#রিস্টার্ট,পার্ট_২৯
#পিকলি_পিকু
ম্যাগনেফিসেন্টে আসার পর নাদিয়া খুব একটা ভালো ক্লাস পায়নি। বাচ্চাদের ক্লাস সব। ফাইভ পর্যন্ত একদম পেছনের সাইডে। ওদের প্লে গ্রাউন্ড সব সাজানো ওদের বয়স অনুযায়ী। সিক্স সেভেন এইট আলাদা একটা ভবন। আবার ও লেভেল এ লেভেল আলাদা একটা জগত। ওদের সুইমিং পুল, বাস্কেটবল গ্রাউন্ড, জিম, মিউজিক ক্লাস, আর্ট স্টুডিও, অডিটোরিয়াম সবই আছে একটা কমপ্লেক্সে। সবচেয়ে সুন্দর লাইব্রেরি। সেটা একটা আলাদা ভবন। একটা বাড়ির মতো। ওকে বড়দের ভবনের কাছে যেতে হবে। নাদিয়া সেখানে গিয়ে ঘুরে দেখছিল। ওর ইউনিভার্সিটিতে আনুষাঙ্গিক সব থাকলেও সুইমিং পুল ছিল না। কিন্তু এটা তো ম্যাগনেফিসেন্ট। তাই হয়তো এখানে সব ভিআইপিদের বাচ্চারা পড়ে। এজন্যই প্রিয়ম অনেক এক্সাইটেড ছিল। ওর মনে হচ্ছে এখানে প্রিয়মের ছোঁয়া লেগে আছে। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা ছেলেকে দৌঁড়ে যেতে দেখল। এরপর ঝড়ের গতিতে আরো কয়েকজন ওর পেছনে। নাদিয়া ও ওদের পেছনে গেলো। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে ঐ ছেলেটা কে দুজন ধরে রেখেছে। আরেকজন ইচ্ছে মতো থা*প্পড় দিচ্ছে। বাকি কয়েকজন দাঁড়িয়ে হাসছে। এরপর আরেকজন আসলো সে ও থা*প্পড় দিচ্ছে। থা*প্পড় খেয়ে ছেলেটা কাঁদতে লাগলো। এসব কী! একটু পর নাদিয়া বুঝতে পারল এরা সবাই প্রতিযোগিতা করছে কে কত জোরে থা*প্পড় মারতে পারে। একজন সবাইকে আবার নাম্বার ও দিচ্ছে সে অনুযায়ী। কী অসুস্থ মানসিকতা! নাদিয়ার রক্ত গরম হয়ে গেল। ও গিয়ে বলল, ” এখানে কী হচ্ছে!” ছেলে গুলো ঐ ছেলেটাকে ছেড়ে দিলো। থা*প্পড় খাওয়া ছেলেটা দৌঁড়ে পালিয়ে গেল।
” তোমাদের আইডি দাও। প্রিন্সিপাল কে বলব।”
সবাই হাসতে লাগলো। ” আপনার আইডি কী মিস? নিশ্চয়ই নতুন। জানেন না এসব বিষয়ে। ”
নাদিয়া তাকালো ছেলেটার দিকে। এটা সবাইকে নাম্বার দেওয়া সেই ছেলেটা। এরপর নাদিয়া রেগে ওদের সবার আইডি খুলে নিয়ে নিলো। তারপর প্রিন্সিপালের অফিসে গিয়ে জমা দিল।
– ওরা সবাই একটা ছেলেকে থা*প্পড় মারছিলো। প্রতিযোগিতার মতো।
– কারা? এরা? মিস নাদিয়া, ফেরত দিয়ে আসুন।
– কী!
– ইয়েস। ইউ আর নিউ হিয়ার। আগেই বলা উচিত ছিল। ওরা হচ্ছে ট্রাস্টির ছেলে। এদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ট্রাস্টি ফয়সাল খানের ছেলে ফারাজ খান আছে। আমি ভুলেও কিছু করতে পারব না।
– একটা ছেলেকে এভাবে মারছে! আর আমরা কিছুই করবো না?
– আপনি ওখানে কী করছিলেন? আপনাকে তো সিক্স সেভেনের ক্লাস দেওয়া হয়েছে।
– আমি ফ্রি টাইমে ঘুরে দেখছিলাম।
– আপনাকে যে কাজ দেওয়া হয়েছে আপনার সেটাই করা উচিত।
– ইক্জেক্টলি।
– কী বলতে চান?
– মাই জব ইজ টু টিচ দেম অ্যান্ড আ’ম টিচিং দেম টু বিহেভ!
– আপনার ক্লাস না থাকলে আপনি বড়জোর লাইব্রেরি যেতে পারেন। ও লেভেল আর এ লেভেলের ক্লাসের ধারে কাছে যাবেন না।
– আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে এটা লেখা নেই কোন কোন ক্লাস।
– আপনারা নতুন টিচাররা কী ভাবেন নিজেদের? এখুনি এই আই ডি গুলো ফেরত দিয়ে আসুন।
অফিসে আরেকজন ঢুকল।
– স্যার আমি এই কয়েকটা আই ডি জব্দ করেছি। ওরা একটা ছেলের মুখে জোর করে এক বোতল পানি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ছেলেটার দম বন্ধ
– চুপ করুন! কী শুরু করলেন! যার যার আইডি ফেরত দিয়ে আসুন!!!
– কিন্তু স্যার!
– গেট আউট!!!
নাদিয়া আর ছেলেটা বের হয়ে আসলো। দুজনেই আস্তে আস্তে হাঁটছে,
– আপনার নাম?
– নাদিয়া সামাদ।
– সালমান ওয়াসি। কোন ডিপার্টমেন্ট?
– ইংলিশ।
– আমি আর্ট।
– আপনিও কী ও লেভেল ধরেছেন?
– এ লেভেল।
– আমিও। বলতে চাইছিলাম ঐ দিকের ছেলে কি না।
– এখন কী আপনি গিয়ে ওদের ফেরত দেবেন?
– কী আর করবো?
– একটা ডিল আছে। আমি গিয়ে আপনার আই ডি দিয়ে আসি আর আপনি আমার,
– ওকে। ডিল ডান।
– বাই দ্য ওয়ে আপনি যাদের ধরলেন ওরা কী করছিল?
– একটা ছেলেকে থা*প্পড় মারার প্রতিযোগিতা করছিল।
– স্ল্যাপ প্র্যাকটিসিং। (ফিসফিসিয়ে)
– কী?
– না , কিছু না। আপনি তো নতুন?
– জ্বী।
– কোথায় পড়াতেন?
– সানশাইন।
– ওহ!
– আপনি?
– আমি টুইংকেল স্টার। আপনি কোন ইউনিভার্সিটি?
– নর্থ সাউথ আর ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টো। আপনি?
– প্যারিস কলেজ অব আর্ট।
নাদিয়া অবাক হয়ে তাকালো। ওয়াসি মুচকি হেসে বলল,
– প্যারিস থেকে পড়ে এখানে কেন? পরে বলব।
– জাজ করছি না, অন্য যেকোনো ভার্সিটিতেই তো পড়াতে পারতেন।
– পারতাম। ফ্রিডম পেতাম না।
– এখানে তো কত ফ্রিডম, তাই না?
– তাও। আমার বাচ্চাদের ভালো লাগে। আর্ট ভালো লাগে।
– সিক্স সেভেন পড়াচ্ছেন?
– আপাতত।
– প্যারিস থেকে আসা টিচার সিক্স সেভেনের আর্ট পড়াচ্ছেন!
– হ্যাঁ। কারণ ওদের আরো সিনিয়র টিচার আছে। আমি নতুন তাই সময় লাগবে।
ওরা এরপর আইডি ফেরত দিয়ে স্কুল থেকে বের হলো। বাইরে ওয়াসি ওর গাড়িতে,
– মাদাম, লিফ্ট লাগবে?
– নো ম্যাখসি। (না, ধন্যবাদ)
– দ্যাকোহ্! (ঠিক আছে)
ওয়াসি হাসতে লাগলো। ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলছিল ওরা। নাদিয়া তবে ফ্রেঞ্চ ও জানে! ও আবার ডাকলো,
– একটু লিফ্ট দিলে কী হবে? আপনার গাড়ি ভাড়া বাঁচলো আরকি।
– জনাব, আমি বিবাহিত। ট্রাই মারা বন্ধ করুন। আর এসব ফ্রেঞ্চ বললেও আমি পটতাম না।
– ওহ নো! এক্সপোজ হয়ে গেলাম। বাই দ্য ওয়ে, ফ্রেঞ্চ কী করে জানেন?
– খুবই সামান্য। হাই হ্যালো পর্যন্ত। এটাকে জানা বলে না।
– আমি যথেষ্ট জানি। আসুন না একটু বিচিং করতে করতে যাই। আজকে আমার মেজাজ টা খারাপ।
নাদিয়া ওর গাড়িতে উঠলো। এরপর ওয়াসি ওকে নামিয়ে দিলো। অনেক কথা বললো ওরা ম্যাগনেফিসেন্ট নিয়ে। এখানে এই হয় সেই হয়। অনেক রহস্যময় অনেক কিছু। দুজনেই ভাবছে ও ম্যাগনেফিসেন্টের ব্যাপারে এত কিছু কী করে জানে? একটু পর নাদিয়া ওয়াসির থেকে পারমিশন নিয়ে রেডিও চালালো। কারণ ওর প্রিয় শো শুরু হয়ে গেছে। আরজে ঐশী কথা বলছে।
” আজকে এস এম এস পড়ছিলাম। সবার আগেই একজনের এস এম এস আমার চোখে পড়লো। তার নামটা পড়তে বারণ করলো। তার স্ত্রী নাকি আমার অনেক বড় ফ্যান। কাল তাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী। আমার প্লে করা গানের জন্য নাকি তাদের অনেকবার ঝগড়া হয়ে গেছে, আবার মিল ও হয়ে গেছে। আজকে যাতে আমি আমার পছন্দের একটা গান প্লে করি তাদের জন্য। সে দেখতে চায় তার স্ত্রী ধরতে পারে কি না। সবার প্রথমে শুনুন স্ত্রী, আমার প্লে করা গানের জন্য শুধু শুধু ঝগড়া করবেন কেন? আমি কী মুড খারাপ করা গান বাজাই নাকি! আমি তো হ্যাপি মুডের গান বাজাই।”
ওয়াসি বোধহয় বিরক্ত হচ্ছে। বিড়বিড় করে বলল,
– আর হ্যাপি মুড।
– কী?
– আপনি বললে রেডিও চেঞ্জ করতে পারি।
– না থাক। এটাই শুনি।
– আপনার মনে হয়ে কেউ আসলেই মেসেজ করে? আমার তো মনে হয় বানিয়ে বানিয়ে বলে।
– অবশ্যই করে। আপনি কয়টা শো শুনেছেন?
– শুনেছি। কম না। এটাও সত্যি মুডের বারোটা বাজায়।
– তাই তো মেসেজ দিলো।
– হতে পারে না ও হতে পারে।
– চুপ করুন। এখন কী গান বাজাবে তা দেখি।
” কে প্রথম কাছে এসেছি
কে প্রথম চেয়ে দেখেছি,
কিছুতেই পাই না ভেবে
কে প্রথম ভালবেসেছি,
তুমি না আমি ? ”
নাদিয়া নিজের অজান্তেই বলে উঠল, “আমি!” এর পর নিজে নিজেই হাসতে লাগলো। ওয়াসি অবাক হলো। কী হলো? জাহিদ অফিসে ইয়ারফোনে শুনছে। নাদিয়া মেসেজ করেছে, ” অবশ্যই আমি।” জাহিদ মুচকি হেসে বলল, ” না, আমি। আর আপনি তা জানেন না। ”
নাদিয়া নেমে যাওয়ার পর ওয়াসি রেডিওটা অফ করে দিলো, ” যত্তসব আরজে ঐশীর ফ্যানগার্ল! এভাবে এক্সের ভয়েস শুনতে কার ভালো লাগে? তবুও ওনাকে কাজের মনে হচ্ছে।”
ফুল নিয়ে বাড়ি ফিরেছে জাহিদ। নাদিয়া দরজা খুলে এসে টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। মুখে রুমাল চাপা দেওয়া নতুন জামাইয়ের মতো হাত দিয়ে মুচকি হেসে ঘরে ঢুকল জাহিদ। নাদিয়ার কাছে এসে ফুল হাতে দিয়ে ভেতরে যাওয়ার সময় নাদিয়া জাহিদের টাই টেনে ধরে। জাহিদ ওর সামনে দাঁড়িয়ে,
– কী চাই?
– তোমাকে। না না, উত্তর।
– কীসের?
– আজকে রেডিও তে কী?
জাহিদ লজ্জা পেয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। তারপর নাদিয়ার কাঁধে চিবুক রাখে। নাদিয়া মুচকি হাসি নিয়ে বলল,
– ওর শো শুনে আমরা ঝগড়া করি?
– সেদিন করলেন না? ঐ যে কী কী পেলেন।
– ওটা তোমার দোষ। কিচেন কাউন্টারে মানুষ এসব রাখে? আজগুবি জিনিস যত্তসব! বাই দ্য ওয়ে, আজকে দেওয়া যাবে?
– কী?
– তোমাকে।
জাহিদ খিলখিল করে হাসতে থাকে। নাদিয়া জাহিদকে একদম ওর সামনে এনে মাথা উঁচু করে তাকায়। জাহিদ হাসি থামিয়ে বলে,
– আপনিও না।
– সেদিন না তুমি বললে তুমি বলতে। আবার আপনি তে ফেরত?
– একটু একটু অভ্যাস থাকবে। আচ্ছা, কাল কী কী করবো?
– ঘুরব।
– অফিস থাকবে।
– ছুটি। হাফ করবে।
কলিং বেল বাজতে লাগলো। নাদিয়া জাহিদকে ভেতরে যেতে বলে। দরজা খুলে দেখে রাহু, মিষ্টি আর মা এসেছে অনেক জিনিস পত্র নিয়ে।
– কালকে তো ম্যারেজ অ্যানিভার্সারী। কেমনে কেমনে একবছর পার করে ফেললে অরনী! আমার বিশ্বাস হয় না!
– ধন্যবাদ ভাবি!
– আমরা আজকে কেন এসেছি জানো?
– কেন?
– কালকে দাওয়াত দিতে।
– আসব না।
– আগেই রিজেক্ট?
– কালকে আমরা ব্যস্ত।
– কেন? কী করবে?
নাদিয়ার মেজাজ এখন আসমানে। কী করবে মানে? বিবাহবার্ষিকীতে মানুষ কী করে? দাওয়াত খায়? তাও আবার বাবার বাড়িতে? একবছর আগেই তো খেয়ে এসেছে। সেই খুশিতে প্রতি বছর খায়? জাহিদ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে ওর ড্রয়িং রুম পুরোটা অনেক রকমের জিনিস দিয়ে ভর্তি। শ্বশুরবাড়ির লোকের হানা। নাদিয়া ওর দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা বলতে চাইছে। কী বলতে চাইছে? নাদিয়া ভয়ে আছে জাহিদ হ্যাঁ বলে দিবে। ও কাল বাবার বাসায় দাওয়াত খেতে চায় না। ও জাহিদের সাথে ঘুরতে চায়। মুভি দেখতে চায়।
– জাহিদ, আমরা ঠিক করেছি কাল তোমরা আমাদের বাসায় আসবে।
– কেন?
– তোমাদের বিবাহ বার্ষিকী! ভুলে গেছ?
– ওহ!
– কাল আসো তোমরা।
জাহিদ এখন বুঝতে পারলো নাদিয়া কেন ওভাবে তাকিয়ে ছিল।
– কাল কাজ আছে।
– কালকে ও তোমার কাজ আছে?
নাদিয়ার যে কী আনন্দ লাগছে ও বলে বোঝাতে পারবে না। স্বামী তার এত দিনে না বলতে শিখেছে।
– জ্বী মা। আমার ও স্কুলে ক্লাস আছে।
– তুই জয়েন করেছিস কোথায়?
– হুম।
– কোথায়?
– আর কী আসে যায়। এখন কী আর ফোন করে ছুটি নেওয়ার সময় আছে? বাদ দাও।
– বেশি কিছু না। রাতে খেতে আসো।
– আমরা ঠিক করেছি অন্য একদিন আসবো। যখন ফ্রী হবো।
রাহু বুঝতে পেরেছে। বোন তার স্বামীর সাথে একাকী সময় কাটাতে চায়। ও বুঝতে পারছে না সবসময়ইতো একসাথে থাকে। তবে আবার ঐদিন স্পেশাল কী? সন্ধ্যা হতেই জাহিদের ভাই ফুফু ওকে ফোন করে মনে করিয়ে দিতে লাগলো কাল ওর বিবাহ বার্ষিকী। কারণ সবাই জানে ও ভুলে যেতে পারে। অবিশ্বাস্য ভাবে রাত নয়টার সময় পিপির থেকেও শুভেচ্ছা কার্ড আসে। বিয়ে করেছে ওরা, আর মনে পড়ছে বাকিদের। আফরা ওর স্বামী কে নিয়ে কেক দিয়ে গেল। সবার ধারণা এটাই ওরা ওদের বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করবে না। ভুলেও বসতে পারে। তাই সব আগের দিনই হচ্ছে। যাতে ওদের মনে থাকে পরের দিন শুধু ওদের।
– কালকে আমরা কোথায় যাবো?
– ক্লাস বাঙ্ক করবো।
– মানে?
– মানে আমার খুব ইচ্ছা ছিল, আমি ক্লাস বাঙ্ক দিয়ে প্রেম করবো। শাখাওয়াত বলতো করতে। কিন্তু আমার তখন অনেক ইম্পরটেন্ট ক্লাস ছিল। আর শাখাওয়াত তো ক্লাসে আইডি পাঞ্চ করেই উধাও হতো।
– তো?
– কাল আমরা ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টের মতো ক্লাস বাঙ্ক দেব।
– ক্লাস কোথায়?
– এই যে বাহানা মারলাম মা কে। তুমি অফিসে বাহানা দাও। এখন কাল তুমি এই ব্লু হুডি টা পড়বে।
– এরপর?
– আমিও স্টুডেন্টের মতোই অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।
– কোথায়?
– যমুনা ফিউচার পার্কে। আমার ভার্সিটির টাইমে সবাই ওখানে ডেটে যেত। অনেক মজা হয়।
– কোথায় থাকবে?
– ফোন করে বলবো।
জাহিদের মন খারাপ। মানুষ এভাবে এক্সের কথা বলে নাকি। ওর এক্স বোধহয় অনেক ওয়াও ছিল। ওর মতো বোরিং ছিল না। যাইহোক, দিন শেষে নাদিয়া তো ওরই বউ। তাই ওর ভেবেই আনন্দ লাগছে। নাদিয়ার ক্লাস শেষে ও যমুনা ফিউচার পার্কের ভেতরে অপেক্ষা করছে জাহিদের। বেচারা অফিসে গিয়েছে। কাজ বুঝিয়ে আবার বাসায় গিয়ে পোষাক বদলে আসলো। যমুনা যেন এক ভুলভুলাইয়া, গোলকধাঁধা। ভেতরে ঢুকে একজন একজনকে খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু কোথায় কোথায় জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে। ভেতরে ঢোকাই উচিত হয়নি। জাহিদ বিচলিত হয়ে যাচ্ছে।
– আমি মিনিসোর সামনে।
– কোন মিনিসো? জাপানি লেখা না কোরিয়ান?
– ওটা কী করে বুঝব?
– আমি জাপানি মিনিসোর সামনে।
– আমি বোধহয় কোরিয়ান।
এভাবে ওরা আবার খুঁজে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত নাদিয়া এখন ওকে বাইরে আসতে বলে। বেচারা এখন বের হওয়ার রাস্তা পাচ্ছে না। মিনিসোর পাশেই নাকি বের হওয়ার রাস্তা। কোন মিনিসো? জাপানি না কোরিয়ান? কাউকে লজ্জায় বলতেও পারছে না। অনেক কষ্টে বের হয়ে নাদিয়াকে ফোন করলো। নাদিয়া পেছন থেকে দৌঁড়ে এসে ওকে জোরে জড়িয়ে ধরল। নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে ও অবাক। একই রকম হুডি পড়েছে ওরা।
– তোমাকে খুঁজে না পেয়ে ভয় পেয়েছিলাম।
– আমি ইচ্ছে করেই ভেতরে যেতে বলেছি।
– কেন?
– জানো না, এই মলটা একটা গোলকধাঁধা। এখানে ঢুকলে আর বের হওয়া যায়না। সব একই। আর সবাই কী মিনিসোর সামনে। এখানে অনেক গুলো মিনিসো। অনেকটা ঐ সাদা কুকুরের সামনের গলির মতো ডিরেকশন। হাহাহাহ!
– টাইম নষ্ট করলে কেন? (অভিমানী সুরে।)
– দেখতে গেলে আমাদের ও দেখা দেরিতেই হয়েছে। এখন আসো। আর সময় নষ্ট করবো না।
– এটা কী?
জাহিদ কে নিয়ে নাদিয়া টাওয়ার চ্যালেঞ্জ রাইডে উঠলো। দোলনার মতো। দুজন বসে আছে। দোলনার ঘুরতে লাগলো। জাহিদ নাদিয়ার হাত চেপে ধরে আছে। দোলনার এবার জোরে দ্রুত গতিতে ঘুরছে। বেচারা ভয়ে, “আম্মা!!!! আম্মা!!!! ” করছে। নাদিয়ার তো হেব্বি মজা লাগছে। ওর চিৎকারটা উপভোগ করার চিৎকার। সেখান থেকে নামার পর ওকে নিয়ে গেল রোলার কোস্টার। বেচারা এবার কেঁদেই দেবে। রোলার কোস্টারেও জাহিদ সবচেয়ে বেশি চিৎকার করেছে। নাদিয়া হেসেই যাচ্ছে।
– আর একটা জাস্ট।
– আর না।
– প্লিজ! আর একটা।
– আমাকে ছেড়ে দিন। আমাকে মাফ করে দিন।
– এত কষ্ট দিয়েছ আমি কী ছেড়ে চলে গেছি? আর কী আপনি আপনি করছো আবার।
– আমাকে শাস্তি দিচ্ছ?
– আমরা ডেটে এসেছি জাহিদ! শাস্তি না।
– আই থট ডেট ওয়াজ সাপোজ টু বি রোমান্টিক!
– এটাও রোমান্টিক। ইটস লাইক আওয়ার ম্যারেজ। ঐ যে ওটা লাস্ট।
এবারের টা তে ওপরে উঠিয়ে ধরে কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিচ্ছে। জাহিদ এবার সত্যি সত্যি কেঁদে দিলো। নাদিয়া ওকে পানি এনে দেওয়ার পর তা নিজের মাথায় ঢেলে দিলো।
– এইটা লাস্ট!
– আর না! আমি মরে যাব। ছেড়ে দে মা! কেঁদে বাঁচি!
– আমি মজা করছিলাম।
– আর মজা না। বাসায় যাবো।
– শেষ হয়নি।
– আর কী?
– ভেতরে যাব। ঐ রোমান্টিক জিনিস হবে।
ভেতরে যাওয়ার পর নাদিয়া জাহিদের হাত জড়িয়ে বলে,
– শেষের টা না একদম আমার জীবনের মতো।
– মানে?
– শেষ রাইডটা। যখন আমার সাথে সব ভালো হয়, আমি অনেক উপরে উঠে যায়। হাওয়ায় ভাসতে থাকি। অমনি আমাকে কেউ টেনে ধপাস করে নীচে ফেলে দেয়।
– কে?
– কোনো মানুষ না। এমনি। খারাপ কিছু হয়েই যায়।
জাহিদ ও ভাবতে থাকে। একই জিনিস ওর সাথে ও হয়। ও যখন সুখ খুঁজে পায়, ওকে কেউ টেনে ধরে। এবার ওরা ফিউচার ওয়ার্ল্ডে গেল। সেখানে কার রাইডে উঠলো। নাদিয়া কে আজ যোগ্য শিক্ষা দেবে। ওর গাড়িকে ইচ্ছা মতো ধাক্কা মারবে। কিন্তু ও জানে না ও কী বিয়ে করেছে। হেরে আবার শিক্ষা হলো। ওর আর মান সম্মান নেই। এবার ডান্স ডান্স রিভোলুশন ভিডিও গেমে নাচের পরীক্ষা। ছিপছিপে পাতলা গড়নের হওয়াতে নাদিয়া এটাতেও জিতলো। জাহিদ ওকে এবার অন্য ভিডিও গেম খেলতে নিলো। সেটাতেও হারলো। অন্য একটা গেমে অবশেষে নাদিয়া হারলো। জাহিদ সেই খুশি। অন্তত একটাতে জিতেছে। নাদিয়া ওর দিকে আফসোসের দৃষ্টিতে তাকালো। এসব নাদিয়া ওর রুমমেটদের সাথে অনেক খেলেছে। তাই ও পারে। বেচারা বোধহয় সময় পায়নি কখনো এ সব খেলে সময় নষ্ট করার। রোলিং বোল খেলতে নিয়ে যেত কিন্তু সময় নেই। মুভিও দেখতে হবে। পুরো ইউনিভার্সিটি লাইফের প্রেম ওরা একবারে করছে। মুভির থেকে বেশি বউয়ের দিকে খেয়াল। আচ্ছা, যদি প্রিয়ম ওদের পরিচয় করিয়ে দিত আর যদি সব স্বাভাবিক থাকতো তবে কী ওরা এভাবে ডেটে আসতো? তখন কী এভাবে সবকিছুতে হেরে গেলেও নাদিয়া ওকেই পছন্দ করতো? ভাবতে ভাবতেই ওর আবার ম্যাগনেফিসেন্টের কথা মনে পড়ে গেল। ভুলেই গিয়েছিল নাদিয়া ওখানে চাকরি করে। যদি সব জেনে যায়। নিজের মন কে ভুলাতে বেনজিরের ম্যাডামের কথামতো মনে মনে এক থেকে একশ গুনতে লাগলো। তাও ভয় লাগছে। বেনজির ম্যাডাম কী আরেকটা বলেছিল, সবচেয়ে কঠিন কোনো কবিতা পড়তে। কবিতা ওর মুখস্ত নেই। দোয়া পড়া যায়। ভুল হবে না ঠিক তা নিয়ে ভাবলেও মন অন্যদিকে চলে যায়। এই টেকনিক টা কাজে দিতে পারে। দোয়া বিড়বিড় করার সময় নাদিয়া ওর দিকে তাকালো।
– কিসিং সিনে কী বিড়বিড় করছ? দোয়া না সূরা?
– হ্যাঁ!
নাদিয়া হাসতে লাগলো। জাহিদ খেয়াল ই করেনি স্ক্রিনে কী চলছে। খুব রোমান্টিক সিন চলছে। নায়ক নায়িকা চুমু খাচ্ছে আর ও দোয়া পড়ছে। নাদিয়া ওকে নিয়ে কী ভাবছে? আজকে দিনে আর কত লজ্জা পাবে।
– কিসিং সিন দেখা পাপ? করা তো আরো পাপ হবে।
– হুহ?
– সিনেমা দেখাও পাপ। আর রোমান্টিক ডেট ও।
আজকে ওর ম্যারেজ ডে না, ইনসাল্ট ডে। কামব্যাক দরকার একটা।
– বউয়ের সাথে পাপ না। হালাল।
– বউয়ের সাথে দেখাও পাপ না। সাধু পুরুষ।
সিনেমা দেখা শেষে অনেক রাত হয়ে গেছে। বাড়ি ফেরার পালা। ওরা হাতে হাত ধরে বের হচ্ছে, ঠিক তখন নাদিয়ার হাতের সাথে অন্য একজন মহিলার স্কার্ফ আটকে গেল। নাদিয়া বুঝতে পেরে স্যরি বলল। সেই মহিলা ও হাসি মুখে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু তার পাশে থাকা ছেলেটি বলে উঠলো, ” আরে লুজার দি গ্রেট!”
জাহিদের চেহারা মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ওকে এই জঘন্য নামে এত বছর পর কে ডাকবে?
– কতদিন পর ভাই ডিয়ার লুজার! আই নেভার থট দ্যাট আই উইল মিট ইউ হিয়ার।
– আপনি মেইবি ভুল করছেন।
– নো। হি ইজ মাই লুজার।
নাদিয়া জাহিদকে নিয়ে চলে আসছিল। জাহিদ যেন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এত বছর পর নিজের অ্যাবিউসার, প্রিয়মের রে*পিস্টের একজন কে সামনে দেখে। নাদিয়া বুঝতে পারলো কিছু সমস্যা আছে।
– জাহিদ, চলো।
– জাহিদ! তোর নাম জাহিদ? ভালো নাম হয়তো।
– আপনি কে?
– আমি শাহনাওয়াজ খান সানি। কীরে আমাকে চিনতে পারছিস না?
– আমার মনে হয় ও সে না যা আপনি ভাবছেন।
– আরে বল না লুজার!
জাহিদ চোখ নামিয়ে আস্তে আস্তে বলল,
– অঅঅ অনেকদিন পর সসসসানি। কেমন আছ?
– ভালো। তুই কেমন?
– ভভভভালো।
– সঙ্গে বউ?
– হুম।
– বিয়ে করেছিস! আমাদের লুজার বিয়ে করেছে? কবে করলি?
– এক বছর হলো।
– এক বছর তোর বউ টিকেছে! কিছু মনে করবেন না ভাবি, ওকে আমরা ভাবতাম গে হবে বোধহয়। মেয়েদের ধারে কাছে যায় না। সারা পর্যন্ত পারেনি ওর ভেতরে পুরুষত্ব জাগাতে। ভেবেছিলাম হি ইজ নট আ মেন ফ্রম ইনসাইড। ইম্পোটেন্ট বোধহয়। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ওর ভেতরের পুরুষত্ব জেগে উঠেছে। কিছু মনে করবেন না। আমরা অনেক ক্লোস ফ্রেন্ড।
জাহিদ পুরো টা সময় চোখ নামিয়ে ছিল। এটা ওর পুরনো অভ্যাস, ওদের সামনে চোখ নামিয়ে কথা বলা। এত বছর পর ও আবার পুরনো শুদ্ধতে ফিরে গেল। সানির এত বাজে কথা শুনে নাদিয়ার মনে হলো ওর টুঁটি চেপে ধরে আছাড় মারতে। যত কাছের বন্ধুই হোক, স্ত্রীর সামনে, বাইরের একজন মানুষের সামনে কেউ কী করে এত বাজে ভাষা ব্যবহার করতে পারে। জাহিদের দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে এ কোনো বন্ধু নয়, এই হচ্ছে ওর অ্যাবিউসার। নাদিয়ার খুব রাগ হচ্ছিল। এর পরিচয় ওর জানতেই হবে। একে শিক্ষা দিতেই হবে। এর দৃষ্টি নাদিয়ার দিকে একদম ভালো না,
– তো সানি ভাই, আপনি কী করেন?
– বিজনেস। আপনি?
– আ’ম আ টিচার।
– দেখলে মনে হয় না টিচার।
– তাই? টিচারদের কেমন দেখতে লাগে?
– অ্যানয়িং। বাট ইউ আর প্লিজিং।
সানি নাদিয়া কে একবার উপর থেকে নিচে স্ক্যান করে দেখছে। নাদিয়ার খুব অস্বস্তি লাগছে, কিন্তু ও বুঝতে দিচ্ছে না।
– আসুন না একবার, একে নিয়ে। না আনলেও হবে। লুজার অনেক বোরিং মানুষ।
নাদিয়া কিছু বলল না। তবে সব ওকে সুদে আসলে ফেরত দেবে। সানি ওর কার্ড বের করে দিল নাদিয়া কে। কার্ড টা নেওয়ার সময় ওর হাতে ছোঁয়া লাগলো। খুবই জঘন্য সেই অনুভূতি। নাদিয়া অনেক কষ্টে জাহিদ কে সেখান থেকে নিয়ে আসলো। গাড়ি চালানোর সময় ও কোনো কথা বললনা। কী ভয় ওর চোখে যে এখনো চোখ মেলাচ্ছে না। বিছানায় বসে আছে জাহিদ। নাদিয়া ওর সামনে এসে বসলো। নিজের হাত দিয়ে ওর চেহারা স্পর্শ করে বলল, ” তাকাও।” জাহিদ ওর দিকে তাকাতেই বলল, ” আর কখনো দৃষ্টি নামাবে না। নিজের শিড়, আর দৃষ্টি সব সময় উঁচু করে রাখবে। ” জাহিদ আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে। “তুমি সবসময় পারফেক্ট। কে কী বলল তাতে কিছুই আসে যায় না। তুমি আমার জাহিদ, আমার জাদুকর।”
(চলবে)