রাকা (৩১)
ফারজানা রহমান তৃনা
আব্বুর সিদ্ধান্ত নেওয়া শেষ।
সে আমাকে আমার সেই নিষ্ঠুর,স্বার্থপর মায়ের কাছে পাঠানোর এই কঠোর, নির্মম সিদ্ধান্তেই তৎপর। আব্বুর প্রতি আমার ভালোবাসার ব্যাখ্যা ভাষায় প্রকাশের জোঁ নেই।
আমার পৃথিবী বলতে তো শুধু আমার আব্বুই। মা নেই, বোন নেই, কেউ নেই আমার, একমাত্র এই আব্বু ছাড়া।
সেই আব্বুর জন্য ও আজ বোঝা হয়ে গেলাম আমি।
আমাকে সে আর তার কাছে রাখতে পারছে না।
তার সন্দেহ আমি আমার মা-বোনের উত্তরসূরি; তাই আমিও যে তাদের অনুসরণ করবো না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
তাছাড়া আমার দাদিও চায়না, আমার মায়ের কোনোপ্রকার চিহ্ন তার ছেলের কাছে থাকুক।
কে জানে হয়তো আব্বুর এই নির্মম, কঠিন সিদ্ধান্তের পিছনে আমার দাদির ও একটা বিরাট অবদান ছিলো!
রিমা খালা শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– এই মেয়েকে ওদের সাথে তুলনা করলে চলবে না ভাই। রাকা ওদের মত হয়নাই। সম্পূর্ণ আলাদা। ও এমন কিছু করবেনা যাতে আপনার মানসম্মান নষ্ট হয়। ছোট থেকেই তো নানারকম কাহিনী দেখে আসতেছে, তাই ভালো-মন্দের তফাৎ করতে জানে। ও বয়সের তুলনায় অনেক বড় হয়ে গেছে। অনেক বুঝে ও,ভাই। এখনই নিজের মেধা দিয়েই ঠিক ভুল বিচার করতে পারে। আপনি ওকে বিশ্বাস করলে কখনো ঠকবেন না,এই গ্যারান্টি আমি আজকে আপনাকে দিলাম।
আব্বু কেমন যেন একটা করলো কথাগুলো শুনে।
আমি বিস্ফোরক দৃষ্টিতে কেবল এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে যাচ্ছি!
আব্বু ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
– তুই আমাকে আমার মেয়ের ব্যাপারে গ্যারান্টি দিচ্ছিস? বাহ্!
– হ্যাঁ। কারণ পুরুষ মানুষ সবসময় সবকিছু বুঝে না। রাকা মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে কিছুটা বুঝতেন।
আব্বু গলা খাকি দিয়ে বললো,
– আমি তো তোকেও ভরসা করতে পারিনা,সেখানে তোর কথার মূল্য আমি কিভাবে দিবো বল? আমি এই দুনিয়ায় এখন আর কাউকেই বিশ্বাস করিনা।
খালার চোখ ছল ছল করতে লাগলো এই কথা শুনে। সে মুখ অন্ধকার করে বললো,
– ও। সেটা আপনার ব্যাপার,আপনার বুঝ। অথবা আমার ব্যর্থতা।
আব্বু খুব শান্ত,স্বাভাবিক স্বরে বললো,
– হ্যাঁ। তুই রাকাকে একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে দিস। আগামীকালই হয়তো ওর শেষ দিন,বাবার কাছে থাকার। বলিস, এই বাবার বুক ভেঙে গেছে। এই বুকে আর কোনো ঝড় সামলানোর শক্তি নেই। বলে দিস,ওর বাবার প্রাণ ও। সবসময় তাই থাকবে।
খালা ভুরু কুঁচকে বললো,
– কি বলেন এসব! এটা ঠিক হবে না ভাই। একবার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করেন দয়া করে। ওর ওই মায়ের কাছে ওকে পাঠানো মানে ওকে ইচ্ছা করে নষ্ট করে ফেলা। মেয়েটা খুব ভালো। ওর সাথে এটা করা ঠিক হবেনা। তাছাড়া আপা ও ওকে রাখবে বলে মনে হয় না।
– ঠিক বেঠিক আমি বুঝবো। রাখবেনা কেন?
– আপার নতুন সংসার তো! শুনছি বাচ্চাও আছে এখন। সামনে আরো হবে।
এখন কি আর আগের ঘরের বাচ্চার প্রতি তার আগের মত স্নেহ-ভালোবাসা থাকবে বলেন? রাকাকে তো সে যত্ন করবে না। তাছাড়া বাড়তি একজনকে তার বর্তমান স্বামীও রাখতে চাইবে না। আমার যা মনে হয়।
আব্বু গম্ভীর গলায় বললেন,
– রাখবে। আমি মাসে মাসে রাকার জন্য টাকা পাঠিয়ে দিবো। ওর ভরণ-পোষণের দায়-দায়িত্ব সারাজীবন আমিই বহন করবো,যতদিন সম্ভব হয়।
খালা খানিক হেসে বললো,
– নাহ্ ভাই। আপা ওর খেয়াল রাখবে না, আগেও যে রাখতো তাও বলবো না। কারণ আমি আগে পিছে কিছু কিছু জিনস শুনছি। বিশ্বাস করেন,নষ্ট হয়ে যাবে মেয়েটা। ও কত ভালো পড়াশোনায়,তাও ও আর হবে না। আপনার নিজের মেয়ে,আপনি না বুঝলে কে বুঝবে?
আব্বু খালার দিকে তাকিয়ে অসহায় চাহনি নিয়ে বললো,
– কিছু করার নেই রিমা। আমার এটা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই।
খালা আব্বু চোখের এক রহস্যময় অসহায়ত্বের আভাস পেয়ে চুপসে গেলো।
ভাবতে লাগলো, কি হয়ে গেলো হঠাৎ মানুষটার?
এমন কি হলো এই মধ্যে!
আব্বু শান্ত গলায় বললো,
– তোর ভাইয়ের আর তোর মধ্যে সমস্যা হয়েছে আমি জানি। আমার জন্যই হয়েছে তাও জানি। আমি সব ঠিক করে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার দরকার নেই। তোর এখন শুধু একটাই কাজ,
কথা শেষ না হতেই খালা জিজ্ঞেস করলো, – কিভাবে জানেন?? আমি তো বলিনাই,আপনিও ছিলেন না ওখানে।
আব্বু হেসে বললো, আমার জানা লাগেনা, সব জানা হয়ে যায়। ওখানে আমার কলিগ ছিলো কয়েকজন। তারাই বললো।
খালা কিচ্ছুক্ষন চুপ থেকে শেষমেশ আর না পেরে কেঁদেই দিলো।
আব্বু গম্ভীর গলায় বললো,
– কাঁদার কিছু নেই। রাকার বিষয়টা মিটমাট হওয়া অব্ধি তুই আমার বাসাতেই থাকবি। এটা আমি খালাকে বলে দিয়েছি কিছুক্ষন আগে।
খালা এবার চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করলো,
– সব ঠিক করে রেখেছেন আপনি! কখন করলেন এসব! আপনি কি সত্যি সত্যিই ওকে পাঠিয়ে দিবেন নাকি?
– হুম। আর কোনো উপায় নাই। ওর দেখাশোনা আমি করতে পারবো না। আমি বিয়েও করবো না যে ওর দেখাশোনা ওর নতুন মা করবে। তাছাড়া ওর রক্তে অনুর রক্ত মিশে আছে। এই মেয়েও আমাকে আঘাত দিবে। আম্মা তো রোজই বলতেছে। আমার বুকের ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে ইদানিং। রাকা কিছু করে বসলে সেই ধাক্কা আমি আর সামলাতে পারবো না। তুই আর কোনো কথা বাড়াইস না রিমা। ভুলে যাস না, এই মেয়েটা আমার কলিজা। ওকে এভাবে পাঠিয়ে দিতে আমার ও ইচ্ছা করেনা। কিন্তু উপায় নাই। তাছাড়া আম্মার কথা..
খালা তড়িৎ গতিতে বললো,
– কিন্তু অনু আপা তো ওকে দেখবেনা!
– অনু যেমনই হোক, ও রাকার মা, আমি না থাকলে অবশ্যই সে নিজের মেয়েকে দেখেশুনে রাখবে। তানিশা কিন্তু ওর মা যতদিন ছিলো ততদিন কোনো বেহায়াপনা করেনি। যখনই মা চলে গেলো,তখনই মেয়েটা বখে গেলো। সব আমার দোষ। আমি আর রিস্ক নিবো না।
– আপনি এসব কি বলতেছেন! সব উল্টা বুঝতেছেন কেন? অবুঝের মত কথা বলেন কেন? তানিশার বখে যাওয়ার পিছনে তো আপারই অবদান! মেয়ে তো এসব নিজের মাকে দেখে দেখেই শিখছিলো!
আব্বু খালাকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলে বললো। ক্রুদ্ধ গলায় বললো, সকালে উঠতে হবে। তুই এক্ষুনি চলে যা রুম থেকে।
খালা গলা পরিষ্কার করে আবার বলতে গেলে আব্বু রক্তলাল চোখে তাকিয়ে নির্দেশনা দিলো, চলে যাওয়ার। তাই খালা বাধ্য হয়েই চলে আসার জন্য উদ্যত হয়।
★
আমি আমার রুমে এসে বসে আছি আর
ভাবছি নানানরকমের ভয়ংকর সব কাহিনী।
খালাকে হয়তো এতক্ষনে আব্বুর বোঝানো শেষ! খালা এখন আসবে আমার রুমে। আদর-সোহাগভরা মুখে বোঝাবে, আমি আমার মায়ের কাছে থাকলেই ভালো হবে… এই… সেই…
আমার ভালো শুধু তারাই বোঝে।
আমি বুঝতেও চাইলেও অনুচিত।
কিছু বললে যে আগ্রাহ্য হবে না, তা বেশ ভালো করেই জানি।
আমি তো কিছুতেই যেতে চাইনা ওখানে!
ওখানে অনু চৌধুরীর মত একটা মহিলা ছাড়াও আজমল উদ্দীনের মত একটা খারাপ লোক ও আছে। ওখানে আমি কিভাবে থাকবো!
কোথায় সেই জায়গা?
আমার তো এখানেই সব কিছু!
আমার স্কুল, আমার গুটিকয়েক বন্ধু-বান্ধব, আমার বাসা, আমার গাছ, আমার বারান্দা, আমার ছাদ..
সবচেয়ে বড় কথা আমার আব্বু, সেও তো এখানেই!!
আর আমার আপন স্যার!
সামনে আমার প্রথম সাময়িক পরীক্ষা, দু সপ্তাহ পর বিজ্ঞানমেলায় আমার প্রজেক্ট ডিসপ্লের ডেট, বার্ষিক প্রতিযোগিতায় আমার গান আর রচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য আপন স্যারের উৎসাহ, আমার প্রাইস পাওয়ার স্মৃতি…. সব তো এখানেই হয়! এখানেই হবে! এই সবকিছু ছেড়ে আমি চলে যাবো? এসব ভাবতেই আমার মাথা ঘুরে গেলো।
আমি কি একবার আব্বুকে গিয়ে অনুরোধ করে দেখবো? যেন আমাকে এখান থেকে না সরিয়ে দেয়! নাহ্। আমি নিশ্চিত!
আব্বুও এই সবকিছু জানে!
কখনোই আমাকে আমার আব্বু ওখানে পাঠাবে না!
আমার কোনোকিছুই কখনো সে কেড়ে নেয় নি, আমার কোনো চাওয়াই সে আজ পর্যন্ত অপূর্ণ রাখেনি।
সেখানে সে আমার সবকিছু, আমার সব আনন্দ কেড়ে নিবে?
এটা হতেই পারেনা।
আমি নিশ্চিন্তে পড়তে বসে গেলাম।
অজানা কারণে পড়তে ইচ্ছা করছেনা।
মনে হচ্ছে যেন বুকের ভেতরে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।
খালা আমার রুমে এসে বললো,
– মা, আয় তো এখানে। কিছু কথা বলবো তোকে।
আমি খালার কাছে গেলাম।
খালা আমার চুলে বিলি কেটে জিজ্ঞেস করলো,
– তোর আম্মুর কথা মনে পড়ে তোর?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, পড়ে।
খালা ঢোক গিলে আবার জিজ্ঞেস করলো,
– একবার গিয়ে দেখে আসবি মাকে? অনেকদিন তো দেখিস না।
খালা আমাকে এখনো আমার বয়সী বাচ্চা মনে করে,সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
সে কথা ঘুরাচ্ছে। অথচ আমি সবই জানি।
সে ইনিয়েবিনিয়ে বলতে চাচ্ছে,
“তোকে তোর মায়ের কাছে সারাজীবনের জন্য দিয়ে আসা হবে। সব গুছিয়ে নে। আগামীকালই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।”
(চলবে)