রাঙিয়ে দিয়ে যাও,পর্ব:০১

0
2618

রাঙিয়ে দিয়ে যাও,পর্ব:০১
লেখনীতেঃমাহি আফরোজ

“আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন আমার বিয়ে হয়ে যায়”

“বাট হোয়াই?”

“কেনো আবার বড় হয়ে গিয়েছিলাম যে।”কথাটা বলে মেয়েটা দুর্বাধ্য হাসল।এই হাসিকে সাধারণ ভাবে নিতে পারলনা মালিহা।অনেক বছর ধরে অত্যাচারিত, নিপীড়িত দাস যেমন মুক্তি পেয়েও ভয়ংকর দুর্বাধ্য হাসে,এটা ঠিক তেমন হাসি।

টেবিলে রাখা লেমন জুস এক ঢোকে শেষ করেন মালিহা।ওর মাথা ঘুরছে।দেশে আসার প্রথম সপ্তাহে সে এমন একটা পরিস্থিতির শিকার হবে বুঝতেই পারেনি।নিজের ভেতরের অস্থিরতাকে দমন করে মাহিকে প্রশ্ন করে মালিহা,
“তখন তোমার এজ কত ছিলো?”

মালিহার প্রশ্ন শুনে মাহি নিঃসংকোচে বলে,
“তখন তেরো বছরের ছিলাম আমি”

মাহির কথায় ঘৃণায় রি রি করে ওঠে মালিহার সর্বাঙ্গ। মানুষ কতটা বোধহীন হতে পারলে ক্লাস এইটে পড়ুয়া একটা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিতে পারে।মালিহা নিজেকে সামলে নেয়।পরক্ষণেই মনে পড়ে সাবিদ ওকে একবার বলেছিলো বাংলাদেশের বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ মেয়েরাই পড়াশুনায় অমনোযোগী হয়।তাছাড়া এরা নাকি ছোট বয়সেই কারো প্রেমে পড়ে যায়।তাই বাধ্য হয়ে বাবা-মা মিলে ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়।সচকিত হয় মালিহার চোখ। ও সাবধানী চোখে সামনে বসে থাকা
তরুনীকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।

বয়স তেইশ চব্বিশ হবে হয়ত।চুলগুলো ঘন তার সাথে বেশ লম্বাও।পরচুলা হবে হয়ত।গায়ের সাদা রংয়ের ওড়নাটা মাথায় শোভা পাচ্ছে। ফর্সা মুখাবয়ব। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা।হাতে চুরি নেই।নাকে নাকফুল আছে তবে তা অনেকটাই ছোট।এই মেয়েটার কথা সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেও না আবার অবিশ্বাস করতে পারছেও না।

নিজের দিকে এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে মাহি টেবিলে হালকা চাপড় মারে।মালিহা নিজেকে সামলে বলে,
“এত তাড়াতাড়ি বিয়ে কেনো দিয়েছিলো?পড়াশুনায় ভালো ছিলে না বোধহয়?না অবাধ্য ছিলে?”

কড়া রোদে মাহির দু’গাল হালকা লাল হয়ে গিয়েছে।হাত দিয়ে কমলা রংয়ের রোদকে প্রতিহত করে সে বলে,
“পিএসসি পরিক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস নিয়ে পাস করেছিলাম।বরাবরই পড়াশুনায় ভালো ছিলাম।আমার আব্বাকে আমি যতটা ভালোবাসি তার চেয়েও দ্বিগুণ তাকে ভয় করতাম।তাই অবাধ্য হওয়ার কোনো সুযোগ ছিলো না।”

নাইফ দিয়ে সযত্নে জেলি মাখানো পাউরুটির এক অংশে কামড় দিতে গিয়ে মাহি লক্ষ্য করে মালিহা এখনও কৌতুহলী দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে।মাহি বুঝতে পারে তার চেয়ে থাকার কারণ।মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে আপন মনে বলতে থাকলো,
“আমায় বিয়ে দেওয়ার কারণ ছিলো আমি বড় হয়ে গিয়েছি।মেয়েরা জন্মের পর বাবা-মায়েরা অপেক্ষা করে কখন তাদের মেয়ে বিবাহ উপযুক্ত বড় হবে। যখন বড় হবে তখন একটা কর্মঠ ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেওয়া।জন্ম আর বিয়ের মাঝখানের সময়টুকুতে সংসারের কাজকর্ম জানা অপরিহার্য এবং পড়াশোনা করা একেবারেই বিলাসিতা।যেখানে সবাই জানে মেয়ে পড়াশুনায় ভালো হোক বা খারাপ একটু বড় হলে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে।”

জন্মসূত্রে এবং জন্মস্থান সুত্রে লন্ডনের নাগরিক হওয়া মালিহা মেনে নিতে পারল না মাহির কথা।একটু জোড়েই বলল,
“বিয়ের কথা বলল অমনি তুমি ইয়েস বলে দিলে?তুমি চাইলেই না বলতে পারতে।নিজের ড্রিম,এইম সবটা শেয়ার কেনো করোনি তোমার মম ড্যাডের সঙ্গে?”

“আমি না রাজি হয়ে ছিলাম আর না মত দিয়েছিলাম”

“তাহলে ম্যারিটা হলো কি করে?”

” কারণ তারা না আমার মত জানতে চেয়েছিলো আর না আমি রাজি কি না তা জানতে চেয়েছিলো। তাই বিয়েটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত ছেলের সাথেই হয়েছিলো।”

“বিয়ের দিনে কিংবা তার আগে তুমি অশান্তি করতে পারতে।চিল্লাচিল্লি হোক বা কান্নাকাটি করে হলেও তুমি তোমার ড্যাডকে বোঝাতে পারতে।কিংবা বাসা থেকে পালিয়ে কোনো আত্মীয়ের কাছে শেল্টার নিতে পারতে।তুমি কেনো করোনি এমন।ইউ হ্যাভ এনি আনসার ফর ইট?

” আমি গ্রামে বড় হয়েছি।গ্রামের কালচার সম্পুর্ন আলাদা হয়।বিয়ে নিয়ে অশান্তি বা চিল্লাচিল্লি করলে প্রতিবেশিরা তিলকে তাল বানাতো।বলত মোতাহার মেয়েকে মানুষ করতে পারেনি?ওর মেয়েটা বড়ই বেয়াদব। নিশ্চয়ই কারো সঙ্গে সম্পর্ক আছে।কিন্তু নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে ভুলিনি।আমার কান্না শুনে ওরা ভেবেছিলো বিয়ে হয়ে গেলে অন্যের বাড়ি চলে যাবো ভেবে কাঁদছি।”

মাহি কথাগুলো বলে একটু থামে।হাতের ঘড়িতে সময়টা দেখে নেয়।নাহ্ হাতে আর বেশি সময় নেই।কিন্তু মালিহা সরু চোখে ওর দিকে চেয়ে ক্ষীণকণ্ঠে বলে,
“তোমার লাইফে কোনো এইম বা ড্রিম ছিলো না? নাকি রুরাল কালচারে গ্রো আপ করে তুমি শুধু পারফেক্ট হাউজওয়াইফ হওয়ারই ড্রীম দেখতে?

মাহি মালিহার রাগের কারণ বুঝতে পারে।তবুও বলে,
” ছোটবেলা থেকেই আমি ভাবতাম আমি একজন শিক্ষকা হবো।আমার লাইফে এটাই এইম ছিলো।শিক্ষার্থীদেরকে ভালোবেসে সযত্নে পড়া শিখাবো।এটাই আমার ড্রীম ছিলো।সেই কথা মাথায় রেখেই আমি নবম শ্রেণিতে উঠে মানবিক শাখায় ভর্তি হয়েছিলাম।”

প্রথম থেকে এই অবদি একটা মেয়ের স্বপ্ন ভাঙার ব্যাথার ব্যাথিত হয়ে মালিহার অন্তরে ছিলো বেদনার সুর আর সমাজের প্রতি ঘৃণা।কিন্তু মাহির শেষ কথাটায় চমকে তাকায় মালিহা।ঠোঁটের কোনে ঈষৎ হাসি ঝুলিয়ে অবাক ভঙ্গিতে বলে,
“ফাইনালি তুমি এইট ক্লাস থেকে নাইন ক্লাসে প্রমোট পেয়েছিলে।আই থিংক ইউ আর সো লাকি।”

“আপনার মনে হয় আমি ভাগ্যবতী।তা এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”

মালিহা স্বাভাবিক উচ্ছ্বাসে বলে,
“বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা পড়তে দিয়েছে, এটা কি এনাফ নয়?”

মাহি মাথাটা নিচু করে রাখে।মালিহার কথার পিঠে কোনো টু শব্দও করেনা।ইতিমধ্যে তারা বিল মিটিয়ে এক পা দু’পা করে হাঁটা শুরু করে দিয়েছে।মাহি চুপচাপ। মালিহা চুপচাপ থাকলেও তার মনের ভেতরে নাড়া দিয়ে উঠছে অনেক প্রশ্ন।মাহির চুপ করে থাকার শুন্যতা বুঝিয়ে দিচ্ছে সে হতাশ হয়ে অতীত হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে।মাহির স্বামি কি ওর প্রতি অসচেতন নাকি খুব কড়া।মারধর করে নাকি।একবারও ফোন করতে দেখা যায়নি তাকে।এর মধ্যে শুধু একবার ওর আব্বা ফোন করেছিলো।তখন মলিন করে রাখা মুখটায় হাসির ফোয়ারা এনে কথা বার্তা চলেছিলো।

ওরা নিঃশব্দে অনেকটা পথ অতিক্রম করল।ওদেরকে অতীত করে চলে গেলো ওদের বাস।পাশের মসজিদে আসরের আযান পড়ে গেলো।মাহি পথ চলা বন্ধ করে বলে,
“বেলা বেশি নেই।আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন।আপনি চাইলে আমি হেল্প করতে পারি।”

“তোমায় অনেক টায়ার্ড আর ডিপ্রেসড লাগছে।আমি কি করে তোমায় একা ফেলে যেতে পারি।”

সত্যি মাহির অনেক ক্লান্ত লাগছে।জীবনে নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে সে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবুও সে আপন সত্তার সাথে সমরে মেতে আছে।

“তুমি চাইলে তোমার কষ্টগুলো আমার সাথে শেয়ার করতে পারো।কষ্ট জমিয়ে ভেতরে ভেতরে গুমরে মরা উচিত নয়।তুমিই তো বললে তোমার ড্যাডকে অনেক ভালোবাসো।তাহলে তোমার এমন উচ্ছ্বাসহীন জীবন দেখে তোমার ড্যাড কি শান্তি পায়।”

“আমরা কি আরো দু’কাপ কফি খেতে পারি?” মাহির গলা খুবই ক্লান্ত শোনায়।মালিহা তড়িঘড়ি করে বলে,
“শিওর”

বহুদিন পর মাহি তার অতীতের কথা কারো সাথে শেয়ার করতে যাচ্ছে।মালিহা একটু নড়েচড়ে বসে।ভেতরে ভেতরে খুব এক্সাইটেড হলেও মুখ ফুটে বলতে পারছে না।কিন্তু তার চোখমুখে সেই কৌতুহল স্পষ্ট। গরম ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করে মাহি,

“জেএসসি পরিক্ষার মাত্র দশ বারো দিন আগে আমার বিয়েটা হয়।অতিরিক্ত ধুমধামে না হলেও কিছুটা আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়।শ্বশুরবাড়ির অমত থাকা সত্ত্বেও জোড় করে পরিক্ষা দেই।সেই সময়টুকু আমার আব্বা আমার সাথে মেয়ের জামাইকেও রেখে দেয়।জানিনা কি হয়েছিলো পরিক্ষা শেষ হওয়ার পর তারা আমাকে রেখে জামাইকে একা পাঠিয়ে দিয়েছিলো।আমি রয়ে গেলাম আমার বাপের বাড়ি,যেটা আমার নিজের বাড়ি।”

“আচ্ছা ওরা কেউ নিতে আসেনি তোমাকে?”

“একবার এসেছিলো শুধু।আব্বা যেতে দেয়নি।আর কখনও আসেনি।আর না কখনও খোঁজ নিয়েছে।”

মাহি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে।কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারেনি মালিহা।একটা মেয়ের সাথে কতটা খারাপ হতে পারে তা ভাবতেই মনটা ভারাক্রান্ত হচ্ছে তার।নিশ্চয়ই মনে মনে মাহি নিজের সংসার স্বপ্ন দেখেছিলো।

“লোকটার প্রতি তোমার মায়া পড়ে গিয়েছিলো বুঝি?”

মাহি বলে,”কারো প্রতি মায়া জন্ম নেয়নি।আর না কারো প্রতি ঘৃণা।সেই দু’সপ্তাহের মতো সময়টা খুব দ্রুতগতিতেই অতীত হলো।নবম শ্রেণীতে বই পাওয়ার দুইদিন আগে ডিভোর্সটা হয়ে গেলো।বিয়ে, ভালোবাসা, মায়া কোনো কিছুই আমার মনে ছাপ পড়ল না।বরং ক্ষণিক বন্দীর পর মুক্তির আনন্দে আমি আত্মহারা ছিলাম।আমার কাছে বিয়ে আর ডিভোর্স ছিলো পরপর দুই কাগজে সাইন করা।কিন্তু আমার সামনে যে মসিবতের পাহাড় অপেক্ষা করছে তা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।”

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here