রাতের_কুয়াশা,_পর্ব-০৩

0
728

রাতের_কুয়াশা,_পর্ব-০৩

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি, চারিদিকে যেন সবকিছু নিস্তব্ধ। থেমে থাকা লঞ্চে চতুর্পাশ থেকে রাতের কুয়াশা ঘিরে আসছে। আমি কিছুক্ষণ মাথা এদিক সেদিক ঘুরিয়ে আবার হঠাৎ করে মুন্নীর দিকে তাকিয়ে দেখি সে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে। তার চোখের উপর থেকে দৃষ্টি সরাতে চেয়েও সরাতে পারলাম না। চোখের মধ্যে মনে হয় যেন পৃথিবীর সব মায়া ভালবাসার দৃশ্য লুকিয়ে আছে। মুন্নীর চোখে এতটা মায়া লুকিয়ে আছে জানা ছিল না, এতক্ষণ হয়তো খেয়াল করে দেখিনি। দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি, তার চোখের ভাষা দেখে মনে হয় সে এখনই আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়তে চায়।

” মুন্নী বলল, বিশ্বাস করো অনেক বেশি ভালবেসে ফেলেছি নাহলে এভাবে পাগলের মতো তোমার জন্য ছুটে বেড়াতাম না। চারিদিকে কত অজস্র মানুষের বসবাস কিন্তু তবুও আমার তোমাকে চাই। যদি ছেড়ে থাকতে পারতাম তাহলে তো আর তোমার জন্য এত বেশি পাগলামি করতাম না। ”

” বললাম, আমি তো তোমাকে কখনো ভালবাসার স্বপ্ন দেখাইনি কারণ আমি আমার অবস্থান জানি। তোমার মতো মানুষকে ভালবাসতে পারার কোন যোগ্যতা ছিল না তাই আশা দেই নাই। ”

” খুব তুচ্ছ কারণে যে কারো প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হতে পারে সজীব, আমি তো কখনো কাউকে ভালবাসতে চাই নাই। কিন্তু তবু দেখো তোমার মতো একটা মানুষ কে না দেখে না চিনে অসংখ্য ভালবেসে ফেলেছি। তোমাকে যতদিন খুঁজে না পেতাম ততদিন হয়তো এভাবে খুঁজতেই থাকতাম। হয়তো হঠাৎ করে কোন এক অমলিন সন্ধ্যা বেলায় বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে রাজি হতাম। তবে মনের একান্ত গভীরে যেই তোমাকে ঠাই দিয়েছি তাকে কোনদিন ভুলতে পারতাম না। ”

” আমার পরম সৌভাগ্য তোমার মতো একটা মেয়ে আমাকে ভালবেসেছ। তোমার সেই ভালবাসার স্মৃতি নিয়ে আমি বাকিটা জীবন পার করতে পারবো। তুমি শহরে তোমার মা-বাবার কাছে ফিরে যাও, জীবনটা নতুন করে আরম্ভ করে দাও। ”

” কেন এমন করছো? তুমি মোবাইলে কথা বলার সময় এমনটা করতে সবসময়। তখন তোমার সামনে থাকতাম না তাই কিছু করতে পারতাম না। তোমাকে কিছু একটা নিয়ে জোর করলে তুমি মোবাইল বন্ধ করে রাখতে। আমি নিরুপায় হয়ে শুধু কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পরতাম, ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে আবার কান্না করতাম। তুমি কি জানো? তুমি যখন মোবাইল বন্ধ করে রাখতে তখন আমার সবকিছু বন্ধ হয়ে যেতো। কখনো বুঝতে চেষ্টা করেছো তুমি? ”

” আমি কথা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললাম, বাহিরে প্রচুর ঠান্ডা চলো আমরা কেবিনে গিয়ে বসি। ”

” ঠিক আছে চলো। ”

মুন্নীর থেকে আমি এড়িয়ে চলতে চেয়েছিলাম কিন্তু সেটা পারলাম না। প্রথম প্রথম তার সাথে কথা বলার জন্য আমি উদগ্রীব থাকতাম কিন্তু যখন দেখলাম মুন্নী আমার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে তখন আমি তার থেকে এড়িয়ে গেলাম। প্রথমত মুন্নী সুন্দর স্মার্ট ছেলে অপছন্দ করে তাই ভয় ছিল যদি আমাকে দেখার পরে অপমান করে? তাছাড়া আমি এখন ভাগ্যের চক্রে আজ ডাকাত দলের সদস্য তাই মুন্নী যদি সবকিছু জেনে আমাকে ঘৃণা করে? যেদিন মুন্নীর সেই চিঠি পেয়েছিলাম সেদিন চেয়েছিলাম তাকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নিবো। কিন্তু অনেক ভাবনা চিন্তা করে আবারও পিছু হটতে বাধ্য হয়েছি। মুন্নীর সেই চিঠি বারবার পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে গেছে, যখন একা একা নীরবে থাকতাম তখন ডায়েরি মেলে পড়তাম। কতটা ভালবাসা থাকলে অনেক আবেগ দিয়ে চিঠি লেখা যায় সেটা ধারনার বাইরে।

” কেবিনে এসে বললো, তুমি এসবকিছু ছেড়ে দিয়ে শহরে যাবে তারপর ভালো একটা চাকরি করবে। ”

” চাকরি পেতে কষ্ট হবে আর তাছাড়া এই দলের মানুষ ছাড়তে কষ্ট হবে। ”

” তুমি কিন্তু খুব ভালো করে জানো এই পথ তোমার জন্য খুব বিপজ্জনক। প্রতিটি মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি থাকে তাই তোমাকে এসব ছেড়ে সভ্য শান্ত হয়ে স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে হবে। চাকরির ব্যবস্থা আমি করে দেবো কিন্তু তোমাকে সবকিছু ছাড়তেই হবে। ”

” আজকের রাতটা আগে সাবধানে পার হতে হবে এই রাতে কি থেকে কি হয়ে যায় কিছু বলতে পারি না। ”

” আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। ”

” সেটা সম্ভব না মুন্নী, আমার সাথে আরো ছয়জন লঞ্চে আছে। আমরা সবাই সবার দিকে নজর রাখি তাই তোমাকেও তারা নজরে রাখবে। আমি চাইনা আমার জন্য তোমার বিপদ হোক, তুমি স্বাভাবিক আর দশটা যাত্রীর মতো অবস্থান করবে। কাল সকালে ঢাকা ফিরে যাবে আমি পরে শহরে গিয়ে তোমার সাথে যোগাযোগ করবো। ”

” তোমাকে আরেকবার হারিয়ে ফেললে আর ফিরে পাবো না আমি জানি, তাই তোমাকে না নিয়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না। ”

” আমার কথা বুঝতে চেষ্টা করো, এতটা জেদ করা ভালো না, তাই কিছু কিছু বিষয় বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে সমাধান করা লাগে। ”

” একটা অনুরোধ করবো? ”

” কি? ”

” তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবো, এতটা শক্ত করে ধরতে চাই যেন কোনদিন ছেড়ে না যাও। ”

” আমাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ভুল করবে তুমি। ”

” তাতে তোমার কি? ”

” আচ্ছা ঠিক আছে কিছু না। ”

★★

পকেটে মোবাইল বেজে উঠলো, বাহির করে দেখি আমাদের সর্দার কল করেছে। রিসিভ করে কথা বলা আরম্ভ করলাম। ” হ্যালো ভাই? ”

” সজীব কোই তুমি? ”

” কেবিনে ভাই। ”

” তোমার সাথে একটা মেয়ে ঘুরঘুর করছে? ”

” সে কথা আপনার কাছে পৌঁছে গেছে? ”

” অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে সেটা তো পৌঁছানোর কথা তাই না সজীব? ”

” জ্বি ভাই। ”

” আমার ধারণা মেয়েটা আইনের মানুষ। ”

” না ভাই সে কোন প্রশাসনের সাথে জড়িত নেই। ”

” তুমি তার সাথে এত বেশি সঙ্গ কেন দিচ্ছো? তুমি কি তোমার দায়িত্ব ভুলে গেছো? ”

” না ভাই, কিন্তু লঞ্চ চরে আটকে গেছে এখন তো অপেক্ষা করতে হবে। ”

” মেয়েটা কি তোমার সাথে কেবিনে আছে? ”

” হ্যা ভাই। ”

” তাহলে তাকে কেবিনের মধ্যে শেষ করে দাও, কোন প্রকার বিপদের আশঙ্কা রাখতে চাই না। ”

” কি বলেন ভাই? শুধু শুধু তাকে মারার হুকুম কেন করছেন? ”

” বুঝতে পারছি তোমার সাহস কম আছে, তুমি এক কাজ করো। মেয়েটাকে কেবিনে রেখে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যাও তারপর সাজিদের কাছে গিয়ে কেবিনের চাবি দাও। সাজিদ এসে যা করার করবে তুমি ততক্ষণে নিচতলায় ডিউটি পালন করো। ”

চলবে…..

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here