#রিস্টার্ট,পার্ট_৫০ (শেষ পর্ব)
#পিকলি_পিকু
বাড়িতে এই মুহুর্তে কেউ নেই। তাই ওয়াসি আন্ডারগ্রাউন্ডে ঢুকলো। ঢোকার পর ওর কোমরের চাবিটা নিয়ে খাঁচা খুলে ফাইয়াজকে বের করলো। ওকে বের করার পর ওয়াসি ফাইয়াজকে মাটিতে বসিয়ে নিজে একটা চেয়ার নিয়ে বসলো। চেয়ারে বসার পর ওয়াসির সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল, যেদিন ফাইয়াজ ওকে ডার্ক রুমে ডেকেছিল। ওয়াসি মুচকি হেসে বলল, “ওয়েলকাম টু মাই ডার্ক রুম ফাইয়াজ!” ফাইয়াজ মাথা উঁচু করে ওয়াসির দিকে তাকালো। সেদিন আর এইদিন ভিন্ন। সেদিন ওয়াসি এভাবে নীচে ছিল, আর ফাইয়াজ ছিল সিংহাসনে। সময় বদলেছে আর অবস্থান ও।
“কেমন লাগছে মেইন বস?” ওয়াসির মুখে এই কথা শুনেও ফাইয়াজের কিছু হলো না। অতঃপর ওয়াসি ফাইয়াজকে আবার প্রশ্ন করল, ” তুমি আমাদের সাথে এমন কেন করতে?” ফাইয়াজ এবার ও কিছু বলল না। “আমরা তোমার কী ক্ষতি করেছিলাম?” “তোমাদের দেখলে আমার ঘৃণা হতো।” ফাইয়াজের এই উত্তর শুনে ওয়াসি অবাক হলো। ও কী এমন করেছিল যে ফাইয়াজের ওকে ঘৃণা করতে হলো?
– আমি কী করেছিলাম?
– কিছুই না। জাস্ট সহ্য হতো না।
– কেন?
– জানিনা। তবে তোমাদের ভেঙে পড়তে দেখে আমার আনন্দ হতো। মানুষের মনোবল যখন ভেঙে যায়, তখন তার সাথে যা ইচ্ছা তা করা যায়। তোমাকে দিয়ে করাতাম কিন্তু তুমি চলে গিয়েছিলে। শুদ্ধ কে দিয়ে করিয়েছিলাম। ও খুব কাপুরুষ টাইপের ছিল। হঠাৎ কী জানি হয়ে গেল।
ওয়াসির খুব রাগ হলো এসব শুনে। ফাইয়াজের মধ্যে কোনো অনুশোচনাই নেই। ওর আফসোস হয় না কেন? ক্ষোভে ওয়াসি জায়গা থেকে উঠে গিয়ে ফাইয়াজ কে মারতে লাগলো। ফাইয়াজ ওর প্রথম কয়েকটা মার খেল। এরপর নিজেকে বাঁচাতে এদিকে ওদিক যেতে লাগলো। তারপর ওর চোখ গেল ভেতরে থাকা একটি লাঠির ওপর। ফাইয়াজ ওয়াসিকে বুঝতে না দিয়ে সেদিকে যেতে লাঠিটা নিয়ে ফেলল। ওয়াসি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফাইয়াজ ওয়াসিকে আঘাত করতে লাগলো। পরপর কয়েকটা আঘাত পেয়েই ওয়াসি জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। ওয়াসিকে এই অবস্থায় রেখে ফাইয়াজ আন্ডারগ্রাউন্ডের দরজা বন্ধ করে ওপরে উঠে আসলো। ওপরে উঠেই ফাইয়াজ ওয়াসির ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি খেল। তারপর হাত মুখ ধুয়ে দাড়ি ছেঁটে পোষাক বদলে নিল। বেশিক্ষণ দেরি না করে ফাইয়াজ ঘর থেকে বেরিয়ে আরেকটা লাঠি জোগাড় করে লুকিয়ে লুকিয়ে গেইটের কাছে আসলো। গার্ড কিছু বুঝতে পেরে পেছনে তাকিয়ে দেখল, কিন্তু সে কাউকে দেখতে পেল না। এরপর সামনে তাকাতেই ফাইয়াজ তার মাথায় আঘাত করলো।
ফাইয়াজ হেঁটে হেঁটে লোকালয়ে এসে একটা বাসে উঠলো। ওয়াসিদের বাসা থেকে কিছু টাকা চুরি করেছিল সে। সেই টাকা দিয়ে শহরে এসে ওর পুরনো সাগরেদদের ফোন করলো। এখন প্রতিশোধ শুরু হবে।
ফাইয়াজ সেই প্রতিশোধের জন্য ছক তৈরি করতে লাগলো। সবার উপর প্রতিশোধ নেবে সে। জাহিদের উপর, ওয়াজিরের ওপর, সেই সব ব্যবসায়ী যারা ওকে ব্যবহার করেছিল তাদের ওপর। এমনকি নিজের বাবার ওপর। অকর্মণ্য লোক! ব্যবসা কী নিজে কখনো জানতো? এই ব্যবসা ও তৈরী করেছে। অনেক অনেক লাশ আর স্বপ্ন মাড়িয়ে আজ এই ব্যবসা ও তৈরী করেছে। সেই ব্যবসা ওর বাবা ভোগ করেছে। তা আবার সে বাঁচাতে চাইছে। কার জন্য? ঐ ফারাজের জন্য? যে কি না একটা স্কুল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না।
প্রতিশোধ নিতে ফাইয়াজ ফোন করলো সুসময় টিভির সাংবাদিক নুসরাত কে।
– হ্যালো।
– কে বলছেন?
– নুসরাতের সাথে কথা বলতে চাই। আমি ম্যাগনেফিসেন্ট স্ক্যান্ডালের একজন মূখ্য আসামী। আমি একান্ত সাক্ষাৎকার দিতে চাই।
টিআরপির জন্য সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে ফেঁসে গেলো নুসরাত। সেখানে থাকা ফাইয়াজের লোকেরা ধরে ফেলেছে ওকে। বাসায় ওর মা বাবাকেও আটকে রেখেছে। এবার নুসরাত আর ওর ক্যামেরাম্যান সহ সুসময় টিভির বিল্ডিংয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দেখিয়ে দিলো। আর এভাবেই পুরো সুসময় টিভি বিল্ডিং জিম্মি হয়ে গেল।
“ফাইয়াজ আমার বদলে ওদের ছেড়ে দেবে?” শুদ্ধের মুখে এই কথা শুনে ওয়াজির বলল, “পাগল হয়েছ? ও তোমাকেও ছাড়বে না। ওদের তো ছাড়বেই না।” “তবে আমরা ওদের কী করে ছাড়াবো?” ওয়াজির কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ” ওখানে ইনটেলিজেন্সের লোকেরা আছেন।”
এদিকে সবাই বলাবলি করছে ওরা না পালিয়েছিল? এখন কী করে ফিরে আসলো? শুদ্ধ ওয়াশরুমে যাওয়ার নাম করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সুসময় টিভি ভবনে গিয়েছে। অরনী আর ওয়াজির লবিতে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর অরনী বুঝতে পারে শুদ্ধ এখানে নেই। ভয়ে অরনী ওয়াজির কে বলে ওয়াশরুমে গিয়ে দেখে আসতে। ওয়াজির সব কয়টা ওয়াশরুম দেখে এসে অরনীকে কিছু বলার আগেই অরনী দৌঁড়ে বেরিয়ে যায়। অরনীকে এভাবে যেতে দেখে ওয়াজির ওর পেছনে যেতে থাকে।
এদিকে শুদ্ধ সেখানে যেতে চাইলেও ওকে কেউ ঢুকতে দিচ্ছে না। “আমি সেই শুদ্ধ ও যাকে খুঁজছে।” তবুও নিরাপত্তাবাহিনীর লোকেরা ওকে যেতে দিচ্ছে না। ফাইয়াজ এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে উপর থেকে নিচে গুলি ছুড়ছে। ভেতরেও গোলাগুলি করেছে। বাহিরে থাকা ইনটেলিজেন্সের লোকেরা ধারণা করছে হয়তো কয়েকজন ঘায়েল হয়েই গেছে। তাই তারা বাধ্য হয়ে শুদ্ধকে পাঠাতে চাইছে। শুদ্ধকে বুলেট প্রুফ ভেস্ট পরিয়ে একটি জরুরি যোগাযোগ যন্ত্র দিয়ে ভেতরে পাঠাচ্ছে তারা। ততক্ষণে অরনী আর ওয়াজির চলে এসেছে। ওদের ও কেউ ঢুকতে দিচ্ছে না। শুদ্ধ বেরিয়ে আসতেই অরনী চিৎকার করে কাঁদতে থাকে, “আমি তোমাকে এভাবে যেতে দিতে পারি না। আমি এত কষ্টে তোমাকে পেয়েছি! তোমার কী আমার প্রতি একটুও দয়া হয় না?” ওয়াজির কে দেখে ওরা অরনী আর ওয়াজিরকে ঢুকতে দিল। অরনী ঢুকেই শুদ্ধ কে জড়িয়ে ধরলো। শুদ্ধ ও অরনীকে খুব ভালোবাসায় আলিঙ্গন করে ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল, “আমি কথা দিচ্ছি, আমি আসব। তোমার জন্য ফিরে আসবো অরনী।” শুদ্ধ ভেতরে চলে গেল। শুদ্ধকে দেখে তারা ঢুকতে দিল। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী তারা বিল্ডিংয়ের কাউকে বের হতে দিল না।
দুজন লোক শুদ্ধকে ছাঁদে দিয়ে আসলো। ওকে দেখে ফাইয়াজ মুচকি হেসে বলল, “বুলেট প্রুফ জ্যাকেট টা খুলে ফেল। গরম লাগছে না?” শুদ্ধ প্রথমে খুলতে না চাইলেও পরবর্তীতে খুলে ফেলে। এরপর জরুরি যোগাযোগ যন্ত্রটাও ওরা নিয়ে নেয়। ফাইয়াজ যাকে চাইছিল সে এসেছে দেখে নুসরাত চিৎকার করে বলে, “এখন তো আমাদের ছেড়ে দাও। শুদ্ধ তো চলে এসেছে।” ফাইয়াজ আবার মুচকি হেসে বলল, “তোমাদের এখন যেতে দিলে আমি বের হবো কী করে? দাঁড়াও, আগে আমার ইন্টারভিউ নাও।”
নুসরাত ফাইয়াজের ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করলো,
– মিস্টার ফাইয়াজ, স্বাগতম আপানাকে।
– ধন্যবাদ।
– আপনি ম্যাগনেফিসেন্টের,
– ফর্মার ট্রাস্টি। আর সেখানে কী হতো তা তো জানেন। কারা করত তা তো কেউ জানেন না।
– কারা করতো?
– সব বড় বড় ব্যবসায়ীরা। সবাই আমাকে দিয়ে ডিল বের করত। এর ছেলেমেয়ের ক্লিপ দিয়ে একে ব্ল্যাকমেল। নামটা হলো কার? আমার! ফল তো সবাই খেয়েছে। সব বড় বড় ব্যবসায়ীরা তাদের নাম বের হওয়ার ভয়ে আমাকে মারতে চাইলো।
– আপনি কী করে বেঁচে আছেন?
– শুদ্ধের জন্য। ও আমাকে বাঁচিয়েছে। তবে সেই বড় ব্যবসায়ীদের নাম আমি এখানে লিখেছি। এক এক করে পড়ছি।
ফাইয়াজ একটা একটা করে নাম পড়তে লাগলো। সেখানে প্রায় সকল নামজাদা ব্যবসায়ীরা আছেন। এমনকি ওর নিজের বাবাও আছে। যাদের যাদের নাম আসছে সবাই ঘাবড়ে গেছে এ সব শুনে,
– কিছু মনে করবেন না, কী প্রমাণ আছে?
– প্রমাণ? আমি করেছি, আমি জানি। আর যা যা ডকুমেন্ট ছিল সব রেইডে জব্দ হয়েছে। সেখানেই আছে। বড় বড় অফিসাররা সব গিলে আছে।
– আপনি এখন এসব প্রকাশ করছেন কেন?
– কারণ ওরা আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ওরা আমাকে যা দিয়েছে তা আমি ওদের ফেরত দিতে চাই।
– তাই বলে আপনার বাবাও?
– সে লোকটা বাবা না, কারণ সে তার সন্তান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
“আর তুমি এটাই ডিজার্ভ করো!!” শুদ্ধের মুখে এই কথা শুনে ফাইয়াজ আর নুসরাত ওর দিকে তাকালো।
– তুমি যত মানুষের জীবন নষ্ট করেছ সেসব তুমি ফেরত পাচ্ছ। আর তোমার বাবা, তুমি তোমার সন্তানের সাথে কী করেছ মনে পড়ে?
– আমার সন্তান কে?
– প্রিয়মের গর্ভে যে ছিল। তুমি আর সারা মিলে ওকে ঔষধ খাইয়ে দাও নি? এরপরই তো প্রিয়মের রক্ত ক্ষরণ হয়। ওর গর্ভপাত করাতে তুমি চাওনি? সেই গর্ভপাতের যন্ত্রণাতেই ও মারা গেছে। নিজের সন্তানকে তুমি হ*ত্যা করেছ। নিজের সন্তান থেকে তুমিও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছ। আর আজ তোমার বাবাও তাই করছে, যা তুমি করেছিলে।
ফাইয়াজ তেড়ে গিয়ে শুদ্ধের কলার চেপে ধরল, “চুপ! আর একটা কথাও না। তুই কোনো কথা বলবি না।” এই বলে ফাইয়াজ শুদ্ধ কে মারতে থাকে। তবুও শুদ্ধ চুপ করেনি,
– তুমি মানুষকে মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ করতে দুই মিনিট ভাবোনা, তো মানুষ কেন ভাববে তোমাকে নিয়ে?
– তোকে আজকে মে*রে ফেলব। তোর কারণে আমি আজ এখানে।
– আমার কারণে নও! নিজের কারণে। ভেবে দেখ, মানুষকে বিপর্যস্ত করে তা ক্যামেরা বন্দী করে তুমি কী মজা পেতে। আজ তোমার এই অবস্থা অন্য কেউ ক্যামেরা বন্দী করছে, আর পুরো দেশ তোমাকে এভাবে দেখে মজা পাচ্ছে।
এই কথা শোনার পর ফাইয়াজ ক্যামেরা ম্যানের ক্যামেরা নিয়ে ভেঙে ফেলল। তারপর আবার শুদ্ধ কে মারতে লাগলো। টিভিতে এসব দেখে সবাই ঘাবড়ে গেল। ওখানে শুদ্ধের সাথে কী হচ্ছে তাই ভেবে অরনী প্রায় মূর্ছা গেল। সবার সামনেই সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো, “শুদ্ধ!! শুদ্ধ!!!”
শুদ্ধ মাটিতে পড়ে আছে। ফাইয়াজ ওকে তিনটে লাথি মেরেছে। নুসরাত আর ক্যামেরা ম্যান একদিকে বসে আছে। তারা একমনে আল্লাহ্কে স্মরণ করছে। এই মুহুর্তে ফাইয়াজ ওদের মেরে ফেললেও কেউ দেখার নেই, বাঁচানোর নেই। শুদ্ধের খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এই শ্বাসকষ্ট নিয়েও সে বলছে,
– ভেবে দেখো, ফাইয়াজ, আজ ঐ সব অসহায় শিক্ষার্থীদের জায়গায় তুমি আছ। কেমন লাগছে?
– আমার তোকে ঐদিন বাঁচানো উচিত হয়নি।
এই বলে ফাইয়াজ শুদ্ধের গলা চেপে ধরলো। শুদ্ধের খুব কষ্ট হচ্ছে, তাও সে বলল,
– হ্যাঁ, ঠিক তাই। নিজের এই অবস্থার জন্য তুমিই দায়ী! আজ আমাকে মেরে ফেললেও কিছুই হবে না।
– তাও তোকে মারব!
– তুমি আমাকে মারলেও বরবাদ, বাঁচিয়ে রাখলেও বরবাদ।
ফাইয়াজ শুদ্ধের গলা ছেড়ে দিল। শুদ্ধ বসে কাশতে কাশতে বলল,
“তোমার জীবনে আর কী বাকি আছে? ক্ষমতা? যার জন্য অমানুষ হয়ে গেছ, সেই ক্ষমতা তো আর থাকবে না।”
ফাইয়াজ শুদ্ধের দিকে তাকালো। শুদ্ধ আবার বলল, “যেই মেইন বসকে কেউ চিনতো না, সেই মেইন বস কে আজ সবাই এই অবস্থায় দেখেছে। পুরো বাংলাদেশ!”
ফাইয়াজ অনুভূতিহীন হয়ে বলল, “সেদিন ম্যাগনেফিসেন্টের যতই বদনাম হতো না কেন, তুই মরলে এত কাহিনী হতো না। আবার যদি সময়ে ফেরত যাওয়া যায়, তো আমি এইবার তোকে আর বাঁচাবো না।”
শুদ্ধ ফাইয়াজের কথা শুনে মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ” আরেকটা সুযোগ পেলে আমিও আত্ম*হ*ত্যা করতে যেতাম না। যে ভিডিওটা চুরি করতে গিয়েছিলাম, তা চুরি করে তোদের এক্সপোজ করে দিতাম। তবে আমি মরলেও তোরা খুব আরামে থাকতি তা নয়। যা করেছিস, তা ফেরত তো পেতি। আজ নয় কাল।”
ফাইয়াজ মুচকি হেসে বলল, “তো তোকে তোরটা ফেরত দিয়ে দেই?” এই বলে শুদ্ধের গলা চেপে ফাইয়াজ শুদ্ধ কে ছাঁদের রেলিংয়ে নিয়ে শুদ্ধ কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চাইলো। শুদ্ধ আপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছে নিজেকে বাঁচাতে। নীচ থেকে ওদের এই ধস্তাধস্তির দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। অরনী চিৎকার করছে। এবার ইনটেলিজেন্সের লোকেরা ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। কারণ তারা ফাইয়াজ কে অনেক সুযোগ দিয়েছে। আর সম্ভব না। ফাইয়াজের লোকেদের উপর কোনো দয়া না দেখিয়েই হামলা করতে লাগলো তারা। এই দেখে উপরের কিছু লোক ও নীচে নেমে গেল।
এদিকে ছাঁদে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে শুদ্ধ ফাইয়াজকে ধাক্কা দিয়ে বসে। আর সেই ধাক্কায় ফাইয়াজ ছাঁদের রেলিংয়ের বাইরে চলে যায়। কিন্তু শুদ্ধ ফাইয়াজকে ওর ডান হাত দিয়ে ধরে ফেলে। ফাইয়াজ ওর ডান হাত দিয়ে শুদ্ধের ডান হাত ধরে ঝুলছে। ঘটনা সেখানে এসে থামল যেখানে শুরু হয়েছিল। যেন এক অসীম চিহ্নের মাঝখান টা মিলিত হয়েছে। এভাবেই ফাইয়াজ শুদ্ধকে বাঁচিয়েছিল। আর এভাবেই নিজের পাপের ফলের যাত্রা করেছিল।
– ফাইয়াজ, তোমার অন্য হাতটা দাও। আমি তোমাকে তোলার চেষ্টা করি। এই, কেউ এদিকে আসো। ওকে বাঁচাতে হবে।
শুদ্ধ বাকিদের ডাকছে ফাইয়াজ কে বাঁচাতে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। এসব দেখে ফাইয়াজ বলল,
– কী করবে আমাকে বাঁচিয়ে?
– তোমার পাপের ফল পাওয়া এখনো বাকি।
– আমি যদি এবার বেঁচে যাই তো তোমার বিপদ হবে শুদ্ধ।
– একবার বেঁচেই দেখ। আমি আর আগের শুদ্ধ নই।
– আমরা সব কিছু শেষ করে দিচ্ছি না কেন? আবার কেন শুরু করতে চাইছ?
– কারণ তোমার শাস্তি বাকি। অনেক অন্যায় করেছ, অনেক মানুষের সাথে। আজ তোমার হাতে কী আছে?
– আমার হাত শুন্য।
এই বলে ফাইয়াজ শুদ্ধের হাত ছেড়ে দিল। শুদ্ধ আরেকবার চেষ্টা করলো ওর হাত ধরতে। এবার আর পারল না। ফাইয়াজ মাটিতে পড়ে গেল। এই দুনিয়া থেকে ও মুক্ত, কিন্তু নিজের পাপ থেকে নয়।
” হারাধনের দুইটি ছেলে
তাদের ছিল ক্ষমতা অনেক
প্রতিশোধের আগুনে শেষ হলো
রইলো বাকি এক!”
ফাইয়াজের রক্তাক্ত লাশ মাটিতে পড়ে আছে। শুদ্ধ ওপর থেকে তাকিয়ে দেখছে সেই লাশ। অনেক বছর আগে ফাইয়াজ ওকে না বাঁচালে হয়তো ওর ও এই অবস্থা ই হতো। কেউ জানতো না ম্যাগনেফিসেন্টে কী হয়েছে। অরনীও কী তখন বাঁচতো? ফাইয়াজ, সারা, অর্ঘ্যদীপ, আজফার, ভিরাজ আর সানি খুব স্বাভাবিকভাবেই জীবনযাপন করতো। খুব অন্যরকম হতো ওদের জীবন।
কিছুক্ষণ পর ওদের উপর থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসলো। শুদ্ধ কে দেখে অরনী ছুটে গেল ওর দিকে। শুদ্ধ অরনীকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলো। এই কান্না দুঃখের কান্না নয়, বিজয়ের কান্না ও নয়। কেমন যেন একটা আফসোস আছে। ফাইয়াজ শেষ পর্যন্ত আত্ম*হ*ত্যা করেছে। তাকে কেউ শাস্তি দিতে পারেনি। সে নিজেই নিজের অন্ত করেছে। যাওয়ার আগে সত্যিই অনেককে নিয়ে ডুবেছে। নিজের বাবাকে তো অবশ্যই। যেসব রাঘব বোয়ালদের পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য সিকান্দার সাহেব রেখে দিয়েছিলেন, তাদের ও দিন শেষ।
ওয়াজিরের ফোনে হাসপাতাল থেকে কল আসলো। ওয়াসির জ্ঞান ফিরেছে, ও ভালো আছে। গার্ড ও ভালো আছে। একে একে সুসময় টিভি ভবনে থেকে সবাই হাসিমুখে ও অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসলো।
সেদিন ফজরের আজানের মধ্য দিয়ে আরেকটা নতুন ভোর হয়েছিল। পাখি ডাকছিল, সূর্যের আবছা আলো ছিল। বাতাসে একটা সুঘ্রাণ ছিল। একটা প্রশান্তি ছিল। সেদিন সারারাত শুদ্ধ জেগেছিল। অরনী ওর মাথায় অবিরত হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল। সেদিন শুদ্ধ কারো সাথে কথা বলেনি। ওর মানসিক অবস্থা জানতে পিপি আর বেনজির অনেকবার ফোন করেছিল। শুদ্ধ ঠিক আছে তো? শুদ্ধ, তুমি কী শক্ত আছ? শুদ্ধ শুধু অরনীর সাথে ছিল।
“অরনী, ওরা আর আসবে না তো?”
” না, শুধু আমি থাকবো তোমার সাথে।”
“আজ সবটুকু আঁধার যেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়
তোমার আমার শহরটা আলোয় ভরে যায়
অবাক লাগে, তুমি ছিলে ঠিকানাবিহীন
ভেবেছিলাম হারিয়ে গেছ,
পাব না কোনো দিন।
ভেবেছিলাম, আমার সৌভাগ্যে ছিল কারো অভিশাপ;
তুমি না এলে ধরেই নিয়েছিলাম,
এ পূর্বজন্মের পাপ।
আমার হতাশ দীর্ঘশ্বাসে,
কিংবা নিরাশ দৃষ্টিতে,
তুমি ছিলে লেখা, শুধু ছিল তোমার প্রয়োজন।
এই বিফল জীবনে না আছে কোনো পূণ্য,
না করেছি কোনো অসাধ্য সাধন।
জানিনা কী করে হলো আমার জীবনে
তোমার প্রত্যাবর্তন।
আমার কাছে তুমি কোনো পুণ্যের প্রতিদান;
তোমার কাছে আমি কারো পাপের অভিশাপ।
না আমি পাপ ছিলাম, না ছিলাম অভিশাপ,
শুধু ছিলাম;
ছিলাম তোমার জন্য
যতই হই নগন্য,
নিজেই নিজের কাছে ঘৃণ্য,
আমি শুধু তোমারই জন্য।
এই অনুধাবনে কেটেছে হাজারো বছর
সরেছে কুয়াশা
এসেছে আলোকরশ্মি
আজ তুমি আমি শঙ্খচিল
এই শহরের আকাশ রঙিন
চলো উড়ে বেড়াই দ্বিধাহীন।”
শুদ্ধ আর অরনীর দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী, অনেক অনেক শুভেচ্ছা এসেছে ওদের ঠিকানায়। অনেক কার্ড, অনেক ফুল। শুদ্ধের দেশেই খুব ভালো একটা চাকরি হয়েছে। আর অরনীও ম্যাগনেফিসেন্টে জয়েন করেছে। তাই ওরা ওদের পুরনো বাসায় আবার চলে এসেছে। সেখানে ওদের অনেক স্মৃতি আছে। যেমনই হোক, শুধুই ওদের মুহূর্ত।
আফরা অরনীকে ভিডিও কল করেছে,
– হ্যালো, হ্যাপি অ্যানিভার্সারী!
– থ্যাংকস।
– আমি তোদের জন্য কেক বানাচ্ছিলাম, আর তোরা কিনা,
– কুয়াকাটায় এসেছি। অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন তো ছিল এখানেই সেটেল হয়ে যাব।
– আসলেই, অনেক সুন্দর তাই না?
– অনেক! সাফিরা কেমন আছে?
– ভালো। শুধু কান্না করতে জানে আরকি। আমি তো আবার জয়েন করলাম। ওকে নিয়ে বিপদে পড়লাম।
– বেবী সিটার নেই?
– ওর দাদী ওর খেয়াল রাখে তো। নাতনি দেখে মন তো গেছে, তাও শুধু নাতনির জন্য। মা অনেক কথা শোনায়। তোর তো কোনো শাশুড়ি নেই, বুঝবি না। শোন, বেবী নিলে তোর বেবী কে রাখবে?
– আমি রাখবো।
– আন্টির কাছে রেখে আসিস।
– দেখা যাবে। এখন রাখি।
পাশ থেকে শুদ্ধ বলে,
– আমরা বেবী নিচ্ছি?
– তোমাকে কে বলল?
– ফোনে তো বললে।
– এমনি ওকে বললাম।
এই বলে অরনী লজ্জা পেয়ে যায়। শুদ্ধ ও অরনীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ওকে আরো বিব্রত করে দেয়। তখনই ওর কাছে পিপির ফোন আসে,
– কী অবস্থা তোমাদের?
– ভালোই।
– তোমরা বাসায় নেই কেন?
– আপনি কী আমাদের বাসায়?
– দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।
– এ মা! আমরা তো কুয়াকাটা।
– ওকে। তবে অরনী, আমরা ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
– কেন?
– চট্টগ্রামে আসছি। শুনেছি এখানে নাকি ডিভোর্স রেট আশংকাজনক হারে বাড়ছে। ভাবছি কিছুদিন এখানে বিচরণ করি। বাঁচিয়ে দেই অনেক সম্পর্ক।
– আর ঢাকার লোকেদের?
– তোমাদের যে জ্ঞান দিয়েছি তা বিতরণ করো। তোমরাও তো এখন আমার শিক্ষায় শিক্ষিত।
শুদ্ধ অরনীর হাত থেকে ফোন নিয়ে বলল,
– তাহলে আমরাও বেড়াতে আসব চট্টগ্রামে।
– আসো। অনেক সুন্দর জায়গা আছে।
এদিকে কানাডার জেলে ওয়াজির গিয়েছে। সেখানে সানি আছে।
– শুনেছ, তোমার সঙ্গীদের সাথে কী কী হয়েছে।
– হুম।
– ওরা কেউ বেঁচে নেই।
– জানি। তুমি দোয়া করো, তোমার শাস্তি যাতে খুব দেরিতে শেষ হয়। কারণ যত তাড়াতাড়ি শেষ হবে, তত তাড়াতাড়ি তোমাকে আমি দেশে নিয়ে যাব শাস্তি দিতে। এখানকার জেল বাংলাদেশের জেল থেকে অনেক ভালো।
ওয়াজির উঠে চলে আসে। আর সানি সেখানে বসে কাঁদতে থাকে,
” হারাধনের একটি ছেলে
কাঁদে ভেউ ভেউ
মনের দুঃখে বনে গেল
রইলো না আর কেউ।”
কুয়াকাটা থেকে ফিরে অরনী আর শুদ্ধ কর্মস্থলে যোগ দিতে বের হয়েছে। শুদ্ধ গাড়ি চালাচ্ছে, অরনী পাশের সিটে।
– আমাদের জন্য এবার অনেক অনেক শুভেচ্ছা এসেছে শুদ্ধ।
– হুম।
– আমাদের একটা থ্যাংকস পার্টি দেওয়া উচিত না?
– ঠিক বলেছ।
– কারা কারা আসবে?
– তোমার বাড়ির লোক, আমার বাড়ির লোক।
– আর, ওয়াসি-ওয়াজির, পিপি স্যার, বেনজির ম্যাডাম। আফরা রাও। আর প্রিয়মের মা বাবা।
– মিশান ভাইয়া?
– থাপ্পড় দেব একটা শুদ্ধ। গাড়ি চালাও ঠিক করে।
– ওর বউ সহ আসবে। নতুন বিয়ে করলো না।
– তুমি মজা করছো শুদ্ধ?
– বিয়ে তো করেছে। বউ সহ ডাকা উচিত তোমার। মামাতো ননদ বলে কথা।
– তা ঠিক বলেছ। তাও, আমি ঝামেলা চাইনা। মিঠাই আপু ও দেশে নেই। তো থাক।
– আরজে ঐশী কে ডাকো।
– ও আসবে?
– ওয়াজির আসলে আসবে।
– তা ঠিক। হাহাহ! তোমার কোনো কলিগ আছে?
– না। ফ্যামিলি গেট টুগেদারে ডাকার মতো নেই।
– আচ্ছা, আমরা চলে এসেছি।
শুদ্ধ অরনীকে ম্যাগনেফিসেন্টের সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল,
– বাই বাই টিচার?
– আমি তোমার টিচার?
– আমার স্কুলের তো। আমার স্কুলের টিচার মানে আমার টিচার।
– ওকে বাই স্টুডেন্ট। লাঞ্চ টাইমে ফোন করবে। নইলে ফাইভ পয়েন্টস ডিডাক্ট করবো।
অরনী হাসতে হাসতে স্কুলের ভেতর ঢুকে গেল। শুদ্ধ ও হাসিমুখে গাড়ি নিয়ে ওর গন্তব্যে চলে গেল। ওদের জীবন এভাবেই সুন্দর করে কেটে যাচ্ছে। আর পাঁচটা স্বাভাবিক সুখী দম্পতির মতো ওদের জীবন ও সুখে শান্তিতে আল হালকা খুনসুটিতে কাটছে।
[অবশেষে শেষ হলো। ধন্যবাদ সবাইকে রিস্টার্ট এর সাথে এতদিন থাকার জন্য। আমি এখনো অবাক হই এত বড় গল্প লিখলাম কী করে? তবে যা ছিল ভালো ছিল। শেষ দিকে এসে আমার আর লিখতে ইচ্ছা হয়নি, কারণ আমি নাদিয়া জাহিদকে খুব মিস করছিলাম ? গল্প শেষ যেন ওরা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এভাবেই নতুন গল্প আসবে, নতুন চরিত্র আসবে। এভাবেই চলতে থাকবে। আরো অনেকের গল্প বলা বাকি, আরো অনেককে মিস করা বাকি। আশা করি পাশে থাকবেন সবাই।]