রাতের_কুয়াশা,দ্বিতীয়_পর্ব

0
1100

রাতের_কুয়াশা,দ্বিতীয়_পর্ব
লেখাঃ-মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

” মুন্নী বলল, লঞ্চের ছাঁদে বসে যাদের সাথে তাস খেলছিলেন তারা আপনাদের সদস্য তাই না? ”

” আরে নাহ, আমরা লঞ্চের মধ্যে কেউ কারো সাথে দেখা করি না, যাদের সাথে দেখেছেন তারা মনে হয় কোন কলেজ ভার্সিটির ছাত্র হতে পারে। ”

” মুন্নী এবার কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আপনি খুব সাংঘাতিক মানুষ তো, আপনার সাথে পিস্তলও আছে? ”

” ডাকাতি করতে গেলে এটা অবশ্যই দরকার কারণ আমি তো আর চোর নই যে শরীরে তেল মেখে চুরি কররো। আমরা হচ্ছি ডাকাত মানুষের মনে ভয় দিয়ে তাদের চোখের সামনে সবকিছু কেড়ে নেওয়া হচ্ছে আমাদের কাজ। ”

” আমি কিন্তু বেশি ভয় পাচ্ছি না। ”

” কেন? ”

” আপনি খুব সহজ আর স্বাভাবিক ভাবে আমার সাথে কথা বলছেন, এটা কখনো কারো মনে ভয়ের জন্ম দেবে না। ”

” ঠিক আছে ভয় পেতে হবে না, আপনি চুপচাপ বসে থাকুন কিংবা শুয়ে থাকুন। আমার কাজ শুরু করতে হবে তাই আমি চলে যাচ্ছি, আপনার সাথে আবার দেখা হবে এবং সেটাই আমাদের শেষ দেখা। তখন আমি আপনার মোবাইল আপনার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে লঞ্চ ত্যাগ করবো। ”

” আমার মোবাইল কেন নিচ্ছেন? ”

” আপনি যদি পুলিশ প্রশাসনের কাউকে কল করে বিষয়টা অবহিত করেন তাহলে যে আমাদের অনেক বড় বিপদ হবে। কিন্তু আমার ধারণা আপনি সেটা করবেন না তবুও সামান্য সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে আমাকে তাই মোবাইল নিলাম। ”

” আমার কিন্তু একা একা ভয় করতে পারে আপনি ডাকাতি করার সময় মাঝে মাঝে আসবেন ঠিক আছে? ”

” হাহাহা ”

আমি একটা হাসি দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিলাম। আমাদের টিমের বাকি ছয়জন লঞ্চে আছে তাদের সাথে যোগাযোগ করা দরকার। চারিদিকে ভারি কুয়াশা নেমেছে এটা একটা ভালো দিক কিন্তু লঞ্চ যদি এই মুহূর্তে দিক হারিয়ে চরের সাথে আটকে যায় তাহলে খুব সমস্যা হয়ে যাবে। কারণ তখন এই স্থানে এসে ডাকাতি করা যাবে না, এখান থেকে সামান্য দুরেই উপকূলে একটা বাজার আছে। সেই বাজার থেকে রাতের প্রহরী কিংবা কারো নজরে দাঁড়িয়ে থাকা লঞ্চ পরলে তো বিপদের আশংকা। তাছাড়া, সামনে গিয়ে ছোট্ট খালের মুখেই লঞ্চ রাখার হুকুম সর্দারের কারন বিপদ আপদে পালানোর বিকল্প রাস্তা আছে।

আমার দায়িত্ব হচ্ছে লঞ্চের মাস্টার মানে চালক কে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আমার ইচ্ছে মতো লঞ্চ সঠিক স্থানে নেয়া। আপনারা যারা জানেন না তাদের জন্য বলছি, লঞ্চ, ফেরী ইত্যাদি যারা চালান তাদেরকে মাস্টার বলা হয়। বাস, ট্রাক চালকদের যেমন করে ড্রাইভার ডাকি তেমন করে লঞ্চ, ফেরীর চালককে মাস্টার বলা হয়।

মাস্টারকে আক্রমণ করার আগে আমার কাজ হচ্ছে লঞ্চ সম্পুর্ন আরেকবার চক্কর দিয়ে দেখা। কোনকিছু সন্দেহজনক আছে কিনা সেটা ভালো করে দেখে তারপর মাস্টার এর কাছে যেতে হবে।

ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডার জন্য সবাই গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। যারা স্থান পাননি তারাও শীতের বস্ত্র পরে বসে আছে। বেশিরভাগ মানুষ ঘুমিয়ে গেছে মনে হয়, কারো মাথা কাঁথা কিংবা কম্বলের বাইরে দেখা যাচ্ছে না। লবনের জন্য যেই ব্যক্তি তার স্ত্রীকে ধমক দিচ্ছিলেন তিনি এখন তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। আরেকটু সামনে যেতেই দেখলাম দুটো মানুষ শুয়ে আছে তাদের মাঝখানে একটা ৫/৬ বছর বয়সী বাচ্চা চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। আমার চোখে চোখাচোখি হতেই সে চোখের ইশারায় কিছু একটা জিজ্ঞেস করলো। আমি ঠোঁট বাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম।

এমন সময় একটা কান্ড ঘটে গেল। লঞ্চ প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে মনে হয় থেমে গেছে, এই ধাক্কার সাথে আমি পরিচিত। শীতের রাতে ঘন কুয়াশার জন্য মাস্টার দেখতে না পেয়ে লঞ্চ চরে উঠে যায়। অনেক সময় লঞ্চ পিছনে ব্যাক করা যায় আবার অনেক সময় জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ধাক্কা খেয়ে সকল যাত্রী নড়াচড়া করে সবাই চেচামেচি শুরু করেছে। হঠাৎ করে আকস্মিক ধাক্কা লঞ্চে ঘুমন্ত সবাইকে জাগ্রত করে দিয়েছে। যারা যারা এখনো জাগ্রত হতে পারে নাই তারা হচ্ছে ঘুম বাবু দলের অনুসারী। সবাই কি? কি? বলে এদিক সেদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।

আমি আমার সাথের বাকি ছয় জনের নাম্বারে কল দিয়ে বললাম সবাই যেন যার যার অবস্থানে অপেক্ষা করে। তাদেরকে নিষেধ করে আমি আস্তে আস্তে মাস্টার এর রুমের দিকে রওনা দিলাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী আজকে লুট করতে না পালে অনেক লস হয়ে যাবে। আমরা সচারাচর প্রতিদিন লুট করি না মাসের মধ্যে ৩/৪ বার লুট করা হয়।

মাস্টারের রুমের মধ্যে আরো কিছু লোক আছে, এরা মনে স্টাফ জাতীয় কেউ হবে। লঞ্চ চরে আটকে গেছে সেটা আমার কাছে পরিষ্কার কিন্তু কীভাবে কি করা যায় সেটা জানার জন্য এখানে আসা।

কথা বলে জানলাম, এই স্থানটায় ডাকাতদের উপদ্রব অনেক বেশি তাই মাস্টার লঞ্চের গতি বৃদ্ধি করেছেন কিন্তু রাতের কুয়াশার জন্য নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গেছে। রাত তিনটার দিকে জোয়ার হবে তখন পানি বৃদ্ধি পাবে অনেক সেই সময় বের হয়ে যাওয়া যাবে।

আমি ট্রলারে সর্দারের কাছে কল দিলাম, সর্দার আমাদের অপেক্ষা করতে বললেন। তার নির্দেশ হচ্ছে যদি লঞ্চ ভোরের আগে বের হতে পারে তাহলে অভিযান চালানো হবে। নাহলে আমরা চাঁদপুরে গিয়ে সবাই নেমে যাবো এবং পরবর্তীতে আবার নতুন পরিকল্পনা করতে হবে।

রঞ্চে আমাদের মধ্যে একজন সিনিয়র ডাকাত সদস্য আছে তিনিও সহমত প্রকাশ করলেন। আমি আবার চারিদিকে তাকাতে তাকাতে কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলাম। এতক্ষণ লঞ্চ চলন্ত অবস্থায় ছিল তবে এখন
স্থীর হয়ে আছে বলে মানুষের কথা ছাড়া তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না। লবনের জন্য স্ত্রীকে বকাবকি করা লোকটা এখনো ঘুমিয়ে আছে তবে তার স্ত্রী জেগে আছে এবং বসে বসে পাশের আরেকটা লোকের সঙ্গে গল্প করছে।

কেবিনের দরজা খুলে দেখি মুন্নী ভয়ে চিমসে গিয়ে বসে আছে, লঞ্চের ধাক্কা হয়তো সে মনে করেছে আমরা আক্রমণ করেছি।

” মুন্নী বলল, আপনারা কি লঞ্চ ভেঙ্গে ফেলবেন নাকি? কিসের শব্দ হয়েছে? ডাকাতি শুরু হয়ে গেছে নাকি? ”

” নাহহ লঞ্চ চরে আটকে গেছে আপাতত আমাদের কাজ বন্ধ। ”

” তাহলে এখানেই তো ডাকাতি করতে পারেন। ”

” না পারি না, আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্য আছে। ”

” তাহলে এখন কি করবেন? ”

” আপাতত কেবিনে বসে থাকবো, রাত তিনটার দিকে জোয়ার হবে তখন দেখা যাবে। ”

” তাহলে এখন আমরা গল্প করতে পারি? ”

” নাহ পারি না। ”

” কেন? ”

” কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ”

” সবসময় মুখটা বাংলা পাঁচের মতো বাঁকা করে রাখলে হয় নাকি? হাসুন প্রাণ খুলে। ”

” হিহিহি, হইছে? ”

” আপনার ব্যাগের ভেতর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস * কপালকুণ্ডলা * পেলাম। বইটা পড়ে কে? আপনি নাকি অন্য কেউ? ”

” জ্বি আমিই পড়ি। ”

” বঙ্কিমচন্দ্রের বই পড়তে তো ব্যকরণ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকা দরকার। তার উপন্যাসের ভাষা সকল সাহিত্যিকের চেয়ে কঠিন। ”

” হুম জানি, আর সে জন্য তাকে সাহিত্য সম্রাট উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। ”

” বাহহ আপনি সেটাও জানেন? আচ্ছা আপনি তো পড়াশোনা করেছেন মনে হয়। কতটুকু পড়েছেন? ”

” খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা কমপ্লিট করেছি। তারপর আর পড়াশোনা করিনি কারণ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করা সম্ভব ছিল না। ”

” বলেন কি? তাহলে আপনি ডাকাতি করেন কেন? ”

” আপনাকে বলেছিলাম না আমি একটা মানুষের কাছ থেকে কিছু টাকা সাহায্য নিয়ে বছর খানিক জেলে ছিলাম? ”

” হ্যাঁ। ”

” সেই সময় জেলে বসেই এই ডাকাত দলের একজন সদস্যের সাথে পরিচয়। তার সাথে জেল থেকে বের হয়ে এই পথে এসেছি, চাকরির চেষ্টা করেছি অনেক কিন্তু না পেয়ে এই পথে এসেছি। ”

” আপনার গ্রামের বাড়ি কোন যায়গা? ”

” বাগেরহাট জেলা। ”

” বাড়িতে কে কে আছে? ”

” মা-বাবা আর ছোট বোন। ”

” আপনাদের তো ছোট পরিবার তাহলে আরো বেশ কিছুদিন চাকরির জন্য চেষ্টা করতে পারতেন। ”

” ওই যে বললাম, মিথ্যা অপরাধে জেলে গিয়ে মন ঘুরে গেছে। ”

” ওহহ আচ্ছা। ”

” হুম, আপনার সজীব বরিশালে কি করে? অবশ্য যদি সমস্যা থাকে তাহলে বলার দরকার নেই। কারন তখন একবার জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু আপনি বলতে চাননি। ”

” আচ্ছা ঠিক আছে আপনি একজন ডাকাত হয়েও যখন এতকিছু বললেন তখন আমিও আমার সকল কিছু আপনাকে বলবো। ”

” এত্তো এত্তো এত্তোগুলা ধন্যবাদ। ”

” আমি মা-বাবার একমাত্র মেয়ে, ঢাকা শহরে বাবার অনেক গুলো বিজনেস আছে। মা একটা কোচিং সেন্টারের পরিচালক, আমি খুব চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে
তাই আমার বন্ধুরা বেশি ভয় করতো আমাকে। আমাদের মহল্লার কোন ছেলে আমাকে কখনো প্রপোজ করে নাই কারণ প্রথমত আমি তেমন সুন্দরী মেয়ে না আর দ্বিতীয়ত আমি রাগী চঞ্চল।

প্রেম ভালবাসা ইত্যাদি থেকে সবসময় দুরে থাকতাম কারণ এগুলো কখনো লাইফে ইম্পরট্যান্ট হিসাবে গ্রহণ করিনি। কিন্তু আজ থেকে নয় মাস আগে এপ্রিল মাসের চার তারিখে আমি আমার নাম্বারে ফ্লেক্সিলড করতে গিয়ে একটা সংখ্যা ভুল হয়ে গেল। পাঁচশ টাকা ভুলে চলে গেল তাই আমি সেই নাম্বারে কল দিলাম। একটা ছেলে কল রিসিভ করেছিল আর আমি তার কাছে টাকার বিষয়টা বললাম। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সে মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যে আমার টাকা ফেরত দিয়ে দিল। ভেবেছিলাম হয়তো মাঝে মাঝে আবার কল করবে কিন্তু আমার ধারণা ভুল। সে আর কখন কল করেনি তাই সপ্তাহ খানিক পরে একদিন আমি হঠাৎ করে তাকে কল দিলাম।

প্রথম প্রথম খুব ভাব নিচ্ছিল তাই আমার রাগ বেড়ে যাচ্ছিল ছেলেটার উপর। কিন্তু আস্তে আস্তে তার মায়াবী কথার মাঝে নিজেকে হারিয়ে যেতে শুরু করলাম। জুন মাসে তাকে আমি প্রপোজ করেছি কিন্তু সজীব রাজি হলো না বরং আমার সাথে ১৩ দিন কথা বলে নাই। তারপর আমি তাকে বন্ধু হয়ে পাশে থাকার অনুরোধ করেছি তখন সে আমাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে। আমি যেহেতু শ্যামলা চেহারার তাই সবসময় সুন্দর ছেলেদের অপছন্দ করতাম। তার নাম সজীব, আর সজীব জানায় তার চেহারা কালো, আমি তাকে বারবার ছবি দেবার কথা বলেছি কিন্তু সে রাজি হয়নি। আস্তে আস্তে সজীব এর প্রতি প্রচুর দুর্বল হয়ে গেলাম কিন্তু সজীব প্রেম করতে চায় না বলে কিছু বলতাম না। আমার বিশ্বাস ছিল একদিন ঠিকই সজীব আমাকে ভালবাসবে। আস্তে আস্তে আমাদের যোগাযোগের প্রায় আট মাস পেরিয়ে গেল, আমি ওকে না দেখে এত পরিমাণ ভালবেসে ফেলেছি যেটা প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু ও সবসময় আমাকে অবহেলা করতে শুরু করে, আমি আবারও সজীবকে প্রপোজ করলাম কিন্তু সে আবারও প্রত্যাখ্যান করেছে। এরপর থেকে প্রতিদিন কল দিয়ে কান্না করতাম শুধু একমুঠু ভালবাসার জন্য কিন্তু সে রাজি হয়নি। আমি যখন কারণ জিজ্ঞেস করতাম তখন সে বলতো, ও নাকি আমার যোগ্য না।

যখন বুঝতে পারছি যে সজীব আমার কাছ থেকে যেকোনো সময় হারিয়ে যেতে পারে তখন এই মাসের দুই তারিখে মানে ডিসেম্বরের দুই তারিখে আমি ওকে কিছু জিনিস উপহার দিতে চাইলাম। তাকে বললাম যেভাবেই হোক সে যেন গ্রহণ করে, অনেক অনুরোধ করার পরে সজীব রাজি হলো।

আমি সজীব এর কাছে কুরিয়ার সার্ভিসের ঠিকানা জানতে চাইলাম কারণ আমি জানি সজীব বরিশাল থাকে। আমার টার্গেট ছিল বরিশালে এসে সেই ঠিকানা অনুযায়ী তার সাথে দেখা করবো। সজীব বলতো সে নাকি একটা হোটেলে কাজ করে তাই আমি সেই হোটেলের ঠিকানা চাইলাম। সজীব ঠিকানা দিল আমি সেই ঠিকানায় কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিয়ে বরিশালে আসলাম। অনেক কষ্ট করেও ওই হোটেল খুঁজে বের করতে পারি নাই।

পরশু রাতে আবারও ঢাকা থেকে বরিশালে এলাম, সারাদিন বিভিন্ন যায়গা খুঁজলাম কিন্তু তাকে পেলাম না তাই সন্ধ্যা বেলা একরাশ হতাশা নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা দিলাম। সজীব এর নাম্বার কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দেবার পর থেকে বন্ধ। সজীব বলেছিল সে উপহার গ্রহণ করে আর যোগাযোগ করবে না। আমি ভেবেছিলাম সে ফাজলামো করেছে কিন্তু সত্যি সত্যি নাম্বার বন্ধ করবে বুঝতে পারিনি। ওকে উপহার দেবার সময় তার মধ্যে একটা চিঠি লিখে দিছিলাম ভেবেছিলাম চিঠি পরে সে আমাকে গ্রহণ করবে। কিন্তু অদ্ভুত পৃথিবীর অদ্ভুত মানুষ তাই আমাকে সে ভুলে গেছে।

★★

” আমি মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, কি বলছে এগুলো? এতটা যত্ন করে কেউ কাউকে যে ভালবাসতে পারে জানা ছিল না। বললাম, আপনি এখন কি করতে চান? ”

” আপাতত আপনার সাথে গিয়ে এখন এক কাপ চা খেয়ে আসবো তারপর আবারও গল্প করবো। ”

” হাহাহা, চলুন তাহলে। ”

আমরা কেবিন থেকে বেরিয়ে হাঁটা শুরু করলাম, সবাই এখন ঘুম বন্ধ করে বসে বসে গল্প করছে। লবণ নিয়ে ঝগড়া করা ব্যক্তি বেশ জোরে চিৎকার করে স্ত্রীকে বকা দিচ্ছে। এবারের কারণ অবশ্য লবণ নয়, লোকটা যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন নাকি তার স্ত্রী পাশের লোকের সঙ্গে খুব রসালো আলাপ করেছে। লোকটা না ঘুমিয়ে ঘুমের ভান করে সবকিছু শুনে ফেলেছে, পাশের লোকটা নাকি তার স্ত্রীকে চা খেতে নিয়ে যেতে চাইছে। আর তার স্ত্রীও রাজি হয়ে গেল ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি আর সহ্য করতে না পেরে জেগে উঠলেন। এখন সেই নিয়ে হুলস্থুল কান্ড হচ্ছে আর বাকিরা সময় পার করার জন্য সেই অহেতুক ঝগড়া মনোযোগ দিয়ে দেখছেন।

আমার গায়ে শীতের বড় কোর্ট আছে আর মুন্নী আমার সেই পাতলা কম্বল জড়িয়ে বের হয়েছে। আমরা দু কাপ চা অন-টাইম কাপে করে লঞ্চের ডেকের পাশে দাঁড়িয়ে আছি।

” মেয়েটা বললো, আজকে রাতে যদি আপনারা ডাকাতি করতে পারেন তাহলে আপনি কত টাকা ভাগে পাবেন? ”

” বললাম, ভাগাভাগি বুঝি না আমি আনুমানিক পঁচিশ হাজারের মতো পাবো। ”

” মনে করেন সেই পঁচিশ হাজার টাকা যদি আমি আপনাকে দেই তাহলে আপনি আমার সাথে গল্প করতে করতে সদরঘাট পর্যন্ত যাবেন? ”

” হাহাহা আপনার কাছে এত টাকা আছে? ”

” অবশ্যই আছে, মুন্নী তার ব্যাগের ভেতর থেকে বের করে টাকার বান্ডিল দেখালো। ”

” আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনার কাছে এত টাকা আছে? তাহলে আপনি আমার কাছে মিথ্যা কথা বলে টাকা নিলেন কেন? ”

” আমাকে অবাক হতে দেখে মুন্নী তার মুখে হাসি হাসি ভাব রেখে বললো, ইচ্ছে করে নিয়েছি। ”

” মানে কি? ”

” জ্ঞানী মানুষ বলেন, মন থেকে কিছু চাইলে সেটা নাকি একদিন ঠিকই পাওয়া যায়। আমিও তোমাকে মন থেকে চেয়েছিলাম তাই আল্লাহ আমাকে খালি হাতে ফেরাননি। ”

” আমি মুখ শুকনো করে বললাম, মানে? ”

” মানে হচ্ছে আমি যেই সজীবকে না দেখে প্রচন্ড ভালবেসে আজ পাগলের মতো বরিশালে ঘুরেছি। সেই সজীব আর কেউ নয়, তুমি সেই সজীব। ”

” ধুর কি বলেন এগুলো? আমি কেন আপনার সেই সজীব হতে যাবো? আপনার ভুল হচ্ছে। ”

” একদম নাটক করবে না, আর আমার কোন ভুল হচ্ছে না। লঞ্চে ওঠার আগেই আমি তোমাকে দেখে চিনতে পেরেছিলাম। তারপর তোমার পিছনে পিছনে আমি লঞ্চে এসে এমনটা করেছি। ”

” আপনি কীভাবে ভাবলেন আমি আপনার সজীব? ”

” অনেক গুলো কারণ আছে। ”

” বলেন তো! ”

” তোমার গায়ে যে শীতের পোশাক আছে সেটা আমি সেই ডিসেম্বরের দুই তারিখে কুরিয়ার করে তোমার কাছে পাঠিয়েছিলাম। বুকের কাছে লোগোর নকশার মধ্যে আমার পছন্দ নাম ” পরি ” লেখা আছে। তোমার হাতের ওই ঘড়িটা আমি তিনমাস আগে সুইজারল্যান্ড থেকে বাবাকে দিয়ে আনিয়েছিলাম। তোমার ব্যাগের ভেতর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের পাশে আরেকটা জিনিস ছিল। সেটা কি জানো? ”

” কি? ”

” ডায়েরি, নীল রঙের সেই ডায়েরির পাঁচটা পাতায় আমি শুধু আমার মনের কথা লিখে রেখছি। ভাবছি তুমি সেই চিঠি পরে আমাকে তোমার ভালবাসা ভিক্ষা দেবে। আমি জানি তুমি সেই চিঠি পড়েছো কারণ আমার চিঠির শেষে তোমার নিজের হাতে লেখা আছে, ” আমিও ভালবাসি মুন্নী “। আর তুমি সেই চিঠির জবাবে ওই ডায়েরিতেই আরেকটা বিশাল চিঠি লিখেছো সেটা আমি পড়েছি। ”

” আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম, তখন মুন্নী আবার বললো, আরেকটা বড় প্রমাণ আছে শুনবে? ”

” কি? ”

” সজীব আমাকে বলেছিল চার পাঁচ বছর আগে ওর সামনের একটা দাঁত ভেঙ্গে গেছে। এবং সেই দাঁত আজও সেভাবেই আছে, আমি তাকে বলেছিলাম ঢাকা গেলে আমি ডেন্টাল ডাক্তারের কাছে গিয়ে দাঁত বাঁধিয়ে আনাবো। আর আমি লঞ্চে ওঠার আগেই দেখেছি তোমার সামনের দাঁত ভাঙ্গা। এরপর আরও প্রমাণ করতে হবে যে তুমি আমার সজীব? ”

#চলবে….
কেমন হলো কমেন্ট করে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here