রাকা-৩২ শেষ অংশ

0
1984

রাকা-৩২ শেষ অংশ
ফারজানা রহমান তৃনা

খালার সাথে আমার বেশিক্ষন কথা হলো না এই নিয়ে। এই বিষয় টপকে আমরা আবার আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়েই আলোচনা করে সেরে ঘুমোতে চলে গেলাম সে যাত্রায়।
আমার মনের অশান্তিটা তখন ও ছিলোনা, আসেই নি! কারণ আমার মনে একটাই ভরসার চিন্তা বাসা বেঁধেছিলো তখন, আমার আব্বু আমার সাথে কখনোই এই অন্যায় করবে না।


অনু চৌধুরী সকালে ঘুম থেকে উঠেন অনেক বেলা করে। যেখানে আজমল উদ্দীন উঠে বসে থাকেন সকাল সাতটার আগে-পরে। বাড়িতে আসার আগে যখন বাসায় ছিলো তখন বাইরে গিয়ে, গাড়ি চালানোর সময় সামান্য নেশাটেশা করে আসতো বলে বেলা করেই উঠতো অনু চৌধুরীর সাথে সাথে। কিন্তু এখন তো সেই সুযোগ নেই।
বাড়িতে এখন বড় ভাই,মেঝো ভাই,দুই বউ আছে..

ঘুম থেকে উঠেছেন অনু চৌধুরী। পাশে কেউ নেই।
আজমল উদ্দীন ইরাকে নিয়েই কোথাও গেছে, কারণ ঘুম থেকে উঠে কাউকেই পাশে দেখতে পাচ্ছেনা সে। মুখ ধুতে গিয়ে স্পষ্ট শুনতে পেলো, একটা বাচ্চা ছেলের আওয়াজ।
অনু চৌধুরী মুখ,হাত ধুঁয়ে আওয়াজের উৎস খুঁজে বের করেই সেদিকে হম্বিথম্বি হয়ে চলে যান। গিয়ে দেখলেন,শাহানা বেগমের ঘর থেকেই ঐ বাচ্চা ছেলের আওয়াজ আসছে।

দরজা আলতোভাবে ধরতেই খ্যাঁক করে খুলে গেলো,অনেক দিনের পুরোনো কাঠের দরজা বলেই অমন ভারী শব্দ।
গিয়ে দেখলেন,শাহানা বেগমের কোলে ইরা আর আজমল উদ্দীনের কোলজুড়ে বসে আছে একটা ৪/৫ বছরের মিষ্টি,বাচ্চা ছেলে।
এই দৃশ্য দেখে অনু চৌধুরীর চক্ষু চড়কগাছ!
সে গলা ভারী করে ক্যাঁচক্যাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– এই পোলা ক্যাডা? ওই ইরার বাপ? এই পোলারে সকাল সকাল বাড়ির মইধ্যে আইন্যা নাটক করে ক্যাঁ আপনার বড় বিবি? কাজ কাম নাই? ঢং খালি।

আজমল উদ্দীন উত্তর দিলেন,
– না ঢং না অনু। এখানে ঢং দেখো কোথায়? এই ছেলে শাহানার।

অনু চৌধুরী ভুরু কুঁচকে বললো,
– শাহানার মানে? অয় না বন্ধ্যা? বাচ্চা পাইলো কই?

আজমল উদ্দীন একরাশ হাসি চোখ-মুখে ফুটিয়ে তুলে বললেন,
– এই বাচ্চাটা আমার বড় বিবির দত্তকপুত্র অনু। সুন্দর হইছে না দেখতে? এই বাচ্চার বাবা-মা দুজনেই রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে কিছুদিন আগে। তাই বাচ্চাটা একটু ভয় পেয়ে আছে। এই ছাড়া বাদবাকি সবই ঠিক আছে একদম। আর শাহানাকেও পছন্দ হইছে ওর।

ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝুঁকে চুমো দিয়ে আজমল উদ্দীন বললেন,
বাবা তোমার নামটা বলোতো এই আন্টিকে?
ছেলেটা আধো আধো স্বরে টেনে বললো,
তা-মি-ম।

অনু চৌধুরীর গা জ্বলে যাচ্ছে এইসব আদিখ্যেতা দেখে।
সে খপ করে শাহানা বেগমের কোল থেকে ইরাকে তুলে নিয়ে বললো,
– অন্যের রক্তকে নিজের মনে করলেই ওইডা নিজের হয়ে যায়না,অন্যের ই হয়। কথাটা মাথায় রাইখ্যেন। বাচ্চা ভাড়া কইর‍্যা আনছে।
বলে হাসতে হাসতে চলে গেলেন।

শাহানা বেগম হাসি মুখেই তাকিয়ে রইলেন।
সে তামিমকে পেয়ে এতটাই খুশি যে কারো কোনো কটুক্তি ও তার এখন কানে যাচ্ছে না।
তামিম নামের ছেলেটাও কিছুক্ষন পর পরই তার দিকে তাকিয়ে আম্মু,আম্মু বলে ডাকে ।
আল্লাহর অশেষ কৃপা। কে জানে হয়তো ছেলেটার আসল আম্মুর চেহারার সাথে মিল আছে শাহানা বেগমের। অথবা এই মাসুম বাচ্চা শাহানা বেগমের মুখের দিকে তাকালেই নিজের মাকে দেখতে পায়! নইলে আসামাত্রই এভাবে এরকম একটা বাপ-মা মরা বাচ্চা সামলিয়ে আনা দুষ্কর বৈ আরকি?

শাহানা বেগমের সাথে আজমল উদ্দীনের ভাব এখন আগের চেয়ে যেন আরো বেড়ে গেছে। ওদিকে নিজের এত সৌন্দর্য, নিজের বাচ্চা, এত এত টাকা দিয়েও সে তার এই স্বামীকে নিজের কাছে ধরে রাখতে অক্ষম।
ইরাকে খাইয়ে সে রান্নাবান্না সব ফেলে শুয়ে পড়লো।
ওদিকে শাহানা বেগম রান্না চাপিয়েছে,আজমল উদ্দীন ও তাকে সাহায্য করছে তাও সে বুঝতে পারছে। অথচ তার রান্নার সময় আজমল উদ্দীনকে সে তার ধারে কাছেও খুঁজে পায় না।
এসব আর তার সহ্য হচ্ছেনা।
দাঁতে দাঁত চেপে সব সয়ে যাচ্ছে।

তখন সকাল দশটা বেজে পনের মিনিট।

অনু চৌধুরীর ফোন বাজছে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফোন রিসিভ করতেই রেজা চৌধুরীর কণ্ঠস্বর পেয়ে কিছুটা শান্ত হলো।
– হ্যালো অনু?
– হ্যাঁ বলেন।
– তোমার ডিভোর্স পেপারে সাইন করার শর্তটা কি ছিলো?
– আপনার সাথে একবার দেখা করবো।
– আর কিছু?
– না।
– নিজের মেয়েটার কথা কি একবারো জানতে ইচ্ছা করেনা তোমার? ওর কথা তো জিজ্ঞেস ই করোনা তুমি! কেন বলো তো? রাকা আসলেই তোমার মেয়ে তো?
অনু চৌধুরী নাক কুঁচকে গ্রাম্য ভাষায় যাচ্ছেতাই রকমের কিছু গালি দিয়ে বললো,
– আপনার সন্দেহ থাকলে মেয়েরে গলা টিপ্পা মাইর‍্যা ফেলান। আমার কিচ্ছু হইবো না।

আব্বু বিষম খেয়ে বললো,
– উহুম। আমার কোনো সন্দেহ থাকলেও আমি বলবো,রাকা আমার ই মেয়ে। কারণ আমিই ওকে ছোট থেকে বড় করছি। এখন আমার মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে,অনেক বড় হয়ে গেছে।
– তাইলে তো ভালোই। এহন কিজন্যে ফোন দিছেন ওইডা বইল্যা ফেলেন।
– তোমার রাকার জন্য খারাপ লাগে? মেয়েটা এই বয়সে একা একা থাকে…
– লাগবোনা ক্যান,ওইডাতো শুধু আম্নের একার মাইয়্যা না,আমারো। এহন মাইয়্যার কপালে মা নাই,কিছু করার নাই। আর আল্লা দিলে যা চ্যাঁটাং চ্যাঁটাং কতা কয় আপনের এই ছোডো মাইয়্যা!

– স্পষ্টভাষী আরকি। আচ্ছা,আজকে তাহলে চলে আসো তাহলে। দেখা করি। তারপর আমার সামনে বসে আমাদের ডিভোর্স ফাইনাল করবে। কেমন?

– ঠিক আছে। কিন্তু আজকে আর পারমুনা। আজকে মন-মেজাজ ভালো নাই।

– কবে পারবা?
– আমি আপ্নারে জানামু।
– আচ্ছা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানাও। আমার তাড়া আছে।
– কিসের তাড়া? বিয়ে করবেন? আপনার ওই বইনডারে তাইনা?
– যাই করি,করবো,তোমার জানার বিষয় না। তবে যেদিন দেখা করবা ওইদিন তোমার জন্য একটা স্পেশাল সারপ্রাইজ আনা হবে।
– কি?
– ডেট ফাইনাল করে জানাও কবে ফাইনালি দেখা করবা। সেদিন নিজেই দেখবা কি সারপ্রাইজ।
– আচ্ছা। তবে আমি আপ্নারে একটা কথা কইতে চাই।
– বলো।
– আমারে আপনি আরো একটা মাস সময় দেন।
– কেন?
– এক মাস পরে দেখা করমুনে।
– এতবেশি সময় নেওয়া যাবেনা। সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ।
– ঠিক আছে।
– অনু…
– বলেন!
– এক মাস নিয়ে কি করতে চাইছিলা? তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে ওখানে?
– না… মানে… সমস্যা তো হয় ই!
মলিন কন্ঠে আবার ডাকলো, অনু…
– কি কইবেন কন না,বার বার অনু অনু বইল্যা থাইম্যা যান ক্যান?
চাপা স্বরে বললো,
– আরেক বার কি ভেবে দেখবে? আমি আবার সুখী হতে চাই তোমাদের নিয়ে।
– দেখা কইর‍্যা নেই,তারপর বাকিডা হইব্যো।

তাদের এই কথোপকথন আমার জন্য এক বিশাল আশীর্বাদস্বরুপ বার্তা বয়ে আনলো।
আমার আর যেতে হবেনা এখনই। যদিও আমি মনে মনে বিশ্বাসই করতাম না,আমার কখনো ওখানে যাওয়া লাগবে বলে।

খালা আমাদের সাথে এক সপ্তাহ কাটালো। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় আমি ফার্স্ট হলাম আবার। খালা আর আব্বু দুজনেই খুব খুশি।
বেদম খুশিতে ভেঙে পড়ে, রেজাল্ট জানাতে অনু চৌধুরীকে ফোন দিলাম।
সেদিন ভালো রেজাল্টের তাড়নায় অনু চৌধুরীর প্রতি সব রাগ ভুলে গেছিলাম। বললাম,
– হ্যালো আম্মু! কেমন আছো?

সে অবাক কণ্ঠে বললো,
– ভালোই আছি। তো,তুই? এতদিন পর তুই তোর মারে ফোন দিলি কি মনে কইর‍্যা?

– একটা গুড নিউজ দিতে ফোন করছি তোমাকে।

– কী কী?

আমি এক বুক আনন্দ নিয়ে বললাম,
– আম্মু আমি প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় ফার্স্ট হইছি!!

সে বিন্দুমাত্র উৎসাহ তো দিলোই না বরং বললো,
– ধুরো! এইডা জানানোর কি আছে! তোরে তো আমি আগেই বলছি,এইসব পড়াশোনা, ফার্স্ট- টার্স্ট দিয়া কিচ্ছু হয়না,হুদাই,এরচেয়ে তুই আমারে বল,তুই রান্না কয়ডা শিখছোস নতুন,কোনদিন তুই বাজার সদাই করছোস নিজে,কাপড় চোপড় ধুঁইতে পারোস। সবচেয়ে বড় কথা হইলো,কালা ছিলি, এহন কি একটুও ধলা হইছোস? ওইডি হইছে কামের কাম! এইসব তেনাতুনা টাইন্না কি কাম,হেই তো থালা বাসন ই মাজন লাগবো।

আমি শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
– তো তুমি চাও, আমি আর পড়াশোনা না করি?

– না কর,তোর যহন ইচ্ছা আছে। ম্যাট্রিকটা দে। এদ্দুরেই সারবো, এরপর তোর বাপরে বইল্যা বিয়ের কামডা সাইর‍্যা ফেললেই হইবো। শুন,রাকা,আবার নিজের বড় বইনডার মত আকাম-কুকাম করিস না,দেহিস! ভালো ঘরে বিয়া দিমু তোরে।

এক মাস পর…

আমার জীবনে পর পর কয়েকটা দুর্ঘটনার অধ্যায় রচিত হয়ে যায়।
আপন স্যার আমার স্কুল থেকে বদলি হয়ে যায়,আচমকা! ফলপ্রসূ, স্যারের কাছে আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।
অন্যদিকে আব্বু আর অনু চৌধুরীর দেখা করার দিন ক্রমশ এগিয়ে আসতে শুরু করলো।
অত:পর একদিন অনু চৌধুরী ফোন দিয়েই ফেললেন!

তাদের মধ্যে সব কথার অন্তিম শেষে আব্বু আমার কাছে এসে একদিন মাথা নিচু করে জানালো,
– মা! রাকা মা! তুমি তোমার প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে নাও। আজ তোমাকে তোমার আম্মুর কাছে রেখে আসবো। তুমি ওখানে ভালোই থাকবে মা। তোমার আম্মু তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। তুমি চাইলে মাঝেমধ্যে আমার সাথে দেখা করতে আসতে পারবা। তবে থেকে যাওয়ার জন্য আর আসতে পারবা না। তোমাকে ওখানেই বাকি দিনগুলো কাটাতে হবে। তবে তুমি চিন্তা করোনা মা, কোনোপ্রকার সমস্যা হলেই তুমি আব্বুকে জানাবে, আমি তোমাকে তৎক্ষণাৎ নিয়ে আসবো বা অন্য কোনো ব্যবস্থা করবো।

তখন আমার হাতের ফোনটাও নষ্ট।
বিপদ আসলে চারদিক থেকেই আসে।
আপন স্যারকে বা খালাকে যে ফোন করে জানাবো তার ও কোনো রাস্তা খোলা রইলো না। খালা তো খালার ভাইয়ের বাসাতেই অবস্থান করছে আর আপন স্যার এখন অনেক দূরে লজিং টিচার হিসেবে আছে।
আমার একটা ফোনেই সব পাল্টে যেতে পারে! কিন্তু তখনই আমার ফোনটা ঠিক ছিলো না।
ভালো দেখে কিনবো করে করে আর কেনাই হয়ে উঠেনি,তাছাড়া আমার এখন ফোনে তেমন কিছু করাও লাগেনা। দিনরাত মিলিয়ে ৯/১০ঘন্টা আমি পড়াশোনাতেই কাটিয়ে দেই,বাকি সময়ে স্কুল,বাসার কাজকর্ম। বাসার টুকটাক সব কাজকর্মই আমি করি। নিজেই শিখে নিয়েছি। খালাও খুব যত্ন করে শিখিয়ে
দিয়ে গেছে কিভাবে কোনটা রান্না করতে হয়। আমার রান্নার নোটবুক ও আছে এখন। সব রিমা খালার অবদান। আমার জীবনের একটি সুখী অধ্যায় সে।

আমি বাধ্য হয়ে মনে চাপা কষ্ট পুষে রেখেই সব গুছাতে লাগলাম।
মাঝখানে একবার গিয়ে আব্বুকে বললাম,
– আব্বু একটু ফোনটা দিবা?
আব্বু জিজ্ঞেস করলো,কেন?

আমি বললাম, আমার ফোনটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই একটু দরকার ছিলো।

আব্বু গম্ভীর গলায় বললো,
– সমস্যা না। যাওয়ার সময় তোমাকে একটা নতুন ফোন কিনে দিবো। তুমি এখন কি কি নিবা তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও। তারপর আমার কাছে এসে একটু বসো।

আমি বললাম,
– কেন আব্বু? আমাকে আম্মুর কাছে রেখে আসবে সারাজীবনের জন্য, তাই?

আব্বু এক বুক শূণ্যতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। আব্বুর চোখে জলেরা ভীড় করতেই সে অন্যদিকে ফিরে গেলো। ওদিকে ফিরেই বললো,
– যাও, যা করতে বললাম করো।
তাড়াতাড়ি আমার কাছে আসো সব গুছিয়ে।

আমি নিঃশব্দে শ্বাস তুলে বললাম,
– আমার গোছাতে বেশিক্ষন লাগবে না। আর লাগলেও লাগাবোনা,প্রয়োজন হলে গোছাবো না।

আব্বু জিজ্ঞেস করলো, কেন?

আমি মলিন মুখ করে বললাম,
– কারণ আমার হাতে এখন সময় খুব কম! আব্বু, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, তোমার কাছ থেকে আমি অনেক দূরে চলে যাবো কিছুক্ষন পর,আর কখনো দেখা হবেনা তোমার সাথে আমার! তাই এই শেষ মুহূর্তটুকু আমি তোমার কোলে শুয়ে থাকতে চাই। শুবো আব্বু?

আব্বু করুন চোখে বললো,
– নাহ্! কি সব আবোলতাবোল বলো তুমি! আসো,শোও।

আমি আব্বুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। আব্বু হেঁচকি তুলে কাঁদছে। তার হাঁপানির সমস্যা আছে, এছাড়াও আছে নানান ব্যাধি। সে প্রাণপণে চাচ্ছে, কান্নাটা গোপনে সারতে, কিন্তু কিছুতেই সংবরণ করতে পারছে। তার চোখের জলের প্রত্যেকটা ফোঁটা আমার গালে, কপালে এসে পড়ছে। আমি সেসব সরাচ্ছি না।
সরাবো ও না। আব্বুকে তো সাথে করে নিয়ে যেতে পারবো না। আব্বুর চোখের জল তো নিয়ে যেতে পারছি! ওগুলো যেখানে যেখানে পড়ছে,ওখানেই শুকিয়ে যাক।
আজীবন আব্বুর স্মৃতিফলক হিসেবে লেগে থাকুক।

আমি কিন্তু কাঁদছিনা।
একটুও কাঁদছিনা!
তবে মনের ভিতর যুদ্ধ বেঁধে গেছে। চোখজোড়া রক্তজবার ন্যায় লাল হয়ে গেছে। আমার ও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! কিন্তু আমার জলকান্না আসছে না,আমার কান্না রক্তলাল!

মনে মনে ভাবছি,
যদি আম্মু আমায় ভালো না বাসে তখন কি হবে? আচ্ছা দাদি কি আমায় রাখবে? উহুম! দাদিও তো আমায় ভালোবাসেনা! কোনোদিন রাকা* বলে ডাকে ও নি! আদর ই তো করেনা দাদি!
আচ্ছা আমার বড় আর মেঝো ফুফি? তারা রাখবে তো? উহুম!
তারা তো যোগাযোগই বন্ধ করে দিয়েছে!

রিমা খালা? উহুম! তাও হবেনা! সে তো নিজেই কোনোমতে মাথার উপরের ছাদটা নিশ্চিত করে দিন পার করছে, আমাকে রাখবে কোথায়?

আচ্ছা,আপন স্যার?

উহুম!
সমাজ বলবে, দুশ্চরিত্রা! অল্প বয়সেই এরকম দুর্নামগ্রস্ত হওয়ার স্বাদ নেই! তাছাড়া এরকম কিছু মাথায়ও আনা যাবেনা! আনিনি,তবুও আব্বু আমায় তার কাছে রাখার সাহস পাচ্ছেনা,সেখানে আনলে কি হবে?

তাই,আপন স্যার,আমার আপন স্যারের কোনো সাহায্য আমি নিবো না।
আমি একদিন কড়ায়গণ্ডায় বুঝিয়ে দিবো আমার আব্বু এবং এই কলুষিত সমাজকে, আমাদের রক্ত এক, কিন্তু মানুষ হিসেবে এক নয়!

বেশ তো বেশ!
আমি আমার আম্মুর কাছে গিয়েই না হয় থাকবো! একটু কষ্ট হবে, তবে মানিয়ে গুছিয়ে নিবো।
ভালো থাকুক সবাই।
আব্বু, আপন স্যার, রিমা খালা এবং আমার জীবনের গল্পের প্রত্যেকটি চরিত্র।
আশা করছি আমিও ভালো থাকবো!


কিন্তু আমি এখানে, আমার আম্মুর কাছে এতটাই ভালো আছি যে আমার কাছে এখন আমার জীবনের প্রত্যেকটা দিন এক বছর মনে হয়!
মনে হয়, এই আলিশান পৃথিবী বড়ই নির্মম,নিষ্ঠুর! কাউকে দিয়েছে অঢেল ভালোবাসা,কাউকে দিয়েছে মৃত্যু!

(সমাপ্ত)

শেষ কথা, রাকার জীবনের সত্য অংশের অধ্যায় শেষ। আজকের এই পর্বের পর আমি রাকার বর্তমান জীবন নিয়ে ছোটখাটো কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো,দ্বিতীয় খন্ড কেমন হবে তা বোঝাতে, যদি কমেন্টে ভালো সাড়া পাই।

বি:দ্র:- দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমি রাকার জীবনের সব না পাওয়া,ব্যর্থতা,কষ্টগুলো গুছিয়ে আনন্দঘন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ! আমি রাকার জীবন গুছিয়ে দিলেও বাস্তবের রাকার জীবন হয়তো আমার কল্পনার মত ওভাবে গুছাবে না কোনোদিন।
সবাই দোয়া রাখবেন!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here