অনু চৌধুরীকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। বাসায় সারাদিন কেউ থাকেনা। আব্বু সারা দিন-রাত থাকে বাইরে বাইরে। তাই আমাদের ও সাথে করে নিয়ে গেলেন অনু চৌধুরী।
আমাদের সাথে করে নিয়ে যাওয়াটা ছিলো তার একটা টোপ।
আমরা সাথে গেলে মাসে মাসে আমাদের খরচ পাঠাবে আব্বু, আর সেটা ও তার চাই, নিজের খরচের জন্য।

আমরা নানুর বাড়ি অনেক দিন কাটাই।
সেই আগের মতই আবার শুরু হলো।
একদিকে অনু চৌধুরী অন্যদিকে তানিশা চৌধুরী। দুজনেই যেন প্রতিযোগিতার মাঠে নেমে পড়েছিলো।
অনু চৌধুরীর ফ্যামিলিকে যখন তার অবৈধ সম্পর্কের কথা আব্বু জানায় তখন তারা একটু রুক্ষ ভাবাপন্ন হয় তার সাথে।

কিন্তু যখন নিজেরাই ঘটনা পরখ করে দেখলো, আসলেই ঘটনা সত্যি। অনু চৌধুরীর সত্যিই আরেকটি অবৈধ সম্পর্ক আছে এবং সে সেই সম্পর্কের সাথে গুরুতরভাবেই জড়িয়ে পড়েছে তখনই তারা শক্ত হাতে ধরে। বিষয়টার গুরুত্ব দেয়। বড় মামার বড় বড় কথা তখন যেন নিমিষেই ভেজা বেড়ালের মত চুপসে যায়।

সে এবং পুরো ফ্যামিলি তাকে নানানভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে।
দুই মেয়ে আছে, এত ভালো-স্বাবলম্বী স্বামী আছে, তাহলে কেন তুই অন্য একটা সম্পর্কে যাবি-এসব বোঝানো হলো কয়েক ধাপে।
কিন্তু ততদিনে খুব বেশিই দেরী হয়ে গেছিলো।
নিজের মা,ভাই, বোনদের কথাও কানে তুললেন না অনু চৌধুরী।
তার আর রেজা চৌধুরীকে ভালো লাগেনা।
তাকে আর তার চাই ই না।
এটাই মূল এবং শেষ কথা।

মাস যেতেই আবার সে কন্সিভ করে।
মাঝেমধ্যেই তো নিঁখোজ থাকে।
তাই সবার আর বুঝতে বাকি রইলো না বিষয়টা আর স্বাভাবিক নেই।
অনু চৌধুরীর মা প্রথম প্রথম খুব শক্তভাবেই ধরেছিলেন। খুব বোঝাতেন, শাসন করতেন।
এসব অনু চৌধুরী আজমল উদ্দীনকে জানালে আজমল উদ্দীন তার টাকার খেল দেখানো আরম্ভ করেন।

সে প্রতিনিয়ত নানান ধরণের ফলমূল, শাড়ি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিতে লাগলেন শাশুড়ি, ভাবী, বোনদের।
ফলপ্রসূ সবাই ই আস্তে আস্তে চুপ করে যায়।
হতদরিদ্র ফ্যামিলি একটু কিছু পেলেই মহানন্দে থাকে – এই আরকি।
তারা আগের মত আর শক্ত হাতে ঘায়েল করলো না অনু চৌধুরীকে বরং সাপোর্টিভ হয়ে গেলো ক্রমশ। কিন্তু বড় মামা আর মেঝো,ছোট মামারা এসবের ঘুণাক্ষর ও জানতেন না। জানলে,তারা হয়তো তাদের বোনকে এই বিপথে যেতে সাহায্য করতো না। অনু চৌধুরীকে কড়া চোখে দেখেশুনে রাখার দায়িত্ব যাদের হাতে দিলো তারাই ছিলো দায়িত্বজ্ঞানহীন,লোভী।
তারাই আরো আস্কারা দিতে লাগলো।
অনু চৌধুরীর খাওয়ার হার আরো বেড়ে গেলো।
সে দিনে দিনে নিজেকে সুন্দরী বানাতে থাকে। প্রতিমাসে দুবার করে পার্লারে যাওয়া আরম্ভ করে।

গ্রাম্য প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে,
১০দিন চোরের, একদিন গেরস্তের।
একদিন সবটা ফাঁস হয়ে যায় মামাদের কাছে। তারা তাদের সর্বস্ব দিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনু চৌধুরীকে সাত আট মাসের ও বেশি সময় পর আবারো রেজা চৌধুরীর কাছে পাঠায়। রেজা চৌধুরী দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে আর অনু চৌধুরীর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে আবারো মেনে নেয়। সে ভাবলো, এতদিন পরিবারের কাছে ছিলো। হয়তো আমার কথা না হোক, মেয়েদের কথা ভেবে হলেও শুধরে গেছে।
মানুষ মাত্রই ভুল করে।
সে বরং নিজেই নিজেকে আরো শুধরানোর চেষ্টা করলো। এবার থেকে অনুকে,বাচ্চাদের বেশি সময় দিবো। এই সেই…

কিন্তু না!
পরের দিনই সে আমাদের বাসায় রেখে পালিয়ে যায়।

অনেক রাত অবধি ফিরছে না অনু চৌধুরী।
পাগলের মত এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন রেজা চৌধুরী।
কাঁদতে কাঁদতে অসহায়ের মত সব জায়গায় ফোন করছেন। কোনো জায়গায় বাদ রাখেন নি।
কিন্তু, কোত্থাও নেই অনু চৌধুরী!

রাত বারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট, তখন ও রেজা চৌধুরীর দরজা খোলা,
“অনু চৌধুরী আসবে বলে।”
কিন্তু সে আর আসেনি।
তখনই রেজা চৌধুরী বুঝে যান,
সে ভুল করেছে আবার। নিজের বউকেও বিশ্বাস করতে নেই এভাবে। এতটা ভালোবাসতে নেই!
বিশ্বাসঘাতকতার শামিল হয়েছে সে!
চরম অন্যায় হয়েছে তার সাথে।
সব মিথ্যা!
সব অভিনয় ছিলো!

(চলবে)

#রাকা (১২)

অনু চৌধুরী চলে যাওয়ার মাস দেড়েক পর ও আমরা কেউ স্বাভাবিক হতে পারি নি। যতই হোক, সে একজন স্ত্রী ছিলো, একজন মা ছিলো।
বাসার আনাচে-কানাচ যেন তার স্মৃতি আঁকড়ে ধরেই আছে। আলস্য কিংবা পরিশ্রমের অথবা হোক তা অবিশ্বাসের..যেমনই হোক, আমরা যেমনভাবে পেয়েছিলাম আমাদের মাকে এতদিন,তেমনভাবেই চিনি তাকে।
আমাদের মা’কে চেনা আর অন্যদের মা’কে চেনার মধ্যে বিস্তর ফারাক। তাই আমরা তেমনভাবেই তার সামান্য অভাব অনুভব করছি।
আমার ক্লাস সেভেনের পড়াশোনা কোথায়,
কোথায় আমার বাল্যকাল?
সব শেষ। সব নষ্ট।
সব আমার আম্মুর সুখের জন্য খুন হয়েছে।
ক্ষতবিক্ষত,নষ্ট হয়ে গেছে তিন তিনটি জীবন।

অনু চৌধুরী যাওয়ার সময় তার সব বিয়ের গহনা,শাড়ি,তার প্রয়োজনীয় কিছু হাড়ি-পাতিল,ব্লেন্ডার ইত্যাদি নিয়ে গেছে।
সে হয়তো একেবারে না পারতে ঘরের সব আসবাবপত্র ছেড়ে গেছে। যদি সম্ভব হতো,তাহলে পুরো বাসার সবকিছু নিয়েই সে চলে যেত।
সবই আব্বুর দেওয়া। আব্বুর টাকায় কেনা।
সামনে দুই দুইটা মেয়ের বিয়ে দিবে, এই ভেবে হলেও সে কিছু গহনা অন্তত রেখে যেতে পারতো। রেখে যাওয়াই তো উচিতব্য ছিলো,মাতৃবৎ আচরণের তাড়নায়?

কিন্তু অনু চৌধুরীর মাতৃত্ববোধ, তার সাধারণ ন্যুনতম হিতাহিত জ্ঞান সব কিছুর উর্দ্ধে চলে গিয়েছে।
এই সবকিছুর চেয়ে তার কাছে দামী একজনই।
আজমল উদ্দীন। আমরা তিনজন,সে একজন। তবুও তার পাল্লাই ভারী।

অনু চৌধুরীর বাড়ি থেকে পালানোর ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ও দাদি বা ফুফুরা কেউই একটা ফোন করে একবারের জন্য ও খোঁজ নেয়নি আমাদের। দাদির ক্ষোভ মূলত আব্বুর উপর। আর আমাদের উপর আছে রাগ, কারণ আমরা অনু চৌধুরী গর্ভজাত সন্তান। ফুফুরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চাচ্ছে কারণ তাদের ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিতে হবে সামনেই। বড় ফুফু তো ঢাকা ছেড়েই চলে গেছেন। ওখান থেকেই পাত্রী দেখেছেন,সম্বন্ধ ও করে ফেলেছে। রেজা চৌধুরী নামে তার কোনো ভাই নেই- পাত্রীপক্ষকে এমনটাই জানানো হয়েছে।
অথচ একসময় এই রেজা চৌধুরীর টাকাতেই তাদের সংসার চলতো।


আপন স্যারের ফোন এসেছিলো ইতোমধ্যে অনেকবার।
স্কুলে কেন যাইনা, এটা জানার জন্যই সে ফোন করে, জানি।
কিন্তু আমার কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই।
কারণ এসবের কৈফিয়ত দিয়ে আব্বুকে টপকানো গেলেও তাকে টপকানো যাবেনা। ধরা পড়তে হবেই।

আব্বুর সাথে এখন আপন স্যারের সম্পর্ক ভালো। কয়েকদিন আগেও দুজন মিলে মতি চাচার দোকানে বসে চা খেয়েছে,গল্প করেছে। এই একজনই মানুষ যে আব্বুকে টিটকারি করে বা খোঁচা দিয়ে কোনো কথা বলেনি এখন পর্যন্ত।
এই বিশারদ কোনো কথাই জিজ্ঞেস করেনি।

কিন্তু দিনে অন্তত হাজারখানেকবার অগণিত মানুষের প্রশ্নের পাহাড়ে ডুবে কাহিল হয়ে সে ফিরে আসে।

“ঐ মিয়া,কেমন পুরুষ আফনে? নিজের বউ ধইর‍্যা রাখতে পারেন না?”
“এই ভাই এই, আফনের বই নাকি ভাইগ্যা গেছে?”
“ভাই আপনার মধ্যে পুরুষত্ব নাই নাকি? না কি কোনো অক্ষমতা আছে?সব ঠিক থাকলে বউ অন্য লোকের কাছে যায় ক্যান ভাই?”
“ভাই শুনছি আপনার পালাইন্যা বউয়ের ওইহানেও ছানাপোনা হইছে?”
” আফনে কেমন পুরুষ ভাই? বউ প্রেমিক নিয়া আফনের নিজের ঘরে ও থাওনের সাহস পায়! এতটা উদাসীন কেম্নে আফনে ভাই?”
ইত্যাদি সব অশালীন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তার, রোজ রোজ।

সে প্রসঙ্গ বাদ দিলাম।
তবুও সে এখন তার দুই মেয়ে নিয়েই ভালো থাকার চেষ্টা করছে।
দাদিকে ফোন করলে দাদি ফোন ধরেনা,
কেটে দেয়।
তাই একদিন আমাকে ও সাথে করে নিয়ে গেলো দাদির কাছে।

দাদির কাছে মিনতি করে বললো,
সে যেন আমাদের সাথেই এখন থেকে থাকে।
দাদি কিছুতেই রাজি হলেন না।
তার এখন আবার একটাই কথা,
– রেজা, তোকে আমি আবার বিয়ে দিবো। আমার ছোট বোনের মেয়ের সাথে। ওর আগের স্বামী মারা গেছে। কিন্তু মেয়েডা খুবই বালা। এমন মেয়ে পাওন ভাইগ্যের ব্যাপার।

আসলেই ঐ মহিলা দেখতে-শুনতে ভালো। ছিমছাম গঠন, টিপটপ চলন।
আমিও তাকে চিনি। মাঝেমধ্যে দাদির বোনের সাথে সেও আমাদের বাসায় আসতো।
অনু চৌধুরী তো তখন বিষ খেয়ে বিষ হজম করতো।
ঐ মহিলা আমাকে খুব আদর করতো।
তার চোখের মধ্যে বিধাতা এক গাদা মায়া ঢেলে দিয়েছেন বোধ করি। ঐ আন্টিকে আমার এতটাই ভালো লাগতো যে ছোটবেলায় সে চলে যাবে শুনলে তার ব্যাগ লুকিয়ে রাখতাম।
তারপর প্রমিস করিয়ে নিতাম,
তুমি আবার কালকেই চলে আসবা তো?

ঐ আন্টির জীবনের গল্পটাও খুব মর্মান্তিক।
তার স্বামী বিয়ের পাঁচ বছর পরই মারা যায়।
তার প্রথম সন্তান ও স্বামী মারা যাবার ছয় মাসের মাথায় মারা যায়। বাচ্চাটার শ্বাসকষ্ট উঠছিলো।
ওর পায়খানায় ও সমস্যা ছিলো।
কালো রঙের পায়খানা করতো নির্দিষ্ট সময় পার হবার পরেও।
তারপর হঠাৎ সামান্য শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েই নিস্তেজ হয়ে যায় শেষ সম্বলটুকুও।
বিধাতার লেখা নিয়তি আমাদের দুই কুলের দুইজনের জন্যই খুব নিষ্ঠুর,পাষণ্ডতায় ভরপুর।
কেন? আমাদের জন্য তাহলে পৃথিবীতে আসা বরাদ্দ হয়েছিলো কেন?
সবার জন্য পৃথিবী এত সুখ-সাফল্যের।
আমাদের বেলায় তাহলে কেন এত নিষ্ঠুরতা,
হে বিধি!

এখন সে নি:স্ব।
এখন পর্যন্ত উনার বিয়ের জন্য অনেক পাত্রই এসেছে। রুপে গুণে লক্ষী তো। কিন্তু যাদের প্রতি সে সামান্য এগিয়েছে বা তার ভালো লেগেছে; তারাই পরে পিছিয়ে গেছে। দু দু বার এনগেইজমেন্ট রিং ও পরিয়ে গিয়েছিলো।
এক সপ্তাহ পর আবার না করে দিয়েছে বিনা কারণে।
অবশ্য ভিত্তিহীন একটা কারণ আছে,
সে অপয়া মেয়ে।
তাছাড়া সমাজে নিন্দুক আর বিয়ে ভাঙার কমিটির তো অভাব নেই, তাইনা?
তাদের কথা,
যার স্বামী, বাচ্চা দুটোই একসাথে মরে, তার মত অপয়া-অভাগী আছে নাকি দুনিয়ায়?
অপয়া মেয়ে-মানুষ!
ঐ আন্টির নাম রিমা। রিমা আক্তার।
সে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছিলো।
উচ্চ মাধ্যমিকের আগেই বিয়ে।
আর তারপর এই সব…
একের পর এক ঘটে গেলো।

দাদি এখন সর্বস্ব দিয়ে চায় রিমা আক্তারকে আমাদের বাবার বউ করে আনতে।
কিন্তু আব্বু কোনোভাবেই রাজি নয়।
সে কিছুতেই অনু চৌধুরীকে ভুলতে পারছেনা। পারবে বলে মনেও হয়না।
অনু চৌধুরীর মায়া কাটিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে সংসার পাতা, তার পক্ষে অসম্ভব।

তার মা বলে,
– ঐ দুশ্চরিত্রা ফিরলেও কি তুই তারে মাইন্না নিবি? সমাজে চলতে পারবি তুই?
আমরা তো কেউ মুখ ও দেখাইতে পারুম না।

– মেনে নিবো মা। মেনে নিবো। অনু আমার দুই মেয়ের মা, আমার স্ত্রী, আমার সব।

– ওরে নিমকহারাম , তুই বুঝলি না এখনো? তুই এখনো বুঝলি ঐ কাল-নাগিনী আসলে শয়তান ছিলো। অয় তোর টাকার লোভে এতদিন পইড়্যা ছিলো? আরে ওর এই প্রেম পিরিতি অনেক আগে থেইক্যাই চলে বাপ, আমি নিজেও দ্যাখছি। বিয়ে কইর‍্যা আহনের পর ও এই মাইয়্যা তার পিয়ারের প্রেমিকগো লগে কথা কইতো। আমি নিজ কানেও শুনছি। এহন এইডা কোনডার লগে ভাগছে তা তো আর বলতে পারিনা বাপ। ঘাট হইছে আমার। তুই এই বউয়ের কথা ভুইল্যা যা বাপ। দোহাই লাগে তোর।

রেজা চৌধুরীর চোখ মুখে আড়ষ্টতা।
সে বিকারহীন।
প্রলম্বিত শ্বাস নিচ্ছে।

কিঞ্চিৎ অবসাদ আর ঘোরের মধ্যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে,
অনু চৌধুরী তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে।
সে তার অধিকার ফিরে পেতে চাচ্ছে।
সে কি মায়াবী চাহনিযুক্ত আঁখিপল্লব!
করুন মুখায়বে বলছে,
– রেজা, আপনি আরেকটা বিয়ে করে নিলেন? আমার ঘর কোথায়? কোথায় আমার সংসার?
রেজা চৌধুরী অস্ফুটস্বরে বলে,
– তুমি ও তো সব ভেঙে দিয়ে চলে গেলে অনু।
এত কিছুর পরেও অন্য কারো সাথে ঘর বাঁধলে তুমি।
– আমার মতিভ্রম হয়েছিলো। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনার পায়ে পড়ি। আর হবেনা এমন।

রেজা চৌধুরী ভাবছে,
তখন সে কি করবে?
যদি অনু ফিরে আসে?
যদি আবার দৃঢ়ভাবে ক্ষমা চায়?
বার বার কেউ ঠকায় নাকি?
না! নিয়তি এত নিষ্ঠুর হতে পারেনা।
অনুর দুই দুইটা মেয়ে আছে।
অনু ফিরে আসবে।
তারপর আমরা দুজন মিলে
আমাদের মেয়েদের বড় করবো, বিয়ে দিবো। আসুক এবার অনু, ওকে আমি আমার ভালোবাসায় ভরিয়ে দিবো!
অনু আসবে, ও আসবে।
আমার ভালোবাসা তো মিথ্যা ছিলো না।
এখনো খুব ভালোবাসি। আমার ভালোবাসা মিথ্যা নয়। আমার ভালোবাসা,মেয়েদের ভালোবাসার টানে হলেও সে ফিরে আসবে।
সে এসব ভেবে মনে মনে আশ্বস্ত হয়।

দাদি ছেলের চোখের এই আশা-ভরসার ছাপ স্পষ্ট দেখেন। বুঝতে পারেন, তার এই ছেলে অন্ধ।
এই ছেলে কোনোদিন ও শুধরানোর নয়।
দাদি ও ছাড়ার পাত্রী নয়।
দাদিও গোঁ ধরে রইলেন।
আমরা দাদিকে ছাড়াই বাসায় ফিরে এসেছি।
সে ফেরেনি আমাদের সাথে আমাদের বাসায়।
যা হয় হোক, ছেলের এই কষ্ট উনি নিজ চোখ দেখতে পারবেন না আর।
তাই ছেলেকে আবার বিয়ে করাবে,
তারপর ছেলের কাছে গিয়ে থাকবে।
ছেলের সুখ দেখে যেতে চায় এই অভাগী মা।


আজকের আকাশ কয়েক মুহূর্ত আগেও স্বচ্ছ ছিলো। সন্ধ্যে নেমে এসেছে।
এখন মনে হচ্ছে দাপুটে হাওয়া বইবে।
আকাশ কালো হয়ে গেছে,হয়তো এখনি তাণ্ডবনৃত্যের ভঙ্গিতে ঝড়-বৃষ্টি নামবে।

কিন্তু আজকে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আমাদের বাসার আরেকজন সদস্য নিরুদ্দেশ।
তানিশা আপু বাসায় এখনো ফিরেনি।
সকালে নাস্তা করে বেরিয়েছিলো কিনা জানিনা। আমি ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম সে বাসায় নেই। আব্বু দরজা বাইরে দিয়ে লক করে ততক্ষনে কাজে চলে গেছে।
আমি একটু দেরী করেই ঘুম থেকে উঠি।
কাজ নেই, পড়াশোনা নেই, করবোটা কি সারাদিন.. তাই।
আব্বুকে এ নিয়ে দুবার ফোন দিলাম।
– আব্বু,তানিশা আপু তোমাকে কিছু বলে গেছে? দুপুরে তো খেতেও আসেনাই।
– না মা। কোন বান্ধবীর বাসায় গেছে হয়তো। চলে আসবে।

আবার সন্ধ্যায় ফোন দিলাম।
– আব্বু আপু কি কল দিছে তোমাকে?
– কেন? তানিশা এখনো বাসায় যায়নি?
– না।

(চলবে)

ফারজানা রহমান তৃনা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here