রাকা (৯)
ফারজানা রহমান তৃনা
পরের দিন সকালে উঠে আর কিছুই করতে পারলাম না। উঠেই দেখলাম এক পাশে আপু বসে আছে। আর অন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছে অনু চৌধুরী। আপুর চোখ ছল ছল করছে আর অনু চৌধুরীর চোখে সামান্য মায়া মায়া ভাব লক্ষ্যার্থ।
আমি চোখ খুলতেই আপু তাড়াহুড়ো করে এসে বললো,
– রাকা, এখন কেমন লাগতেছে তোর?
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
– কেন? কেমন লাগবে আবার? ভালোই।
আমার গায়ে জ্বর। সারা রাতই নাকি জ্বর ছিলো। আপু খেয়াল করেছে ফজরের সময়। গায়ে হাত পড়তেই সে হকচকিয়ে যায়। সকাল হতেই অনু চৌধুরীকে ডাকতে যায় কিন্তু সে দরজা খুলেছে কিছুক্ষন আগে।
দরজা খুলেই আপুকে চোখ গরম করে জিজ্ঞেস করছে, কী চাই? সকাল সকাল ঘুম নষ্ট করলি ক্যান?
আপু বলছিলো,
– আম্মু রাকার গায়ে খুব জ্বর।
আম্মু উদাস গলায় উত্তর দিয়েছিলো,
– পানিপট্টি দে, ঔষধ খাওয়া মহারাণীকে। আমার কাছে আসছোস ক্যাঁন? মহারাণীর তো আমারে পছন্দ হয়না। আমি এখন যাবো ক্যান?
আপু বলে,
– খাওয়াইছি প্যারাসিট্যামল। কমে না তো। সেই চারটার সময় খাওয়াইছি। মাথায় পানিও দিছি। কমেনা তো আম্মু।
– আরে কইম্যা যাইব্যো। ঔষধের রিএকশন তো হইতে দিবি? যা আমার জন্য এক কাপ দুধ চা বানায় আন তানিশা। আর এক কাপ রং চা ও দিবি। পিঠা আর ব্রেড রেডি কর। মেহমানের নাস্তা দিতে হবে তো।
– রাকাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে না?
ওর জন্য কী নাস্তা বানাবো?
– ডাক্তার দেখাইবো সামান্য জ্বরের জন্য? এমনি সাধারণ জ্বর,ডাক্তার লাগবোনা। আর ওর এহন জ্বর। যা খাইবো সবই তিতা লাগবো। ওর জন্য এখন নাস্তা বানানো লাগবো না। জ্বর কমুক। তুই তোর আংকেলের নাস্তাটা আগে রেডি করে দে।
আপু অনু চৌধুরীর রুমের ভেতর উঁকিঝুঁকি দিতে দিতে বলে,
– উনি কোথায় এখন আম্মু?
সে খুব বিরক্তির চোখে বললো,
– তার খোঁজ নিয়া তোর কী হইবো?বাথরুমে গেছে।
– আংকেল রাতে কই ঘুমাইছিলো?
– ক্যান? তোর কাছে সব জবাবদিহি করা লাগবো? তোর মামারে জিগাইস।
– গতকাল রাতে তুমি দরজায় টোকা দিছিলা ?
– আমি! আমি তোগো দরজায় টোকা দিতে যামু ক্যান?
– তাহলে কে দিচ্ছিলো?
– ভূতে। বকবক কইর্যা মাথা খাইস না। যা তো এখন। সে আইস্যা পড়বে। নাস্তা রেডি করগে,যা।
তানিশা আপু এবার খানিক আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– ইনিই কি উনি যে আমাকে মোবাইল ফোন কিনে দিছিলো?
– হ। ইনিই তিনি। নইলে আমি অত টাকা পামু কই? তোর কথা বলতেই পরের দিন ফোন নিয়া আইস্যা হাজির! তোদের বড্ড বেশি ভালোবাসে লোকটা।
কথাটা শুনেই সে গলে একেবারে জল হয়ে গেলো। সব রাগ-কষ্ট ধুঁয়ে-মুছে একাকার!
জিজ্ঞেস করলো,
– এইবার আর কিছু আনেনাই আম্মু?
– কী আনবো? তোর কিছু লাগবো? লাগলে তারে গিয়া বল। দেখ, আইন্যা দেয় কিনা।
আপুর এবার খুশিতে চোখ মুখ চকচক করতে লাগলো। তব্ধা খেয়েই জিজ্ঞেস করলো,
– যা চাইবো,তাই দিবে আম্মু?
– চাইয়্যাই দেখো না মা।
– আচ্ছা! ঠিক আছে!! তো, কী কী খাবে আংকেল? রুটি করবো?
– না। তার সময় নাই এখন। তুই তাড়াতাড়ি পিঠা নামা। এক কাপ দুধ রেডি রাখিস। ব্রেড,জেলি,কলা সামনে আইন্যা রাখিস। যেটা ইচ্ছা হবে ঐটাই খাবে। বড়লোক মানুষ,কি খায় না খায় জানি না তো। বুঝোস না!
আপু আর তর্ক করলো না।
মাথা নাড়িয়ে সে খুশি মনে দৌঁড়ে চলে গেলো নাস্তা বানাতে।
তার অনেক অনেক কেনাকাটা জরুরি হয়ে আছে। কিন্তু আব্বু তাকে হাত খরচের বাইরে খুব বেশি টাকা দেয়_ই না।
আর চাইতে গেলে ও দেওয়া লাগে হাজারটা কৈফিয়ত। এত কৈফিয়ত দিতে কার ভালো লাগে?
কত রকমের দরকারি কাজই তো থাকতে পারে।
কিন্তু না! হাজারটা প্রশ্ন করে বসবে সে।
সব কি বলা যায় নাকি!
সে অনেক বড় হয়েছে এখন।
তাই সে ভাবছে, আংকেলের কাছেই বরং চেয়ে নেওয়া যাক। সে দিলেই সবকিছুর একটা সমাধা হবে। দিলে তো আর কম দিবেনা!
টাকাটা খুব জরুরিভিত্তিক হয়ে পড়েছে যে!
সে নাস্তা বানিয়ে টেবিলে রাখতে যাবে তখনই আওয়াজ পেয়ে ছুটে আসে আমাদের রুমে।
বমি করে সব ভাসিয়ে দিয়েছি আমি।
আওয়াজ হয়েছে বেশ জোরেই ।
বমি করেই আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়েছি। গায়ে কোনো শক্তি নেই। দিন-দুনিয়ার কিছুই কান বা ব্রেইনে পৌঁছাচ্ছেনা। আবার শুয়ে পড়েছি।
আওয়াজ যেহেতু জোরেই হয়েছে তাই অনু চৌধুরী ও ছুটে এসেছে।
আর না বোঝার ভাণ করে থাকতে পারলেন না।এসে কিছুক্ষন ইচ্ছামত বকাঝকা করে আপু আর সে মিলে সব পরিষ্কার করেছে।
তারপর আজমল উদ্দীনকে নিয়ে খেতে বসেছে। লোকটা বাইরে যাবে। ফিরবে বিকেলের দিকে। অনু চৌধুরী তাকে বিদায় দিয়ে এসে এখন আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি চোখ মেলতেই আপু জিজ্ঞেস করলো কেমন লাগছে, তারপর অনু চৌধুরী জিজ্ঞেস করলো,
– এখন কেমন লাগতেছে তোর?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
– বললাম তো,ভালো।
সে আবার বললো,
– কী খাবি বল। নুডুলস খাবি তো? জ্বর তো ছাড়ছে।
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
– কিছু খাবো না।
– কিছু খাবি না মানে? সুস্থ হইতে হইবো না? নাকি এমনেই শুয়ে বসে কাজকাম বাদে খাবি আর মানুষ খাটাবি? কার এত সময় পইড়্যা আছে তোর জন্য? আমাদের তো নিজস্ব কাজ-কারবার আছে। নাকি?
আমি কিছু বললাম না।
এমন সময় ফোন এসেছে অনু চৌধুরীর।
ফোন আসতেই সে খুশিতে গদগদ।
ভাবলো প্রিয় মানুষটার ফোন এসেছে বুঝি।
বাসা থেকে যেতে না যেতেই লোকটা তার অভাব অনুভব করা আরম্ভ করেছে।
কিন্তু না!
ফোন করেছে তার বিরক্তিভাজন স্বামী মহাশয়,আজিজ।
ফোন ধরার জন্য সে নিজের রুমে রওনা হওয়ার আগে তানিশা আপুকে বলে গেলো,
– রাকা কী খাইতে চায় দেখ। তারপর বানিয়ে খাওয়া। আমি গেলাম। বলে চলে গেলো।
ফিরেছে ঘন্টাখানেক পর।
ততক্ষনে আমি উঠে বসেছি।
জ্বর বেশি নেই।
তবে শরীর হালকা লাগতেছে।
অনু চৌধুরী আমার রুমে এসেই জিজ্ঞেস করলেন,
– কী ব্যাপার মহারাণী? বাপের কাছে কী কী নালিশ করলেন আমার নামে? আপনের বাপ আমার উপর এত চটে আছে ক্যান?
আমি একবার তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
সে আবার বললো,
– ঐ বল,কী বলছোস তারে? আমারে এইভাবে গালাগাল করলো ক্যান ঐ ইতরের বাচ্চা? ঐ হারামজাদা কী ভাবছে আমার আর যাওনের জায়গা নাই?….
আপু আর আমি তড়াক চোখে তাকালাম তার দিকে, এরকম বিশ্রী ভাষা শুনে।
সে এসব কী ভাষা ব্যবহার করছে আমাদের সামনে!
আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
– তুমি আব্বুকে একদম গালি দিবানা বললাম।
সে আরো এক ধাপ গলা উঁচায়ে বললো,
– তোরে আমি এমনে এমনে মারছি? তুই দুষ্টামি করবি আমি শাসন করমুনা? তোর বাপের আসলে আমার কোনো কিছুই সহ্য হয়না। পোলাপাইন মানুষ হয় এমনে এমনে? না মাইর্যা কিছু শেখানো যায়? আমারে এতগুলা কথা শুনাইলো তোরে মারার জন্য!
আমরা কেউই কিছু বললাম না।
সে আমাদের দিকে ঝুঁকে এসে বললো,
– খালি আমিই খুব খারাপ। তাইনা রে?
তা বল তো, তোদের ভালো বাপ এতদিন আটকাইয়া আছে ক্যান ঐ জায়গায়? দুইদিন পর পর ঐখানে ক্যান যায়? হুম? ওইখানে কিসের এত কাজ তেনার?
তানিশা আপু বললো,
– কারণ ওখানে আব্বুর ব্যবসা আছে। তুমি ভুলে গেছো নাকি আম্মু?
অনু চৌধুরী নাক ছিঁটকে বললো,
– না রে না। তোর বাপের ঐখানে শুধু ব্যবসাই না। আরো অনেক কিছুও আছে।
তানিশা আপু জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি কিভাবে জানো? আর কী আছে ওখানে?
সে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো,
– এগুলা জানোনের লাগি বুদ্ধি লাগে তানিশা, বুদ্ধি। খালি তোরা আছোস দেইখ্যাই আমি এই বদ-লোকটার সংসার করতেছি।
নয়তো কবেই চইল্যা যাইতাম।
আমার কী যাওনের জায়গার অভাব আছে রে? ক? আছে? আমার মত মহিলাদের বিয়া হওনডা কি কোনো ব্যাপার আজকাল? আর আমার কোনটা কম আছে,চাইলে আমিও আজকেই বিয়ে করতে পারি।
আপু কিছু বললো না।
আমাদের সামনেই অবলিলাক্রমে মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে মানুষটা!
আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর দিলাম,
– ঐ লোকটাকে আমাদের বাসায় আনলা কেন তুমি? ঐ লোকটার সাথে থাকো কেন তুমি? আমি যে বার বার বলছি,ঐ লোকটা ভালো না। আমার কথা কি তোমার বিশ্বাস হয়না তোমার, আম্মু? কী করলে বিশ্বাস করবা?
অনু চৌধুরী বললো,
– ঐ লোকটাকে কেন আনছি? বড় হ। একদিন বুঝবি। তোর বাপের যেমন আরেকজন লাগে, আমার ও তেমন লাগে। আমি মেয়ে দেখে কি ফেলনা নাকি? তোর বাপের চেয়েও ভালো কাউরে আমি আমার জীবনে আনতে পারি। বুঝুক সে।
তানিশা আপু নাক-মুখে হাত নিয়ে অনু চৌধুরীকে টেনে ধরে বললো,
– আম্মু, ঐ রুমে চলো… রাকা আবার এগুলা ডেলিভারি করে দিতে পারে আব্বুর কাছে!
সে এখন তালে তাল মেলাচ্ছে।
কারণ তার প্রচুর টাকা চাই।
আর টাকা পেতে হলে তো আসল জায়গায় ভালো থাকতে হবে।
অনু চৌধুরী বললো,
– করুক করুক। আমি কাউরে ভয় পাই নাকি?
আমি একবার অসহায়ের ভঙ্গিতে বললাম,
– তুমি আমাদের সাথে আর থাকতে চাও না। তাইনা আম্মু?
অনু চৌধুরী এবার মলিন মুখে বললো,
– না। চাইনা। না পারতে থাকতেছি। না পারতে। আমার যদি সাধ্য থাকতো,তোরা যদি না থাকতি, তাইলে কবেই চইল্যা যাইতাম। এই সংসার আমার কাছে নরক নরক লাগে। বুঝলি?
আমি শক্ত গলায় বললাম,
– তাহলে চলে যাও না। আর ঐ লোকটাকেও তোমার সাথে করে নিয়ে যাবা। তুমি কিন্তু আবার ফিরে আসবা আম্মু। কিন্তু তাকে কক্ষনো নিয়ে আসবা না। আসবা না আর আম্মু? আমাদের ছাড়া থাকতে পারবা তুমি?
সে এবার খুব কৌতূহলী হয়ে আমার কাছে এসে ঝুঁকে বসলো। জিজ্ঞেস করলো,
– আচ্ছা তুই আমাকে বলতো,তুই কেন ওকে সহ্য করতে পারিস না? এত আদর করে তোকে তাও কেন!
আমি বললাম,
– এমনিতেই করি না। তাছাড়া এই লোকটা আমাকে কোলে নেওয়ার সময় সারাক্ষন শুধু ব্যাথা দেয়।
অনু চৌধুরী সামান্য ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
– ক্যাম্নে ব্যাথা দেয়?
– জোরে, শক্ত করে ধরে রাখে। আমি তখন ব্যাথা পাই খুব। ঐদিন বাসে চুমো দিয়ে সব ভিজিয়ে ও দিছিলো। ইয়াক! জানো?
অনু চৌধুরী হেসেই দিলো এবার।
তারপর শান্ত গলায় বললো,
– আরে শক্ত করে ধরে দেখেই তো তুই পড়ে যাস না কোল থেকে। তুই যা তিড়িংবিড়িং করিস,তাই শক্ত করে ধরে রাখে,যাতে পড়ে না যাস। তো তুই এটা ওকে বললেই তো হয়। এত ঘৃণা থাকবেনা দেখবি। ও মানুষ হিসেবে খারাপ না রে। তোর আব্বুর মতই তোদের ভালোবাসে। আর চুমো দিতে গেলে একটু তো লালা পড়েই। ধুঁয়ে ফেললেই তো চলে। তোকে কি জীবনেও কেউ চুমো দেয় নাই নাকি?
আমি আবার বললাম,
– না হয়না! না,এভাবে কেউ চুমো দেয়নি। আর ওকে একদম আমার আব্বুর সাথে তুলনা করবা না। খবরদার।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
তারপর তানিশা আপুর দিকে তাকিয়ে ওকে শোনার আহ্বান করে বললো,
আচ্ছা এখন শোন তোরা,
আজকে বিকেলে আজমল আমাদের সবাইকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। জাদুঘর,চিড়িয়াখানায়। আরো অনেক জায়গায় যাবো আমরা। রাকা, তুই এখন খেয়ে নে। আর বিকেলে রেডি থাকিস তোরা,হুম?
আমি বললাম,
– আমি যাবো না কোথাও।
আপুও একই কথা বললো কারণ ওর কোথাও কোনো বিশেষ কাজ আছে।
আমাদের আগ্রাহ্য শুনে অনু চৌধুরী এবার কড়া গলায় বললো,
– দেখ আমি তোদের মা। তোদের বাপের সাথে আমার যাই হোক, তোরা তো আমার পেটের সন্তান। আমাকে বার বার এভাবে চটিয়ে দিস না। কথার অবাধ্য হোস না বার বার। তোরা জানোস আমি এক কথার মানুষ। আমি তোদের ভালো রাখতে চাই। ঘুরে আসবি, মন ভালো হবে, এখানে আপত্তি কিসের?
একটু থেমে আবার বললো,
– আজমল শখ করে বলছে, আমাদের তিনজনকে নিয়েই সে জাদুঘরে, চিড়িয়াখানায় যাবে। আরো অনেক অনেক জায়গায় নাকি ঘুরে আসবে। এরকমভাবে কে করতে চাইবে বল? কে নিতে চাইবে নিজ খরচে? তোর বাপে ও তো জীবনে বলেনাই।
আমি বললাম,
– আমরা নিজেরাই তো ঘুরে আসতে পারি। উনি না নিলেও বা কি? আমরা যেতে পারিনা? আব্বু আসলে আমরাও যাবো আম্মু। আব্বুকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। ডান?
অনু চৌধুরী দাঁত গিজগিজ করতে করতে বললো,
– রাকা, মুখে মুখে একদম তর্ক করবি না একদম।ইশ, আব্বুর সাথে যাবে! ঐ লোক জীবনেও এসবে রাজি থাকেনা। তার শুধু কাজ আর কাজ। আর তোর আব্বু তো শোনার আগেই বলবে, দরকার কি এসবের, বাড়িতে গিয়ে ঘুরে আসো বরং। তোদের ঐ নোংরা বাড়ি,তোর ঐ জঘণ্য দাদি,আমার দুই চোখের বিষ।
জীবন থাকতেও আর যামুনা ওইহানে।
মরণ হোক আমার, ঐ বাড়ি যাবার আগে।
আমি যা বললাম, তাই ফাইনাল। বিকেলে রেডি থাকবি। আমরা প্রথমেই জাদুঘরে যাবো।
তানিশা আপু এরকম ঘুরাঘুরি একা একা করতে বেশি পছন্দ করে। ফ্যামিলির সাথে সে কোথাও যেতে সহসা রাজি হয় না।
তবুও কেন যেন আজ সে বলে উঠলো,
– আচ্ছা আম্মু, সিনেমা-হলে গেলে কেমন হয় বলো তো?
অনু চৌধুরী তানিশা আপুর আগ্রহ দেখে খুশি হয়ে গেলেন। হাসিমুখে আপুর গালে হাত বুলিয়ে, চুমো খেয়ে বললেন,
– আচ্ছা তুই তোর আংকেলকে এই প্রস্তাব দিস। না করবে না,দেখবি।
কথাটা বলেই অন্যদিকে তাকিয়ে মুখ গোমড়া করে বললো,
– কিন্তু তোদের বাপ হলে তো ঠিকই না করে দিতো। বলার আগেই না করে দিতো। আমি সিউর। একটা নীরস লোকের সাথে বিয়ে দিছে আমার মা। আমার জীবনটাই শেষ।
আমি বললাম,
– কেন আব্বু ও তো আমাদের নেয়। আপুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
কি আপু? নেয়না?
আপু শুকনো মুখে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
– কবে নিছিলো তোর মনে আছে? কয় বছর আগের কথা? আমার তো মনেও আসেনা কবে নিছে।
আমি কিছুটা আঘাত পেয়েই বললাম,
– আব্বুকে বলে দেখলেই তো দেখতি নেয় কিনা..
গত বছর ও তো গেলাম চন্দ্রীমা উদ্যানে,পার্কে.. মনে নাই তোর?
– ধুর। ঐগুলা তো আসতে যাইতে কতই দেখি। ঐগুলা কি দেখার মত কিছু নাকি?
অনু চৌধুরী আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারলেন না।
উঠে যেতে যেতে বললেন,
– এই তানিশা, ও না গেলে না যাবে। এত জোরাজোরি করার দরকার নাই। ওর আব্বু ওরে মরার আগে যখন নিবে, তখন ই ও যাবে। যাক। তুই আর ওর সাথে তর্ক করিস না। বিকেলে রেডি হয়ে থাকিস তুই। আমরা তিন জন যাবো।
মহারাণী বাসায় একা থাকবে।
আপু হাসি হাসি মুখ করে আজ্ঞাবহ উত্তর জানিয়ে বাইরে চলে গেলো,তার বিশেষ কোনো দরকারে।
আমি বসে রইলাম একা একা।
আপন স্যারের দেওয়া পুতুলটা বের করে কিছুক্ষন কথা বললাম ওটার সাথে।
আপন স্যারকে ফোন দিতে ইচ্ছা হলো খুব।
তার নাম্বার তো নেই। হঠাৎ মনে পড়লো, একদিন সে নিজেই তার নাম্বার লিখে দিয়েছিলো আমার নোট খাতায়।
কিন্তু ঐ খাতাটা কোথায়?
খুঁজে বের করতে হবে!
আমি প্রাণপণে লেগে পড়লাম, খোঁজার কাজে।
অবশেষে নোট খাতা আর তার নাম্বার দুটোই জোগাড় হলো।
কিন্তু ফোনটা জোগাড় হলোনা। আমার তো ফোন নেই। অনু চৌধুরী ছাড়া বাসায় আর কেউ নেই। বাসার এক্সট্রা ফোনটাও তার রুমেই পড়ে থাকে।
আমি অতি সন্তপর্ণে তার রুমের দিকে রওনা হলাম।
রুমের কাছাকাছি যেতেই শুনলাম তার ফোনের কিছু আলাপন।
” আজমল, বাসার কাজটা কবে সারবা? বেশি দেরী করা যাবেনা কিন্তু, সব কাজ আগে আগে করে রাখতে হবে। তানিশার আব্বু কখন এসে পড়ে কে জানে। তুমি কতদিন থাকবা এখানে? ফ্ল্যাট দেখছো তো? কয় রুমের? বারান্দা আছে তো? ঐ টাকাটা তো তোমার কাছেই না? ”
ইত্যাদি সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শুনতে পেলাম। কিছুই বুঝলাম না। বোঝার মত বয়সই হয়নি তখন। কিংবা বুঝতেই চাইনি।
আমি তার রুমে ঢুকে টুপ করে এক ফাঁকে ড্রয়ার থেকে ফোনটা নিয়ে নিলাম।
সে একমনে কথা বলে যাচ্ছে।
আমি ফোন নিয়েই ভোঁ দৌঁড় দিলাম।
তারপর আপন স্যারের নাম্বারে ডায়াল করলাম। কি ভাগ্য! ডায়াল করতে না করতেই রিসিভড!
– হ্যালো, কে?
– স্যার… আমি রাকা…
– ও। কী খবর তোমার? সব ঠিকঠাক?
আমতা আমতা করে বললাম,
– মোটামুটি।
– মোটামুটি কেন? তোমার শরীর ঠিক আছে তো? গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?
– আমার জ্বর আসছিলো রাতে। এখন ভালো আছি। আপনি?
– আচ্ছা.. আমি আছি কোনোরকম। কিন্তু রাকা, আমার মনে হচ্ছে, তোমার শরীর খুব দূর্বল। তোমার আব্বু কই?
– আব্বু চট্টগ্রামে।
– তারমানে তুমি তোমার আম্মুর সাথে একা আছো বাসায়?
– হুম।
– হোয়াট! কোথাও নিয়ে যায় এখন?
– না। তবে আজকে মনে হয় নিয়ে যাবে।
– কোথায়? কার সাথে?
– ঐ লোকটার সাথেই। স্যার আপনি কাউকে কিছুই বইলেন না। আম্মু আমাকে খুব মারবে,যদি জানে আমি আপনাকে এসব বলছি।
– বলবো না। কিন্তু তুমি আগে সবটা খুলে বলো..
– আসলে আমার একটু ও ইচ্ছা করেনা ঐ লোকটার সাথে কোথাও যেতে…
– কোন লোক? বাসের ঐ লোকটা ?
তখনই অনু চৌধুরী এসে হাজির।
– কার সাথে কথা বলছিস? এই মেয়ে! কার সাথে আবার বেজাল পাকাচ্ছিস বেয়াদবের বাচ্চা?
বলে ফোনটা কেড়ে নিয়ে নিজের কানে নিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
– হ্যালো কে? কে আপনি?
স্যার হয়তো বুঝতে পেরে তখনই ফোনটা কেটে দিয়েছে।
অনু চৌধুরী রাগে কটমট করতে করতে,
তুমুল রাগের বশীভূত হয়ে, ফোনটা আছাড় মেরে ফেলে দিলো ফ্লোরে। ফোনটা পার্টে পার্টে খুলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো চারপাশে।
আমার চুলের মুঠি ধরে আবার জিজ্ঞেস করলো,
– কার সাথে কথা বলছোস বল? কার কাছে সব বলে দিছোস? ঐ শয়তানের বাচ্চা।
আমি গলা কাঁপাতে কাঁপাতে বললাম,
– আম্মু এইটা আমার বান্ধবী… তিথী ওটা। ও জিজ্ঞেস করতেছিলো আমি স্কুলে যাইনি কেন আজ…
অনু চৌধুরী বোধ হয় কথাটা বিশ্বাস করেনি। সে আমার সামনে তানিশা আপুর রেঁধে যাওয়া নুডুলস এনেছিলো। ওটা টেবিলে রেখে বললো, খেয়ে নে এটা। না খাইলে মর তুই।
আর যদি তোর বাপ এখন আমাকে ফোন করে কিছু বলে তাইলে আজকে আমিই তোরে মাইর্যা ফেলবো। খতম করে দিবো একদম।
চিনোস না আমারে।
বিকেল বেলায় আজমল সাহেব বাসায় এসেই তাড়া দিতে লাগলো সবাইকে।
অনু চৌধুরীর জন্য একটা রঙীন শাড়ি,দামি দামি গহনা আর আমাদের জন্য ড্রেস কিনে এনেছে সে।
আমার জন্য একটা লেহেঙ্গা এনেছে।
লাল রঙের। কিন্তু ওটা পরার মত না।
একে তো শর্ট হাতা, তার উপর উপরের অংশ সাইজে খুব ছোট। ওটার স্টাইলই নাকি অমন।
হাত সামান্য উপরে তুললেও পেট দেখা যায়।
কি বিচ্ছিরি! এমন ড্রেস আমি জীবনেও পরিনি।
সবার গুলোই ঠিক আছে। শুধু আমারটাই এমন!আমি রাগের তাড়নায় ড্রেসটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে এলাম।
অনু চৌধুরী চোখ গরম করে তাকিয়ে রইলেন।
কিন্তু আপু তার মর্ডান লেহেঙ্গা পেয়ে মহা-খুশী।
সে হাতে পেয়েই পরতে চলে গেছে।
আজমল উদ্দীন আমার চলে যাওয়া দেখে অনু চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– কী হলো অনু? তোমার ছোট মেয়ের কি আমার আনা জামাও পছন্দ হয়নি নাকি? আচ্ছা,মানলাম আমাকে ওর ভালো লাগেনা,কিন্তু আমার আনা ড্রেসটাও ওর ভালো লাগলো না? এটার প্রাইস কত পড়ছে জানো? বসুন্ধরার সেরা দোকান বেছে কেনা।
(চলবে)