রাঙিয়ে দিয়ে যাও,পর্ব:১৪,১৫
লেখনীতে -মাহি আফরোজ
[১৪]
“আপনি এখানে?” আবিরকে এখানে দেখে আশ্চর্য হয় মাহি।সে একা আসেনি।সাথে আলীও এসেছে।আলীর তীর্যক দৃষ্টি উপেক্ষা করে মাহি আবারও বলল,”আপনি এখানে কেনো এসেছেন?”আবির কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই আদেশের সুরে বলে,”দরকার আছে মিষ্টি ।গাড়িতে উঠে বসো।”মাহি কিঞ্চিৎ হাসে।এই পার্কিং এড়িয়ায় দাড়িয়ে ওর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।তাও আবার আলীর সামনে।আবির আবারও বলে,”শুনতে পাওনি নাকি? “মাহি মুখে হাসি রেখে আবিরের দিকে তাকায়।ওই চোখের মায়ায় হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো ওর।কিন্তু নিয়তির লিখন ভিন্ন। সে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলে,” আমি শুনতে পেয়েছি।কিন্তু আমি কেনো যাবো?আপনার সাথে যাওয়ার একটা কারন অন্তত বলুন। “আবির কিছু বলতে উদ্যত হতেই আলী মাঝখান থেকে ফোড়ন কেটে বলে,
” এত ভাব নেওয়ার কি আছে বুঝলাম না।কুমারী হলে না হয় কথা ছিলো।তোমার ভাগ্য ভালো তাই আবিরের মতো অবিবাহিত ছেলে তোমায় বিয়ে করতে চাচ্ছে। আমি হলে পঁচা শামুকে পা কাটা তো দুরের কথা ওদিকে ফিরেও তাকাতাম না।”
আবির আলীর দিকে চেয়ে বলে,”এখন চুপ করো তো আলী।”পুনরায় মাহির দিকে চেয়ে বলল,”মিষ্টি আমার রাগ বাড়িয়ো না। ভালোয় ভালোয় আমার সাথে বাড়ি চলো।তারপর কথা না শোনার বিচার হবে।”
মাহি মুখ চেপে ধরে হাসে।সত্যি এখন ওর খুব হাসি পাচ্ছে।ও কি বোকাই না ছিলো।এই এতগুলো বছর ধরে সে ভেবে এসেছে আবির ওকে ভালোবাসে।অথচ রাশেদ নিত্য ওকে বোঝাতো।ও হয়ত চিনতো আবিরকে।একই রক্ত বলে কথা।মাহিকে হাসতে দেখে আবির রেগে যায়।মাহির মতো একটা মেয়ে ওকে ইগনোর করছে এটা ওর ইগোতে লেগেছে।আবির মাহির চেয়েও বেটার কিছু ডিজার্ভ করে।আগে মাহিকে যা বলা হতো মাহি বিনাবাক্যে সব শুনত।কিন্তু এখন সব লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে।চাকরীটা পেয়ে মাহি বড় বাড় বেড়েছে।মাহি ঠিক যখনই কবুল বলবে তার পরই চাকরীর রিজাইন ফর্মে ওকে দিয়ে সই করিয়ে নেবে।তখন ঠিকই ও মিষ্টি হয়ে ওর সব কথা শুনবে।আবিরের এতসব ভাবনার মধ্যে মাহি বলে,
“আমি যেকোনো কাজ করার আগে প্রথমে নিজেকে জিজ্ঞেস করে নেই আর দ্বিতীয়ত আব্বাকে।আমি অনুমতি নিয়েই এখানে এসেছি।আজ অফিসিয়াল কাজ শেষ। কালকের মধ্যেই বাড়ি ফিরব।কারো হেল্প আমার লাগবে না।”
“এতদিন যা হয়েছে তা আমি জানিনা।কিন্তু এখন আমি যা বলব তাই হবে।তুমি আমার কথা শুনতে বাধ্য মিষ্টি। ” আবিরের কথাগুলো কঠিন শোনালো।আলী মুচকি হাসে।মাহি যেনো ওদের নিজস্ব প্রোপার্টি।এতক্ষণ ভালোভাবেই কথা বললেও এখন মাহি বেশ রুক্ষস্বরে বলে,
—“কেনো আমি আপনার কথা শুনব?আপনি আমার কে হন?ভাই,কাকা-চাচা,নাকি হাজবেন্ড।আপনার সাথে আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই,আর না আছে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক।নয়বছর আগে যা ছিলো সব ভুলে গেছি আমি।আপনার জন্য কম কষ্ট পাইনি আমি।অপমান আর অপদস্ত হতে হয়েছে যেখানে সেখানে।আপনাদের পরিবারের কারণে আমি শুধু আত্মহত্যাই করিনি।কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঠিকই পুরে মরেছি প্রতিনয়ত।কই আপনি তো কখনও খোঁজ নেননি আমার।তখন দিব্যি অন্যের সাথে টাইমপাস করেছেন।সব জানি আমি।কোনোটাই অজানা নয় আমার কাছে।”
মাহির কথায় আশ্চর্য হয় আবির।ও কখনও ভাবেনি মাহিকে পেতে গেলে এতকিছু পোহাতে হবে।এই দুনিয়ায় কিছু কিছু মানুষ আছে যারা গিভ এন্ড টেক পলিসির শুধু টেক’টাকেই ফলো করে।ওরা সব ভালো ডিজার্ভ করে।কাউকে অবহেলা আর অপমানের সাগরে ভাসালেও ওরা চাওয়া মাত্রই কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি তারা পেয়ে যাবে।আবির তাদের মধ্যেই একজন।
মাহি আলীর দিকে তাকিয়ে বলে,”হ্যাঁ আমি ডিভোর্সী।দুনিয়া ওলটপালট হয়ে গেলেও আমি ডিভোর্সীই থাকবো।এটা আমার নির্ধারিত ভাগ্য।আমি ডিভোর্সী এতে কোনো পাপ নেই।আমি বুকে হাত রেখে হাজারও অবিবাহিত মেয়ে-ছেলের সামনে চিৎকার মেরে বলতে পারবো, “সবাই জেনে রাখো আমি একজন ডিভোর্সী মেয়ে।” এর কারণ যে ব্যাক্তিটি আমায় ছুঁয়েছে সে কোনো পরপুরুষ নয়,বরং সবাইকে স্বাক্ষী রেখে ইসলামিক বিধান অনুযায়ী আমার সাথে তার বিয়ে হয়েছে।এতে কোনো পাপ নেই,কোনো কলংক নেই।আমি নোংরামতে না জড়িয়ে শরীয়াহ্ মোতাবেক বিয়ে করেছি।আমার কোনো পাপ নেই।কিন্তু এই হাজারও অবিবাহিত মেয়েরা যাদের আপনি অবিবাহিত আর সতী মনে করেন বুকে হাত দিয়ে আমার মতো বলতে বলুন, যে তারা কুমারী,তাদের কেউ ইচ্ছেকৃত বা দুর্বলতার সুযোগে ছুয়ে যায়নি।নোংরা ভালোবাসায় মেতে কেউ তার বয়ফ্রেন্ডের কাছে নিজের সতিত্ব বিলিয়ে দেয়নি।বিশ্বাস করুন হাজারটা মেয়ের মধ্যে একজন, অন্তত একজন হলেও হাতটা বুকে রাখলেও মনে মনে কেঁদে উঠবে,কারণ সে কুমারী নয়।সে হারিয়েছে নিজের কুমারীত্ব।হোক তা ইচ্ছেকৃত বা কারো লালসার শিকার।তবুও সে সমাজের চোখে….. ”
আবির মাহিকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”মিষ্টি আমার এতে কোনো সমস্যা নেই।আমি সব জেনেশুনেই তোমাকে বিয়ে করতে চাই।”
মাহির চোখ ছলছল করছে।কন্ঠ কেনো জানি রুদ্ধ হয়ে আসছে।যেকোনো সময় সে কেঁদে ফেলতে পারে।যে ধরা গলায় বলে,”কিন্তু আমার যে সমস্যা আছে।যখন আমার আপনাকে খুব দরকার ছিলো তখন তো আপনি আসেননি।আমি মানছি আপনি অনেক দুরে ছিলেন।কিন্তু সাথে না থেকেও পাশে থাকা যায়।আমি আপনার জীবনে একজন হয়ে থাকতে চেয়েছিলাম,কিন্তু আপনি আমাকে অপশন বানিয়ে দিলেন।আপনাকে আমি ভালোবাসতে চেয়েছিলাম।আপনি আমাকে ভালোবাসায় রাঙিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে মিথ্যের জালে অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছিলেন।আমার জীবনে আমি তাকেই চাই যে আমায় ভালোবাসবে।”
“ওহ্ তারমানে তুমি আমায় চাওনা মিষ্টি। ” আবির নিচুস্বরে কথাটা মাহিকে বলে।মাহি একটু থেমে পরক্ষণে বলে,”আপনি কখনও আমায় ভালোবাসেননি।প্রথমেও না আর শেষেও না।শুধু আমাকে দেখে ভালোলেগে গিয়েছে তাই।আর আপনার পরিবারে মানিয়ে নেওয়ার মতো ক্ষমতা আমার নেই।”অবিবাহিত মানেই কুমারী এটা অবিশ্বাস্য ”
—আমি বলেছিলাম না,যে এগুলো কিছুই নয়।বরং দেখো অন্য কাউকে পাইছে বোধহয়।এগুলো মেয়েদের বিশ্বাস নেই।”আলীর কথায় মাহি বলে,”অবশ্যই আমার জীবনে আমি একজনকে চাই যে আমায় ভালোবাসবে।”মাহি পেছন ফিরে হেঁটে চলে আসে।আর ফিরে তাকাতে চায়না সে। ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিলো সে।ওদিকে আবির নিজেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছেনা।ইচ্ছে করছে হাতে একটা রড নিয়ে পার্কিং এর সবগুলো গাড়ি ভাঙতে।যদিও তা সম্ভব নয়।
_____________
ড্রয়িংরুমে বসে আছে আজমির সাহেব আর ওনার স্ত্রী। আজ আজমির সাহেব একটু বেশিই খুশি।কেননা দুপুরে নাফিসার সাথে কথা বলে মাহির বাসার ঠিকানা সে জোগাড় করেছে।বিশ্বস্থ একজনকে সে মাহি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে পাঠিয়েছে।হঠাৎ একটা কল আসে উনার ফোনে।ফোনটা রিসিভ করে কথা বলেন উনি।মুখের হাসি তার উবে যায়।নেমে আসে চিন্তার কালো আঁধার।
আপনি ভালো দৌড়াতে পারেন,ভালো সাঁতার কাটতে পারেন কিংবা ভালো চাকরী করেন ঠিক আছে।কিন্তু যদি বাহিরের কেউ আপনার সম্পর্কে জানতে চায় তাহলে লোকজন আপনার সেই পারদর্শিতা নিয়ে কথা না বলে বলবে, তার বাম পায়ের বুড়ো আঙুলের নখটা উঠানো।তার পায়ের সাইজ অনেক বড়, সহজে জুতো মেলেনা,ওই মেয়েটা রুটি গোলা করতে পারে না।শিলনোড়ায় বাটতে পারেনা,পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে কেঁদে সমুদ্র বানায়।
ঠিক এমনই হলো মাহির সাথে।মোস্তাফা সর্বপ্রথম মাহি সম্পর্কে এই খবরই পেলো যে তার নয় দশবছর আগে বিয়ে হয়েছিলো।ঘটনা এখানেই সীমাবদ্ধ থাকলো না।কেউ বলল,বাচ্চা হয়েছিলো বরপক্ষের লোক নিয়ে গিয়েছে,কেউ বলল পরকিয়া করে সংসার নষ্ট করেছে,তো কেউ বন্ধার অপবাদ দিলো।সমাজ বুঝি এমনই,তারা ডিভোর্সী মেয়েদের মানুষ মনে করে না।
মাথার উপরে ফুলস্পিডে ফ্যান চলতে থাকলেও আজমির সাহেবের কপালে সামান্য ঘামের উপস্থিতি টের পাওয়া গেলো।
চলবে……
রাঙিয়ে দিয়ে যাও
লেখনীতে -মাহি আফরোজ
[১৫]
এর মধ্যে কেটে গিয়েছে আরও কিছুদিন।এই কিছুদিনে আজমির সাহেব নিজের সাথে ভাবনা যুদ্ধ শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে উনি মাহির সাথে রিয়াদের পরিচয় করিয়ে দেবে।ছেলের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে নিজের মতামত যথাযথ রাখতে উনি কখনও জোড় করতে পারেন না।হোক নিজের ছেলে তবু ছেলে মেয়েদের বিয়ের সম্পর্কে প্রথমে তাদের মতামতটা নেয়াই জরুরি। কেননা সারাজীবন তারাই একসঙ্গে থাকবে।নিজের পছন্দ অন্যের ওপর চাপিয়ে পছন্দ করেন না আজমির দেওয়ান।
আজমির সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উনি দুুএকের মধ্যেই মাহির বাসায় যাবেন।কিন্তু সাবিহার মনটা একটু খুঁতখুঁত করছে।ছেলে এখন বড় হয়েছে।তাছাড়া ওর জীবনের এত বড় একটা সিদ্ধান্ত ওকে ছাড়া নেওয়া ঠিক হবে না।কিন্তু আজমির সাহেব বলেছেন যে উনি শুধু মেয়ে দেখতে যাবেন।একেবারে বিয়ে ঠিক করতে নয়।পরবর্তীতে ওনার ছেলে যেনো মেয়েটার সাথে দেখা করে, কথা বলে।উনার বিশ্বাস রিয়াদ মেয়েটাকে ঠিক পছন্দ করবে।
মেয়ে দেখার কথা একটু আধটু রিয়াদও শুনেছে।সে এখন ওই বিষয়টাতেই বিরক্ত। এতদিন ওর বাবা শুধু মাঝে মাঝে বিয়ের কথা বলেছে।কিন্তু এখন মেয়ের বাড়ি যাওয়া শুরু করে দিয়েছে।মাহির কথা বাড়িতে বলার সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছে না সে।ও ভেবে পাচ্ছে না ওর বাবা বিষয়টা কেমন চোখে দেখবে।রিয়াদ চায় আগে ওর ফ্যামিলির সবাইকে ম্যানেজ করতে।তারপর ও মাহিকে নিজের মনে জমিয়ে রাখা সুন্দর অনুভূতি সর্ম্পকে জানাবে।কিন্তু জানানোর পর যদি রিয়াদের পরিবার দ্বিমত পোষণ করে তবে মেয়েটার মন আবারও ভাঙবে।সে চায়না মাহি আবারও ভেঙে পড়ুক।
ঘড়ির কাটা এগারোটার ঘর পেরুতেই কলিং বেল বাজল।সাবিহা তখন নিজের ঘরে।আজমির সাহেব একটু আগেই ড্রয়িংরুম থেকে নিজের ঘরে গিয়েছে।চুৃমকি গিয়ে দরজা খুলে দিলো।অপরিচিত মানুষ দেখলে অযথা অবোধের মতো কথা বলা চুমকির মুদ্রাদোষ।দরজার ওপাশে দাড়ানো মাহিকে একপলক দেখেই সে বলে উঠে,
“এমা এত কম বয়সে চোখে দেখতে পাওনা।আমার দাদি এখনও চোখে দেখতে পায়।”
চুমকির কথায় মনে মনে বিরক্ত হয় মাহি।চশমা পড়া মানেই সে কানাবিবি।অন্য কোনো সমস্যার জন্য বুঝি লোকে চশমা পড়ে না।তবুও সে হাসি মুখে চশমাটা খুলে উত্তর দিলো,
“তেমন কিছু নয়।আমি চশমা ছাড়াও দেখতে পাই।মাথা ব্যাথার কারণে মাঝে মাঝে পড়ি।” চুমকি কিছুক্ষণ দরজা আগলে কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়েই থাকে।একটু পর ডানহাতের তিনটে আঙুল মাহির সামনে উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“বলোতো এখানে কয়টা আঙুল আছে?”
কি ম্যানার্সলেস লোকজন।যেমন উদ্কট ওই রিয়াদ,বোধহয় ঠিক তেমন উদ্ভট ওর বাড়ির সবাই।সে চশমাটা পুনরায় চোখে দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চুমকিকে বলে,”আপনি রিয়াদ স্যারকে বলুন যে মাহি আফরোজ নামের কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।তাহলেই হবে।চুমকি আর কথা না বাড়িয়ে মাহিকে ড্রয়িংরুম দেখিয়ে দিয়ে রওনা হয় রিয়াদের রুমের দিকে।বন্ধ দরজার এপাশ থেকে ডাকতে থাকে।ভেতর থেকে গিটারের সুর হালকা ভেসে আসছে।চুমকির ডাকে থেমে যায় গিটারের ঝংকার।
নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারপাশে।রাত্রির দ্বী-প্রহরে কারো জেগে থাকার কথা নয়।কিন্তু মাহি এখনও জেগে আছে।পাশেই দিশা ঘুমিয়ে আছে।নিজের জীবন নিয়ে অহেতুক ভাবনা তাকে জাগিয়ে রেখেছে।কল্পনায় কতকিছু মনে আসছে, আবার তা অতীতও হচ্ছে। মাহির ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে অতীতের মুখোমুখি হতে।একেবারে প্রথম থেকে।যখন অষ্টম শ্রেণীতে তার বিয়ে হয়েছিলো।ওই জায়গা তার এখনও মনে আছে।মাঝে মাঝে ওর ইচ্ছে করে ওখানে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করতে যে কেনোই বা আমাকে বিয়ে করেছিলেন আর কেনই বা আবার ছেড়ে এসেছিলেন।ওই লোকটা বোধহয় বিয়ে করে নিয়েছে এতদিনে।ও যখন অনার্সে পড়ত তখন উড়ো কথায় লোকটার বিয়ের কথা শুনেছিলো।কিন্তু এ নিয়ে তার বিশেষ ভাগাবেগ হয়নি।আবিরের সাথে পরিচয়ের সময়টা তার মনে জ্বলজ্বল হয়ে আছে।আবির ছেলেটা দেখতে মন্দ নয়।বিয়ে করতেও রাজি।কিন্তু ওর পরিবারের লোকজন মাহিকে বিশেষ কারণে পছন্দ করে না।যদি আবির ওকে ভালোবাসত তবে মাহি নিশ্চিয়ই বিয়েতে রাজি হতো।
রিয়াদের কথা মনে হতেই বিছানা ছেড়ে উঠে বসে মাহি।ও জানে রিয়াদ ওকে ভালোবাসে।সবসময় বলতে হয়না ভালোবাসি।মেয়েরা ঠিক বুঝতে পারে।আজ ওদের বাসায় গিয়ে রিয়াদের দিকে তাকাতে পারেনি ও।ঢাকায় গিয়ে ওরা শেষ দিনটা একসাথে কাটিয়েছে।মাহির যে রিয়াদকে পছন্দ নয় তা ঠিক নয়।মাহি আসলে নিজেকে যোগ্য মনে করে না।নিজের নামের সাথে ডিভোর্সী ট্যাগটা সে সহ্য করতে পারেনা।ওর মনটা ভীষণ ভাবে পুড়ে যায়।
কে বলেছে মানুষের জীবনে প্রেম একবারই আসে।আমি বলি ভালোবাসা বারবার আসে, যতক্ষণ না সঠিক মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়।তাই হয়ত মাহির জীবনে আবারও ভালোবাসা এসেছে।যে মানুষটা ভালোবেসে তাকে রাঙিয়ে দিতে চায়।
_____________
নরম সাদা বালির ওপরে দাড়িয়ে আছে মাহি।সমুদ্রের নোনাপানির হালকা ফেনাযুক্ত ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ওর পা দুটো।গায়ে তার কমলা রঙের লং গাউন।সমুদ্রের বাতাসে চুলগুলো বিদিশায় উড়ছে।বিকেলের কমলা রঙের রোদ ওর গাউনে প্রতিফলিত হয়ে মুখটাকে কমলা রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে।দুর থেকে মাহির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে রিয়াদ।বিকেলের নরম কমলা আলোতে “কমলাপরী”নামটা এখন মাহির জন্য উপযুক্ত লাগছে তার।হাতের লালটকটকে গোলাপটা বিচের একটা বেঞ্চিতে রেখে জিন্সের প্যান্টটা টেনে গোড়ালী হতে একটু ওপরে ভাঁজ করে রাখে।যাতে পানিতে ভিজে না যায়।তারপর হাটা শুরু করে নরম ভেজা বালির ওপর দিয়ে।
সামনে সমুদ্রের স্বাভাবিক গর্জন।কিন্তু মাহির মনের ভেতরে সমুদ্রের ভয়াল গর্জন।যা টের পাচ্ছে ওর নিজেই।সামনে রিয়াদ গোলাপ হাতে এসে দাড়ালো।ওর ষষ্ঠইন্দ্রীয় জানান দিলো কি হতে যাচ্ছে। রিয়াদ মাহির সামনে দাড়িয়ে ওর চোখের দিকে তাকালো।নিজের জীবনের কালো অধ্যায়ের সুরের মূর্ছনার বিমোহিত মাহি অবাক হয়ে চেয়ে থাকলো সামনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে।রিয়াদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলে,
“তোমাকে আমার ভালোলাগে মাহি।ভালোবাসার আগে ভালোলাগাটুকু খুব জরুরী। আমি তোমায় খুব করে ভালোবাসতে চাই। আমার ভালোবাসায় ওই প্রভাতের মতো রাঙাতে চাই তোমাকে।কমলারোদে দাড়িয়ে থাকা এই কমলাপরীকে আমি আমার করে চাই।আমি চাই তুমি বৈধভাবে আমাকে সঙ্গ দাও।
আমার প্রতিশ্রুতিকে সত্যি করার একটা সুযোগ আমার চাই।”
রিয়াদ কথাগুলো বলে চেয়ে থাকে মাহির দিকে।মাহি অবাক নয়নে প্রথম থেকে শেষ অবদি ওর দিকেই চেয়ে থাকে।ভালোবাসাটা অপ্রকাশিতই ভালো।প্রকাশ হয়ে গেলে বেড়ে যায় অবহেলা।অপমানিত হয় মিষ্টি অনুভূতি। কিন্তু আজ ওর ইচ্ছে হচ্ছে ওই সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গর্জন করেই চিৎকার করে বলতে,”আমিও চাই কেউ আমাকে ভালোবাসুক।আমিও কাউকে খুব করে ভালোবাসি।আমারও মন আছে।ছোট ছোট ইচ্ছে আছে।”কিন্তু নিজের মনের সেই সুপ্ত ইচ্ছে মনেই রেখে দেয় মাহি।হাত বাড়িয়ে রিয়াদের দেওয়া গোলাপটা নেয় সে।মাথাটা নিচু করে দাড়িয়ে থাকে।মাহির নিরবতাময় প্রস্তাব গ্রহণে আপ্লূত হয়ে রিয়াদ ওকে জড়িয়ে ধরে।
মাহি আশ্চর্য হয়।ওরা কত কাছাকাছি। অথচ জড়িয়ে ধরে থাকা সেই পুরুষ কি জানে তাকে এর আগেও কেউ নিজের করে রেখেছিলো।কেউ তাকে আপন মনে ছুঁয়েছিলো।কেউ আবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে খুব করে কাঁদিয়েছিলো।এই ছেলেটা যখন জানবে সমুদ্রবিলাস করা এই কমলাপরী সমাজের মানুষের কাছে জলন্ত কলংক। স্বামী পরিত্যক্ত এক অবহেলিত মেয়ে।যারা মনে করেছিলো এই মেয়েটাকে কখনও ভালোবাসা যায়না।পরম আবেশে ভালোবেসে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করা ছেলেটা যখন জানবে মেয়েটা ডিভোর্সী তখন হয়ত তার ভালোবাসায় সজল থাকা চোখদুটোতে ওর জন্য হৃদয় উগরে দেওয়া সীমাহীন ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই দৃশ্যমান হবে না।মুহূর্তেই ভেঙে পড়বে ওর মনের কল্পনার রাজপ্রাসাদ। লেপ্টে যাবে সুন্দরবাক্য প্রণয়।বিষাদে ছেয়ে যাবে মনটা।
আর ভাবতে পারছে না মাহি।সে রিয়াদকে পাঠিয়েছে এক বোতল খাওয়ার পানি আনতে।বিচের ধারেই রিয়াদের গাড়িটা রাখা।ও দরজা খুলে ভেতর থেকে ওর ব্যাগটা নিয়ে একটা সাদা কাগজে কিছু লেখে।তারপর সেটা স্টিয়ারিং এর কাছে রেখে দ্রুত সে স্হান ত্যাগ করে।পেছনে রেখে যায় কারো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।সে পেছনে ফিরে তাকায় না।
______________
মাগরিবের নামাজ পড়ে চুলায় চা পাতা গরম করছে নাজমা।বসার ঘরে সোফায় বসে ফোনে কথা বলছে মোতাহার।একটা লোক ফোন করে মাহির বিয়ের কথা বলছিলো।মোতাহার পরে জানাবে বলে ফোনটা রেখে দেয়।মেয়ের জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত সে নিজের মতো করে নিতে চায়না।আগে যা হয়ে গিয়েছে তা অতীত।আর কোনো ভুল করতে চায়না সে।
হঠাৎ বসার ঘরের দরজা দিয়ে মাহি প্রবেশ করে।এসেই দরজার সামনেই মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ে।হাতের ব্যাগটা বুকে চেপে রেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে সে।শব্দ শুনে নাজমা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসে।দিশাও এসে হাজির হয়।সোফাতে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে থাকা মোতাহার সচেতন হয়ে চেয়ে থাকে মেয়ের দিকে।পরিস্থিতি কেউ বুঝে উঠতে পারে না।হাতের খুন্তিটা টেবিলে রেখে মেয়ের বাহু ধরে তোলার চেষ্টা করে নাজমা।কিন্তু মাহি অনড় হয়ে ওখানেই বসে কাঁদতে থাকে।মেয়ের চোখে পানি দেখে নাজমা বলে,”কি হয়েছে মিষ্টি?কেউ কিছু বলেছে মা?”
নাজমার কথায় মাহি কিছু বলে না।শুধু হাউমাউ করে কেঁদেই চলে।নিজের মেয়েটাকে সেই ছোট থেকেই চোখে চোখে রাখতো মোতাহার।এত এত কষ্ট আর না পাওয়ার বেদনায় মাহি কখনও কাঁদেনি।মুখে হাসি বজায় রেখে চলেছে সবসময়।নিজের কষ্টটা আন্দাজ করতে দেয়নি কাউকে।অথচ আজ কি এমন হলো যে সে সকলের সামনে বসে থেকে কাঁদছে।
মোতাহার বাকরুদ্ধ হয়ে ওখানেই বসে থাকে।সে ভেবে পায়না ওর কি করা উচিত।মাহি ওর মাকে জড়িয়ে ধরে।কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলতে থাকে,
“আমি ভালো মেয়ে নই মা।আমি কাউকে ভালোবাসতে পারিনা।আমার অধিকার নেই ভালোবাসার।আমি নিক্রিষ্ট একজন মানুষ।”
মেয়ের কথা শুনে আস্তে আস্তে বসার ঘর ছেড়ে শোয়ার ঘরে চলে যায় মোতাহার।মাহি ওর মাকে জড়িয়ে আবারও বলে,”আমায় কেনো বিয়ে দিয়েছিলে মা?আর দেওয়ার পরেও কেনই বা ছাড়িয়ে নিয়েছিলে?”
নাজমা কাঁদতে কাদতে বলে,”আমরা তো ভালো বুঝেই বিয়ে দিয়েছিলাম মিষ্টি। কিন্তু দোষটা তোর ভাগ্যের। তোর ভালোর জন্যই তোকে ছাড়িয়ে এনেছিলাম।”মায়ের কথা শুনে মাহি সোজা হয়ে বসে বলে,”কোন ভালোর জন্য ছাড়িয়ে এনেছিলে মা?রাস্তা-ঘাট,সবজায়গায় আমাকে অপমানিত করার জন্যে,নাকি ডিভোর্সী ট্যাগ গায়ে লাগিয়ে স্বাধীনভাবে চাকরী করানোর জন্যে।”
“আমি হাঁপিয়ে গেছি মা।আমি কাউকে ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও ভালোবাসতে পারিনা।স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলতে পারিনা।ডিভোর্স নামের বেড়ি আমার পা আকড়ে ধরে চলার সময়।আমার গলা পেঁচিয়ে ধরে কাউকে নিজের মনের ভেতরে জমিয়ে রাখা সুন্দর কিছু অনুভূতি জানানোর সময়।আমি নিজের প্রতি বিরক্ত। এই জীবন আমার সহ্য হচ্ছে না”
বসার ঘর থেকে মাহির কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।আজ মেয়েটা না হয় মনভরে কাঁদুক। কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দিক নিজের নিছক অভিমান।শুক্লপক্ষের চাঁদটা না হয় সেই কান্নার স্বাক্ষী থাকুক।
চলবে………