রাকা (১৯)
আজমল উদ্দীনের সাথে অনু চৌধুরীর রাগারাগির পর্ব শেষ। এখন চলছে কথা না বলার অনশন ধর্মঘট। আহা, কেউ কারো সাথে কথা বলেনা। এদিকে আজমল উদ্দীনের ফোন এসেছে।
তাকে এক্ষুনি একবার বাড়ি যেতে হয়।
কিন্তু কিভাবে যাবে? অনু চৌধুরী তো গোঁ ধরে বসে আছে। সে এখন মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করা মানেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা।
অনু চৌধুরী একবার মুখ খুললে তো আর থামানোই যাবেনা।
এখন তাকে যেভাবেই হোক অনু চৌধুরীর রাগ ভাঙাতে হবে। সে বিড়ালের মত লেজ গুটিয়ে বউয়ের পিছন পিছন ঘুরতে লাগলো।
কিন্তু তার বউ এখন ফোনে ব্যস্ত।
কার সাথে যেন হাসি হাসি মুখ নিয়ে কথা বলছে! আজমল উদ্দীনের মাথায় দুশ্চিন্তা এসে ভর করলো।
জীবনে অনেক পাপ করছে সে।
সেই পাপের শাস্তি ইতোমধ্যে অনেকবারই পেয়েছে।
এখন কি আবার নতুন কোনো শাস্তি পাওয়ার সময় হয়েছে?
অনু কার সাথে কথা বলছে অমন হাসি হাসি মুখ নিয়ে?
আজমল উদ্দীন এক টানে ফোন কেড়ে নিলো অনু চৌধুরীর হাত থেকে।
তার চোখ লাল হয়ে গেছে।
অনু চৌধুরীর দিকে তাকিয়েই সে ফোন কানে তুললো। তার সন্দেহের বাণ প্রক্ষেপিত হলো অনু চৌধুরীর দিকে।
সে মনে মনে ভাবছে, যে নিজের এত ভালো স্বামীকে ফেলে আমার সাথে এসে যেতে পারে, সে তো আমার মত খারাপ-গরীব স্বামীকে ফেলে যেতেই পারে! এটাতে তো আশ্চর্য হওয়ার কথা না!
ফোন কানে নিয়ে আজমল উদ্দীন ‘হ্যালো বললো। ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসলো।
– কে? আংকেল?
ওটা তো তানিশার গলা!
আজমল উদ্দীন নিশ্চিন্ত হলেন।
কিন্তু কথা না বলেই কেটে দিলেন। তানিশাকে তার ভালো লাগেনা। মেয়েটা কেমন যেন, আজমল উদ্দীনের বিরক্ত লাগে। একদম মায়ের ডুপ্লিকেট। সে তো এক অনু নিয়েই আর পারছে না, এখন আবার দ্বিতীয় অনু উদয় হলে তো সমস্যা!
ভাগ্যিস,ওকে রেজা মেনে নিছে,নইলে আমার এখানে আইস্যাই অন্ন ধ্বংস করতো জামাই নিয়ে।
অনু চৌধুরী আরো এক ধাপ ফুলে গেলেন। আজমল উদ্দীনের সামনে দিয়ে রাগ দেখিয়ে উঠে চলে যাবে তখনই আজমল উদ্দীন হাত ধরে ফেললো তার।
– অনু, আমি তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাবো। কিন্তু ওখানে এখন গেলে প্রচুর খরচ হবে। কারণ তোমার এখন যত্ন দরকার। সেইফলি থাকতে হবে। মাত্রই তো বাচ্চা হলো তোমার। আর ওখানে তোমার থাকা,খাওয়ায় অনেক সমস্যা হবে। বোঝার চেষ্টা করো অনু!
অনু চৌধুরী ঘুরে দাঁড়ালেন।
– আমার কোনো সমস্যা হবেনা। আমার এইটা প্রথম বাচ্চা না। তাই আমার সমস্যা টমস্যা হইব্যোনা। আমার সব অভ্যাসই আছে। তুমি শুধু ব্যবস্থা করো।
– আসলে… আচ্ছা,তাহলে সামনের মাসে যাও। ততদিনে আমি কিছু টাকার ব্যবস্থা করি।
অনু চৌধুরী আজমল উদ্দীনের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
– টাকা পয়সার কথা ভাবতে হইব্যো না। ওইডার ব্যবস্থা আমি করমু।
– কিভাবে?
– সে যেমনেই হোক। পরে জানামু কেম্নে ব্যবস্থা করমু।
– আচ্ছা।
তো,তানিশার সাথে কথা বলতেছিলা?
কী অবস্থা ওর? রেজা মাইনা নিছে?
– নিছে মানে! হাহ্ হা হা! না নিয়া যাইব্যোডা কই আজমল!
আজমল উদ্দীন কিছু বললেন না আর।
উঠে চলে এলেন।
তার আবার ফোন এসেছে। ফোনের ওপাশ থেকে খুব বিনয়ের স্বরে কেউ একজন বলছে,
– শুনছেন? আপনি কি আজকে একবার আসতে পারবেন?
– না। আমি আজকে ম্যানেজ করতে পারবো না। অনু খুব রেগে আছে।
– ম্যানেজ করেন। আপনার জন্য একটা উপহার আছে। এখন আর আপনি আমাকে ছেড়ে এতদিন ওখানে গিয়ে থাকতে পারবেন না। আসবেন একবার? না আসলেও সমস্যা নেই। আপনি আনন্দ করুন। আমি তো আপনাকে সুখ দিতে পারিনাই। ছোট বোন সেটা দিতে পারছে।
– বার বার এসব বইল্যো না। বিরক্ত লাগে।
– ঠিক আছে। আপনি আসা লাগবেনা। আমি এরকম আবদার করতে করতে একদিন এভাবেই নিঃশেষ হয়ে যাবো। আপনি ছোট বোনের সাথেই ভালো থাকেন। রাখলাম।
– হ্যালো শাহানা? শুনো, দেখো, আমি কিছুতেই ম্যানেজ করতে পারছিনা। আচ্ছা শুনো,
ততক্ষনে ফোন কেটে দিয়েছে।
আজমল উদ্দীনের বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠলো। সে ভাবছে,
একবার তো যেতেই হবে।
মেয়েটা আমার জন্য কি না করে!
আমার বিয়ের সব কিছু সে ই জোগাড় করে দিলো। আমি না চাইতেই আমার হাত ভরিয়ে টাকা দিয়ে দেয়। কত ভালোবাসে মেয়েটা আমায়।
আমি কিভাবে ওকে এতটা কষ্ট দিতে পারি?
অত:পর অনু চৌধুরীকে অনেক কষ্টে মানানো গেলো। শর্ত হলো,
সামনের সপ্তাহেই বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে তাকে।
অনেক কিছু ঠিক করতে হবে এই মধ্যেই।
সব সরিয়ে ফেলতে।
কিছু যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ তো না করলেই নয়!
আজমল উদ্দীন ছুটে চলে গেলেন।
★
আব্বু,তানিশা আপু আর আমি ড্রয়িংরুমে একসাথে বসে আছি। আব্বুর দুই পাশে আমরা দুজন বসে আছি। তানিশা আপুর কাজকর্ম দেখে আমরা মুগ্ধ। সে নিজেই সব রান্নাবান্না করছে। পুরো বাসা নিজেই পরিষ্কার করেছে।
আব্বুর আমার কিছু অপরিষ্কার জামা-কাপড় ছিলো, কখন যে সব নামিয়ে ধুঁয়ে দিয়েছে, জানিইনা।
আব্বু অনেকবার নিষেধ করেছে।
কিন্তু সে শোনে নি। কিন্তু আমার মন এখনো সন্দিহান। আব্বু তো বলছে দুলাভাইকে ছেড়ে দিতে। আপুও তাই মেনে নিলো দেখলাম। কিন্তু শেষের দিকে ওটা কিসের ক্লাইম্যাক্স ছিলো!
আব্বু খুব নরম গলায় বললেন,
– তানিশা, তোর এই অন্ধকার জীবন আমি ঠিক করে দিবো। তুই চিন্তা করিস না। তোর এই বাচ্চাকে আমি আমার কাছে রেখে দিবো। আমার তো কোনো ছেলেপুলে নেই। তাই নাতিকেই সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি না ফেরার দেশে চলে যাবো ভাবছি। আর তোকে আমি আবার বিয়ে দিবো। অনেক ভালো জায়গায়। তোর নতুন সংসার হবে। তুই সুখী হবি। তবে আমাকে শুধু তোর ছেলেটাকে দিয়ে যাস। ও আমার কাছেই থাকবে সবসময়। কেমন?
– আচ্ছা আব্বু। তোমার যা ইচ্ছা তাই হবে।
– তোকে ওখানে অনেক কষ্ট দিছে ওরা। তাই না রে?
আপু উত্তর দিবে তখনই আমি পট করে বলে দিলাম,
– হুম আব্বু। দুলাভাই তো আপুকে মারে অনেক! আজকেও মারছে। আমি নিজে দেখছি।
আব্বুর ভ্রু কুঁচকে বললো,
– কি বলিস? আজকে কখন মারছে? কিভাবে মারছে? আগে বললি না কেন?
– আজকেই তো দুইবার দেখলাম! যা বাজে গালি দেয় উনি! কিছুটা আম্মুর মত! খাবার দিতে দেরি হওয়ায় আপুকে ধাক্কা দিয়েছিলো। আপু তখন ভাতের মাড় গালতেছিলো। আপুর হাত দেখো তুমি! দুলাভাই একটুও ভালো না। একটুও না।
তানিশা আপু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করছিলো আমাকে থামার জন্য। আমি শুনলাম না। কথা শেষ করে তারপর ওরদিকে তাকিয়ে মৃদ্যু হাসলাম।
আব্বুর চোখ ছল ছল করছে।
– আমি আমার মেয়েটাকে আজ পর্যন্ত একটা টোকা পর্যন্ত দেই নাই। অথচ অন্য একটা বখাটে ছেলে আমার মেয়েকে এতদিন মারছে! এখানে অবশ্য ছেলের দোষ না। দোষ আমার মেয়ের।
আপুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুই কেন এমন করলি বলতো? কেন নিজের জীবন নিজেই নষ্ট করতেছিলি?
তানিশা আপু মিনমিনিয়ে বললো,
– ভুল করছি আব্বু। আর হবেনা।
আমরা সারা সন্ধ্যা গল্পগুজব করেই কাটালাম।
আপুকে যখন একা পেলাম তখন খুব আগ্রহ নিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়লাম,
– আপু, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
– কর। আগে বল আব্বুর সামনে এরকম
কালারিং করলি ক্যান তোর দুলাভাইরে? এমনেই আব্বু পছন্দ করেনা। ছাইড়্যা চইল্যা আসছি। এরপরেও শান্তি হয়না তোগো?
আমি বিষম খেয়ে বললাম,
– তোকে ওই লোকটা আমার সামনে মারছে। আমি এটা বলবোনা আব্বুকে? আম্মু যখন তোর গায়ে একটু হাত দিতো, তখন কে নালিশ দিতো আব্বুর কাছে? আমিই তো!
– আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। এরকম মাইর টাইর সবাই ই টুকটাক খায়। তুই বুঝবিনা। কথায় আছে,শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে।এখন বল,কি বলবি।
আমি খুব আড়ষ্টভাব নিয়েই বললাম,
– আপু তুই দুলাভাইকে ছেঁড়ে একাবারে চলে আসছোস না?
– হুম।
– আর যাবিনা। ঠিক তো?
– হুম।
– তাহলে দুলাভাই যাওয়ার সময় আদর করলি কেন? আব্বুর কাছে বললি ছেড়ে দিছোস অথচ যাওয়ার সময় এরকম করলি। কেন?
আপু আমার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন।
তারপর আমার হাত পেটে রেখে বললো,
– এই দেখ। এটা তোর বোনপো। আমার ছেলে।
ও কিন্তু তোর দুলাভাইয়েরই সন্তান। এখন আমার ছেলের বাপকে আমি একটু ভালোবাসবো না? এখানেও কৈফিয়ত লাগবে?
আমি চুপ করে গেলাম।
আপু আবার বললো,
– ছেড়ে দিলেই তো সব শেষ হয়ে যায় না রাকা।
আমি আর কিছু বললাম না।
বড়দের ব্যাপার-স্যাপার খুব জটিল।
আমার মাথায় ঢুকে না এসব থিওরি।
আমি একজনকে ছেড়ে চলে আসলাম কারণ সে খুব খারাপ,বখাটে,আমাকে মারে, তাহলে আমি কেন তাকে ভালোবাসতে যাবো?
আমার আম্মুও তো এমন,মিসের অনু চৌধুরী। অবশ্য সে আরো খারাপ।
কই,আমি তো তাকে আর ভালোবাসিনা।
তাহলে আপু…
★
পরের দিন সকালে।
ঘুম থেকে উঠলাম বেলা ১০টায়।
দাঁত ব্রাশ করতে গিয়ে মনে পড়লো, আমার টাওয়েল আনা হয়নি।
আনতে গেলাম।
আপু তখন নাস্তা বানাচ্ছে আমার জন্য।
সে আর আব্বু খেয়ে নিয়েছে আগেই।
আমি টাওয়েল এনে বাথরুমে ঢুকবো তখনই দেখলাম আপন স্যার এসেছে।
সে আমাদের ড্রয়িংরুমে বসেছে।
আব্বু কথা বলছে তার সাথে।
আব্বুর মুখ হাসি-হাসি।
সে তানিশা আপুকে ফিরে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে।
সেই খুশিতেই কি আপন স্যারকে ডেকে আনলো?
আমাকে দেখতে পেয়েই জোরে ডাক দিলো আব্বু।
– এই মেয়ে। এখানে আয়।
আমি ছুটে চলে গেলাম তার সামনে।
আমার সামনেই দুজন।
আব্বু বললো,
– যা, তানিশাকে বল, আপন আসছে। ওকে নাস্তা দিতে বল। সকালে যে গোপিকে দিয়ে কুমিল্লার রসমালাই এনেছি,ওটা দিতে বলবি আগে। যা..
আমি বললাম, আচ্ছা।
বলতেই মুখে থাকা টুথপেস্টের ফেনা বেয়ে পড়ে গেলো অনেকটা।
আপন স্যার বেদমে হাসছে।
আব্বু বললো,
– তুই ব্রাশ না করেই চলে আসলি! দেখো আপন দেখো, এই মেয়ে এখনো বাচ্চাই রয়ে গেছে।
আমি লজ্জ্বা পেয়ে তাড়াতাড়ি মুখ ধুতে চলে আসলাম।
এসে আপুকে বলে নিজেই সব ঠিক করে দিলাম। তারপর আপুকে বললাম,
– আপু প্লিজ! তুই এগুলা একটু ওখানে দিয়ে আয়না!
– ওমা! কেন! আমি তো কাজ করতেছি! দেখতেছোস না?
– কী কাজ করতেছোস দেখি! ও আচ্ছা। পেঁয়াজ,আলু এগুলা আমিই কেটে দিচ্ছি। তুই এগুলা দিয়ে আয়। প্লিজ!
– ও! বুঝছি! মনের মধ্যে কি চলে তোর রাকা? এমনে তো কিছুই বুঝোনা! অথচ মনে মনে এতদূর..!
– কি! ধুর! আরে কিছুনা! পরে বলবো তোকে। এখন ওখানে যেতে পারবো না কারণ লজ্জ্বা লাগতেছে।
আব্বু আবার জোর গলায় ডাকলো আমাকে। আমি আপুকে ঠেলে পাঠিয়ে দিলাম। আপু গেলো। আমি আর গেলাম না।
আব্বু আবার আমার জন্য আপন স্যারকে
এনেছে। আমার পড়াশোনার জন্য।
তাছাড়া আব্বু মনে মনে আপন স্যারকে ভীষণ পছন্দ করে। প্রথম থেকেই।
কে জানে তার মধ্যে কোন ইচ্ছা লুক্কায়িত আছে!
(চলবে)
ফারজানা রহমান তৃনা।