#রিস্টার্ট,পার্ট_৪০
#পিকলি_পিকু
হাতে সেই ইনভিটেশন লেটার নিয়ে অনেকক্ষণ বসে ছিল নাদিয়া। জাহিদ তো প্রিয়মের সহপাঠী এটা তো ও জানে। এখন কী ও যেতে চাইবে কি না সেটাই বিষয়। এই রিইউনিয়ন পার্টির ভেন্যু থিম সব বলা আছে। শুধু ওয়েবসাইটে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। নাদিয়া ভাবছে জাহিদ কখনো ওর বুলিদের সাথে রিইউনিয়ন পার্টিতে যাবে না। এই পার্টি ওর জন্য শুধুই যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়াবে। তবুও নাদিয়ার সত্যিটা জানা দরকার। শেষ পর্যন্ত নাদিয়া চিঠিটা নিজের কাছে রেখে দিল।
জাহিদের চেহারায় একই সাথে একটা নিষ্পাপ আর মিথ্যেবাদী ভাব লুকিয়ে আছে। ও কী সত্যিই কিছু জানে না? নাকি ও ভান করছে। নাদিয়া জাহিদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। জাহিদ বুঝতে পারে ও কিছু একটা ভাবছে, তাই ও অপ্রস্তুত হয়ে একটু হাসলো। ওর সেই অপ্রস্তুত হাসিটা নাদিয়ার কেমন মিথ্যে মনে হয়। সত্যিই কি ও চেনে না? জাহিদ উঠে রান্নাঘরের দিকে যায়। নাদিয়া ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
“তোমাকে বুঝিনা প্রিয়ো
বুঝো না তুমি আমায়
দুরত্ব বেড়ে যোগাযোগ নিভে যায়”
নাদিয়া জাহিদকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর পিঠে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। খুব হতাশ লাগছে ওর। জাহিদের প্রতি ভালোবাসাটা অনুভব করতে পারছে না। ওর দুশ্চিন্তা, ওর সন্দেহ যেন বারবার ওর ভালোবাসার সাথে জিতে যায়। নাদিয়া ওকে এভাবে কেন ধরে আছে তা ও জানেনা। তবুও জাহিদ শীতল হয়ে দাড়িয়ে আছে। নাদিয়া কে সময় দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর সে বলল,
– কী হয়েছে? সব ঠিক আছে?
– হুম।
– স্কুলে সব ঠিক আছে? কেউ কিছু করেছে?
– কিছু কী করার কথা?
– না, তবে এমন করছো কেন?
– আমাকে কাল স্কুল থেকে আনতে পারবে?
জাহিদ চুপ হয়ে গেল। হঠাৎ ম্যাগনেফিসেন্ট যেতে বলছে কেন? ঐ নকল ওয়াসি কি কিছু বলেছে? জাহিদ নাদিয়ার সামনে ফিরে বলল,
– ওয়াসি তোমাকে কিছু বলেছে?
– না।
– তো?
– একটি বার কী তোমাকে আমি আমার কর্মস্থলে ডাকতে পারি না?
– পারো, তবে হঠাৎ?
– প্রথম দিনের পর তো আর যাওনি?
– যাব। তুমি বললে যাবো।
জাহিদ কথাটা নাদিয়ার চোখে চোখ না রেখেই বলল। নাদিয়া বুঝতে পারছে ও চায় না। তবে জাহিদ বিষয়টা বদলাতে চায়,
– আচ্ছা, শোনো। আ’ম স্যরি।
– কেন?
– বেবির কথা বললাম যে। তোমাকে চাপ দেওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। তুমি যা চাও তাই হবে। যখন চাও তখনই। আর আমরা এডপ্ট ও করতে পারি। যা তোমার ইচ্ছা। কোনো চাপ নেই। আ’ম ওকে উইথ এভ্রিথিং।
নাদিয়া জাহিদের দিকে এক অনিশ্চয়তা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। ও মাঝে মাঝে এমন কেন করে?
– তুমি এই কথা কেন বলছো?
– তুমি যে কষ্ট পেয়েছিলে?
– তোমার কী আজ ও মনে হয় আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব?
জাহিদ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকে। উত্তর যেটাই দেবে কিছু একটা ভুল হবে। তাই ও আবার রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। নাদিয়ার মনে হচ্ছে ও গভীর কিছু লুকাচ্ছে, তা না হলে এত হারাবার ভয় কেন?
– তুমি কেন মনে করো আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব?
– জানিনা। তবে এটা জানি, তুমি বোধহয় হ্যাপি না। আর কারণ টা আমি।
– কেন?
– জানি না। তুমি অনেক স্ট্রেইটফরোয়ার্ড। চলেও যেতে পারো। সিদ্ধান্তটা তোমার পক্ষ থেকে খারাপ হবে না।
– কেন মনে হয় খারাপ হবে না?
– তুমি কখনো ভুল কাজ করো না। তোমার সিদ্ধান্ত গুলো সবসময় ঠিক হয়। চারপাশ ভাবো না। শুধু যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই। আমি পুরো বিশ্ব নিয়েই ভাবি। আল্টিমেটলি একটা সিদ্ধান্তে যেতে পারি না। বেশি ভাবলে কাজ হয়না।
– আমাকে এভাবে স্টাডি করেছ?
জাহিদ নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি। স্টাডি তো প্রিয়ম করেছিল। ও শুধু শুনেছে। পরবর্তীতে মানুষটাকে মিলিয়ে নিয়েছে।
– হাসছো কেন?
– এমনি। তবে তোমার সিদ্ধান্ত গুলো অন্তত তোমার জন্য খারাপ না। আমি যদি এভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম।
– অফিসে তো পারো।
– অফিস আর ব্যক্তিগত জীবন আলাদা। অফিসে আমার ভালোবাসা নেই, তাই ভয় ও নেই।
– তো তুমি বলছো, আমি তোমাকে ছেড়ে গেলে ভালোই হবে?
– তা না! সেই মুহূর্তের জন্য জিনিস টা ঠিক ছিল। সেটা বলছি।
– এই মুহূর্তে? এই মুহূর্তে আমি যা করবো তা কী হবে?
– তার দায় তোমার হবে। তবে ফলাফল কী হবে জানি না। তবে তুমি তা মেনে নিতে পারো। আমার মধ্যে সেই দায় নেওয়ার সাহস টা নেই।
জাহিদের সাথে কথা বলার পর সবসময় নাদিয়ার অন্যরকম এক অনুভূতি হয়। সত্যি ওকে জানার এখনো অনেক কিছুই বাকি আছে। সেসব না জেনেই ওকে সেই ভয়ানক মানুষগুলোর সামনে নিয়ে গেলে ওর অনেক ক্ষতি হতে পারে।
পরদিন রোহানকে নাদিয়া সব বলার পর,
– তো তুমি ভাবছো জাহিদ কে ইনভিটেশন দেবে না?
– না। কারণ ও এখানকার কিছুই সহ্য করতে পারে না।
– তোমাকে পারে? তুমিও তো এখানকার।
– পারে। আমি ওকে এখানকার কিছু বলি না। ওর খুব বাজে কিছু স্মৃতি আছে এসব নিয়ে। আমি ওকে ওসব মনে করাতে চাই না।
– তো প্রিয়ম কে ও চেনে না?
– না হয়তো। সবাই তো আর সবাইকে চেনে না।
– তোমার স্বামী আর প্রিয়ম কী স্কলারশিপ?
– হ্যাঁ, বোধহয়। হ্যাঁ!
– তারপর ও বলছো?
নাদিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
– আমি ওকে বারবার সন্দেহ করতে চাই না। জিনিসটা করে আমরা কেউই শান্তি পাই না।
– তো একবারে সব সন্দেহ শেষ করে দাও। তিলে তিলে কষ্ট পাওয়ার থেকে, সেটা ভালো না।
নাদিয়া স্কুল থেকে বের হতেই দেখে জাহিদ ওর জন্য দাঁড়িয়ে।
– তুমি?
– আসতে বললে তো।
– তাই আসতেই হবে?
– মানে? না আসলেও হতো?
নাদিয়া হেসে জাহিদের গাড়িতে উঠলো। ম্যাগনেফিসেন্ট ওর কখনোই ভালো লাগতো না। বিশেষ করে এই পার্কিং। সবসময় এখানে সব দামী গাড়ি থাকতো। ও পায়ে হেঁটে বাসে উঠতো। ওর ও স্বপ্ন ছিল গাড়ি কেনার। আজ গাড়ি আছে তবে অফিসের। যাই হোক, ম্যাগনেফিসেন্টের সামনে গাড়ি নিয়ে এসেছে তা ভাবতেই চোখে জল আসলো ওর। কারণ অনেক অপমান মনে পড়ে যাচ্ছে। শেষবার এখান থেকে যখন বের হচ্ছিল তখন প্রতিজ্ঞা করেছিল এখানে আর আসবে না। তবে এসেছিল, সারপ্রাইজ দিয়েছিল নাদিয়া। সেই প্যানিক অ্যাটাক ও এক ভয়াবহ স্মৃতি। পুরো ম্যাগনেফিসেন্টই একটা দুঃস্বপ্ন।
নাদিয়া জাহিদের চোখের কোণে সেই জলবিন্দু দেখলো,
– কী হয়েছে?
– কিছু না। বাসায় যাবে?
– আর কোথাও যাবে?
– একটু ঘুরে যাই।
– ওকে।
ওয়াসি গাড়িটা দেখে চিনতে পারলো। এই লোক এখন স্কুলে ও আসে, কিন্তু সত্যিটা বলতে পারে না। নাদিয়া সত্যিই বোকা মেয়ে। উল্টো ওকে ভুল বুঝে আছে। কিন্তু ওকে ভুল বোঝাচ্ছে কে? ওর স্বামী? বসের সাথে জরুরি ভিত্তিতে কথা বলা দরকার। নইলে এই বোকা মেয়ে ওর গেইম বাজিয়ে দেবে।
জাহিদ আর নাদিয়া পুরো সন্ধ্যা একসাথে ঘুরে বেড়ানোর পর শেষে আফরার প্রিয় আইসক্রিম কেক নিয়ে আফরার সাথে দেখা করতে গেল। প্রেগনেন্সিতে আফরার মিষ্টির খুব ক্রেভিং হচ্ছে তা নাদিয়া ঠিকই বুঝতে পারছে। আফরা তো খুশি তে আত্মহারা। নাদিয়া আর জাহিদ দুজনেই মিষ্টি খায় না ওরা জানে। কিন্তু সাব্বির তো খায়। ওদের সামনেই ওরা খাচ্ছে। কিন্তু সাব্বির খাওয়া বন্ধ করে দিলো,
– কী হলো? খাচ্ছ না কেন খাও? গলে যাবে।
– ফ্রিজে রেখে আসি?
– না। এখন খাও। অনেক বড় কেক। আমি এত বেশি খেলে যদি স্যুগার বেড়ে যায়।
– পরেও তো খেতে পার।
– তোমার কী সমস্যা? খাও!
– না পরে।
– তোমার কী, ডায়াবেটিস!
– না। নো ডায়াবেটিস!
– তো?
নাদিয়া আর জাহিদ ওদের দুজনকে পর্যবেক্ষণ করছে। জাহিদ যা ভাবছে তা যদি সত্যি হয় তো, আফরা কষ্ট পাবে। কিন্তু নাদিয়া,
– সাব্বির ভাই, আপনি মিষ্টি পছন্দ করেন না। তাই না?
– হ্যাঁ! না। মানে করি!
সাব্বির ইতস্তত করতে লাগলো। জাহিদ নাদিয়ার হাত চেপে ধরলো। এভাবে না বললেও তো পারতো।
– এই! না! ও করে তো। আমরা প্রেম ই শুরু করলাম কারণ আমাদের মিষ্টি পছন্দ। তাই না সাব্বির?
– হুম।
সাব্বিরের চেহারা অনুভূতি শূন্য। আফরার হাসিমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ওর আর বুঝতে বাকি রইলো না,
– সাব্বির!!! তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছ?
– না। ওভাবে না।
– চুপ করো! আমি এতদিন একটা মিথ্যেবাদীর সাথে সংসার করেছি!!!
আফরা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। প্রেগনেন্সির সময়টাই এমন। হঠাৎ হঠাৎ মুড সুইং। নইলে আফরা কতটা শান্ত মেয়ে সেটা সবাই জানে। তবুও ওর এই রূপ দেখে নাদিয়া আর জাহিদ অপ্রস্তুত হয়ে গেল। নাদিয়া এগিয়ে গিয়ে আফরা কে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলল,
– উনি হয়তো ওভাবে বলে নি।
– তো কীভাবে! রিলেশনশিপের শুরুটাই মিথ্যা দিয়ে।
– আশ্চর্য! কারণ আছে। লেট হিম এক্সপ্লেইন!
– কী বলবে? সবই মিথ্যা ছিল।
আফরার চোখের পানি মুছতে মুছতে সাব্বির বলল,
– আমি ইচ্ছে করে বলিনি। তোমার মিষ্টি পছন্দ। আমার একদম না। তোমার আমার কিছু কিছু জিনিস একদমই অমিল। তবে প্রথমে ব্যাপারটা আমি জানতাম না। আমার শুধু সন্দেশ পছন্দ। তাই তোমার সন্দেশের পোস্টে লাভ দিয়েছিলাম। আর এরপরইতো একটা টপিক পেলাম কথা বলার।
– কিন্তু সন্দেশের পর তো বলতে পারতে!
– কী করে বলতাম? তুমি মিষ্টির ব্যাপারে অনেক কিছু জানো। আমার তখন ভালো লাগছিল। আর লা মেরিডিয়ানের ডেজার্ট ফিয়েস্টাতে তোমার সাথে ডেটের অপর্চুনিটি আমি হারাতে চাইনি।
– এরপর ও তো বলতে পারতে।
– ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ভালো লাগছিল।
– মিষ্টি?
– না তুমি। মিষ্টি জিনিসটা একটু খেলেই বমি পায়। আ’ম স্যরি।
– সেজন্যই আদর করে পুরো সব ডেজার্ট আমাকে খাওয়াতে। তোমার পছন্দ না সেজন্য!!!
আফরার চেঁচানো দেখে জাহিদ আর নাদিয়া কানে হাত দিয়ে ফেলে। কিন্তু সাব্বির ওর চোখের দিকেই তাকিয়ে ছিল। এরপর আস্তে করে বলল,
– মিষ্টি খাওয়ার পর তোমার চেহারায় জাদুর সেই হাসিটা ভালো লাগতো।
– কিন্তু তোমার তো পছন্দ না মিষ্টি!
– তুমি তো পছন্দ। আর সেটা তো মিষ্টি, বিষ তো আর না। একটু না হয় খেলাম।
– সত্যি বললে কী হতো?
– কিছুই না। হয়তো কষ্ট পেতে। আরে এটা তেমন কিছু না। হরমোনের জন্য এখন একটু খারাপ লাগছে। আর তোমার খারাপ লাগলে এই তো খাচ্ছি।
আফরা সাব্বিরের কাছ থেকে প্লেট টা নিয়ে রেখে দিলো। নাদিয়া এবার আফরাকে বলল,
– ও যে মিথ্যা বলেছে তা খারাপ ছিল, মানছি। কিন্তু পরবর্তীতে যে সত্যি বলেনি তার পেছনে যে ভালোবাসা ছিল তা দেখবি না?
– জাহিদ ভাই তোকে মিথ্যা বললে দেখতাম তুই কী করতি!
– আফরা, ব্যাপারটা এত সিরিয়াস ও না।
– জাহিদ ভাই যদি তোকে সামান্য মিথ্যা ও বলতো তুই তখন বাড়ি ছেড়ে চলে যেতি। নিজে তো পান থেকে চুন খসলেই কুরুক্ষেত্র করিস। আর আমার তো আর যাওয়ার জায়গা নেই। আমি এখানেই এই মিথ্যুকটার সাথেই থাকবো।
নাদিয়া জাহিদের দিকে তাকায়। জাহিদ লজ্জায় মাথা নীচু করে রাখে। সে তো প্রচুর মিথ্যা বলেছে, বলে যাচ্ছে। সাব্বির পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে বলল,
– তোমাকে আমি যেতে দিলে তো যাবে। তুমি যেদিকে যাবে আমি ওদিকে চলে যাবো।
– আমি যাবো না!
– ওকে, কেক গুলো তো নষ্ট হয়ে গেল।
– হয়ে যাক।
– আচ্ছা কাল অন্য কেক আনবো।
– লাগবে না।
– আচ্ছা, তুমি যা বলো।
নাদিয়া আফরাকে ঠান্ডা করে বেরিয়ে আসে। গাড়িতে জাহিদ নাদিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
– কথা টা সামনাসামনি না বললেও পারতে।
– না বললে ও সত্যিটা কখনো জানতো না।
– এটা জেনে কী হবে? না জানলেই ভালো হতো।
– একটা মিথ্যা নিয়ে এভাবে সংসার করলে বিরক্তি চলে আসতো।
বিরক্তি! কথাটা শুনে জাহিদের অনেক রাগ হলো। ও গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো। নাদিয়া বুঝতে পেরে বলল,
– সাব্বির ভাইয়ের। কারণ ওনাকে না চাইতেও ওনার অপ্রিয় জিনিসটা খেতে হতো।
– এতে বিরক্তির কী আছে? ওনার স্ত্রী খুশি তো,
– মিথ্যে জিনিসে কখনো শান্তি আসে না। হয়তো একবার দুইবার। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী সময়ের জন্য নয়।
জাহিদ মনে মনে ভাবছে আর দেরি না করে পিপি স্যার কে বলতে হবে একটা ডেট ফিক্সড করার জন্য। এই বোঝা ও আর টানতে পারছে না। এদিকে রিইউনিয়নের দিন ঘনিয়ে আসছে। নাদিয়া এখনো বলেনি জাহিদকে। রোহান ওর পাশে এসেই বলল,
– এখনো বলোনি?
– না।
– তুমি কী জানতে চাও না?
– তোমার পিসি দেখে বলো। ওটা আরো সহজ।
– ওখানে মেয়ের নাম লেখা নেই। সেকশন আর রোল লেখা।
– এ কেমন কথা!
– ওর সেকশন আর রোল দেখে তুমি খুঁজে বের করতে পারো।
– কী করে?
– রিইউনিয়নে।
– রিইউনিয়নে কীভাবে?
– ওখানে রোল কল করা হয়।
– কোন বছরের সুইসাইড?
– জানা নেই। আমার সার্ভের ইনফো আমি কেন পাবলিশার্স করছি না জানো?
– কেন?
– অনেক কনফিউশন আছে। কিছু রেকর্ড আছে, কিছু নেই। রিপোর্ট বের করলেও কেস খাব।
– আমাকে সেকশন আর রোল দেবে?
– দিয়ে কী হবে? তুমি তো আর যাবে না।
– আমি কী করে যাবো?
– তোমার স্বামীর পাস দিয়ে আরামসে যেতে পারো।
– নো! আমার মোরাল আছে। ওকে এভাবে ট্রমাটাইজড করতে পারি না!
– দেন বসে থাকো। এত ভালো সুযোগ আর আসবে নাদিয়া!
– কী করে যাব? ওকে তো সবাই চিনবে। আমি কী করে বলব?
– লিসেন, একবার আমি ভলান্টিয়ার ছিলাম। ওরা এমন রোল ডাকে। মিসিং দের নিয়ে কথা বলে। সুইসাইড করেছে যারা তাদের নিয়েও। যেমন কারো কী মনে আছে কেমন যেন বিরক্তির ছিল? ওরা নিজেরাই বলে। তোমার কিছু করা লাগবে না। স্পাউসের পাস নিয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে সব শুনবে।
– কিন্তু জাহিদ?
– সবাই মাস্ক পড়বে। কেউ কাউকে চিনবে না। এবারে থিম ও তোমার সহায়। আর যদি তোমার স্বামীর অস্বস্তি হয় ওকে বলো কোথাও লুকিয়ে থাকতে। আরে একটা রাতের জন্য সহ্য করতে পারবে না! কী ভালোবাসে তোমাকে?
নাদিয়া এখনো চিন্তা করছে। ওর ভয় হচ্ছে। ওরা যদি প্রিয়মের ব্যাপারে কিছু না বলে তখন জাহিদ তো ওকে ভুল বুঝবে। অনেক স্বার্থপর হতে হবে। এতটা স্বার্থপর হওয়া ওর সামনে সম্ভব না।
– কী চিন্তা করছো? জাস্ট ওয়েবসাইটে ঢুকে রেজিস্ট্রেশন করে নাও।
– ওর ইনফো জানি না তো।
– ইনভিটেশনে আছে।
নাদিয়ার ব্যাগে ইনভিটেশন টা ছিল। ও লাইব্রেরির ল্যাপটপে রোহানের কথামতো রেজিস্ট্রেশন করছিল। রোহান বলল,
– ওর নাম্বার না দিয়ে নিজের নাম্বার দাও। ও জেনে গেলে নাও যেতে দিতে পারে।
– হুম।
রেজিস্ট্রি করার পর নাদিয়ার মনে হলো রোহান এত কিছু কী করে জানে?
– ওর তথ্য যে ইনভিটেশনে ছিল তা তুমি?
– ইনভিটেশন লেটার আমিই ছাপাতে দেখেছি। এই ফরম্যাটে ছাপায়। রোল অমুক, সেকশন তমুক আপনাকে ডাকা হচ্ছে এমন। আগেও কাজ করেছি কিছু অ্যারেঞ্জমেন্ট এ। কিন্তু এবার আমি ভেন্যুতে যেতে পারছি না। গেলে তোমার যেতে হতো না। আমিই যেতাম।
– আমাকে ঐ মেয়েটার তথ্য,
– বাসায় গিয়ে দিচ্ছি।
বাসায় যাওয়ার পর মেসেজ আসলো, “সেকশন এ রোল থার্টি টু।” নাদিয়ার মনে হলো প্রিয়মের রোল এত পেছনে হবে না। ও তো স্কলারশিপ স্টুডেন্ট, হেবি ব্রিলিয়ান্ট। ঐ বছর কিনা তাও নিশ্চিত না। তবে নাদিয়া এখন জাহিদকে পার্টিতে যাওয়ার জন্য তৈরি করছে। বেচারা জানে না এটা কোন পার্টি।
– কোন পার্টি?
– রিইউনিয়ন।
– তোমার কলেজ?
– স্কুল। ওখানে গিয়ে কোনো কথা বলবে না।
– কেন?
– এমনি। অনেক অপরিচিত লোক থাকবে। হাই হ্যালো ও করবে না।
– এটা কী ধরণের পার্টি?
– স্পেশাল।
– আর?
– যদি কোনো কারণে সাফোকেশন হয় বা খারাপ লাগে, আস্তে করে ওয়াশরুমে চলে যেও।
– কোথাকার পার্টিতে যাচ্ছ? এত নিয়মকানুন?
– যা বলছি ভালো করে শোনো, আমার উপর বিশ্বাস রাখো। ভয় পাবে না।
– ভূতের বাড়ি থিম নাকি?
– অনেকটা।
– এর আগে কিডন্যাপ করেছিলে, ভালোই লেগেছিল। আই বিলিভ ইউ।
মাস্ক ও চলে এসেছে। আজকের ব্যাপারটা ডু অর ডাই। আজকে ও হয়তো ও সব জেনে যাবে। আর যখন ও জেনে যাবে তখন আর ওর কোনো পিছুটান থাকবে না। তবে আজ জাহিদের সাথে সবচেয়ে স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করবে। তার জন্য পরে যেভাবেই হোক ক্ষমা চাইবে। ওকে ব্যবহার ই করা হচ্ছে বলা যায়। তবে জাহিদ বলেছে ওর সব সিদ্ধান্তই পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক। এই সিদ্ধান্তর দায় ওর। যা হবে দেখা যাবে।
মাস্ক সহ পাস দেখিয়ে ওরা ঢুকলো। ভেতরটা অনেক অনেক অন্ধকার। ম্যাচিং স্যুট আর গাউনে ওদের দারুণ লাগছে। জাহিদ আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখছে সব।
সারার হাতে গ্লাস, হলের পাশে দাঁড়িয়ে জাহিদ আর নাদিয়া কে দেখে বলে, “প্রেস আর হিয়ার।” সারার পাশে এসে ভিরাজ দাঁড়ালো,
– সো, দিস বাংলাদেশ ভিজিট উইল ওর্থ ইট।
– অফকোর্স! টোটালি।
ওদের ঠোঁটের বাঁকা হাসির পাশে আজফারের বাঁকা হাসিও শোভা পায়।
মাস্ক পড়ে অনেকেই বল ডান্স করছে। আর আলো শুধু তাদের উপরেই পড়ছে। নাদিয়া আর জাহিদ সেই দৃশ্য উপভোগ করছে। একটু পর অর্ঘ্যদীপ এসে সারাকে নাচার জন্য আমন্ত্রণ জানালো। সারা হাত বাড়িয়ে দিলেও আবার হাত ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “অরনীকে বল। ও করলে আমি করছি।” পাশে আজফার আর ভিরাজ হাসতে লাগলো। সেই পুরনো ট্রিক। অর্ঘ্যদীপ নাদিয়ার কাছে গিয়ে বলল, “ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, ক্যান আই ডান্স উইথ ইউ ম্যাডাম?”
নাদিয়া অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “অ্যাকচুয়ালি আই হ্যাভ মাই হাসবেন্ড উইথ মি।” অর্ঘ্যদীপ জাহিদের দিকে তাকায়। ফিরে আসার পর ভিরাজ বলল, “লেট মি ট্রাই।” ভিরাজ গিয়ে নাদিয়ার সমানে ঝুঁকে ওকে আমন্ত্রণ জানায়। নাদিয়া এবার ও অমায়িক ভাবে ওকে মানা করে দেয়। জাহিদ একটু জেলাস। এভাবে থাকলে একজনের পর একজন শুধু আমন্ত্রণ ই জানাবে। ” সো ম্যাডাম, হোয়াই আরেন্ট ইউ ডান্সিং উইথ ইওর হাসবেন্ড। আই বেট হি ইজ আ রিয়েলি গুড ডান্সার।” ভিরাজ তাচ্ছিল্য করেই বলল। জাহিদের কেন যেন এই তাচ্ছিল্যে ভরা ইংরেজি পরিচিতি মনে হলো। “ইয়েস, হি ইজ।” এই বলে নাদিয়া জাহিদের হাত ধরে ওকে ডান্স ফ্লোরে টেনে নিয়ে যায়।
– আমি জানি না নাচতে।
– ভং ধরো।
– কীভাবে ধরে?
– এমনি, বাম না, ডান হাতটা আমার কোমরে রাখো।
নাদিয়া ওর বাম হাত টা জাহিদের ডান কাঁধে রাখে। তারপর অপর হাত ধরে দুলতে থাকে।
– আচ্ছা আর?
– এখন তোমার পা আগালে আমার টা পেছাবে।
– আর?
– এখন একটু আস্তে আস্তে ডান দিকে চলো,
– হুম।
– চলতে থাকো,
– হা।
– পেছাও।
সারা সব দেখছে। ওর রাগ হলেও এর পরের প্ল্যানটা সফল হলেই সব উসুল। অর্ঘ্যদীপ সারার পাশে দাঁড়াতেই সারা অন্য দিকে চলে গেল। আজফার আর আজফারের স্ত্রী ও নাচছে। আস্তে আস্তে জাহিদ নাদিয়া সরে আসে। জাহিদের খুব আনন্দ লাগছে। এভাবে ডান্স কখনো করেনি। যদিও ম্যাগনেফিসেন্টে শেখাচ্ছিল, ও শেখেনি। খুবই বাজে ড্যান্সার ও।
– আচ্ছা, ঐ লোকগুলো কে ছিল?
– কোন লোক?
– যারা নাচতে আগ্রহ জানালো।
– চিনি না।
– তোমার স্কুলের লোক, চেন না?
– তুমি চিনতে সবাই কে?
জাহিদ চুপ হয়ে গেল। ওর হঠাৎ মনে হলো, নাদিয়া তো গার্লসে পড়তো। এরা কী কারো স্বামী? আশেপাশে আরো ভালো করে দেখলো।
“গুড ইভিনিং লেডিস এন্ড জেন্টলমেন। আফটার আ লং টাইম ফাইনালি উই আর হিয়ার। উই মিসড ইউ সো মাচ। এটলিস্ট উই আর হিয়ার। ”
নাদিয়া অধীর আগ্রহে শুনছে ভাষণ। জাহিদ এখনো বুঝছে না। চেহারাই বোঝা যাচ্ছে না কারো। অনেক ইমোশনাল কথা বলছে ছেলেটা। কিন্তু গার্লস স্কুলের প্রোগ্রামের উপস্থাপক ছেলে?
” টুডে দিস স্পেশাল ডে উই আর রিমেম্বারিং আ লস্ট সোউল। শি লেফ্ট আস ঠু আর্লি। উই মিস ইউ ডার্লিং! নাও উই আর গোয়িং টু লুক অ্যাট সাম অফ হার আনফরগটেবল পিকচার্স দ্যাট উই টুক ইন স্পেশাল ডেইস। ”
একে একে প্রজেক্টেরে সব ছবি আসতে শুরু করলো। জাহিদ প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছে না। প্রিয়ম! নাদিয়া তাকিয়ে দেখছে। ওর প্রিয়ম। এই ইউনিফর্ম পরেই দেখা করতে আসতো। ওর একটা ভিডিও আছে কার সাথে যেন কথা বলছে। নাদিয়ার চোখ ঘোলা হয়ে আশে।
“নাও আই উড লাইক টু কল হার ‘বেস্টফ্রেন্ড’ শূন্য। উপ্স! স্যরি শুদ্ধ অন স্টেজ টু শেয়ার সাম মেমোরি উইথ আস।”
জাহিদ কিছু বুঝে উঠার আগেই ওর ওপর আলো এসে পড়লো। ও কী করবে বুঝতে পারছে না। নাদিয়া জাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে। ততক্ষণে প্রজেক্টেরে একটা ভিডিও চলছে,
” হাই আই এম জাহিদ আহমেদ শুদ্ধ। সেকশন এ, রোল ওয়ান। ”
” হাই আই এম প্রিয়ম চৌধুরী। সেকশন এ রোল থার্টি টু।”
” উই আর গোয়িং টু রিপ্রেজেন্ট ম্যাগনেফিসেন্ট ইন ফিজিক্স অলিম্পিয়াড। ”
দুজনে একসাথে এই কথা বলে একজন একজনের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো। পেছন থেকে একজন বলল কাট। প্রিয়ম তখন বলল, “শুদ্ধ তুই বেশি করিস!” শুদ্ধ চশমা ঠিক করে বলল, “তোকে এত সিরিয়াস দেখে আমার হাসি পেয়ে গেল।”
পেছনে আরো ভিডিও ছবি চলছে। জাহিদ ওর মুখোশ টা খুলে অশ্রু সিক্ত চোখে নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। কীভাবে বোঝাবে কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। নাদিয়াও ওর মুখোশ খুলে ওকে আর কিছুই বলল না। ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে আসলো। জাহিদ নাদিয়ার পেছনে দৌঁড়াতে লাগলো,
“আমার কথা শোনো। যেমন ভাবছো তেমন না। আমি জানতাম না নাদিয়া।”
নাদিয়া থেমে গেল। জাহিদ ওর সামনে আসতেই জাহিদ ধাক্কা মারতে মারতে বলতে লাগলো, “কেন? কেন বেইমান? মিথ্যাবাদী! কী জানতে না!!”
নাদিয়া চিৎকার করতে লাগলো। জাহিদের এসব শোনা ছাড়া কিছুই করার নেই। ” এতদিন ধরে মিথ্যা বলেছ? এতদিন! তুমি কী মানুষ!!!” জাহিদ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সব শেষ হয়ে গেছে। নাদিয়া ক্রোধে জাহিদ কে অবিরত থাপ্পড় মারতে লাগলো। জাহিদ দাঁড়িয়েই আছে। থামাচ্ছেও না। বাইরে এসে সারা, অর্ঘ্যদীপ, ভিরাজ আর আজফার সেই দৃশ্য দেখছে।
“এখন আমাকে এটা বলোনা শি ওয়াজ রে*ইপড!”
জাহিদ এই কথা শুনে নাদিয়ার দিকে তাকায়। ওর চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ও কী করে জানলো? আশেপাশে ওদের দেখে জাহিদ বুঝলো এটা বিশাল বড় একটা ফাঁদ ছিল। আগে থেকেই এসব সাজানো হয়েছিল। ওদের এইজন্যই ডেকে আনা হয়েছিল। জাহিদের চেহারা দেখে নাদিয়ার যা বোঝার ও বুঝে গেছে। সত্যের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে কঠিন হলো সত্য মেনে নেওয়া। সত্যের মুখোমুখি হওয়ার পর এ ছাড়া আর কোনো উপায় ও থাকে না। এই মিথ্যেবাদী বেইমান লোকটা প্রিয়মের বন্ধু ছিল, আর ও জানতো ওর সাথে কী হয়েছিল। তাও এতদিন চুপ ছিল। ও জানতো নাদিয়া কে। তবুও অভিনয় করে গেছে।
এই থমথমে নীরবতার মধ্যে সারা মুখে হাত দিয়ে বলল,
” কে করেছিল গেস করো তো অরনী। শুদ্ধ?”
এটা শুনে নাদিয়ার হাত পা অবোশ হয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল। অসম্ভব! রোহান বলেছিল, মেয়েটার বন্ধুরাই…
(চলবে)