“রূপগঞ্জের রূপসী”
পর্ব- ১৩
(নূর নাফিসা)
উৎসর্গে – Imran Mahmudul
.
.
আংটি পড়ানোর সময়,
নাফিসার মাথায় দুষ্টুমি চাপলো। ইমরান যখন আংটি পড়াতে গেলো, নাফিসা তখন হাত মুঠ করে রাখলো! ইমরান তার দিকে ব্রু কুচকে তাকালে নাফিসা ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে একে একে সব আঙুল সোজা করতে লাগলো। সব শেষে অনামিকা আঙুল বের করেছে সে। তার দুষ্টুমিতে ইমরান নিশব্দে হেসে আংটি পড়িয়ে দিলো। প্রথমে আপু ভাইয়ারা একটু অবাক হলেও এবার সবাই হেসে উঠেছে।
অত:পর যারা দুপুরে খায়নি তাদের খাওয়াদাওয়া চললো। তারপর নাফিসা ছাদে চলে এলো। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে সে। আর এক মুহুর্ত দেরি না করে ইমরানও চলে এলো ছাদে। যেনো একটু একা পাওয়ার সুযোগই সে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। অতি খুশিতে ইমরান জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়ালেই নাফিসা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“এই, একদম না!”
“একবার.. ”
“না।”
“রূপসী, শুধু একবার। অল্প সময়ের জন্য…”
“উহুম, বিয়ের আগে টাচও করবে না। বলে দিলাম।”
ইমরান হাত নামিয়ে বললো,
“ওকে।”
অত:পর রেলিংয়ের কাছ ঘেঁষে দাড়িয়ে নিজের হাত মুঠো করে রেলিংয়ে হালকা বারি দিল ইমরান। তারপর আবার নাফিসার সামনে দাঁড়িয়ে দুপাশে রেলিংয়ে তার দুহাত রেখে নাফিসাকে বন্দী করে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
“না-ই বা করলাম টাচ! দেখতে তো পারবো?”
নাফিসা লজ্জায় ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ইমরান পলকহীন তাকিয়ে বললো,
” রূপসী, বিয়ের পরও মাঝে মাঝে আমাকে রাগিয়ে এমন সারপ্রাইজ রেডি রাখবে।”
নাফিসা নিচু স্বরে লজ্জিত কণ্ঠে বললো,
“বাইরে বেরিয়ে গেলে ধরে আনার জন্য আবার কাকে পাঠাব?”
“ফোনে কল বা মেসেজ দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করবে।”
“ইশ! সব ঠেকা আমারই পড়ছে!”
“হুম পড়েছে। কতো দিন পর এভাবে দেখলাম,এতো কিউট কেন তুমি!”
“জানিনা, চুপ।”
“তোমার চুলগুলো আগের চেয়ে অনেকটা বড় হয়েছে। তবে স্ট্রেইট না করলেও পারতে। ওটাই মানিয়েছিল।”
“স্ট্রেইট করিনি। স্ট্রেইট করলে এমন হয় বুঝি! আরো সুন্দর থাকতো। এটাই আমার চুলের প্রকৃত সোন্দর্য।”
“উহুম, আগে এমন ছিলো না।”
“আগেও এমনই ছিল, ইচ্ছে করে এলোমেলো করে রাখতাম তাই অন্যরকম দেখাতো।”
“আচ্ছা!”
“হুম। সরুন, নিচে যেতে হবে। বাসায় চলে যাবো বাবামায়ের সাথে।”
” কেন?”
“বা রে! আমি আমার বাপের বাড়ি থাকবো না!”
“পরশু দিন না মাত্র এলে!”
“২৪ ঘন্টাও থাকতে পারিনি।”
“আবারো কি পালানোর চেষ্টা করছো?”
নাফিসা মাথা দু’দিকে নাড়াতেই ইমরান বললো,
“ওকে। তাহলে আরো কিছুক্ষণ থাকো আমার সামনে।”
“না, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। বাবামা আবার চলে যাবে আমাকে রেখেই।”
ইমরান কথায় সামান্য বিরক্তি এনে বললো,
” সবসময় না না আর না! উত্তর গুলো হ্যাঁ হতে পারে না!”
নাফিসা মুচকি হেসে আবারও বলে উঠলো,
“না।”
অত:পর ইমরানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিচে চলে এলো। দেখলো, সত্যিই বাবামা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। নাফিসা যেন তারাহুরো করেই বলে উঠলো,
“মা, আমিও তোমাদের সাথে চলে যাবো।”
সুমি তার কারণ জানতে চাইলে নাফিসার মা ই জবাব দিলো,
“যাক না। আর মাত্র চৌদ্দ দিন পরই তো বিয়ে। এই কয়টা দিন আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকুক।”
“আমি বুঝি কেউ না?”
“আরে পাগলী মেয়ে, তুমি ই তো আমার বড় মেয়ে।”
সুমি হাসলে নাফিসা বিস্ময়করভাবে বললো,
“চৌদ্দ দিন পর বিয়ে মানে! এতো তাড়াতাড়ি কেন!”
“তাড়াতাড়ি কোথায়! আমি তো চেয়েছিলাম আরো তাড়াতাড়ি করতে। সামনের মাসে আপু চলে যাবে আবার তোর ক্লাস স্টার্ট হয়ে যাবে। বিয়ের কোনো আনন্দই হবে না!”
নাফিসা এ নিয়ে আর কিছু না বলে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“চলো এবার। বাসায় গিয়ে যেন মাগরিবের নামাজ পড়তে পারি।”
অত:পর তারা বিদায় নিয়ে বাসায় চলে গেলো। আসার সময় বাসা থেকে বেরিয়ে নাফিসা ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলো ইমরান সেখানেই দাড়িয়ে আছে। সাঈদও দেখে আবার ইমরানকে হাতে ইশারা করে টাটা জানিয়ে এসেছিলো। তখন ইমরানের পাশে সুমন ভাইয়া এবং বাচ্চারা ছিলো। ইমরান উপর থেকে সাঈদকে ডেকে কিছু বলেছিলো। কিন্তু নাফিসা তাদের কথা বুঝেনি কিছুই।
বাসায় নামাজ পড়ে পাঠ্যবই পড়তে বসেছে নাফিসা। কিছুক্ষণ পর ইমরান কল করলো। নাফিসা রিসিভ করে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কি করছে এখন আমার রূপসী?”
“আমি কি জানি! রূপগঞ্জ গিয়ে দেখে আসুন।”
“সবসময় কথা উল্টো দিকে ঘুরাও কেন! তুমি এখন কি করছো?”
“পড়তে বসেছি।”
“এখনো কি শাড়ি পড়ে আছো?”
“না।”
“পাশে কে আছে?”
“সাঈদ।”
“সাঈদের কাছে দাও।”
“ওকে।”
সাঈদ ফোন হাতে নিয়ে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কি করছো?”
“পড়তে বসেছি।”
” ওহ্ আচ্ছা, ফোনের লাউড স্পিকারটা অফ করো।”
নাফিসা চোখের পরিধি বড় করে তাকালো! সে বুঝলো কিভাবে ফোন লাউডস্পিকারে রেখে সাঈদকে দিয়েছে!
সাঈদ হেসে বললো,
“ওকে। করেছি।”
“এবার ভিডিও কল দেই তুমি রিসিভ করবে, আর নাফিসার দিকে ক্যামেরা রাখবে। ওকে?”
” ওকে।”
ইমরান ভিডিও কল দিলে সাঈদ রিসিভ করে ক্যামেরা নাফসার দিকে রাখলো। ইমরান দেখতে পেল নাফিসা কিছু লিখছে। শাড়ি চেঞ্জ করে ফেলেছে সে। চুল গুলো এলোমেলো ভাবে হেয়ার ব্যান দিয়ে বেধে রেখেছে। আর ছোট ছোট চুলগুলো সিলিং ফ্যানের বাতাসে বারবার তার মুখে এসে পড়ছে আর সে বিরক্তি নিয়ে কানের পেছনে গুজে দিচ্ছে।
এদিকে সাঈদের কোনো কথা শুনতে না পেয়ে নাফিসা চোখ তুলে তাকালো তার দিকে। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে সে বিস্মিত! ইমরান ভিডিও কলে আছে! নাফিসা সাথে সাথে খাতা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো এবং বললো,
“সাঈদ তুই ভিডিও কল রিসিভ করেছিস কেন!”
ওদিকে সাঈদের আগে ইমরান জবাব দিলো,
“আমি বলেছি তাই…”
নাফিসা এবার খাতা সরিয়ে টেবিলে রেখে ফোন হাতে নিয়ে বললো,
“কেন?”
“দেখবো বলে…”
“কিছুক্ষণ আগে না দেখা করে এলাম!”
“মন ভরেনি।”
“আযান দিচ্ছে, নামাযে যান।”
“এমন কেন তুমি! একটু রোমান্টিক তো হতেই পারো রূপসী। আমাদের এখানে এখনো আযান দেয়নি।”
“ওযু করতে থাকুন। এখনি দিবে। আল্লাহ হাফেজ।”
ইমরানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো নাফিসা।
সময় রাত এগারোটা। খাটে বসে হাতের রিং টা ঘোরাচ্ছে এদিক সেদিক। আর চোখ থেকে টুপটাপ ফোঁটা পড়ছে গাল গড়িয়ে। কিছুক্ষণ আগে ইমরান কল করেছিলো, কিন্তু রিসিভ করেনি নাফিসা। সে তো এমনিতে স্বাভাবিকই আছে তাহলে ইমরানের কথা মনে হলে কেন শুধু কান্না আসে! সেই কারণ নিজেও জানে না। তার প্রতি ইমরানের কেয়ারনেস স্পষ্ট হলেও ইমরানের প্রতি তার মাঝে তেমন কোনো ফিলিংস উপলব্ধি করতে পারছে না নাফিসা। শুধু বেদনাটাই অনুভব করতে পারে! রূপগঞ্জ যখনই ইমরানকে দেখতো, তখনই যেন অন্যরকম এক আনন্দ ও ভালোলাগা অনুভব করতে পারতো৷ সকালে দেখা হলে দুপুরের দর্শনেই নতুনভাবে অনুভব করতো! দুপুরে দেখলে বিকেলের দর্শনেই আবারও নতুনভাবে অনুভব করতো। এভাবে প্রতিটি মুহুর্তে প্রতিটি দর্শনে সে নতুনভাবে অনুভব করতো সেই মানুষটাকে! আর আজ! আজ এতোটা চেষ্টা করেও সেরকম কোনো অনুভূতি জাগাতে পারছে না মনে! কেন? মন কি চায় না তাকে! না চাইলে শুধু শুধু এই সম্পর্ক গড়ে উঠবে কেন! নাহ! সম্পর্ক যদি স্থায়ী না হয় তাহলে তো এমন সম্পর্ক গড়ারই প্রয়োজন নেই! আর সম্পর্কে ভালোবাসা না থাকলে, বন্ধন অটুট না হলে তা স্থায়ী হবে কিভাবে! সম্পর্ক গড়ে উঠার আগেই এর একটা নিরীক্ষা করা দরকার। কিন্তু কিভাবে কি করবে!
নাফিসা ইমরানকে কল করলো। একটু দেরি করে প্রথম কলটাই রিসিভ হলো।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। ঘুমাওনি এখনো। পড়াশোনার চাপ বেশি?”
“উহুম। আপনি ঘুমাননি কেন?”
“আমি তো একটু বদ অভ্যাসে জর্জরিত। লেট করে ঘুমাই আবার লেট করে উঠি। কল দিয়েছিলাম একটু আগে।”
“দেখেছি। ইচ্ছে করেই রিসিভ করিনি।”
বিপরীতে ইমরানের কোনো জবাব এলো না। নাফিসা কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বললো,
“আপনি কি রাগ করেছেন? রাগ করলেও একটা সত্য জানানো খুব বেশি জরুরি মনে করছি। আমি কেন জানি আপনাকে আগের মতো ফিল করতে পারি না। আপনাকে দেখলে আগে যেমন ভালো লাগা কাজ করতো এখন একটুও ভালো লাগা অনুভব হয় না! যখনই আপনাকে স্মরণ করার চেষ্টা করি তখনই বিষন্নতা অনুভব করি! মাঝে মাঝে বিরক্তিকরও মনে হয়। আর সেজন্যই আমি আপুর বাসা থেকে বারবার নানান অজুহাতে চলে আসি।”
মুহুর্তেই যেন ইমরানের কণ্ঠ বদলে গেছে! কিছুটা জিদ্দি কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,
“কষ্টে হোক আর অভিমানে হোক, দুপুরেও আমি পারভেজ ভাইয়ার কাছে বলে দিয়েছিলাম এনগেজমেন্ট ও বিয়ে সব ক্যান্সেল করে দিতে! তুমি, শুধুমাত্র তুমি চেয়েছিলে বলেই কিন্তু এনগেজমেন্ট হয়েছে আজ। এখন এসব বলে কি সকলের বিশ্বাস ভাঙতে চাইছো নাকি আমাকে হাসির পাত্র হিসেবে দাড় করাতে চাইছো? কোনটা?”
“এমন কিছুই আমি চাইছি না। কাউকে ঠকানোর ইচ্ছাও আমার নেই, কারো বিশ্বাস ভাঙার ইচ্ছাও আমার নেই, কাউকে হাসির পাত্র হিসেবে দাড় করানোর ইচ্ছাও আমার নেই। আমি অনিচ্ছাও প্রকাশ করতে পারছি না আবার শত চেষ্টার পরেও স্বাভাবিক হতে পারছি না। নিজেকে পাগল ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছি না আপাতত! আমি কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। আর বললেও কেউ কিছু বুঝবে না! হয়তো আমার কথাবার্তায় উল্টো বকাঝকা করবে কিংবা জোরজবরদস্তি করবে৷ কিন্তু একবারও বুঝতে চেষ্টা করবে না আমাকে যে, আমি কি বুঝাতে চাইছি! আমার ভেতরে কেমন যেন চাপা পড়ে আছে বিষয়গুলো। কারো সাথে শেয়ার করলে কেউই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে নিবে না। আপনিও নিচ্ছেন না আমি জানি সেটা। হয়তো নেওয়ার মতোই না। তবুও একটু চাপমুক্ত হতে আমি জানাতে বাধ্য হয়েছি। সত্যি বলছি, আমি কারো বিশ্বাস ভাঙতে চাইছি না। আপনাকেও হাসির পাত্র বানাতে চাইছি না।”
ইমরানের গলা কিছুটা নরম হয়ে এলো।
“তো, এখন কি চাইছো?”
“জানি না! আমি নিজেই জানি না আমি কি চাই আর আমার কি করা উচিত! শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি, কোনো একটা কূল ধরে অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণা থেকে একটু মুক্তি পাওয়াটা জরুরী। কিন্তু কোন কূল রেখে কোন কূল আঁকড়ে ধরবো ভেবে পাচ্ছি না!”
কথা বলতে বলতে নাফিসার গলা ধরে এসেছে! অশ্রুবিন্দু গাল গড়িয়ে পড়ছেও কিন্তু নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে সে। তবুও ইমরানের কাছে স্পষ্ট সে কাদছে! তাই ইমরান বললো,
“কাঁদছো কেন তুমি? কেঁদো না। লাইফ তোমার, ডিসিশন তোমাকেই নিতে হবে। আর তুমিই নিবে। রাত বেড়ে যাচ্ছে। জেগে থেকো না আর। ঘুমানোর চেষ্টা করো। আল্লাহ হাফেজ।”
ইমরান সাথে সাথেই কল কেটে দিলো। নাফিসা নিশ্চিত, ইমরান কষ্ট পেয়েছে। কষ্ট পাওয়াটাই স্বাভাবিক! কিন্তু সে তো কষ্ট দেওয়ার জন্য বলেনি। তার ভেতরটা কেমন যেন অপ্রীতিকর বস্তু দ্বারা ভারি হয়ে আছে! যা থেকে মুক্তি পেতে বিষয়গুলো ইমরানকে বলতে বাধ্য হয়েছে! এতে কি মনটা একটু হালকা হয়েছে? কিন্তু ইমরান যে কষ্ট পেল! পাক। যদি সে নিজে স্বাভাবিক হয় তবে তাকেও মানিয়ে নিবে, এটাই ভেবে নিলো নাফিসা।
সকল ভাবনা নিশ্চিহ্ন করে এবার সে ঘুমাতে চাইছে। ঘরের আলো নিভে গেলেও চোখের পাতা যে নিভে যেতে চাইছে না!
নেই নিদ্রা নেই সুখ!
অচেনা এক স্বপ্নলোক,
গেছে ভেঙেচুরে!
বেদনার জল স্রোতে
ভাসিয়ে তারে আজ,
নিদ্রা খেয়েছে কুঁড়ে!