#রিস্টার্ট,পার্ট_১২
#পিকলি_পিকু
জাহিদ ওর অরনীকে জড়িয়ে ধরে আছে। ওর হৃৎপিন্ড টা যেন ফেটে যাবে। নাদিয়ার উষ্ণ নিঃশ্বাস ওর ঘাড়ে লাগছে আর তার স্নিগ্ধতা ওকে মাতাল করে দিচ্ছে। ওর শরীর থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে। এই আগুনে অরনী পুড়ে না যায়। এই সব অনুভূতি এত সত্যি কেন মনে হচ্ছে? এসবই কী বাস্তবে হচ্ছে? অরনী, অরনী সত্যি ওকে জড়িয়ে ধরেছে। ঠিক তখনই
“শুদ্ধ!!! শুদ্ধ !!!! আমাকে বাঁচা!!!! বাঁচা আমাকে!!!”
” প্রিয়ম!!! আমি আসছি! আমাদের ছেড়ে দাও!!!”
জাহিদ নাদিয়াকে সরিয়ে দেয়। ওর পক্ষে সম্ভব না। ওর ভেতরে ভয় কাজ করছে। নাদিয়া ওকে এখনো ছাড়তে চাইছে না। কিন্তু নাদিয়ার স্পর্শ গুলো ওর কাছে বিষের মতো লাগছে। ও আর এক মুহূর্ত ও এখানে থাকতে পারছে না। সব যেন অন্ধকার হয়ে আসছে। এই ঘরের সব অক্সিজেন যেন শেষ হয়ে গেছে। এখান থেকে চলে আসতে হবে। শেষ পর্যন্ত তাই ও নাদিয়া কে ধাক্কা দিয়ে চলে আসতে হয়েছে।
ভেতরে এসে ও সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা টা আটকে দেয়। এখানে কেউ যাতে না আসে। ওর খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ওর কানে এখনো বাঁজছে প্রিয়মের চিৎকার। কান বন্ধ করার পর ও বন্ধ হচ্ছে না শব্দ। জাহিদ তাই ঝর্ণা ছেড়ে তার নীচে বসে আছে। এখন যদি অরনীর ছোঁয়া ওর শরীর থেকে মুছে যায় তবে হয়তো প্রিয়মের বিভৎস চিৎকার বন্ধ হবে। কিন্তু সেই আর্তনাদ শুধু বেড়েই চলেছে। অরনী যাতে ওকে এভাবে না দেখে। ওর এখানেই থাকা উচিত। হয়তো এই পানির সাথে ওর ধুয়ে যাওয়া উচিত।
ঝর্নার নীচে বসে থাকা জাহিদ ভয়ে চুপসে আছে। ওর হাঁটু আর মাথা একত্রে। সেদিন ও ওর পাশে কেউ ছিল না, আজ ও নেই। তবে ওর সাথে আছে শুধুই সেদিনের বিভৎস স্মৃতি গুলো।
” আমাদের ছেড়ে দাও। আমরা কাউকে কিচ্ছু বলব না।”
” আমাদের ছেড়ে দাও। আমরা কাউকে কিচ্ছু বলব না।”
” আমাদের ছেড়ে দাও। আমরা কাউকে কিচ্ছু বলব না।”
” আমাদের ছেড়ে দাও। আমরা কাউকে কিচ্ছু বলব না।”
” আমাদের ছেড়ে দাও। আমরা কাউকে কিচ্ছু বলব না।”
এভাবেই সারারাত এই বুলি আওড়াতে থাকে জাহিদ। আর এদিকে রান্না ঘরে নীচে বসে কাঁদতে কাঁদতেই নাদিয়া ঘুমিয়ে যায়। ভোর বেলা আজানের সময় জেগে ওঠার পর নাদিয়া অন্য ঘরে যায়। আজ সকালে আর ও বের হবে না। জাহিদের চেহারা ও আর দেখবে না। অনেক হয়েছে।
বেলা বারোটা,
নাদিয়া ওর বিছানায় শুয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে ওর শরীরে আরেকটুও শক্তি নেই। আফরার ফোন বাঁজছে।
– হ্যালো, তোর কী অবস্থা? আসিসনি কেন?
– ইচ্ছে হচ্ছে না তাই।
– তোর গলা এমন কেন? কী হয়েছে?
– কিছু না।
– দ্যাট টাইম? আচ্ছা শোন কে স্কয়ারের ফুচকা না মোমো? মোমোই আনি। আর টি টাইমে নাকি একটা হারবাল টি এসেছে , ক্র্যাম্প কমায়। নিয়ে আসছি। এরপর গল্প করব।
– কোনো প্রয়োজন নেই। তুই আমার সামনে ও আসবি না। আমার কোনো পিরিয়ড হয়নি।
নাদিয়া ওর ফোনটা বন্ধ করে দিল। ওর কিছু ভালো লাগছে না। জাহিদের কাছ থেকে পাওয়া প্রত্যাখ্যান ওর সহ্য হচ্ছে না। কাল রাতে কী করে ও নাদিয়া কে আবর্জনার মতো ফেলে চলে গেল। নাদিয়ার ম*রে যেতে ইচ্ছে। এমন মুহূর্তে আত্ম*হ*ত্যা ছাড়া ও একটা উপায় থাকা উচিত ছিল, গায়েব হয়ে যাওয়ার। ওর অস্তিত্বই থাকবে না এমন। তখন সামাদ সাহেবের শুধু দুটো ছেলে থাকতো, ওর স্কুলে একটা টিচার কম আর জাহিদ হয়তো ওর বাড়িতে একা থাকতো। তেমন কোনো পরিবর্তন হতো না। কোনো সমস্যার শুরু হতো না। ও থেকেই যত ঝামেলা। এখন মারা গেলে সবাই কান্না করবে, হার্ট অ্যাটাক করবে, কেস করবে। সারাজীবন ওকে ভেবে কষ্ট পাবে। আফসোস করবে ওকে নিয়ে। কিন্তু ও আর পারছে না। একটা মুহূর্তের জন্য ওর মাথায় এসব কিছুই আসছে না, আসছে শুধুই সেই অপমান গুলো। ওর খাট থেকে ও একটা ওড়না দেখতে পেল। নীল ওড়না। আর সোফার পাশে বেতের মোড়া। নাদিয়া আস্তে আস্তে সেই ওড়না টা হাতে নিল। ফ্যানের সুইচ টা বন্ধ করল। ফ্যান পুরোপুরি বন্ধ হতেই পাশে রাখা বেতের মোড়া টা খাটে রাখল। সেই বেতের মোড়ার উপর দাঁড়িয়ে ওড়না টা ফ্যানে বাঁধার পর দুই মিনিট ভাবলো। এরপর সেই বাঁধন টা গলায় বেঁধে মোড়াতে একটা লাথি দিয়ে দিল। মুহুর্তেই নাদিয়া ওর গলায় প্রচণ্ড চাপ অনুভব করল। খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। কষ্টে হাত পা ছুড়ছে। একটু শ্বাস নেওয়ার জন্যে হা করে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। একটা সময় নিঃশ্বাস না নিতে পেরে নাদিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। ওর লা*শ ঝুলছে। খুব বেশি সময় লাগেনি। ঘরের দরজা বন্ধ। জাহিদ যখন বাড়িতে আসবে তখনও হয়তো বুঝবে না ভেতরে নাদিয়া নেই। হয়তো একটু সময় লাগবে। যখন ও নাদিয়ার কোনো সাড়াশব্দ পাবে না, তখন হয়তো ঘরের দরজায় কড়া নাড়বে। নাদিয়ার কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে ও যখন দরজা খুলবে তখন হয়তো অবাক হবে। এরপর সবাইকে ডাকবে। আফসোস করবে। কিন্তু নাদিয়া থাকবে না।
অফিসে জাহিদের কোনো কাজে মন বসছে না। শুধু কাল রাতের কথাই মনে পড়ছে। আগের সেই বিভৎস স্মৃতিগুলি মনে পড়ছে। জানিনা আজকের পর আর নাদিয়ার সাথে চোখ মেলাবে কী করে। কী ভাবে বোঝাবে ওকে ওর দোষ ছিল না।
এদিকে নাদিয়া,
চোখ খুলে দেখল একটা সাদা ফুলের বাগান। সূর্যের আলো এদিক থেকে ওদিকে। কেউ নেই এখানে। ও হয়তো মারা গেছে। যাক, এখন আর কোনো জবাবদিহিতা নেই। নাদিয়া প্রাণ খুলে দৌঁড়াতে লাগলো। হাসতে হাসতে হঠাৎ শুনতে পেল একটা পরিচিত ডাক। পেছন ফিরে তাকাতেই,
– আরে প্রিয়ম।
– কেন করলি এমন?
প্রিয়মের মন খারাপ। একটু রাগ ও করেছে অরনীর ওপর। নাদিয়া হাসি মুখে এগিয়ে গিয়ে বলল,
– ভালো লাগছিল না তাই। চল ওদিকে গিয়ে বসি।
– চল।
ওরা গিয়ে একটা গাছের নীচে বসল। প্রিয়ম কে ওর নীল কুর্তিতে কী সুন্দর লাগছে। প্রিয়ম নাদিয়ার হাত ধরে বলে,
– আসল কারণ?
– বেঁচে থাকার ইচ্ছা ছিল না। ম*রে যাওয়াই ভালো না?
– একটা ছেলের জন্য?
নাদিয়া চুপ করে থাকে। প্রিয়ম মাথা নিচু করে নাদিয়ার দিকে তাকায়।
– একটা পুরুষের প্রত্যাখ্যান এতই বড় তোর কাছে যে একবারে আত্ম*হ*ত্যা করে ফেললি? দুনিয়ার সব ছেলে কী ম*রে গিয়েছিল?
– জিনিসটা শুধু একটা প্রত্যাখ্যান নয়। সেটা ছিল একটা মুহূর্ত। আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্বল মুহূর্ত। সেই মুহূর্তে আমি ভালোবাসা চেয়েছিলাম, অনেক কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলাম তার। সেই মুহূর্তে আমি চাইনি উনি এভাবে চলে যাক। কেন যেন মনে হচ্ছে আমি কোনো অবাঞ্ছিত জিনিস। আমাকে ওনার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি খুবই নিকৃষ্ট।
– আর তাই এই পৃথিবীতে আর কিছুই তোর কাছে কোনো গুরুত্ব রাখে না। রাখে শুধু এই বলদ জাহিদ।
– আমি ওনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। জিনিসটা খুবই স্টুপিড হলেও সত্যি। আর কেউ হলো না। জাহিদই হলো। এত বাছাইয়ের পর জাহিদই হলো।
– তোর ভালবাসা অপাত্রে দান করিস না।
– আর কী করব? আমার খুব আত্মবিশ্বাস ছিল, কেউ আমাকে ভালো না বেসে থাকতেই পারবে না। আমি যেখানে দাঁড়াই সেখানে সবাই শুধু আমাকেই দেখে। আমি চেয়েছিলাম কেউ শুধু “ভেতরের আমি” কে ভালোবাসবে। সবার মতো আমার গুণকে না, দোষকে ও। ওর তো আমার বাহিরের দিক ও প্রতিপত্তি ও পছন্দ না। আমার দোষ খোঁজা তো দূরে থাক, সামনে থাকা গুণ ও দেখতে পায় না। এই আমি থেকে কী করব?
– তুই না অনেক স্ট্রং অরনী, তবে শুধু এই সামান্য কারণে!
– আমি স্ট্রং না প্রিয়ম! আমি অনেক ভঙ্গুর। ভেতর থেকে আমি অনেক ফাঁপা। তুই যাওয়ার পর থেকে আমি ভেঙে গেছি। আমার অন্তঃসারশূন্য! আর কাল রাতে, কাল রাতে আমার ভেতরের ক্ষুদ্রতম ভাঙা টুকরোটাও একশ বার ভেঙে গেছে। আর কিছু ভাঙার মতোও নেই।
– যদি ভাঙার মতো কিছু না থাকে তবে কীসের ভয় অরনী?
– আর কোনো ভয় নেই। তাই তো এলাম এখানে।
– ভয় নেই তো ম*রবি কেন? ভয় থাকলেই তো ম*রার ইচ্ছা হয়। তুই জানিস কে সবচেয়ে বেশি সুখী? যার কিছুই হারানোর নেই। আবার জীবন শুরু কর।
– করেছিলাম তো, মা বাবার জন্য পারলাম আর কোথায়। আবার ফেরত না গেলে এত বাজে ভাবে পড়তাম না।
– কোথায়? ঐ অসভ্যটার প্রেমে? তোর পৃথিবীতে কী সেই অসভ্যটাই আছে? তোর পৃথিবীতে আর কোনো লক্ষ্য নেই? আর কিছু জানার নেই?
– ছিল তো।
– ভুলে গেছিস তা? মনে রাখিস, বিয়ে টা তোর মূল লক্ষ্য ছিল না। পরিবারের চাপে করেছিলি। করতে হতো তাই। এত সিরিয়াস হয়ে গেলি কেন? এত প্রায়োরিটি কেন?
– তাই তো। আমি তো কখনো বিয়ে কে প্রায়োরিটি দিতে চাইনি!
– আর দিস না। জাহিদ জাহান্নামে যাক। তুই যা করতে চেয়েছিলি তাই কর। তোর তো একটা লক্ষ্য ছিল। ভুলে গেলি নাকি?
– আর কী সম্ভব? আমি তো আর ফেরত যেতে পারব না। এখানেই থেকে যাই।
প্রিয়ম গালে হাত দিয়ে বলে,
– হয়তো সম্ভব।
– তো তুই আসছিস না কেন?
– আসব না, তুই যা।
– তুই ও আয়। তুই যদি ওখানে না থাকিস তো ওখানে থেকে আমি কী করবো। এখানে তো তুই আছিস।
– আমি কী এখানে সত্যিই আছি? তুই কী করে এতটা কন্ফিডেন্ট যে আমি এখানেই থাকব?
– এ যে তুই আছিস।
– না! নেই!
– প্রিয়ম। প্রিয়ম! প্রিয়ম!!!!
নাদিয়া চোখ খুলে দেখে ও এখনো সেই ঘরে , একই সিলিং। সোফার উপর নীল ওড়না। পাশেই বেতের মোড়া। তারমানে ও আত্ম*হ*ত্যা করেনি? প্রিয়ম ও তো ছিল, নাদিয়া মা*রা গিয়েছিল। এ সব কিছু ও স্বপ্নে দেখেছে। কী বাস্তব ছিল সব! ও আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল সব ঠিক ঠাক। ওর অনেক ক্লান্ত লাগছে। তাই হয়তো সব স্বপ্ন দেখেছে।
রাহেলা খালা এসে সব ঠিক করে গিয়েছে। ঘরটা বন্ধ ছিল তাই ঢোকেনি। নাদিয়া এরপর জাহিদের ঘরে গিয়ে ওর জিনিসপত্র সব এই ঘরে নিয়ে আসে। দুপুরের খাবার খেয়ে চিন্তা করে, এই বাসা এবার ছেড়েই দেবে। আর থাকবে না এখানে। এই সম্পর্ক ঠিক হওয়ার নয়। এরকম একটা অপমান হয়তো ওর দরকার ছিল। মিষ্টি ভাবী ঠিকই বলে, অহংকারী ও। সব অহংকার এখন ঝড়ে পড়েছে। রাতে জাহিদ ফিরে নাদিয়া কে দেখল না। জিজ্ঞেস ও করল না। কী বলবে? তবে টেবিলে ওর ল্যাপটপ টা দেখলো। ও কী যেন ব্রাউজ করছিল। ভেতরে এসে বিছানায় শুয়ে জাহিদ নাদিয়ার দিকটায় তাকিয়ে আছে। কাল এমন ব্যবহার করা টা ওর উচিত হয়নি। যদিও যা করেছে তাতে ওর হাত ছিল না। ওর এখনো সব স্বপ্নের মতো লাগছে। নাদিয়া ওর এত কাছে, আর আজ কত দূরে। জাহিদ নাদিয়ার দিকটায় হাত দিয়ে নাদিয়া কে অনুভব করার চেষ্টা করে।
“আমরা চাইলেও কখনো এক হতে পারব না। আমি যে আপনাকে কত ভালোবাসি, তা বলতে পারব না। আপনি যদি জানেন আমি কে, তবে ভালোবাসা তো দূর, চেয়েও দেখবেন না।”
সকালে নাদিয়া স্কুলে ক্লাস নিল। ওর আজ এখানে বসে আড্ডা গল্প করার ইচ্ছা নেই। তবুও সুলোচনা ম্যাম একটু ইশারা করে বললেন,
– নাদিয়া, ইজ এভ্রিথিং অলরাইট?
– ইয়েস।
– মনে তো হচ্ছে না।
নাদিয়া কিছু বলল না। ফাহিমা ম্যাডাম আড়চোখে চেয়ে আছেন। নাদিয়ার সাথে চোখাচোখি হতেই তিনি মুচকি হেসে বললেন।
– কেমন চলছে সংসার?
– আপনি কী শুনতে চান?
– মানে?
– আপনি কী ভালো শুনলে খুশি হবেন না, খারাপ?
– কী ধরণের আচরণ নাদিয়া!
আফরা এসে নাদিয়া কে ধরল। ওর যা ভয় ছিল। নাদিয়া রেগে গেছে। এখন ঝামেলা হবে।
– স্যরি, ওর পক্ষ থেকে স্যরি।
– তোমার বন্ধু কে বলো ভদ্রভাবে কথা বলতে।
নাদিয়া রেগে গিয়ে বলল,
– আপনারাও মানুষের পার্সোনাল ব্যাপারে নাক গলাবেন না।
– আমরা তোমাকে হেল্প করতে চাচ্ছিলাম। তোমার মতো রুড আর বেয়াদব মেয়ের হেল্প করতে চাওয়া ও ভুল।
– আমি আপনাদের হেল্প চাই না। যে চায়, তাকে করুন।
নাদিয়া ওর ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেল। বের হয়ে রাস্তায় আসতেই ফোনে পিপির কল আসলো। তুলবে কি না ভাবছে। কিন্তু ওনাকে তো জানানো দরকার ওরা আর আসবে না।
– হ্যালো।
– কী ব্যাপার নাদিয়া, তোমরা আসছো না কেন?
– আমরা আর আসব না।
– কেন? কী হয়েছে?
– অনেক কিছু। আমাদের পক্ষে আর একসাথে থাকা সম্ভব না। সময় যা নষ্ট হওয়ার হয়েছে। আমার আর আফসোস হবে না। ধন্যবাদ। আপনার পেমেন্ট বাকি টা ক্লিয়ার করে দেব।
– কী বলছ নাদিয়া! পাগলামি করো না। কী হয়েছে আমাকে জানতে হবে।
– আমি বলতে চাইনা।
– নাদিয়া, তুমি কী টাস্ক শেষ করেছ? সেই টাস্কেই কিছু হয়েছে। তাইনা?
– হুম। আর বেশি কিছু বলব না। শুধু এটাই বলব, এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।
– তুমি আমার সাথে দেখা করতে আসো। এখনই!
– আমি পারব না। আপনি বুঝতে চাইছেন না কেন, আমিও মানুষ। আমারও কষ্ট হয়। সবসময় আমার দ্বারা সব সম্ভব না।
নাদিয়া অজান্তেই কাঁদতে লাগলো। পিপি ওর কান্না বুঝতে পারছে। একটা মেয়ে কতটা অসহায় হলে এভাবে কাঁদে। নাদিয়া যখন বুঝতে পারলো ও কাঁদছে তখন নিজের চোখ মুছলো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কান্না করাটা কেমন জানি। সবাই দেখছে।
– নাদিয়া প্লিজ, দেখা করতে আসো। আমাকে সব বলো। বিশ্বাস করো, ভালো লাগবে। আমি জানি তুমি কাউকে কিছু বলোনা। এভাবে কী করে চলবে? নিজের মধ্যে সব চেপে রাখাটা ঠিক না।
– কিন্তু আমি এই সম্পর্ক টা আর কন্টিনিউ করব না।
– ওকে, তাও আসো।
পিপির কেবিনে অনেকক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে নাদিয়া। পিপি অপেক্ষা করছে নাদিয়ার কিছু বলার।
– সে কী করল?
– কে?
– জাহিদ।
নাদিয়া চুপ হয়ে আছে। পিপি আবার বলল,
– তুমি কী টাচ করেছিলে?
– হুম।
– এরপর?
– উনিই কাছে টেনে নিলেন। খুব কাছে। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম, পরক্ষণেই দূরে সরিয়ে দিলেন। আমি তো পাগল! বেহায়া! ছাড়তে চাইছিলাম না। অবাঞ্ছিত উচ্ছিষ্টের মতো ছুড়ে ফেলে দিলেন।
– কী!
– জ্বী। কেন? আমি যদি এতই বাজে হই তো কাছেই টানল কেন? এমন অপমানিত আমি কখনো হইনি। এরপর ও কী বলবেন আমার থেকে যাওয়া উচিত।
পিপি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কী বলছে ও, একদম কাছে টেনে ফেলে চলে গেল? ব্যাপারটা স্বাভাবিক না।
– আমি জানি, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে এভাবে ভেঙে পড় না।
– পড়ছি না। আমি বাসা দেখা শুরু করেছি। ঠিক করেছি আর ওনার সাথে কথা বলব না। সব হিসাব করে নিজের বাসায় চলে যাব। বাবা মায়ের কষ্ট, সমাজ এসব আমি আর দেখব না। অনেক কিছু করার আছে আমার। আগেই আসা উচিত হয়নি। এসে আরো ভ্রমে পড়েছি।
– ভ্রম! কীসের ভ্রম? তুমি জাহিদকে ভালোবাসো?
– আমি জাহিদ কে ঘৃণা করি। খুব খুব ঘৃণা করি!
– বাসতে? সেই ঘটনার আগ পর্যন্ত?
– জ্বী। উচিত হয়নি। ওনার মতো কাউকে তো না।
– আচ্ছা নাদিয়া, খেয়াল করে দেখ, ও তোমায় কাছে টেনে নিল। পরবর্তীতে দূরে সরিয়ে দিল।
– জ্বী।
– ওর কী কোনো ট্রমা আছে?
– মানে?
– ও কোথায় থাকতো? ওর তো মা বাবা নেই।
– জ্বী।
– ও কী একা থাকতো?
– ইউনিভার্সিটি লাইফ থেকে একা। ওনার মা তখনই মারা যান। তার আগে মায়ের সাথেই থাকতেন।
– ছোটবেলার কোনো ট্রমা হতে পারে।
– হোয়াটেভার। আই ডোন্ট কেয়ার নাও। ওনার ট্রমা, ওনার সাইলেন্স, ওনার অবহেলা। আমি আমার মতো থাকবো।
– কিন্তু একটা বারের জন্য ও কী জানতে চাইবে না, ও কেন এমন করল? আমার তো খুব জানতে ইচ্ছে করছে। থাক, তোমাকে আর জোর করব না। ওর সমস্যা ওর মধ্যেই থেকে যাক।
– না, আমার মধ্যেই কোনো সমস্যা আছে। বা, ওনার আছে, আর আমি তা জানতে চাই না।
– পাগলামি করো না। তোমার মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। তোমার মধ্যে কেন থাকবে? তোমার কাছে নিজেকে দোষারোপ করাটা আশা করি না। তবে ব্যাপারটা সিরিয়াস। সত্যিই ওর কোনো ট্রমা আছে। আর সেটা সেক্সুয়াল ট্রমা। কোনো একটা সময়ে ও এমন কিছুর সম্মুখীন হয়েছিল যার কারণে ও তোমার সাথে সেই ইন্টিমেট মোমেন্টে এই ঘটনা করেছে। ওর হয়তো সেইসব বিভৎস স্মৃতি মনে পড়ে গেছে। এমন হয়, ফ্ল্যাশব্যাক। বিশেষ মুহূর্তে, আগের কথাগুলো মনে পড়ে যায়।
– কী বলতে চান?
– অ্যাবিউস। ও মেইবি ছোটবেলায় অ্যাবিউসের শিকার হয়েছিল। সেটা সেক্সুয়াল অ্যাবিউস আর মেন্টাল অ্যাবিউস। দুটোই হতে পারে। আমি একজন সাইকোলজিস্ট। পরবর্তীতে ম্যারেজ নিয়ে স্টাডি করেছি। বিবাহিত লোকেদের সাইকোলজি নিয়ে। অনেক লোক দেখেছি, ছোটবেলার অ্যাবিউসের জন্য বড় হয়ে ইন্টিমেট রিলেশনশিপে যেতে পারে না। মানে ভালোবেসেই বিয়ে করে, কিন্তু বিয়ের পরে ইন্টিমেট হওয়ার সময় ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। সেই থেকে সম্পর্কে ফাটল ধরে। আবার অনেকে নিজেদের অ্যাবিউসারের মতোই হয়ে যায়। নিজের পার্টনারকেই অ্যাবিউস করে। এমন কেইস আমি হ্যান্ডেল করিনি, তবে শুনেছি। তারা ওটাকেই প্রপার ওয়ে মনে করে। আবার অনেকেই সেই স্মৃতি ভুলতে পারে না। মিশতে পারে না কারো সাথে। প্রচন্ড একাকীত্বে ভোগে। এরপর সেই ডিপ্রেশনে আত্ম*হ*ত্যা করে ফেলে। জানি না জাহিদের কী সমস্যা!
নাদিয়া একদম নিশ্চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর বলে,
– জাহিদ, অ্যাবিউসড হয়েছিল!
– আমি শিউরিটি দিতে পারছি না। তবে ওর একটা সিক্রেট আছে। ও অনেক চুপচাপ। কমিউনিকেশন ভালো না। ভেতরে অনেক কিছু চাপা আছে। যখন কেউ এইরকম এক্সট্রিম কিছুর মধ্য দিয়ে যায়, তখনই এমন চুপচাপ হয়ে যায়। আচ্ছা ও কী খুব বেশি অ্যাপলোজাইস করে?
– জ্বী।
– আর ও প্রথমে বলেছিল ও তোমাকে ডিভোর্স দিচ্ছিল কারণ তুমি চাইতে তাই।
– হ্যাঁ। উনি কাউকে না করতে পারেন না। আমার কথায় ডিভোর্স ল’ইয়ার খুঁজলেও ফুফুর কথায় আমাকে নিতে আসেন। কী চান তা মুখ ফুঁটে বলেন না। উনি শুধু নির্বাক তাকিয়ে থাকে।
– কিছুই বলে না। বলতে চায়। সব মিলে যাচ্ছে।
– কীসের সাথে?
– অ্যাবিউসের শিকার হওয়া লোকদের সাথে।
– এখন আমি কী করব? কী করা উচিত?
– দেখ নাদিয়া, তোমার কাছে এখন দুটি পথ আছে। প্রথম, চলে যাওয়া। নিজের জীবন নিজের মতো বাঁচা। জাহিদের জন্য তুমি দায়বদ্ধ নও। আর এক্ষেত্রে এটা স্বার্থপরতা নয়। স্বাভাবিক। তুমি ও মানুষ। দ্বিতীয়, এই ছেলেটার ট্রমার আসল কারণ জানা। ওকে সাহায্য করা। ওকে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানো। তুমি বলতে পারো, তুমি কোনো সাইকোলজিস্ট না। তুমি মানসিক হাসপাতাল ও না। তবে এরকম কিছু থেকে বাঁচতে হলে কারো খুব সাপোর্টের দরকার হয়। যার সাপোর্টের দরকার হয়, তাকেও মানসিক ভাবে খুব শক্ত হতে হয়। তবে আমি বলব, তোমার আগে নিজের কথাটা ভাবা উচিত। তুমি কী সক্ষম কি না?
– স্যার, আপনি আমার জায়গায় থাকলে কী করতেন?
– নাদিয়া, আমি তোমার জায়গায় নেই। কখনো থাকবোও না। তাই আমি কখনো তোমার অবস্থাটা জানবো না, বুঝবো না। আমরা সবসময় নিজের অবস্থানে থাকি। অন্যের অবস্থানটা নিজের অবস্থান থেকে বিবেচনা করি। আল্টিমেটলি নিজের দিক থেকেই। তাই কখনো অন্য কারো ইচ্ছায় নিজের কী করা উচিত তা করবে না। নিজে বিবেচনা করবে।
নাদিয়া নিজেও মানসিক ভাবে এখন এতটাও শক্ত নয়। কিন্তু ব্যাপারটা যদি সত্যি হয় তো ও জাহিদের সাথে খুব খারাপ করবে। ওর নিজের ভেতরে একটা অপরাধবোধ কাজ করছে।
– আমি কী করে ওনাকে সাহায্য করতে পারি?
– তুমি কী চাও? তার আগে তুমি ভেবে দেখ তুমি পারবে কি না? তোমার সেই সামর্থ্য আছে? তুমি নিজেই একটা ভঙ্গুর মানুষ এখন।
– হ্যাঁ আমি ভাঙা মানুষ। তাই আমি নিজেও নিজেকে সারাতে চাই।
– তুমি কী পারবে? সময় দিচ্ছি তোমাকে। ভেবে দেখ। তোমার আবার নিজের না ক্ষতি হয়ে যায়।
– আমি জানি না।
– নাদিয়া, তুমি ওর স্ত্রী হতে চাও?
– জানি না।
– তুমি ওকে ভালোবাসো?
– জানিনা।
– তুমি আগে ওর বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করো। ওকে এখনই ভালোবাসতে যেও না। আমারই একটা ভুল হয়ে গেছে। আমার বোঝা উচিত ছিল, জাহিদ বাইরে থেকে সুস্থ স্বাভাবিক হলেও ভেতর থেকে অস্বাভাবিক হতে পারে। ওর ভেতরে যে ও কী নিয়ে ঘুরছে শুধু ও নিজেই জানে আর আল্লাহ্ জানে।
– পিপি স্যার, আমি আবার শুরু করবো।
– কেন?
– আমি জানতে চাই। আমি জানতে চাই উনি নিজের ভেতর কী পাথর নিয়ে ঘুরছেন। এখন আমি কী করতে পারি?
– সেই রাতের ব্যাপারে ভুলে যাও। এমন ভাব করো কিছুই হয়নি। বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে পারো। তবে নাদিয়া, এতটা আত্মত্যাগ না করলেই পারো।
– এটা আত্মত্যাগ না, এটা আত্মশুদ্ধি। এই যে আপনি যেটা বললেন, উনি হয়তো অ্যাবিউস হয়েছিলেন। উনি এটা কাউকে বলেননি। ওনার এটা বলা উচিত। এটা জেনে যদি আমি এখন চলে যাই, ধরুন একদিন খবর পেলাম জাহিদ আর নেই। উনি আত্ম*হ*ত্যা করেছেন। আমার পক্ষে কী আর একটা রাত ও ঘুমানো সম্ভব হবে? কাউকে এই অবস্থা থেকে সাহায্য করতে না পারা, কারো এত কাছে থেকেও তার জীবন বাঁচাতে না পারা যে কতটা কষ্টের তা আমি জানি। এই আত্মগ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহূর্ত, নিজেকে শুধু দোষারোপ করা। আর আফসোস, তাও নিত্যদিনের।
– তোমার কী খুব কাছের কেউ এভাবে ছেড়ে গেছে?
– হুম।
– সাহায্য করতে পারোনি?
– শুনিইনি। মনেই হয়নি ওর দরকার ছিল। আসলে তাদের দেখে মনেই হয়না।
– ঠিক বলেছ। বোঝাই যায়, কার ভেতরে কী চলছে।
একজন সুই*সাই*ডাল মানুষ নিজে অন্য আরেকজন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। সত্যি তাদের দেখলে বোঝাই যায় না। পিপি ও বুঝতে পারছেন না নাদিয়ার কথা। জ্বর সর্দি কাশির মতো রোগ ও বোঝা যায়। কিন্তু, মানসিক রোগে আক্রান্ত তা খুব কাছ থেকে না জানলে বোঝা যায় না। মন ভালো থাকার আড়ালে কার মন খারাপ তা কেউ জানে না….
(চলবে)