রাকা-২৩,২৪
ফারজানা রহমান
পার্ট-২৩
আজমল উদ্দীনের মাথায় বাজ ভেঙে পড়েছে। অনু চৌধুরী তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য গোঁ ধরে বসে আছে। এবার এমনভাবে কব্জা করেছে যে আর কোনোভাবেই তাকে নিষেধ করা যাবেনা!
কোনোভাবেই না! আজমল উদ্দীন প্রাণপণে চাচ্ছেন,অনু চৌধুরী তার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসুক। কারণ অনুর এই সিদ্ধান্তের জন্য তার জীবন বিপাকে পড়ার সম্ভাবনা সুদৃঢ়।
সে অনু চৌধুরীর পিছন পিছন হাঁটছে আর বার বার শুধু একই কথা আওড়ে যাচ্ছে।
– অনু, ও অনু, পাখি আমার, না গেলে হয় না? ছেঁড়ে দাও না অনু! বললাম তো পরে নিবো! আচ্ছা, একটা মাস সময় দাও?
অনু চৌধুরীও ছাড়বার পাত্রী নয় যে!
তার উত্তর অপরিবর্তনশীল এবং অভিন্ন।
– না। আমি হয় আজকে যাবো নয়তো আগামীকাল সকালে। আর কোনো কথা বলবা না। এমনিতেও আজকে বহুত বলছো তুমি। তোমার জিহ্বা খুব বেশিই চালু হইছে আজমল।
– আচ্ছা আমাকে ক্ষমা করে দাও না অনু। তুমি এক মাস পরে যাও।
– না।
– তো,কবে যাবা?
– আজকেই যাইতে চাই। যাইব্যা?
– মাত্রই তো ফিরলাম। আবার আজকেই যাবো?
– ঠিক আছে। কালকে সকালে তাহলে। তুমি হাত মুখ ধুইয়্যা আসো, ভাত দেই টেবিলে।
আজমল উদ্দীন এরপর ও অনেকক্ষন ঘ্যানঘ্যান করলেন বৃথাই।
অনু চৌধুরীকে সে এক চুল ও নড়াতে পারলো না।
দুপুরে এবং রাতে দুশ্চিন্তায় আর ভাত খাওয়া হলো না তার। শুকনো মুখেই ঘুমাতে গেলো।
ঘুম ও হলো না সারারাত।
শেষ রাতে তার গায়ে জ্বর এলো।
অনু চৌধুরীর অত খেয়াল নেই।
সে নিজেই ঔষধ খেয়ে শুয়েছে আবার।
কিন্তু না,ঘুম আর হলোই না।
সারারাত নির্ঘুমেই কাটলো তার।
ফলপ্রসূ সকালের দিকে তীব্র জ্বর আর মাথাব্যাথা অনুভূত হলো তার।
অনু চৌধুরী তার নতুন মেয়ে ইরাকে ঘুমে রেখেই সকাল সকাল নিজের যাবতীয় সব কাজ শেষ করে,সবকিছু গুছিয়ে একেবারে প্যাক করে নিলো।
কিন্তু জ্বরে কাতর আজমল উদ্দীনের দিকে ফিরেও তাকালো না। যখনই আজমল উদ্দীনকে এসে বলতে যাবে রেডি হওয়ার জন্য; তখনই দেখলো তার অবস্থা ভালো নেই খুব একটা।
অনু চৌধুরী তার কপালে হাত দিয়ে দেখেন মহাকেলেঙ্কারি! তার জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
এই অবস্থা হঠাৎ কিভাবে হলো কে জানে!
মাথাব্যাথা ও নাকি খুব বেশিই।
সেবা-শুশ্রূষা করার অত সময় ও নেই তার।
কোনোমতে তাড়াতাড়ি স্যুপ রান্না করে খাওয়ালো দু চামচ। তারপর আবার ঔষধ দিয়ে কোথায় যেন বেরিয়ে গেলো না বলেই।
আজমল উদ্দীন মনে মনে হাসছেন আর ভালোই খুশি হয়েছেন তিনি।
আজ আর তাহলে বাড়িতে যেতে হচ্ছে না।
বেঁচে গেছে আজকের জন্য ও।
অনু চৌধুরী কোথায় যাচ্ছে এখন,সেটা অনুসরণ করলে ভালো হতো। কিন্তু তার তো নিজের ওঠার শক্তিটুকুও নেই! থাকলেও সে উঠবেনা! রিস্ক আছে।
বাচ্চাটা বেদমে কাঁদছে।
অনু এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন কিভাবে হয়?
এই মাসুম,দুধের বাচ্চা ফেলে গেলোটা কই ও? ভাবতে ভাবতে তিনি নিজেই উঠে মেয়েটাকে নিজের পাশে শুইয়ে দিয়ে জোর গলায় ‘অনু অনু বলে চেঁচালেন।
অনু চৌধুরী সাড়াই দিচ্ছে না।
এদিকে বাচ্চাটার কান্নাও ক্রমশ ভারী হচ্ছে।
তাই তার নিজেকেই উঠতে হলো।
এই বাচ্চাটা তার কলিজার টুকরা।
এর কান্না সে এক সেকেন্ড ও সহ্য করতে পারেনা।
তাই বাধ্য হয়ে নিজেই এখন দুধ গরম করে খাওয়াবে। এছাড়া তো আর কিছু করার ও জায়গা নেই। কোলে করে আদর ও তো করা যাবে না এই জ্বরের শরীরে।
সে বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে।
বাচ্চার কান্না থামলো।
কিন্তু না খেয়েই আবার ঘুম দিলো।
এমন সময় অনু চৌধুরী ফোন দিলো।
আজমল উদ্দীন ফোন তুললেন।
– হ্যাঁ অনু। কই তুমি? তুমি কি মানুষ?
অনু চৌধুরী নিশ্চুপ।
– কথা বলো না কেন? তুমি দেখলা আমি অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি। তবুও তুমি এই বাচ্চাটাকে আমার কাছে রেখে চলে গেলা! বাচ্চা সামলাতে পারবো আমি এই শরীরে?
অনু চৌধুরী শান্ত গলায় বললেন,
– ভালোই তো সামলাইছো। ওইযে ইরা ঘুমাচ্ছে তার বাবার পাশে।
– তুমি জানলা কেম্নে? কই তুমি?
– আমি বাসাতেই। তুমি তো খুব অভিনয় জানো আজমল!
– মানে!
– এইযে জ্বরের ভাণ করলা গায়ে গরম কাপড়ের শ্যাক দিয়ে,থার্মোমিটার চুলার সামনে ধরে গরম করে, তা কি আমি বুঝিনাই ভাবছো?
– কি! আচ্ছা ঠিক আছে,আমার গায়ে আসলেই জ্বর আছে কিনা তুমি নিজেই এসে দেখে যাও।
আড়াল থেকে বেরিয়ে সে হাসিমুখে বললো,
– আসছে কিন্তু বেশি না। তুমি চুলায় জামা কাপড় গরম কইর্যা নিজের শরীর গরম কইর্যা এরপর নাম দিছো তোমার জ্বর। থার্মোমিটার ও গরম কইর্যা..যাক গে,মানলাম তোমার জ্বর, মাথাব্যাথা। কিন্তু সবই তো করতে পারছো দেখলাম, তারমানে তুমি বাড়িতে যাইতে পারবা। আর প্যাঁচাল পাইড়ো না,রেডি হও।
আজমল উদ্দীন হাল ছেড়ে দিলেন।
তার গায়ে জ্বর আছে,মাথাব্যাথা ও প্রচন্ড। কিন্তু কিছুই করার নেই। এই বউ তাকে কোনোভাবেই ছাড়বেনা।
সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও শার্ট গায়ে দিচ্ছে।
আজকে তার এই অসুখ আরো দ্বিগুন বাড়বে।
মহাপ্রলয় হবে আজ।
★
আজমল উদ্দীনের স্ত্রী শাহানা বেগম একজন ধার্মিক,পরহেজগার নারী। সে অনু চৌধুরীর মত অত রুপবতী, আকর্ষণীয়া নয়। কিন্তু ব্যবহার এবং চরিত্রগত দিক দিয়ে তার মত নিঁখুত ভালো মহিলা এই যুগে পাওয়া হয়তো সত্যিকার অর্থে দুষ্কর। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার পাশাপাশি তার দয়া মায়ার এবং গুনের কথার ও ছড়াছড়ি সবদিকে।
তার বাবার পরিবার এবং তার ফ্যামিলি স্ট্যাটাস ও উচ্চ মার্গের।
আজমল উদ্দীনের সাথে প্রেম করে বিয়ে হয়েছিলো। ভার্সিটি লাইফের প্রেম।
কিভাবে যেন ভালো লেগে যায় তার আজমল উদ্দীনকে।
আজমল উদ্দীন ও মরিয়া ছিলো শাহানা বেগমের জন্য। তার তখন আয় প্রাণ যায় প্রাণ টাইপ ভালোবাসা ছিলো।
শাহানা বেগম ভাবতো, আমার মত এমন একজন কালো গড়নের, গুণহীন মেয়েকেও কেউ এতটা ভালোবাসতে পারে বুঝি?
সে নিজেকে একদম সাধারণ আর অযোগ্য ভাবতো সর্বদা।
অথচ তার বাবার অবস্থা কত ভালো ছিলো। নির্বিঘ্নে কত ভালো জায়গায় তার বিয়ে হতে পারতো।
কিন্তু শাহানা বেগম আজমল উদ্দীনের মধ্যেই নিজেকে হারিয়েছিলেন।
আজমল উদ্দীনের কোনো একটা দিক তাকে এতটাই আকৃষ্ট করেছিলো যে সে একেবারে তাকে বিয়েই করে নেয় একদিন।
বিয়ের পর তাদের সংসার ভালোই চলছিলো।
সে যেহেতু খুব ভালো ফ্যামিলির মেয়ে তাই আজমল উদ্দীনের এই নাই নাই ধাঁচের অভাব-অনটনেরন সংসারে মানিয়ে-গুছিয়ে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো তার।
কিন্তু ভালোবাসার টানে সব সয়ে গেছিলো।
কারণ বিয়ের পর ৬/৭মাস তার বাবার ফ্যামিলি তার সাথে কোনোপ্রকার যোগাযোগই রাখেনি।
কারণ সে তাদের সবার অমতে একজন গাড়ির ড্রাইভারকে বিয়ে করেছিলো।
তাই না পারলেও পারতে হবে করে করে পেরেও গেছিলো।
শাহানা বেগম নিজেও শিক্ষিত।
সে টিউশন করার পাশাপাশি গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে গেস্ট টিচার হিসেবেও নিয়োগ দিয়েছিলো। সে হিসেবে অনেক আয় হত তার।
আজমল উদ্দীনের চেয়েও তার রোজগার ভালো ছিলো। এক কথায় বেশ কয়েক বছর আজমল উদ্দীন শুয়ে বসে বউয়ের টাকাতেই সংসার চালিয়েছিলেন।
সাংসারিক কত ঝামেলা,ঝগড়াঝাঁটিই থাকে। কিন্তু কোনোদিন ভুল করেও শাহানা বেগম তার স্বামীকে তার দুরাবস্থার খোঁটা তুলে কিছু বলেন নি।
স্বামীকে তিনি এতটাই ভালোবাসতেন যে সে তাকে হরহামেশাই গাড়ি চালাতে নিষেধ করতো। বলতো,আপনি সপ্তাহে একবার গাড়ি চালাইয়েন। আপনার হাত কেমন হয়ে গেছে দেখেন! ইত্যাদি ইত্যাদি ধরণের কত মায়া-মোহাব্বতের ফুলঝুড়ি!
উপর্যুপরি,
আজমল উদ্দীনের গাড়িখানাও শাহানা বেগমের বাপের টাকায় কেনা।
আজমল উদ্দীনের মা বেঁচে ছিলেন তখন।
মহিলা খুব বদমেজাজি আর খিটখিটে স্বভাবের ছিলেন। সবসময় শুধু খুঁত ধরতেন সবার।
শেষ জীবনে এসেও সে সেটা অব্যাহত রেখেই মরেছে।
তার শাহানা বেগমকে পছন্দ হতোনা,দিন রাত শুধু এটা ওটার খোঁটা আর খুঁত ধরতেন। কারণ তার স্বপ্ন ছিলো ছেলের জন্য পরীর মত মেয়ে আনবে ঘরে। সেখানে শাহানা বেগম ছিলেন কালো।
ছেলের কান ও খেয়ে দিয়েছিলেন বুড়ি।
শাহান বেগম চুপচাপ স্বভাবের মানুষ।
ভুলেও টু-শব্দটি পর্যন্ত করতেন না।
নীরবে সব সয়ে যেতেন।
তার চাকরী,টিউশন নিয়েও ছিলো তার শাশুড়ির ঘোর আপত্তি।
এরকমভাবেই কেটে গেছিলো এক বছর।
কিন্তু শাহানা বেগম কন্সিভ করেনি তখনো।
শাশুড়ি কটুক্তির জন্য সে প্রাণপণে লেগে পড়ে।
কিন্তু দু বছর গড়িয়ে তিন বছর অতিক্রমের পথে; তখন ও তার বাচ্চা হওয়ার নামগন্ধটুকুও নেই!
চারপাশের নাক ছিটকানো, আজেবাজে কথা উপেক্ষা করা যায় কিন্তু নিজের ঘরেই যদি রেডিওর মত সারাক্ষন এইসব কটুক্তি চলতে থাকে অনবরত, কতক্ষন সহ্য করা যায় সেটা?
উঠতে বসতে,দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা এসব শুনতে হত তার।
তবে আজমল উদ্দীন কিছুই বলতেন না এ ব্যাপারে।
শুধু বলতেন, এত তাড়া কিসের? হবে হবে।
তার ওরকম কোনো দুশ্চিন্তাই ছিলোনা এই বিষয়ে।
তার চিন্তা ছিলো, সে পারছে না,তার ব্যর্থতা। একদিন সুখবর আসবেই।
তবে তার সামান্য কিছু অশান্তি ছিলো মনে মনে।
কারণ শাহানা বেগম তাকে স্বর্গীয় সুখের অনুভূতি দিতেও অনেকটাই ব্যর্থ। তবুও আজমল উদ্দীন কোনোদিন কিছু বলেনি তার স্ত্রীকে। কারণ তার জন্য তার স্ত্রীই ছিলো সব। যদিও মাঝেমধ্যে সে সীমালঙ্ঘন করে ফেলতো,নিজের অজান্তেই।
শাহানা বেগম এত নামাজী,এত আল্লাহর অনুগত ছিলো না প্রথম প্রথম।
এসবের থেকে মুক্তি পাওয়ার আশাতেই সে শান্তির পথে অগ্রসর হয়।
দীর্ঘ সময় নিয়ে সে নামাজ পড়তো।
ঘন্টার পর ঘন্টা সিজদাহ্,মোনাজাতে পড়ে থাকতো,খুব কান্নাকাটি করতো।
পানি-পড়া হতে মোকছুদুল মোমিনীনের সবকিছু অনুসরণ করতো। সব ধরণের টোটকা নিজের উপর ফলাতো,যেখানেই যা পেতো। কারণ তাকে বাচ্চা প্রসব করতে হবে, যেকোনো মূল্যে।
নিজের পছন্দে বিয়ে করায় তার
বাবার বাড়ির সাথেও তার যোগাযোগ তেমন ভালো না। এরা তাড়িয়ে দিলে কোথায় গিয়ে উঠবে সে?
কিন্তু তাতেও তার শাশুড়ির ঘোর আপত্তি!
তিনি বলে বেড়াতেন,
শাহানা বেগম সারাদিন আসলে নামাজ-কালাম করেনা, কালা যাদুর আশ্রয় নিয়ে তাবিজ করতেছে তার ছেলের উপর। এইজন্যই নাকি যবে থেকে শাহানা বেগম এরকম সময় নিয়ে ইবাদাতের অভিনয় আরম্ভ করেছে; তবে থেকেই নাকি তার ছেলে তার হাতের বাইরে চলে গেছে। তার ছেলে তার কোনো কথাই শোনেনা। তার ছেলেকে বশ করেছে তার শয়তান বউ।
(চলবে)
রাকা (২৪)
অত:পর ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হলো আজমল এবং শাহানা দম্পতির। কিন্তু ঐ ডাক্তার তেমন কোনো জটিলতা খুঁজেই পায়নি। শাহানা বেগম তারপর ও স্ব-খরচে, স্ব-উদ্যোগে ঢাকায় এসে পরীক্ষা করান। পরীক্ষার ফলাফল যে এতটা ভয়ংকর হবে তা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
তার জরায়ুতে টিউমার ছিলো। এবং সেটা ততদিনে এতটাই গুরুতর হয়ে গেছিলো যে তা ক্যান্সারের উপক্রম। ডাক্তার জানালেন,তাকে ইমেডিয়েটলি অপারেশন করে জরায়ু কেটে বাদ দিতে হবে।
এবং এই টিউমারের জন্যই সে ব্যর্থ ছিলো শারীরিক কার্যকলাপে।
আজমল উদ্দীন এসব শুনে তদ্ধা খেয়ে গেলেন। কি বলছে এই শহুরে ডাক্তারনী?
অবশেষে তাই করতে হলো।
শাহানা বেগমের জরায়ু কেটে বাদ দিতে হলো। এবং তখন থেকেই সে বন্ধ্যাত্ব লাভ করে। শাহানা বেগম আর কখনোই মা হতে পারবেন না এবং তার স্বামীর প্রয়োজনীয় সুখ,আহ্লাদ ও দিতে অক্ষম তিনি।
এরপর থেকেই আজমল উদ্দীনের সামান্য মানসিক উত্তেজনা,সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে; তার প্রচন্ড যৌন উত্তেজনাহেতু কারণে।
ফলপ্রসূ সে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে বাচ্চাকাচ্চাদের সাথেও অপ্রীতিভাজন আচরণ অনিচ্ছাসত্ত্বে ও করে ফেলতো। পরে অবশ্য নিজেই আফসোস করতো। কিন্তু নারী দেহ দেখলে সে আর কোনোভাবেই সামলাতে পারতো না নিজেকে। ডাক্তার বলেছে, তার স্ত্রীর এই অক্ষমতা সে মেনে নিতে পারছে না বলেই এরকমটা হচ্ছে। এটা আস্তে কমে যাবে। যদি না কমে বা একান্তই যদি সে আর সংবরণ করতে না পারে নিজেকে, তাহলে তার জন্য বিয়ে অবধারিত।
একদিকে চির বন্ধ্যাত্ব লাভ; অন্যদিকে স্বামীর এই মনের অসুখ। পাশাপাশি শাশুড়ি মায়ের কথার খোঁটা শুনে শুনে তো সে একপ্রকার গোলকধাঁধায় পড়ে গেছিলো তখন। মানুষের কথা দিয়েই আঘাত করার ক্ষমতা সীমাহীন বেশি হয়,সে তার শাশুড়ি মাকে দেখে তা বুঝে যায়। সে বুঝতে পারে,আজমল উদ্দীনের ভালোর জন্যই তাকে আবার বিয়ে করাতে হবে। একসময় সে টের ও পেয়ে যায় যে আজমল উদ্দীন ইতোমধ্যে একটা সম্পর্কে জড়িয়েও গেছে।
আস্তে আস্তে আজমল উদ্দীন স্বাভাবিক হতে শুরু করেন। শাহানা বেগম ও প্রমাণ পেতে শুরু করলেন,তার স্বামী এখন আর শুধু তার সম্পদ নেই,অন্য একজন ও তাকে ব্যবহার করছে,ভোগ করছে। শাহানা বেগম স্বামীর এই সুস্থ, সুখীচিত্রে আর ব্যাঘাত ঘটালেন না। বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে সবটা সয়ে গেলেন।
মাঝেমধ্যেই আজমল উদ্দীনের মন খারাপ থাকতো। শাহানা বেগম বুঝতেন,তার স্বামীর প্রেমিকার কোনো নতুন আবদার এসেছে আবার, যেটা তার স্বামী পূরণ করতে পারছে না টাকার অভাবে। সে তখনই নিজের জমানো টাকার অনেকটাই আজমল উদ্দীনের হাতে দিয়ে নিঃশব্দে চলে যেত। আজমল উদ্দীন অবাক হতেন,
তার স্ত্রীর এই অগাধ ভালোবাসা এবং ক্ষমতা দেখে।
তিনি তার স্ত্রীকে ফেলে যার প্রেমে মশগুল ছিলো তিনিই হলেই আমার মা,মিসেস অনু চৌধুরী।
অনু চৌধুরীর প্রতি আসলে আজমল উদ্দীনের ভালোবাসার পাল্লা ছিলো শূণ্য। উনি মূলত তার প্রথম স্ত্রীকেই মন প্রাণে ভালোবাসেন। আর অনু চৌধুরীকে সামান্যই পছন্দ করেন তাও শুধুমাত্র দৈহিক,শারীরিক সুখের/চাহিদার জন্য।
এই বিষয়টি আজমল উদ্দীন আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করলেন তখন,যখন তিনি অনু চৌধুরীকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।
আজমল উদ্দীন অনু চৌধুরী কখনোই বিয়ে করতেন না;যদিনা তার মুমূর্ষু মা এমন শেষ আবদার করে যেত।
আজমল উদ্দীনের মা, গুলনাহার বেগম, মারা যাওয়ার আগে হেঁচকি তুলে শুধুমাত্র এ কথাটিই বলে গেছেন ছেলেকে,
” বাবা,তুই ঐ মেয়েটাকে বিয়ে কর। নাতি-পুতনি আন। এই মুখপুড়ির জন্য নিজের জেবন নষ্ট করিস না বাপ।”
ঘটনাস্থলে শাহানা বেগম ও উপস্থিত ছিলেন। তিনি শব্দ করে সূরা,কে’রাত পড়ছিলেন শাশুড়ির শান্তিময় মৃত্যুর জন্য। কথাগুলো তার কান পর্যন্ত আসলেও সে তোয়াক্কা করেনি। শুধু চোখের জলে ভিজে গেছিলো তার সামনের ধর্মীয় গ্রন্থগুলো।
অবশেষে আজমল উদ্দীন মায়ের মৃত্যুর কয়েক বছর পরই বিয়ে করলেন।
তার মৃত মায়ের নাতনি হলো,ইরা।
আজমল উদ্দীন আজ তার দ্বিতীয় বউ নিয়ে বাড়িতে ও এসে হাজির হয়েছেন।
অনু চৌধুরীর ভয়ে সে সবই মিথ্যা বলেছে।
তবে আসলেই তার বাড়ি তার ভাইয়েরা দখল করে নিয়ে তাকে পথে বসানোর মত একটা ষড়যন্ত্র করেছিলো একসময়।
কিন্তু শাহানা বেগম সেটা হতে দেন নি।
সে নিজের টাকার সাথে বাপের বাড়ির ও কিছু টাকা যোগ করে সেই বাড়ি নিজের নামে লিখিয়ে নেয়। সেখানেই আজমল উদ্দীন এসে মাঝেমাঝে উঠে। কারণ এখানে তার প্রাণ-প্রিয় স্ত্রী,শাহানা বেগম থাকেন।
বাড়িটা সে নিজ নামে কিনে নিয়েছে কারণ আজমল উদ্দীনের স্মৃতি, তাদের সাংসারিক জীবনের সব স্মৃতিই এই বাড়িকে ঘিরে। আজমল উদ্দীন ও অবশ্য জানে,কেন শাহানা বেগম বাড়িটা কিনে নিয়েছিলো এভাবে।
নিজের স্বামীর নামে কেন কিনে নি সেটা অস্পষ্ট হলেও যৌক্তিক অর্থে বলা বাহুল্য,যেহেতু আজমল উদ্দীনের মতিভ্রম হয় মাঝেমধ্যে, সেহেতু তার নামে বাড়িটা না কেনাই শ্রেয়।
অনু চৌধুরীকে নিয়ে উঠার মত ঐ একটা জায়গাই আছে। শাহানা বেগমের অধীনে থাকা বাড়ি।
কারণ আজমল উদ্দীনের নামে কিছুই অবশিষ্ট নেই। জমি-জমার সবকিছুই ভাইয়েরা নিয়ে নিয়েছে।
অনু চৌধুরী যখন জানতে পারলেন, আজমল উদ্দীনের আগের ঘরেও একজন স্ত্রী আছে, সে তাণ্ডবলীলার চিত্র বলে বোঝানোর নয়।
রাগ দেখিয়ে চলে যাওয়ার মতলব এঁটেও তার ফায়দা নেই,কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আর।
★
আব্বু আর আপন স্যার অনেকক্ষন যাবত ফোনে কথা বললো।
কি বললো তার সবটা পরিষ্কার না।
শুধু বুঝলাম অনু চৌধুরীকে নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে তাদের মধ্যে। আমার নামটাও দু একবার শোনা গেছে। কিন্তু স্পষ্ট বুঝলাম না। আব্বু চাচ্ছে না আমি তাদের কথোপকথন শুনি।
রিমা খালা আর আমি বারান্দায় বসে বসে আচার দিচ্ছি।
সৌভাগ্যবশত খালা এই দু সপ্তাহ আমাদের কাছেই থেকে গেছেন।
খালার জন্যই আজ আব্বু সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে মূলত। আমিও পারছি, কথা বলতে।
কোনো এক অজ্ঞাত কারণে রিমা খালার মুখ সকাল থেকেই হাসি হাসি।
সে বার বার আব্বুর রুমের দিকে উঁকি দিচ্ছে কেবল, আব্বু ফ্রি হয়েছে কিনা দেখার জন্য। খুব সম্ভবত কোনো সু-খবর আছে আব্বুকে দেওয়ার মত। আমি জিজ্ঞেস করেছি, খালা না শোনার ভাণ ধরে আছে। মানে আমাকে বলা অত গুরুত্বপূর্ণ না।
যেইনা আব্বু ফোন রাখলো অমনি খালা ছুটে গেলো তার কাছে। আমিও পেছন পেছন গেলাম।
মাথা একদম নিচু করে প্রজাদের বেশে সে বললো,
– ভাই, একটা সু-খবর আছে। তিন প্যাকেট মিষ্টি আনায়ে দিতে পারবেন?
আব্বু হতচকিত হয়ে বললো,
– কী সু-খবর? তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে নাকি?
কথাটা বলতেই খালা লজ্জ্বায় লাল হয়ে গেলেন।
– না না,সেরকম কিছু না!
– তো?
– ভাই,আমি চাকরী পাইছি। দুইটা টিউশন ও পাইছি। অনেক বড় ফ্যামিলির দুইটা বাচ্চাকে বাসায় গিয়ে পড়ায়ে আসতে হবে। ৫,০০০ করে দিবে বলছে। আর চাকরীটাও ভালো। শুধু হিসাব-নিকাশ করবো। এই ই কাজ। মাসিক বেতন ও ভালো।
আব্বু মুখ গম্ভীর করে বললো,
– হ্যাঁ ভালোই তো। মিষ্টি আনিয়ে দিচ্ছি আমি। কিন্তু তিন প্যাকেট কেন?
খালা খুশির ছলে বলছে,
– এক প্যাকেট আমাদের বাড়িতে।
এক প্যাকেট আপনার আম্মার কাছে, আরেক প্যাকেট এই বাসার জন্য। আপনি আর রাকা খাবেন। রাকা তো মালাইকারির মিষ্টিটা বেশি পছন্দ করে। ওর জন্য এটাই আইন্যেন।
– তাহলে দুই প্যাকেট আনো। আমাদের জন্য লাগবেনা।
এই কঠিন কথা শুনে খালা আহত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কেন?
– কয়েককটা জীবন নষ্ট হওয়ার জন্য দায়ী কারণের জন্য আমি আমার বাসায় মিষ্টি এলাউ করতে পারিনা।
– মানে?
– মানে খুব সোজা রিমা। আমার জীবন তছনছ হয়ে গেছে। গৃহিনী বউ হয়েও তাকে সামলে রাখতে পারিনি। সেখানে তুমি চাকরী করবা। তোমাকে যে বিয়ে করবে তার সংসার ও যে আমার মতই হবে একদিন,তা আর বুঝতে বাকি নেই আমার। তাই আমি মিষ্টি খাবো না। কারণ তোমার বাইরে বাইরে ঘোরার সাথে আমি একমত নই।
খালা চুপসে গেলেন এরকম কঠিন কথা শুনে।
তার কষ্টে চোখ ভিজে গেলো।
করুন স্বরে বললো,
– ভাই, স্বাদে কি আর চাকরী করতে বলি? নিজের ভরণ-পোষণের দায়িত্বটা তো এখন নিজের উপরই। স্বামী-সংসার কিচ্ছু তো নেই! একজন বিধবা নারীর ভাইয়ের বাসায় গিয়ে থাকার জীবনটা যে কতটা দু:খের, কতটা নির্মম হয়,তা কী আর আপনি বুঝবেন?
আব্বু হালকা গলায় বললেন,
– কত খরচ লাগে আমাকে বললেই হবে। আমিই দিয়ে দিবো না হয়।
খালা হাস্যজ্জ্বল স্বরে বললেন,
– থাক। আর লোককথা প্রশ্রয় দেওয়ার দরকার নাই। আমি কারো দয়া নিতে চাইনা। আপনাকে মিষ্টি খেতে হবে না। আসলাম।
বলেই খালা তাড়াহুড়ো করে সব গোছগাছ শুরু করলেন।
আব্বুর হাতে ডিভোর্স পেপার।
সে রিমা খালার সাথে তার এই রূঢ় ব্যবহারের কারণটা বলে বোঝাতে পারবে না বলেই হাতে এই পেপারটা নিয়ে এসব বলেছে এতক্ষন।
ভাবলো,খালা হয়তো বুঝবে।
সে নিজের কষ্টগুলো খামোখাই রিমা খালার উপর ঝেড়েছে এতক্ষন, কঠিন কথা বলে বলে।
কিন্তু খালা এতটাই সেন্টিমেন্টাল, সে একবার ও ওদিকে চোখ ই দেয়নি!
আব্বু মনে মনে ভাবলো,না, মেয়েটার সাথে আমার এতটা শক্ত আচরণ করা ঠিক হয়নি। সে নিজেও আমার মতই দু:খী,অসহায়।
খারাপ হওয়ার মনস্থ থাকলে, তাকে বন্দি করে রাখলেও লাভ হয়না।
আব্বু খুব ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো,
আর পিছুটান রেখে লাভ নেই।
অনু আর ফিরবে না।
ওকে এবার আমার জীবন থেকে মুক্ত করে দেওয়াই উত্তম।
কোথায় আছে ও? আজকেই ওকে ডিভোর্স দেওয়ার ক্রম শেষ করে ফেলা যাক।
সে ডিভোর্স পেপারের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
তার বুকটা ফেঁটে গুড়িয়ে যাচ্ছে।
এই একটা অনুই যথেষ্ট, হাজার হাজার রেজার জীবন ধ্বংস করার জন্য!
সত্যিই কি আর ফিরবেনা তুমি? অনু?
আব্বুর চোখের কোণের জল এসবের জানান দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার কলম জানান দিচ্ছে অন্যকিছু।
এবার আর থামা যাবেনা। সব কাটসাফ করে ঠিক করে ফেলতে হবে।
আমি এসব নিয়ে চিন্তিত না।
নতুন কম্পিউটার, নতুন ক্লাস, ক্লাস মনিটরিং এবং নতুন নতুন প্রজেক্টে ধ্যান দিয়েছি।
ভালোই এগোচ্ছে সব।
আপন স্যারের দেওয়া সব হোমওয়ার্কস,তার নোটবুক সবই এখন আমার চলার পাথেয়।
আমার জীবন তখন ও খুব গোছানো ছিলো।
সুন্দর ছিলো। আমি সুখে ছিলাম খুব।
কিন্তু ভাগ্য যে খুব নির্মম,নিষ্ঠুর আমার জন্য,বোধগম্য ছিলো না।
(চলবে)