“রূপগঞ্জের রূপসী” পর্ব- ১০

0
1105

“রূপগঞ্জের রূপসী”
পর্ব- ১০
(নূর নাফিসা)
উৎসর্গে – Imran Mahmudul
.
.
ক্লাস শেষে মীরার সাথে ল্যাবের থেকে কিছুটা দূরে রাস্তায় দাড়িয়ে আছে নাফিসা রিকশা কিংবা সি এন জি এর অপেক্ষায়। মীরা যাবে এক রাস্তায় আর সে অন্য রাস্তায়। রাস্তায় গাড়ি চলাচল করছে তবুও গাড়ির অভাব! কেননা তাদের জন্য সিট ফাঁকা নেই! এইমাত্র এগিয়ে যাওয়া একটা গাড়ি সামনে চলে আবার পেছনে টেনে এলো। গ্লাস নামাতেই তারা দেখতে পেল ইমরান মাহমুদুলকে। গাড়ি থেকে নেমে সে তাদের পাশে এলে নাফিসা বললো,
” ইমরান ভাইয়া, আপনি হঠাৎ এখানে?”
এদিকে মীরা বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে গিয়ে বললো,
“ইমরান……! ও মাই গড! বিশ্বাস ই করতে পারছি না!”
ইমরান কিছুটা বিদ্রুপ স্বরূপ বললো,
“আচ্ছা? বিশ্বাস করার জন্য তাহলে কি করতে পারি এখন?”
এদিক নাফিসা মীরার হাতে খুব জোরে চিমটি দিয়ে বললো,
“বিশ্বাস হয়েছে?”
” আহ! তুই না! আসলেই একটা…! থাক, এখন বললাম না!”
নাফিসার প্রতি কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে আবার ইমরানের উদ্দেশ্যে বললো,
” সত্যিই আমি এক্সাইটেড! আজ এখানে দেখা হবে ভাবতে পারিনি। কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি?”
” আপনাকে দেখে ভালো না থাকতে পারি! যদি কিছু মনে না করেন একটি সেলফি তুলি?”
“শিওর…”
নাফিসা মনে মনে বলতে লাগলো,
“আহ! কি ঢং! যদি এমন হতো, আমার বিয়ে ঠিক না হয়ে মীরার বিয়ে ঠিক হতো তাহলে হয়তো এই মেয়ে দিনে চার বার হার্ট অ্যাটাক করতো । ধুর! আমিও কি বলছি! দুইবার হার্ট অ্যাটাক হলেই মানুষ সহজে বাচে না, চার বার হবে কিভাবে!”
এদিকে সেলফি তুলে ইমরান বললো,
” নাফিসা, গাড়িতে উঠো একসাথে যাই।”
“ধন্যবাদ, আমি এমনিতেই যেতে পারবো।”
মীরা নাফিসাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
“এমন সুযোগ কেউ মিস করে!”
নাফিসা তার আহ্লাদ দেখে বললো,
“তুই যা..”
“ইশ! আমাকে তো বলেনি! তাছাড়া আমার বাসা এইদিকে না।”
ইমরান নাফিসার কথার ভিত্তিতে বললো,
“সমস্যা কি! এক বাসায় ই তো যাবো।”
মীরা অবাক হয়ে বললো,
” একই বাসায় থাকেন আপনারা ?”
“হুম। কেন তুমি জানোনা?”
“না তো!”
ইমরান মীরাকে রকটু উস্কে দিতে বললো,
“কেমন ফ্রেন্ড তোমরা! এক জন অন্যজন সম্পর্কে জানো না!”
মীরা নাফিসাকে আবারও হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
“কিরে আগে তো কখনো বলিসনি!”
” বলবো কিভাবে! আগে তো কখনো থাকিনি। বেড়াতে এসেছি একই বাসায়।”
“আচ্ছা, জানাজানি পরে করো। এখন চলো, নাফিসা। ওইদিকে জ্যাম আছে, গাড়ি পাবেনা সহজে।”
“ওকে। মীরা তুই একা দাড়াতে পারবি?”
“যেন তোর পা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি! ”
ইমরান হাসলো আর নাফিসা ভেঙচি কেটে বললো,
“স্টুপিড একটা! সামনে হাটতে থাক, আল্লাহ হাফেজ।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
নাফিসা গাড়িতে উঠে সামনের সিটে ইমরানের পাশে বসলো। ইমরান ড্রাইভ করতে করতে বললো,
“ক্লাস তো মনে হয় আরো অনেক আগে শেষ হয়েছে। এতোক্ষণ দাড়িয়ে ছিলে?”
“না ভাইয়া, একটা কাজ ছিলো। দাড়িয়েছি মাত্র পাঁচ সাত মিনিট হবে।”
ভাইয়া ডাকে ইমরানের চেহারায় কিছুটা বিরক্তিকর ভাব প্রকাশ পেল। হয়তো সে প্রত্যাশা করছে না নাফিসার মুখে ভাইয়া ডাক! তবুও স্বাভাবিকভাবেই বললো,
“অহ, আচ্ছা।”
“ভাইয়া, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?”
“স্টুডিও তে।”
“ভাইয়া নতুন গান শুরু করেছেন?”
“না শুরু করিনি। কখন থেকে কি ভাইয়া ভাইয়া শুরু করেছো! ভাইয়া বলবে না আমাকে।”
“কেন! আপনিই তো বলেছেন ভাইয়া বলতে!”
“আমি বলিনি তোমাকে, ভাইয়া বলে ডাকতে। তুমি নাম ধরেও ডাকো না, কোনো কিছু বলে সম্মোধন কর না তাই এক্সামপল দিয়েছি। ভাইয়া ডাক শুনতে ভালো লাগছে না। আর ভাইয়া বলে ডাকবে না।”
“তাহলে কি বলবো?”
“নাম ধরে ডেকো।”
“না না, আপনি আমার চেয়ে কম হলেও ১০ বছরের বড় হবেন। নাম ধরে কিভাবে ডাকবো!”
“বাহ! এবার নানা বানিয়ে দিলে! তোমার বয়স কতো?”
“একুশে বছর শেষের দিকে ।”
“আমার বয়স ৩০ শুরু। তাহলে আমি ৮.৫ বছরের বড়। তবে বড়দের নাম ধরে ডাকা যায়।”
“আমি পারবো না।”
পারবো না শব্দটা খুবই বিরক্তিকর মনে হলো ইমরানের কাছে। তাই সে বললো,
” ওকে যা খুশি ডেকো।”
“আপনি তো আমার বেয়াই হন, বেয়াই বলে ডাকবো!”
ইমরান হাসতে শুরু করলো এবং গাড়িও গেলো থেমে! নাফিসা আশপাশ না দেখেই বলে উঠলো,
“গাড়ি থামালেন কেন!”
“এতো লম্বা জ্যাম কি চশমা পড়েও দেখতে পারো না!”
নাফিসা এবার চুপ করে বসে আছি। ঢাকার রাস্তা এজন্য একদম পছন্দ না! একটু পর পর ই জ্যামে আটকে যায়।হঠাৎই ইমরান নিঃসংকোচভাবে বলে ফেললো,
“নাফিসা, আমাকে কি তোমার ভালো লাগে না?”
নাফিসা সহজভাবেই জবাব দিলো,
“হুম, আপনার গানগুলো সবই আমার ফেভারিট।”
” ও তাই?”
“হুম। আমার ফোনের সেভেন্টি পার্সেন্ট গান আপনার।”
“আর বাকিটা?”
“বিশ পার্সেন্ট আরমান মালিক এর, দশ পার্সেন্ট অন্যান্য।”
“হাহাহা….. আমার চুল গুলো কেমন লাগে?”
কথাটা শুনে নাফিসা মুখ চেপে হাসলো। মানুষ চুলের প্রশংসাও শুনতে চায়! ইমরান তার উত্তরের আশায় বসে না থেকে বললো,
” পেয়ারা খাবে?”
“না। আমি এসব খাই না।”
“পেয়ারাতে প্রচুর ভিটামিন সি আছে, তুমি ডাক্তার হয়েই খাও না! পেশেন্টদের কি সাজেস্ট করবে?”
“ডাক্তার হলেই সব খেতে হবে! তাছাড়া আমি এখনো স্টুডেন্ট, ডাক্তার হইনি।”
“সেই একই কথা।”
জ্যাম এ আটকে আছে তারা। একটা ছোট ছেলে এসে নাফিসার কাছে হাত পাতলো টাকার জন্য। নাফিসা পার্সে হাত দিয়েও হাত সরিয়ে নিলো। তারপর গ্লাস লাগিয়ে সামনে তাকিয়ে রইলো। ইনরাম তার দিকের জানালা দিয়ে ছেলেটিকে ডেকে তার কাছে কিছু টাকা দিলো। জ্যাম আস্তে আস্তে ছাড়লে গাড়ি টেনে বাসায় পৌছে গেলো দুজন।
বাসায় ঢুকতেই নীলার সাথে দেখা হলো নাফিসার। আপু আর সুমন ভাইয়া সোফায় বসে টিভি দেখছে বাচ্চাদের সাথে। ইমরান ও নাফিসাকে একসাথে আসতে দেখে বললো,
” দুজন একসাথে এলে কিভাবে!”
নাফিসা জবাব দিলো,
” রাস্তায় দেখা হলো।”
“ওহ আচ্ছা।”
দুপুরে খাওয়ার পর, নীলা সোফায় বসে ডাকলো নাফিসাকে। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করে ফেললো, ইমরানকে তার কেমন লাগে? ইমরানের সাথে বিয়েতে সে রাজি কি না!
নাফিসা এর উত্তর কি দিবে তার নিজের ই জানা নেই। সে তো এই বিয়েতে রাজি না! মুখের উপর না ই বা বলবে কিভাবে! তাই কোনো উত্তর না দিয়েই চুপচাপ চলে গেলো সোজা শান্তা আপুর রুমে। শান্তা আয়াশের খেলনা গুছিয়ে রাখছিলো। নাফিসা কিছুটা মেজাজে বলে উঠলো,
.
“আপু এসব কি শুরু করেছো! আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না। বাদ দাও এসব।”
“মাইর দিবো একদম। খুব পাজি হয়ে গেছিস। ২ বছর ধরে তোর পিছনে কতো মানুষ পড়ে আছে বিয়ের জন্য। সবসময় একই কথা শুনছি, এখন বিয়ে করবি না। তাহলে কখন করবি! এবার আর তোর কোনো কথা শুনছি না! মেয়ে মানুষ কি সারাজীবন ঘরে রেখে দেয় কেউ! তোকে কি বিয়ে না দিয়ে বাসায় ই রেখে দিবো!”
” বললেই পারো তোমার বাসায় রাখবে না। আমি ইচ্ছে করে তো আর থাকছি না এখানে। চলে যাবো.. ”
“নাফিসা! কথা কোনদিক থেকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছিস! এসব ফাজলামো বন্ধ কর। ইমরান ভাইয়ার ফ্যামিলিতে সবাই রাজি। বাবামা কাল পরশু আসলে তারিখ ফাইনাল করবে।”
” কিহ!”
” হুম।”
রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো ইমরান। দরজা খোলাই ছিলো। দুই বোনের কথা শুনে ইমরান মৃদু হাসলো এই ভেবে,
মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি ঝড়ছে! ইউএসএ থেকে আসার সময় সে ভেবেছিলো নেহার মতো নাফিসাকেও বুঝাতে পারবে কি না! আর এদিকে এই মেয়ে এমনিতেই রাজি না! ভাবতে ভাবতে সে রুমে চলে গেলো।
.
এদিকে নাফিসার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে আপুর কথা শুনে। সে আপুর রুম থেকে গেস্ট রুমে এলো। গতরাতে ভাইয়াদের সাথে ইমরান এখানেই থেকেছে আর মেয়েরা বাচ্চাদের নিয়ে শান্তা ও সুমির রুমে। নাফিসা গেস্ট রুমে এসে দেখলো ইমরান রুমেই আছে। ইমরান তাকে উঁকি দিতে দেখে বললো,
“কিছু বলবে?”
নাফিসা এবার রুমে প্রবেশ করে বললো,
” হুম।”
“কি?”
“আপনার না গার্লফ্রেন্ড আছে! তাহলে আপনি বিয়েতে রাজি হয়েছেন কেন?”
“আমি কখন বললাম যে আমি রাজি!”
“কিহ! আপনি বলেন নি? মতামত না নিয়েই বিয়ের দিন ঠিক করছে!”
“আমি এসবের কিছু জানিনা। আমি কোনো মত রাখিনি বিয়েতে।”
” ওয়েট, আমি আসছি….”
নাফিসা দ্রুত পায়ে আবার চলে এলো শান্তার রুমে। শান্তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সে আর শান্তা বিরক্তি নিয়ে বলছে,
“আরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস!”
“এসো আমার সাথে।”
শান্তাকে গেস্ট রুমে এনে ইমরানের সামনেই নাফিসা বলতে লাগলো,
“বিয়ের জন্য ছেলেও রাজি না, মেয়েও রাজি না আর তোমরা সবাই মিলে বিয়ে ঠিক করে আছো! সংসার কি তোমরা করবে!”
শান্তা বিস্মিত হয়ে বললো,
“মানে কি এসবের! ইমরান ভাইয়া, আপনি কি রাজি না?”
ইমরান চেহারায় রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে বললো,
“আমি কখন বললাম যে আমি রাজি না!”
শান্তা নাফিসার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালো আর নাফিসা অবাক হয়ে ইমরানের উদ্দেশ্যে বললো,
“আশ্চর্য! এইমাত্র না বললেন আপনি বিয়েতে মত দেন নি!”
” হুম বলেছি, আমি বিয়েতে মত দেই নি। কারণ আমার কাছে মতামত চাওয়া ই হয়নি।”
নাফিসা শান্তাকে বললো,
“শুনো এবার।”
শান্তা ইমরানের কথায় অবাক হয়ে বললো,
“আপুরা কেউ জিজ্ঞেস করেনি, ভাইয়া?”
“না।”
শান্তা কিছুটা হতাশ হলো! কারণ, তার কাছে বলেছিলো তাদের সবার পছন্দ! তাই তো সে এ ব্যাপারে কথা বলেছিলো তার বাবামায়ের সাথে! আর নীলা চলে যাবে বিধায় কার্যক্রমও তারাতাড়ি সম্পাদনের চেষ্টা করছিলো তারা! তাহলে এখন এসব কি শুনছে! ওসব ভাবনা একপাশে ফেলে বিষয়টা পরিষ্কার করতে শান্তা বললো,
“ওহ! আচ্ছা, ভাইয়া এবার আমি আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি, আপনি কি এ বিয়েতে রাজি আছেন?”
ইমরান নাফিসার দিকে একপলক তাকিয়ে নির্দ্বিধায় বলে ফেললো,
” হ্যাঁ, আমি রাজি!”
ইমরানের কথা শুনে নাফিসার চোখ কপালে উঠার উপক্রম হয়েছে! এটা কি বললো! এমন আঁকাবাঁকা কথা কি করে বলতে পারে ইমরান! ক্ষণে বলে তার গার্লফ্রেন্ড আছে, ক্ষণে সে মত দেয়নি, ক্ষণে আবার বিয়েতে রাজি! নাফিসা রেগেমেগে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। এবং সিড়ি বেয়ে দৌড়ে ছাদে চলে গেলো। অসহ্য লাগছে সব! শক্ত করে রেলিং চেপে ধরে দাঁড়িয়েছে সে। কেননা রাগে গা ঝিমঝিম করছে তার! সাথে বদনে বিড়বিড় চলছে,
“এটা কেন বললো সে! গার্লফ্রেন্ড আছে তবুও বিয়েতে রাজি! কেমন জঘন্য মানুষ! ক্ষণে ক্ষণে গিরগিটির মতো রূপও পাল্টায়! কথার কোনো ঠিক নেই!”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here