গল্পঃ #রাতের_জোনাকি
পর্বঃ চার
দাদী আমার সাথে প্রচণ্ড অভিমান করেছে। আমার সাথে কথাই বলে না। বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসা ছিল। আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আমি দাদীর কাছে গেলাম। আমার দিকে একবার ফিরেও তাকায়নি। আমি হুট করে বললাম, “দাদী বাবা না-কি কৈ মাছের ঝোল খুব পছন্দ করত? তোমাদের বাড়িতে এতদিন ধরে আছি, একদিন কৈ মাছের ঝোল খেতে পারলাম না।”
দাদী এবার আমার দিকে ঘুরে বসলেন। জানতে চাইলেন, “আর কী কী কয় তোর বাপে? আমার কথা কয় না?
-এখনো মুখ ঘুরিয়ে রাখো। আমি বলব কেন?
-বল না। তোরে কালকা আমি কৈ মাছের ঝোল কইরা খাওয়ামু। তোর দাদাকে কইমু গঞ্জ থেইকা কৈ মাছ লইয়া আইতো।
-হ্যাঁ তোমার কথা বলত। দাদার কথা বলত। দাদা অনেক রাগী। দাদা যখন বাবাকে মারতে আসত তুমি আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখতে। বাংলা ঘরে নিয়ে লুকিয়ে রাখতে।
-বাংলা ঘরডা এহন আর নেই। তোর দাদা কিচ্ছু রাহে না। এহানে ঘরডা থাকলে কী অইতো?
পরদিন দাদী আমাকে বলে দিলেন, “তোর দাদারে বলবি কৈ মাছ লইয়া আইতো”। কিন্তু আমি যখনই গঞ্জে দাদাকে বললাম, “দাদী বলেছে কৈ মাছ নিয়ে যেতে।” দাদা আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোর দাদী বলেছে কৈ মাছের কথা?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ। দাদীকে বলেছি কৈ মাছের ঝোল আমার পছন্দ। তখন দাদী আসার সময় বলে দিল যেন কৈ মাছ নিয়ে যাই।”
দাদা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “তোর দাদী অনেক বছর অইলো কৈ মাছ খায় না। তোর উছিলায় যহন খাইবো, আজ অনেক মাছ কিনমু।
বিকেল সাড়ে তিনটা। দাদা চারটা অবধি ঘুমান। আজ তিনি ঘুমাননি। কৈ মাছ কাটাকুটি দেখছেন। দাদী কারো বারণ না মেনে চাচীর সাথে নিজেও মাছ কুটতে লাগলেন বটিতে। খড় কুটার ছাই দিয়ে মেখে কৈ মাছের বড়ো কাটাগুলো কাটা হচ্ছে। দাদা বললেন, “হীরার মা, আইজ কয় বছর পর কৈ মাছ কিনলাম কও তো? আগে তো কৈ মাছ কিনতাম না। বৈশাখ মাসে ঝড়-তুফান অইলে উঠানেই কৈ মাছ আইতো।”
আমি অবাক হলাম দাদার মুখে কথাটি শুনে। কৈ মাছ না-কি আকাশের গুড়গুড় শব্দে বাড়ির উঠানে চলে আসত।
শানু ছোটো বালতিতে করে পানি নিয়ে আসল। মাছ কেটে পানিতে ভিজানোর জন্য। দাদার কথাটির কোনো উত্তর দেয়নি দাদী।
দাদা এবার একটু রেগেই বললেন, “গতকাল শানুর বিয়ের কথা কওয়ার পর থেইকা তোমরা কেউ ঠিকমতন আমার কথার উত্তরই দেও না। কী এমন কইয়া ফেলছি আমি? যা কিছুই ঘটছিল তাতে তো শানুর কোনো দোষ নাই।
আমি বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেললাম, “কী হয়েছিল দাদা?”
আমি জানি এমন সময় এই প্রশ্ন করাটা উচিত হয়নি। কিন্তু ঐ যে ছোটো বেলা থেকে সব কিছু আগ্রহ ভরে জানতে চাই। যে কারণে জানতে চেয়েছিলাম দাদীর কাছেও, গত রাতে।
দাদা বললেন, “মাস ছয়েক আগে শানুর বিয়ে ঠিক অইছিল। এই বাড়ির উঠানো বড়ো প্যান্ডেল করা অইছে। রায়পুরার শ্রীরামপুর বাজার থেইকা লাইটিং এনেছিল শানুর বাপে। মেহমানরা বাড়ি ভর্তি। গায়ে হলুদে শানুর দুই হাত ভইরা মেনদিও আছিলো। কিন্তু বিয়াডডা শানুর ভাগ্যে আছিলো না। তার হাতের মেনদীর রং চইলা গেছে। জামাইর ঘর করা অইছে না।
-কেন দাদা? বিয়েটা হয়নি কেন?
-বিয়া কাছেই আছিলো। হ্যাওড়াতলী ফটিক মাস্টারের পোলার লগে। গায়ে হলুদের রাইতে পোলার বাইত ডেকসিট বাজাতে চাইছিল। ডেকসিট চিনোস? স্পীকার না-কি কয়। ঐগুলা বাজাইতে কারেন্ট লাগব। তো জামাই কারেন্টের খাম্বায় উঠছিল। আর নাইমা আসতে পারছে না। কারেন্টের শটে মইরা গেছে। পরে এই সব আয়োজন শেষ। মেহমানরা যার যার বাইত গেছে। বাবুর্চিও বড়ো পাতিলে আর রান্না বসায়নি। দই বসানো আছিল ঘর ভরা, সব নষ্ট অইছে। আমার নাতনির কপাল পোঁড়া।
শানু এখান থেকে চলে গেল। চলে যাবার মতোই ঘটনা ঘটেছে। শানুর মন যে খুব খারাপ হয়েছে তা আমি বুঝতে পেরেছি। আর এতগুলো দিন কেন মেয়েটা চুপচাপ থাকত তারও একটা ধারণা জন্মে গেল। শানুর মা বা দাদীর মুখেও কোনো কথা নেই। এ যেন জীবনের এক বিরহ গাঁথা। আমি এখানে বড়োদের মতো একটি কথা বলে ফেললাম,
-আচ্ছা দাদা, শানুর তো আর বিয়ে হয়নি। আর এখানে শানুরও কোনো দোষ নেই। তাহলে এটা নিয়ে কেনই বা এই পরিবারের সবার মন খারাপ থাকবে। ওর তো আবার বিয়ে হবে, তাই না?
দাদা বললেন, “নাতিরে। বাড়ি ভরা মেহমান আছিলো। হাতে মেনদী পরানো হইছে। এর মইধ্যে এমন অঘটন ঘটছে। আর গেরামের মাইনষের সাথে তো তোর পরিচয় নাই। মানুষের স্বভাব চরিত্রও তোর জানা নাই। এই পুরা নয়াচরে প্রতিটি ঘরে জানে মফিজ উদ্দিন খন্দকারের নাতনির বিয়ার আগের দিন তার জামাই মরছে। এত সহজে নতুন করে বিয়া অইবো ভাবিস না। চেষ্টা তো আমরা কম করছি না।
-এই নয়াচরেই বিয়ে দিতে হবে এমন তো কথা নেই।
-এই গেরাম ছাড়াও আরো দুইটা বিয়ে আসছিল। ঐ যে বললাম না, গেরামের মাইনষেরে তো তুই চিনোস না। পোলা শানুকে দেখে চলে যাওয়ার পরে কেউ কেউ ঐ পোলার পক্ষরে অর্ধেক পথ গিয়া শানুর বিয়ের অঘটনের কথা বইলা আসে। যে মানুষগুলা সকাল সন্ধা আমাদের সম্মান করে, সারাজীবন যাদের উপকার করছি তারাও আমার ক্ষতি করে মজা পায়রে নাতি।
আমি কিছু বলতে গিয়েও বলিনি। দাদাও আমার কথা কিছু বলতে গিয়ে আবার আটকে গেল। শুধু বলল, “আমার নাতনিডা অনেক ভালা। এমন মাইয়া পুরা গেরামে হাতে গোনা দুই চাইরডা পাওয়া যাইতো না। তোর মতোন কোনো ভালা পোলা যদি পাইতাম, আমি ঐ পোলারে এই বুকটার মইধ্যে জায়গা দিতাম।
এবার চাচী আর দাদী দু’জনেই দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তবে কিছু বলছেন না। আমারো এখানে কিছু বলা ঠিক হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু দাদা আবারো বললেন, “নাতি তুই তো বিয়ে শাদি করছস না। তোর বাপ মায়ের কেমন পোলার বউ লাগবো? আমার নাতনিটারে পছন্দ করবো?”
দাদার চোখ ছলছল করছে। আমি দাদার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিয়েছি। কিছু বলতেও পারছি না। দাদী এবার মুখ খুলে বললেন, “বুইড়া বয়সে তোমার বুদ্ধি কমে না-কি? নাতিটাকে কেমন লজ্জায় ফেলছ। কথা বলারর থাকলে ওর বাপ মায়ের লগে কইবা। আর নাতি যদি চায় তার বাপ মায়ের সাথে কথা কইবো। তুমি আগ বাড়াইয়া তারে এসব কী কওয়া শুরু করছ?
দাদা বললেন, “ঠিকই তো। নাতি নরসিংদী কোথায় তোমাগো বাড়ি? শানুর বাপ তো প্রায়ই যায় নরসিংদীতে।”
আমি বললাম, “নরসিংদী শাপলা চত্ত্বরের কাছে।” বলে সেখান থেকে কিছু না বলে চলে এসেছি। দাদী ফিসফিস করে বলছে, শরম পাইছে।
আমার বুকের ভিতরটা কেমন যেন করছে। কেমন এক গোলক ধাঁধাঁয় পড়েছি আমি। শানু আমার চাচাত বোন হয়। এই জগতে চাচাত ভাই বোনের বিবাহ আইন ও মুসলিম ধর্মীয় রীতিতে স্বীকৃত। কিন্তু দাদা তো জানেন না আমি তার আপন নাতি। জানার পর কি তিনি বিয়ে দিতে রাজী হবেন? আর শানুই কি রাজী হবে মন থেকে? আমিই বা কতটুকু রাজী? আমি তো শুধু শানুর চোখের গল্পটা পড়তে চেয়েছিলাম। গল্প পড়তে না পারলেও দাদার মুখে শুনেছি। কিন্তু সেই গল্পে কি আমি কখনো জড়াতে চেয়েছিলাম? আমার এখন কী করা উচিত? জোনাকিকে বলেছিলাম আমি একদিন এক রাজকুমারী নিয়ে আসব অনেক দূর থেকে। শানুই কি তবে সেই রাজকুমারী? শানু জোনাকির মতো সুন্দরী না। তবে কেন যেন শানুর মধ্যে এক গভীর মায়া আছে। আমি কি সেই মায়ায় পড়েছিলাম কখনো? আমার মনকে প্রশ্ন করলে মন অনেক প্রশ্নেরই কোনো উত্তর দেয় না। আমার এখনকার প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই আমার মনে। জীবনকে মানুষ কখনো নিজের মতো করে সাজাতে পারে না। জীবন কখনো হয়ে যায় নাটকের মতো। আবার নাটকও তৈরী হয় মানুষের জীবন থেকে। আবার বাস্তবতা মানুষকে মাঝেমধ্যে এমন পরিস্থিতীতে নিয়ে দাঁড় করায় যা সে কখনো এমনটা ভেবেও দেখেনি।
পাটের গুদামে বসে আছি। কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। রাতের অনেকটা সময় ঘুম হয়নি আমার। এরই মধ্যে দাদা ঘুরে ফিরে আবার এসে আমার পাশে বসলেন। এবার সরাসরি বলতে লাগলেন, “বুঝলি নাতি, জগতে মানুষ চেনা বড়ো দায়। তবে আমি মাইনষের চেহারা দেখে চিনতাম পারি। যেমন প্রথমদিন দেখার পরেই তোরে লগে কইরা আইনা চাকরি দিয়া দিলাম। কারণ আমি তোর চেহারার দিকে তাকানোর পরে মন বলছিল, তুই ভালো একটা পোলা। আসলেও তাই, আমি তোরে নিজের নাতির মতোই ভাবি।”
আমি কিছু বলছি না। দাদা কেন আমার প্রশংসা করছে আমি কিছুটা টের পেয়েছি। দাদা আবার বললেন, “শানুও কিন্তু অনেক ভালা মাইয়া। বললাম না আমি মানুষ চিনি। বয়স তো কম হয়নি, সত্তরের উপর আরো দুই।”
দাদা আবারো একটু থামলেন। তবুও আমি চুপ করেই আছি। দাদা চেয়ার টেনে আরেকটু কাছে এলেন। বললেন, “জানিস নাতি আমার কিন্তু অনেক সম্পত্তি। তিন পোলা আছিলো। এক পোলা তো মরে গেল। তবুও কিন্তু আমার সম্পত্তি দুই ছেলের নামেই লিখে দিছি, তোর দাদী ছাড়া কেউ জানে না।”
এবার আমি জানতে চাইলাম, সত্যি করে বলেন তো দাদা আজ কী হয়েছে আপনার?
-তুই এহনো বুঝোস না আমি কি বলতাম চাই?
-না দাদা, আমার বয়স তো সত্তর না। এত জ্ঞান তো নেই আপনার মত। ইঙ্গিতের কথা বুঝতে পারি না।
-দেখ নাতি, বললামই তোকে আপন নাতির মতোই ভাবি আমি। শানুর বিষয়টা এতদিন তুই জানতি না, নতুন করে তোর লগে বিষয়টা বাড়িতেও আবার সবার মনে পড়েছে। সবারই মন খারাপ। আমি বাড়িতে ঢুকে একেকজনের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। হঠাৎই তোর কথা আমার মনে হইলো। বুইড়া বয়সেও তোরে আমার বন্ধু মনে হয়। একটা লাঠি মনে হয়। যাতে ভর করে, ভরসা করে আমি চলতাম পারি। তাই সরাসরি বলতাম পারি না তুই শানুকে বিয়ে কর। কিন্তু এত কিছু বলার কারণ একটাই, আমার নাতনীটা অনেক ভালা। আমার জানার ইচ্ছা তোর কি একটুও পছন্দ হয় না শানুকে?”
দাদার চোখ ছল ছল। আমার এই মূহূর্তে কী বলা উচিত ঠিক বুঝতেছি না। তবুও বললাম, দাদা শানু অনেক ভালো একটি মেয়ে। তাকে অপছন্দ করার মত কোনো কারণ নেই। কিন্তু বাবা…
-তোর বাপের লগে আমি কথা বলমু। নিয়া আয় একদিন। দরকার হইলে শানুর বাপরে পাঠামু নরসিংদী কথা কওয়ার লাগি।
-দাদা আপনি বুঝতে পারছেন না। আসলে বাবাকে আপনি বাড়িতেই ঢুকতে দিবেন না।
-কী বলিস এসব? বাড়িতে ঢুকতে দেব না কেন? এই নাতি বল কেন বাড়িতে ঢুকতে দেব না?
আমি হঠাৎ দাদার হাত ধরে ফেলেছি। তারপর বললাম, দাদা বিশ্বাস করেন আমি আগে জানতাম না আপনি মফিজ উদ্দিন খন্দকার। আমি যখন জেনেছি তখন চলে যেতেও পারিনি।
দাদা আমার হাতদুটো চেপে ধরে বললেন, চলে যাবি মানে? কী হয়েছে?
-কারণ আমার দাদার নাম মফিজউদ্দিন খন্দকার, বাবার নাম রতন খন্দকার।
দাদা অনেক্ষন চুপ ছিলেন। তারপর কিছু না বলে বের হয়ে গেলেন। একটু পর পাতিলে করে কী যেন নিয়ে এসে বললেন, “চল বাড়িতে। আজ দোকান বন্ধ।”
আমি মনে মনে ভাবলাম আজ হয়তো আমাকে বাড়ি থেকেই বের করে দেবে। দাদা গেইট দিয়ে ঢুকেই সবাইকে ডাকছে, “হীরার মা কই তুমি? শানু কই গেলিরে বইন?”
দাদী এলো, শানু আর চাচীও এলো। আমি পেছন পেছন গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। দাদা পাতিলের উপর থেকে কাগজ ছিঁড়ে মিষ্টি বের করে বললেন, “সবাই মিষ্টি খাও। এই শাওন এই নে খা।”
সবাই মিষ্টি খাচ্ছে। দাদী মিষ্টি হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল কিসের মিষ্টি?
দাদা বললেন, “আমি শানুর বিয়া ঠিক করেছি আবার।”
সবাই মোটামোটি একটু অবাক হলো। শানু পিছিয়ে চলে যেতে চাইলে দাদা বললেন, “হীরার মেয়ে শানুর সাথে রতনের ছেলে শাওনের বিয়ে। শাওন রাজী, শুধু তার বাপ মা’রে নিয়া চিন্তা। শাওনকে পাঠাইয়া দেও ওর বাপ মা’রে নিয়ে আসুক আমরা কথা বলি।”
দাদার চোখে পানি। কেন যেন। দাদীর চোখও ছলছল। শানু পেছন ফিরে আর তাকায়নি। তাই বুঝতে পারিনি শানু বিয়ের কথা শুনে লজ্জা পেয়েছে না-কি মন খারাপ করে চলে গেছে। আমি স্তব্ধ হয়ে আছি, জগতে এভাবেও বিয়ের কথা হয়।
দাদী বললেন, “নিজের নাতিরে চিনতে এত সময় লাগলো?”
দাদা বললেন, “প্রথমদিন হাঁটুভাঙ্গা স্টেশন থেইকা আসার সময় তারে পথম দেখেই কেমন যেন আপন মনে হইলো। লগে কইরা লইয়া আইলাম। এতটা আপন এটা ভাবছি না হীরার মা।”
বিকেলে আমি বের হবো নরিংদীর উদ্দেশ্যে। দুপুরে খাবার পর নিজের ঘরেই পায়চারি করছিলাম। মনে মনে আশা করছিলাম শানুর সাথে দেখাটা হোক। শানু পানি আনতে যাচ্ছিল নলকূপে। আমি ডাকলাম, শানু দাঁড়ালো কিন্তু ঘরে আসেনি। শানু নিজেই বলল, “বেঞ্চের কাছে আসেন।”
আমি বুঝে নিলাম, শানু বেশ বুদ্ধিমতিও বটে। এখানে কথা বললে কেউ না কেউ দেখবে। পূর্ব দিকের বেঞ্চটিতে বসে মাঝে মাঝে আমি বই পড়ি। বেশ নিরিবিলি জায়গা। শানু দাঁড়িয়ে আছে পানির জগ নিয়ে। আমি বললাম, “আসলে কী থেকে কী হয়ে গেল বা হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। তুমি তো জানো, চোখের সামনেই হারানো তোমাদের সবাইকে খুঁজে পেলাম। কিন্তু তোমাদের খুঁজে পাওয়ার সাথে তোমাকে খুঁজে পাব বা পাওয়ার দরকার ছিল সেটা ভেবে দেখিনি কখনো। দাদা আমাকে আমাদের বাড়ি পাঠাচ্ছেন বাবা মা’কে নিয়ে আসতে। আমি এখানে অতিথী হয়ে এসেছিলাম। এখন পরিচিত, আত্মীয়। তুমি যদি চাও তাহলে আমি বাবা মা’কে নিয়ে আসব। আর যদি তোমার আপত্তি থাকে, আমি যাব ঠিকই কিন্তু আর ফিরে আসব না।”
শানু কিছুক্ষণ পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “আমি আগে খুব চঞ্চল ছিলাম। এখন শান্ত হয়ে গেছি। কিছু দুর্ঘটনা অল্প দিনের না, সারাজীবনের। আমি আপনাকে দুইটা কথা বলব, এক, যদি আমাকে করুণা করেন, আমার বিয়ে হবে না ভেবে আমাকে বিয়ে করতে রাজী হোন বা ইচ্ছে পোষণ করেন তাহলে আপনার ফিরে আসার দরকার নেই। আর আমার যে বিয়ে হবে না, এটা ভুল ধারণা। আজ হোক কাল হোক বিয়ে আমার হবে। হোক ভালো উচ্চ ঘর কিংবা কোনো গরীব ঘরে। সুতরাং আমাকে করুণা করার কিছু নেই এখানে।
দুই, আপনি যদি আমাকে পছন্দ করে থাকেন। তাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই। বা যদি মনে করেন দাদা আপনাকে প্রস্তাব করেছে আমাকে বিয়ে করার জন্য। আপনি যদি ভেবে থাকেন, আমাকে বিয়ে করলে রতন চাচা ফিরে আসবে। বা দাদা রতন চাচাকে বুকে টেনে নিবে। দাদা দাদী শেষ বয়সটাতে একটু সুখ দেখতে পাবে। সেটা মনে করেও যদি আমাকে বিয়ে করতে রাজী হোন, তাতেও আমার আপত্তি নেই আমি রাজী। একটি পরিবারের সুখ ফিরিয়ে দিতে, ভাঙ্গা পরিবারকে জোড়া লাগাতে গিয়ে নতুন সম্পর্কের বন্ধনকে তখন করুণা বলব না আমি।”
রাধাগঞ্জ বাজার থেকে সিএনজিতে উঠলাম, নামলাম গিয়ে সোজা আরশীনগর। সেখান থেকে রিক্সা নিয়ে শাপলা চত্ত্বর বাজার।
গেইট দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকার সময় জোনাকির ছোটো ভাইটা আমাকে দেখেছে। এখন দৌড়ে তাদের বাড়ি যাচ্ছে, নিশ্চয় জোনাকিকে বলবে আমার আসার কথা।
মা রান্না ঘরে। বাবা চেয়ারে বসে ছিলেন। আমাকে দেখে বাবা কোনো অবাক হয়নি এমন ভাব ধরেছেন। রাগী মানুষদের স্বভাবই এমন। বাবা বললেন, “শাওনের মা। তোমার গুণধর ছেলে বউ নিয়ে এসেছে।”
আমি তো অবাক, কোথায় আমি বউ নিয়ে আসলাম?
মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। গেইট খুলে বাইরে চুপি দিয়ে দেখে এলেন কেউ নেই। বাবাকে মা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় বউ? কেউ তো নেই।
বাবা বললেন নেই কেন? আমি তো ভেবেছি কোনো মেয়ের সাথে লাইন ছিল তাই আমি বিয়ে ঠিক করাতে মেয়ে নিয়ে পালিয়েছে। সেজন্য ভেবেছি বউ নিয়ে ফিরেছে। যেহেতু বউ নিয়ে ফিরেনি, জোনাকির বাবা মা’কে খবর দাও আর ছেলেকে বুঝাও। মেয়েটার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর সে পালি গেছে। সুতরাং বিয়েটা আবার হবে, তাতে কোনো দোষের নেই।
মা বললেন, এতদিন পর ছেলেটা এলো, ওকে একটু শান্তিমত বসতে দাও।
বাবা বললেন, বসলেও আমার কথা এটাই থাকবে। আর আবারো যদি চলে যায় তাহলেও কথা এটাই থাকবে।
—(চলবে-)
লেখনীর শেষ প্রান্তে,,,,
,,,,,ওমর ফারুক শ্রাবন