রাকা-৫

0
863

রাকা-৫
ফারজানা রহমান তৃনা

ক্লাস ফাইভের এক্সাম শেষ হওয়ার পর পরই আম্মুর নির্মমতা ক্রমশ বেড়ে যায়। কারণে অকারণে রেগে যেত শুধু। তখন তো আগের চেয়েও বেশি তার রাগের দহন।
ভালো কথা জিজ্ঞেস করলেও রেগে যেত, খারাপ কথা বললে তো বলাই বাহুল্য।
মানে তার সামনা-সামনি কিংবা তার ধারে-কাছে কোথাও আমি বা আমরা না ঘেষলেই সে খুশি।
আর আপু তো আপুর মতই থাকে।
বাসায় এখন আর থাকেই না।
ওর অনেক বন্ধু-বান্ধব হয়েছে।
দিন-রাত আড্ডাবাজি,এটা ওটা করে বেড়ায়।
এক কথায় সে থাকে তার মত।
তাই আম্মুর এই আচরণগুলো তার সহ্যই করতে হয়না। পারিবারিক কোনো আলোচনাতেও সে শামিল হয়না।
সে পারিবারিক সবকিছুতেই উদাসীন।

একদিন আমি সকালে ঘুম থেকে উঠেই বায়না করলাম, আজকে নুডুলস খাবো। আর খাবো চিকেন রোল। কারণ আমাদের বাসায় নাস্তা বানানোর হার এখন একেবারে নেই বললেই চলে।
অনেক ইনিয়েবিনিয়ে যখন কথাটা বললাম, আম্মু তখন ও রেগে অস্থির।
আমি খেতে চাইছি কেন এর জন্য আমাকে সারা সকাল-দুপুর নানান ধরণের কথা শোনালো।
ফলপ্রসূ, না খাওয়া হলো নাস্তা। না পেলাম ভাত। কথা শুনেই পেট ভরে গেলো।
আপু সেদিন বাসায় ছিলো।
আমার তখন এক্সাম শেষ হয়েছে কেবল।
তাই তখন আমার কত কি খেতে,করতে ইচ্ছা করতো। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি।

পাশের বাসার আন্টি, রাহেলা আন্টি, আমাকে খুব আদর করে।
আন্টি সেদিন আচমকা বাসায় আসেন।
হাতে এক প্লেট কাচ্চি বিরিয়ানী।
আমাকে ডেকে নিয়ে প্লেটটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
” তানিশা আর তুমি খেয়ো মা। আজকে মেহমানদের জন্য রেঁধেছিলাম তো, তাই ভাবলাম তোমাদের ও একটু দিয়ে যাই। তোমরা তো খুব পছন্দ করো কাচ্চি। খেয়ে অবশ্যই জানাবা। হ্যাঁ? ”
সারা সকাল থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত খালি পেটে পড়ে থাকা যেন তখন স্বার্থক হয়ে গেছিলো।
মনে হচ্ছিলো, যাক! সবুরে মেওয়া ফলে!

আম্মু রাহেলা আন্টির সাথে তেমন একটা কথা বলে না। তাই আন্টি আসছে এটা বুঝেও এদিকে আসেনি, একটু কথা বলার জন্য।
তবে যখন আন্টি আমার সাথে কথা বলছিলো, তখন কান খাড়া করে শুনছিলো। আমি রান্নাঘরে গিয়ে প্লেট রেখে,ঢাকনা দিয়ে এসে তাড়াতাড়ি গোসল, নামাজ সারতে যাই।
আপু সকালেই ভাত খেয়ে নিয়েছিলো।
তাই এখন ঘুমাচ্ছে।
গোসল সেরে এসে নামাজ পড়া শেষ করলাম।
তারপর আপুকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললাম,
– আপু আয়, কাচ্চি খাবি।
বলেই দৌঁড় দিয়ে রান্নারুমের দিকে চলে যাই।

কিন্তু কি আশ্চর্য!
ওখানে গিয়ে প্লেটটা আর দেখলাম না।
অনেকক্ষন খুঁজে ও না পেয়ে হতাশ হয়ে যখন ডায়নিং’এ আসলাম, তখন দেখলাম আম্মু পায়ের উপর পা তুলে ঐ প্লেটের কাচ্চি বিরিয়ানীগুলো খাচ্ছে।
প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখি, আর বেশি নেই ও।খাওয়া প্রায় শেষের পথে।
আমাদের ডায়নিং রুম থেকে ড্রয়িংরুমের টিভি দেখা যায়। আম্মু চোখ বড় বড় করে সিরিয়াল দেখছে আর গোগ্রাসে খাচ্ছে।

আমি ব্যাপারটা সহ্য করতে পারলাম না ঠিক। সকালে সামান্য নুডুলস, রোল খেতে চাইলাম। দিলো না। সারা সকাল-দুপুর বকলো।
কিসব আজেবাজে কথা শুনলাম সামান্য খাওয়ার আবদার করায়। নিজের মায়ের কাছেও খাওয়ার আবদার করা যাবেনা। নিজের মায়ের কাছাকাছি বেশিক্ষন থাকতে নেই- আমার মধ্যে তখন এরকম ধ্যান ধারণাই সৃষ্টি হয়েছিলো।
স্কুলে গেলে দেখতাম, মোটামুটি সবার মায়েরাই বাইরে বসে অপেক্ষা করতো, কখন আমাদের ব্রেক আওয়ার হবে তার জন্য।
যখনই ঘন্টা দিতো তখনই সবাই ছুটে চলে যেত যার যার মায়ের কাছে।
তারা আদর করে টিফিন খাইয়ে দিত ওদের।
তাকিয়ে থাকতাম ওদের দিকে।
এসব দেখতেই ভালো লাগতো।
আমার আম্মুও আসতো কোনো-এক-সময়।
এই ক্লাস ওয়ান, টু তে থাকা-কালীন।
কিন্তু এখন কেন যেন আর আসেনা।

একদিন একজন বান্ধবীর মা এসে আমার হাতে জেলি মাখানো একটা ব্রেড দিয়ে বলেছিলো,
– তোমার নাম রাকা না? নাও এইটা খাও। আর এখান থেকে চলে যাও। ঐ যে ওখানে যাও।
আমি জিজ্ঞেস করছিলাম,
– হুম। আমার নাম রাকা। ওখানে যাবো কেন আন্টি? ওটাতো ক্লাস ফাইভের আপুদের বসার জায়গা।
তখন উনি ঠোঁট চেপে বলেছিলেন,
– তুমি এইভাবে তাকিয়ে থাকো কেন? আমার বাচ্চার পেট ব্যাথা হবে তো। তোমার আম্মু তোমাকে খাওয়ায় না নাকি? যেটা খেতে ইচ্ছা করে ওটা মাকে গিয়ে বলবা। এভাবে কারো দিকে তাকিয়ে থাকবা না।

আমি আর কিছু বলতে পারিনি।
সোজা ক্যান্টিনে এসে হাতের ব্রেডটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে টেবিলের উপর দু হাত রেখে, তার উপর মাথা রেখে বসেছিলাম। মনে মনে বলছিলাম,
” আমার আম্মু কেন আমার জন্য টিফিন নিয়ে আসেনা? টিফিন দিয়েও দেয়না। প্রতিদিন ১০/১৫টাকা দেয় টিফিনে জন্য। প্রতিদিন একটা ব্রেড আর কলা খেতে হয়। কোনোদিন বা খেতে হয় ক্যান্টিনের সিঙ্গারা,পুরি। কেন? ”
যাক সেসব এখন আর মনে হয়না।
এখন অনেক বড় হয়ে গেছি!

সেদিন সারা সকাল, দুপুর পেরিয়ে তখন বেলা তিনটার বেশি বাজে। তখন ভাবলাম একটু খাবো। আম্মুতো কিছুই বানায়ে দেয়নি। দিবেনা এটাও জানি। কিন্তু আমার বিরিয়ানীর ও প্রায় সবটাই সে খেয়ে নিয়েছে। আর মাত্র এক মুঠোর সমান পড়ে আছে থালায়। আম্মুর খাওয়া দেখে মনে হচ্ছেনা, সে এক চামচ ও টেস্ট করার সুযোগ দিবে বলে।

আপুকে ডেকে এসেছিলাম তাই ও মাত্রই পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে এই বিষয়টা খেয়াল করলো।
সে এটা দেখেই জিজ্ঞেস করে ফেললো,
– ওমা আম্মু! এইটা তো নাকি রাহেলা আন্টি রাকাকে দিয়ে গেছে! তুমি যে খেয়ে ফেললা?

আম্মু চিবানো বন্ধ করে খাওয়া মুখে নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললো,
– রাকাকে দিছে মানে? আমার বাসায় দিয়ে গেছে। তাই আমার ইচ্ছা করলে আমি খাবো। আর মহারাণী আমার রান্না করা খাবার খাবেনা, অন্য ঘরের আন্টির রান্না দেখলেই খুশিতে লকলক করবে! ক্যান? আমি কি ঘরে রান্নাবান্না করিনা নাকি? ঘরের রান্না খায়না ক্যান? যা দিবো তাই খেতে হবে। বলে দে।

আপু বললো,
– ও তো রাগ করে সারা সকাল, এমনকি এখন পর্যন্ত কিছু খায়নি আম্মু। তুমি ওর জন্য কিছুতো রাখতে পারতে।

আম্মু চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
– ঐ তুই আমাকে শাঁসাচ্ছিস? আমার খাওয়ার খোঁটা দিচ্ছিস? তারে বল ভাত খেয়ে নিতে। তোর যখন এতই দরদ। যত্তসব ঢং।
তানিশা আপু বললো,
– আম্মু তুমি ডাল আর ঝাল দিয়ে শুটকি বিরান করছো। এগুলো ও খেতে পারেনা। এজন্যই তো এতক্ষন না খেয়ে বসে ছিলো।
আম্মু বললো,
– তাইলে মহারাণীরে ফ্রিজ থেকে ডিম নিয়া ভাইজ্যা খেতে বল। খাক উনি। সবাই যেডা খায়, ঐডা তো মহারাণীর মুখে রোচে না। এইডারে বিয়ে দিবো ক্যাম্নে?
আপু বলে,
– ও ডিম ভাজি করতে পারে নাকি?
আম্মু নাক টেনে বলে,
– আরে করতে দে তো ওরে। দুই একদিন গায়ে তেলের ছিটা পড়ুক। এরপর দেখবি কয়দিন হাত পুইড়্যা ট্যুইড়া আমনা-আমনিই শিইখ্যা যাইবো।

আমার কাচ্চি বিরিয়ানী খুব প্রিয়।
তার উপর সকাল থেকে কিচ্ছু খাওয়া হয়নি। পেটের ভেতরটা যেন জ্বলে যাচ্ছে।
মেঘের ডাকের মত আওয়াজ করছে।
ক্ষিধায় আমার সব জ্বলে যাচ্ছে যেন।
তাই না চাইতেও কান্না চলে আসলো।
আমি হেঁচকি তুলে কেঁদেই দিলাম।
আম্মুর সেদিকে বিন্দুমাত্র ও ভ্রুক্ষেপ নেই।
সিরিয়ালের ছোট মেয়েটাকে আজ অন্যায়ভাবে মেরে ফেলা হবে- ওটা এখন আম্মুর দেখার বিষয়।
ততক্ষনে প্লেটের সব কাচ্চি শেষ অবশ্য।
তাই এখন সিরিয়ালে মনোযোগ বেশি।

তানিশা আপু এই প্রথম আমার পক্ষে কিছু বললো। তার পিছনে অবশ্য একটা কারণ আছে। আপুর ও কাচ্চি খুব পছন্দ। আর রাহেলা আন্টির কাচ্চি হলে তো কথাই নাই। অনবদ্য স্বাদ। আম্মুর জন্য সে ও একটু চেখে দেখতে পারেনি।
আপু আমার কান্না দেখে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
– ডিমের রোল খাবি? আয়। ডিমের রোল আর ডিম,মরিচ,পেয়াজ দিয়ে তোকে ডিম-বিরিয়ানী বানিয়ে দেই। খুব মজার!

আমি কিছু বললাম না।
আপুর পিছনে পিছনে গেলাম।
আপু দুইটা রুটি বানিয়ে তার ভেতরে ডিমের পুর দিয়ে ওটা ভাজ করে মাইক্রোওভেনে রেখে আবার বের করে নিলো। তারপর কিছু ভাত একটা কড়াইয়ে নিয়ে তেল,মরিচ,পেয়াজ,লবণ দিয়ে ভেজে দিলো।

সুন্দর করে পরিবেশন করে সোজা আমাদের রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
আপু আর আমি মিলে খেলাম।
কাচ্চির জন্য আর আফসোস লাগলো না।
ভাত-ভাজাটাই দারুন ছিলো।
কি জানি, হয়তো অতিরিক্ত ক্ষুধায় অখাদ্যও অমৃত লেগেছিলো তখন!
তারপর ভাবলাম, থাক, আমার আম্মুই তো খেয়েছে।
আর কেউ না তো।

আপন স্যার তখনো আসতো।
ক্লাস সিক্সের ভর্তি পরীক্ষার জন্য আমাকে নানা টিপস দিতো। ভর্তি পরীক্ষার জন্য অনেক এক্সট্রা তথ্য জানা লাগে। কারণ পাঠ্য বইয়ের বাইরের কিছু কোয়েশ্চন ও আসে। ওগুলোই শিখাচ্ছিলো তখন।

কিন্তু আপন স্যারকে আম্মু দু – চোখে সহ্য করতে পারতো না। তার কারণ আগে জানতাম না। এখন বুঝেছি। এখন তো আমি একজন চল্লিশা বুড়ির চেয়েও বেশি বুঝি।

আম্মু সপ্তাহে ২/৩ বার বাইরে বেরোতো।
আগে আমাকে প্রতিনিয়ত নিতো।
এখন আমি যাইনা। জোর করলেও যাইনা। শুধুমাত্র আংকেলের সাথে দেখা করার প্রস্তাব দিতে আসলেই আম্মু আমাকে আদর করে কথা বলতো।
বলতো, চল রাকা। আজ আমরা বাইরে যাবো। অনেক কিছু খাবো। তোর ফেভারিট ডিশগুলো খাওয়াবো। তোকে অনেকগুলো টেডিও কিনে দিবো। তুই যা কিনতে চাইবি, তাই তাই কিনে দিবো!
সেদিন আমি আর লোভ সামলাতে পারলাম না।
সমাপনী পরীক্ষা শেষ করেছিলাম তখন।
আর কতদিন এভাবে ঘর বন্ধি থাকবো?
তাই গেলাম।

আংকেলে আসবে এরকম কিছু আমাকে বলা হয়নি। সেজন্যই মূলত যাওয়া। কিন্তু সি.এন.জি থেকে নামতেই দেখলাম, উনি একটু দূরেই হাসি হাসি মুখ নিয়ে, খুব পরিপাটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার আব্বু একটু কালো। কিন্তু এই লোক দেখতে একদম আমার আম্মুর মতই ফর্সা। লোকটার বেশভূষা ও অনেক স্মার্ট আর বড়লোকি ভাবসাব। চেহারায় কোনো চিন্তার বলিরেখা নেই যতটা আমার আব্বুর চেহারায় বিদ্যমান ।
এই লোকের ও থাকতো।
কিন্তু এই লোকের তো আমার আব্বুর মত দুই মেয়ে, বউ, সংসার আর এতগুলো ব্যবসা নেই যে চিন্তাটিন্তা করবে।
তাই সে দিব্যি বয়স ধরে রেখেছে।
যদিও তার বয়স আমার আব্বুর চেয়েও বেশি।

আমি আংকেলকে দেখেই দমে গেলাম।
হ্যাঁ, এখন এসেই আমাকে কোলে তুলে নিবে। কোলে তুলে শরীরের সব শক্তি দিয়ে ঝাপ্টে ধরবে। এত জোরে ধরে রাখবে যে আমার চোখে পানিও চলে আসবে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করে চিৎকার করে নেমে যাই।

আমি তখন ক্লাস ফাইভের এক্সাম দিয়ে ফেলেছি। সবকিছু না বুঝলেও কিছু কিছু জিনিস কিভাবে যেন বুঝে যেতে লাগলাম। বয়সের চেয়েও বেশি বুজুর্গ যাকে বলে তাই হবে হয়তো।
আমার আংকেলের কোল, আংকেলের আদর এখন আর একদমই ভালো লাগে না। অসহ্য লাগে। সে আমাকে ধরলেও আমার বিরক্ত লাগে।
ইচ্ছা করে ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেই।
ঐদিন আংকেলের কোলে বেশিক্ষন থাকতে হলো না। সে নিজেই নামিয়ে দিয়েছিলো। আমি ইচ্ছা করেই ভার ভার করে বসেছিলাম, যাতে তার হাত ব্যাথা হয়ে যায়। আমাকে যেন নামিয়ে দেয়।
সেদিন মার্কেটে আর বেশি দেরী করা হয়নি।
এদিক-ওদিক ঘুরাঘুরি করে চলে আসলাম আমরা।

বাসে করে আসার সময় আম্মু আর আংকেল বসলো পিছনের সিটে। আর আমি বসলাম সামনের সিটে, একলা। আমার সাথে একজন বৃদ্ধ বসে ছিলেন।
কিছুক্ষন যেতেই উনি চলে গেলেন।
উনি চলে যাওয়ার পর হুট করে পেছন থেকে আংকেল আমাকে টেনে তুলে নিয়ে গেলেন তাদের সিটে।

কিন্তু উনি আমাকে সিটে বসালেন না।
বসালেন তার কোলে।
আমি বার বার সিটে বসতে চাইলাম।
বললাম, অল্প একটু জায়গা হলেই চলবে।
কিন্তু আংকেল বললো,
– না কেন! তুমি আমার কোলেই আরাম করে বসো মামণি। সমস্যা কী? আমি তোমার আংকেল না?
আমি তবুও রাজি হলাম না। ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগলাম।

আম্মু তখন আমার হাতে চাপ দিয়ে বললো চোখ বড় করে বললো,
– রাকা! বস তোর আংকেলের কোলে। তোকে খেয়ে ফেলবে নাকি ও? এত ঢং করিস কেন?

আমি আবারো না সূচকভাবে মাথা নাড়ালে আম্মু আমাকে থাপ্পড় দিতে উদ্যত হয়। তখন আংকেল আমাকে সামলে নেয়। তার কোলে আরো ঝাপ্টে ধরে বসে থাকে। আমার অস্বস্তিকর অবস্থা ক্রমশ বাড়তে থাকে। আংকেলে আমাকে এত জোরে কেন ঝাপ্টে ধরে আমি জানিনা। কিন্তু সেদিন তার হাত আস্তে আস্তে নড়াচড়া করতে ও আরম্ভ করে।
কখনো একদম উপরে উঠে যাচ্ছে কখনো বা একদম নিচে চলে যাচ্ছে।

আম্মু কি এসব দেখছে না? না! আম্মু তখন আংকেলের কাঁধে মাথা রেখে ঘুম ঘুম অভিনয় করছে। সে এসব দেখছে না।
দেখলেও সন্দেহ করার মত মনোভাব নেই।

আমি তার কোল থেকে যতই সাইডে গিয়ে বসি, সে ততই আরো চাপ দিয়ে বসায়।
আর না পেরে একসময় আমি তার হাত টান দিয়ে ছাড়িয়ে নেই। সে তখন আমার পিঠে চুমো দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– কী হলো মামণি? ভালো লাগছে না?
আমি চোখ বন্ধ করে সয়ে যাই।
আমার তার চুমোর ধরণ ও অস্বস্তিকর লাগছিলো। তার মুখের লালা,থুথুতে ভিজেই গেছিলো বোধ হয় পিঠটা। ভীষণ গা ঘিনঘিন করছিলো।

বুঝতেই পারছিলাম না সে এমন কেন করছে।
সেই প্রশ্নের উত্তর ও আমার জানা ছিলো না।
যদি জানতাম তাহলে হয়তো আম্মুকে বলে দিতাম, আম্মু আংকেল আমাকে… …
কিন্তু বলেও বা ফায়দা কি?
আম্মু তো এসব বিশ্বাস করবেনা কখনো।

কই আমার আব্বু যখন আমাকে চুমো দেয়, যখন আমি আমার আব্বুর কোলে বসে থাকি, তখন তো এরকম অস্বস্তি হয় না!
বাসে উঠলে তো আমি ইচ্ছা করেই বরং আব্বুর কোলে উঠে বসি। বাসাতেও আব্বুর কোলে বসেই সারাদিনের সব ঘটনা বলতে বলতে কখন যে ঘুমায়ে যাই তার হদিস ও পাই না।
এরকম ভাবতে ভাবতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাই।
আর অপেক্ষার প্রহর গুনি, কখন বাস থামবে। কখন আমরা বাসায় যাবো।

ঠিক তখনই দেখলাম, আপন স্যার বাসে উঠেছে। সে এগিয়ে আসছে এদিকেই।
তাকে দেখেই আমার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
এই তো সুযোগ!
আমাদের সামনের সিটের কাছার সিটটাই খালি পড়ে ছিলো। আপন স্যার এসে ওখানেই বসলো।
আমি টুপ করে আংকেলের হাত ছাড়িয়ে নিলাম। আংকেল আবার ধরতে নিচ্ছিলো। আমি শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে নেমে পড়ি তার কোল থেকে।
তারপর টুপ করে আপন স্যারের সামনে চলে যাই।

স্যার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
তাই আমাকে দেখতে পাচ্ছিলো না।
আমি তার পায়ে ধরে নাড়া দেই।
সে আমার দিকে তাকিয়ে হকচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– রাকা! তুমি এখানে! একা নাকি? তোমার আব্বু কোথায়?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here