#রিস্টার্ট,পার্ট_১৬
#পিকলি_পিকু
সকালে নাস্তার টেবিলে নাদিয়া আর জাহিদ বসে আছে। জাহিদ বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছে। এটাই নাদিয়া, ওকে দেখলে কী মনে হয় ও আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে? প্রিয়মকে ও তো লাগতো না। কিন্তু ওর পরিস্থিতি তো ভিন্ন ছিল।
– কী হয়েছে জাহিদ?
– না কিছু না।
– আজ কী পিপি স্যারের কাছে যাবেন?
– হ্যাঁ।
– ও। ঠিক আছে।
নাদিয়া পিপিকে কিছুই বলেনি। ও কাল কী বলেছিল তা বলেনি। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য কথা বলে চলে এলো। পিপি ও কিছুই বোঝেনি। সন্ধ্যাবেলা জাহিদ এলো। ওর চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে অনেক কিছুই হয়েছে।
– কি হয়েছে জাহিদ?
– আমি বুঝতে পারছি না আপনাকে এসব কী করে বলব?
– বলো। আমি শুনছি।
– আপনি নাদিয়াকে বলবেন না তো?
– কেন?
– কারণ এটা ওনার সিকরেট। উনি আমাকে বলেছেন। আর কাউকে বলেননি। এই ব্যাপারটা আমার ও কাউকে বলা উচিত না, কিন্তু বলতেই হচ্ছে। কারণ দেরি হলে আবার কিছু একটা না হয়ে যায়।
– কী বলতে চাও?
– নাদিয়া সুই*সাইড করতে চেয়েছিল।
– কী! কবে!
জাহিদ সব খুলে বলল। পিপি অবাক। তবে কী এই কারণেই ও জাহিদের কথা শুনে আর গেল না। এই দুজনের কেস তো সত্যি অন্যরকম। পিপির হ্যান্ডেল করা সব কেস থেকে আলাদা। পদে পদে ভুল করছে। আরেকটা ভুল তো সব কিছু যেন ভেঙে পড়বে। নাদিয়ার এই সমস্যা জানার পরেও জাহিদের সাথে থাকাটা অনেক বড় ভুল। এইটা নিরাপদ না।
– জাহিদ, আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি।
– জ্বী?
– তোমরা দুজন আদৌ একসাথে থাকতে পারবে তো?
– মানে?
– তুমি ঠিক করে কথা বলো না , আর নাদিয়া সুই*সাইডাল। ব্যাপার টা বুঝতে পারছো! অনেক সময় তুমি কিছু বলবে না, আর ও বুঝবে না। ভুল বোঝাবুঝির চরম পর্যায়ে কী হতে পারে জানো? নাদিয়া নিজেকে শেষ করে দিতে পারে।
জাহিদ ভয় পেয়ে গেল। এসব কী বলছে পিপি!
– উনি এমনটা কেন করবেন?
– কেন কেন করছো আবার? যারা একবার সুই*সাইড করতে বিফল হয় তারা বারবার করে। অনেকবার লাকি হলেও একবার আনলাকি হয়ে যায়। আর তাই যথেষ্ট! তারা সেই একবার আনলাকি হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা করতেই থাকে। ওর তো আবার কাউন্সিলিং ও হয়নি।
– না।
– জানি না সামনে কী হবে। তুমি জানো, বাংলাদেশে কতজন দাম্পত্য কলহে আ*ত্মহ*ত্যা করে? বিশেষ করে মেয়েরা। তারা রান্নাঘরে যখন রান্না করে তখন গ্যাস জ্বালানোর আগে চিন্তা করে সিলিন্ডার টা কখন ফাটবে। আর কখন মুক্তি পাবে। তারা সিলিং এর দিকে তাকায় আর ফ্যানে ঝুলে যেতে চায়। সবজি কাটতে কাটতে চিন্তা করে ছুরিটা হাতে চালিয়ে দেই। হয়তো সব এখানেই শেষ হয়ে যাবে! রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে ভাবে একটা বাস চালিয়ে দিক তার উপর।
– চুপ করুন!
– আমি চুপ করলে তা মিথ্যা হয়ে যাবে না। এটা মেন্টাল ইলনেস। রোগ এটা! সাড়াতে হবে। আমার তো মনে হয় ও তোমার সাথে এইসব ঝামেলাতে ও অনেকবার চেষ্টা করেছে। আমি শিওর ও সেদিন ও করেছে।
– কোনদিন ?
– তুমি যেদিন সরিয়ে দিয়েছিলে। এরপর ও এসেছিল, আর ওর অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল খুবই বিধ্বস্ত ছিল।
– উনি অনেক অন্যরকম ব্যবহার করছেন।
– ও ওর হতাশার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। তুমি জানো প্রিয়জনকে হারানোর পর যখন তার মৃত্যুর জন্য তোমাকেই দায়ী করা হবে তখন কেমন লাগে? নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হয়। আমাদের তো দোষারোপ করতে ভালো লাগে, কষ্ট কমছে মনে হয়। কিন্তু যাকে দোষারোপ করা হয় তার কষ্ট আমরা জানি না। আর তুমি কবে তোমার সমস্যার কথা বলবে জাহিদ!
– আমার কোনো সমস্যা নেই।
– সবচাইতে বড় সমস্যা তো তোমার! দেখ জাহিদ, এখনো যদি তুমি স্বাভাবিক না হতে পারো, তবে অনেক খারাপ কিছু হতে পারে। প্লিজ জাহিদ, এবার সিরিয়াসলি স্বামীর দায়িত্ব পালন করো! জোর করছি মনে হচ্ছে, তবে তুমি তোমার সমস্যা টা আমাকে খুলে বলো। হালকা হও! পরবর্তীতে আফসোস করো না যে নাদিয়া এমন কেন করল?
– আমার কোনো সমস্যা নেই স্যার। আমি একদম ঠিক!
– আমাকে মিথ্যা বলতে পারো, নিজেকে বলতে পারবে না। তুমি নিজে জানো তোমার কী অবস্থা!
জাহিদ সেখান থেকে চলে আসে। ওর দুশ্চিন্তা আরো বাড়তে থাকে। ও এখন নাদিয়ার দিকে কারণে অকারণে তাকিয়ে থাকে। ওর ভয় করে। অবাক হয়, নাদিয়ার মতো স্ট্রং মেয়ে কী করে এমন করতে পারে। রাতে যখন নাদিয়া ওর ঘরে ঘুমাতে যায় জাহিদ ওর দরজায় এসে দাঁড়ায়।
– জ্বী, জাহিদ। কোনো সমস্যা?
– না। ইয়ে মানে, আপনি কী আমার ঘরে এসে ঘুমাবেন?
– জ্বী!
জাহিদের আবার কী হলো? ও ওকে ওর সাথে ঘুমানোর জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে? কী হলো জাহিদের? ও কী কমফরটেবল হতে চাইছে?
– কেন? আমরা তো রুমমেট বললাম না?
– এমনি। শুধু শুধু আলাদা থাকাটা কেমন যেন। জিনিসপত্র কালকেই আনুন। তবে আজ চলে আসুন।
– হু!!!
– জ্বী।
– স্পেসিফিক কারণ টা কী? কী জন্য ডাকছেন?
জাহিদ এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাবতে থাকে। কী বলা যায়?
– দুটো ফ্যান , দুটো মানুষের জন্য।
– তো?
– বিদ্যুতের অপচয়। অপচয়কারী শয়তানের ভাই।
নাদিয়ার ব্যাপারটা স্বাভাবিক লাগছেনা। নাদিয়া আর জাহিদ ওদের বিছানায় শুয়ে আছে। মাঝখানে বাউন্ডারি। জাহিদ এই কাজ টা করলো কারণ ওর ভয় লাগছে, যদি নাদিয়া রাতে কিছু করে ফেলে। এতদিন একা ছিল, নিশ্চয়ই উল্টো পাল্টা জিনিস ভেবেছে। একা তো রাখাই যাবে না। পরদিন সকালে নাদিয়া চা বানাতে যায়। জাহিদ রান্নাঘরে ঢুকে চুলা দেখতে লাগলো। চুলার আগুন হালকা কমিয়ে দিল। আবার ওর গায়ে আগুন না লেগে যায়। ওর চুল যদিও বাঁধা, আঁচল টাও কোমড়ে আটকানো। নাদিয়া হুট করে জাহিদ কে দেখে ঘাবড়ে গেল।
– কী হলো?
– চা।
– বানাচ্ছি তো।
– আমি বানাবো।
নাদিয়া টোস্টারের কাছে যেতেই জাহিদ দৌঁড়ে টোস্টারের কাছেও গেল।
– কী?
– আমি দেখবো। আপনি থাক।
– ওকে।
নাদিয়া ফ্রিজ থেকে ডিম এনে তা ভাজতে তাওয়া হাতে নিলো। জাহিদ চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করল কী?
– ডিম কী কাঁচা খান?
– আমি করছি।
– সমস্যা কী? আগেই বলতেন নাস্তা আপনি বানাবেন। আমি এত সকালে উঠতাম না!
– আচ্ছা টোস্ট আপনি করুন।
– বিরক্তিকর!
নাদিয়া স্কুলে যাবে। জাহিদ গাড়ি নিয়ে সামনে আসলো।
– আপনি কিছু মনে না করলে স্কুলে দিয়ে আসতে পারি?
– হ্যাঁ!!!
জাহিদ নাদিয়াকে স্কুলে নামিয়ে দিলো। কী হয়েছে ওর? এইটা কী কোনো টাস্ক যার ব্যাপারে ও জানেনা? সিক্রেট টাস্ক? স্কুলে জাহিদের গাড়ি থেকে নাদিয়া কে নামতে দেখে ওর অন্যান্য কলিগেরা একজন অপরজনকে ইশারা করছে। সব বোধহয় ঠিকঠাক। এই মেয়েটাই এত রাগ দেখায়। ফাহিমা ম্যাডাম আর সুলোচনা ম্যাডাম গিয়ে জাহিদের সাথে কথা বলতে গেলেন।
– এই এই দাঁড়ান। আপনি নাদিয়ার স্বামী তাই না?
– জ্বী।
– ঝগড়া থেমেছে তাহলে? টোনাটুনি খুশি?
নাদিয়া এগিয়ে এসে বলল,
– মিসেস ফাহিমা, আই থিংক হি ইজ গেটিং লেইট।
– একটু কথা তো বলতে পারি। কোনোদিন তো আসেন না।
– অন্যদিন বলবে। আজকে আমাদের পরীক্ষা আছে তো। গার্ড দিতে হবে। বাই জাহিদ।
জাহিদ অফিসে চলে গেলো। সেখানে নানা কাজের মধ্যে হঠাৎ ওর মনে হলো আজকে তো পরীক্ষা স্কুলে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে বোধহয়। এতক্ষণে কী ফিরেছে? ফোন করবে? কখনো তো করেনি। একটা ফোন করাই যায়। ফোন বাঁজতে বাঁজতে বন্ধ হয়ে গেল। আশ্চর্য! ফোন ধরলো না কেন? একটা মিটিং শেষে ও আবার কল করলো। এবার ও তুলল না। লাঞ্চ ব্রেকে ও আবার কল করলো। এবার ওর চিন্তা হচ্ছে। আবার কী কোনো লোকাল বাসের সামনে? না! এ হতে পারে না! চিন্তায় জাহিদের ঘাম ঝড়ছে।
– হ্যালো! অরনী আপনি কোথায়? ফোন ধরছেন না যে?
– আমি ডিউটি তে ছিলাম। আর আমরা এখন মিটিংয়ে আছি। খুব জরুরী!
নাদিয়া খুব রেগে কথা গুলো বলল। পুরো ৯ বার কল করেছে। হঠাৎ ওর মনে হলো জাহিদ ওকে অরনী বলল।
– আমার বাসায় কী কিছু হয়েছে জাহিদ? আমার বাবার সাথে?
– না।
– এতবার কল করলেন যে?
– এমনি। বাসায় গিয়েছেন কিনা?
– না, যাবো।
– পৌছালে ফোন করবেন।
– কেন?
– এমনি।
– আচ্ছা, আপনি অরনী বললেন কেন? সত্যিই কী বাসায় কিছু হয়নি?
– না। আমি ভুলে বলেছি অরনী। স্যরি নাদিয়া।
– না, না। ডাকতে পারেন। তবে সত্যিই কী কিছু হয়নি ?
– না।
– রাখছি।
জাহিদ এত অদ্ভুত ব্যবহার করছে কেন? নাদিয়ার মনে প্রশ্ন জাগে। আর এদিকে জাহিদের কলিগ ভাবছে জাহিদ ওর বউয়ের নাম ভুলে গেছে।
– স্যার, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, নামটা সেভ করে রাখলেই পারেন।
– মানে?
– ম্যাডামের নাম ভুলে গেছেন যে, তাই।
– না, নাম ভুলিনি। ভালো নামে ডাকা হয়। আর ঐ কাজটা হয়েছে?
– ঐ ব্যাপারেই এসেছি।
– তো দিন।
সেদিন বিকালে পিপির সামনে ওরা দুজন।
– কেমন খেললে ট্রুথ অর ডেয়ার?
– ভালো।
– কে জিতল বলে মনে হয়?
– আমি। আমি অনেক গেম দিয়েছি। একদম ঘরের কাজও করিয়েছি।
– জাহিদ ও তো মজা করেছিল।
– এটা তো একটা ছিল। বেশি আমি করেছি।
– কী জাহিদ?
জাহিদ গলা ঝেড়ে বলে,
– হ্যাঁ।
– তো তুমি বলছ তুমি হেরেছ?
– জ্বী। খেলা উনিই ভালো খেলেছেন।
– তো ফাইনাল। নাদিয়া উইনার। জাহিদ টাকা দাও ওকে।
টাকা দেওয়ার পর এখন নতুন টাস্ক।
– তোমরা দুজন হানিমুনে কোথায় গিয়েছিলে?
– হানিমুন!
ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকায়। পিপি বুঝতে পারে ওরা কী ভাবছে।
– বাদ দিন।
– তোমরা যাওনি! ওহ নো!
– সময় হয়নি। ওনার আমার।
– তো এখন যাও।
– কী করে! আমার বাচ্চাদের পরীক্ষা চলছে। আমার খাতা দেখতে হবে। অনেক কাজ।
– তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করো। এভাবে আর কখনো সময় হবে না।
– আমি সত্যিই ব্যস্ত।
জাহিদ ও বলল,
– আমার ও অনেক কাজ। ফ্রি নেই সামনে।
– চুপ করো তোমরা! সামনে শনি বার ছুটি নিয়ে নাও। রবিবার একটা সরকারী ছুটি আছে। শুক্র, শনি, রবি তিন দিন! তোমরা না গেলে তোমাদের মার লাগাবো!
– এখন সামনে একটা ডিল ফাইনাল করতে হবে। খুব ইম্পরটেন্ট। দুই মাস ধরে কাজ করছি তার উপর।
– এগিয়ে নাও।
– জ্বী?
– কবে ফাইনাল ডেট?
– নেক্সট উইক।
– এই উইকে কাজ এগিয়ে রাখো।
নাদিয়া বলে,
– আমার খাতা দেখতে হবে। তিনটা সেকশন।
– সে আর এমন কী? রাত দিন দেখে শেষ করো।
– অনেক কষ্ট হবে!
– না না আমি শুনব না। আমার টাস্ক তো শুনো।
– জ্বী বলুন।
– টাস্ক হচ্ছে ” আমার চোখে দেখ।”
– নামটা সুন্দর।
– টাস্কটা ও সুন্দর। তোমরা দুজন ঘুরতে যাবে। আর তোমরা একে অপরের সব সুন্দর সুন্দর ছবি তুলবে। সেই ছবি গুলো আমাকে মেইল করবে। আমি আর একজন বিচারক সেই ছবি গুলো দেখে বিচার করবো। এরপর সেই বিজয়ী কে পুরস্কার দেওয়া হবে। তবে ভিডিও দিতে পারো।
– কিন্তু এতো সময় হবে কী!
– হতে হবে। জায়গা তোমরা ঠিক করবে। আর হ্যাঁ, কোনো ফ্লাইটে যাওয়া নয়। রাতে বাসে গেলে ভালো হয়। যাওয়ার আগে আলাদা আলাদা কথা বলবে আমার সাথে।
জাহিদ আর পিপি আলাদা বসে,
– আপনি এমনটা কেন করছেন? সেদিন না বললাম ওনার এত বড় সমস্যা।
– তাই করলাম। ওকে খুশি রাখো। ও যাতে খুশি থাকে আর ভুলে যায় ব্যাপার গুলো। ও তোমাকে এটা কেন বলল? কারণ ও চায় তুমি ওকে সাহায্য করো। ও তোমাকে আপন ভাবছে। আর তুমিও তোমার কষ্ট গুলো শেয়ার করো ওর সাথে। এভাবে একসাথে শুধু দুজন, অচেনা জায়গায় ঘুরলে দেখবে ট্রাস্ট বাড়ছে। তুমিও ওকে এবার আপন ভাবতে শুরু করো।
– কোথায় গেলে ভালো হয়?
– তোমার মিসেস যা বলে। ট্রিপটা ওর জন্য।
নাদিয়া আর জাহিদ বাড়ি ফেরার পর রাতের খাবার খাচ্ছে,
– এখন আমরা ঘুরতে যাব কী করে জাহিদ ?
– যেতে তো হবেই।
– আপনার না কাজ?
– আছে। তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। একটু কষ্ট করতে হবে। এরকম বন্ধ ও তো আর পাওয়া যাবেনা।
– তাই?
নাদিয়া ক্ষান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। এতদিন তো কোনো ছুটিই ছিল না। এখন তো ছুটি ও আছে। হয়তো তখন ইচ্ছে ছিল না। আচ্ছা যাই হোক, কথা তো বলছে। হয়তো এরকম কোনো জায়গাতেই বলতে চায় আসল কথা।
নাদিয়া ওর ভাগের খাতা এনে চেক করতে থাকে। আর জাহিদ অফিসে ওর কাজ সামলাতে থাকে। একটা দিন ছুটি করা পুরো পুষিয়ে দিতে হবে। বিয়ের পরই ওদের এত ভালো লিডার টা বদলে গেছে। মাঝখানে ডিভোর্স ল’ইয়ার খুঁজছিল। আর আজ একদম বউ নিয়ে কী চিন্তা। কাজের মাঝখানে মাঝখানে আবার ফোন ও করে বাসায়। জাহিদের অফিসে খুব ফিসফাস চলছে। ব্যাপারটা এখন বিরক্তিকর লাগছে নাদিয়ার কাছে। হঠাৎ করে এত কেয়ার কেন? নাদিয়া খাতাই দেখতে পারছে না। কী সব। মাঝরাত পর্যন্ত ওর জন্যে রুমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। যদিও ও অন্য রুমে আলো জ্বালিয়ে খাতা দেখে কারণ জাহিদের ঘুমের কষ্ট হবে। দিনের বেলাও খাত দেখছে কাজ আগাতে। এখন আবার মায়ের ফোন। নাদিয়া ফোন তুলল না। নাদিয়ার মা ফোন করল জাহিদ কে।
– হ্যালো বাবা, আমি নাদিয়ার মা।
– জ্বী মা, বলুন।
– নাদিয়া ফোন ধরছে না কেন?
– কী বলছেন! কেন ধরছে না?
জাহিদের ভয় লাগছে। আবার কী করে ফেলল নাকি?
– না , না। শান্ত হও বাবা! ও যে তোমার বাসায় গেল, আর রাগ করে কথাই বলে না আমার সাথে। রাগ করেছে, ওর রাগ তো এমনই। আজকে সকালেও দুবার করলাম, একটু আগেও করলাম। ফোন ধরছে না।
– সকালে সে ধরেছিল। এখন আমি আবার দিচ্ছি।
– ধরলে একটু বলো আমার কথা আছে। অনেকদিন কথা বলি না।
– জ্বী মা।
জাহিদ ওকে আবার কল করল,
– আপনার সমস্যা কী! আমি বাসায় ই আছি। আমাকে আর ফোন করবেন না।
– আপনার মা,
– কী! মায়ের কী হলো?
– ফোন করছেন। কথা বলবেন।
– ওকে। আর কিছু?
– না।
নাদিয়া ওর মাকে ফোন করল,
– ফোন ধরছ না যে?
– আ’ম বিজি।
– এখনো রাগ?
– জরুরি কথা থাকলে বলো।
– তোমাদের মধ্যে সব ঠিক?
– না। আমরা কাউন্সিলিং এ যাচ্ছি জানো না?
– জানি তো। তা বলো। ওসব আপডেট দিচ্ছ না যে।
– এখন আমার অনেক কাজ। আমরা ঘুরতে যাবো। সব ঠিক করতে হবে। আমার খাতা ও দেখে যেতে হবে এর মধ্যে।
– কোথায় যাবে?
– জানি না।
– সুইজারল্যান্ড যাবি? জামাইয়ের কী ঠান্ডার সমস্যা আছে? টিকিট বুক করিয়ে দেই?
– জানিনা। খুবই স্বল্প ঝটিকা সফরে যাচ্ছি। বাইরে যাচ্ছি না। ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।
– বাংলাদেশের ভিতর?
– হ্যাঁ।
– খাগড়াছড়ি ? ওখানে যা। অংশু কে বলি ও সব ঠিক করবে। আমাদের কটেজটা তে যা। ফোন করে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
– তোমার কিচ্ছু করার দরকার নেই।
– তোর মামা কে বলি,কক্সবাজারে তার বন্ধুর বড় হোটেল আছে। অংশু ফ্লাইট ও বুক করে দেবে।
– তোমাদের কিছু করা লাগবে না। আমি জানি কী করা লাগবে।
নাদিয়া ফেসবুকে ট্রাভেল গ্রুপের সাথে সাজেকের ইনফরমেশন দেখতে লাগলো। খাতা দেখা বাদ দিয়ে ও সব ঠিক করছে। জরুরি জিনিস পত্র সব অর্ডার বুকিং করে শেষ। জাহিদ রাতে বাড়িতেও চলে এসেছে। অনেক ক্লান্ত, তাই আজ খেয়েই শুয়ে পড়ার ইচ্ছা। রান্নাঘরে নাদিয়া ছুরি দিয়ে সালাদ কাটছে। আজ সালাদ খাবে। জাহিদ রান্নাঘরে ঢুকতেই দৌঁড়ে গিয়ে সেই ছুরি ধরে টান দিল। নাদিয়া ও ছুরিটার দিকে হাত বাড়ালো। কিন্তু জাহিদ ছুরিটা দিচ্ছে না। ওদের দুজনের মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু হলো ছুরি নিয়ে। জাহিদ ছুরিটা উপরের দিকে তুলে আছে। জাহিদ ওর থেকে লম্বা হওয়ায় নাদিয়া তা ধরতে পারছে না। অনবরত লাফাচ্ছে। একটা সময় ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল আর জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো।
” কী!!!! কী শুরু করলেন !!!” নাদিয়া গর্জন করে উঠল। জাহিদ ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে আছে।
“এটা দিন। দিন আমাকে!!!” আরেকটা চিৎকার। জাহিদ ছুরি টা হস্তান্তর করলো। নাদিয়ার হাতে এখন ছুরি আর ছুরির মুখে জাহিদ।
– আমি জানি, আপনি এমনটা কেন করছেন।
– এমনি। আমি সালাদ কাটতে চাইছিলাম।
– এমনিতে তো না!! (আরেকটা চিৎকার)
– সত্যি!
– আমি আপনাকে সত্যি টা বলেছিলাম বিশ্বাস করে। আপনাকে আপন ভেবে বলেছিলাম। ভয় লাগানোর জন্য না।
– আমি ভয় পাচ্ছি না তো।
– তো কী করছেন এগুলো! আপনি আমাকে ঘরে একা থাকতে দেন না আমি কিছু করব তাই?
– না।
– চুলা চেক করতে থাকেন, আগুন লাগাবো গায়ে তাই?
– না না!
– ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেন বাসায় পৌঁছেছি কিনা, অ্যাক্সিডেন্ট করলাম কিনা তাই?
– একদম না।
– সত্যি বলছেন?
– না তো! হ্যাঁ হ্যাঁ।
– দেখুন, আমি আর আগের মতো নেই। আমি বদলে গেছি। বিছানায় শুয়ে আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। আমি জানি আমার জন্য কত কষ্ট হয়েছে সবার। আমার বাবার সেই জমিটা আজ পঞ্চাশ কোটি টাকা। তার পাশে এয়ারপোর্ট হচ্ছে। কত লস হয়েছে আমি জানি। আমার মা সময়ের আগে রিটায়ার্ড হয়ে গেছে। আর রাহু ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়ে ডাক্তারি পড়ল। সব ধ্বংস হয়ে গেছে আমার জন্য!
নাদিয়া কথা গুলো বলতে বলতে থেমে গেলো। ও আসলে কথা বলার সময় ওর হাতের ছুরিটা নেড়ে বলছিল এসব। জাহিদ ওর দিকে না, ছুরিটার দিকে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ। এখন ও নাদিয়ার হাতে ছুরিটা এমন ভাবে ধরা যা দেখে জাহিদ ভয় পাচ্ছে।
– কী দেখছেন?
– কিছু না আপনি বলুন।
– এই যে ছুরিটা, এই ছুরি দিয়ে এখন আর আমি নিজে মরবোনা, মানুষ মারবো!
এই বলে নাদিয়া ছুরিটা রেখে চলে আসে। এরপর ও মাথায় হাত দিয়ে খাবার টেবিলের পাশে বসে। বলে কী ভুল করলো নাকি? জাহিদ এসে ওর পাশে বসে।
– আমি এখন কেন মরবো?
– না, না, কিছু হবে না। আমি এমনিই করছিলাম।
– মিথ্যা বলবেন না। আমি এসব বলেছিলাম যাতে আপনি আপনার মনের সব কথা আমাকে বলতে পারেন! আপনি তো আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন। কেন যেন মনে হচ্ছে আমি এসব আপনাকে ব্ল্যাক মেইল করতে বলেছিলাম।
– না , না।
– তাই তো মনে হচ্ছে। আমি কখনোই আপনাকে ভয় লাগতে চাইনি। আমি এখন আর করি না। আপনি ভয় পাবেন না।
জাহিদ মাথা নাড়ল ঠিকই কিন্তু এখনো ওর মাথায় ওগুলোই চলছে।
(চলবে)