রাকা (১৩)

0
632

রাকা (১৩)
ফারজানা রহমান তৃনা

আমি বাসায় বসে বসে খুব বিরক্ত হচ্ছিলাম।
একা থাকা যায়, কিন্তু কতক্ষন?
সারা দিন গেলো, সন্ধ্যা ও চলে যাচ্ছে..
এই একাই পড়ে আছি বাসায়.. সারা বাসা শূন্য, কেউ নেই। মা নেই, বাবা ও নেই। বোন থাকতো কিছুক্ষন, এখন বোন ও নেই। আচ্ছা তানিশা আপু এতক্ষন বাইরে কী করছে? কোনো বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে গেছে নিশ্চয়? কিন্তু আব্বু এত বিচলিত হলো কেন? এমন সময় কলিংবেল বাজলো।

আব্বু এসেছে। তার চোখ-মুখ গম্ভীর হয়ে আছে।
– আব্বু, তানিশা আপু কি ওর বান্ধবীর বাসায় গেছে?
আব্বু চোখ গরম করে বললো,
– রাকা, বিরক্ত করিস না। রুমে যা।
– আব্বু…
– যাও মা, তুমি রুমে যাও। আমি তানিশার খোঁজ নিচ্ছি।
আমি খুব করুণ কন্ঠে বললাম,
– আব্বু আমার সারাদিন একা একা বাসায় থাকতে আর ভাল্লাগেনা। দম বন্ধ হয়ে আসে। কেউ নাই। কারো সাথে খেলতে পারিনা,কথা পর্যন্ত বলতে পারিনা। তুমিও থাকো না বাসায়।
আবার জোর গলা যোগ করে বললাম,
আমি কি করবো টা কি সারাদিন? বলো!

আব্বু এবার শান্ত চাহনিতে তাকিয়ে ভাবলেশহীন স্বরে বললেন,
– মা, তোমার আপু তো সারাদিনই থাকে তোমার সাথে। আজ হয়তো ছিলো না। এখন তুমি একটু আমাকে একা ছেড়ে দাও। তোমার জন্য আজকে বার্গার এনেছি,ব্যাগে দেখো। নিজের রুমে গিয়ে খাও এটা? আমি একটু পরে তোমার রুমে আসছি। আজকে আমিই তোমার সাথে গল্পগুজব করবো।

আব্বু মনে করে, তানিশা আপু সারাক্ষন বাসায় থাকে, আমার সাথে খেলে,আমাকে সময় দেয়।
কিন্তু আসল কাহিনী তো ভিন্ন।
আপু মোটেও আমাকে সময় দেয়না।
সে সারাক্ষন তার নিজ কর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
আমি লক্ষ্য করেছি,
বেশ ক’দিন যাবত সে কিছু একটা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন।

আমি বার্গার নিয়ে নিজ রুমে গেলাম না।
ড্রয়িংরুমে টিভি অন করে বসলাম।
আব্বু তখনই তাড়াতাড়ি নিজের রুমে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সে তার সব কাজ একদিকে ঠেঁসিয়ে চলে এসেছে। তার বুকটা ধকধক করছে।
তানিশা তার অবাধ্য-হেয়ালীস্বভাবের মেয়ে,
তাই তানিশাকে নিয়ে তার খুব দুশ্চিন্তা হয়।
তার হৃদয়চূর্ণ মন শুধু কু গাইছে,
কোথায় চলে গেলো মেয়েটা হঠাৎ?

তানিশা আপুর কাছে তার বান্ধবীদের নাম্বার অনেকবার চাওয়া সত্ত্বেও দেয়নি।
এখন যে জরুরি প্রয়োজনে ফোন করে দেখবে তার ও জোঁ নেই।
আব্বু আমাদের রুমে গিয়ে আপুর সব বই-পত্র খুঁজে খুঁজে হট্টোগোল করে ফেললো।
অবশেষে মাত্র দুটো নাম্বার পেলো।
সাথে সাথে ওখানে ফোন দিলো।
তানিশা আপু ওখানেও যায়নি।
আব্বু ভাবতে লাগলো,
আর কোথায় যেতে পারে মেয়েটা?
ও তো ওর ফুফুদের বাসাও ঠিক করে চেনেনা। অনেক দূরে তো।
আর ওর বড় ফুফুও তো এখন আর ঢাকায় নেই।
কাকার বাসা তো চিনবেই না।
আর ওর ছোট ফুফু থাকে উত্তরায়।
ওখানে কয়েকবার গেছিলো অবশ্য।
কিন্তু তবুও, এতদূরে কি একা একা যেতে পারবে?
গেলেও চিনবে কি করে?
আব্বু তৎক্ষণাৎ ফোন দেয় ছোট ফুফুর কাছে। কেউ ফোন তুললো না।
একাধারে ৫/৬বার ফোন করলো।
রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন ধরছে না।
কারণ তারা আব্বুর সাথে যোগাযোগ তো দূরে থাক, কথা বলতে ও নারাজ।

তাই বাধ্য হয়েই সে ছোট ফুফাকে ফোন করলো। ছোট ফুফা হচ্ছে সাদাসিধে ধরণের একজন নিতান্ত ভালো মানুষ। আব্বুর সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক। তাই প্রথম কলেই রিসিভ হলো।
আব্বু হ্যালো বলা ছাড়াই ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কায়সার, তানিশা কি তোমাদের বাসায় গেছে?
– কই ভাই আমি তো জানিনা। আপনার বোনকে ফোন করলে জানা যাবে। আমি তো এখন দোকানে আছি।
– আমার বোন তো আমার ফোন ধরবে না ভাই। নিজ হাতে বড় করছি তাকে। কিন্তু এখন তার কাছে আমি খুব খারাপ মানুষ। তার বড় ভাই তাকে এতবার কল করলো তবুও সে ফোন তোলেনি। ভালো ভালো,খুব ভালো হোক তার। দোয়া করি।
– ভাই আপনি কষ্ট পাইয়েন না তো। আমি ফোন করে খবর দিচ্ছি আপনাকে।
কিছুক্ষন পরই আবার কল ব্যাক,
– রেজা ভাই, তানিশা তো ওখানে যায়নি। কেন তানিশার হঠাৎ কি হলো?
– মেয়েটা এখনো বাসায় ফেরেনি কায়সার।
– কি বলেন!

এভাবে একে একে ফোন দেওয়ার মত সব জায়গায় ফোন করা শেষ হলো।
রাত ১১ টায় আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারলো না আব্বু।
ফোন দিলো অনু চৌধুরীর কাছে।
আব্বু আশাও করেনি অনু চৌধুরীর এই নাম্বার খোলা থাকবে বলে।
কিন্তু না।
অনু চৌধুরীর নাম্বার অন ছিলো এবং সৌভাগ্যবশত সে প্রথমবারেই ফোন রিসিভ করলো।
– হ্যালো অনু!
– হ্যাঁ। বলেন..
– আচ্ছা,তানিশা কি তোমার কাছে গেছে নাকি?
– কই না তো। এখানে কিভাবে আসবে? ও তো চেনে না। কেন? কী হইছে?
– তানিশা তো এখনো বাসায় ফেরেনি। আজকে সকালে বের হইছে। এখনো বাসায় আসেনি। কোনো বান্ধবীর বাসায় থাকার কথা হলে তো বলে যাবে। কিছু বলেনি আমায়। এত রাত হয়ে গেছে,মেয়ে এখনো বাসায় আসেনাই। ও এত রাত বাইরে থাকছে কখনো বলো?
কোনোদিন তো থাকার সাহস_ই করেনি !

– ওমা! তানিশাকে ফোন করেন তাহলে!
মেয়ে কই যাবে তাহলে!

– তোমার কী মনে হয়? আমি করিনাই? ওর ফোন বন্ধ। আমি হাজারবার ট্রাই করছি। ফোন বন্ধ মেয়ের।

– আচ্ছা দাঁড়ান! দাঁড়ান! আমি দেখছি।
বলে সে ফোন কেটে দিয়েই তানিশা আপুকে কল দিলো। সেই একই অবস্থা,ফোন বন্ধ।

অনু চৌধুরীর এবার সামান্য খটকা লাগলো।
তানিশা আপুর খুব কাছের একজন বন্ধু আছে।
নাম রফিক।
সে সবসময়ই তার কথা বলতো অনু চৌধুরীর কাছে। একদিন কথায় কথায় ছবিও দেখিয়েছিলো ছেলেটার।
কি অদ্ভুত বাজে দেখতে!
মাঝেমধ্যেই তো মা মেয়ের আড্ডা বসতো,সেই খাতিরেই ছবি দেখিয়ে বলেছিলো একদিন,
– আম্মু দেখো,এটা হলো রফিক। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ও খুব খুব ভালো। জানো?

অনু চৌধুরীর মেয়ের বন্ধু হিসেবেও এই ছেলেকে ভালো লাগেনি। কারণ সে উচ্চাকাঙ্ক্ষী।
তার স্বপ্ন সে তার এই মেয়ের বিয়ে দিবে খুব বড় কোনো ঘরে।
এমন ছেলের কাছে দিবে যে ছেলে দেখতে হবে রাজপুত্রের মত। ধনাঢ্য সেই ফ্যামিলির ও নামডাক ছড়িয়ে থাকবে চারপাশে।
রাকা তো অত সুন্দর হয়নি, কালো হয়েছে বাপের মত। তাই তানিশাকে নিয়েই তার কত শত আশা-ভরসা! বুকভরা স্বপ্ন!

কিন্তু সেখানে তানিশার এরকম একটা ছেলে বন্ধু আছে,তাও আবার বেস্ট ফ্রেন্ড।
এক কথায় অনু চৌধুরীর ভালো লাগেনি।
ছেলেটা ঐ পাড়ারই,একই এলাকার।
বস্তিটস্তিতেই থাকে।
অনু চৌধুরী তাকে চেনে অল্পস্বল্প।
ভবঘুরে, বখাটে ছেলে।
রাস্তাঘাটে বিড়ি-সিগারেট টানে।
পথেঘাটে সুন্দরী মেয়ে দেখলে শিঁস দেয়,
এমন টাইপের। দেখলেই গা ঘেন্না দিয়ে উঠে তার।
এমন ছেলে তানিশার বন্ধু হয় কি করে?
সে কয়েকবার মেয়েকে মানাও করেছে এই ছেলের সাথে এত বেশি না মিশতে।
কিন্তু তানিশা সেটাকে আমলেই নেয়নি।
সেও আর অত গুরুত্ব দেয়নি, দেওয়ার সময় ও অবশ্য পায়নি। ভেবেছে, বন্ধুই তো। থাক না! এরকম ছেলে বন্ধু সবারই থাকে, তার ও তো কত ছেলে বন্ধু ছিলো!
গুনে শেষ করা যাবে কি?
উহুম। সুন্দরী মেয়েদের জীবনে ছেলে বন্ধুর অভাব থাকে না তো!

কিন্তু অনু চৌধুরীর বুকের ভেতরটা এখন কেমন যেন খচ খচ করছে!
তার কেন যেন মনে হচ্ছে তানিশা এই ছেলের সাথেই…না! না! ছি:! কি ভাবছি আমি এসব!
সে পর পর একনাগাড়ে ফোন দিতেই লাগলো।
তীব্র রাগে ফেঁটে পড়ছিলো,ফোন বন্ধ দেখে।
সে ভাবছে,
“তানিশা এই ছেলের সাথে কিছু করে ফেলেনি তো! হায় হায়!”
মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগলো,
“তানিশারে, ফোন ধর মা। ফোন ধর্!”

অনু চৌধুরী নিজেও খুব একটা সুখে নেই এখন। তার নতুন সংসারেও ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে। আজমল উদ্দীন আসলে এত বড়লোক কেউ না। সে আসলে একজন গাড়ির ড্রাইভার। কিন্তু সামান্য গাড়ি চালিয়ে সে এতদিন এত টাকার বাহার কিভাবে দেখালো কিছুতেই সেই অংক মেলাতে পারছে না অনু চৌধুরী।
সে ইতোমধ্যেই আবার কন্সিভ করেছে।
সব মিলিয়ে তার জীবন এখন ভাঙা ব্রিজের ন্যায়। যেকোনো সময় ভেঙে পড়ে যেতে পারে। যদি বড় কোনো ট্রাক বা বাস ঐ ব্রিজে উঠে পড়ে তাহলে তো হলোই। আর কোনো কথাই নেই।
সব ভেঙে চুরমার হয়ে ভেসে যাবে।

এখন আবার তানিশার এই খবর।
তার মাথা ঠিক নেই।
সে অনবরত মেয়েকে কল দিয়েই যাচ্ছে।
পাগলের মত এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। আর উত্তেজিত মনে ভাবছে,
হায়রে,তানিশা আবার ঐ ছেলের সাথে চলে যায়নি তো? এইসব ভেবে ভেবে সে মরিয়া হয়ে উঠলো।

অত:পর তানিশা আপুর ফোনে কল ঢুকলো।
তখন রাত প্রায় একটা ছুঁই ছুঁই।
তানিশা আপু ফোন রিসিভ করেই খুব আনন্দঘন গলায় বললো,
– হ্যালো আম্মু!
অনু চৌধুরীর তির্যকপ্রক্ষেপণ গলায় বললো,
– হ্যাঁ মা! তুই কই? কোথায় চলে গেছিস?
– ওমা! তুমি কিভাবে জানো আমি চলে গেছি কিনা? কে বললো?
– তোর আব্বু কল দিয়ে বলছে, তুই আজকে সারাদিন বাসায় ফেরোস নাই। রাত ১১টায় ও বাসায় যাস নি। কোথায় তুই মা? কোথায় গেলি?

তানিশা আপু উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
– আম্মু আমি রফিকের সাথে পালিয়ে আসছি!
কথাটা এমনভাবে বললো যেন সে কোনো বড়সড় পরীক্ষায় টপ মার্কস পেয়েছে, তার এখন চাকরী নিশ্চিত।

অনু চৌধুরী এবার খাবি খেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কোন রফিক? ঐ কোন রফিকের সাথে গেলি?
– আরে আম্মু,ঐ যে ও, তোমাকে না ছবি দেখাইছিলাম! ও ই তো! আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, আমার লাভার! এখনো চেনোনাই?

অনু চৌধুরীর নিজের এত এত প্রিয় মেয়ের মুখে এরকম একটা দু:সংবাদ শুনে একেবারেই দমে গেলো। নিজের এই মন্দ নসিবের উপর এবার খুব আক্ষেপ হলো তার।
তার হৃদপৃন্ডের গতি ক্রমশ প্রবল বেগে ছুটতে আরম্ভ করলো। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো নিজের মেয়ের মুখে এই অলুক্ষুনে কথা শুনে।
তোঁতলাতে তোঁতলাতে জিজ্ঞেস করলো
– তু_তু_ই কি বললি? তুই শেষমেশ রফিকের সাথে পালিয়ে গেলি!

– হ্যাঁ আম্মু! কেন?

অনু চৌধুরী বিষম খেয়ে সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,
– ওরে গাঁধা,ঐ পোলা তো বখাটে,মূর্খ,বস্তির একটা ছেলে। তুই এরম একটা ছেলেরেই পাইলি? ওরে শুওরের বাচ্চা, তুই আমার কত স্বাদের মেয়ে, কত ভালো জায়গায় আমি তোরে বিয়ে দিমু বলে ভাইব্যা রাখছি। কত শখ আমার। আর তুই এইডা কি করলি! হায় হায়!

তানিশা আপু এবার গম্ভীর গলায় বললো,
– ও তাহলে তুমিও আমাকে সাপোর্ট দিবানা? আর গালিগালাজ করবা না একদম। খবরদার!

অনু চৌধুরী বজ্রধ্বনির ন্যায় হুংকার ছেড়ে বললো,
– তুই ঐ কুত্তার বাচ্চাটারে ফোনটা দে। তাড়াতাড়ি দে। হায় হায় রে সর্বনাশ হয়ে গেছে আমার।

তানিশা আপু কঠিন গলায় বললো,
– তুমি একদম আমার হাজবেন্ড কে গালি দিবা না আম্মু। তুমি ওকে এইভাবে বলার সাহস করো কিভাবে হ্যাঁ? আমি তো তোমাকে ফোন দিয়ে মনে হয় ভুল করছি।

আহাজারি করতে করতে সে বললো,
– ওরে তানিশা, ঐ পোলা ভালো না একদম। ও একটা বখাটে, বস্তির ছেলে। তুই জানোস না। আমি নিজেও ওরে রাস্তাঘাটে বিড়ি-সিগারেট টানতে দেখছি। বদমাইশি করতে দেখছি।
কেউ ওরে ভালো বলে না। বাজে ছেলে।

– কেন আম্মু? আজমল আংকেল ও তো সিগারেট খায়। আংকেল ও তো রাকার সাথে বদমাইশি করছে। কই তবুও তো তুমি ঐ আংকেলের সাথেই পালায়ে গেছো! কেন বলোতো? কারণ তুমি তাকে ভালোবাসো। তুমি শাহ্ রুখ খানের ঐ মুভিটা দেখোনি? প্রেম-ভালোবাসার কাছে সব তুচ্ছ আম্মু। রাবনে বানায়ে দিয়া জোড়ি। সব নাটক, মুভিতেই তো দেখায় এসব। আর রফিক ও তেমন। ও আমাকে খুব ভালোবাসে আম্মু। আমার জন্য ও মরে যেতেও পারবে। আমাকে এটা প্রতিদিন বলে তো!

অনু চৌধুরী নিজের মেয়েকে আর বোঝাতে পারলো না।
কিভাবে বোঝাবে?
মেয়ে তো এখন তার দিকেও আঙুল তুলছে!
– রাকাকে আদর করছে। বদমাইশি করছে কই? আর সিগারেট টানে সে,তার এখন কত বয়স হইছে জানোস? তুই আজমলের সাথে ঐ বেয়াদব ছেলেটাকে একদম মিলাবি না।

– তাহলে তুমিও আমার হাজবেন্ডকে নিয়ে এসব বাজে কথা একদম বলবানা। তোমার যেমন তোমার দ্বিতীয় জামাইকে নিয়ে কোনো বাজে কথা শুনতে ভালো লাগেনা; তেমন আমারো আম্মু। আমারো ভালো লাগেনা। কারণ আমি ওকে খুব ভালোবাসি। আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো না আম্মু। বিশ্বাস করো।

অনু চৌধুরী এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
কপাল কুঁচকে গেছে তার।
মেয়েকে সে কোনোভাবেই বোঝাতে পারছেনা। মেয়ে উল্টা তাকেই কথা শোনায়ে দিচ্ছে।
সে খুব কষ্টে কপট রাগের প্রতাপ কমিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– হাজবেন্ড হাজবেন্ড বলছিস কেন তানিশা?
তারপর আবার খুব আবেগ জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– মা, তোরা কি বিয়ে করে ফেলছোস নাকি?
সত্যি করে বল তো?

তানিশা আপু এবার স্বাভাবিক হলো।
সে খুব সবিনয়ের সাথে বললো,
– না। তবে ভোরেই করবো।

– ভোরে করবি মানে? কোথায় করবি? তোরা এখন কোথায় আছিস?

– কাজী অফিসে করবো। রফিকের বন্ধুরা মিলে সব ম্যানেজ করে রাখবে। আম্মু সাক্ষী কয়জন লাগে? আমার দিক থেকে কেউ একজন লাগবে তো। কাকে বলবো বলো! ধুর!

– আমি জানিনা কিছু। তুই কোন জায়গায় আছিস এখন, আমাকে বল। দোহাই তোর।

– কোন জায়গায় আছি…
আমতা আমতা করতে করতে পাশেই বসে থাকা রফিককে জিজ্ঞেস করলো,
এই আমরা এখন কোথায় আছি?
এই জায়গার নাম কী? আম্মু জিজ্ঞেস করতেছে।
রফিক ফিসফিস করে বললো,
তোমার মাথা নষ্ট নাকি তানিশা? তোমার আম্মু তো এই বিয়ে এখনো মানেই নাই। এখন তুমি জায়গার নাম বলে দিলে তো সে এখানে তোমার আব্বুসহ চলে আসবে। আইস্যা তোমারে আমার কাছ থেকে নিয়া যাবে। তখন কি হবে? তোমাকে যেটা বলতে বলছি শুধু ওইটা বলেই ফোন কেটে দাও বেবি, তাড়াতাড়ি করো!

অনু চৌধুরী তাদের ফিসফিসানি শুনলো।
কিন্তু কিছুই বুঝলো না।
সে পাগলের মত আবার জিজ্ঞেস করলো,
– তানিশা,তানিশা.. মা তুই এখন কোথায় আছিস? বল মা.. কোন জায়গায়?

তানিশা আপু তার বয়ফ্রেন্ডের কথাই মানলো।
সে খুব কঠিন গলায় বললো,
– শুনো আম্মু। আমি তোমাকে শুধু দুইটা কারণে ফোন দিছি। এক, আমি চাই আমার বিয়েতে আর কেউ না থাকুক,অন্তত তুমি থাকো। তাই তোমাকে ফোন দেওয়া।
দ্বিতীয়ত, তুমি মোল্লা কাজী অফিসে ভোর ছয়টায় একা চলে আসবা।

– মোল্লা কাজী অফিস কোথায়? ঠিকানা দে।

– ঠিকানা দেওয়া যাবেনা। তুমি রেডি থাকবা। রফিকের বন্ধুরা তোমাকে নিতে আসবে। তুমি তোমার বাসার ঠিকানা দাও।

– তানিশা,তুই এরকম করিস না… তোর আব্বু তোর অনেক ভালো জায়গায় বিয়ে দিবে,এই বখাটে ছেলে তোর জীবন ধ্বংস করে দিবে মা। তুই কোথায় আছিস আমাকে বল। রাতারাতি সব ধামাচাপা দেওয়া যাবে। নইলে পরে ভালো জায়গায় বিয়েও দিতে পারমু না আর। আমার কথা শোন তুই…

তানিশা কন্ঠ ভারী করে বললো,
– আব্বু থাকা সত্ত্বেও,তোমার দুই মেয়ে থাকা সত্ত্বেও তুমি আজমল আংকেলের প্রেমে পড়েছো। তার সাথে পালিয়ে ও গেছো সব ফেলে। তুমি যদি তোমার প্রেমের জন্য এতকিছু করতে পারো,তাহলে আমি বা অন্য কেউ করবে না কেন? অন্য কেউ কি কাউকে কখনো ভালোবাসতে পারেনা? আমি তো তোমাকে সবসময় সাপোর্ট করেছি। তুমি কেন করবা না? তোমাকে আমি সবসময় হেল্প করছি আংকেলের সাথে দেখা করতে। এটা ওটা করতে,সব কাজে হেল্প করছি।
তোমাকে সাপোর্ট করি দেখেই তো তুমি পালিয়ে যাওয়ার আগের রাতে তোমার সবকিছু এই আমিই গুছিয়ে দিছিলাম লুকিয়ে লুকিয়ে। আব্বুকেও কিছু বলিনাই। কারণ আমি জানি তুমি আব্বুর চেয়েও আংকেলকে বেশি ভালোবাসো। আর আমি জানি,ভালোবাসা কোনো নিয়ম মানে না আম্মু।
তাইজন্যই তো তুমি আমার আব্বুকে ফেলে চলে গেছো।

অনু চৌধুরীর শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা।
তার নিষ্পেষিত মন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে লজ্জ্বায়, নিজের ১৫/১৬ বছরের বাচ্চার মুখে এরকম কথা শুনে শুনে।
সে কান্নার রোলে ভেঙে পড়লো।
ভ্রুকুটি চেহারায় আতঙ্কিত হয়ে বললো,
– থাম তুই! আমার কথা শোন, ঐ ছেলে ভালো হবেনা। তুই সুখী হবি না।

তানিশা আপু নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
– আমার ভালো ছেলে চাইনা আম্মু। আমার রফিককেই চাই। তুমি যদি আমার ভালো চাও, তাহলে এই ব্যাপারে আর একটা কথা ও বলবা না। আর হ্যাঁ,কাউকে ঘুণাক্ষর ও জানাবা না এই ব্যাপারে। যদি আমার বিয়েতে থাকতে চাও তাহলে সকালে কাজী অফিসে চলে আসবা। যদি না আসো বা কাউকে কিছু বলো তাহলে কিন্তু খুব খারাপ কিছু হবে, বলে দিলাম।

– কী খারাপ হবে আর?

– আমি গলায় দঁড়ি দিবো। মরে যাবো। আল্লাহর কসম।

অনু চৌধুরী চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলেন। নিজের মেয়ের এই অন্যায় আবদার তার আজকে মেনে নিতেই হবে।
কারণ মেয়েকে সে কোনোভাবেই বোঝাতে পারছেনা, নিজের অপকির্তীর জন্য।
কিছু বললে মেয়ে পাল্টা তীর ছুঁড়ে।
সে শব্দ করে কেঁদেই দিলো এবার।
আজমল উদ্দীন তার পাশে এসে বসলো।
সে অনু চৌধুরীর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
– কী হইছে অনু?
অনু চৌধুরী তার হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে বললো,
– তুমি এখান থেকে যাও এখন আজমল। যাও। আমার সব আশা-ভরসা শেষ। আমার মেয়ে এইটা কি করতেছে! হায়রে! হায় হায়! এটা কী হলো!

ভোরের দিকে রফিকের সাঙ্গপাঙ্গ আসলো।
এসে অনু চৌধুরীকে নিয়ে গেলো মোল্লা কাজী অফিসে। অনু চৌধুরী নিজের সর্বস্বটা দিয়ে নিজের মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করলো।
কিন্তু তার পেটের মেয়ে তার চেয়েও বেশি বুঝদার।
অনু চৌধুরীর চোখের সামনে তার বড় মেয়ের একটা বখাটে,বস্তির ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো।

সে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসলো।
রেজা চৌধুরীকে ফোন দিয়ে বিষয়টা জানালো। তার মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো কথাটা শুনে।
আঁতকে উঠে শুধু বললো,
– আহ্, আমার তানিশা… আমার তানিশা…
তারপর আমাকে আঁকড়ে ধরে গগণচুম্বী চিৎকার দিয়ে কাঁদতে লাগলো আর আল্লাহর দরবারে আহাজারি করে বললো,

” হে আল্লাহ, আমি কি এমন পাপ করছি? কী পাপ করছিলাম আমি? তুমি আমার জীবন তছনছ করে দিলা। মেনে নিলাম। আমি পাপী। এখন আমার কলিজার টুকরা, আমার বড় মেয়ের জীবনটাও শেষ করে দিলা? ”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here