রাঙিয়ে দিয়ে যাও,পর্ব:১২,১৩

0
956

রাঙিয়ে দিয়ে যাও,পর্ব:১২,১৩
লেখনীতে -মাহি আফরোজ
[১২]

বৃহস্পতিবার স্কুল শেষে সে সোজা ওর বড় মামার বাড়ি এসেছে।কি একটা দরকারে ও মামা আসতে বলেছে তাই।আর আজ সকাল সকাল তিনি মাহি আর নাফিসাকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছে।তিনজন একসাথে বের হলেও এখন মাহি একা।এই জায়গায় সামনেই ছোট একটা ক্লিনিক। বেশ নিরিবিলি জায়গা।দু একজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। কেউ দোকান খুলছে মাত্র। ও ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশের বেঞ্চিতে বসে পড়ে।আসলে ওর অভ্যাস নেই।তাছাড়া ঘুমও পাচ্ছে খুব।ইচ্ছে করছে এখানেই ঘুমাতে।বসা থেকে উঠে ও পাশেই দাড়িয়ে থাকা এক গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে থাকে।

রাস্তা দিয়ে একটা ছেলেকে আসতে দেখা যাচ্ছে। গায়ে সাদা টি-শার্ট। বোঝাই যাচ্ছে সকালে হাঁটতে বেরিয়েছে।নাহ্ ছেলেটা এদিকেই আসছে।আস্তে আস্তে যখন লোকটা ওর কাছে চলে এলো তখন মাহির চোখ কপালে।সে ভুল দেখছে না তো!এটাতো সেই অদ্ভুতকিমাকার রিয়াদ স্যার।মাহি চোখদুটোতে রাজ্যের বিস্ময়।এ এখানে কি করে?রিয়াদ মাহির কাছাকাছি এসে থেমে যায়।রিয়াদ যারপরনাই আশ্চর্য হয় মাহিকে দেখে।তবুও সে বিস্ময়ভাবটা চেপে রেখে নিশ্চিত হয় এ আসলেই মাহি নাকি ওর ভ্রম।

“আমায় খুব মিস করছিলেন বুঝি?”

“আপনাকে কেনো আমি মিস করতে যাবো?”

“আরে বলতে হবে না,এগুলো আমার কাছে নতুন কিছু নয়।প্রায়ই আমাকে এমন হাজারো মেয়েকে সামাল দিতে হয়।” রিয়াদ এমন ভাবে কথাগুলো বলল যেনো সে একজন সেলিব্রিটি।

মাহি চোখদুটো গোল গোল করে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো।রিয়াদের কথা শুনে বলল,”নিজেকে সালমান খান মনে করেন বুঝি?যে মেয়েরা আপনার সাথে ডেইটে যাওয়ার জন্য বাড়ি এসে হানা দেয়।”

“উহু সালমান খান নয়।আমিতো বিয়ে করতে চাই।দেখুন আমি সালমান খান হলে আপনাকে তো চিরকুৃমারি থাকতে হবে তাইনা।আর একটা ঝগরুটে
বোকা মেয়ের যদি বিয়ে না করে তাহলে দেশটা ভালো মানুষে ভরে যাবে।তখন এই এত ভালো মানুষের ভীড়ে আমার মতো প্রতিভা হারিয়ে যাবে।যা আমি কখনওই হতে দেবো না।”

কথাগুলো শুনে মাহি একবারে হতবাক।ও জানত এমন কিছু ত্যাড়া কথাই তাকে শুনতে হবে।সে পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

“আপনার বিয়ের সাথে আমার চিরকুমারী হওয়ার কি সম্পর্ক? ”

রিয়াদ অবাক হওয়ার ভান করে বলে,”সে কি এই টি-টা,খানা-খানির সম্পর্ক আপনি বুঝেন না।ওহ্ আল্লাহ! আচ্ছা ব্যাকারণে কি শুধু টিটিপি করেই এসেছেন। ”

মাহি বরাবরই বাংলা ব্যাকারণ অংশ আর ইংরেজি গ্রামারে দুর্বল।ওর খুব বিরক্ত লাগে এগুলো পড়তে।তাই ব্যাকারণ নিয়ে খোঁচা দেওয়াতে তার গা জ্বলে যায়।তাছাড়া রিয়াদের খাপছাড়া কথাবার্তায় সে খুবই বিরক্ত। সিনিয়র হওয়াতে সে কিছু বলতেও পারছে না।আছে যেহেতু সে ওই বিষয়ে দুর্বল, যদি এই লোকটা তা জানতে পারে তবে ভবিষ্যৎ এ ওর জন্য বিপদজনক। সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে,

“আপনি না বললেন মেয়েরা আপনার পেছনে সবসময় লাইন দিয়ে বেড়ায়।অনেকক্ষণ তো হলো কোনো মেয়ের মাথার চুলও তো নজরে পড়ছে না।”

রিয়াদ এদিক ওদিক তাকিয়ে মাহির একটু কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,”মিস চিনি তার মাথার চুল আপনি কি করে দেখবেন,আমিই তো দেখতে পাচ্ছি না।”

মাহি সন্ধিহান চোখে রিয়াদকে পরখ করে বলে,”কেনো?”

রিয়াদ সোজা হয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,”কারণ তার লম্বা চুলগুলোর খোঁপা ওড়না দ্বারা ঢেকে রাখা হয়েছে।”

মাহি নিজের অজান্তেই ওর মাথার হাত দেয়।নিজের খোঁপা করা চুলটা টেনে ধরে।চোখটা বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।মাথা দিয়ে মনে হচ্ছে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।সে রাগান্বিত স্বরে কিছু বলার আগেই রিয়াদ ওকে হাত দিয়ে দুরে ইশারা করে একটা মেয়েকে দেখায়।মেয়েটা এতক্ষণ হেঁটে আসলেও হাত ইশারা করা দেখে জোড়ে জোড়ে হাঁটতে শুরু করে এবং শেষে দৌড়ে আসতে থাকে।তা দেখে রিয়াদ মুখে হাত দিয়ে মিথ্যে বিস্ময় দেখিয়ে মাহিকে বলে,
“দেখেছো মেয়েরা আমাকে কতোটা ইমপোর্টেন্স দেয়।প্রথমে হেঁটে আসলেও আমাকে দেখে দৌড়ে আসছে।”

মাহি চোখদুটো ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে রিয়াদের দিকে।একটা মানুষ কতটা চাপাবাজি করতে পারে।সে চোখমুখ শক্ত করে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ও আপনার কাছে নয় বরং আমার কাছে আসছে।ও আমার কাজিন নাফিসা।”

পাশের বেঞ্চিতে বসে হাতদুটো দুদিকে মেলে দিয়ে রিয়াদ বলে,

“আমি জানি ওর নাম নাফিসা।”

মাহি রিয়াদের কাছে আসে।অবাক হয়ে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে থাকে।সে ভেবে পায়না রিয়াদ নাফিসাকে কি করে চেনে।ততক্ষণে নাফিসা ওদের কাছে চলে এসেছে।রিয়াদ বলে,আরে এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই।নাফিসা আমার শালিকা হয়।”

“শালিকা মানে?”

“ওমা শালিকা মানে হলো বৌয়ের ছোট বোন।এটাও জানেন না।আমাকেই দেখছি বুঝিয়ে শুনিয়ে নিতে হবে সব।”

“শালিকা মানে বৌয়ের বোন তা আমি জানি।কিন্তু ওর কোন বোনের অকর্মণ্য, গুনোধর পতিদেব আপনি তাই জিজ্ঞেস করছি?আর আমি কিছু না জানলে আপনাকে বোঝানোর দায়িত্ব কে দিয়েছে?”মাহি রিয়াদকে প্রশ্ন করে।

রিয়াদ নাফিসার কাছে গিয়ে দাড়ায়।নাফিসা এসে থেকে ওদের ঝগড়া শুনে যাচ্ছে। এভাবে রাস্তায় দুজন অচেনা মানুষ ঝগড়া করছে তা দেখেই নাফিসা চুপ হয়ে আছে।রিয়াদ নাফিসাকে বলে,

” আচ্ছা নাফিসা তোমার আর কোনো বড় বোন নেই বুঝি,নাকি মিস চিনি একাই?”

“না ভাইয়া, আমারও আরো কাজিন আছে।”

রিয়াদ মাহির চারপাশে ঘুরতে থাকে।বলে,
“বি পজিটিভ চিনি ম্যাম।আপনি বোধহয় নাফিসার সেই বোনের জায়গায় নিজেকে ভেবেছিলেন। যাক কোনো ব্যাপার নয় এমন ঘটনা হরহামেশাই হয়ে থাকে।আপনাদের কাছে নতুন হলেও আমার কাছে একেবারে পুরোনো। সব মেয়েরা আমাকে নিয়ে ভাবতে পছন্দ করে”

মাহি আর কত মনে মনে গালি দেবে।আসলে দোষটা ওরই যে বারবার তার সামনে আসে।রিয়াদের চোখেমুখে দুষ্টুমির হাসি।সে মুখে হাসি বজায় রেখে বলে,
“একজন সিনিয়র হিসেবে জুনিয়রকে সব বুঝিয়ে দেবার দায়িত্ব আমাকে গভর্নমেন্ট দিয়েছে।তাছাড়া ট্রেনিং এ আপনি আমার ইউনিটেই কাজ করবেন।আমি এই দায়িত্বের কথাই বলেছি।এখন এটা যদি কেউ অন্য দায়িত্ব ভেবে থাকে তাহলে সে দায়ভার আমার নয় নাফিসা।”

মাহির ইচ্ছে করছে রাগে ওর মাথার চুলগুলো ছিঁড়ে ফেলতে।শুধু সিনিয়র বলে পার পেয়ে যাচ্ছে।রিয়াদের মুখের হাসি দেখলে ওর গা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। কি মনে করে লোকটা নিজেকে। প্রিন্স চার্মিং নাকি আরো অন্যকিছু।এত অসহ্যকর আর গায়ে পড়া লোক মাহি আর দেখেনি।তার চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে “এই লোকটা বেয়াদব,অতি অসহ্যকর।”

_____________

মেইনরোডটার পাশেই বড় সাদা রঙের বাড়িটা দাড়িয়ে আছে।রোড থেকে বাড়ির গেইট অবদি পিচ ঢালাই করা।গেইটের সামনে দুটো গাড়ি রাখা একটা সাদা অপরটি মেরুন রঙেয়।লোহার গেইটটা পেরিয়ে ভেতরে কিছু জায়গা। গাড়িগুলো এখানেই রাখা হয় বোধহয়।পাঁচতালা বিল্ডিং।লিফটের প্রসেস করে রাখা হয়েছে, এখনও লিফট বসানো হয়নি।সিড়ি দিয়েই যাতায়াত করে সবাই।
রেলিং ধরে ধরে তিনতালা অবদি গিয়ে একটা বড় খয়েরি রঙের দরজার সামনে দাড়িয়ে কলিং বেল চাপলেন আজমির দেওয়ান।পরনের পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি সকালে হাঁটতে বেড়িয়েছিলেন।কিছুক্ষণ পর দরজাটা খুলে দেয় বিশ বছর বয়স্কা এক মহিলা।আজমির সাহেব ভেতরে ঢুকে সোজা হাতের বামদিকের ড্রয়িংরুমে গিয়ে সোফাতে বসে পড়েন।ভেতর ঘর থেকে আওয়াজ আসে,
“কে আসল রে চুমকি?”
চুমকি কড়াইয়ে খুন্তি নাড়ানো বন্ধ করে উত্তর দিলো”খালুজান আইছে খালাম্মা।”

ড্রয়িংরুমের পশ্চিমে জানালা,দক্ষিণের ওপরের দেয়ালে বড় একটা এলইডি আর নিচে চকচকে কালো রঙের দুটো সোকেশ।যাতে হরেক রকম পুতুল,শো-পিস,আরো অদরকারী বিলাসবহুল তৈজসপত্র,অনেক চুড়ি আর গিটার।চারদিকে দেয়াল ঘেষে অনেকগুলো সোফা। ছাদের মাঝখানটায় একটা সুন্দর ঝাড়বাতি আর তার নিচেই একটা টি-টেবিল।ড্রয়িংরুম দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাড়ির মালিক একজন রুচিবোধসম্পন্ন মানুষ। ড্রয়িংরুমের দরজার জায়গায় ঝুলে থাকা ঝুলরটা ভেদ করে হাসিমুখে এগিয়ে আসে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা।হাতে এক গ্লাস পানি।ভদ্রমহিলার চোখে মুখে আন্তরিকতার ছাপ।পানিটা খেয়ে আজমির সাহেব বলেন,
“একটা ভালো খবর আছে বুশরার মা।”

ভদ্রমহিলা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”বলুন কি সেই খবর।”

“আজ ওই মেয়েটাকে আবারও দেখেছি।যার কথা তোমায় বলেছিলাম।কি মিষ্টি দেখতে কি বলব।সেদিন রাতে দেখলেও আজ সকালে দেখেছি।”

“আপনি চাইলে তাকে বাসায় আনতে পারতেন।এই সুযোগে আমিও একটু দেখতাম।”

“আরে একজন ভদ্রমহিলা আর বুশরার মতো একটা মেয়ের সাথে হেঁটে যাচ্ছিলো ও।কি গিয়ে কি বলব।সাথের লোকদের তো আমি চিনি না।”

ভদ্রমহিলা একটু ভেবে তারপর বলে,”ছেলে এখন বড় হয়েছে।তার মতামত না নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা কি ঠিক হবে।তাছাড়া তার নিজস্ব পছন্দ থাকতে পারে।”

আজমির দেওয়ানকে এবার একটু কঠিন দেখালো।উনি বললেন,
“আমি বাবা হয়ে ছেলের জন্য খারাপ কিছু করতে পারিনা সাবিহা।আর ওর পছন্দের কেউ থাকলে নিশ্চয়ই এতদিন বাড়ি বইয়ে এসে ঘুরে যেতো।তা যখন যায়নি তখন কেউ নেই।আর আমার সিদ্ধান্ত তাকে মানতে হবে।”

কথাগুলো বলে আজমির সাহেব চলে গেলেন।সাবিহা একা একা ড্রয়িংরুমে বসে ভাবতে থাকে আর তাকিয়ে থাকে দেয়ালে ক্যালিওগ্রাফি করে লেখা, “আল রহমান রিয়াদ” এর দিকে,,

চলবে………

রাঙিয়ে দিয়ে যাও
লেখনীতেঃমাহি আফরোজ

[১৩]

মাহি আর হিমু মিলে ওদের স্কুল থেকে ট্রেনিং এ এসেছে।আরো অন্যস্কুল থেকে পাঁচজন আর সিনিয়র অফিসাররা মোট পাঁচজন এসেছে।একটু আগেই সবাই মিলে একটা হলরুমে কনফারেন্স করেছে।ঢাকায় একটা বিশেষ ট্রেনিং এ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক অফিসাররা আর টিচাররা এসেছে।

হিমু চুপিসারে স্যারের ফাইলের ভাঁজে একটা কাগজটা রেখে দেয়।যে ফাইলটা মাহি নিজে লিখে কমপ্লিট করেছে।মাহি বিকেল চারটার দিকে মিটিংরুমে যায়।ওদের সেক্টরে আসা অফিসারদের মাঝে রিয়াদও আছে।মাহি ফাইলটা নিয়ে গিয়ে রিয়াদকে দেয়।

রিয়াদ ফাইলটা খুলে প্রথম পাতাতেই আটকে থাকে।কাগজটা নিয়ে পড়ে।ফাইলটা টেবিলে রেখে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়।মাহি বুঝে উঠতে পারে না ওর কি চলে যাওয়া উচিত।

———“এই ফাইলটা কি আপনি লিখেছেন? ”

——–“জ্বী স্যার, আমিই লিখেছি।”

রিয়াদ খুব কড়া ধাঁচের কাজের দিক দিয়ে।মাহি ফাইলটা অন্তত সাতবার চেক করে তবে নিয়ে এসেছে।মাহি ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করে,

———-“স্যার কোনো ভুল হয়েছে কি?”

রিয়াদ হেসে উঠে ওকে বলে না কোনো ভুল হয়নি।আপনার হাতের লেখা যথেষ্ট সুন্দর। তাই অনেকক্ষণ দেখছিলাম।মাহি অনুমতি নিয়ে ফিরে আসতে গেলে
রিয়াদ যথেষ্ট নম্রভাবে মাহিকে বলে আপনি বোধহয় এটা ভুল করে এখানে রেখে দিয়েছেন।মাহি ভেবে পায়না কোন জিনিসের কথা বলছে রিয়াদ।একটা সাদা কাগজ হাতে ধরিয়ে মাহিকে।রুম থেকে বের হয়ে মাহি কাগজটা খুলে পড়তে থাকে।

মিস্টার অসভ্য,
আপনাকে দেখলে আমার গাঁ জ্বলে যায়।আপনার মুখের হাসি দেখলে মনে হয় করলার ফ্রাই খাইয়ে দিই।আপনি একটা ইডিয়েট।আপনি যেনো পচাঁ কাদায় পড়ে যান।মুখটা যেনো কাদায় মাখামাখি হয়।আপনার পাবনায় যাওয়াউচিত ………..
……………”

এমন হাজারো কথাবার্তায় ভরা চিঠিটা মাহির নিজের হাতের লেখা।কিন্তু ও রিয়াদের জন্য লিখেনি।বরং হিমু ওকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলো কাউকে দেবে বলে।কিন্তু হিমুর পাতা ফাঁদে সে আটকা পড়ে গেলো।তাইত কি সুন্দর করে স্যার মাহির সাথে পুরোটা সময় কথা বলেছে।আসলে ওটা ছিলো ঝড়ের পুর্বে প্রকৃতির শান্ত রুপ।এখন ওই ভয়ংকর লোকটা কি আমায় এমনিতেই ছেড়ে দেবে।ওহ্ আল্লাহ্ আমাকে বাঁচাও। এমন কথার মাঝেই রিয়াদ সেখানে হাজির।মাহি এখন কি করবে। রিয়াদ নরমালি এসে ওর পাশ কাটিয়ে চলে যায়। যেনো ওকে দেখতেই পায়নি।

——–“দুই মিনিটের মধ্যে মিটিং রুমে আসুন মিস চিনি।”

এমন লেখা নিয়েই একটা ম্যাসেজ মাহির ফোনে আসে।বুঝতে বাকি রইলো না ওর কপালে আজ কি আছে।একবার ভাবল ও যাবে না।কিন্তু রিয়াদকে ও চেনে।কতটা গায়েপড়া লোক।দরকার হলে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবে।সেদিনের কথা আজও মনে আছে।স্কুলে গিয়ে প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে মাহিকে হাত ধরে সবার সামনে দিয়ে নিয়ে এসেছিলো।আর গ্যারেজে নিয়ে গিয়ে গাড়ি ওয়াশ করে নিয়েছিলো।

———“আসলে স্যার এই লেখাটা আপনাকে নিয়ে লিখিনি।আপনি প্লিজ এবারের মতো মাফ করে দিন।”

রিয়াদ বরাবরের মতো শান্ত থেকেই মাহিকে ইশারায় বসতে বলে।মাহি চেয়ার টেনে বসে পড়ে।মনে মনে তৈরি হয় রিয়াদের বিভিন্ন অযৌক্তিক আর উদ্ভট কথা শোনার জন্য। কিন্তু রিয়াদ একেধারে সামনে রাখা ফাইলটা দেখেই যায়।মাহি আড়চোখে দেখতে থাকে রিয়াদকে।ও ফাইলে চোখ রেখেই বলে,

———“দেখতে ইচ্ছে করলে সরাসরি দেখুন আমার আপত্তি নেই।কিন্তু এভাবে চুরি করে দেখবেন না।”

নিজেকে কি মনে করে আল্লাহ ‘ই জানে।উফ!কি ঢং।চারদিকে নিস্তব্ধ। অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও রিয়াদ কিছু বলে না।মাহি উসখুস করে।এসির বাতাস ওর ভালো লাগে না।শ্বাস নিয়ে মনে হয় ডুপ্লিকেট অক্সিজেন ভেতরে যাচ্ছে। এই পিনপিন নিরবতা ভেঙে রিয়াদ উষ্ণ গলায় বলে,

——–“কাউকে ভালোবাসেন মিস আফরোজ?”

মাহি একটা সাধারণ কথায় চমকে ওঠে।স্যারের এমন কথাবার্তা আর স্বভাবে সে অভস্ত নয়।কথাটা একটা বাক্যের হলেও তার ওজন কয়েক টন।মাহি ভেবে পায়না ও কি জবাব দেবে।মাহি বসা থেকে উঠে দাড়ায়।রিয়াদ এসে ওর কাছে দাড়িয়ে থাকে।মাহি ধরা গলায় বলে,

“আমার কাজ আছে স্যার।আমায় যেতে হবে।”

মাহি ফিরে যেতে উদ্যত হতেই রিয়াদ ওর আরও কাছে এসে দাড়ায়।রিয়াদের গায়ের মিষ্টি পারফিউমের গন্ধ এসে বাড়ি খাচ্ছে মাহির নাকে।মাহি অবাক হয়ে যায়।বন্ধ ঘরের এমন দৃশ্য যদি কেউ দেখে ফেলে তবে।

“—-আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আমি পাইনি?”

মাহি বিনাবাক্যে রুম ছেড়ে বাহিরে যায়।পেছনে রেখে যায় এক প্রেমিক পুরুষ।যে তার গোপনে তাকেই ভালোবেসেছে।আর লুকিয়ে রেখেছে নিজের থেকে।

—মিষ্টি ”

ডাকটা শুনে অবাক হয় মাহি।এই ঢাকা শহরে তাকে এই নামে ডাকার মতো কেউ নেই।মাহি কৌতুহল চেপে রেখে পেছনে ফেরে।ভুত দেখার মতো চমকে ওঠে সে।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না মাহি।নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ে,

——-আবির,

_____________

নারদ নদীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর তীরে একটা দোতালা ডুপ্লেক্স বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে আছে আজমির দেওয়ান।খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পেরেছে মেয়েটা এই বাড়ির।অনেক ফলমুল আর মিষ্টি নিয়ে এসেছেন উনি।একবার পকেটে হাত দিয়ে ছোট্ট একটা রিং বক্স চেক করে আবার রেখে দেন।একবার যদি মাহির বাবা রাজি হয় তবে উনি মাহিকে আংটি পড়িয়ে আসবেন।

নাফিসার মা ঠিকমতই জানে ভদ্রলোক যে মেয়েটির কথা বলছে সে নিশি নয় বরং ওর ননদের মেয়ে মাহি।কিন্তু ঘটক একটু আগে ছেলে আর ছেলের বাপের সম্পর্কে যে সকল কথা শুনিয়েছে তাতে উনি সত্যি কথা বলে দেওয়া বাদ দিয়ে নিশিকে সাজাতে ব্যাস্ত।উনি মাহিকে ভালোবাসেন ঠিকই কিন্তু এত বড় একটা সমন্ধ হাতছাড়া করতে উনি চায়না।

নিশি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে থেকে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। সে এখন বিয়ে করতে চায়না।ওর বাবাও এখন বাসায় নেই।নাফিসা ওর আম্মুকে ভয় পায়।তাইত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সে সত্যিটা দেওয়ান সাহেবকে বলতে পারছে না।যথাসময়ে নিশিকে উপস্থিত করা হয় সকলের সামনে।কিন্তু একি!নিশিকে দেখে আজমির সাহেব অবাক।এটাতো সেই মেয়ে নয়।উনি অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে থাকে ঘটক মোস্তফার দিকে।নিশিকে প্রশ্ন করা হলে ও কিছু না বলে নিরবে অশ্রুবিসর্জন দেয়।

আজমির সাহেবের বুঝতে বাকি হয় না আসল ঘটনা।উনি মোস্তফাকে পাঠিয়ে দেয় নিশির মায়ের কাছে যাতে উনি মাহির পরিচয় দিতে পারে।কিন্তু নিশির মা বিষয়টাতে ক্ষুব্ধ হয়।সে সাফ জানিয়ে দেয় সেদিন নিশিই ওদের সাথে ছিলো।

বড় আশা নিয়ে আসা আজমির দেওয়ান বাসা থেকে বের হয় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে।অনেক অনুরোধ করার পরেও ওরা মাহির আসল ঠিকানা দেয়নি।মাকে লুকিয়ে নাফিসা দৌড়ে আসে দেওয়ান সাহেবের কাছে।বলে,আমি যদি কোনোদিন আপনার সাথে দেখা করতে চাই তবে কি করব?”

নাফিসার কথায় আজমির একটু হাসে।পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে নাফিসাকে দিয়ে গাড়িতে উঠে চলে যায়।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here