রাকা (১৫)

0
544

রাকা (১৫)
ফারজানা রহমান তৃনা

আব্বু যখন ঘরে ঢুকলো খালাও তার পেছন পেছন আসলো। বৃষ্টি থামছে না। বাইরের দাপুটে হাওয়ায় তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে সব। বিদ্যুৎ একবার গিয়ে আবার পাঁচ মিনিটের মাথাতেই চলে এসেছে। আজ বিদ্যুৎ থাকার সম্ভাবনা নেই। ঝড়-তুফানের সময় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার ব্যাপারটা আসলেই খুব জঘণ্য একটা বিষয়। তাকে আনার সময় I’m at your service টাইপ একটা প্রতিশ্রুতি দেওয়া-নেওয়ার বিষয় যোগ করা উচিত। যাতে ঝড় তুফানের সময় ও বিদ্যুৎ না যায়।
বিপদের সময়েই সার্ভিস না পেলে কিভাবে হবে।

– রাকা, এই রাকা, এদিকে আয় দেখি মা!
খালা আমাকে ডাকতেই আমি চলে গেলাম তার কাছে।
– কী খালামণি?
খালা তার হাতের ফার্স্ট এইড বক্সটা আমার হাতে দিয়ে বললো,
– এই দেখ, এটা রুই। এটাতে স্যাভলন দিয়েছি একটু। তুই তোর আব্বুর হাতে-পায়ে যেখানে যেখানে কাটা দেখবি ওখানে ওখানেই এটা দিয়ে ওয়াশ করে দিবি। ব্যথা করে কিনা জিজ্ঞেস করিস। আমি তার কথা মোতাবেক তাই করলাম।
করে এসে বললাম,
– খালামণি, আব্বু নিজেই সব ওয়াশ করছে। বলে, তেমন কিছুই হয়নাই। সেরে যাবে নাকি। আমি জোর করায় একটু করছে আরকি!
খালামণি চিন্তিত স্বরে বললেন,
– কি বলিস, আমি স্পষ্ট দেখলাম অনেকটাই ছিলে গেছে..
– হুঁ।
– আচ্ছা জিজ্ঞেস কর তো, চা খাবে নাকি স্যুপ খাবে? গরম কিছু খাবে কিনা জিজ্ঞেস করে আয়। করে দেই। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আসছে মানুষটা।

আমি তখনই গেলাম আব্বুর কাছে।
– আব্বু, ও আব্বু, চা খাবা?
আব্বু আমাকে টেনে নিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
– কে করবে মা? তুমি?
– না। আমি করবো কেন! খালামণি আছে নাহ?
– ও। আমিই করে আনি। তোমরা ড্রয়িংরুমে বসো। সে আমাদের মেহমান তো।
– না তুমি বসো। তুমি ব্যথা পাইছো।
চা খাবা তাই তো? আচ্ছাহ্।
আব্বু ইনিয়েবিনিয়ে কিছু বললো, আমি শুনলাম না।
খালামণিকে গিয়ে বলে দিলাম, চা বানাও।
সে একা মানুষ। কারো জন্য কিছু করার সুযোগ পেলে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করে।
এত ভালো মনের মানুষ মুখ দেখলে কেউ বুঝবেনা। অথচ তার কি পোড়া কপাল দেখো!
আমার আব্বুরও তাই।
আমার মনে হয়, জগতের সব ভালো ভালো মানুষদের জীবনে শত কষ্ট আর শত শত ব্যর্থতার গল্প নিবন্ধ থাকে।

খালার চা বানানোর গন্ধে সারাবাড়ি মৌ মৌ করছে। আমি চা খুব পছন্দ করি।
বজ্রপাত হচ্ছে তাই টিভি চালাতে দিলো না আব্বু। আব্বু ডিশ লাইন কেটে আমার পাশে বসে গল্পসল্প করতে লাগলো।
আমিও দুনিয়ার সব গল্প জুড়ে দিলাম।
সারাদিন কি কি করছি,কে কি বলছে সব কিছু আব্বুর কানে তুলে দিলাম!
এটা আমার নিত্যদিনের কর্ম।

আব্বু সামান্য হেসে বললো,
– আচ্ছা আচ্ছা… তা, নামাজ পড়ো তো? তোমার আপুর জন্য যে দোয়া করতে বললাম, করছিলা?
– ও হ্যাঁ হ্যাঁ। ঐ যে আপু বাসায় আসেনা সেটা? হ্যাঁ বলছি, সবার আগে এটাই বলছি, আপু যেন আমাদের কাছে ফিরে আসে। আচ্ছা আব্বু, আপু কই গেছে? রিতু আমাকে বার বার শুধু লজ্জ্বা দেয় জানো?
– কী বলে ও?
– বলে এই তোর আম্মুও পালাইছে, তোর বোন ও পালাইছে। তুই কবে পালাইবি রে? তারপরই সবাই হাসি-ঠাট্টা শুরু করে।
– রিতু কে? নাম ঠিকানা বলো। আমি ওকে ওর উত্তর দিয়ে আসি গিয়ে। বেয়াদব ছেলেমেয়ে!

অমন সময় খালা ডাক দিলো।
– রাকা, এইদিকে আসো তো মা।
আমি তার কাছে গেলাম।
সে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়েছে। এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যেন সে আব্বুকে দেখতে পায়, কিন্তু আব্বু যেন না দেখে।
ফিসফিস করে বললো,
– নাও। এই কাপটা তোমার আব্বুকে দিয়ে আসো। আর তারপর স্যুপটা রেখে আসো ওখানে। খেতে ইচ্ছা হলে খাবে। চিকেন স্যুপ, বলে দিবা।

আমি ট্রে হাতে নিয়ে আব্বুর সামনে গিয়ে খালার ডিরেকশনগুলো বললাম।
খালার কাছে গিয়ে দেখলাম,সে আমার রুমে বসেছে। সামনে দু কাপ চা,বিস্কুট পিঠা আর স্যুপ।
বিস্কুট পিঠা আজ খালাই বানিয়ে নিয়ে এসেছে।
আমার খুব পছন্দের তাই প্রায়শই বানিয়ে নিয়ে আনে। এইসব বানানোর জন্য ভালোই খরচ পড়ে। দুধ,চিনি,আটা,বিস্কুট ইত্যাদি..
এসব দিয়ে বানাতে গেলে তাকে অনেক কথা শুনতে হয়। ভাইয়ের বাসায় বাড়তি ঝামেলা হয়ে পড়ে আছে তো! ভাবীর কথার আঘাতেই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সব। তাই লুকিয়ে লুকিয়েই করে আনে।

আমি তার সামনে যেতেই আব্বুর ডাক পড়লো।
দৌঁড়ে গেলাম। আব্বু চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,
– রিমা কই? একা একা ওখানে কী করে?
– আমার রুমে বসছে। ওখানেই চা খাবো আমরা দুজন।
– তো, আমার সাথে বসে খেলে কী হয়ে যাবে? ওখানে কেন?
– কি জানি…
– এখানো আসো তোমরা।

আমি গিয়ে খালাকে বলতেই খালা দাঁড়িয়ে গেলো। আমি কিছুতেই বুঝিনা, খালা কেন আব্বুকে এত ভয় পায়!
সে কাচুমাচু করতে করতে ঐ রুমে গেলো।
সে আব্বুর থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে বসলো।

আব্বু চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন,
– রিমা, তোমার আম্মা কেমন আছে?
– আছে ভালোই। বাতের ব্যথা বাড়ে কমে। হাঁটতে সমস্যা হয় একটু..
– ও.. তোমার কী অবস্থা?
– আছি ভাই, এইতো ভালোই।
– তো, আজকে এত ঝড়-তুফান যখন, থেকে যাও বাসায়। সমস্যা তো নাই। তাইনা?
– না.. ঠিক আছে ভাই।
– খালা ফোন করছিলো একটু আগে।
বললো, তুমি নাকি থাকতে চাও না এই সেই… এত কিসের সমস্যা? আমার রাকাকে তোমার ভালো লাগেনা নাকি?
– না না! কি বলেন! রাকা তো আমার মেয়ের মত ভাই। ও অনেক লক্ষী একটা মেয়ে।

আব্বু এবার খুব নরম স্বরে বললো,
– আমার মেয়েটা তোমাকে কাছে পেলে যে খুব খুশি হয়, তাকি তুমি বুঝো?
খালা আমতা আমতা করে বললো,
– জ্বী।

আব্বু উদাস গলায় কণ্ঠস্বর ভারী করে বললো,
– ওকে একটু সময় দিও.. মেয়েটার তো আমি ছাড়া আর কেউই নাই…

– দেই তো। আমি প্রতিদিনই ওর কাছে আসার চেষ্টা করি। আপনি এত চিন্তা কইর‍্যেন না।

আমি চা নিয়ে বারান্দায় গেলাম। বড় মানুষদের বিদঘুটে আলাপ-আলোচনা শোনার চেয়ে বারন্দায় গিয়ে ঝড়-তুফান দেখা ভালো।

তখন আব্বু বললো,
– আমি জানি। তোমাকে ও খুব পছন্দ করে। তুমি চলে যাওয়ার পর রাতে তো আমার কাছেই থাকে। সারাক্ষন শুধু তোমার কথা বলে মেয়ে।
এই কথা শেষ করেই হেসে দিয়ে বললো,
– আমিতো তোমার সুনাম শুনতে শুনতে রীতিমত পাগল হয়ে যাচ্ছি! হাহ্ হা। ও ওর মায়ের নাম ও এতবার নেয় না। কি আশ্চর্য, এই বাচ্চা মেয়েটাও তার মাকে মিস করেনা। আমি তো ওকে অনুর নামই নিতে শুনিনা! আর অনুও.. মেয়ের খবর নিতে নামেমাত্র ফোন করে।

খালা কিছু বললো না। শুধু হুঁ,হ্যাঁ করে গেলো।
আমাকে ডেকে আনা হলো।
আমরা সবাই একসাথে বসে ফ্যামিলির মতই সময় কাটালাম। আমি কিছুক্ষন আব্বুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিলাম।
তারপর আবার শুলাম খালার কোলে।
এত আনন্দ, এত ভালো লাগা আমার এই প্রথমবার অনুভব হলো।
মনে হচ্ছে, এই তো আমার স্বর্গ!
আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় দুটি মানুষ,
আব্বু, খালামণি!
তারা দুজনেই এখন আমার কাছে!
কে বলে আমি দুখী, আমার কেউ নেই?

আব্বু হঠাৎ বলে উঠলো,
– রাকা ওটা কি খাচ্ছো তুমি?
– বিস্কুট পিঠা আব্বু। খালামণি বানাইছে। খুব মজা! তুমি খাবা?
– কই আমাকে যে দিলানা! শুধু স্যুপ ধরায়ে দিলা!
– তুমি খাবা?
– কই দাও! আবার জিজ্ঞেস করে!

খালা উঠে তাড়াতাড়ি আমার হাতে বিস্কুটের প্লেট দিয়ে দিলো। তার খুশিতে মুখ চকচক করছে।
আব্বুর এই সামান্য চাওয়াটুকুর জন্যই তার খুশিরা ঠিকরে পড়ছে।
আব্বু একটা হাতে নিতে নিতে বললো,
– রাকা, ভাত আছে আম্মু? ভাত খেয়ে নিতে হবে। আজকে দুপুরেও কিছু খাইনাই। ক্ষিধা লাগছে খুব।
আমি হা করে রইলাম। ভাত নেই। রান্না করতে হবে। খালা আর আমি মিলে খেয়ে ফেলছি।

খালা কথাটা শুনেই উঠে দাঁড়ালো ব্যস্ত হয়ে।
সে দৌঁড়ে চলে গেলো রান্না ঘরে।
চাল ধুয়ে ভাত বসিয়ে দিলো।
ভাত হতে অল্প কিছুক্ষন।
এই সময়ে তরকারি রেডি করে ফেলতে হবে।
দৌঁড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো আব্বুকে,
– ভাই, আপনি মাছের ভর্তা খান? টাকি মাছের ভর্তা খাবেন? আচ্ছা, ঝাল করে রসুন দিয়ে শুটকি মাছের ভর্তা করে দেই?
– না থাক থাক। ব্যস্ত হওয়া লাগবেনা রিমা। বৃষ্টি একটু কমুক তাহলে। হোটেল থেকে নিয়ে আসা যাবে।
– আমি আছি যখন, তখন কি দরকার? আর আমার রান্না করতে ভালোই লাগে। এখন পাঁচ মিনিটে কিছু একটা করে দেই। খেয়ে ফেলেন। হোটেলে এখন ভালো কিছু পাবেন না। আমি দুটোই করি। রাকার জন্য ডিম ভাজা.. বলে ওড়নার একটা পার্ট কোমরে গুজে ব্যস্ত ঘরণির ন্যায় রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেলো।

আব্বু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
তার চোখ দেখছে এটা রিমা নয়, সেই প্রথম দিনের অনু। হ্যাঁ তো, ওটা অনু!

আমি খালার পেছন পেছন যাবো বলে হাঁটা দিবো তখনই দেখলাম, আব্বু কেমন যেন করছে ফোন হাতে নিয়ে।
আমি আব্বুর কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম,
– কী করো আব্বু? কাকে ফোন দাও?
আব্বু আমার কথা শুনেই আমাকে জড়িতে ধরে হু হু করে কেঁদে দিলো।
খুব আস্তে কাঁদার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হলো। পুরুষ মানুষ, যখন বেসামাল কষ্ট পেয়ে যায় তখন যদি কান্না আসে/চোখের জল এসে পড়ে তাহলে আর সহসা সেটা থামাতে পারেনা। অনেকে বলে এটা মেয়েলি স্বভাব। কিন্তু না! এটাই তো হওয়া উচিত। তাদের ও মন বলে কিছু আছে।
আমি অবাক হয়ে আব্বুকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুঝতে আর বাকি রইলো না, আব্বু আবার অনু চৌধুরীকে মিস করছে। চোখ বাঁকিয়ে দেখলাম, পর্দার নিচে দুটো পা এসে দাঁড়িয়েছে। ওটা খালাই। তা নয় তো আর কে হবে!

খালা রান্নাবান্নায় খুব এক্সপার্ট। এক হাতেই সব করে ফেললো।
ডায়নিং’এ খাবার বেড়ে আব্বুকে ডাক দিলো। আমরা গেলাম।
আমাকে খাইয়ে দিবে তাই আমাকে আগে দিলো না। আব্বুকে বেড়ে দিয়ে তারপর আমাকে খাইয়ে দিবে।
আব্বু খালার দিকে চোখ কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে তাকায় আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়।
এমন সময় বিদ্যুৎ চলে গেলো।
খালা ব্যস্ত হয়ে পড়লো লাইট,মোমবাতির জন্য। কিন্তু সে তো জানেই না কোথায় কি আছে।
দুজন একসাথেই উঠে দাঁড়ালো। আব্বু বললো,
রাকা, তুমি উঠবা না। বসে থাকো।

বলে সেও উঠলো,খালাও উঠলো। আব্বু ভুলবশত, অন্ধকারে, খালার নরম পায়ের উপর পাড়া দিয়ে দিলো। খালা শব্দ করতেই আব্বু পা সরিয়ে নিলো। তারপর তাকে চেপে ধরে আস্তে করে বললো,
– ধুর, তুমি উঠতে গেলা কেন! নখটা তো মনে হয় গেছে। বসো তো তুমি। আমি মোমবাতি আনি।

খালার হৃদয়ের কম্পন বেড়ে গেলো।
আজ কতগুলো দিন কেটে যাওয়ার পর এই প্রথম নিজ স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ স্পর্শে সে শিউরে উঠলো।
এই স্পর্শে তার একটুও অস্বস্তি হলোনা। মনে হলো, এই স্পর্শের অনুভূতি যেন শেষ না হয় কখনো!
কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সেটার অবসান ঘটলো।
আব্বু মোমবাতি আনতে গেলো।
আনলো এবং নিঃশব্দে খাওয়া আরম্ভ করলো।
খালা আমাকে ভাত খাওয়াচ্ছে।
আমি দুজনের মাঝখানে বসেছি।
আব্বু দুদিনের অভুক্তের মত খাচ্ছে আর খালা সেটা মুগ্ধ চোখে দেখে যাচ্ছে।

তারপর সে খেয়ে শুতে চলে গেলো।
খালা আর আমি আমাদের রুমে শুলাম।
আমি খালাকে যতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছি ; সে তার চেয়েও বেশি শক্ত করে ধরেছে।
একদম তার দেহের সাথে মিশিয়ে দিলো আমায়। কি অদ্ভুত ভালো লাগা!
ভাবলাম, গল্প টল্প শুনবো।
কিন্তু তাকে জড়িয়ে ধরে তার উষ্ণতা পেতেই ঘুমের দেশে চলে গেলাম।

আমি তখন ঘুমে।
হঠাৎ করে আব্বুর রুম থেকে গোঁ গোঁ করে কিছু অদ্ভুত শব্দ আসতে শুরু করলো।
মোমবাতি নিভু নিভু করে জ্বলছে।
বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজে সৃষ্টি হয়েছে এক ভুতুড়ে পরিবেশ।
খালা কৌতূহলপরবশ হয়ে উঠে গেলেন।
কিসের শব্দ ওটা? জানতে।

খালা খুব কষ্টে, খুব সাবধানে আব্বুর রুমে গিয়ে উঁকি দিলেন। আব্বু ঠান্ডায় হাত পা এক করে শুয়ে আছে আর গোঁ গোঁ করে শব্দ করছে। যেন কিছু বিড়বিড় করে যাচ্ছে অনবরত। আব্বুর এমনিতেও মানসিক আঘাতজনিত কারণে একটা বাজে সমস্যা আছে। সেটা খালা জানে।
সে অন্যায়, অনুচিত এসব কিছু বিবেচনা করলো না আর।
গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো আব্বুর কাছে।
সে অস্ফুটস্বরে ‘অনু চৌধুরীর নাম আওড়াচ্ছে।
খালা তার কপালে হাত দিয়ে দেখলো, গায়ে জ্বর জ্বর ভাব। মাথাব্যথা করছে নির্ঘাত।
সে নিঃশব্দে রান্না ঘরে গেলো। কপালে, মাথায় পানি ঢেলে তাকে ঘুমের মধ্যেই ঔষধ খাওয়ালো। মাথা টিপে দিলো নিক্স দিয়ে। ঝাঁঝালো বাম বুকে আর মাথায় ম্যাসাজ করে দিতে দিতে একসময় সে শব্দ করা বন্ধ করে দিলো।
খালা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
উঠে চলে আসবে বলে দাঁড়ালেন।

এক পা বাড়াতেই খেয়াল করে দেখলেন,
এই মানুষটার অসহায় মুখখানা কতটা ঝলসে গেছে। কতটা কষ্টে আছে সে সেটা তার মুখ দেখলেই বোঝা যায়..
সে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকতেই দেখলো তার প্রয়াত স্বামীর মুখ ভেসে উঠেছে তার মুখে। সে হাত দিয়ে তাকে কাছে যাওয়ার জন্য ডাকছে। খালার হেঁচকি উঠে গেলো।
সে দৌঁড়ে চলে আসলো আমার রুমে।
তারপর আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে শব্দ করে কিছুক্ষন কাঁদলো।
কিন্তু আমরা কেউই শুনলাম না।
মেয়েদের লুকানো,গোপন জিনিসের টের- সহসা কেউ পায়না। আমরাও পেলাম না।


অনু চৌধুরীর সংসারে আগুন লেগেছে।
আজমল উদ্দীন আজকে এক সপ্তাহ বাসায় ফেরেনা। ইতোমধ্যেই একদিন সে একজনের কাছ থেকে কিছু আজগুবি কথা শুনেছে। যার থেকে শুনেছে সে আজমলের একজন বিশেষ বন্ধু।
সেই বন্ধু একদিন নিজেই যেঁচে ফোন দিয়ে এসব বললো। এসব শুনে তো অনু চৌধুরীর চক্ষু চড়কগাছ!

সেসব সত্য-মিথ্যা যাচাই করার জন্য আজমলকে জিজ্ঞেস করার পর থেকেই আজমল উদ্দীন গায়েব। সে আর বাসায় ফিরছে না।
কয়েকবার মাত্র ফোনে কথা হয়েছে।
কিন্তু আজমল যেন খুব ব্যস্ত।
কথা বলার সময়ই পায়না।
আজমল উদ্দীনের বাড়ি আছে।
তার মা-বাবা কেউই নেই। সেও শহরে শহরেই ঘোরে। তাই তার ভাইয়েরা সুযোগ করে গ্রামের বাড়ির প্রায় সবই দখলে নিয়ে নিয়েছে। এসব শুনেছে অনু চৌধুরী। কিন্তু এখন এতদিন এভাবে কোথায় গিয়ে পড়ে আছে লোকটা?
সে একজন অন্তসত্ত্বা নারী।
এসময় স্বামীর যত্নটা কতটা জরুরি!
অথচ এই নিরিবিলি, একা একটা বাসায় তাকে ফেলে আজমল উদ্দীন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।
ফোন দিলে এখন ফোন ও তুলতে চায়না। কয়েকবার করলে একবার রিসিভ হয়!
ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো অনু চৌধুরী বুঝে উঠতে পারছে না।

সে এর বিহিত করবেই।
এই নিয়ে ১৫বার কল দিয়েছে।
ফোন রিসিভ করছে না।
কতক্ষন রিসিভ করবেনা? সে ও করেই যাচ্ছে।
১৭বারের সময় ফোন রিসিভ হলো।
একটা মিষ্টি মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসলো,
– হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।

নারী কন্ঠ পেয়েই অনু চোধুরীর মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।
– হ্যালো! কে আপনি? এটা আজমলের ফোন না?

– জ্বী।

– তাহলে আপনি রিসিভ করলেন কেন? আপনি কে হন ওর? বোন?

– আজমলের বোনেরা কেউ বাড়িতে নেই।

– তাহলে আপনি কে? ওর ফোন আপনি রিসিভ করলেন কেন? চেঁচিয়ে বলে উঠলো।

ওপাশ থেকে শান্ত গলায় বললো,
– আমি কেন রিসিভ করলাম.. আমি কে হতে পারি বা কেন রিসিভ করলাম, এসব আজমল আপনাকে এখনো জানায়নি?
– মানে! কি জানাবে?
– আচ্ছা। আপনি এখন রাখুন বোন। ও আসুক। আসলে ও_ই জানাবে।
– ও কোথায় গেছে?
– বাজারে গেছে। ভুল করে ফোন রেখে চলে গেছে।
– বাজারে গেছে! বাজারে কেন গেছে? কার জন্য বাজার করতে গেছে?
– কার জন্য মানে? আমার জন্য গেছে। ঘরে বাজার-সদয় লাগেনা? তাই!
অনু চৌধুরী থ হয়ে গেলেন এসব শুনে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here