রাতের_জোনাকি পর্বঃ দুই

0
1302

গল্পঃ রাতের_জোনাকি
পর্বঃ দুই

আমার ঘুম ভাঙ্গল বিকেলে। ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে আমি ভয় পাচ্ছিলাম। আমার ভয় কাটাতে একদল জোনাকি ছুটে এলো। মিট মিট করে আলো ছড়াচ্ছে। জোনাকির আলোর দিকে তাকিয়ে আমার ভয় কেটে গেল। সেই সাথে ঘুমও ভেঙ্গে গেল। খেয়াল করে দেখলাম কপালের কাছে চুলের গোড়া ঘামে ভিজে উঠেছে। আমি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমার গোসল করা দরকার। আজ তো গোসল করিনি। দুপুরে হাত মুখ ধুয়েই খেতে বসেছিলাম। আমার একটা লুঙ্গি দরকার। বাড়ির পাশে যেহেতু নদী, সাতরিয়ে গোসল করতে মন্দ লাগবে না। আমাদের বাড়ির পাশের দিঘীতে ছোটোকাল থেকে সাতরিয়ে গোসলের অভ্যেস। আর এখন এই আড়িয়াল খাঁ নদী পেয়ে সাতার কাটার লোভ তো হতেই পারে।
-এই তুমি এদিকে আইয়ো নাতি। তোমারে ভালা কইরা দেহি।
দুপুরে যেখানে বসে ভাত খেয়েছিলাম সেখানে একটি বেতের চেয়ারে বসে বৃদ্ধা মহিলা আমাকে ডাকছে। আমি এগিয়ে গিয়ে বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে আছি।
-তোমার নাম শাওন, তাই না? তোমার দাদা কইছে আমারে। আমারে দাদী ডাকবা। আর তোমার দাদীর বাড়িত যা আছে, সব নিজের মনে করবা। মনে থাকব?
-জ্বি দাদী, মনে থাকবে।
-আয় কাছে আয়, আমি তোর মাথায় হাত রেখে দোয়া করি। আমি তুমি করে বলতে পারব না। আমার আরেকটা নাতনি আছে যে, তারেও তুই করেই বলি।

দাদী আমার মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, ঘুম কেমন হইছে?
-ভালো দাদী। কিন্তু আমার গোসল করা হয়নি এখনো। একটা লুঙ্গি হলে ভালো হতো।
-লুঙ্গি দিতাছি, সাতার জানোস তো? এই শানু এই, দেখে যা তো।
পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি দুপুরের মেয়েটা। এখনো তার মাথায় ওড়না। এদিকে আসার সময়ও তার দৃষ্টি নিচের দিকে। আমার মনে হয় আমি যে এই বাড়িতে এসেছি আমার চেহারাটাও ঠিকমত দেখেনি মেয়েটা। পথে যদি দেখাও হয়, তবুও আমাকে চিনতে পারবে না। যে আমি এই বাড়িতে এসেছি।
-শানু তোর বাবার একটা লুঙ্গি আইন্না দে তো বইন, শাওন এখনো গোসল করেনি।
মেয়েটা যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবে চলে গেল লুঙ্গি আনতে। যেন একটা যন্ত্র চলাফেলা করছে। সুইচ টিপলেই নড়বে, চলাফেরা করবে।

বিকেল বেলাও নদীতে বাচ্চারা গোসল করে। একেকটা বাচ্চার চোখ লাল টক টক করছে। তবুও এক নাগারে ডুব দিয়েই যাচ্ছে। দুইটা কলাগাছ আছে দুই জনের দখলে। লোখ সামলাতে না পেরে ওদেরকে বললাম, আমাকে একটা কলাগাছ দিবা?
অমনি একটি বাচ্চা কলাগাছ থেকে নেমে আমার দিকে কলাগাছটি ঠেলে দিয়ে সাতার কাটে আর ডুব দেয়। আমি কলাগাছ নিয়ে একদম মাঝ নদীতে। বিকেলের রোদ কম। আমি পানিতে কলাগাছে পা পেঁচিয়ে শুয়ে আছি আকাশের দিকে মুখ করে। যেন ফিরে এসেছি আমার ছোটোবেলায়। জোনাকির কথা মনে পড়ছে। বৃষ্টি হলেই আমাকে ডাকতে আসত। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে আবার নামতাম পুকুরে। তখন বৃষ্টির পানি ঠাণ্ডা আর পুকুরের পানি গরম। ডুব দিলে গরম, ভেসে উঠলে ঠাণ্ডা। সেই ছোটো জোনাকি বড়ো হয়ে গেল কত দ্রুত। সে না-কি আবার আমাকে ভালোও বাসে। আমারই কেবল জোনাকির প্রতি প্রেম এলো না। আমি তো পালিয়ে এসেছি, জোনাকি মনে হয় অনেক কষ্ট পেয়েছে। আমার কী করার ছিল? যার জন্য মনে কোনোদিন প্রেম আসেনি। যার প্রতি বন্ধুত্ব ছাড়া কোনোদিন ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনি। তাকে বিয়ে করে সংসার পাতব? সেজন্যই চলে এসেছি। এবার বাবাও বুঝুক, সন্তানের মতামত না নিয়ে বিয়ের দিন-ক্ষণ ঠিক করাটা কতটা ভালো হয়েছে।

সন্ধ্যা রাতে নিজেকে খুব একা লাগছে। ঘরের মধ্যেই বসা ছিলাম। একা একা সময় কাটছে না। এত বড়ো বাড়ি, ছয়টা ঘর। অথচ সারা বাড়িতে মানুষ পাঁচজন। দাদা দাদী, আর শানু নামের মেয়েটা ও তার বাবা মা। আমার সাথে কথা বলার মতো কেউ নেই। নিজেকে নির্বাসিত মনে হচ্ছে। কোনো এক অচেনা অজানা দ্বীপে বসে একাকীত্বের বিষাদের মত। ঘরের দরজা খোলা। একা থাকলে আমার গুনগুন করে বেসুরে গলায় গান গাওয়ার অভ্যেস আছে। তবে এখন একটু জোরেই গাওয়ার চেষ্টা করছি। চারপাশ নীরব, বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায়। আমি গাইতে লাগলাম..
আমার ভাঙ্গা ঘরের, ভাঙ্গা চালা ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁকে
অবাক জোছনা ঢুইকা পরে হাত বাড়াইয়া ঢাকে
হাত ইশারায় ডাকে কিন্তু মুখে বলে না
আমার কাছে আইলে বন্ধু আমারে পাইবা না।

তুমি আমার হইলা না গো তুমি রইলা দূরে
তোমার হইয়া অবাক জোছনা ডাকল অচিন সুরে

-আইতাছি, এই শাওন ভাই। দাদাজান আপনারে ডাকে।
আমার গান তো থেমেই গেল সেটা বড়ো কথা নয়। এই ঘরের কাছে শানু এতক্ষণ কী করছিল? দাদাজান শানু বলে ডাক দেয়াতে বলল, আইতাছি। কিন্তু এর আগে কী করছিল এখানে? আমার গান শুনছিল? আরে না, এই বেসুরে গলার গান? আরেকটি জিনিস খেয়াল করলাম, শানু এই প্রথম আমার সাথে কথা বলেছে। ঠিক কথা বলা না, ডাকতে এসেছে।
গিয়ে দেখি সবাই খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সন্ধ্যা রাতে কেউ রাতের খাবার খায়? তবুও সবাই যখন বসেছে আমারো বসতে হবে। শানুর বাবাকে এই প্রথম দেখলাম। আমার বাবার চেহারার সাথে যথেষ্ট মিল আছে। আমি প্রথমে এসে ভুলক্রমে তো ভেবেই বসেছিলাম, বাবা আমাকে নিতে এলো না-কি?
-শাওনের কাম তো দুপুর পর্যন্ত। বিকাল থেকে শাওন আমার কাছে থাকব। আমার একলা লাগে।
দাদীর মুখে এই কথা শুনে দাদা বললেন, কেন? শানুর তো পরীক্ষা শেষ। সারাদিন বাড়িতেই থাকে, তোমার একলা লাগে কেন?
-আমনে বুঝতেন না, থাহেন তো বিচার শালিস লইয়া। শানু মাঝে মধ্যে বান্ধবীদের সাথে একটু খেলতে যায়, বইসা দুইডা কথা কয়। শাওনের তো বিকালে কাম নাই। থাকুক না আমার লগে।

রাতে ঘুম আসতে দেরি হলো। এত সন্ধ্যা রাতে বুঝি কারো ঘুম হয়? বিছানার পাশে টেবিল। কিছু পুরাতন খাতা বই ছাড়া কিছুই নেই। একটি কলম খুঁজে পেলে ভালো হতো। কিছু একটা লিখে সময় কাটানো যেত। অবসরের টুকিটাকি হিসেবে খাতা কলম থাকলে মন্দ হতো না। খাতা নিয়ে দেখি চার পাঁচটা পৃষ্ঠা ছাড়া সবই লিখে ফেলেছে। অংকের ধরণ বলে এটা নাইন টেনের কোনো ছাত্র/ছাত্রীর খাতা হবে। কিন্তু হাতের লেখার যে অবস্থা তাতে মাষ্টার মশাইয়ের নাম্বার দিতে অনেক ভাবতে হবে। হাতের লেখা ক্লাস থ্রী ফোরের বাচ্চাদের মত। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালেও ঘুম ভাঙ্গল শানুর ডাকে। চোখ কচলিয়ে ভাবলাম এমন মোরগ ডাকা সকালে কেউ ডাকে? শানু এসে জানালায় টোকা দিয়ে বলছে, “শাওন ভাই। দাদাজান ডাকতে বলেছে, গঞ্জে যাবেন না?”
আমি উঠে বসলাম। মনে করার চেষ্টা করলাম রাতের স্বপ্নটা। এই অদ্ভুত স্বপ্ন কেন দেখছি আমি? এবারে একটি মেয়ে মোমবাতি হাতে এলো অন্ধকারে। আমাকে আলোকিত করল কিন্তু মেয়েটা অন্ধকারে থাকায় চেহারা দেখতে পারিনি। অন্ধকারের মেয়েটা কী শানু? যে না-কি গতকাল থেকে আমাকে শুধু দুইবার ডাকতে এসেছে। আর কোনো কথা হয়নি আমাদের মাঝে।

পাটের গুদামে আমার জন্য চেয়ার টেবিল বরাদ্দ হলো। লাল মলাটের চিকন একটি খাতা, আরেকটি বড় হাজিরা খাতার মতো। দাদাজান আমাকে বললেন, “তোমারে সকাল সকাল নিয়া আসছি কারণ পাইকাররা সকালেই পাট কিনতে আসে। তারা কিন্না নিয়া বিভিন্ন গঞ্জে হাট করবো। বিকালে কেউ পাট কিনতে আইবো না। তাই তোমার কাজ দুপুর তামাখ। আমি লেখাপড়া জানি, তবে কম। হিসাব নিকাশে মাঝে মধ্যে ঝামেলা হয়। তার উপর বয়স তো হয়েছে জানো, সত্তরের উপর দুই। ছেলেটা ঐ দোকানে থাহে। আমি একা আর কত সামাল দিমু? তাই হিসাব নিকাশে তুমি সাহায্য করবা। এই যে বড়ো পাথরটা দেখছ এটা এক মণ। চল্লিশ সেরে এক মণ। আর এই ছোটোটা বিশ সের। পাট ওজন করে পাইকাররা কিনবো। মাপার সময় তুমি এখানে লিখবা। আর এই দুইজন মাপার সময় তোমারে জোরে জোরে বলব কয় সের অইছে।”
দাদা আমাকে আমার কাজ বুঝিয়ে দিলেন। যে লোক দুটোকে দেখিয়ে দিলেন, লোক দুটো মনে হয় আমাকে পেয়ে খুশি হয়নি। দুই জনের মধ্যে কেমন ফিসফিসানি।

দুপুর অবধি চারজন পাইকার এসেছেন পাট নিতে। তিনজনই এসেছে ছোটো ট্রাক নিয়ে। আর একজন নিবে নৌকা বুঝাই করে। শেষ পাইকারের পাট দেবার সময় খেয়াল করে দেখলাম দাদা যে দুই লোক দেখিয়েছিলেন ওজনের পরিমান বলার জন্য তারা চোর। এই পাইকারের সাথে রফাদফা করা আগে থেকেই। সত্তর মণ পাট মাপতে চারবার ওজনে কম বলেছে। দেড় মণ দিয়ে বলত এক মণ। এক মণ দিয়ে আমাকে লিখতে বলত আধা মণ। কিন্তু দাদা তো আমাকে পাথরগুলো চিনিয়ে দিয়েছেন। তাই আজ চুরি করতে পারেনি বলে তাদের দু’জনের মন খারাপ। পাইকারও দাঁতে কিড়মিড় করে পাট নিয়ে চলে গেলেন। দাদা কিন্তু একটু সামনেই। গুদাম ঘরের সামনে আলস্য দ্বিপ্রহরে ঝিমাচ্ছে। এখন বুঝতে পারছি কেন ওরা দুইজন চুরি করার সুযোগ পায়। মাপার সময় এই দু’জন যা বলত দাদাজান তাই লিখত।

দুপুরের খাওয়ার পর দাদা ঘুমাতেন। বিকালে বিভিন্ন বিচার শালিসে যেতেন। আমি দুপুরের পর পুরাতন খাতায় কখনো হাঁস মুরগী, মাছ আঁকতাম। কখনো দুই চার লাইন কবিতা লিখতাম। কিসের আর কবিতা, ছন্দ মিল রেখে কিছু একটা লেখা। এক পড়ন্ত বিকালে শানু এসে ডাকছে, “শাওন ভাই দাদী আপনারে ডাকে।”
শানুর সাথে আমার এখনো কোনো কথা হয়নি। সে শুধু ডাকতেই আসে। আমার যেমন চাকরি পাটের গুদামে হিসাব রাখা। শানুরও আমাকে ডেকে দেয়াটা একটা চাকরীর পর্যায়ে চলে গেছে।
গিয়ে দেখি দাদী কুমড়া গাছের পাতা ছিঁড়ে। আমাকে দেখে দাদী বলল, “কিরে নাতি শুটকি খাইতে পারোস?”
আমার মনে আছে, মা আলু আর বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছের শুটকি রান্না করতেন। তরকারী রান্না করতেও লবন দিতেন না, আবার খাওয়ার সময়ও লবন নিতাম না। অথচ একদম পরিমান মতো হয়ে যেত। আমি বললাম, “খাই দাদী।” শানুও আছে এখানে। দাদীর কাপড়ের আঁচলের একাংশ আঙ্গুলে পেঁচাচ্ছে। দাদী আমাকে বললেন, “শাওন আয় তোরে শুটকির বড়া বানান শিখাই। প্রথমে শুটকি ভালা কইরা ধুইতে অইব। সাথে লাগব শুকনা মরিচ, পিঁয়াজ আর লবন। তারপর পাটায় পিষতে অইব মিহি কইরা। সবশেষে কড়াইতে তেল গরম করতে অইব। এই যে কুমড়া পাতা লইলাম। এই পাতায় মিহি শুটকি মরিচ বাটা পেঁচিয়ে অল্প তেলে মাছের মতো ভাজতে অইব। আজকে খাইয়া দেহিস তো নাতি আরো খাইছসনি এমন মজার খাওন?”
শানু মুখ টিপে হাসছে। এখানে হাসার কী হলো?
কুমড়া পাতা নিয়ে আসার সময় দাদীর হঠাৎ চোখ ভিজে এল। দাদী দাঁড়িয়ে গেলেন। দেয়াল টেনে বাঁধাই করা একটা কবর। আমি জানতে চাইলাম, দাদী কী হয়েছে? এটা কার কবর?

দাদী শানুর হাত থেকে আঁচল টেনে চোখ মুছলেন। বললেন, “আমার খুব আদরের পোলাটা এখানে ঘুমাইয়া আছে। শানুর বাপে ছাড়াও আমার আরো দুইটা পোলা আছিলো। এইটা ছোটো পোলার কবর। আর মেঝোটারে ছোটো পোলা মরার পর থেকে আর দেহি না। তোর দাদা বাড়ি থেইকা বাইর কইরা দিছে।”
-বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে মানে? কেন দাদী?
-আমার মোঝো পোলা আর ছোডো পোলা হাইঞ্জা রাইতে নয় কাডির কুচ আর লাইট লইয়া মাছ ধরতে গেছিলো। পুবের চকে কয়ডা গাতা আছে। দিনের বেলাতেই ভয় পায় মাইনষে। বড়ো বড়ো কচুরিতে ভরা ঝোঁপের মতোন। মেঝো পোলা দৌড়াইয়া আইয়া তোর দাদারে কইলো, “আব্বা, মানিকরে কিয়ে জানি গাতায় টান দিয়া লইয়া গেছে।” এই কথা হুনলে কার মাথা ঠিক থাহে? চিৎকার মাইরা তোর দাদার আরো দুই তিন ভাই সাথে লইয়া লাইট, কুপি, হারিকেন সব লইয়া গেল। গিয়া দেহে কচুডিপেনার নিচে মাইরা রাখছে। তোর দাদা পরেরদিন মেঝো পোলারে মাইরধর কইরা বাড়িত থেইকা বাইর কইরা দিছে। বাইর কইরা দিছে বলতে আর মাইর খাইতো না পাইরা আমার পোলাডা পলাইয়া গেছে। তোর দাদায় মনে করে মেঝো পোলায় ছোডো পোলারে মারছে। আইচ্ছা ভাই ভাইরে কীয়ের লাইগ্যা মারবো নাতি? আপন মায়ের পেডের ভাই।

দাদীর চোখ ভরে পানি এলো। তাকে শান্তনা দেয়ার মতো ভাষা আমার জানা নেই। শানুর দিকে তাকাতেই দেখি সে চোখের দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। তার মানে এতক্ষণ আমাকে দেখছিল? না, এটা আমার মনের ভুল।
শুটকির বড়া আসলেই খুব মজা হয়েছে। আমার মনে হয় এতটুকু জীবনে যতগুলো ভালো, সুস্বাদু আর মজাদার খাবার খেয়েছি। দাদীর হাতে বানানো সেই শুটকির বড়া প্রথম স্থান পাবে বলে আমার ধারণা। রাতে গরম ভাত দিয়ে খাওয়ার সময় একটু ঝাল লেগেছিল বটে, কিন্তু খেতে দারুণ মজা।

রাতে ঘুম আসছে না কিছুতেই। ঘুটঘুটে অন্ধকারের যে স্বপ্নটা দেখতাম, একদিন জোনাকি পোকা আমাকে আলো দিলো। আরেকদিন একটি মেয়ে মোমবাতি নিয়ে এগিয়ে এলো। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারের স্বপ্নটা দুই দিন দেখার পর আর দেখি না। দু’দিন দেখার পর আমার কেন যেন মনে হয়েছিল আমি রোজই দেখব এই স্বপ্ন। কিন্তু আজ ছয় সাত দিন হয়ে গেল স্বপ্নটা আর দেখলাম না। আমার খুব ইচ্ছে আমি শানুর সাথে কথা বলি। আজ এগারোদিন হয়ে গেল এই বাড়িতে, শানু শুধু আমাকে ডাকতেই আসে। আর কোনো কথা হয়নি আমাদের মাঝে। অথচ মুখ টিপে হাসে। তাকিয়ে থাকে প্রায়ই, আমি তাকালে চোখ নামিয়ে নেয়। ঐ দুই চোখে যেন গল্প লেখা। আমি কি পড়তে পারব? উছলে পড়া কোনো ঢেউয়ের গল্প নয়। নীরবধি বয়ে চলা শান্ত নদীর গল্প।

বাবার কথা মনে পড়ছে। মায়ের ভাষ্য অনুযায়ী দাদার বাড়ি রাধাগঞ্জের আশেপাশে। বাবা কেন আমাকে কোনোদিন দাদার বাড়ি নিয়ে যাননি তার কোনো কারণ জানা নেই আমার। আমি যে বাড়িতে আছি এটাও খন্দকার বাড়ি। তবে এটি রাধাগঞ্জ থেকে ক্ষানিকটা দূরে। কিন্তু এই খন্দকার বাড়ির দোকান ও গুদাম রয়েছে রাধাগঞ্জে। তাহলে কী এমনটা কখনো হতে পারে যে এই বাড়িই আমার দাদা বাড়ি?
না, দাদী বলল তার ছোটো ছেলে মারা যাওয়ার কথা। মেঝো ছেলেকে বাড়ি থেকে মারধোর করে বের করে দেওয়ার কথা। আমার বাবা তাহলে?
হতেই পারে না। বাবা রাগী হতে পারেন, আমিও অনেক ভয় করি। তাই বলে নিজ ভাইকে মেরে ফেলবেন না। এই বাড়ি আমার দাদার বাড়ি না। আমার দাদার বাড়ি খুঁজতে হবে না। যেখানে আছি এমনিতেই অনেক ভালো আছি। আমাকে সবাই তাদের পরিবারের একজনই মনে করে।
আমার দাদার বাড়ি না হোক, দাদার মেঝো ছেলে আর ছোটো ছেলে যেদিন মাছ ধরতে গিয়েছিল। সেদিন যদি মেঝো ছেলে ছোটো ছেলেকে না পারবে তবে মারবে কে? ভূত পেত্নি বিশ্বাস করে মানুষ? কেউ বিশ্বাস করে কেউ করে না এমনটাই হয়ে আসছে। কিন্তু যদিও মন্দ কিছুর উৎপাত বা অস্তিত্ব থেকেও থাকে এক ভাইয়ের সামনে অন্য ভাইকে মেরে ফেলবে? হিসেব মিলছে না।

মোরগ ডাকা ভোরে শানু আবারো আমাকে ডেকে চলেছে, “শাওন ভাই দাদাজান আপনারে ডাকে।”

——–(চলবে-)

লেখা: ওমর ফারুক শ্রাবণ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here