রাকা (৮)

0
688

রাকা (৮)
ফারজানা রহমান তৃনা

ফারজানা রহমান তৃনা।
আমরা মিসেস অনু চৌধুরী আর তার ছদ্মবেশী জেঠাতো ভাইয়ের খাবার টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে, নিজেদের খাবার নিজেদের রুমে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
আপু পোলাও,মাংস সবই নিয়ে আসছে একটু একটু করে। কত বেলা হয়ে গেছে। তার উপর এত এত পদের রান্না,তাই ওর মনে হচ্ছিলো আজ ও একাই সব খেয়ে সাবাড় করে ফেলতে পারবে।
কিন্তু আমার খাওয়া হচ্ছেনা।
এই লোকটা আমাদের সাথে একই বাড়িতে থাকবে, এটা হতেই পারে না।
মেনে নেওয়া তো দূর,সহ্যই করতে পারছি না তাকে। এই লোককে যেভাবেই হোক তাড়াতে হবে আমাদের বাসা থেকে।
এইসব চিন্তায় চিন্তায় কোনো খাবারই মুখে রোচে না আমার।

তবে আমি আমার রাগ ঝেঁড়ে এসেছি একভাবে।
ইচ্ছা করেই তাদের জন্য রাখা খাবারের কিছু তরকারিতে বেশি করে লবণ ঢেলে এসেছি।
খাক, ভালো করে। অনু চৌধুরী খুব রাগারাগি করবে, মারধর ও করতে পারে, সে বিষয় নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কাজটা করেছি খুব গোপনে। আপুও টের পায়নি। অতিরিক্ত জেদের বশত আর সামলে রাখতে পারিনি নিজেকে।

এসব ভাবতে না ভাবতেই অনু চৌধুরী এসে হাজির।
আপু মুরগীর রান আর ইলিশ মাছের ডিম, চিতল মাছের পেটি, সবজি ইত্যাদি নিয়ে বসেছে।
খুব মজা করেই সে খাচ্ছে।
আমি শুধু ডাল আর এক পিস মাংস নিয়ে বসে আছি,খাচ্ছি না।
ঠিক তখনই ‘অনু চৌধুরী এসে হাজির হয়েছে। তাকে এখন আর আম্মু ডাকতে ইচ্ছা করেনা।
ভাগ্যিস তার একটা নাম আছে, তাই মনে মনে ঐ নাম ধরেই ডাকতে পারছি।

এসেই দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– এই,সবগুলো তরকারিতে এত লবণ দিয়েছিস ক্যান? লবণের বয়াম কি ঢেলে দিয়েছিস নাকি?
তারপর তানিশা আপুর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,
– ও মা! তুই তো দ্যাখতাছি এক্কেবারে সব খেয়ে কাবার করে দিবি! তোর জন্য এগুলা রান্না করা হইছে? সব নিজেই গিলবি? এগুলা মেহমানের জন্য রান্ধা হইছে না? তুই সব বড় বড় টুকরাগুলা পাতে নিলি ক্যান? জীব লকলক করে খুব, না? আরে বাটি ভরে ও নিয়ে আসছে দ্যাখো দ্যাখো!

তানিশা আপু খাওয়া বন্ধ করে শীতল চাহনিতে তাকিয়ে বললো,
– ওমা, তুমি এইভাবে বলতেছো কেন? এগুলা আমার খাওয়ার অধিকার নাই?

আম্মু অগ্নিচক্ষু নিয়ে বললো,
– বাবারে অধিকার খাটাতে আসছে উনি। তো কিভাবে বলবো আপনাকে নওয়াবের বেটি? আফনে একাই সব গিলে ফেললে বাকিরা খাবে কি?

আমি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলাম,
– ডেকচিতে তো সবই পড়েই আছে। ভর্তি সব। এতগুলো রান্না করা হইছে। এরপরে ও এইভাবে বলতেছো কেন?

আপু শান্ত গলায় বললো,
– তোমার গলা নামাও বুঝলা। ঠিক করে কথা বলো তুমি। খাওয়ার খোঁটা দেওয়া ও শুরু করছো।
বেশি মিল দিয়া চলি দেইখ্যা,বেশি ফেলনা মনে কইর‍্যো না আমাকে। অনেক কিছু বুঝি এখন।

আম্মু আমার কথার ভ্রুক্ষেপ না করে আপুর কাছে গিয়ে তার চুলে হেঁচকা টান দিয়ে বললো,
– এই কি বললি তুই? গলা নামায়ে কথা বলতে বলছিস আমাকে? তোর এত বড় সাহস? কী বুঝোস তুই? আমারে কথা বলা শিখাস?
দাঁড়া আজকে তোর খাওয়া কেম্নে হয় আমিও দেখি। ফেলনা না কি, বুঝবি হাড়ে হাড়ে। বলে আপুর আঙুল ডুবে থাকা পোলাওভর্তি খাবারের থালাটা টান দিয়ে নিয়ে নিলো সে।

আপু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
অনু চৌধুরী আজ এত বাজে ব্যবহার কেন করছে, সে ভেবেই পাচ্ছে না।
তাই গলা শক্ত করে বললো,
– সব রান্নাবান্না করলাম আমরা। তুমি সারাক্ষন তোমার সাজগোজ নিয়া পইড়্যা থাকলা। এখন খেতে আসছি। খেতেও দিলা না। আমার বাপের টাকার খাবার আমি খাবো, তোমার এত আপত্তি কিসের? আমার হক নাই? সত্যিই বেশি বাড় বাড়ছো তুমি। আব্বু ঠিকই বলে।

সে সাথে সাথে কষিয়ে দুটো চড় দিয়ে দিলো আপুর গালে। তারপর আমাদের সামনে থাকা বাটির তরকারিগুলো চেখে বললো,
– গলা উঁচাস কারে? আমি আগেই বুঝছিলাম, তরকারিতে এত লবণ এমনে এমনে আসেনাই। তোরাই দিছোস। নিজেদেরগুলা আলাদা রাইখ্যা আমাদের গুলায় লবণ ঢাইল্যা দিছোস, যেন আমরা না খেতে পারি। নে, এইবার তোরাও না খাইয়্যা থাক। বদের হাড্ডিগুলা।
সমবয়সী মনে করোস আমারে?

আপু হুট করে শব্দ করে কেঁদে দিলো।
আমি অনু চৌধুরীর হাত টেনে ধরে শক্ত গলায় বললাম,
– খাইতে ও দিবা না আমাদের,তাই না? এজন্যই আব্বু তোমাকে হেডেক বলে।

সে হাত ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বললো,
– তরকারিতে বাড়তি লবণ দিলি ক্যান? তুই দিছোস, না? তুই দিছোস? বল্!

আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম পলকহীনভাবে।
সে গলা খাকি দিয়ে আবার বললো,
– হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝছি, তুই ই দিছোস। বুঝছি তো আমি। কারণ তুই তো ওরে অনেক আগে থেইক্ক্যাই সহ্য করতে পারোস না। তোর কোন ক্ষতিটা করছে ও শুনি? কত আদর করে তোরে। এমন করলি ক্যান বল?

আমি অন্য দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম,
– ঠিক করছি একদম। আবার করবো। কী করবা তুমি..

সে ঝাঁকুনি দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
– ক্যান এরকম করলি বল? আজকে মাইর‍্যাই ফেলমু একদম।

আমি তার দিকে তাকিয়ে সোজাসাপ্টাভাবে সহজ বাংলায় বলে দিলাম,
– আমার ভালো লাগেনা ঐ লোকটাকে। ঐ লোকটা একটা বেয়াদব। একটা বদমাইশ,পাজি লোক।

কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে আর কুলালো না।
একটার পর একটা থাপ্পড় পড়তে লাগলো নাক- মুখের উপর।
এভাবেই টানা অনেকক্ষন থাপড়াতে থাপড়াতে নিজেই কাহিল হয়ে গেলো।
যাওয়ার আগে বলে গেলো,
– তুই মরোস না ক্যান? মর তুই,মর। ও খারাপ লোক, বেয়াদব,না? দাঁড়া। আমিও দ্যাখতেছি তোকে।
আপু থামাতে আসলে তাকেও মেরে,ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো।

এরপর আমাদের সব খাবার নিয়ে সে চলে গেলো।
আমার নাক দিয়ে ততক্ষনে রক্ত পড়তে লাগলো। নাকে পলিপ ছিলো। ওটা ফেঁটে রক্ত পড়তেছিলো অবাধে। আমি দম মুখ খিঁচে বসে রইলাম তবুও। নাকটা জ্বলছে, চিন চিন করে সুইঁ ফোঁটানোর মত ব্যাথা করছিলো। কিন্তু কিছুই করলাম না।

আপু আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,
– রাকা! কিভাবে হইলো এইটা! বলে আমার মুখ টেনে ওর দিকে ফিরিয়ে উত্তেজিত হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন।
তারপর তাড়াতাড়ি সে ব্যস্ত হয়ে টিস্যু নিয়ে এসে নাকে ধরলো। একে একে ৪টা টিস্যু রক্তে ভিজে গেলো। আপুর কি করা উচিত বা উচিত না সে এসব না ভেবেই তাড়াতাড়ি আমার নাক, মুখ মুছে পরিষ্কার করে দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে নিজের ওড়না গরম করে এনে আমার নাকে চেপে ধরলো।
তার মতে গরম কিছু লাগালে ভালো হবে তাই।

রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেছে ততক্ষনে। নাপা খাইয়ে দিলো যেন ব্যাথা কমে যায়। আমার নাকে ব্যাথা করছিলো কিনা বা কোনোপ্রকার কষ্ট হচ্ছিলো কিনা,কিছুই বুঝিনি। চুপচাপ বসে ছিলাম। রাগেই সব ফেঁটে যাচ্ছিলো।

অনু চৌধুরী আর আজমল উদ্দীন ডায়নিং এ বসে তখন খাচ্ছে। হাসি-তামাশার ও জোয়ার বইছে।
আপু বার বার দৌঁড়াদৌঁড়ি করে তাদেরকে ডিঙিয়েই রান্নাঘরে গেলো। ঔষধের জন্য ড্রয়িংরুমে, এই রুমে সেই রুমে দৌঁড়াদৌঁড়ি করলো।
তারা দেখলো। কিন্তু একবার ও জিজ্ঞেস করলো না, কি হয়েছে বা কেন আপু এরকমভাবে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে।

আমার হঠাৎ করে মাথাব্যাথা শুরু হয়ে গেলো। প্রচন্ডরকমের ব্যাথা। এত ব্যাথা যে আর সহ্যই করতে পারলাম না। হাত ধুঁয়ে এসে শুয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো আর রাতে।
উঠে দেখলাম,চারদিক শুনশান হয়ে আছে।
শুধু আপুর কথা শোনা যাচ্ছে।
জানালার পাশে বসে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে সে। আমি উঠেই আপুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– আপু ঐ লোকটা কি বাড়ি থেকে গেছে?
আপু মাথা নাড়িয়ে বললো, না।

কিছুক্ষন পর দেখলাম, জানালা দিয়ে আপু কিছু একটা দেখছে। কেউ একজন ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। দেখলাম, কাগজে মোড়ানো কিছু একটা আপুর হাতে দিলো। অন্ধকারে তার মুখটা স্পষ্ট দেখা গেলো না। আপু তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে তাই চেহারাটা মোটেও দেখতে পারলাম না। বুঝলাম ও না, কে সে।

সে চলে যাওয়ার পর আপু কাগজে মোড়ানো ঐ প্যাকেট আমার সামনে নিয়ে এসে হাসি মুখেই বললো,
– খুব খিধা লাগছে নারে বোন?

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, না।

ও আদুরে গলায় বললো,
– লাগছে। আমি জানি। আমি তো তাও একটু খাইছিলাম। তুই তো একটুও খাস নাই। এখন খাবি,আয়।

আমি কিছু বললাম না।
ও দরজা বন্ধ করে প্যাকেট খুলে বসলো।
দুটো বিরিয়ানির প্যাকেট, একটা কোক আর কিছু চকলেট।
আমি হা হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– এগুলা কোত্থেকে পাইলি আপু? কে দিলো?
সে প্রশ্নটার গুরুত্ব না দিয়ে বললো,
– পাইছি একভাবে। এখন তুই খা।
আমি আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম,
– জানালা দিয়ে কে আসছিলো আপু?
আপু চোখ বড় বড় করে বললো,
– রাকা! সবসময় তোর এত প্রশ্নের উত্তর দিতে ভাল্লাগেনা আমার। বন্ধু দিছে। হইছে এইবার?
আর কোনো কথা না। খেতে বলছি, খা।

আমি আর কথা বাড়ালাম না।
আসলেই তো। আপুর তো বন্ধুর অভাব নেই।
নির্বিঘ্নে খেয়ে নিলাম দুজন।

ওয়াশরুম থেকে দুজন ফিরে এসেই দরজা বন্ধ করে দিলাম আবার। আর খুললাম_ই না।
আমি বসে বসে পড়ছিলাম।
আপু শুয়ে শুয়ে কিছু একটা করছিলো।
হঠাৎ দরজায় খট খট আওয়াজ হলো।
আওয়াজ কানে আসতেই আমার শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। কে আসলো এত রাতে!
ঐ লোকটা নিশ্চয়?

আপুও চোখ সরু করে তাকালো দরজার দিকে।
আবার আওয়াজ হলো।
বেশি জোরে না। আস্তে আস্তেই নক করছে।
আমি উঠে আপুর কাছে গিয়ে তার হাত ঝাপ্টে ধরে বললাম,
– আপু, ঐ লোকটা আসছে বোধ হয়..
আপু বললো,
– দাঁড়া দেখি আগে, কে..
– দরজা খুলবি?
– না। যেই আসুক,দরজা খোলা হবেনা।

তারপর আপু জোর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– কে?
কোনো সাড়া-শব্দ এলো না।
আপুও দরজা খুললো না।
তারপর থেকে আর আওয়াজ হয়নি।

আমি আর পড়ায় মনোযোগই আনতে পারলাম না। খুব মিস করছিলাম আব্বুকে। আমার নিজের কোনো ফোন নেই। আপুর ফোন আছে।
কিন্তু আপুকে সারাক্ষনই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়, এই ফোন নিয়ে।
আপুর কথা শেষ হয় সেই ফজরের পর।
ততক্ষনে আমি ঘুমে কাতর।

আপুর কাছে গিয়ে অনেকক্ষন ইনিয়েবিনিয়ে অনুরোধ করলাম, আব্বুর সাথে কথা বলবো।
ভাগ্য ভালো আপুও রাজি হলো।
সে নিজেই আব্বুকে কল দিলো।
ফোন বন্ধ আসছে নাকি।
আমিও ট্রাই করলাম কয়েকবার।
কিন্তু আব্বুর ফোন বন্ধ আসছে বার বার।
আব্বুর ফোন তো কখনোই বন্ধ থাকেনা।
ব্যস্ত মানুষ, কাজের জন্য কত শত গুরুত্বপূর্ণ ফোন আসে তার।
কিন্তু আজকে ফোন বন্ধ আসছে কেন!

রাত বারোটায় আব্বুর কল আসলো।
তখন আমি ঘুমে।
আপু তাড়াতাড়ি তার নিজের ঐ উড়ো কল কেটে দিয়ে আব্বুর কল রিসিভ করলো।

আব্বু খুব কাতর স্বরে বললো,
– হ্যালো মা। ঘুমায়ে গেছো তোমরা?

আপু বললো,
– রাকা ঘুমাচ্ছে। আমরা এখনো ঘুমাইনাই।

আব্বু বললো,
– তোমরা কল দিছিলা অনেকবার,তাই না? আসলে খুব চাপে আছি মা। ফোন বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম তাই। তা,তোমরা ভালো আছো তো? তোমাদের মামা আসছে শুনছি। অনু বলছিলো। কথা বলছো তোমরা?

আপু উত্তর দিলো,
– ভালো আছি আমরা। হ্যাঁ, কথা বলছি। তুমি কবে আসবা?

আব্বু বললো,
– এইতো দেখি সব ম্যানেজ করতে পারলে দুদিনের ভেতরেই। আচ্ছা,ঘুমাও তোমরা। এখন রাখি।

আপু বললো,
– আব্বু দাঁড়াও। রাকা খুব বায়না করতেছিলো তোমার সাথে কথা বলার জন্য। ওর সাথে একটু কথা বলো। আজকে আবার ওর নাক দিয়ে অনেক রক্ত পড়ছে।

আব্বু ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কি বলো ! আচ্ছা,ওকে দাও দেখি।

আমাকে টেনে তুললো তারপর।
আমি ফোন কানে দিয়েই ঘুম ঘুম গলায় বললাম,
– হ্যালো।

আব্বুর কন্ঠ ভেসে আসলো,
– হ্যালো মা। কেমন আছো তুমি?

আমার অন্তর শীতল হয়ে গেলো আব্বুর কণ্ঠস্বর শুনে। এই বিশাল দুনিয়ায় এই একজনই আমাকে মা বলে ডাকে। আমাকে এত ভালোবাসে।
আর কেউ কি এভাবে ভালোবাসে?
আপন স্যার ও হয়তো বাসে।
কিন্তু তারটা কেমন ভালোবাসা?
আম্মুর মত নকল? নাকি আব্বুর মত আসল?

আমি উঠে বসে ফোন চেপে ধরে ফোনের স্ক্রিনেই কয়েকবার চুমু দিয়ে বললাম,
– আব্বু.. আব্বু.. ..

– বলো মা। কেমন আছো? তোমার নাক দিয়ে আবার রক্ত গেছে নাকি?

আমি কান্না জড়ানো গলায় বললাম,
– আব্বু আমি ভালো নাই। আব্বু, তুমি কবে আসবা? কালকে চলে আসো না প্লিজ।

– আসলামই তো আজকে সকালে। আগামীকাল কিভাবে আসবো মা? ভালো নাই কেন তুমি? রাতে কী খাইছো?

– রাতে বিরিয়ানি খাইছি। তুমি?

– আমি ভাত,মাছ খাইছি মা।

– তুমি কালকেই চলে আসো আব্বু।

– আমি ব্যবসার কাজে আসছি রে মা.. আরো দুই,তিন বা আরো বেশি ও লাগতে পারে… তুমি ঔষধ খাইছো তো? তোমার আম্মু খাওয়াইছে নিশ্চয়। তোমার আম্মু আমাকে বললো না কেন বিষয়টা!

আমি রাগী স্বরে বললাম,
– আম্মুর এতকিছু দেখার সময় নাই তো। জানেও না উনি। দুপুরে তো খেতেও দেয়নাই, জানো? আমার আর আপুর সামনে থেকে খাবারের থালা নিয়ে চলে গেছে।

আব্বু গম্ভীর স্বরে বললো,
– কি! কেন? কই এসব কিছুই তো আমাকে বলেনি অনু! আমি শুনছি, তোমরা নাকি দুষ্টামি করছো খুব। খাবারে লবণ ঢেলে দিছিলা,কথা শুনোনা তোমাদের আম্মুর। এরকম কেন মা?

আমি আরো গম্ভীর স্বরে বললাম,
– আব্বু আমার ঐ আংকেলকে ভালো লাগেনা। এজন্য উনার খাবারে লবণ দিয়ে দিয়েছি বেশি করে। ঐ আংকেল তো খুব বাজে।

– এরকম করতে হয়না! বাজে কেন হবে? তোমার মামা হয় না? তুমি তো এটা ভালো করোনি একদম।

আমি বললাম,
– জানি ভালো করিনি। এজন্যই তো মার খাইছি ইচ্ছামত। মার খেতে খেতে নাকের পলিপ ও ফাঁটায়ে দিছে তোমার বউ।
এখন তুমিও আর কথা শুনাইয়োনা। এটার জন্য শাস্তি পাইছি আমরা।

আব্বু গলা নরম করে বললো,
– অনুকে আমি বার বার নিষেধ করে আসছি না মারতে। আমি আগামীকাল ফোন করে ওকে প্রচুর বকা দিয়ে দিবো মা। এখন ঘুমাও তোমরা। রাখি।

আমি শক্ত গলায় বললাম,
– তুমি আম্মুকে বিয়ে করছো কেন আব্বু? আর কোনো মেয়ে ছিলো না?
আব্বু এবার হাসলো।
অস্ফুটস্বরে বললো,
– আমার ভাগ্যে যে তোমার আম্মুই ছিলো। তাই!
বাবা, এখন রাখি। ঘুমাও তুমি। গুড নাইট।

আমি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলাম,
– না দাঁড়াও! আমি আরো কথা বলবো। আব্বু আম্মু আমাদের একটুও ভালোবাসে না। আর ঐ আংকেলকে আমি আগে থেকেই চিনি। এই লোকটা একদম ভালো না।
আব্বু ততক্ষনে ফোন কেটে দিয়েছে।
আরেকটু কথা বললে কী ক্ষতি হতো?
না, সে এখন চিন্তা করবে।
কিন্তু আমাদের চিন্তায় ফেলবে না।
জানি আগামীকাল অনু চৌধুরীকে সত্যিই খুব বকবে। কিন্তু এর ফল হবে খুব খারাপ।
ঐ মহিলা আবার এসে,হিংস্রভাবে আমাকে মারবে।
আব্বু তো এসব জানেনা।
কারণ আব্বুর সামনে তো সব ঠিকঠাক।
তাই জানালেও তেমন গুরুত্ব দিবে বলে বলে মনে হয়না।
কারণ ছোটদের কথায় এত গুরুত্ব দিতে নেই।
এবার সে যতই সত্য বলুক।

আমি আবার ফোন দিলাম।
আব্বু ফোন ধরে বললো,
– ঘুমায়ে যাও। আমি আগামীকাল অনুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করবো, এত বড় সাহস সে কেন দেখালো, আমার মেয়েদের কেন মারলো, কেন খাবার নিয়ে গেছে, এসব নিয়ে খুব বকবো। এখন আমার খুব মাথাব্যাথা করছে মা। ঘুমাবো এখন। রাখি।
বলেই রেখে দিলো।

আমি হ্যালো ছাড়া আর কিছুই বলতে পারলাম না।খুব অভিমান হলো। যদি সব জানতাম তাহলে হয়তো অভিমান হতোনা। কষ্ট লাগতো।
কিন্তু আব্বু তো আমাদের কাউকেই কিছু বলেনি।
বললে বুঝতাম,বোঝার চেষ্টা অন্তত করতাম ।
সে একাই সব সয়ে যাচ্ছিলো।
বিরাট বিরাট পাহাড়সম দুশ্চিন্তাগুলো একা একাই পোহাচ্ছিলো আর অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ।
দিনকে দিন ভেঙে পড়ছিলো।

আব্বুর ব্যবসায়িক কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিলো তখন। তার কয়েকটা জায়গায় শুধু লোকসান হচ্ছিলো। কয়েকজনের সাথে শেয়ারে কোনো একটা ব্যবসা শুরু করে ধোঁকা ও খেয়েছিলো। বিশ্বস্ত বন্ধুগুলোই ধোঁকাটা দিয়েছে।

ফলস্বরুপ,লাখ লাখ টাকা টাকা জলে গেছিলো।
ব্যাংকের টাকাও অপরিশোধিত ছিলো,যেহেতু বিপুল পরিমাণ লোন নিয়েই বন্ধুদের বিশ্বাস করে নতুন ব্যবসা শুরু করেছিলো। তাই ব্যাংক ও লোন দিচ্ছিলো না। ওখানে কোনোভাবেই কোনো সুরাহা করতে পারছিলো না বলে নতুন, পুরাতন ব্যবসাগুলোও দাঁড় করাতে পারছিলো না কোনোভাবে। আর এত বিপুল অর্থ কেউ সহসা ধার ও দিতে চাচ্ছেনা। আত্মীয় -স্বজন বলতে ভালো অবস্থায় তেমন কেউ নেই ও।
যারা আছে তারা আব্বুকে জানে-প্রাণে হিংসা করে।

তার চিন্তার পাল্লা ক্রমশ ভারি হয়ে যাচ্ছিলো সেই মুহূর্তে।
তার উপর আবার আমি সব গড় গড় করে বলে দিয়েছি। আব্বু কখনো আমাদের মারার পক্ষে না। সে সবসময় অনু চৌধুরীকে বলতো,
” বাচ্চাদের মেরে কখনো কিছু শেখানো যায়না। ওদের শেখাতে হয় আদর-স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে। ”

আমার সব অভিযোগ সে কড়ায় গন্ডায় উসুল করবে জানি।
কিন্তু সে তো বুঝবে না,
সে দূরে আছে এখন। আমাদের কাছে নেই।
তাই সে যতটা কঠোর হবে ওখান থেকে,
তার চেয়ে বহুগুন কঠোরত্বের স্বীকার হবো আমরা।
এখানে থেকে।

আপু চোখ গরম করে বললো,
– তুই এসব বলতে গেলি কেন? এখন কালকের মার খাওয়ার জন্য আবার তৈরী হ। গাঁধা।

আমি হাসলাম। আমি ও প্রস্তুত, মার খাওয়ার জন্য। আব্বুর প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েই বললাম,
যার কথা ভাবার জন্য পৃথিবীতে কেই নাই, তার এভাবে মার খেয়ে খেয়ে মরে যাওয়াই উচিত।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here