রাতের_জোনাকি পর্বঃ তিন

0
1126

গল্পঃ #রাতের_জোনাকি
পর্বঃ তিন

বিকেলটা আমার বড়ো আলসেমিতে কাটে। ঠিক করেছি দাদা যদি মাস শেষে আমাকে বেতন দেয় তবে কিছু গল্পের বই কিনে আনব। অবসর সময়টা তাহলে আর খাতায় হাঁস মুরগী এঁকে কাটাতে হবে না।
-শাওন ভাই মা আপনারে ডাকে।
এই মেয়েটার কাজই শুধু কে আমাকে ডাকল সেই খবর দেয়া। আর কিছু বলতে পারে না? আড় চোখে না তাকিয়ে সরাসরি তাকাতে পারে না? আমি তো শানুর চোখে গল্প পড়তে চেয়েছিলাম। শানুর প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা আছে? মনে হয় না। শানুর চেয়ে জোনাকি যথেষ্ট সুন্দরী। তবে কিসের গল্প পড়তে চাই আমি? মনকে প্রশ্ন করলে সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় না। তবে নিজে থেকে একটি উত্তর খুঁজে পেয়েছি। ছোটোবেলা থেকে প্রতিটি বিষয় জানার তীব্র ইচ্ছে আমার। এটা কেন হলো? না হলেই বা কী হতো। তেমনি হয়তো শানুর চোখে গল্প পড়ার একটি আগ্রহ তৈরী হয়েছে আমার মস্তিষ্কে। তবে চোখের ভাষা বুঝার ক্ষেত্রে মেয়েরা এগিয়ে। রাস্তায় হাঁটার সময়ও মেয়েদের দিকে কেউ তাকালে তারা বুঝতে পারে কোনটা প্রেমিকের চোখ কোনটা লালসার চোখ। ছেলেরা এক্ষেত্রে কম বুঝে।
শানুর মা আজ আমাকে প্রথম ডেকে পাঠালেন। তাদের ঘরেও এর আগে আমি যাইনি। ঘরের দরজার কাছে যেতেই শানুর মা বললেন, “বাবা ভিতরে আসো। এতদিন হয়ে গেল তোমার সম্পর্কে কিছুই জানা হয়নি।”
আমি ঘরে ঢুকে বেতের চেয়ারে বসলাম। এই বাড়িতে বেতের চেয়ার বেশি। আমি লাজুকতা বজায় রেখে মাথা যথেষ্ট নিচু করে বসেছি।
-তোমাদের বাড়ি কোথায়? লেখাপড়া কতদূর করেছো?
-জ্বি আমাদের বাড়ি নরসিংদী। অনার্স থার্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়েছি।
-বাবা মা দু’জনই আছেন? বলে এসেছো তাদের কাছে?
-হ্যাঁ আছেন। বাড়ি থেকে বলেই এসেছি।
পরক্ষণে মনে হলো অনেক বড়ো একটি মিথ্যে বলে ফেললাম। শানু এই ঘরে নেই। গেছে হয়তো কোথাও। একটু পর দেখি একটি ঝুড়িতে করে আপেল আর ডালিম নিয়ে এলো। এখনো পানি পড়ছে ঝুড়ি থেকে। নলকূপে গিয়েছিল নিশ্চয়।
-খাও বাবা। তোমার মা তো অনেক দূরে। চাচীও মায়ের মতোই হয়। এই বাড়ির সবাই কিন্তু তোমাকে আমাদের পরিবারের একজন মনে করে।

আমি একটি আপেল নিলাম হাতে। শানু আড় চোখে তাকায় মাঝে মধ্যে। কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে খেতে লজ্জা করে। মনে মনে ভাবছি, শানুর এই আড়চোখে তাকানোর কোনো রহস্য আছে? সে কি আমার প্রতি দুর্বল? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইনি আমি, নিজে ফেঁসে যেতে পারি। কারণ আমি তো আরো শানুর চোখের গল্প পড়তে চাই।
-এই বাড়িতে থাকতে তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো বাবা?
-না আন্টি। তবে বিকালটা কাটতেই চায় না। দাদাকে বলে কিছু গল্পের বই কিনে আনব ভাবছি।
-বই? শানু তোর না কত গল্পের বই? শাওনকে তো দিতে পারিস। তুই তো বই পড়োস না, সারাদিন টৈ টৈ করোস।

মেমসাহেব, নন্দিত নরকে, ডঃ লুৎফর রহমানের রচনাসমগ্র, আশার মুকুল, বিলম্বিত বাসর, পাহাড়ী ললনা এই বইগুলো নিলাম। আরো বই আছে শানুর কাছে। তবে এই গুলোতে আমার বহুদিন কেটে যাবে। যদিও কয়েকটা বই আমার আগেই পড়া। বই পড়ার জন্য পূর্ব দিকের আমগাছের নিচের বেঞ্চটিকে বেছে নিয়েছি। বাঁশের বেঞ্চটিতে বসে আমগাছে হেলান দিয়ে বসা যায়। এখান থেকে দেখা যায় শানুর চাচা মানিক খন্দকার যেখানে মারা গিয়েছিল। কচুরির নিচে না-কি লাশ পাওয়া গিয়েছে। আচ্ছা এখানে পানি কতটুকু? ঠাঁই পাওয়া যায়?
-আমার হাতের লেখা অনেক খারাপ। অনেক চেষ্টা করেও ভালো করতে পারিনি। আপনার হাতের লেখা অনেক সুন্দর।
পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি শানু দাঁড়িয়ে। একটু অবাক তো অবশ্যই। যে মেয়েটা আমাকে ডেকে দেয়া ছাড়া আর কিছুই বলত না সে নিজে থেকে কথা বলছে। মনুষ্য জীবনে অনেক অবাক হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। সব মনে রাখা যায় না। তবে শানু নিজ থেকে আগে কথা বলেছে এটা আমার বহুদিন মনে থাকবে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, আমার হাতের লেখা দেখেছেন কোথায়?
-আপনি আমার পুরাতন খাতায় কবিতার লাইন লিখেছেন।
-ও হ্যাঁ। সময় কাটে না তাই যা মনে আসে লিখেছিলাম।
-জানি, ‘পঁচা লেখা’ এই কথাটা আপনি মোট ষোল বার লিখেছেন। আমার হাতের লেখার জন্যই যে লিখেছেন সেটা আমি জানি।
বলেই মেয়েটা চলে যাচ্ছে। বড্ড মন খারাপ হয়েছে হয়তো মেয়েটার। আমি ডাকলাম,
-এই শানু। একটু শুনেন তো।
মেয়েটার চোখ ছল ছল করছে। এত অল্পতে কারো মন খারাপ হয়? আবেগের বয়সটা তো তার পেরিয়ে আসার কথা। আমি তাকে বললাম,
-আচ্ছা আপনার যে চাচা বাড়ি থেকে চলে গেছেন, তিনি এখন কোথায়? আর খোঁজ পাওয়া যায়নি?
-বাবা একদিন মায়ের সাথে বলছিল, সেই চাচাকে না-কি দোকানের মাল কিনতে গিয়ে নরসিংদী বাজারে দেখেছিল। বাবা বাড়িতে এসে দাদা দাদীকে কিছু বলেননি। যদি আবার দাদা দাদী রাগ করেন সেজন্য।
-আচ্ছা দাদাজানের নামটা কী?
-হায় আল্লাহ, আপনি এতদিন ধরে দাদার সাথে গঞ্জে যান আর দাদার নাম জানেন না? দাদার নাম মফিজ উদ্দিন খন্দকার। আর এটা খন্দকার বাড়ি। গঞ্জ থেকে আসার পথে যে স্কুল পড়ে, সেখান থেকে এই পুরোটাই খন্দকার গোষ্টি।

আমি বসা থেকে উঠে গেলাম। আমার শরীরটা একটা কাঁপুনি দিলো। কিছু সময়ের জন্য নিজেকে পাথর মনে হলো। আমার কী করা উচিত? বাড়ি ছেড়ে চলে যাব? চাকরি ছেড়ে দেব? বাবা কী চাচাকে সত্যিই মেরেছিলেন? শানু তাহলে বড়ো চাচার মেয়ে? অনেকগুলো কথা, প্রশ্ন মস্তিষ্কে বিচরণ করছে। আমি সোজা হেঁটে চলে এলাম ঘরে। শানু দুইবার পেছন থেকে ডেকেছিল। যে বইটা নিয়ে গিয়েছিলাম পড়ার জন্য সেটা বেঞ্চেই ফেলে এসেছি। শানু এবার বই নিয়ে হাজির সরাসরি ঘরের ভিতর। আগে কখনো আমি থাকলে শানু এই ঘরে আসেনি।
-কী হয়েছে আপনার? দাদার নাম শুনে এমন হয়ে গেলেন কেন? এভাবে চলে এলেন যে?
-না কিছু না। এমনি, ভালো লাগছে না।
-নিশ্চয় কোনো কারণ আছে, বলুন আমাকে।

বলা উচিত হবে কি-না ভাবছি। আমার চোখ ছলছল করছে। নিজের দাদার বাড়িতেই আছি এতদিন। দাদা দাদী, চাচাদের কথা ভেবে চোখে খুশির পানি না-কি বাবার কথা ভেবে চোখে দুঃখের পানি আসলো বুঝতে পারছি না। আমি শানুকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,
-তোমার সেই চাচার নাম কি রতন?
-হ্যাঁ, আমার বাবার নাম হীরা। মেঝো চাচার নাম রতন আর ছোটো চাচার নাম মানিক। কিন্তু আপনি জানেন কী করে? কে আপনি?
-আমি শাওন। তোমার সেই রতন চাচা আমার বাবা।
শানু আমার দিকে তিন সেকেন্ডের মতো তাকিয়ে ছিল। সে বের হয়ে যাচ্ছে। তাকে ডাক দিয়ে ফেরানো উচিত ছিল। বলার দরকার ছিল, কাউকে বলো না। বলতে পারিনি। শানু কি সবাইকে বলে দিবে? বলে দিক, দাদা হয়তো বাড়ি থেকে বের করে দিবে। এর বেশি তো আর কিছুই না।

শানুর মা ঘরে ঢুকলেন। পেছনে শানু দাঁড়িয়ে আছে।
-শানু যা বলছে তা সত্যি? বাবা তোমাদের কি নরসিংদী বাজারে কোনো দোকান আছে?
-হ্যাঁ, দুইটা দোকান। আপনি জানেন কীভাবে আন্টি?
-শানুর বাবা বলেছে। দুইদিন তোমার বাবাকে দেখেছে নরসিংদী বাজারে। তুমি সত্যিই তাহলে শানুর চাচার ছেলে। এখন হুট করে তোমার দাদাকে কিছু বলিও না বাবা।
শানুর মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মুখে প্রশান্তির খুশি খেলা করছে। আমারই কেবল মনের ভিতর আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছে।

পরদিন সকালে পাটের গুদামে দাদার দিকে তাকিয়ে আছি। দাদার বয়স বায়াত্তর বছর। বৃদ্ধ মানুষটির ভিতরে একটা কষ্ট পুষে রেখেছেন। মধ্য দুপুরে চেয়ার টেনে ঝিমাতে থাকেন। তার তিনটি ছেলেই যদি আজ থাকত, এই বয়সে তিনি নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করতে পারতেন।
-কী দেখো নাতি তাকাইয়া?
দাদা আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন।
-কিছু না দাদা। আচ্ছা দাদা, দাদীর মুখে মানিক চাচার ঘটনা শুনলাম। আপনার কি মনে হয় এটা জ্বিন ভূতের কাজ?
-তোর দাদীর আইজ খবর আছে। বাড়ি গিয়া লই।
-দাদী আবার কী করল? বৃদ্ধা মানুষ, এক ছেলেকে শুধু হারায়নি। দুইটি ছেলে একসাথে হারিয়েছে। তার চোখ দিয়ে তো অনবরত পানি পড়েই। উনি তো পেটে ধরেছেন।
-পেটে ধরছে বইলা কষ্ট বেশি, জন্ম একলা দিছে? আমার কষ্ট লাগে না? মেঝো পোলারে তো আমি বাইর কইরা দেই নাই। রাগের মাথায় মারছি। তোর দাদী আইজও আমারেই দোষে, আমি না-কি বাড়ি থেইকা বাইর কইরা দিছি।

দাদার চোখ ছলছল করছে। এমন পরিস্থিতী হবে জানলে কিছুই বলতাম না। চুপ করে থাকতাম। দাদা চেয়ার নিয়ে আমার কাছে এসে বসলেন। আমি যে চেয়ারে বসেছি তার হেলান দেয়ার জায়গাটার ঠিক উপরে দাদার হাত। যেন আমি দাদারই বাহুডোরে।
-নাতি তোরে একখান কথা কই। এহন আমাদের বাড়িত কারেন্ট আছে। একটা সময় আছিলো মাগরিবের আজান অইলে পা ধুইয়া ঘরে চইলা যাইতাম। কুপি জ্বালিয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। তখন বাড়ি ঘর ছিল খুবই কম। জ্বিন ভূত আছিলো অনেক। পাইন্যা ভূতে মাছ খায়। অনেকে পেত্নিও কয়, অনেকে আজরও কয়। ঐসব আজর, পেত্নি মাইনষেরে পানিত চুবাইয়া মারে। তহন পরিবারের ছোটো পোলা, এক মায়ের এক পোলা, তিন চার ভাইয়ের একমাত্র বইন, এগুলারে জ্বিন,ভূত আর আজরে ধরত। আমি জানি আমার মাইজ্জা পোলা কেমন আছিলো। হেয় ভাইরে মারব, এইডা আমার কখনো মনেও আইবো না। তয় মাগরিবের পরে আমরা ঘরে গিয়া বইসা থাকতাম। অথচ মাইজ্জা পোলায় আমার চার ব্যাটারির টর্চ লইয়া ছোটোটারে লইয়া মাছ ধরতে যে নামল। এই অঘটনের পর কার মাথা ঠিক থাকেরে নাতি?মারছি, রাগের মাথায় অনেক পিটাইছি। কেউ আইসা আমার হাত ধইরা ফিরাইবো এমন সাহস কারো আছিলো না। কিন্তু মাইর খাইয়া যে পোলাটা বাড়ি ছাইড়া চইলা যাইবোরে নাতি সেইটা ভাবি নাই। গেছে তো গেছে আর একটাবার আইলো না।

দাদা চোখ মুছে বলল, “আয় বাড়ি যাইগা। আইজ মঙ্গলবার, পাইকার আর আইবো না।”
দাদার সাথে আড়িয়াল খাঁ পাড়ি দেওয়ার সময় বললাম, “আচ্ছা দাদা, যদি আপনার মেঝো ছেলে হুট করে একদিন যদি বাড়ি ফিরে আসে। আপনি তারে বাড়ি জায়গা দিবেন, না বের করে দিবেন?
দাদা মধ্য পথে থামল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, যেই পোলা এতদিন আইয়ে নাই, হেয় আর কোনোদিন আইবো না।
আমি আর কথা বাড়াইনি। দাদার সাথে বাড়ি গেলাম।

খেয়াল করে দেখলাম শানু আজকাল আমার সামনে আসে না। আগে আড়চোখে তাকিয়ে থাকত, মুখ টিপে হাসতো। আর এখন মোরগ ডাকা ভোরে শুধু একবার এসে, “শাওন ভাই দাদাজান আপনারে ডাকে।” এর পর আর মেয়েটাকে খুঁজে পাই না। পুরো বিকেলটা বই পড়ে কাটলেও জানালা খুলে দৃষ্টিটা আড়চোখে বাইরেই দিয়ে রাখি। কিন্তু শানু আমার সামনে আসে না। আমি তার চাচাত ভাই এজন্য আমাকে আড়াল করছে? হয়তো আমাকে পছন্দ করত বা আমার প্রতি দুর্বল ছিল। যখন জানতে পারল আমি তার চাচাত ভাই তখন আড়ালে থাকতে চায়। তা হতে হবে কেন? সত্যিই যদি দুর্বলতা থাকে আমার প্রতি থাকুক না। জগতে কি চাচাত ভাই বোনের বিয়ে হচ্ছে না? আর কেউ তো আগে থেকেই জানতাম না। তাহলে হয়তো দৃষ্টি, মন-মানসিকতা সেরকম থাকত। কিন্তু আমি এতকিছু ভাবছি কেন? এখন তো মনে হচ্ছে আমিই শানুর প্রতি দুর্বল ছিলাম।

দাদী শানুর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। আমি দাদির পিছনে গিয়ে বসলাম। বললাম, “দাদী দেও আমি তোমার চুলে বিলি কেটে দেই।”
-আমার চুলে পাক ধরছে নাতি। এই চুল বিলি কাইটা কী হইবো?
শানু আমার কণ্ঠ শুনে উঠতে চাচ্ছে। দাদী শানুর চুল টেনে বসিয়ে বলল, “অর্ধেক মাথা বিলি দিলে মাথা ব্যথা ঘাড় ব্যথা হইবো হারা রাইত। এইডারে কয় আধকপাইল্যা বিষ। শিখ্যা রাখ, কামে দিব। বিলি শেষ হইলে উডিস।”
এবার ঠিকই বুঝতে পেরেছি, শানু আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমি দাদীর চুলে আঙ্গুল পেঁচিয়ে আবার সোজা করছি।
-কিরে নাতি, দুইটারেই দখল দিলি না-কি? আমারটারে সহ নিয়া গেলে বুইড়া বয়সে আমার চলব কেমনে?
পেছন ফিরে দেখি দাদা ঘুম থেকে উঠে এলেন। আমি নাকি দাদী নাতনি দুইজনকে দখল দিয়েছি। বহুদিন পর এমন দুষ্টুমি শুনে ভালোলাগা কাজ করল। কাছেই নানীর বাড়ি আমার। নানীর বাড়ি গেলে নানা প্রায়ই বলত, “এই নাতি এই বুড়িটারে নিয়া যা তো। আমি চুলে কলব লাগিয়ে আরেকটা বিয়া করে আনি।” আর নানি নানারে বকা দিত। “বুইড়া বয়সে ভিমড়তি। এক ঠ্যাং কবরে গেছে, বিয়ার খায়েশ গেল না।”

সন্ধ্যায় আমার ডাক পড়ল আবার। এইবার শানু আসেনি। দাদা জোর গলায় ডাকলেন। এই বয়সেও গলার জোর কত, মাশা-আল্লাহ। গিয়ে দেখি, সবাই চূলার কাছে। চাচী তেলের পিঠা বানাচ্ছে। একটি করে পিঠা গরম তেল থেকে নামাচ্ছে আর একজনকে দিচ্ছে।
-আসো বাবা আসো, পিঠা খাও।
চাচী বাসনে একটি পিঠা এগিয়ে দিলো। দাদা বললেন, “নাতি এখানে বইসা খাও। তেলের পিডা খাইতে অয় চূলার ধারো বইসা। গরম পিঠাও খাইবা মাঝে মধ্যে গরম তেলের ছিটাও খাইবা, হা হা।”
সবাই হেসে উঠল। মনে হচ্ছে কোনো দুঃখ তাদের কখনো স্পর্শ করেনি। আমরা মনুষ্য জাতি এজন্যই পৃথিবীতে টিকে আছি। শত দুঃখেও একটু আনন্দের উপলক্ষ পেলে অথৈ নদীতে খড় কুটার মত আঁকড়ে ধরে একটু আনন্দ পেতে চাই।
দাদা বললেন, “এইবার শানুর বিয়ে দেওন লাগব। তাইলে শানু যহন হওরর বাড়িত থেইকা এই বাড়িত নাইঅর আইব তহন ওর হওর বাড়িত থেইকা কয়েক জাতের পিডা লইয়া আইব, হা হা।”
কিন্তু এবার দাদার সাথে আর কেউ হাসল না। সবাই কেমন চুপ হয়ে গেল। কারো মুখে হাসির রেশমাত্র নেই। শানু হুট করে উঠে ঘরে চলে গেল। দাদা মুখে দেয়া পিঠাটুকু খেতে ভুলে গেলেন। মনে হচ্ছে অনেক বড়ো ভুল হয়ে গেছে, দাদা এর শাস্তি পাচ্ছেন। শুধু আমিই কেবল জানি না ঘটনা কী।

সন্ধ্যা রাতের পিঠা খাওয়ার অনেক পরে দাদী এলেন আমার ঘরে। শানু বাইরে দাঁড়িয়ে। দাদী এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, কপালে চুমু খেলেন। দাদীর চোখে পানি। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই দাদী বললেন, “তোর কাছে রতনের কোনো ছবি আছে? আমি অনেক বছর তোর বাপটারে দেহিনারে নাতি।”
এবার বুঝতে পেরেছি। এটা শানুর কাজ। শানু দাদীকে সব বলে দিয়েছে। আমি ডাকলাম শানুকে, “এই শানু ঘরে আসো, শুনে যাও। ”
শানু ডাক শুনে চলে যাচ্ছে। আমি এক পা ঘরের বাইরে দিয়ে আবার ডাক দিলাম, “এই যে শানু ডাকছি কিন্তু তোমাকে।”
ঐ পাশের ঘর থেকে শানুর মা বের হলো।
-কী হয়েছে শাওন?
এবার তো আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। আমি শানুকে ডাকছি আর শানুর মা জানতে চাচ্ছে কী হয়েছে। আমি কথা ঘুরিয়ে বললাম, আসলে দাদী আসছে আমার ঘরে। অন্ধকার, তাই শানুকে বলছিলাম দাদীকে নিয়ে যেতে। একা যেতে পারবে না-কি।
-এই চলে এলি কেন? যা তোর দাদীকে নিয়ে আয়।
শানু তবুও ফিরে এলো না। কেন হলো এমনটা? শানু তার মা’কে মুখের উপর বলল, “আমি পারব না।”
এখন কী যেন মনে করে শানুর মা। বা হয়তো মেয়ের কাছে জানতে চাইবে বিষয়টা কী? লজ্জার ব্যাপার। কেন যে ডাকতে গেলাম।

দাদী এরই মধ্যে আমার বিছানায় বসে আঁচলে চোখ মুছে আর কাঁদে। আমি দাদীর কাছে গিয়ে বললাম, “আচ্ছা দাদী, শানুর বিয়ের কথা শুনে পিঠা খাওয়ার সময় সবাই চুপ হয়ে গেল কেন?”
দাদী রাগ করে আমার ঘর থেকে চলে যাচ্ছে। আটকিয়ে রাখতে পারছি না। তিনি বলতে লাগলেন, “আমি তোর কাছে তোর বাপের ছবি আছে না-কি জানতে চাইছি আর তুই আছোস বিয়া লইয়া।”
আমি আর কিছু বলতেও পারলাম না। দাদা শুনতে পেলে হয়তো এই রাতের বেলাতেই বের করে দিতে পারে। কিন্তু ভাবনাটা রয়েই গেল। শানুর বিয়ের কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল কেন? আর আমি ডাকার পরও শানু কেন এলো না? সে মনে হয় আমাকে এড়িয়ে চলতে চায়।

——–(চলবে-)

লেখনীর শেষ প্রান্তে,,,,,,,,,,
,,,,,,,,,,,ওমর ফারুক শ্রাবণ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here