#রিস্টার্ট,পার্ট_১৮
#পিকলি_পিকু
সকালে নাদিয়ার ঘুম ভাঙার পর চোখ খুলে দেখে ও ঘরের ভেতর। যতটুকু মনে পড়ে ও তো বাইরে ঘুমিয়েছিল। এখানে আসলো কী করে? আর এই উদ্ভট জিনিসটা ওর গায়ের উপর কেন? পাশে তাকিয়ে দেখে উদ্ভট জিনিসটা জাহিদ। জাহিদের হাত ওকে জড়িয়ে আছে আর ওর মুখটা ওর ঘাড়ের উপর। কাল রাতের কাপ নুডলস বা কাপ কেক এ কিছু ছিল নাকি? নাদিয়া পাশ ফিরে জাহিদের দিকে তাকায়। কী সুন্দর করে ঘুমায়। বাচ্চা একটা। ওরা কখনো মুখোমুখি ঘুমায় নি। ওকে চশমা ছাড়া দেখতে কেমন? এখন তো চোখ বন্ধ। নাদিয়ার খুব ইচ্ছে হচ্ছে জাহিদের গাল টা স্পর্শ করতে। নিজেকে আটকাতে না পেরে করেই ফেলল সেই কাজ। নিজের শ্বাস আটকে রেখে জাহিদের গাল স্পর্শ করে কতক্ষণ তাকিয়েই রইলো ওর দিকে। প্রেমে পড়ে যাচ্ছে, আরো প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু পিপি স্যার বলেছে ওকে এখন ভালোবাসা যাবে না। নাদিয়া পাশ থেকে ফোন নিয়ে ঘড়ি দেখে। এখনই কংলাক পাহাড় দেখার সময়। দশটার মধ্যে আবার সাজেক ছাড়তে হবে। জলদি জলদি করতে হবে। নাদিয়া পোশাক ছেড়ে তৈরী হয়ে এসে দেখে জাহিদ এখনো ঘুমাচ্ছে। ওকে জাগাতে গেলে ও অনেক আহ্লাদের সুরে বলে, “আরেকটু ঘুমাই না মা!” নাদিয়ার খুব জোরে হাসি পেয়ে গেল। মা! ওকে বোধহয় আর কেউ এভাবে জাগায়নি এত বছরে। সবসময় তো অ্যালার্ম দিয়ে নিজে থেকেই উঠে। মনে হচ্ছে জাহিদ তো এখন উঠবে না, তাই বলে ও সকালের কংলাক পাহাড় মিস করবে না। একটা চিরকুট রেখে নিজে নিজেই সেখানে ছুটল।
একটা বাঁশ নিয়ে তাতে ভর করে পাহাড়ে উঠতে লাগল। সকাল বেলার পাহাড়! এই পাহাড় সমুদ্র দেখলেই যেন মনে হয় বেঁচে আছি। সভ্যতা কত বছর ধরে শহরে? এক জেনারেশন আগের লোকেরাও প্রকৃতির কাছে থাকতো। প্রকৃতির সাথে মানুষের আত্মার একটা রহস্যময় সম্পর্ক আছে। আর নাদিয়া তা খুব স্পষ্টভাবেই অনুভব করে। নাদিয়া উঠতে উঠতে মেঘ ও দেখছে। যেন ও মেঘের সাথে সাথেই চলছে।
” উড়ছে দেখো মেঘ আর আকাশ
উড়ছি দেখো আমি।
মেঘ আর আমার তফাৎ যে নেই
এই মুহূর্তটা দামী।
আজকে আমি পাহাড় চূড়ায়
মেঘের সাথে ভেসে বেড়াই
এখন আছে এই স্থানে
আমার সত্তা, আমার আত্মা
আর আমি।”
পাহাড় চূড়ায় নাদিয়া, হাতে লাঠি। মাথা উঁচিয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিল। এখানেই আসতে চেয়েছিল। সত্যি, বিধাতার অপরূপ সৃষ্টি দেখলে মন সত্যিই ভালো হয়ে যায়। নাদিয়া সেখানে বসে একা কিছুক্ষণ সকালের সূর্য দর্শন করল। এই সময়টা শুধু ওর আর ওর নিজের। আশেপাশে সবাই কারো না কারো সাথে সময় কাটাচ্ছে। ও শুধু নিজের সাথে। মাঝে মাঝে নিজের সাথেও সময় কাটানো জরুরী। কিছুক্ষণ ওর মনে হলো এখন একটা ছবি তোলা উচিত। এই সূর্যটা অনেক সুন্দর। এই সূর্যটা ও নিয়ে যাবে ওর সাথে। সেই জায়গা থেকে উঠে ছবিটা তুলতে পাহাড়ের একদম কিনারায় গেল নাদিয়া। কিন্তু হঠাৎই একটা হ্যাঁচকা টান অনুভব করল। ওকে কেউ যেন জড়িয়ে ধরে আছে।
” আমি তোমার কাছে যাবো
কেউ জানতেও পারবেনা,
আমি তোমার পাশে রবো
কেউ বুঝতেও পারবেনা।
আমি নিজেকে হারিয়ে কোথায় পালিয়ে
আমি তোমার কাছে যাবো,
কেউ বুঝতেও পারবেনা। ”
জাহিদ নাদিয়াকে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। পাহাড় বেয়ে ও শ্বাস নিতে পারছে না। তবুও নাদিয়া কে ধরে আছে। আশেপাশের সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। নাদিয়া কিছুক্ষণ পর নিজেকে ছাড়ালো।।
– কী হয়েছে?
– আপনি এখানে কিনারায় কী করছিলেন!
– আস্তে, আস্তে। আমি ছবি তুলছিলাম।
– এত কিনারায় কেন?
– পড়ে যাব? আরে আমি সেইফ জায়গায় ই আছি।
– তাও! আমাকে রেখে আসলেন কেন?
– রিলেক্স। সবাই কিভাবে যেন দেখছে। আর আমি এসেছি, আবার যেতাম তো। ভাবলাম আপনার একটু ঘুমের দরকার।
এরপর নাদিয়া আর জাহিদ একসাথে বসে আছে।
– আপনার কেন বারবার মনে হয় আমি লাফ দেব ঝাঁপ দেব?
– না। সেটা না। পড়েও যেতে পারেন।
– মিথ্যে বলবেন না।
জাহিদ মাথা নিচু করে আছে। নাদিয়া ওর সামনে তাকিয়ে হেসে বলে,
– এই দৃশ্য টা দেখছেন? এত উপর থেকে, এত মেঘ এত সুন্দর!
– জ্বী।
– এত সুন্দর দৃশ্য দেখেও কী কারো মরতে ইচ্ছে হয়? মনে হয় না আরেকটু বাঁচি? ” মরিতে চাহি না আমি এ সুন্দর ভূবনে।”
জাহিদ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে নাদিয়ার কথা। কী সুন্দর করে কথা বলে ও। একদিন ওকে জীবনানন্দ দাশের একটা কবিতার বই দেবে। সেখান থেকে দুটো কবিতা শোনার আবদার করবে। কিন্তু,
– আমি ঠিক এই কারণেই ডিভোর্সের ঝামেলা চলাকালীন বাংলাদেশ ঘুরতে চেয়েছিলাম। প্রকৃতির কাছে থাকলে মন ভালো থাকে। আমার যে লক্ষ্য টা আছে সেই লক্ষ্য পূরণ হলে আমি কুয়াকাটা চলে যাব। ওখানেই থাকবো বাকি জীবন।
‘আর আমি?’ জাহিদ চিন্তা করছে। কিন্তু বলতে পারছে না। সেই অধিকার কী আছে?
– আপনি কখনো পাহাড়ে ওঠেননি?
– না।
– কোনো ট্রিপে যান নি?
– না।
– এটাই প্রথম?
জাহিদ মাথা নাড়ে। নাদিয়ার খুব মায়া হয়।
– আপনি গিয়েছেন?
– জ্বী। আমরা তো প্রতিবছর ফ্যামিলি ট্রিপে যেতাম। আমার অ্যাক্সিডেন্টের পর বন্ধ ছিল। তাছাড়া আমি, রাহু আর প্রিয়ম লুকিয়ে লুকিয়ে ছোট খাটো বনভোজনে যেতাম। মা জানলে বকতো। আমাদের শুধু বড় হওয়ার ইচ্ছে ছিল। ভার্সিটিতে উঠলেই আমরা দুজন ঠিক করেছিলাম ছুটি পেলেই আমরা নিরুদ্দেশ হয়ে যাব। এই রাহু বডিগার্ড ও নেব না। দেখুন না, কী হলো। সে নিজেই,
জাহিদের ভেতর আবার অপরাধ বোধ কাজ করতে লাগলো। ওর জন্যই তো সব শেষ হয়ে গেছে।
– কিন্তু জানেন, একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের মা বাবা বলেছিল আমরা গ্র্যাজুয়েট হলেই একটা সোলো ট্রিপে ফরেন কান্ট্রি যেতে পারি। স্পনসর ওনারা করবে। অংশু ভাইয়া গিয়েছিল স্পেন। কিন্তু আমার সময় অ্যাক্সিডেন্টের শকে কেউ আমাকে একা ছাড়বে না বলে। তখন ফুল ফ্যামিলি, রাহু ছাড়া নেপাল যাই।
– নেপাল কেমন?
– যেমনই হোক। পরিবার সহ কিছুই করতে পারিনি। শুধুই নজরদারি। পরবর্তীতে যদিও বিদেশে পড়ার সময় পার্ট টাইম জব করে সেই টাকা দিয়ে থাইল্যান্ডে গিয়েছিলাম। প্যারাসেইলিং আর স্কুবা ডাইভিং ও করেছি। খুব মজা হয়েছিল!
– মা বাবা জানে না?
– যাওয়ার সময় বলিনি। রাহুকে ছবি পাঠানোর পর ও দেখিয়ে দেয়।
– বকেছিল?
– হুম। কিন্তু সেই আনন্দের কাছে তো কিছু না। আপনি করেছেন প্যারাসেইলিং?
– না।
– ও হ্যাঁ, আপনি তো ট্রিপেই যাননি। করবেন?
– না না!
– কক্সবাজারে ও আছে। এখান থেকে ওখানে যাবো।
– সময় নেই।
– পরের বার?
– পরের বার!
– হ্যাঁ! পরের বার আমরা কক্সবাজার যাব। মন খারাপ করবেন না। আমরা তার পরের বার আপনার পছন্দের রাজা রানী মহলেও যাব।
নাদিয়ার সত্যি ই ওকে নিয়ে এত ভবিষ্যত পরিকল্পনা। অবাক হচ্ছে জাহিদ। আনন্দ ও লাগছে।
– সত্যি আবার আপনি আমাকে নিয়ে ঘুরতে আসবেন?
– কেন না?
– আপনি না কুয়াকাটা যাবেন?
নাদিয়া কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সত্যিই তো! ওর লক্ষ্য যদি পূরণ হয় ও তো কুয়াকাটা যাবে। তো আবার জাহিদের সাথে সংসার করার স্বপ্ন দেখছে কেন? জাহিদের সাথে ও তো থাকতে চায়। জাহিদ ও তো ইম্পরটেন্ট। ও জাহিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আপনি যাবেন কুয়াকাটা?
– জ্বী!
– আমার সাথে?
তখনই ওদের গাইড ওদের ডাকতে লাগলো। সবাই এখন নাস্তা করে সাজেক ছাড়বে। আর তারপর বাকি ঘোরাঘুরি। জাহিদ কিন্তু এখনো উত্তর টা দেয়নি। তবে নাদিয়ার লক্ষ্য টা কী? টিচার তো হয়েই গেছে। এখন আর কী লক্ষ্য হতে পারে ? নাস্তা খেয়ে ওরা সাজেক থেকে বিদায় নিয়ে আলুটিলা গুহা দেখতে গেল। সেই অন্ধকার গুহায় ঢুকতে জাহিদ বারণ করলেও নাদিয়া ঠিকই ঢুকল। ওকে পাহারা দিতে জাহিদ ও ঢুকলো। দুজনের ফোনের আলো জ্বালানো। কিন্তু জিনিসটা খুবই পিচ্ছিল হওয়ায় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। নাদিয়ার পা পিছলে যেতেই জাহিদ নাদিয়ার হাত ধরে নিল, ” প্লিজ ! ধরে রাখুন আমার হাত।” সেখান থেকে বেরিয়ে এবার ওরা রিসাং ঝর্ণা দেখতে গেল। কী মনোরম ঝর্ণার আওয়াজ। তার থেকেও মনোরম নাদিয়ার হাসি। আশেপাশের নানা কলতানে জাহিদ তা ভিডিও করলো। নাদিয়া সেই ঝর্ণার ধারে জাহিদের কয়েকটা ছবি তুলল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নাদিয়ার পা সেখানেই পিছলে গেল। জাহিদ বুঝতে পারছে না পা মচকে গিয়েছে কিনা। সেখানে থাকা একজন বলল মচকে গিয়েছে। নাদিয়া দাঁড়াতেই পারছে না, হাঁটা তো দূরের কথা। এখন এখান থেকে কী করে বের হবে।
“এমন একজন স্বামী থাকতে আর চিন্তা কী?” পাশ থেকে একজন বলে উঠল। জাহিদকেই এখন ওকে কোলে নিতে হবে। এই ঢালু জায়গা বেয়ে একা নিজে ওঠাই কষ্ট, সেখানে একটা মানুষকে কোলে নিয়ে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। জাহিদ চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত। আর নাদিয়া ও এত ভারি নয়। আগেও নিয়েছে। কাল রাতের ছেলে গুলোর মধ্যে একজন বলল,” কাল ও তো নিয়েছেন ভাইয়া। ” জাহিদ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। নাদিয়া বুঝতে পারল, কেন সকালে বিছানায় ছিল। জাহিদ আল্লাহর নাম নিয়ে নাদিয়া কে কোলে তুলে নিল। নাদিয়া যথাসম্ভব চেষ্টা করছে যাতে ওর কষ্ট না হয়। লজ্জা ও লাগছে, আবার পায়েও ব্যাথা। অনেকেই ওদের ছবি তুলছে। নাদিয়া একটু বিরক্ত।
– প্লিজ ছবি তুলবেন না।
– আপনাদের দেওয়ার জন্যই তুলছি।
কোনো ভাবে গাড়ি পর্যন্ত এসে একটা ফার্স্ট এইডের ব্যবস্থা হলো। সন্ধ্যা হতেই ওরা রাতের খাবার খেয়ে ঢাকার গাড়িতে উঠলো।
– তো, এ পর্যন্ত ই?
– হ্যাঁ।
– তিনদিনের ছুটি! কাল তো শুধু শুধু।
– জাহিদ! ঘুরতে গেলে দুইদিন এক্সট্রা দরকার। একদিন আগের দিন প্যাকিং এর জন্য। আরেকদিন ফেরার পর বিশ্রাম। এই ডার্ক সার্কেল নিয়ে প্রেজেন্টেশন দেবেন?
জাহিদ চুপ করে আছে। একটু পর বলল,
– তো এত ভারী ব্যাগ?
– এত ভারী কোথায়? জামা কাপড় ও কম। আনুসাঙ্গিক জিনিস বেশি ছিল। যেমন ফার্স্ট এইড খাবার এসব। এসবের প্রয়োজন ও হয়েছে।
– ওহ!
জাহিদ মনে মনে ভাবছে, ‘এভাবে ঘুরে বেড়ালে মন্দ হয় না। এত কম সময়ে নতুন অনেক কিছুই দেখেছি। আচ্ছা, কুয়াকাটাতে কী সারা জীবন থাকবে না এমনি ঘুরতে যাবে?’ রাত গভীর হতে হতে নাদিয়ার ঘুম চলে আসে। নাদিয়া আস্তে আস্তে জাহিদের কাঁধে মাথা রাখে। জাহিদ জেগে থাকায় চমকে উঠে। বাসের লাইট নেভানো। জাহিদের একটু লজ্জা লাগতে থাকে। তবুও ও ওর ফোন বের করে নাইট ভিউতে খুব ভয়ে ভয়ে একটা শেষ ছবি তোলে। এভাবেই শেষ হলো ওদের ঝটিকা হানিমুন।
ঢাকা ফিরে নাদিয়ার মচকে যাওয়া পা নিয়ে বাড়ি চলে এলো ওরা। পরে রাহুকে বলা যাবে। এদিকে ওদের সেই ছবি কেউ ফেসবুকে আপলোড করে দিয়েছে। রোমান্টিক ক্যাপশন সমেত বিভিন্ন পেজে পেজে রীতিমত ভাইরাল। ” সত্যিকারের ভালোবাসা এমনই হয়।” “ট্রু লাভ আফটার ম্যারেজ।” “খোঁড়া বউ ও আদর্শ স্বামী ” সাথে ওদের দশ বছরের পুরনো প্রেম আর সদ্য হওয়া অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এর নকল কাহিনী তে ফেসবুক দুই ভাগে বিভক্ত। সপ্তর্ষি এই ছবি দেখে নাদিয়া কে চিনে ফেলে। সাথে সাথে রাহুকে সেই ছবি পাঠায় সে। রাহু তো জানেই না ওরা সাজেক। জাহিদ রাহুকে নাদিয়ার পা সম্পর্কে বলার আগেই ওর শালাবাবু হাজির সব জিনিস নিয়ে।
– তুমি!
– জ্বী আমি!
– আমি তো তোমাকে ফোন করতাম। রাতে এসেছি যে।
– আপনারা আমাকে জানাবেন না?
– জানাতাম। তবে তুমি কী করে জানলে?
– পুরো বাংলাদেশ জানে। আপনারা ভাইরাল!
নাদিয়া সেই পোস্ট গুলো দেখে খুবই বিরক্ত। কে তুলল সেই পিকচার। মানা করেছিল। সবাই এখন হাসাহাসি করবে। অবশ্য পিপি নিজেই করছে, ওদের নকল প্রেম কাহিনী শুনে। দশ বছরের প্রেমের পর বিয়ে। দুই পরিবারের বাঁধা পেরিয়ে। ফেসবুকের কর্মহীন লোকেরা গল্প ও ফাঁদতে পারে ভালোই। আফরা হাসতে হাসতে কুপোকাত। সাব্বির দেখে বলে,
– কী হয়েছে?
– নাদিয়ার পা ভেঙে গেছে।
– এতে হাসার কী হলো?
– আনন্দ হচ্ছে তাই। দেখো!
সেই ছবি দেখে সাব্বির ও অবাক। শাখাওয়াতও ছবিটা দেখেই চিনে ফেলল , মেয়েটাকে। তবে কী ও এত সহজে পেয়ে গেছে প্রেম? চোখ দেখে তো তাই মনে হয়। ও কী বুঝেছে ভালোবাসা পেতে কত কষ্ট করতে হয়? যাই হোক, ভালো থাকুক প্রাক্তন। জাহিদ নাদিয়ার চেনা পরিচিত প্রায় সবাই দেখেছে এই ছবি। আর সবাই খুব আনন্দিত। কিন্তু একজনের চোখ বিষাক্ত অশ্রুতে ছলছল করছিল। ওর না ডিভোর্স হচ্ছিল? ঠিক হয়ে গেল কেন? অরনী কী কখনো ওর হবে না? ডিভোর্সী হলেও ওর সমস্যা ছিল না। অরনী তো অরনী, তাই না?
কিছুদিন পার হয়ে গেল। জাহিদ ওর অফিসে, ডিল টা ও হয়ে গেছে। এখনো ওর কলিগেরা ভুলতে পারছে না এই মহান প্রেমিক পুরুষকে। অসহ্যকর! নাদিয়া কে নিয়ে আজ পিপির কাছে যাওয়ার কথা। ছবিগুলো আগেই মেইল করা আছে। আজ ফলাফল।
– এত কষ্ট করে আসতে গেলে কেন? পা ভালো?
– আপনি ও জানেন?
– জাহিদ, তোমার কোমর?
পিপি হাসতে লাগলো। জাহিদ খুব বিরক্ত হয়ে তাকালো।
– রাগ করছ কেন? সবাই নাদিয়া কে দেখে ওর পায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। কেউ তোমার কোমরের কথা বলে না।
– টাস্কের কথা বলুন।
– টাস্ক তো শুধু আমিই বিচার করিনি। একজন গেস্ট জাজ ছিল।
নাদিয়া জিজ্ঞেস করল,
– কে?
– বিবি।
– বিবি? আপনাদের কী উদ্ভট নাম। পিপি, বিবি। আসল নাম বলুন।
– আমার বিবি। হাবিবি, ওয়াইফ, পেত্নি, মানে পত্নি।
– ওহ!
– ওনার আর আমার সব ছবিই ভালো লেগেছে। বিশেষ করে নাদিয়া যখন মেঘ দেখছিল। ক্যান্ডিড। ও জানত না। ভালো ছিল জাহিদ।
– আমার তো ছবি জানতাম না। উনি তো জানতেন ই না যে সাজেক যাচ্ছে! সারপ্রাইজ ছিল।
– রিয়েলি! তবে নাদিয়ার সানসেটে জাহিদের যে ছবি টা তুলেছ ওটা খুব দারুন। ওটা তুমি ওয়াল পেপার দেবে।
– না, পারব না। এগুলো ন্যাকামি।
– ফাইন হবে। আর জাহিদ তুমিও তোমার পছন্দের একটা ছবি দেবে। আর ভিডিও গুলোও দারুন। জাহিদ তুমি কী দোয়া করেছ?
জাহিদ ঘাবড়ে যায়। দোয়া এভাবে বলে নাকি?
– রহমতের দোয়া। আর কী দোয়া?
– স্পেশাল কিছু চাওনি?
– নামাজে চাই। ওটা আমার আর আল্লাহর মাঝে।
– ওকে, আমি তোমার আর তোমার রবের মাঝে আসব না। মূল কথা বিবি আর পিপি সব ছবিকেই এ+ দিয়েছে। তোমরা যৌথভাবে বিজয়ী।
নাদিয়া আর জাহিদ দুজন দুজনের দিকে তাকায়। একটু হতাশ। এত কষ্ট করলো।
– তোমাদের দুজনের চোখে তোমরা দুজনেই খুব সুন্দর। সত্যি বলতে আমি তোমাদের চোখে তোমাদের দেখতে চাই নি। তোমাদের ই দেখাতে চেয়েছি তোমরা কত সুন্দর। কিছু মুহূর্ত হয়তো তোমরা তুলতে পারোনি। কিন্তু ভুলতেও পারবেনা , তাই না?
ওরা দুজনেই লজ্জা পেতে থাকে। পিপি তা খেয়াল করে।
– তোমরা কী এখনো কিশোর কিশোরী? এত লজ্জা পাচ্ছ কেন? আই থিংক তোমরা শুধু একজন একজনকে দেখনি, কথাও বলেছ।
– জ্বী। স্বাভাবিকের তুলনায় অবশ্যই অনেক কথা বলেছি।
– তো আরো কিছুদিন কথা বলে এসো। আর তোমার পা ঠিক করো। আমি নতুন টাস্ক ঠিক করি।
– এতদিন সময়ে কী করেছেন?
– আরে , তোমরা বেড়ালে , আর আমি আর আমার বিবি বেড়াবো না?
জাহিদ আর নাদিয়া ওদের গাড়িতে। জাহিদ ভাবছে ওয়ালপেপারে শেষ সেলফিটা দিলে কেমন হয়। যদিও ওকে দেখা যাচ্ছে না। শুধুই ঘুমন্ত নাদিয়া ওর কাঁধে। নাদিয়া মাথা নিচু করে ভাবছে জাহিদ যে সেদিন ওর এত কাছে এসেছিল এটা কী ও জানে? সেদিন কী বাউন্ডারি না থাকায় এমন করলো? আজকে কেউ কোনো কথা বলছে না। শুধুই মুচকি হাসি দুজনের মুখে। তবে কী সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে?
জাহিদ আর নাদিয়ার ছবি গুলো দেখে মিষ্টি এখনো লাফাচ্ছে। নাদিয়া তবে সব ঠিক করে ফেলল।
– মা! মা!
– বলো।
– আমি কী কাল অরনী কে দেখতে যাব? ওর তো পা মচকানো।
– দরকার নেই। আমরা যাচ্ছি।
– আমি তো ভাবি। আমারও দায়িত্ব আছে।
– মিষ্টি মামনি, তুমি কী এখনো জানো না অরনী তোমাকে পছন্দ করে না।
– আমি তো করি। আমার ননদ।
– ওভাবে না। তুমি ভাবো একটা, করে বসো আরেকটা। অরনীর এ সব পছন্দ না। তুমি ওর বাসায় গিয়ে ওকে একটা কথা বলবে, আর ও রেগে গেলে? ভালো দেখাবে?
– ওটা তো এমনিতেই বলে।
– কিন্তু ওটা ওর বাড়ি।
– আচ্ছা যাই হোক। ওকে তো আসতে বলতে পারি।
– ও আসবে না। ওর ইগো বেশি। ঐদিনের রাগ এখনো আছে।
– তো কী করবো? আচ্ছা মা, আমরা এক কাজ করি। সবাইকে দাওয়াত দেই। জামাই সহ। তখন তো আসবে।
– অকেশন কী?
– অর্ষার জন্মদিন?
– অর্ষার জন্মদিন তিন মাস আগে গেল।
– তো, রাহু, অংশু বা অবনী। অবনীও তো বোন তাই না। চাচা তো কোনোদিনও ওর জন্মদিন পালন করে না।
– তাও ঠিক। ওর তো সামনেই জন্মদিন।
– ওর নাকি বড় জন্মদিনের শখ। আমাদের এখানে করি?
– অরনীর ও অবনীকে খুব পছন্দ করে। ও না করবে না। আসতেই হবে। এক কাজ করো, তোমার চাচা শ্বশুর কে ফোন দিয়ে বলো আমরা অবনীর জন্মদিন করছি।
– আচ্ছা মা, আমার চাচি মানে, ফুফুদের ও বলব?
– উমমম, বলো। সবাই যখন আসবে, ওরা না আসলে জামাইয়ের সামনে খারাপ দেখায়।
– ওদের বাসার সবাইকে বলব?
– হ্যাঁ বলো। মিঠাই , মিঠাইয়ের বর ও দেশে।
– মা, মিশান ও দেশে এসেছে। মিশান কেও কী?
অরনীর মা থেমে গেল। এরপর মিষ্টির দিকে তাকালো। মিষ্টি হালকা ভয়ে ভয়ে আছে। যদিও ওর শাশুড়ি কিছুই বলে না ওকে।
– মিশান কী এ বাড়ির ছেলে না?
– ছেলে তো। কিন্তু আজ এত বছর ও এখানে নিষিদ্ধ। মানে আমার বিয়েতে ও এলো না। ছোট ভাইটা আমার।
– ও কী শুধু তোমার ভাই? অংশু অরনীর না? ও যা করেছে ওর ভুল ছিল। এতে অরনীর ও দোষ নেই। ও যা করেছে ওর উচিত ছিল।
– সবাই আসবে, মিশান কী একা বাড়িতে বসে থাকবে। কতদিন দেখি না।
– অংশু রাগ করলে? অরনী ও তো আসবে। এটা কী ঠিক হবে?
– আর কত বছর মা? অরনী ও ভুলে গেছে এতদিনে। জাহিদের সাথে কত সুখে আছে। ছবি দেখলেন তো। মিশান ও মুভ অন করেছে হয়তো। আর বাবারা ভাইবোন ঠিকঠাক, শুধু মিশান বাদ। এতদিনে তো পাথর হৃদয় ও গলে যায়।
– ওকে। মিশান কে ও ডাকো। তবে আগে অংশুর অনুমতি নেবে। আর ওসব কথা উঠবে না। অরনীর বিয়ে হয়ে গেছে।
– আমি কথা দিচ্ছি। আচ্ছা মা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
– করো।
– আমাকে কেন এ বাড়ির বউ করলেন?
– কেন করব না? তুমি অংশুর পছন্দ, এত ইনোসেন্ট একটা মেয়ে। না করার কারণ কী?
– আমি যদি আপনার ননদের ভাসুরের মেয়ে না হতাম তো?
– কিছুই হতো না। আর সেটা একদমই কারণ ছিল না। তুমি যেখানেই থাকতে, অংশুর সাথে তোমার বাঁধা। আল্লাহ্ জোড়ায় জোড়ায় বানায়। তোমার বিয়ে অংশুর সাথেই হতো। অরনীর সাথে জাহিদের ই হতো। এখন বাদ দাও। বাড়ির বড় বউ তুমি। একটা অনুষ্ঠান হবে, অনেক কাজ তোমার।
মিষ্টি কাজে লেগে পড়ে। মিষ্টি বিয়ের আগেই এই বাড়িতে এসেছিল। তবে অতিথি হয়ে। তখন ও রাহু অরনীর মিষ্টি ভাবি ছিল না। মিষ্টি আপু ছিল। এই বাড়ি তখন অনেক হাসিখুশি ছিল। তিনটে একই বয়সের ছেলেমেয়ে সারাদিন দৌঁড়াদৌঁড়ি করতো। রাহু, অরনী, প্রিয়ম। মাঝে মাঝে শুক্রবার গুলো তে মিঠাই, মিশান আর মিষ্টি ও আসত। মিশান আর মিঠাই মিষ্টির চাচাতো ভাইবোন তবে অংশুর ফুফাতো ভাইবোন। অর্থাৎ মিষ্টির চাচা আর অংশুদের ফুফু স্বামী স্ত্রী। তবে ছোটবেলায় ওদের এত দেখা হয়নি। মিষ্টির ভার্সিটিতে পড়তে এসেই দেখা হয়েছিল। মিষ্টির বাবা নেই। গ্রামে বিধবা মায়ের কাছে মানুষ। অংশুর ওকে পছন্দ হবে কে জানতো? তবে মিষ্টির সরলতা আর উদ্ভট কর্মকাণ্ড অংশুর মন গলিয়ে দেয়। অংশু যখন রাজি ওর মা ও রাজি।
সেরকমই একদিন অরনীদের বাসায় মিশান, মিঠাই, মিষ্টি আর প্রিয়ম ও ছিল। প্রিয়ম দেখে মিশান আর মিষ্টি হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মিশান বলছে, “ভালোবাসি, ভালোবাসি তো! বলতে ভয় পাই।” প্রিয়ম এই দৃশ্য দেখে পা টিপে টিপে সেখান থেকে চলে আসে। এই ব্রেকিং নিউজ তো অরনীকে দিতেই হবে।
(চলবে)