রাঙিয়ে দিয়ে যাও,পর্ব:০৮,০৯

0
1028

রাঙিয়ে দিয়ে যাও,পর্ব:০৮,০৯
লেখনীতে-মাহি আফরোজ
[৮]

পা টিপে টিপে মাহি প্রিন্সিপালের কেবিনের কাছে যায়।বন্ধ দরজায় কান পেতে সে ভেতরের কথা-বার্তা শোনার চেষ্টা করে।কিন্তু ভেতরের কোনো কথা কেনো টু শব্দও সে শুনতে পায়না।আর পাবেই বা কি করে সাউন্ডপ্রুফ রুম এটা।তবুও সে ওভাবেই দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকে।মাঝখানে কারো গলা খাঁকারির আওয়াজ পায়।সে বিষয়টা পাত্তা দেয়না।এদিকে পুরো স্কুলের জনগনের কাছে প্রকাশ্যে আজমল স্যার আর গোপনে ডাকা বাঘ স্যার পড়েছে বিপাকে।ভিজিটিং অফিসারকে নিয়ে সে দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে ভেতরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু মাহি জড়বস্তুরও প্রাণ আছে কিনা তেমনই এক থিথিসের গবেষণা নিয়ে দরজার সাথে গোপন শলাপরামর্শে ব্যাস্ত।

“মিস আফরোজ”

আজমল স্যারের গলা তার চেনা।”সব ভুলিবো কিন্তু তোমায় ভুলতে পারব না “কথাটার মতো মাহি উনার আওয়াজকে ভুলতে পারে না।নিজের নামের সম্বোধন শুনে মাহি পেছন ফিরে আরো এক দফা অবাক হয়।সামনে আজমল স্যার আর তার সাথে সেই বদমাইশ,অসভ্য ইডিয়েট লোকটা আর পেছনে দাড়িয়ে আছে পিয়ন।মাহিকে এমন নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে স্কুলের পিয়ন আনিস চাচা মিটিমিটি হাসছে।ভিজিটিং অফিসার হয়ে আসা রিয়াদ দুহাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে নিঃশব্দে মৃদু হাসে।এই হাসি দেখে গা পিত্তি জ্বলে যায় মাহির।মনে হয় দিই দুই ঘা লাগিয়ে।নেহাত নতুন চাকরী।এখন একে চটিয়ে দেওয়া মানে সদ্য শপথ নেওয়া মন্ত্রীর পদত্যাগ সমতুল্য।

মাহি গালে হাত দিয়ে বসে ভাবতে থাকে।হিমুর হাতের ঠেলায় ওর ভাবনায় ছেদ পড়ে।বিরক্তিতে ধ্যাত বলে সে।হিমু হাতে রাখা আপেলটায় এক কামড় বসিয়ে দিয়ে বলে,

” কিরে কিছু হলো?”

“কিছু হলো মানে?কি হবে?”

“না আমি ভাবছি এত মনোযোগ দিয়ে যখন ভাবছিস,তাহলে নিশ্চয়ই নিউটনের চতুর্থ সুত্র আবিষ্কার করে ফেলেছিস?”

“কোনো কিছু আবিষ্কার করা মুখের কথা নয়।আর তুই আমার সমস্যা……এখানেই থেমে যায় সে।অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে হিমুর দিকে আর বলে,”তুই না অসুস্থ?”

“ক্যান তোর বিশ্বাস হয়না।”

“যেমন করে কচমচ করে আপেল শেষ করলি?তাতে মনে হলো না তুই অসুস্থ?”

হিমু মাছি তাড়ানোর মতো করে হাতটা নাড়িয়ে জবাব দেয়,
“আরে ধুর,ব্যাথা আমার পায়ে।খাইলাম তো মুখ দিয়া।আর শোন স্যার যদি বেশি প্রশ্ন করে এমন একটা চোখ টিপি দিবি সালার দুনিয়া আন্ধার হয়ে যাবে।আর না পারলে মিটিংয়ে আমি তো আছিই।একেবারে দুধে-ভাতে করে সলভ করে দেবো।”

উনি তোর কাছে দুধে-ভাত নয়রে হিমু, বরং তুই ওর কাছে দুধে-ভাত।গেইটে এমন নাজেহাল করে ছেড়েছে যে আমি অর্ধেক শেষ হয়ে গিয়েছি।কথাগুলো মনে মনেই ভাবে মাহি।হিমুকে আর বলে না।হিমু মাহিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে,

“তা স্যারকে কেমন দেখলি?”

“কেমন আবার দেখবো।দেখলাম দুটো হাত,দুটো পা,একটা মাথা গায়ে কোট,বাহিরে পার্কিং করা চকচকে গাড়ি আর ইডিয়ট ড্রাইভার। ”

“গরুর রচনার মতো সারাজীবন গরুর হাত পা পড়ে গেলি।শুনলাম স্যার নাকি হেব্বি দেখতে।আর হবেই না কেনো।চাকরিতে নাকি নতুন……

হিমুর এমন বকবকানির মাঝে মাহির ফোনে কল দেয় আজমল স্যার।তাকে প্রিন্সিপাল রুমে যেতে বলে।এতক্ষণ উনিই মাহিকে এখানে থাকতে বলেছিলেন।দরকার হলে তিনি নিজেই ডেকে নিবেন।মাহি যেতে উদ্যত হলে হিমু বলে,
” মাহি জানু একটা কথা, প্লিজ.”

মাহি ফিরে এসে বলে,
“যা বলার তাড়াতাড়ি বল,স্যার ডেকেছে।”

“আমি এখানে শুয়ে বসে থেকে এমন একটা জিনিস আবিষ্কার করছি যার দ্বারা তিন চার ইঞ্চি দেওয়াল ভেদ করে বাহিরে দেখা যায়।তুই চাইলে সিনিয়র অফিসারকে তা বলে একটু ইমপ্রেস করতে পারবি।”

“ইমপ্রেস ছাড়। আগে বল কি সেটা?”

“জানালা”কথাটা বলে হিমু মুখ চেপে হাসে।

মাহি ফুঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে।আসলে গাধা হিমু নয়,গাধা মাহি নিজেই যে সবসময় গুরুত্ব দিয়ে হিমুর গাধামী মার্কা কথা শুনে।ওর নামটা হিমানী না রেখে গাধামী রাখা উচিত ছিলো।মাহি মেডিক্যাল রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

____________

“মাহি নতুন টিচার এবং সদ্য ট্রেনিং শেষ করে আসার জন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে এবারের কাউন্সিলিং এর দায়ভার আপনাকে দেওয়া হয়েছে।আপনি স্যারকে আপনার সেক্টরে থাকা ক্লাস এবং মনিটরিং করা সবকিছু উনাকে সংক্ষেপে বুঝিয়ে দেবেন।”জনাব আজমল মাহিকে উদ্দেশ্য করে কথা গুলো বলে,

” ইয়েস স্যার,আই উয়িল ট্রাই অব মাই বেস্ট। ”

প্রিন্সিপ্যালের চেয়ারে বসে আছে রিয়াদ।হাতে কলম পেন্সিলের মতো ঘুরিয়ে তিনি আজমল স্যারকে জিজ্ঞেস করেন,
“আমি যতদূর জানি তাতে প্রাইমারি সেক্টরের দুজনকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো।তাহলে আরেকজন কোথায়?সে কি অনুপস্থিত?”

“তিনি বিদ্যালয়ে উপস্থিত আছে,তবে সকালে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য উনি সাময়িক সময়ের জন্য স্কুল মেডিকেয়ারে আছে।আপনি কাউন্সিলিং শেষ করে মিটিং রুমে আসেন ইনশাআল্লাহ সে ওখানে থাকবে।”

রিয়াদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়।কলমটা কলমদানিতে রাখতে গিয়ে পাশের নোটটা সরে যায়।তা দেখে প্রিন্সিপাল স্যার ফুস একটা শ্বাস ছাড়ে।দরজায় গিয়ে পেছন ফিরে বলে,
“উনি যদি বেশি অসুস্থ হয় তবে তাকে মিটিংয়ে যোগদান না করলেও চলবে।”

মাহি ভিজিটিং অফিসার হিসেবে আসা রিয়াদকে ওর সেক্টরে থাকা সবকিছু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখায়।বাচ্চাদের সাথে কথা বলায়।ওদের স্পিলিং স্কিল দেখে রিয়াদ খুশি হয়।পুরোটা সময় মাহি যদিও একটু ভয়ে ভয়ে ছিলো।মিটিংয়ে এসে সে ভয়টুকুও কেটে গিয়েছে।ও ভেবেছিলো সকালে গেইটে হওয়া ঘটনার হয়তো সিজন ২ চালু হতে পারে।কিন্তু মাহিকে অবাক করে দিয়ে রিয়াদ তেমন কিছুই করেনি।সিনিয়র অফিসার হিসেবে পুরোটা সময় তিনি মাহিকে প্রশ্ন করে গিয়েছে।মাহি কোনোটা পেড়েছে।যেটা জানে না তা সুন্দরমতো আগেই জানিয়ে দিয়েছে।

হিমুকে ওর ভাই এসে বাইকে করে বাসায় নিয়ে গিয়েছে অনেক আগেই।স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়াতে মাহি গেইট থেকে একটা অটো নিয়ে বটতলা অবদি আসে।এখন এখানে থেকে কোনো সিএনজি বা অটো পেয়ে গেলেই হয়।বাস দাড়িয়ে আছে তবে ছাড়তে অনেক দেরি।এমনিতেই মাহি বাসে চড়তে পারে না।

সামনে কয়টা অটো দাড়িয়ে আছে। মাহি ওদিকে হাঁটা শুরু করতেই আচমকা রিয়াদ এসে দাড়ায় ওর সামনে।ভুত দেখার মতো চমকে যায় সে।গায়ে শোভা পাচ্ছে সাদা শার্ট।ঘড়িতে সময়টা দেখে নিয়ে মাহিকে বললো,
“গাড়িতে গিয়ে বসুন

” কেনো?”

“কথা আছে।যদি স্বেচ্ছায় না যান তবে সকলের সামনে হাত ধরে টেনে গাড়িতে উঠাবো।দশ সেকেন্ড সময়। ইওর টাইম স্টার্ট নাউ।”

মাহি চারদিকে তাকিয়ে চুপিসারে গাড়িতে গিয়ে বসে।এর পাশেই ওর নানিবাড়ি।তাছাড়া ওদের এলাকার লোকজনকে প্রায় এদিকে দেখা যায়।হট্টগোল হলে বিপদ।রিয়াদও গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে ড্রাইভিং সিটে।ও কিছু বলার আগেই মাহি
বলে,
“দেখুন সেদিন ডেয়ার নিয়ে আমি আপনাকে কিছু বলতে এসেছিলাম ব্যাস আর কিছু নয়।”

“আমি তো সেদিনের কথা কিছু বলিনি।আমি আপনাকে গাড়িতে তুলে দেশের উন্নয়নমুলক কাজ করলাম।”

মাহি চারদিক তাকিয়ে দেখার ব্যার্থচেষ্টা করল।গাড়ির উয়িন্ডো গ্লাস উঠিয়ে দেওয়া।মাহি ভেবে পায়না ওর গাড়িতে উঠার সাথে দেশের উন্নয়নের কি সম্পর্ক।রিয়াদ মাহির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ছন্দে বলে,
“বাহিরে এতো মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে।কত বাচ্চা কাচ্চারাও আছে।বড় মানুষ আছে।কথায় আছে আজকের দিনের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যতে। এখন সেই হাজারো আগামির ভবিষ্যতের মাঝে আপনাকে কি করে ছেড়ে দিই বলুনতো?যদি ওরা আপনাকে ভুত মনে করে বা আপনি ওদের কামড়ে দেন।ওরা যদি আপনাকে ভুত মনে করে উল্টাপাল্টা কিছু করে।না না আমি এতবড় রিস্ক নিতে পারব না।”

নাহ্ মাহি ভুল ভেবেছিলো। লোকটা সত্যকার অর্থেই একটা অসভ্য। নইলে এমন উদ্ভট কথাবার্তা বলে কি করে।আচ্ছা উনি শিকল ছিড়ে পালিয়ে আসেন নি তো। মাহি নিজের রাগটাকে চাপা দিয়ে ক্রোধের সাথে বলে,

“মিস্টার আল রহমান রিয়াদ,সিনিয়র অফিসার অব এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট।আমাদের অফিস আওয়ার শেষ।এখন আপনি আমার সিনিয়র অফিসার নন।সাধারণ আমজনগন।তাই আপনি এখন কিছু বললে আমি কিন্তু ভদ্রতা দেখিয়ে চুপ করে থাকব না।”

রিয়াদ একটু ভাবে, তারপর বললো,
“ওহ্ আপনি কি কোনোভাবে কালকেও দেখা করতে চাচ্ছেন?ঠিক আছে আপনি যদি রিকুয়েষ্ট করেন আমি তা ফেলতে পারব না।আমরা অবশ্যই কালকে দেখা করব।”

মাহি মনে হয় আকাশ থেকে পড়ল।কোন কথার কোন উত্তর।লোকটাকে খুব অসহ্য লাগছে তার।সে বিস্ময় সুরে বললো,

“আমি কখন বললাম কালকে দেখা করার কথা।”

“কেনো আপনিই তো বললেন আজকে অফিস আওয়ার শেষ।আর অফিস আওয়ার শেষে কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাজ থাকতে পারে না।ঠিক আছে এত ব্যাস্ত হওয়ার দরকার নেই।আমরা কালকে আবারও দেখা করছি।”

মাহির গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে যায়।পরক্ষণেই বলে,
“ঝামেলা হয়েছিলো গাড়ি নোংরা করা বিষয়ে।সমস্যা নেই আমি সময় করে একদিন দরকার হয় আপনার বাড়ি গিয়ে গাড়ি পরিষ্কার করে দিয়ে আসব।এত বড় দেশদরদী, সুনাগরিকের বাড়ি গিয়ে গাড়ি পরিস্কার করলে আমারও একটু দেশপ্রেম বাড়বে।”

“বুঝেছি আমি চলে গেলে আপনি আমায় মিস করবেন তাই বাড়ি গিয়ে দেখা করতে চাইছেন।আসলে ছেলেরা একটু সুন্দর হলে মেয়েরা তাদের কাছে যাওয়ার জন্য বাহানা খোঁজে। এটা আমার কাছে নতুন কিছু নয়।প্রতিদিন আমায় কত যে মেয়ের প্রপোজাল রিফিউজ করতে হয়।ওহ্ আল্লাহ ”

মাহি গাড়ি থেকে বেড়িয়ে বাহিরে এসে দাড়ায়।এই লোকটাকে আর সহ্য করা যাচ্ছে না।গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রেখে রিয়াদ বলে,

“একি চলে যাচ্ছেন?”

“হুম,এখন যদি আমি না যাই তাহলে এক বিরাট দেশদরদী, সুনাগরিক আর হাজার হাজার মেয়েদের ক্রাশবয়ের মাথার চুল একটাও থাকবে না।আমি নিজেই টেনে সব চুল তুলে ফেলবো বলে দিলাম।”

রাগে মাহির নিজের মাথার চুলই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।ভাগ্যিস আশেপাশে পরিচিত কেউ ছিলো না।কেউ দেখলে কি সর্বনাশ হতো।রিয়াদ মাহির ফিরে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।সাদা কামিজে হলুদ জড়ি দেওয়া।পিঠ বেয়ে মরা সাপের মতোন পড়ে আছে বিনুনী করা চুল।রিয়াদ ভাবে এই মেয়েটা কি অলওয়েজ চুল বেণী করে রাখে?

চলবে……

রাঙিয়ে দিয়ে যাও
লেখনীতে মাহি- আফরোজ

[৯]

“বিয়ের পর তুমি পারবে সংসারের জন্য চাকরী ছাড়তে?”

ভদ্রলোকের কথায় মাহি একটু হাসে।সে মাথাটা উঁচু করে রেখে ওর বাবার দিকে একপলক তাকায়।যদিও তাকে সবসময় মাথাটা নিচু রাখার কথা বারবার বলা হয়েছে।তারপর জবাব দেয়,

“আমার সংসারে মিশে থাকবে আমার স্বামী,শ্বশুর-শ্বাশুড়ি মোটকথা সেই বাড়ির প্রত্যেকের সুখ-দুঃখ, কাজ,অর্থনীতির টানাপোড়েন সহ প্রত্যেকের জীবন যাপন।আর আমার চাকরীতে মিশে আছে আমার বাবার ঘাম ঝড়ানো হাজারো মেঘরোদ্দুরের দিন,আমার কঠোর পরিশ্রম, আশেপাশের মানুষের কটুক্তি, আমার মায়ের জেগে থাকা শত রাত,সাধারণ মিষ্টির মাহি হয়ে ওঠার ক্ষুদ্র ইতিহাস। আরো অনেক কিছু।একটা সংসার গড়ে তুলতে যেমন সকলের পরিশ্রম সাধনা থাকে ঠিক তেমনই আমার এই সাধারণ চাকরীতেও মিশে আছে অসাধারণ ত্যাগ,তিতিক্ষা আর অধ্যাবসায়। আমি না চাকরী ছেড়ে দেবো আর না সংসার ছাড়ব।আমার নিজের প্রতি বিশ্বাস আছে সংসারের পাশাপাশি নিজের স্বপ্ন পুরণের পথে হাঁটার। ”

সোফায় বসে থাকা হ্যাংলা শ্যামলা বর্ণের ছেলেটা বলে ওঠে,
“তাহলে কি করে হবে।বিয়ের পর যা বলা হবে তাই শুনতে হবে।তাছাড়া গেরস্থ বাড়ির কাজ বাদ দিয়ে সবসময় স্কুলে পড়ে থাকলে সংসার কি করে চলবে।তোমার নিজের প্রতি বিশ্বাস কি এসে রান্নাবান্নাসহ সব কাজ করে দেবে?”

লোকটার কথায় ক্ষোভ ঝড়ে পড়ে।তার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে তাকে জবরদস্তি এখানে আনা হয়েছে।মাহি চুপচাপ শুনে যায়। আবিরের বাবা প্রসঙ্গ পাল্টাতে মাহির সঙ্গে অন্য পাঁচ কথা বলে।ওরা মোট পাঁচ জন এসেছে।সাথে মাহির দাদা,কাকা আর ওর আব্বা।কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ করে সেই লোকটা আবারও বলে,

“আচ্ছা তুমি নিজে তোমার দোষ বা খারাপ দিক সম্পর্কে কিছু বলো তো।সবাইতো ভালোটা বলে, আজ তুমি নেগেটিভ দিকটা বলো শুনি?”

মাহি একটু অবাক হয় লোকটার কথা শুনে।ওই লোকটার পাশে যে হ্যাংলা করে লোকটা বসা ওটা আবিরের বোনের স্বামী।ওর নাম আলী হবে হয়ত, রাশেদ একবার বলেছিলো।এতক্ষণে মাহি তাকে চিনতে পেরেছে।

“আমরা চোখ দিয়ে দুনিয়ার সবকিছু দেখতে পাই।অথচ সেই চোখে সামান্য কিছু পড়লে আমরা অন্যের দারস্থ হই।কারণ পুরো দুনিয়া দেখার ক্ষমতা রাখলেও আমাদের চোখ কিন্তু আপন অন্তর দেখতে পায়না।ঠিক তেমনই আমরা অন্যান্য লোকদের দোষগুন আলোচনা করতে পারলেও নিজের ভুলটা ধরতে পারিনা।একজন মানুষ হিসেবে চোখের মতো আমিও ব্যার্থ আপন দোষ ধরতে।এটা কেবলমাত্র অন্যরাই পারবে।”

আলী একটু বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করে,

“তা তোমার বয়স কত?”

“চব্বিশ ”

“এটা কি সঠিক নাকি মুখস্থ হিসেব।”

“আমার বয়স হিসেবে এটা একদম সঠিক। আপনি যদি এটা আমার দাদার কিংবা আপনার বয়স হিসেবে ধরেন তাহলে মুখস্থ কিংবা ভুল হতে পারে।”

মুখের ওপর সঠিক উত্তর দেওয়ায় আলীর মুখটা দেখার মতো।মাহির দাদী দরজার আড়াল থেকে এসে মাহিকে আস্তে করে বলে সে জেনো মাথাটা নিচু করে রাখে আর কথার উত্তর ত্যাড়া করে না দেয়।অন্যরা হালকা নাস্তা খেলেও আলী কিছুই মুখে দেয়নি।সে ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুরছে মাহিকে অপমান করার জন্য।সে বেহায়ার মতো আবারও বলে,
“আবির, রাশেদ এদেরকে কেমন করে চিনো?”

“সে আলোচনা সমালোচনা শুনে আপনারা আজ এখানে ঠিক সেভাবেই সেই কারণেই আমি আবিরকে চিনতাম।আর রাশেদের কথা সম্পুর্ণ ভিন্ন। ও আমার খুব ভালো একজন বন্ধু। ”

আবিরের বাবা বুঝতে পেরে আলীকে থামিয়ে দেয়। মাহির দাদা ওকে ঘরে চলে যেতে বলে।আবিরের চাচা পকেট থেকে টাকা বের করার আগেই মাহি সালাম দিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে চলে যায়।মোতাহার নিরবতা ভেঙে বললো,

“আপনারা এসেছেন, খাওয়া-দাওয়া করেন গল্প-
গুজব করি ঠিক আছে।যদি বিয়ের কথা বলেন তো আমার একটাই কথা।আমরা আলোচনা করে পরে জানাবো।”

মাহির দাদাও একই কথা বলে।

মাহি নিজের রুমে গিয়ে বসে।আবিরের বাড়ির লোকজন বিয়ে নিয়ে কথা বলতে চাইলেও মোতাহারেরা কথা আগায় না।নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে তবেই সিদ্ধান্ত জানাতে চায় মাহির আব্বা।

আলী বাহিরে বারান্দায় দাড়িয়ে মাহির দাদাকে বলে
“নাতনি বিয়ে দিতে হবে না, ঘরের খুঁটি করে রেখে দিয়েন?”

আলী মাছের কারবারে মাহির দাদার সাথে পরিচিত।তাই মাহির দাদা সাঈদ পুরোনো ঘরের একটা খুঁটি হালকা নাড়িয়ে আলিকে বলে,

“এই খুঁটিটা বড্ড নড়বড়ে লাগছেরে আলী।তোমার কথায় দাম আছে বৈ কি।”

______________
চিরপরিচিত কফি হাউজে বসে আছে ওরা সবাই।মাহি প্রথম থেকে শেষ অবদি সবটা সবাইকে বলে।মাহির কথা শুনে সিয়াম বলে,
“তোর নিজস্ব ব্যাক্তিগত মতামত কি আবির সম্পর্কে? ”

“আমার ভেতরে এক মিশ্র অনুভূতি বিরাজমান।আমি আমার স্বাভাবিক জীবনেই ঠিক ছিলাম।আজ এতদিন পর অতীত যখন সামনে এসেছে তখন আমি নিজেই কনফিউজড। ”

রাশেদ মাহির সব কথা শুনে।অনেকক্ষণ মৌনাবলম্বন করে বলে,

“তুই এতটাই কনফিউজড যে ওরা তোকে দেখতে গেলো আর তুই সেজেগুজে গিয়ে ওদের সামনে বসলি।তোর কি আত্মসম্মান নেই?তুই আমায় উত্তর দে কেনো গেলি ওদের সামনে?”

রাশেদ অনেক ক্ষুব্ধ স্বরে কথাগুলো বলে।বাকিদের সাথে মাহিও অবাক।কখনও রাশেদকে এতটা রাগান্বিত হতে দেখা যায়নি।মাহিকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে রাশেদের রাগটা আরও বেড়ে যায়।সে মাহির হাতটা চেপে ধরে টেনে তুলে চেয়ার থেকে।মুখটা কাছে এনে বলে,
“তোর সাথে আমার সম্পর্ক এক দুই বছরের নয় মাহি।পুরো নয় বছরের সম্পর্ক।আর ভাইয়ার সাথে তোর সম্পর্ক বোধহয় একবছরও ছিলো না।অথচ এত বছর তোর পাশে থাকার মুল্য তুই এভাবে দিলি।”

মাহি চোখ বেয়ে পানি পড়ে।সে রাশেদের ব্যাবহারে অত্যন্ত কষ্ট পাচ্ছে।এই রাশেদকে চিনতে তার বড্ড কষ্ট হচ্ছে।নয়টা বছর কম সময় নয়।রাশেদ নিরন্তরভাবে মাহির পাশে থেকেছে।কিন্তু এই পাশে থাকার মুল্য মাহি কিভাবে দেবে রাশেদকে। তবে কি রাশেদ….?কথাটা ভাবতেই আঁতকে ওঠে মাহি।

“দ্যাখ তাকিয়ে আছে কেমন করে?” সে স্নেহার দিকে তাকায় বলে,”তোরা মেয়ে জাতটাই বেঈমান জানিস?আসল নকল বোঝার চেষ্টা করিস না।”

সিয়াম এগিয়ে আসে রাশেদের কাছে।ও কিছু বলার আগেই মাহি বলে,
“দ্যাখ রাশেদ আমি কখনও ভাবিনি তুই কখনও তোর অমুল্য বন্ধুত্বের মূল্য চাইবি?”

“তুই বুঝনি কেমন করে?তুই তো বোধহীন।অথচ এই বোধহীনের জন্য আজ বাড়িতে অশান্তি করতে হলো।”

“রাশেদ শান্ত হ,ভুলে যাস না আমরা সবাই সবার খুব ভালো বন্ধু। ব্যাস,এর বেশি একচুলও নয়।তোকে দেখে আমার ভয় হচ্ছে। তুই কি…..এমনটা হলে কিন্তু এতদিনের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে।”সিয়াম রাশেদকে চেয়ারে বসিয়ে শান্ত করার উদ্দেশ্য কথাগুলো বলে।

” মাহি আমার শুধু বন্ধু নয় সিয়াম।আরো অনেক কিছু।”

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here