“রূপগঞ্জের রূপসী”
পর্ব- ১১
(নূর নাফিসা)
উৎসর্গে – Imran Mahmudul
.
.
সিড়ি বেয়ে দৌড়ে ছাদে চলে গেলো। অসহ্য লাগছে সব! শক্ত করে রেলিং চেপে ধরে দাঁড়িয়েছে সে। কেননা রাগে গা ঝিমঝিম করছে তার! সাথে বদনে বিড়বিড় চলছে,
“এটা কেন বললো সে! গার্লফ্রেন্ড আছে তবুও বিয়েতে রাজি! কেমন জঘন্য মানুষ! ক্ষণে ক্ষণে গিরগিটির মতো রূপও পাল্টায়! কথার কোনো ঠিক নেই!”
পেছন থেকে ইমরান বললো,
” পাগলের মতো একা একা কথা বলছো কেন?”
নাফিসা পেছনে ঘুরে কিছুটা রাগান্বিত গলায়ই বললো,
“আপনি এখানে এসেছেন কেন?”
“তোমার সাথে কথা বলতে।”
“বিয়ে নিয়ে কিছু বলবেন না। আমি বিয়েতে রাজি না। না চাইলেও মানতে হবে। অন্য কথা হলে বলে ফেলুন।”
ইমরান ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো এবং রেলিংয়ের কাছ ঘেঁষে দাড়িয়ে নিচের দিকে একটু উঁকি দিলো পরিবেশটা দেখার জন্য। অত:পর আবার সোজা হয়ে দাড়িয়ে বললো,
“আমার জন্যই তো অপেক্ষা করে আছো, এখন তো আমাকেই পাচ্ছো তাহলে বিয়েতে রাজি নয় কেন তুমি?”
নাফিসা ভরকে গেছে তার কথায়! তবুও কথায় সামান্য জেদ নিয়ে বললো,
“মানে! কি বলছেন এসব! আপনার জন্য কেন অপেক্ষা করতে যাবো আমি!”
“ওহ, তাই তো! আচ্ছা, আমার তো গার্লফ্রেন্ড আছে সেজন্য না হয় আমি না করতে পারি, কিন্তু তোমার তো বয়ফ্রেন্ড নেই তাহলে তুমি বিয়েতে রাজি হচ্ছো না কেন?”
নাফিসা উঁচুনিচু ভবনের সীমান্তে তাকিয়ে আগের তুলনায় নরম গলায় বললো,
“আমার এখন বিয়ে করার ইচ্ছে নেই।”
ইমরান তার কথায় মজা পেয়ে বললো,
“তাহলে কখন করবে? বুড়ি হলে?”
নাফিসা আবার তার দিকে তাকিয়ে সামান্য বিরক্তির সাথে জবাব দিলো,
“হ্যাঁ, বুড়ি হলে যদি ইচ্ছে হয় তাহলে বুড়ি হলেই করবো।”
“ওকে, প্রব্লেম নেই। আমি বুড়ো হয়েও তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।”
“আপনি এসব কি বলছেন!”
” বুঝতে পারছো না তাইতো, রূপসী! ওকে আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি।”
নাফিসার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ইমরানের কথায়! সে বিস্মিত কন্ঠে বললো,
“রূপসী মানে! কে রূপসী!”
ইমরান মুখে তাচ্ছিল্যের হাসির রেখা ফুটিয়ে নাফিসার চশমা খুলে নিজের হাতে নিয়ে বললো,
“পরিস্থিতি বুঝি নিজেকেও নিজের কাছে অপরিচিত করে তুলে? জানা ছিলো না, আজ জানলাম সেটা। তুমি রূপসী। আমার পরিচিত সেই রূপগঞ্জের রূপসী। চশমা পড়ো কেন? কুরআন শরীফ তো চশমা ছাড়াই পড়তে পারো দেখলাম। আর এটা কি চশমা পড়েছো, কোনো পাওয়ারই তো নেই!”
“আরে! আমার চশমা নিয়ে নিলেন কেন! চশমা দিন..!”
“কি ভেবেছো তুমি, চোখে চশমা পড়ে, চুল স্ট্রেইট করে, শাড়ি বাদ দিয়ে লং কটি আর জিন্স পড়লেই আমার কাছ থেকে নিজেকে লুকাতে পারবে! ধরা তো পড়েছো আমার কাছে তিন বছর আগেই, শুধু তোমার দেয়া কষ্টে আমি মাথা খাটাতে লেট করে ফেলেছি। তারপর ভেবেছি দেশে ফিরে আর দেখাই করতে পারবো না। যেদিন দেশে ফিরি সেদিনই রূপগঞ্জ গিয়েছিলাম ছুটে। কিন্তু এদিকে পাখি যে আমার খাচায়ই বন্দী হয়ে আছে তা যে জানা ছিলো না!”
“দেখুন, আপনি কি বলছেন, কার কথা বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“ওফ! রূপসী, এই ড্রামা বন্ধ করো তো। মানছি তুমি খুব ভালো ড্রামা করতে পারো কিন্তু এসব ড্রামা আমাকে দেখিয়ে কোনো লাভ নেই।”
“আমি রূপসী নই। বার বার কেন একই কথা বলছেন! কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে যে আমি রূপসী।”
“অহ হ্যাঁ প্রমাণ, দাড়াও…”
ইমরান পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে ছবি এনে ফোনটা নাফিসার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“নাও, দেখো প্রমাণ। প্রতিদিন ল্যাবে ক্লাস শেষে এতিমখানার বাচ্চাদের সাথে খেলা, মীরার সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পেয়ারার ভর্তা খাওয়া আর আমি বলাতে বলেছো পেয়ারা খাও না, আমি পাশে ছিলাম বলে ছোট বাচ্চাটিকে সাহায্য না করতে পেরে আড়ালে চোখের পানি মুছা, পার্সে হাত রেখেও সরিয়ে নেওয়া, সকালে ঘুম থেকে উঠে কুরআন শরীফ পড়া, বিছানার পাশে আমার ছবি নিয়ে ঘুমানো। সব প্রমাণ দিতে আমি প্রস্তুত। তোমাকে আপুর বাসায় দেখার পর থেকেই ফলো করে যাচ্ছি। এতো ভালো ড্রামা করে লাভটা কি হলো, আমি যে ফলো করছিলাম সেটাই তো ধরতে পারলে না!”
নাফিসা ইমরানের হাতে ফোন দিয়ে বললো,
“দেখুন আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। রূপসী ছাড়া যে কাজ গুলো অন্যকেউ করতে পারে না এমন তো নয়! আমি আপনার ছবি নিয়ে ঘুমাই না, আরোশি আমার সাথে থাকে রাতে, সে ই ছবি নিয়ে দুষ্টুমি করে। আমি নাফিসা। নূর নাফিসা।”
“তাহলে কি এখন আমাকে বিশ্বাস করতে বলবে যে তোমার যমজ টমজ বোন আছে! তাহলে তো দুইটা বিয়ে করতে হবে আমাকে! বলা তো যায় না, শালিকে যদি আবার বউ ভেবে ফেলি!”
“সবসময় মজা ভালো লাগে না৷ আপনার যদি কোনো সন্দেহ থাকে, আপনি আমার সকল সার্টিফিকেট চেক করতে পারেন।”
“আচ্ছা, তাহলে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছো না কেন? চশমা ছাড়া আমাকে দেখতে পাও না নাকি? ধরা পড়ে এখন আরোশির অজুহাত দেখাচ্ছো সবটা। কুরআন পাঠের সুর নিশ্চয়ই সবার এক হয় না!”
ইমরানকে অসহ্য লাগছে এখন। তাই নাফিসা আর কিছু না বলে চলে যেতে নিলো কিন্তু সম্ভব হলো না! ইমরান খুব কঠিন গলায় বললো,
“এক পা ও নড়বে না এখান থেকে..”
তবুও নাফিসা না থেমে পা বাড়াতে নিলো, এমনি ইমরান খপ করে নাফিসার দুবাহু শক্ত করে চেপে ধরে নাফিসাকে একদম তার কাছে টেনে আনলো। নাফিসা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলছে। কান্না পাচ্ছে তার! ইমরান জেদি কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,
“এই মেয়ে, তুমি না নিয়মিত নামাজ পড়, কুরআন পড়! তাহলে এতো মিথ্যা বলতে পারো কিভাবে? তাকাও আমার দিকে, তাকাও….!”
নাফিসা অশ্রুসিক্ত নয়নে ইমরানের দিকে তকালে সে আবার বলতে লাগলো,
“এবার বলো যে, তুমি রূপসী না। বলো….”
নাফিসা আর কোনো কথা বলতে পারলো না। নিরবে তার চোখ বেয়ে অশ্রু ধারা বইতে লাগলো। চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়েছে সে। ইমরান দাতে দাত চেপে বললো,
“বলছো না কেন এবার? এখন চুপ কেন? মানুষ চোখে চোখ রেখে কখনো মিথ্যে বলতে পারে না। সেটা নিশ্চয়ই তোমারও অজানা নয়।”
নাফিসাও নিচু শব্দে ধাধানো কন্ঠে উচ্চারণ করলো,
“আমার হাতে ব্যাথা লাগছে।”
এবার ইমরান হাত ছেড়ে দিয়ে ঠিক হয়ে দাড়ালো। নাফিসার চশমা টা সে নিজেই আবার পরিয়ে দিতে দিতে বললো,
“আমার রূপসীকে চেনার জন্য কোনো প্রমানের প্রয়োজন নেই আমার। ছবি গুলো তোমাকে দেখানোর জন্যই তুলেছিলাম। এখানে এসে প্রথম দেখার পর আমার এক সেকেন্ডও সময় লাগেনি তোমাকে চিনতে। শুধু দেখতে চাইছিলাম তুমি আমার সাথে কেমন বিহেভ কর! যেই বুঝলাম অচেনা হিসেবে আমার সাথে ড্রামা শুরু করেছো, সেই থেকে ফলো করছিলাম।
আপুরা তোমাকে ছবিতে দেখেছে, তাই হয়তো চিনতে পারেনি। কিন্তু আমি তোমাকে রূপগঞ্জে মাত্র পাঁচ দিন দেখার পর, তোমার সাথে সময় কাটানোর পর খুব ভালোভাবে চিনে ফেলেছি। যা মৃত্যুর আগে কখনোই হয়তো ভুলতে পারবো না। নিজের কষ্ট চেপে রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারো তুমি খুব সহজেই। তবে তুমি তার কষ্টটা বুঝার চেষ্টা মোটেও করো না, যে তোমার জন্য কষ্ট পায়!”
নাফিসার চোখ দিয়ে এখনো নিশব্দে পানি পড়ছেই চোখের পানি মুছতে মুছতে সে নিচু স্বরে বললো,
“আপনার না গার্লফ্রেন্ড আছে, তাহলে আমাকে ফলো করছিলেন কেন?”
“হুম গার্লফ্রেন্ড আছে। আর ফলো তো গার্লফ্রেন্ডকেই করছিলাম! আমার প্রতিটি দিন শুরু ও শেষ হয় তোমাকে নিয়ে তুমি কি সেটা জানো? কখনো জানতে চেষ্টা করেছো, তোমাকে নিয়ে আমার ফিলিংসটা কেমন? গত দিনগুলোতে এক মুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি আমি তোমার স্মৃতি।”
নাফিসা রেলিং চেপে ধরে ইমরানের বিপরীতে মুখ করে দাড়িয়ে আছে। কান্না থামেনি তার, কেন জানি প্রচুর কাদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার কারণ জানা নেই। উপযুক্ত কোনো জায়গাও খুজে পাচ্ছে না কাদার জন্য! ঠোঁট কামড়ে শুধু কান্না কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে সে! ইমরান তাকে চুপ থাকতে দেখে বললো,
“চুপ করে আছো কেন তুমি? এখনো কি অস্বীকার করবে?”
নাফিসা এক হাতে চোখ মুছে বললো,
“কেউ, যেন রূপসী সম্পর্কে এসবের কিছুই না জানতে পারে। ভুলে যান রূপসী বলে কেউ ছিলো….”
হঠাৎই পেছন থেকে নীলার কণ্ঠে ভেসে এলো,
” কেন? কেউ জানলে কি হবে?”
নাফিসা ও ইমরান দুজনেই চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখে নীলা, সুমি ও শান্তা দাড়িয়ে আছে! নাফিসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ইমরানের দিকে! তার ধারণা ইমরান জানিয়ে এসেছে এখানে! এদিকে নাফিসাকে এভাবে তাকাতে দেখে ইমরান বললো,
“আমার দিকে এভাবে তাকাও কেন? আমি কিছু বলিনি, যা বলার তুমিই বলেছো।”
এদিকে নাফিসার উদ্দেশ্যে নীলার উক্তি,
“কেউ জানলে কি হবে, বলো? দুজনকে একে অপরের থেকে আলাদা করে দিবে? নাকি দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিবে?
কোন ভয়টা পাচ্ছো?”
নাফিসা অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে রাখলো। নীলা এগিয়ে এলো নাফিসার কাছে। আর ইমরান দুহাত ভাজ করে রেলিং এ হেলান দিয়ে দাড়ালো। নাফিসার উদ্দেশ্যে নীলার উক্তি,
“খুব কষ্ট পেয়েছো সেদিন, তাই না? কষ্ট পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবুও সরি, সবকিছুর জন্য। তবে সেদিন তোমার যোগ্যতা ইমরানের চেয়ে অনেক নিম্নস্তরে ছিলো যেটা আজ নেই। এমনও হতে পারতো এই স্তর নিয়েই নিজেদের সাংসারিক জীবনে কোনো ঝামেলা সৃষ্টি হতো! নিজেরাই হয়তো মানিয়ে নিতে পারতে না একে অপরের সাথে। তাই আমি বলেছি উক্ত কথাগুলো।”
“আপু সরি বলছো কেন ! শুনতে খারাপ লাগলেও হয়তো থেকে তোমার কথাগুলো সত্য ছিলো।”
“আচ্ছা, তাহলে একবার আপুকে জরিয়ে ধরো….”
নাফিসা জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে নীলার সাথে কুশলাদি বিনিময় করলো। নীলা মুচকি হেসে বললো,
“এখন তো আর বিয়েতে কোনো সমস্যা নেই, হুম?”
নাফিসা দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে মুচকি হাসার চেষ্টা করলো।
নীলা ইমরানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“কি সাহেব! আপনার নাকি মতামত ই নেই নি আমরা! তো বলেন এবার, বিয়ে ঠিক করবো? নাকি, এখনো বলবেন ভালো লাগছে না বিয়ের কথা শুনতে!”
ইমরান মাথা চুলকাতে-চুলকাতে বললো,
” শান্তা ভাবির কাছে মতামত জানিয়ে দিয়েছি তো, এখন তোমরা যা ভালো মনে করো তা ই….!”
সুমি বললো,
“আচ্ছা! এখন মনের মানুষকে পেয়েছেন বলে আমরা যা মনে করি তা ই! তাহলে আমরা মনে করে নেই নাফিসার সাথে বিয়ে দিবো না। হুম?”
“ওকে, না দাও। কখনো বিয়েই করবো না!”
সুমি নীলা একজোটে হেসে উঠলো। শান্তা কোনো কিছু না বুঝতে পেরে বললো,
“কি বলে যাচ্ছো তোমরা! আমি তো এসবের কিছুই বুঝতে পারছি না!”
নীলা তার জবাব দিলো,
“আগে আংকেল আন্টি কে কল করে বলো কালই যেন আসে ডেট ফাইনাল করতে আর কালই এনগেজমেন্ট হবে তাদের। বাকি ঘটনাটা নিচে গিয়ে বলবো।”
“ওকে।”
তারা ছাদ থেকে সুমির রুমে এসে কথা বললো। নীলা যতটুকু জানে তা বললো বাকিটা ইমরান বললো। কিন্তু নাফিসা এখানে উপস্থিত ছিলো না। সে পড়ার অজুহাতে কেটে পড়েছে তাদের কাছ থেকে। তাদের কথপোকথন শুনে শান্তার উক্তি,
“অহ! তাহলে এই ব্যাপার! এজন্যই নাফিসা আমাদের বলেছিলো, রূপগঞ্জের কথা যেন তার সামনে কখনো উচ্চারণও না করি!”
ইমরান শান্তার দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
” ভাবি, নাফিসা কি আপনার আপন বোন?”
” হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”
” আমি তো সেখানে তার সাথে শুধু একজন মহিলাকে দেখেছিলাম যাকে আম্মা বলে ডাকতো। তাই জিজ্ঞাসা করলাম।”
“নাফিসা আমার আপন বোনই। আমরা ২বোন এক ভাই। যাকে আম্মা বলে ডাকতো, আমরা ছোট থাকতে তিনি আমাদের বাসায় কাজ করতেন। উনার এক ছেলে ছিলো, সে ও অসুস্থতায় অকালে মারা যায়। আপন বলতে তার আর কেউ ছিল না। আমাদের খুব ভালোবাসতেন। আমরা বড় হওয়ার পর মা ই সব কাজ একা করতে পারে। তাই আম্মাকে কাজে রাখার প্রয়োজন ছিলো না। কিন্তু আম্মা আশ্রয়হীন হওয়ায় মা বাবা আমাদের গ্রামের বাড়ি দেখাশুনোর জন্য আম্মাকে বলেছেন সেখানে থাকতে। আর আমরা মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতাম সেখানে। সেখানে আমাদের অনেক জমিজমা ছিলো। ফসলের মাঠ, পুকুর, বাড়ি, আর বাড়ির চারপাশে বিভিন্ন ফলের গাছ। নাফিসা স্কুল কলেজ দুতিন দিনের জন্য ছুটি হলেও সেখানে চলে যেতো। রূপগঞ্জ তার খুব প্রিয়। আর আপনি যে সময়ের কথা বললেন, তখন নাফিসা এইচএসসি এক্সাম শেষ করে বেড়াতে গিয়েছে। কোচিং শেষ করে অনেক দিন থেকেছে সেখানে। আর ছোট বেলায় আম্মা ওর নাম দিয়েছিলেন রূপসী। তাই আশেপাশের সবাই রূপসী বলে ডাকতো। আম্মা তিন বছর আগে মারা যাওয়ার পর আর সেখানে যাওয়া হয়নি। কারণ সেই বছরই সিটি করপোরেশন সব জমি কিনে নিয়েছে। বাবা জমি বিক্রি করাতে নাফিসা ছয়দিন বাবার সাথে কোনো কথা বলেনি। এটা তাকে কিছুতেই বুঝতে পারিনি যে, সবার জমি কিনে নিয়েছে আমাদের টা কি রেখে যাবে!”
নীলা বললো,
“খুব অভিমানী নাকি, নাফিসা?”
“হুম।”
ইমরান আবার জিজ্ঞেস করলো,
“আপনারা ছোট থেকেই সাভার থাকেন?”
” হ্যাঁ, নাফিসার বয়স যখন দুএক বছর তখন থেকেই। ঢাকার স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে পড়াশোনা আমাদের।”
আরও কিছুক্ষণ তাদের মধ্যে আলোচনা চললো।
.
এখন সকাল ৮:৩০ বাজে। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকে আর নাফিসা কে দেখেনি ইমরান। জরুরি ভিত্তিতে না খুজলেও দৃষ্টি খুঁজে বেড়াচ্ছে ঠিকই। বাসায় নেই নাকি! এমনি পারভেজ তার দৃষ্টিকে কেন্দ্র করে জিজ্ঞাসা করলো,
“কাউকে খুজছো নাকি?”
ইমরান হাসিমুখে স্বাভাবিকভাবেই বললো,
” হুম, নাফিসাকে দেখছি না।”
“রুমে নেই?”
“না। কোথাও বের হয়েছে নাকি!”
“কোথায় যাবে, আজ তো তোমাদের এনগেজমেন্ট! দেখো ছাদে হবে হয়তো। আর না হয় কিচেনে।”
” ভাইয়া, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“অফিসে যাবো।”
“আজও যেতে হবে?”
“এসে পড়বো দুপুরের দিকে। সুমন ভাই আর পাবেল দেখবে এদিকটা।”
“ওকে।”
পারভেজ চলে গেলে ছাদে গেলো ইমরান। কিন্তু নাফিসা এখানে নেই। ড্রয়িং রুমে মা আর আন্টি বাচ্চাদের নিয়ে বসে আছেন। এখানেও নাফিসা নেই। কিচেনে গিয়ে দেখলো শান্তাভাবি , সুমি আপু, নীলা আপু আছে। কিন্তু নাফিসা কোথায়! ইমরানকে কিচেনে উঁকি দিতে দেখে সুমি বললো,
“কিরে কিছু বলবি?”
“আপু, নাফিসা কোথায়?”
“রুমে দেখ।”
“দেখেছি কোথাও নেই।”
শান্তা সামান্য বিস্মিত হয়ে বললো,
“নেই মানে! সকালেই তো দেখলাম উঠে নামাজ পড়লো। আমি না ও করে এলাম আজ ল্যাবে যেতে!”
নীলা শান্তার উদ্দেশ্যে বললো,
” কল করে দেখো কোথাও বের হয়েছে কিনা।”
শান্তা ফোন হাতে নিয়ে কল করলো। একবার কেটে গেলো। পরের বার রিসিভ হলো।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কোথায় তুই?”
“ল্যাবে এসেছি।”
“তোকে না নিষেধ করলাম ল্যাবে যেতে! আর এতো সকালে তুই ল্যাবে কেন?”
“ল্যাবে মাত্র আসলাম। আজ কিছু টেস্ট আছে। শীট গুলো একজনের কাছ থেকে নিতে হয়েছে। তাই সকালে বের হয়েছি।”
“আজ টেস্ট আছে সেটা আগে বললি না কেন?”
“মনে ছিলো না।”
“সামনে পেলে যে এখন কি করতাম তোকে!”
শান্তাকে রাগান্বিত হয়ে কথা বলতে দেখে নীলা বললো,
“প্রব্লেম নেই, বিকেলে হবে এনগেজমেন্ট।”
এদিকে শান্তা জোর গলায় বললো,
“টেস্ট শেষ হওয়ার সাথে সাথে দ্রুত বাসায় চলে আসবি।”
“ওকে।”
.
নাফিসার কোনো টেস্ট ছিলো না। সে এসেছিলো কমলাপুর রেলস্টেশনে, চিটাগং চলে যাওয়ার জন্য। তার কলেজ ফ্রেন্ডের বাসা আছে সেখানে। গতরাতেই সে বন্দোবস্ত করে রেখেছিলো সব। কিন্তু স্টেশনে এসে জানতে পারলো আজ সকালে কোন ট্রেন নেই! দুপুর ১টায় ট্রেন! সকাল থেকে এখানেই বসে আছে সে। এখন বাজে ১২:২০। এই পর্যন্ত পানি ছাড়া কিছু খায়নি। কি-ই বা খাবে! কিছু ভালো লাগছে না খেতে। তার এই বিয়ে করার একদম ইচ্ছে নেই। কারণ, এমনিতে সকলের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করলেও তিন বছর আগের আঘাতগুলো তাকে থমকে দিয়েছে! ভালোবাসা প্রকাশ না করতে পারা, কারো কটু কথা, কাউকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেওয়া, আম্মার মৃত্যু, রূপগঞ্জকে হারিয়ে ফেলা। এতে কার দোষ দেয়া যায়! কারো দোষ নেই। কিন্তু আগের জীবনের মতো কোনো মজা সে পায় না। এখন শুধু ব্যস্ততার মাঝে সময় কাটছে। কোথাও বেড়াতেও যেতে পারেনা। তার উপর বিয়ে হলে জীবন আরও ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তাছাড়া ইমরানকে দেখলে পুরনো সব আঘাত গুলো মনে পড়ে যায়। এই বিয়েতে তার মাঝে শান্তি কিভাবে আসবে! এই আঘাতগুলো নিয়ে সারাজীবন কিভাবে কাটাবে সে! না পারছে ইমরানকে আপন করে নিতে, আর না পারছে ভুলে যেতে! একদম ই ভালো লাগে না এসব। তাই সিদ্ধান্ত নিলো কিছুদিন চিটাগং থেকে আসবে। সেখানে গিয়ে কোনো অজুহাতে বাবাকে ফোন করে বুঝিয়ে বললেই হবে। স্টেশনে ওয়েটিং সিটে বসে এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তার খেয়ালই নেই।
ঘুম ভাঙলে দেখলো সে খাটে শুয়ে আছে! এটা কিভাবে সম্ভব! সে তো স্টেশনে ছিলো! ঝটপট উঠে বসে পড়লো নাফিসা! চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো কারো রুমে আছে সে! এটা কার বাসা! চোখ ভালোভাবে কচলে আবার চারিদিকটা দেখলো। হ্যাঁ, সে কারো রুমে আছে। কেউ কি তাকে কিডন্যাপ করেছে! সেই যে মেসেজ পাঠিয়েছিলো, সে নয়তো আবার!