রাকা (২৭)
আব্বুর পুরোনো একটা প্রাইভেট কার ছিলো,ওটা দিয়েই আমরা আমাদের যাতায়াতের সমস্যাটা মেটাতাম।
কিন্তু ওটা বহুদিন যাবতই অকেজো হয়ে পড়ে আছে। মেরামত করেনি কারণ নানান দুর্যোগ, নানা সমস্যা অতিক্রম করতে হয়েছে ইতোমধ্যেই। তাছাড়া অনু চৌধুরীর বেহিসাবি চলাফেরা,খরচ সামলে গাড়ি কেনা দুর্বিষহ ছিলো বৈকি। ইদানিং আব্বুর ব্যবসার প্রশস্ততা বেড়েছে তাই একটা গাড়ির ও প্রয়োজন হয়েছে বিস্তরভাবে।
আমাদের পার্কেই সন্ধ্যা হয়ে গেলো। মার্কেটে আজ আর যাওয়া হবে বলে মনে হয়না। তবে আমার বা খালার এ নিয়ে কোনো আপত্তি বা কষ্ট ও নেই। কারণ আজকের আব্বুকে আমরা অন্যভাবে পেয়েছি। আব্বু আজ আমাদের সাথে ঘাসের উপরে বসেছে, মজার মজার গল্পগুজব করেছে, হাওয়াই মিঠাই খেয়েছে পর পর তিনটা। সেই আগের আব্বু। দোলনায় ও উঠেছে। খালাকে আর আমাকে ও উঠিয়েছে। আব্বুর দুর্ভাগ্য,সে দ্বিতীয়বার উঠতে গেছিলো তখনই দোলনার শক্ত দড়ি ছিঁড়ে পড়ে গেছিলো। সবার সামনে সে কি লজ্জ্বা! আমরা ভাবলাম আব্বু বুঝি এখনি ছুটে চলে যাবে,রাগারাগি করবে। কিছুই করেনি। সে উঠে বেদমে হাসলো কিছুক্ষন। তারপর কতৃপক্ষের কাছে জরিমানা দিয়ে তিনজনই হাসতে হাসতে এসে বসে পড়লাম পার্কের নিরিবিলি, লাল-হলুদ আলো মিশ্রিত একটি মুখরিত পরিবেশে।
পাশেই একটা ছোট পুকুরের মত। কিন্তু তবুও এটার রাজকীয় নাম, ভিক্টোরিয়া সাগর। এটার চারপাশের এখন লাল,নীল,সবুজ বাতি জ্বলছে,পানিগুলো একদম নীল আর স্বচ্ছ। কিছু দূরেই দেখা যাচ্ছে একটা বিশাল পানির ফোয়ারা। আমরা বসে আছি অনেক দূরে। সেখান থেকেই দেখা যাচ্ছে এই সুন্দর সুন্দর দৃশ্যগুলো। আব্বু আর খালা এক পাশে,আমি একটু সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইলে ভিডিও করছি।
আমি শুনতে পাচ্ছি,খালা আর আব্বু আজকে একটু বেশিই খোশগল্পে মেতে গেছে। আব্বু কিছু বলছে,খালা শুধু হাসছে। আবার খালা কিছু বলছে, আব্বু আস্তে আস্তে হাসছে। কিছুক্ষন পরেই আব্বুর ফোন আসলো। আব্বু ব্যস্ত হয়ে
উঠে চলে গেলো। খালা আমাকে ডেকে এনে তার কাছে বসালো। আমার চুল নষ্ট হয়ে গেছে সে আবার ঠিক করে দিচ্ছে।
এমন সময় আব্বু পিছনে এসে হাজির।
– রাকা, এই আম্মু, এইদিকে আয় তো দেখি!
আমি বিদ্যুতের গতিতে সব ছেঁড়েছুঁড়ে আব্বুর কাছে চলে গেলাম।
আব্বু ডান পাশে ইশারা করে বললো,
– দেখ তো কেমন হইছে?
আমি তাকিয়ে রইলাম বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে। ওটা একটা গাড়ি। সাদা রং। কি সুন্দর! আমি গাড়ির কাছে এগোতেই দেখলাম গাড়ির ভেতরে কেউ বসে আছে। কিছুক্ষন পরই বেরিয়ে এলো আপন স্যার। আমি গাড়ি দেখে যতটা না চমকালাম তার চেয়েও বেশি চমকালাম স্যারকে দেখে।
স্যার বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
– কী অবস্থা? কেমন আছো?
আমি আস্তে করে বললাম,
– আপনি, স্যার, আমি ভালো আছি, আপনি না ১৪দিনের ট্রেনিং’এ গেছেন?
সে মৃদ্যু হেসে বললো,
– হ্যাঁ গেছি। আজকে ব্রেক দিছিলো। তাই ভাবলাম তোমাদের কাছে আসি একটু। দেখে যাই কেমন আছো তুমি! তোমার আব্বু ও বললো, সে নতুন কার কিনবে একটু দেখে শুনে যেন দেই। তো আর কি, চলে আসলাম!
আব্বু আর খালা ততক্ষনে এসে হাজির।
আব্বু আমার কাঁধে হাত রেখে বললো,
– কী মা? পছন্দ হইছে?
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, হ্যাঁ।
আব্বু বললো, এখন কী করবা? ঘুরে আসবা আপনের সাথে? যাও, যাও, সামনে যাও তোমরা। আমার একটু কাজ আছে এদিকে।
খালা বলে উঠলো,
– ওকি গাড়ি চালাতে জানে?
আপন স্যার বললো,
– জানিনা ম্যাডাম। শিখতেছি। এখন আপনাদের নিয়ে একবার ট্রায়াল করে দেখবো।
খালা ভয় পেয়ে বললো,
– তুমি আর মানুষ পাইলা না! মেয়েছেলে নিয়ে তুমি ট্রায়াল দিবা?
আব্বু হেসে বললো,
– আরে না! রিমা, ও গাড়ি চালাতে পটু। গাড়ির সব আগাগোড়া তার মুখস্থ দেখেই তো তাকে ডেকে এনে গাড়ি কিনালাম! যাও তোমরা, চিন্তা নাই।
আমি কিছুই বলছি না। একটু একটু পর পর শুধু আড়চোখে স্যারের দিকে তাকাচ্ছি। কেন তাকাচ্ছি তা নিজেও জানিনা। যেন একটা অন্য রকম টান! সে সামনে আসলেই তাকে লুকিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। না দেখলে যেন আমার পেটের ভাতই হজম হয়না!
খালা বললো,
– কিন্তু আমাদের তো মার্কেটে যাওয়ার কথা ছিলো! রাকার জন্য কিছু কেনাকাটা করার কথা ছিলো।
আব্বু বললো, সেটাই তো বললাম। যাও তোমরা, নতুন গাড়ি নিয়ে মার্কেট বা এনিহয়্যার,ঘুরে আসো!
আমি আব্বুকে ডেকে বললাম,
– এই গাড়িটা তুমি কিনছো আব্বু?
আব্বু মলিন মুখে বললো,
– আমি কিনছি বলতে এটা মূলত আমাকে গিফট হিসেবেই দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়িক অনেক ইস্যু আছে,তুই বুঝবি না। আমার একার পক্ষে এই মুহূর্তে এরকম একটা গাড়ি কেনা সম্ভবপর ছিলো না।
খালা জিজ্ঞেস করলো,
– কেন? তাহলে কিনলেন কেন? আর কিনছেন ই বা কিভাবে?
– কারণ আমার প্রায় দুই,তিন লাখ টাকা নিয়ে তানিশা চলে গেছে। তারউপর আমার দুই তিনটা নতুন ব্যবসা। এতকিছু সামলে গাড়ি কেনার সাধ্য ছিলো না। নতুন ব্যবসাগুলো শুরু করেছিলাম যাদের সাথে, তারাই খুশি হয়ে গাড়ি দিতে চেয়েছিলো। তাই আমি ভাবলাম দিবেই যখন তখন আমিও কিছু দেই,ভালো দেখেই কিনি। এই আরকি।
খালা বললো,
– আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি চলেন, আমরা নিউ মার্কেটে যাবো। এখান থেকে রিক্সায় ১৫টাকা ভাড়া।
– ভাড়া লাগবে কেন? গাড়িই তো আছে।
– গাড়িতে করে রাকারা যাক, ও ওর স্যারের সাথে ঘুরে আসুক। আপনি আর আমি নিউ মার্কেটে গিয়ে ওর জন্য কিছু কেনাকাটা করে আবার ওদের সাথেই ফিরবো।
খালা খুব করে চাচ্ছে, আব্বুর সাথে একটু আলাদা সময় অতিবাহিত করতে। সেখানে আমার বা কারোরই উপস্থিতি হয়তো তার ভালো লাগছে না। তাই সে চাচ্ছেনা তাদের সাথে আমিও থাকি।
আব্বু রাজি হচ্ছিলো না,তবুও অনেক বলার পর আব্বু ও রাজি হলো। আমি তেমন একটা বাঁধা দিলাম না। আমার ও ইচ্ছা করছে,নতুন গাড়িতে করে ঘুরতে। আপন স্যার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। সে আনমনে কথা বলে যাচ্ছে কারো সাথে।
অত:পর আপন স্যারের পাশের সিটেই আমি বসলাম।
স্যার গাড়িতে বসেও ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। আমি বাইরে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি,আজকে আব্বু আমাদের এটা ওটা বলে এইজন্যই পার্কে এতক্ষন রেখেছিলো; যাতে গাড়িটা সারপ্রাইজ হিসেবে দিতে পারে! কিন্তু আমি তো গাড়ি পেয়ে অতটা সারপ্রাইজ হই ই নি। সেটা কি আর আব্বু জানে? আমি তো সারপ্রাইজ হয়েছি স্যারকে দেখে।
ইশ,স্যার কি সুন্দর দেখতে!
হালকা আকাশী কালারের একটা শার্ট আর নীল কালারের জিন্স। লম্বা চুলগুলো এলোমেলোভাবে আছে। হাতে দামী, কালো রং’র ঘড়ি।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, সারাজীবন যদি তাকে দেখতে দেখতেই কাটিয়ে দেই,তবুও হয়তো আমার তাকে দেখা শেষ হবেনা!
স্যারের কথা শেষ হয়েছে।
সে ফোন নামিয়েই বললো,
– কোথায় যাবা বলো। আজকে তুমি যেখানে বলবা সেখানেই ঘুরে আসা হবে।
আমি বললাম, আমি জানিনা। আপনার যেখানে ইচ্ছা,সেখানেই চলেন স্যার।
স্যার হাস্যজ্জ্বল মুখে বললো,
– রাকা, তুমি ভালো আছো তো? সব ঠিকঠাক না এখন?
আমি স্বাভাবিক স্বরে বললাম,
– হুম। ভালোই আছি স্যার। এখন আমার কোনো সমস্যাই হচ্ছেনা।
– ভালোই! আচ্ছা, তোমার খালাকে তোমার কেমন লাগে?
আমি খুশিমনেই বললাম,
– খুব ভালো লাগে।
– খুব?
– হ্যাঁ।
স্যার একটু গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– আচ্ছা,গুড! তোমার রিমা খালাকে যদি আম্মু হিসেবে পাও, তাহলে তোমার আপত্তি থাকবে না তো?
এই প্রশ্ন শুনে আমি চমকে গেলাম।
চমকিত স্বরে বললাম,
– কেন! আমার তো একজনই আম্মু, তার নাম অনু, অনু চৌধুরী। এখন আবার আরেকটা আম্মু কেন?
– হুম। একটাই আম্মু তোমার। কিন্তু এখন আর নেই। সে চলে গেছে তোমাদের ছেড়ে। তাই আরেকটা আম্মু আসলেও সমস্যা নেই। স্যার বললো।
আমি কিছুক্ষন ভাবলাম। তারপর বললাম,
– কিন্তু স্যার, সে ও যদি আমার আম্মু হওয়ার পর অনু চৌধুরীর মত হয়ে যায়?
স্যার গম্ভীর গলায় বললো,
– না। তেমন কিছু তো মনে হয়না। তবে অচিরেই সে তোমার স্টেপ মাদার হবে। এটা মনে হচ্ছে।
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
– স্টেপ মাদার কেমন হয়? খুব খারাপ হয় তাইনা?
– তুমি স্টেপ মাদারের মানে বুঝো?
– হ্যাঁ। আমার আসল আম্মুই তো আমার সাথে ওরকম ব্যবহার করছে।
– তোমার আম্মুর মত আম্মু পাওয়া দুর্লভ। এরকম স্বার্থপর মা সাধারণ হয়না।
– তাহলে স্যার,আমার মনে হয় আমার ক্ষেত্রে উল্টোটাই হবে! আমার স্টেপ মাদারই ভালো মা হবে!
– মেবি। স্টেপ মাদার মানেই কিন্তু সৎ মা। জগতের ৮০% সৎ মা খারাপ ই হয়। সো, বি কেয়ারফুল রাকা। সাবধান থাকবা সবসময়।
আমি আগে থেকেই জানি স্টেপ মাদারদের বৈশিষ্ট্য। সমাজ বইয়ে এই নিয়ে সামান্য কিছু টপিক পড়েছিলাম।
কিন্তু স্যারের মুখে বাংলা নাম, “সৎ মা” নামটা শোনার পর থেকেই কেমন যেন হয়ে গেলাম।
সৎ মায়েরা খারাপ ই হয় বেশিরভাগ,এইটার মমার্থ বুঝতেই যেন বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো।
রিমা খালাও কি এমন হবে?
আল্লাহ এমন না করুক।
★
আব্বু আর খালা এক রিকশায়।
তারা নেমে পড়তেই আব্বুকে চেনে এমন কয়েকজন এসে টিটকারি মারলো,
– কী ভাই? নতুন ও পাইয়া গেছেন? এত তাড়া আপ্নের? যেমন বউ,তেমন তার জামাই! বউ ভাগছে এখন জামাই ও মাইয়্যা নিয়া ঘুরে!
খালা কথাটা শুনে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
আব্বু কিছুই বললো না।
সোজা কাপড়ের দোকানে গিয়ে কেনাকাটা শুরু করলো।
হঠাৎ আব্বু বাথরুমে যাওয়ার জন্য ফোনটা খালার কাছে দিয়ে গেলো।
কিছুক্ষন পরই ফোন বেজে উঠলো।
অন্ধকার আর ব্যস্ততার জন্য সে ফোন তুললো না। কিন্তু বার বার ফোন আসছিলো, নাম্বার আননোউন, তাই সে বাধ্য হয়েই ফোন ধরলো। ধরেই বললো,
– আসসালামু আলাইকুম। কে? একটু পরে ফোন করেন।
কথা শেষ না হতেই ওপাশ থেকে বাজখাঁই গলায় কেউ বললো,
– ওই তুই কে বল! আমারে জিগাস আমি কে? তুই কার ফোন ধরছোস বল?
অনু চৌধুরীর হাতে ডিভোর্স পেপার এসেছিলো। সে সেটা সাথে সাথেই কুচি কুচি করে কেটে ফেলে দিয়েছে।
সে এত সহজে ডিভোর্স দিবেনা। কিছুতেই না। সেই খবর দিতেই আব্বুকে ফোন করছিলো। মনে মনে সে অনেক ফিকিরবাজিই করে রেখেছে, জোর করলেই নারী নির্যাতনের মামলায় ফাঁসিয়ে দিবে অথবা অন্য কোনো সমস্যায় ফেলে দিয়ে ঠিক নিজের চাহিদা মত সবটা উসুল করে নিবে।
(চলবে)
(রাকার নতুন মা হবে? হলে কেমন হবে সে?)