রাকা (৬)
আপন স্যার আমাকে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। স্যার আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে আবারো জিজ্ঞেস করে,
– কী হয়েছে রাকা? তোমার সাথে আর কেউ নেই? একা কোথায় গেছিলা?
আমি কোনোরকমেই কিছু বলতে পারছি না। স্যারকে বললাম শুধু,
– আমাকে একটু আপনার সিটে জায়গা দিবেন?
স্যার উঠে গিয়ে বললো,
– কেন দিবোনা! বসে পড়ো।
এই কথাটা বলতেই সে যখন পেছনের সিটে চোখ নেয়, তখন হকচকিয়ে যায়।
হয়তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলো না।
আংকেল নামের ঐ ভয়াবহ লোকটা ও তখন আপন স্যারের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। আমি কেন হুট করে তার কোল থেলে উঠে গিয়ে আপন স্যারের কাছে গেলাম, সে সেটা বুঝতে পারেনি।
আপন স্যার দেখে খুব অবাক হলো,
আমার আম্মু একটা অন্য একটা পুরুষের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে।
স্যার কিছু না বলে আমাকে জানালার সাইডে বসালো। আর ঐ পাশের লোকটাকে অন্য সিটে ট্রান্সফার করে যখন নিজে সেখানে বসতে গেলো তখন আংকেল ডেকে বললো,
– এই যে মিস্টার, ওকে এইদিকে দিয়ে দিন তো। এই মেয়েটা আমাদের। জানিনা কেন ও পট করে আপনার কাছে চলে গেলো।
কথাটা আমার কানেও আসলো।
আপন স্যার কিছু একটা বলতে গিয়ে ও চেপে গেলো। আমার দিকে তাকালো কিছু শোনার আশায়। আমি কিছুই বলিনি। শুধু কাঁদো কাঁদো চেহারায় অসহায়ত্বের আভাস ফুঁটিয়ে তাকালাম তার দিকে।
সে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তখন আংকেলকে বললো,
– বাচ্চাটা আমার স্টুডেন্ট। আমার সাথে বসতে চাইছে যখন,বসুক না। সো, ওকে আমি চিনি। আচ্ছা,আপনার নাম কী?
আপন স্যার কথাগুলো বললো খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে যেন সে একটুও চমকায় নি।
কিন্তু লোকটা কথাগুলো শুনে মুখ শক্ত করে ফেললো।
কথার আওয়াজে উঠে গিয়ে যখন আম্মু দেখলো তার সামনে আপন স্যার দাঁড়িয়ে আছে, তখনই সে তৎক্ষণাৎ তার ওড়নাটা মুখের উপর দিয়ে দিলো। আপন স্যার আস্তে করে বললো,
– মিসেস অনু, আমি দেখেছি আপনাকে। এখন আর মুখ ঢেকে বা লুকিয়ে কোনো লাভ নেই। শুধু বলবো,সাবধান হয়ে যান।
আংকেলের দিকে তাকিয়ে স্যার আবার জিজ্ঞেস করলো,
– কই আপনার নাম বললেন না তো?
লোকটা কিছুক্ষন ইতিউতি তাকিয়ে উত্তর দিলো,
– আমার নাম যাই হোক, আপনাকে বলতে বাধ্য না।
আপন স্যার হেসে দিলো কথাটা শুনে।
মুখে হাসি রেখেই জিজ্ঞেস করলো,
– না, বলেন না। ক্ষতি কোথায়?
লোকটা তখন দাঁত-মুখ এক করে ক্রুদ্ধ গলায় জানালো,
– আপনি ওর টিচার, আমার না। আর আপনি আমার হাঁটুর বয়সী। বেশি কথা না বলে, বসে থাকেন।
স্যার আর কথা বাড়ালো না।
আমার পাশে বসে পড়লো।
আমাকে কিছুক্ষন এটা ওটা জিজ্ঞেস করলো। আমি কোনোমতে হ্যাঁ,হুঁ করেই উত্তর দিলাম। ইচ্ছা করছিলো না বেশি কথা বলতে। আংকেল যেভাবে ধরে ছিলো এতক্ষন, আমার তো শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
কথা বলবো কী করে!
কিন্তু স্যার আমার দিকে মিনিটে দুইবার করে তাকাচ্ছিলেন।
উনি হয়তো বুঝেছিলেন,
আমি কোনো একটা দুশ্চিন্তায় মহাচিন্তিত।
এজন্যই তো সারাক্ষন বক বক করতে থাকা মেয়েটাও এখন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।
এক ফাঁকে স্যার আমার দিকে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
– রাকা, এই লোকটার নাম কি? তুমি জানো?
আমি বললাম,
– হ্যাঁ। আজমল উদ্দীন।
স্যার উদাস কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
– লোকটা কি কিছু করতেছিলো নাকি তোমার সাথে? না মানে তুমি এভাবে উঠে আসলা যে তাই জিজ্ঞেস করলাম..
– স্যার লোকটা খুব অদ্ভুতভাবে আদর করে,কোলে নেয়। আমার ভালো লাগেনা উনাকে।
এই কথাটা বলার পর আর কোনো কথা বললো না উনি। একদম চুপ করে গেলেন।
বাস থেমেছে, বাসার মোড়েই নামায়।
স্যার আরেকটু পরে নামার কথা। কারণ উনার মেছ একটু সামনেই। কিন্তু উনিও আমাদের সাথে নেমে পড়লেন। আজমল উদ্দীন নামেনি।
শুধু আম্মু, স্যার আর আমি নামলাম।
আম্মু আমাকে না ধরেই সোজা হেঁটে চলে যাচ্ছিলো।
বিষয়টা দেখে স্যারই আমার হাত ধরে হাঁটছিলো।
আম্মু আমাকে ফেলে এভাবে চলে যাচ্ছে কেন, এইভেবে আমি তাকে জোরে ডাকলাম,
– আম্মু, আম্মু!
সে একবারের জন্যও ফিরে তাকালো না।
এত জোরে হাঁটছে যেন তার কোনো একটা জরুরি কাজের জন্য সময় ফেরিয়ে যাচ্ছে।
স্যার ও আমাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলেন। আম্মুর কাছাকাছি গিয়ে স্যার ধমকের স্বরেই বললেন,
– থামেন ম্যাডাম। থামেন। সমস্যা কী আপনার? ওকে সাথে নিচ্ছেন না কেন?
আম্মু থামলো এবার।
আম্মু থামতেই স্যার আমাকে ইশারা করলো আম্মুর হাত ধরতে।
ততক্ষনে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
চারপাশে আঁধার নেমে এসেছে।
চারপাশ থেকে কেবল কুকুরের ধ্বনি ভেসে আসছে। আজকের আকাশ সোনালী। আমাদের গলিটা একদম চিপায়। তাই এ রাস্তায় এই সময়ে হাঁটা খুব দুর্লভ। আমাদের বাসাটাও তাই ছিমছাম হয়েই থাকে। আলো-আঁধারের খেলায় সজ্জ্বিত থাকে সন্ধ্যাবেলায়।
আমার উচ্চতা একটু কম। তখন খুব খাটো ছিলাম। বড় হচ্ছিলাম না।
তাই স্যারের ইশারা দেখে নিজেও ইশারা করলাম একটু উবু হওয়ার জন্য।
সে উবু হতেই ফিসফিস করে বললাম,
– স্যার, আপনি আব্বুকে আংকেলের ব্যাপারে কিছু বইলেন না। আব্বু আম্মুকে মারবে। ঘরে খুব সমস্যা হবে।
– আচ্ছা ঠিক আছে। বলবো না। তুমি এখন তোমার আম্মুর হাত ধরো।
আমি তখন স্যারের হাত ছেড়ে দিয়ে একছুটে আম্মুর কাছে গিয়ে তার হাত ধরলাম।
অন্ধকারে তার মুখটা ও যেন দেখতে পেলাম খানিক।
কি ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে!
আজ আবার কোন ভুল করলাম?
আমি তো আম্মুর ভালোর জন্যই স্যারকে বললাম কিছু না বলতে।
স্যার কিছু না বলেই যখন পিছনে ফিরে হাঁটা দিলো তখনই আম্মু বলে উঠলো,
– আ_আ_আপন… শুনো, তু_তুমি তো সব জেনে গেছো.. রাকার আব্বুকে কি সব বলে দিবা? আসলে ও আমার ক্লাসমেট ছিলো..
স্যার আম্মুর দিকে ফিরে কিছুক্ষন হাসলেন। তারপর বললেন,
– হাহ হা..হ্যাঁ। আজকেই জানলাম পুরোপুরি।
এতদিন অবশ্য সন্দেহ করেছিলাম। ধোঁয়াশায় ছিলাম। এখন সব বুঝতে পারছি। আর ক্লাসমেট! হাসালেন আপনি।
আম্মু তখন বলে উঠলো,
– আচ্ছা কী কী দেখছো?
স্যার অবলীলায় বলে দিলেন,
– লোকটার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলেন আর রাকাকে তার দায়িত্বে ছেড়ে দিয়েছেন। নিজ চোখে দেখলাম সেই দৃশ্যটা। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেছে। আপাতত এটুকুই দেখে নিলাম। আর কিন্তু দেখতে চাইনা ভবিষ্যতে।
আম্মু তখন একরাশ অস্বস্তি নিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললো,
– কাউকে কিছু বলবা না তুমি আপন। আমার হাজবেন্ডকে তো না_ই। এর বিনিময়ে তুমি যা চাও তাই পাবে। আর আমাকে ভয় দেখানো বন্ধ করতে হবে।
স্যার ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
– তাই! আচ্ছা, কী কী পাবো?
– আমার গলায় এখন একটা স্বর্ণের চেইন আছে। ওটা এখনই আমি তোমাকে দিয়ে দিবো। তুমি চাইলে কিছু নগদ ক্যাশ ও দিতে পারি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কি দেখছো ওটা কাউকেই কোনোভাবে বলা যাবেনা। মরে গেলেও না। কাগজে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
বলে আম্মু তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে লাগলো।
স্যার কঠিন অবয়ব নিয়ে তাকিয়ে আছে।
এমন সময় আপন স্যারের ফোন বেজে উঠলো।
“রাকার আব্বু” কলিং…
স্যার এটা দেখে সোজা মোবাইলটা তার মুখোমুখি ধরে বললো,
– আপনি শুধরাবেন? নাকি আপনার স্বামীকে বলে তার হাতেই ছেড়ে দিবো? তার হাতেই শুধরান। ওটাই ভালো। তাইনা বলেন?
এত বড় বড় দুইটা বাচ্চা ফেলে কিভাবে আপনি… ছি:!
উনি কত ভালো,নিষ্পাপ একটা মানুষ। জানেন আপনি? আর আপনি কি করছেন এসব?
বিশ্বাসঘাতকতা..!
আম্মু স্যারের মোবাইলের স্ক্রিনে আব্বুর কল দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। স্যারের কথাগুলো শুনে একেবারেই দমে গেছিলো তখন। আম্মু অস্ফুটস্বরে বললো,
– না আপন। রিসিভ করো না!
আপন স্যার ফোন রিসিভ করেছে।
করতে না করতেই আব্বু বললো,
– তুমি আজকে বাসায় আসোনাই নাকি রাকাকে পড়াতে। কেন বলোতো?
স্যার বললো,
– আজকে বাড়িতে গেছিলাম তাই আসতে পারিনি চাচা। আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।
আপনার সময় হবে?
বলে যখনই আম্মুর দিকে তাকালো তখনই সে হাতজোড় করতে আরম্ভ করলো।
তাড়াতাড়ি করে গলায় চেইনটা খুলে স্যারের সামনে দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
– প্লিজ! দোহাই তোমার আপন। বইলো না কিছু। আমার সংসার ধ্বংস কইরো না।
আপন স্যার ফোন কেটে দিয়ে সহজ গলায় বললেন,
– কলের পুতুল নাকি? আমাকে এগুলো দিচ্ছেন কেন! আপনি আমাকে এত লোভী ভাবেন নাকি! আজ এত বছর ধরে দেখছেন.. আসলে আমি বলতে চাচ্ছিলাম, এই লোকটা খুব বেশি একটা ভালো না। আমি উনাকে চিনি। উনার আগের ঘরে একজন স্ত্রী আছে। আপনার হাজবেন্ড তো ঠিকই আছে। এই লোকটার মনে কোনো দাগ নেই,বিশ্বাস করেন। উনাকে আমি ভালো করেই চিনি। আমার আব্বার সাথেও ভালো সম্পর্ক। খুব ভালো মনের মানুষ।
কথাটা আম্মু পাত্তা না দিয়েই বললো,
– তুমি ব্যাস আমার হাজবেন্ডকে এই কথাগুলো জানাইয়োনা। আমি আর কখনো যাবো না এভাবে। বললাম তো। যাও।
স্যার বললো,
– ওকে। রাকাকে নিয়ে বাসায় যান। আমি চাচাকে বলে দেই আপনারা বাসায় ফিরছেন।
আম্মু আমার হাত ধরে তড়িঘড়ি করে বাসায় চলে গেলো তারপর।
আব্বু টিভির রুমে বসে অপেক্ষা করছিলো।
সেদিন আর কিছুই বলেনি। কারণ আপন স্যার ফোন করেছে বলেছে হয়তো, আমরা তার সাথে গিয়েছিলাম।
সেদিনের পর থেকে আম্মু আর একদমই আপন স্যারকে সহ্য করতে পারেনা।
আপন স্যারের সাথে আব্বুর সম্পর্ক ও ভালো। কখন কি বলে দেয়, কে জানে। এই ভয় থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো, আপন স্যারকে আমার টিউটর থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া। সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া তার সাথে।
রাতে খাবার টেবিলে আম্মু কথাটা তুলেছিলো ও সেদিন।
কিন্তু আব্বু পাত্তা দেয়নি।
আমার আব্বুর নাম রেজা চৌধুরী।
আম্মুর নামে ও তাই চৌধুরী যুক্ত হয়েছে।
দুজনের ভালোবাসা-বাসির অবস্থা ছিলো দহরম-মহরম টাইপ। এই সম্পর্কে কিভাবে ছেদ এসেছে জানা নেই।
আরকদিন ও তাদের ঘরে আরেক ধপায় আপন স্যারকে নিয়ে কথা হলো।
তাদের কাছাকাছি আসার মুহূর্তে হঠাৎ করেই মিসেস অনু চৌধুরী ওরফে আমার মা বললেন,
– আপনি আমাকে ভালোবাসেন?
রেজা সাহেব ওরফে আমার বাবা সাথে সাথে উত্তর দিলো, হ্যাঁ।
– তাহলে আমার একটা কথা রাখবেন?
– হ্যাঁ। আমার প্রাণ দিয়ে হলেও রাখার চেষ্টা করবো।
আম্মু, চোখ গরম করে বললো,
– আচ্ছা। তাইলে বলি। আপনি আপনকে মানা করে দিবেন। আর কোনোদিন আমাদের বাসার ত্রিসীমানায় না আসতে বলবেন। ব্যস।
আব্বু জিজ্ঞেস করলো,
– কেন? হঠাৎ করে এভাবে কেউ না করে দেয়? আর ওকে না করার কোনো কারণ ও তো নেই। ওর বাবার সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক অনু। এভাবে কিভাবে না করে দেই?
আর ভালো ছেলে তো। সমস্যা কোথায় তোমার?
আম্মু নাক কুঁচকে বলেছিলো,
– আমার ওকে খুব একটা সুবিধার মনে হয় না। রাকার সাথে বেশিই ঘেষাঘেষি করে। আর ও খুব সেন্সিটিভ ছেলে। মতি-গতি ভালো না। ঘরে আমরা তিনজন মেয়ে থাকি। বাকিটা আপনি বুঝে নেন। আপনার কার প্রতি দায়িত্ব পালন করা উচিত,ভাইব্যা নেন।
আব্বু চিন্তিত হয়ে গেলো কথাগুলো শুনে।
আম্মু আরো যোগ করলো,
– শুনেন, এই ছেলের নজর খারাপ। পাশ কইর্যা বইস্যা আছে। চাকরী-টাকরী হয়না। ভালো-মন্দ কিছু একটা ঘটলেও কি মেয়ে বিয়া দিবেন তার কাছে? আর চরিত্র খারাপ তো। দেখেন না, তানিশারে কোনোমতেই বুঝাইয়া তার কাছে দিতে পারলাম না? আপনার ছোট মাইয়্যাডারে তো মনে হয় তাবিজ করছে। সারাক্ষন শুধু আপন স্যার, আপন স্যার.. আবার এইড্যা ওইড্যা মাইয়্যারে দেয় ও। ওইদিন দেখলাম কি হাসি-ঠাট্টা চলে তাগো..
আব্বু গম্ভীর স্বরে জানালেন,
– আচ্ছা। আমি ওকে আগামীকালই না করে আসবো।
আম্মু তখন গলায় জড়িয়ে ধরে বললেন,
– শুনেন, তার সাথে দেখা করার দরকার কী? এমনি ফোনেই না করে দিয়েন। আর ভুলেও কথা কওয়ার দরকার নাই। পরে জুইড়্যা বসবো।
আব্বু জানায়, আচ্ছা।
ব্যস। আব্বু এক কথার মানুষ।
স্যারকে না করে দিলেন আসতে।
স্যারের সাথে সব যোগাযোগ ও বন্ধ করে দিলেন।
স্যারের সাথে একদিন দেখাও হয়েছিলো তার।
স্যার হালকা ইঙ্গিত দিতেই আব্বু তাকে ইচ্ছামত কথা শোনায় সবার সামনে।
অথচ আব্বু নিজেও জানতো,প্রমাণ ও পেয়েছিলো,এমন কিছু আছে আম্মুর জীবনে।
কিন্তু তার ওয়াদা,অতিরিক্ত ভালোবাসার অভিনয়.. সবকিছু ভুলিয়ে রাখছিলো আব্বুকে।
স্যারকে তখন এরকভাবে অপমান করায় আর যোগাযোগ করলেন না তিনি। আব্বুর থেকে এরকম ব্যবহার সে আশাই করতে পারেনি হয়তো।
তারপর থেকে আমি একা একাই পড়াশোনা শুরু করি।
স্কুলে যাওয়ার সময় মাঝেমধ্যে দেখা হতো স্যারের সাথে। স্যার না পারতে হাসতো,কথা বলতো।
তবুও সামনে পড়ে গেলে জিজ্ঞেস করতো,
ভালো আছি কিনা। সব ঠিক আছে কিনা।
বেশিক্ষন কথা ও বলা যেত না,আব্বুর কড়া পাহারার দরুন।
আমার একাকিত্বতা ক্রমশ বেড়ে গেলো।
খুব কষ্ট হতো এই দেওয়ালের জন্য।
কেন? জানা নেই।
ভাবতাম মাঝেমধ্যে,
“আচ্ছা,আপন স্যারের ও কি আমার জন্য একইভাবে কষ্ট হয়?
ছি:! এসব আমি কি ভাবছি!”
বাসায় ও সব শান্তিতে চলমান রাখা আর সম্ভব হলো না।
আম্মুর সাথে অবশ্য আর কোথাও যেতে হয়নি। কিন্তু সমস্যার শুরু অন্যভাবে হলো।
ক্লাস সিক্সে…
একদিন আব্বুকে দিয়ে ইচ্ছামত বাজার করানো হলো। সব ধরণের আইটেমই আনা হলো।
কিছুই বাদ পড়েনি।
আব্বু বাজার করে এনে যখন জিজ্ঞেস করলো, কেন বা কার জন্য এত আয়োজন তখন জানতে পারে, আম্মুর নাকি দূর সম্পর্কের এক জেঠাতো ভাই আজ বাসায় আসবে।
তার জন্যই এত আয়োজন।
আব্বুর ব্যবসার জন্য সেদিনই কিছুদিনের জন্য চট্টগ্রামে যেতে হলো। তাই সকালের নাস্তা খেয়েই সে চলে গেছিলো।
যাওয়ার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো,
– তোমার জন্য কি আনবো আম্মু?
আমি বলেছিলাম,
– তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসবা। ব্যস। কিছুই আনতে হবেনা।
ততদিনে আমার সাথে আমার মায়ের সম্পর্ক আগের চেয়ে কিছুটা ভালোর দিকে। বুঝতে পারতো, আসলেই কতটা ভালোবাসতাম। তাই আর এভাবে এতটা অবহেলা করতে পারেনি।
আসলে বড় হচ্ছিলাম তো আস্তে আস্তে, তাই ছেলেমানুষি আবদারগুলোও কমিয়ে দিচ্ছিলাম ক্রমশ। তাইজন্যই খুব দ্রুত আপুর মত ভালো মেয়ের তকমা পেয়ে গেছিলাম।
সেদিন রান্নাবান্নার কাজে আমিও হাতে হাত লাগালাম। আপু তো করলোই।
হঠাৎ করে আম্মু মাঝখান দিয়ে সব ফেলে রেখে উঠে চলে গেলেন।
ফোন এসেছিলো দেখছিলাম।
কথা শেষ হতেই উঠে গেলেন।
তারপর আপু আর আমি মিলেই বাকিটা করলাম।
পুরো ঘর পরিষ্কার করা হতে শুরু করে রান্না, সব আমরাই করলাম।
ততক্ষনে আম্মু গোসল করেছে।
নতুন শাড়িও পড়েছে।
দেখলাম, লিপস্টিক ও দিচ্ছে..
চুল ও ছেঁড়ে দিয়েছে।
সাহস হলো না জিজ্ঞেস করতে, কোথায় যাচ্ছে বা কেন এত সাজগোজ।
আপু আর আমি দরজার কোণে আম্মুকে দেখে কিছুক্ষন বিড় বিড় করে চলে আসলাম।
বিড়বিড়ের বিষয় বস্তু,
কোনো বিশেষ অতিথিই আসছে বোধ হয়..
(চলবে)