#রুপকথা,পর্ব-৪
লেখক- ইতি চৌধুরী
ঘড়িতে রাত ১১টা বাজে। রোদ বসে আছে নিজের ঘরে। তার হাতে রিতুর দেয়া ডায়েরিটা। সে একটাবার ইতির সাথে দেখা করতে চাইলো। অথচ রিতু তাকে একটা রহস্য ধরিয়ে দিলো। ডায়েরি নামক রহস্য। কি আছে এর ভেতর! রোদের ভেতরে ভেতরে অনেক আশফাস লাগছে। অদ্ভুত এক অস্বস্তি অনুভব করছে সে এই মুহূর্তে। বারবার গলা শুকিয়ে আছে। হঠাৎ এমন লাগছে কেন? বুঝে উঠতে পারছে না রোদ। কপালের কাছটায় বিন্দু বিন্দু পানি ফোঁটা জমেছে। হাতের পিঠে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করে রোদ। নিজের জায়গা থেকে উঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি খায় সে। পানি খেয়ে পূর্বের জায়গায় ফিরে এসে ডায়েরি হাতে নেয়। কাঠের ফার্নিচার বার্নিশ করলে যে রঙটা হয়, ঠিক সেই রঙের একটা ডায়েরি। পিঠে বালিশ গুঁজে তাতে আরাম করে হেলান দিয়ে কোলের উপর ডায়েরিটা নিয়ে তা হাতিয়ে দেখে রোদ। এপিঠ ওপিঠ হাতিয়ে ডায়েরির প্রথম পাতাটা খোলে সে।
ডায়েরির লেখা,
তুমি রুপকথায় বিশ্বাস করো?
এই একটা প্রশ্নের দিকে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো রোদ। পরের লাইনে কি আছে সেদিকে চোখ পরছে না তার। এই লাইনটায় অদৃশ্য কিছু একটা আছে, যা তাকে টানছে। মনে মনে বেশ ক’বার এই একটা প্রশ্ন, এই একটা লাইন আওড়ায় সে। তারপর,
আমি বিশ্বাস করি। আগে অবশ্য করতাম না তবে এখন করি। কিন্তু কেনো জানো? তোমাকে দেখার পরে। তুমি আমার জীবনে ঠিক রুপকথার রাজকুমারের মতো।
এই ছেলে, তুমি কি কখনো প্রেম করেছ?
রোদকে ইতি যেমন প্রতিটা প্রশ্ন আলাদা আলাদা ভাবেই করেছে। নিজের কথাও সে আলাদা করে বলেছে। তারপর,
আমার জীবনের ২৪ টা বসন্ত শূন্যই কেটে গেল। তবে ইচ্ছে ছিল মনের গহীন কোনে আগামী বসন্ত আমার তোমার হাত ধরাধরি করেই কাটুক। আমি জীবনে প্রথমবার কারো জন্য সাজবো। সেই সাজে বেশি কিছু নয় শাড়ির সঙ্গে থাকবে কপালে ছোট্ট একটা টিপ ও এলো চুলে হাত খোপা।
আচ্ছা তোমার কোন রঙটা বেশি প্রিয়?
আমি কিন্তু বসন্তের দিন বাসন্তী রঙের শাড়িই পড়তাম। একটা বাসন্তী রঙের জর্জেট শাড়ি। আঁচল টা বাতাসের তোড়ে একবার এদিক যাবে, আরেকবার সেদিক।
রোদ যেন সঙ্গে সঙ্গেই তার কল্পনায় ইতিকে দেখে ফেলল একটা বাসন্তী রঙের জর্জেট শাড়ি গায়ে জড়িয়ে, কপালে ছোট্ট একটা টিপ পরে তার এলো চুলে হাত খোপা করতে ব্যাস্ত সে। যেই সে চোখ তুলে তাকালো ওমনি তাকে দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ইতি। ভীষণ পাগল করা, মন কেমন কেমন করা সেই হাসি। রোদের বুকের ভেতর টাও জানি কেমন কেমন করে উঠলো যেন।
কল্পনা রেখে ডায়েরিতে মন দেয় রোদ। তারপর,
বড্ড ভুলভাল বকছি তাই না? একটু বকি। বকতে বকতেই তোমার প্রশ্নের উত্তর তুমি পেয়ে যাবে।
ছোটবেলা থেকেই ভীষণ চঞ্চল আমি। বাবার ভীষণ আদর, আহ্লাদে বড় হয়েছি। বাবার বদলির সুবাদে আজ এই শহর তো কাল সেই শহর। কে জানত তোমার শহরটাই আমার জীবনের শেষ শহর!
তোমাকে বিরক্ত করতে, পথে ঘাটে ভরকে দিতে কী ভালো লাগত আমার। শুধু মনে মনে চাইতাম,
তুমি শুধু একদিন সামনে এসে জেরা করো আমায়, আমি জড়িয়ে ধরবো তোমায়।
আবৃত করবো তোমায়, আমার ভালোবাসার চাদরে।
রাঙাবো তোমার শহর, আমার ভালোবাসার রঙ তুলিতে।
কিসের রঙ? কিসের ভালোবাসা? সব যেন কেড়ে নিলো আমার। ভাবছ কি সব আবোল তাবোল বলছি। আসলেই আবোল তাবোল বলছি। আসলে তোমায় লিখছি ভেবে লিখতে ভালো লাগছে। ভেবেছিলাম তোমায় পাওয়ার পর অন্তত চিঠি লিখব প্রতি সপ্তাহে একটা, চিরটুক হবে তোমার নামে প্রতি রজনীতে একটা। কিন্তু তা আর হলো কই! তবু তৃপ্তি আমার শেষ চিরকুট তোমার নামে।
তুমি হয়তো কিছু বুঝতে পারছ না। আসো আরও ক্লিয়ার করে বলি।
তুমি সেদিন আমায় থাপ্পর মারলে, মনে আছে? আপাতদৃষ্টিতে সেটা থাপ্পর হলেও আমার জন্য তা তোমার স্পর্শ। অন্তত একটিবার তো তুমি আমায় ছুঁয়ে দিলে। আমি তোমার স্পর্শ মনের গহীনে তুলে রাখলাম একান্তই নিজের করে। তুমি খেয়াল করেছ কিনা সেদিন আমি তোমাকে কিছুই বলিনি। কোনো জবাব দেইনি। এমনকি তোমার থাপ্পর খেয়েও টু শব্দ করিনি। আমি তো জানতাম না তোমার স্পর্শ আমার জীবনে আসার আগে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঝড়, তুফান আমার সমস্ত জীবনটাই ওলোট পালোট করে দিয়ে যাবে।
তুমি থাপ্পর মারার দু’দিন আগেই জানতে পেরেছি আমার একটা কিডনি সম্পূর্ণ ডেমেজ আরেকটা এইট্টি পারসেন্ট ডেমেজ। অথচ দেখো আল্লাহ আমাকে কি সুন্দর চেহারা সুরত দিয়েছিলেন। কেউ দেখে বলতেই পারবে না আমার ভেতরের দুইটা কিডনিই প্রায় পচে গেছে। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে আমার জীবন৷ আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না।
এতটুকু পড়েই ঝট করে ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেলে রোদ। বুকের ভেতরটা ধপধপ করছে তার। যেন কেউ বুলডোজার চাচ্ছে সেখানে। গলা কাঁপছে, ঠোঁট কাঁপছে। মাথার ভেতর ভনভন করছে। এমন কিছু রোদ মনে মনেও ভাবেনি কখনো। সে তো ভেবেছিল ইতি হয়তো অভিমান করে দূরে কোথাও চলে গিয়েছে। সে একবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই ইতির সব অভিমান পানি হয়ে যাবে।
অজানা ভয় ও শংকায় ডায়েরির সামনের অংশ পড়ার সাহস হচ্ছে না তার। তবু পড়তে তো হবেই। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে, বার কয়েক লম্বা শ্বাস ছেড়ে আবার ডায়েরি খোলে রোদ। তারপর,
আব্বু, আম্মু অনেক চেষ্টা করেছেন। আমি তাদের একমাত্র সন্তান। ডাক্তারের মন্তব্য ছিল যদি একটা কিডনিও পাওয়া যায় তাহলেও আশা আছে আমার বেঁচে থাকার। একটা কিডনি নিয়েও অনেকে বেঁচে থাকে। ভালো ভাবেই বেঁচে থাকে, হয়তো আমিও থাকবো। কিন্তু আমার সাথে মেচিং কিডনি পাওয়া যাচ্ছিল না। খুঁজেও ও নেগেটিভ ব্লাড গ্রুপের কিডনি পাওয়া যাচ্ছিলো না। তবে আমার শুধু মনে হতো হয়তো আমি অপারেশন টেবিলেই মারা যাবো। ডাক্তার বারবারই বলেছেন এমন কিছুই হবে না। নষ্ট কিডনি দুইটা ফেলে দিয়ে, একটা ভালো কিডনি লাগালেই আমি আগের মতো একদম ভালো হয়ে যাবো আবার। অনেক খোঁজাখুজির পর কিডনি পাওয়া গেল। তবে একটা নয়, দুইটা কিডনিই পাওয়া গেল। আমার দুঃখি বাবা মা যেন চাঁদ হাতে পেয়ে গেলেন। তাদের একমাত্র সন্তানকে বাঁচাতে, তাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। কিন্তু চেষ্টা করে কি হবে বলো? যা হবার তা তো আগেই সেট করা। তোমার, আমার জীবনে কি ঘটবে তা তো পূর্ব পরিকল্পিত। এই যে তুমি এখন ডায়েরিটা পড়ছো এর মানে কি জানো? এর মানে তোমার পৃথিবীতে আমি আর বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি না। তোমার পৃথিবীর কোথাও এখন আর আমি নেই। আমার বসবাস এখন তোমার থেকে বহু দূরে। তোমার দুনিয়ার সাথে আমার সম্পর্কের ইতি ঘটে গেছে আরও আগেই।
রোদের চোখ জোড়া আপনাতেই ঝাপসা হয়ে আসে। এমন কিছুর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ভুলেও সে কখনো ভাবেনি ইতির কিছু হয়েছে বা সে বেঁচে নেই। তার ভাবনাদের ভুল প্রমাণ করে ইতি তাকে ফাঁকি দিয়েছে। পাড়ি জমিয়েছে এমন জায়গায় যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না কখনো।
বুকের ভেতর একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে রোদ। ব্যথা টা হয়তো থামবে না বরং বাড়তেই থাকে। এই ব্যথার হয়তো সবে শুরু। কখন রোদের অজান্তে তার চোখ গোলে গাল বেয়ে গরম পানি নেমেছে সে টের পায়নি। গালে অশ্রুর অস্তিত্ব টের পেতেই বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে তার। গলার কাছে যেন দম টা আটকে আছে। কান্নার দমকে সব তোলপাড় হয়ে আসে তার। কোনো একটা অনুভূতির বীজ বপন হয়েছিল রোদের অগোচরেই তার মনের জমিনে। এতদিন এই অনুভূতি সম্পর্কে অবগত নাহলেও এই মুহূর্তে সে ঠিক টের পাচ্ছে অজ্ঞানে জন্মা নেয়া এসব অনুভূতিদের অস্তিত্ব।
.
চলবে…